বেড়ী পর্ব-০৬

0
2172

#বেড়ী পর্বঃ৬
#লেখায়ঃপ্রজাপতি(Nosrat Monisha)

-ভিডিওটা ফেক। আপনার স্ত্রী যা ধারণা করেছেন তাই। ঐ ভিডির কোথাও তিনি নেই। তবে এতো সুন্দর করে এই অকাজটা আসামী করেছে যে আসল মনে হয়েছে। আর ম্যাডাম আপনি সত্যি অনেক সাহসী। অভিনন্দন আপনি লড়াইটা জিতে গেছেন।

আদৃতা জানতে চায়,
-কেন এটা করেছে কিছু বলেছে?

-প্রাথমিক জিজ্ঞেসাবাদে শুধু এটা বলেছে আপনার স্বামীর উপর প্রতিশোধ নিতে সে এই কাজটি করেছে। তবে আপনার কথা বলুন যদি আরও কিছু বলে।
থানার ইনচার্জ খুব সহজেই কথাটা বলে।

আসামীর স্থানে বসে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে আদৃতা কিংবা তার স্বামী তারেক কারও মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।

নিজেকে বহু কষ্টে সামলে তারেক তার সামনে গিয়ে জিনিস করে,
-রাফিন এটা সত্যি তুই? চাচা অসুস্থ হওয়ার পর তোদের সংসারের সমস্ত খরচ আমি উঠিয়েছি। সেই উপকারের এই প্রতিদান? আর আদৃতা সে তো তোকে নিজের ভাই মনে করতো ।

হিংস্র চোখে বিশ বছর বয়সী যুবকটা তারেকের দিকে তাকায়। তারেক অবাক হয়ে যায় এতো বড়ো অপরাধ করেও মানুষের চোখ কি করে অনুশোচনা থাকে না।
গম গম করে উঠে রাফিনের গলা,
-আমি তাকে নিজের বোন বলে মনে করি না। আমার বোন একজনই রিমি। যাকে তুই আর তোর মা মিলে মেরে ফেলেছিস। তোর মা বিয়েতে রাজি হয় নি। বলেছিলো, আমার বোনের চরিত্র খারাপ তোর জন্য ভালো মেয়ে আনবে। তাই তোর ভালো বউকে সবার চোখে আমি খারাপ বানিয়ে দিলাম।

আদৃতা ধীর পায়ে রাফিনের কাছে গেলো। রাফিন খুব বিচ্ছিরি একটা হাসি দিলো। আদৃতা খুব শান্ত গলায় বলে,
-এতে তুমি শান্তি পেয়েছো তো?

-অনেক। যেদিন খবর পেলাম তুমি ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছো আমি মসজিদে মিষ্টি দিয়েছিলাম।

-ভেবেছিলাম যেদিন অপরাধীকে খুঁজে পাবো তাকে ইচ্ছে মতো থাপ্পড় দিবো কিন্তু তোমাকে দেখে দয়া হচ্ছে। কি পেলে আমার সংসার ভেঙে আমাকে বদনাম করে?

দাঁত বের করে রাফিন বলে,
-শান্তি পেয়েছি। আমার বোনের আত্মা শান্তি পেয়েছে।

আদৃতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
-তুমি স্বাভাবিক নেই।
আমি জানি না এতে তোমার আপুর আত্মা শান্তি পাবে কিনা বা তুমি কতটুকু শান্তি পেয়েছো। তবে এটা বলতে পারি তুমি তোমার সহায় সম্বলহীন মা-বাবার আশা ভরসাকে নিজ হাতে গলা টিপে মেরেছো আর সাথে সাথে নিজের ভবিষ্যৎকেও। আমার তোমার উপর দয়া হলেও আমি এতটা উদার নই যে তোমাকে ছেড়ে দিবো। আমার জীবনটা তুমি দুর্বিষহ করে তুলেছো। যেখানে যতদূর যেতে হয় যাবো কিন্তু তোমার যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি হয় তা দেখবো।

থানা থেকে চলে যাওয়ার আগে আদৃতা রাফিনকে বলে,
-কিছু বছর আগে তোমার একবোন মারা গিয়েছিলো তার সাথে ন্যায় করতে গিয়ে আজ তুমি আরেক বোনকে হারালে।

আদৃতা তারেকের সাথে কোন প্রকার কথা বলে না।



নির্ঝরের অফিসের কাজে মন বসছে না। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে।
তাই ভাবলো আজকে হৃদিতার জন্য একটা শাড়ি নিয়ে যাবে। খুশি হয়ে যাবে মেয়েটা। এখনো মনে আছে প্রথম যেদিন বেগুনি রঙের শাড়ি আর কাঁচের চুড়ি এনে দিয়েছিলো খুশিতে বাড়ির সবাইকে দেখিয়েছিলো। অবশ্য নির্ঝরের মা বকাও দিয়েছিলো বলেছিলো, “স্বামীর দেওয়া উপহার কাউকে দেখাতে নেই হিংসুটেদের কুনজর লাগে। ”
তবুও সে বাপের বাড়ি ফোন করে আনন্দে প্রায় কেঁদে দিয়েছিলো।
তার কান্না দেখে নির্ঝর অবাক হয়ে গিয়েছিলো এই ভেবে হৃদিতার চাহিদা এতো কম কিভাবে হয়?


আদৃতা বাড়ি ফিরে এসেছে। আজ সে প্রমাণ নিয়ে এসেছে নির্দোষ হওয়ার। আজ সাহস করে বাবা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কাগজ হাতে দিয়ে বলে,
-আমি কোন অন্যায় করি নি। এই তার প্রমাণ।
ভেবেছিলাম পুরো পৃথিবী আমাকে ভুল বুঝবে কিন্তু আমার মা-বাবা আমাকে আগলে রাখবে। আমার ভুল ভেঙে গেছে। একটা কথা বুঝতে পেরেছি, জীবনটা যেহেতু আমার সেহেতু লড়াইও একা আমার।

আদৃতা ঝর্ণার নিচে গিয়ে পানি ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মনে হচ্ছে চোখের পানির সাথে এতদিন পর শরীর থেকে সব কালি ধুয়ে যাচ্ছে। মনে হয় এতদিনে মানুষের বলা সব কথাগুলো তার গায়ে লাগছে আর তাই সেগুলো মনে করে মাঝে মধ্যেই চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠছে।

আদৃতার মা অনেকক্ষণ দরজার ধাক্কায় কিন্তু আদৃতা খুলে না।

তখন আদৃতার বাবা শফিকুল এসে স্ত্রীকে বলে,
-ওকে একটু একা থাকতে দাও। এতদিনের লড়াইয়ে সে ক্লান্ত।


এদিকে নির্ঝরের মা-বাবা গ্রামে যেতে পারে না। কারণ অপর পক্ষ শালিসের তারিখ পিছিয়ে নিয়েছে।
তাই বিকেলে মাকে বাড়িতে দেখে বেশ অবাক হয় নির্ঝর। পরে পুরো ঘটনা শুনে।

নির্ঝরের হাতে গিফটের প্যাকেট দেখে মুমু জিজ্ঞেস করে,
-কি আছে?

-তেমন কিছু না হৃদিতার পছন্দের কিছু।
লজ্জা পেয়ে নির্ঝর বলে।

-বাব্বা বউয়ের জন্য গিফট কেনা হচ্ছে। তোমার বউ অনেক লাকি বুঝলে? নাহলে তোমার ভাইয়াতো আমার জন্য এমন কিছু করে না।

এই কথা শুনে নির্ঝরের মা নাফিসা প্রচন্ড খেপে যায়। আসলে তিনি ওত পেতে বসেছিলো মুমুকে টাইট দিবে বলে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলেন না। এখন নিরবও নেই আবার সরোয়ার আহমেদও বাসায় নেই তাই বলা শুরু করলো৷
– তুমি তোমার স্বামীকে সুখী রাখতে না পারলে কারও তো কিছু করার নেই মুমু। বিয়ের প্রথম ছয়মাস তো পড়ালেখার বাহানা করে বাপের বাড়ি ছিলে। সেখানে নিরব গেলে তাকে নানান জন নানান কথা বলতো। এর পরে এখানে এসে এমন কাহিনি করলে যে আমার নাহিদ বাধ্য হয়ে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেলো। আমি নিজে দেখেছি নিরব যখন তোমাকে বাইরে নিয়ে যেতে বলতো তুমি বাহানা করতে। কোন কিছু এনে দিলে আলমারির কোণায় ফেলে রাখতে। আরে সোজা মুখে তো আমার ছেলের সাথে কথা অব্দি বলো না।

মুমু শ্বাশুড়ির কথায় হাঁ হয়ে যায়। এ বাড়িতে কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলবে তা মুমুর কল্পনাতীত। তাই মুখ ভার করে বলে,
-মা আপনি বলতে চাইছেন আমি আপনার ছেলেকে অবহেলা করি?

-আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। আর না আমি তোমার শ্বশুরের মতো স্নেহে অন্ধ। তাই তোমার গুণের পাশাপাশি দোষও আমার চোখে পড়ে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তুমি আমার ছেলেকে কতটা অবহেলা করো।

নির্ঝর মধ্যস্থতা করতে যায়,
-আহ মা! হচ্ছেটা কি চুপ করো না।

নাফিসা নির্ঝরকে ধমকে বলে,
-তুই চুপ থাক। আমি নিরবের বউয়ের সাথে কথা বলছি। ওর হয়ে কথা বলার তুই কে? কখনো তো বড় ভাবীর হয়ে কথা বলতে শুনি নি। তবে সবসময় মুমুর হয়ে কেন এতো ওকালতি করিস? শোন স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, মনে রাখবি ভাবীদের ব্যাপারে তোর নাক গলানো আজ থেকে বন্ধ। যখন তোর বউকে বকবো তখন তার হয়ে ওকালতি করতে আসবি। যা গিফট নিয়ে এসেছিস বউকে দে গিয়ে। আজ মনে হয় মেয়েটার শরীর খারাপ দুপুরের পর ঘর থেকে বের হয় নি।

নির্ঝর কথা না বাড়িয়ে ঘরের দিকে যায়। কারণ মা যা খেপেছে এখন কারও কথা শুনবে না।

নাফিসা আবার শুরু করে,
-মুমু তুমি অন্য কিছু হিসেবে কেমন আমি জানি না তবে স্ত্রী হিসেবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। যে স্ত্রী নিরবের মতো ছেলের সাথে সুখী থাকতে পারেনা সে ব্যর্থ। তোমার চেয়ে তো ঐ বাচ্চা মেয়েটা মানে হৃদিতা ভালো। হ্যাঁ হয়তো সে ঘরের কাজ জানে না, রান্না ভালো পারে না, সবার সাথে ঠিকমতো মিশতে পারে না কিন্তু তাও নিজের স্বামীকে নিয়ে সুখে আছে। আর তুমি…

নাফিসা কথা পূর্ণ করার আগেই নির্ঝরের গলা শুনা যায়। সে হৃদিতার নাম ধরে চিৎকার করছে।

নাফিসা আর মুমু দৌড়ে সেদিকে যায়।


আদৃতার স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি সবাই এসেছে মাফ চেয়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।

আদৃতার তাদের সামনে না গিয়ে ঘরে চুপচাপ বসে আছে।
আদৃতার মা মার্জিয়া ঘরে গিয়ে মেয়ের পাশে বসেছে।

আদৃতা কাটা কাটা গলায় বলে,
-আমি জানি তুমি কি বলবে। কিন্তু বিশ্বাস করে এতে আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। আমি ফিরে যাবো না।

মার্জিয়া গলা ভারী করে বলতে শুরু করে,
-ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছো তাই দিয়েছি। অনেক বড় ঝড় এসেছে তোমার জীবনে। সেটা সামলে উঠেছো। জানি আমাদের সবার তোমার পাশে থাকা উচিত ছিলো, তোমার উপর বিশ্বাস রাখা উচিত ছিলো কিন্তু আমরা সেটা পারি নি। সব কিছু একটা দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যাও। আবার নতুন করে শুরু করো।

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আদৃতা বলে,
-কি ভুলে যাবো? ঐ বাড়িতে সবার করা অপমান?
অফিস, কিংবা রাস্তা-ঘাটে মানুষের আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া ঐ প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি। ঐ দৃষ্টিতে লুকানো আমার ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট? চলো ঠিক আছে সব ভুলে গেলাম। কিন্তু কি বলো তো মা! আমি দুনিয়ার সব ভুলে সবাইকে মাফ করতে পারবো শুধু তিনজনকে ছাড়া। তুমি, বাবা আর তারেক। আমার শ্বশুর বাড়ি মানুষ পর ছিলো, রাস্তা কিংবা অফিসের সবাই পর ছিলো। কিন্তু যাকে বিশ্বাস করে ঘর ছেড়ে ছিলাম সে কিংবা তোমার দুজন তো আমার আপন ছিলে। বলো ছিলে না?
তাহলে কেন এমন করলে? সত্যি কথা বলি?
তারেক যখন সবার সামনে গায়ে হাত তুলে খাঁটি বাংলা গালি দিয়েছিলো বিশ্বাস করো তখনই তার সাথে আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আর তোমরা যেদিন আমাকে অবিশ্বাস করে ঐ ভিডিওটা বিশ্বাস করেছিলে তখন পৃথিবীতে আমি এতিম হয়ে গিয়েছিলাম।

-না সোনা মেয়ে লক্ষী মেয়ে এমন করে বলে না। মা কে মাফ করে দাও।

-আর আমাকেও।
বলে তারেক হাঁটু গেড়ে আদৃতার সামনে বসে বলে,
-আমি জানি তোমার ক্ষমা পাওয়ার কোন যোগ্যতা আমার নেই তবুও প্লিজ আরেকটা সুযোগ দাও।

-চলবে?