বেড়ী পর্ব-০৫

0
2074

#বেড়ী পর্বঃ৫
#লেখায়ঃপ্রজাপতি(Nosrat Monisha)

দুঃখটা আড়াল করে রাখতে হয় মুখে একটা সুখী হওয়ার মুখোশ পড়তে হয়। কখনো বাবা, কখনো ভাই, কখনো স্বামী, কখনোবা সন্তানের ইচ্ছেতে চলতে হয়। যতই স্বাধীন হওয়ার দাবি করো তুমি নারী তাই জন্মগতভাবেই বেড়ীতে বন্দি। তাই নিয়তিকে মেনে নেবে।

চোখ আর গালে ফাউন্ডেশন ঘষতে ঘষতে মায়ের এই কথাগুলোই ভাবছিলো হৃদিতা। তার মা বিয়ের ঠিক আগের দিন কেন এই কথাগুলো বলেছিলো এতোদিনে তা অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে পারছে হৃদিতা।
ফুল হাতা আর কলার জামায় শরীরের আঘাত আর ভারী মেকআপে মুখের নীল জমাট বাঁধা রক্তগুলো আড়াল হয়ে গেলো। ভাগ্যিস তখন আপুর জোর করে মেকআপ করা শিখেয়েছিলো; নাহলে আজ এই ভালো থাকার মুখোশ সে পড়তে পারতো না।

চার দেওয়ালের মধ্যে হৃদিতার জীবনে যতই ঝড় উঠুক সবটা সামলে প্রতিদিন ভোরে উঠে বাসি ঘর ঝাড় দিয়ে বাড়ির সবার জন্য চা বানাতেই হবে। নির্ঝর এখনো ঘুমোচ্ছে।
তার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হৃদিতা রান্নাঘরে চলে গেলো।

চা বানাতে বানাতে হৃদিতার নিজের তুবার কথা মনে পড়ে,
বছর তিন আগের কথা ইদের ছুটিতে হৃদিতারা সবাই মিলে মামার বাড়ি গিয়েছিলো। হৃদিতার মামাতো বোন তুবা শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছিলো। তুবার বিয়ের তখন বছর দুই চলে।
তুবা যেদিন এসেছিলো সেদিন রাতে হৃদিতা আর আদৃতা তুবার হাতে আর গলায় আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়। অনেক জোরাজোরির পর তুবা বলে তার স্বামী মেরেছে।

আদৃতা খেপে বলে,
-এসব দেখে আমি ভাবছি জীবনে বিয়েই করবো না।

হৃদিতা বলে,
-আমার জামাই আমার গায়ে হাত তুললে সেই সংসারের কপালে লাথি মেরে তাকে ছেড়ে দিবো। নাহয় উল্টা তারে ধরে পেটাবো, দরকার হলে তার হাত ভেঙে দিবো।

আদৃতা আর হৃদিতার কথা শুনে তুবা শুধু হেসে বলে,
-তোরা দুজন দুনিয়াটা যত সহজ ভাবছিস তত সহজ না। এখানে পঁচিশ বছরে কোন মেয়ের বিয়ে না হলে সমাজ তাকে বিষ নজরে দেখে। স্বামীকে পেটানো সেটা তো তোর আর আমার মতো মেয়ে পারবে না।
আর স্বামী সংসার ছাড়ার কথা বলছিস তাহলে তো হয়েই গেলো। এই সমাজ এমনকি তোর নিজের মা-বাবা তোকে একটা নরকের কীটের নজরে দেখবে। বিবাহিত মেয়েকে কেউ ঘরে বসিয়ে রাখতে চায় না। তোদের দুলাভাইয়ের হাতে প্রথম মার খেয়ে আমি এসেছিলাম বাপের বাড়ি। কিন্তু সবাই বিশেষ করে আম্মা-আব্বা আমাকে বোঝালো, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন একটু আধটু হয়। এসব সহ্য করেই সংসার করতে হয়৷

সেদিন তুবার কথা শুনতে হৃদিতার ভীষণ বিরক্ত লাগছিলো। আর মনে মনে বলছিলো,
-ধুর আমি এসব সহ্য করবো না। ঘোড়ার ডিমের সংসার। জামাই মারলে এমন সংসারের দরকার নাই। যার যা খুশি বলুক আমি অন্তত জামাইয়ের মাইর খাইয়া সংসার করবো না।

সেদিনের কথাগুলো মনে করে আজ হৃদিতার হাসি পেলো। সে ভাবে,
তুবা আপু কতো সত্যি বলেছিলো। বলা যত সহজ সংসার ছেড়ে যাওয়া তত সহজ না।


সকালে খাবার টেবিলে সবাই খাচ্ছিলো মুমু আর হৃদিতা বেড়ে দিচ্ছিলো তখন সরোয়ার আহমেদ বলে,
-গ্রামে জায়গা জমি নিয়ে কিছু ঝামেলা হচ্ছে তাই তোমাদের মা আর আমাকে যেতে হবে।

নিরব বলে,
-বাবা কখন যাবে? আর ফিরবে কবে?

-আজকেই দুপুরের পরে। কবে ফিরবো ঠিক নেই তবে জমি জায়গার ব্যাপার অন্তত চার-পাঁচ দিন লাগবে।

-ঠিক আছে বাবা আমি ড্রাইভারকে বলে দিবো। তোমাদের দিয়ে আসবে। ফেরার আগে বলো আবার গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।

নিরব খাবারের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তার মনমতো কোন খাবার নেই। তাই কিছু না খেয়ে উঠে দাঁড়ায়।

-কি রে নিরব, নাস্তা না করে কোথায় যাচ্ছিস?

নাফিসার এমন প্রশ্নে নিরব শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
-মা আমার আজকে ৮.৩০ ক্লাস আছে। তাছাড়া সকাল সকাল এসব তেল রুটি আমার গলা দিয়ে নামে না। আর চা তো খেয়েছিই। দুপুরের ক্যান্টিনে কুছু খেয়ে নিবো।

সারোয়ার আহমেদ একটু রেগে বলে,
-গলা দিয়ে খাবার নামে না মানে? একজন লেকচারার হয়ে খাবার সম্পর্কে এমন কথা বলছো কোন কান্ড জ্ঞান নেই?

-বাবা ছোটবেলা থেকে সকালে ভাত ছাড়া অন্য কিছু আমি খেতে পারি না। এতে যদি তোমার মনে হয় আমি কান্ড জ্ঞানহীন তবে তাই।
বলে নিরব বের হয়ে যায়।

-তোমার সকাল সকাল একটা ঝামেলা না করলে চলে না তাইতো? ছেলেটা আমার না খেয়ে চলে গেলো।

সেদ্ধ ডিমে কামড় দিতে দিতে নিরবের ছেট বোন সায়মা বলে,
-এ আর নতুন কি মা? যেদিন মুমু ভাবী রান্না করে নিরব ভাইয়া খেতে পারে না। কারণ সব খাবার উনি উনার দেবরের পছন্দের করে।

নির্ঝরের সায়মাকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
-সায়মা বিভেদ ইউরসেলফ।

সায়মা তাতে কোন পাত্তা না দিয়ে বলে,
-কি? আমাকে চোখ রাঙিয়ে লাভ নেই। আমি সত্য বলেছি। তোমার বিয়ের আগে করতো তখন মানা যেতো কারণ তখন নিরব ভাইয়া আর আমার খাবারটা মা দেখতো। কিন্তু এখন এ বাড়িতে একদিন মুমু ভাবী রান্না করে, আরেক দিন হৃদিতা। মা রান্না ঘরে কম যায়। হৃদিতা বাচ্চা মানুষ অত ভালো রান্না করতে পারে না। তবু প্রতিদিন সবার পছন্দের কিছু না কিছু করে। কিন্তু মুমু ভাবী শুধু তোমার পছন্দের রান্না।

মুমু একটু নাকি কান্না শুরু করে বলে,
-আমার ভুল হয়ে গেছে সায়মা। আমি এই রান্নাগুলো ভালো পারি তাই করি। তাছাড়া নতুন মাস্টার্স ভর্তি হয়েছি পড়ার চাপে তাড়াতাড়ি করে। আর ভুল হবে না এখন থেকে আমিও চেষ্টা করবো বায়ান্ন পদ রান্না করতে।

মুমুর নাকি অভিনয় সায়েমার কাছে বিরক্ত লাগলেও সারোয়ার আহমেদ গলে যায়। তিনি মেয়েকে ধমক দেয়,
-চুপ করো বেয়াদব কোথাকার। কি পেয়েছো কি? বড়দের সাথে কথা বলতে পারো না। নিজের ভাবীকে কেউ এভাবে অসম্মান করে? খাবার পছন্দ না হলে নিজে রান্না করে খাও।

সায়েমা চোখে মুখে বিরক্তি এনে বলে,
-রান্না করতে আমার কোন সমস্যা নেই। তবে
এ বাড়িতে তো দেখছি কাউকে কিছু বলাই যাবে না। আর ভাবী তোমাকে বায়ান্ন পদ রান্না করতে বলি নি। নিরব ভাইয়া সকালে ভাত ছাড়া কিছু খেতে পারে না। ভাতের সাথে একটা ডিম ভেজে দিলেও সে খেয়ে নেয়। আশা করি ডিম ভাজি আর ভাত তোমার এই পরটা, দুই পদের সবজি, সেমাই এসব থেকে রান্না করা সহজ। আমার তো মনে হয় তুমি এটাই জানো না নিরব ভাইয়া কি খেতে পারে আর কি খেতে পারে না। নাহলে আজ সবজিতে মাশরুম দিতে না। আমার তোমার জন্য দয়া হচ্ছে চার বছরে এটা জানলে না তোমার স্বামীর মাশরুমে এলার্জি আছে। নির্ঝর ভাইয়ার পছন্দ বলে..

টেবিলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আর নিজের মেয়েকে থামাতে নাফিসা বলে,
-যথেষ্ট হয়েছে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। সবাই চুপ।

বিরক্ত হয়ে সায়েমা বলে,
-আমি উঠছি। এখানে কিছু বলা দায়।

চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে সায়েমা নির্ঝরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-নির্ঝর ভাইয়া একটা কথা আরেকবার নিজের বউকে গরমে ফুল হাতা কলারওয়ালা জামা পড়তে বাধ্য করার আগে মনে রেখো তোমারও একটা বোন আছে, ভবিষ্যতে একটা মেয়েও হতে পারে। তোমার মতো হয়তো তাদেরও কেউ বাধ্য করবে।

নির্ঝর সায়েমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।
সায়েমা চলে যায়।


সকাল সকাল আদৃতাকে বের হতে দেখে শফিকুল ইসলাম জিজ্ঞেস করে,
-কোথায় যাওয়া হচ্ছে? শুনেছি সমস্যা সমাধান অব্দি অফিস যেতে নিষেধ করেছে।

-ঠিকই শুনেছো। আসলে আজ সাইবার ক্রাইমের জন্য একজন এক্সপার্ট আসবে তাই থানা থেকে ডেকেছে।

-ও, আমি ভাবলাম তুমি তারেকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছো।

-বাবা, আসছি।
আদৃতা কথা বাড়ায় না। কারণ তার মা-বাবা প্রতিদিন একটাই আশা করে মেয়ে আবার নিজের সংসারের ফিরে যাবে। কোন দোষ না থাকা সত্ত্বেও সবার কাছে মাফ চাইবে। স্বামীর কাছে সেই সংসারে থাকার ভিক্ষা চাইবে যেটা সে নিজ হাতে গড়েছিলো।



-সরি, চাঁদ।

– নামটা বিয়ের দিন রাতে আপনি আমাকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন,
তুমি জানো, আকাশে থাকা চাঁদে কলঙ্ক আছে কিন্তু আমার চাঁদ সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক।
কিন্তু আজ আপনি নিজেই আমার গায়ে কলঙ্ক ছিটানোর কাজ করছেন।

নির্ঝর হৃদিতাকে বাহুডোর বেঁধে বলে,
-বললাম তো সরি। আর হবে না। এবার একটু স্মাইল করো।

হৃদিতা না হেসে বলে,
-একটা কথা বলি? আর কখনো এরকম ফালতু জিনিস নিয়ে আমাকে অবিশ্বাস করবেন না। সেরকম হলে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন। আপনার কোন কিছু ভালো না লাগলে আমাকে সরাসরি বারণ করবেন আমি করবো না৷ কিন্তু আমাকে এভাবে মারবেন না আমার খুব কষ্ট হয়। আসলে ছোটবেলা থেকে এতো মার খাই নি তো।

-সরি বউ আর হবে না। মনে করে আরেকটা ওষুধ খেও। খুব লেগেছে তাই না?

-না আমি ঠিক আছি। এখন অফিসে যান আপনার দেরি হচ্ছে।

-যো হুকুম মহারাণী এখন একটু হাসো। তোমার হাসি মুখ না দেখে যে আমি ঘর থেকে বের হতে পারছি না।

হৃদিতা সকল দুঃখ চেপে একটা হাসি দিলো।

নির্ঝর হৃদিতার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো,
-আমার মিষ্টি বউ।


নাফিসা ব্যাগ গুছিয়ে রাখছিলো।
সারোয়ার আহমেদ পত্রিকা পড়তে পড়তে বলে,
-সায়েমাটা বড্ড বেশি বেয়াদব হয়ে গেছে।

-কেন? ও আবার কার পাকা ধানে মই দিলো।

-কেন তোমার চোখে পড়ে নি? আজ মুমুর সাথে কি ব্যবহারটাই না করলো।

নাফিসা স্বামীর কথায় বেশ বিরক্ত হয়ে বলে,
-শোন নাহিদের বাবা আমি মানছি সায়েমার কথা বলার ধরন ভুল ছিলো কিন্তু ওর কথাগুলো যুক্তি সঙ্গত ছিলো।

-মানে তুমি কি বলতে চাও?

-দেখো তোমার বন্ধুর মেয়ে বলে তুমি মুমুকে আলাদা নজরে দেখতেই পারো। তবে আমার কাছে আমার তিন ছেলের বউ এক রকম। তাই যেমন হৃদিতার দোষ আমার চোখে পড়ে তেমন মুমুর দোষও আমার চোখে পড়ে।

স্ত্রীর কথায় একটু রেগে গেলো সারোয়ার আহমেদ।
-কি যা-তা বলছো? মুমু আবার কি দোষ করলো?

-দেখো সব কথা বলে বোঝানো যায় না। তবে মুমু যে দোষী তা আমি নিরবকে দেখেই বুঝতে পারি। আমার হাসি-খুশি প্রাণবন্ত ছেলেটা এই চার বছরের কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে।

-আরে ও কিছু না। তোমার মনের ভুল। বাদ দাও। আচ্ছা তোমাকে কাল রাতে একটা কথা বলেছিলাম তুমি হৃদিতাকে কখন বলবে?

একটা বিরক্ত দেখিয়ে নাফিসা বলে,
-আমি পারবো না বলতে। দেখো হৃদিতা এখনো ছোট, ওর এখনো বাচ্চা নেওয়ার সময় হয় নি।

-সময় হয়নি বলে বলে আমার বড় ছেলেটা বিয়ের সাত বছর পর এখনো নিঃসন্তান। তুমি না বলতে পারলে আমি বলি।

-দেখো নাহিদের কথা এখানে টেনো না। আর তোমার যদি এতো নাতি-নাতনীর মুখ দেখার শখ হয় আমি না হয় মুমুকে বলছি। ওদের বিয়ের অনেক দিন হয়েছে।

-না ওর সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে হবে না।

-কেন?

-কেন আবার কি আমি আমার বন্ধুকে কথা দিয়েছিলাম মুমুর মাস্টার্স হওয়া অব্দি তার উপর কোন চাপ দিবো না।

-কথাতো তুমি হৃদিতার বাবাকেও দিয়েছিলে।

-শোন মুমু আর হৃদিতা এক না। হৃদিতা একটা বাজে পরিবারের মেয়ে। তাই ওকে যত দ্রুত সম্ভব সংসারে বাঁধতে হবে বলা যায় না কখন কি করে বসে। পরে আমার মান-সম্মান ডুববে। তাই এখন ওদের বাচ্চা হওয়াটা জরুরি।

-আল্লাহকে কিছুতো ভয় করো নাহিদের বাবা।
তোমার এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহারের জন্য নাহিদ আজ বউ নিয়ে আলাদা। এখন হৃদিতার সাথে শুরু করেছো৷ তবে তখনকার মতো আমি আর বোকা নেই। গ্রাম থেকে ঘুরে আসি সব ঠিক করবো।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মুমু সব শুনছিলো।
সে শুধু মুচকি হেসে মনে মনে বলে,
-যান যান ঘুরে আসুন। আমি এমন প্ল্যান করেছি যা আপনি ভাবতেও পারবেন না। শ্বাশুড়ি মা আপনি ঘুরে আসতে আসতে হৃদিতার সংসার ভেঙে যাবে। আর হৃদিতার বাচ্চা সোতো আমি এ বাড়িতে থাকতে হবে না।

-চলবে?