বেড়ী পর্ব-০৭

0
1298

#বেড়ী পর্বঃ৭
#লেখায়ঃপ্রজাপতি(Nosrat Monisha)

-তোর মতো সন্তান পেটে ধরে পাপ করেছি আমি। এই তোর শিক্ষা? নিজের স্ত্রীকে মারধর করিস?
নাফিসার কথাগুলো নির্ঝরের গায়ে কাঁটার মতো বিঁধলেও মায়ের সামনে মুখ খোলার সাহস তার নেই।
বাসায় জ্ঞান ফেরাতে না পেরে বাধ্য হয়ে হৃদিতাকে নিয়ে হাসপাতালে আসে নির্ঝর। সাথে আসে নাফিসা , মুমু আর সায়মা।
ডাক্তার পরীক্ষা করে বুঝতে পারে অতিরিক্ত মারধোর আর অভুক্ত থাকার জন্য জ্বর এসেছে। তাছাড়া এই বয়সে বেশিরভাগ মেয়েরা রক্তশূন্যতায় ভুগে। হৃদিতাও তাই আর সে জন্য অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। ডাক্তার স্যালাইন দিয়ে কিছু টেস্ট দিয়েছে আর বলেছে ঘন্টা তিন পর বাড়ি যেতে পারবে।

নাফিসা ডাক্তারের সামনে কিছু না বললেও তিনি চলে গেলে নিজের ছেলের উপর ক্ষোভে ফেটে পরে। এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার শিক্ষাতো তিনি কোন ছেলেকে দেয় নি। তাই তিনি নির্ঝরকে হৃদিতার সাথে দেখা করতে বাধা দেয়।

নাফিসার কথাকে কাটাতে চেষ্টা করে মুমু,
-মা আপনি শুধু শুধু নির্ঝরকে বকছেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন একটু আধটু হয়েই থাকে। আর দোষতো হৃদিতারও রাগ করে না খেয়ে কি কান্ড ঘটালো। সব কিছুতে বাড়াবাড়ি।

নাফিসার রাগ চরম সীমানায় পৌঁছে যায়।
-মুমু তুমি যদি আরেকবার নির্ঝরের সাফাই গাও তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। লজ্জা নেই তোমার তাই না? কাকে শেখাচ্ছো স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলা? আমি আজ ছত্রিশ বছর সংসার করি তাই আমাকে শেখাতে আসবে না। তাছাড়া তোমরা দুজন আছো কেন? যাও না বাড়ি যাও।

মুমু শাশুড়ির হৃদিতার প্রতি দরদ দেখে বিরক্ত হয়। তাই সে চুপ হয়ে যায়।

কিন্তু নির্ঝর মাফ চেয়ে বলে,
-মা আমি জানি আমি ভুল করেছি কিন্তু বিশ্বাস করো আমি বুঝতে পারি নি। আমাকে ওর সাথে দেখা করতে দাও।

-নির্ঝর আমি অন্যায় হলে নিজের বাপকে মাফ করি নি সেখানে তোমাকে ছাড় দিবো কখনোই না। তবে অন্যায়টা যেহেতু আমার সাথে না করে হৃদিতার সাথে করেছো তাই সেই সিদ্ধান্ত নিবে। তবে এখন না সে সম্পূর্ণ সুস্থ হলে। সায়মা কালকে সকালে এখানে এসে রিপোর্ট নিয়ে যাবে।

নির্ঝর থতমত খেয়ে বলে,
-মা সায়মা কেন? আমি নিয়ে আসবো।

-না তোমাকে আসতে হবে না। হৃদিতা সুস্থ হলে সবার সামনে বলবে তোমার অন্যায়ের জন্য সে তোমাকে ক্ষমা করেছে কি-না। যদি ক্ষমা করে তবেই তুমি তার সব কাজ করতে পারবে। আমি সায়েমাকে বলে দিয়েছি আজ থেকে হৃদিতা সায়েমার ঘরে থাকবে।

– কিন্তু মা..

-আমি আর কিছু শুনবো না এখানে অপেক্ষা করো আমি বিল চুকিয়ে আসছি।

নির্ঝর আর মুমু নাফিসার ব্যবহারে অবাক হলো না কারণ তারা দুজনেই জানে নাফিসার মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধটা একটু বেশিই। তারা এটাও জানে এ ক্ষেত্রে সে কারও পরোয়া করে না।


-বিয়ে মানে কি তারেক? মেনে নেওয়া না মানিয়ে নেওয়া? তোমার কাছে দুটো এক কিন্তু আমার কাছে নয়। আজ আমি তোমাকে বলছি দুটোর মধ্যে তফাতটা কোথায়।
তারেক বিয়ের পর তুমি বলেছো তুমি আমাকে বড় ঘর দিতে পারবে না গাড়ি দিতে পারবে না আমি মানিয়ে নিয়েছি। তুমি বলেছো তোমার মায়ের সব কাজ করে অফিস যেতে হবে আমি মানিয়ে নিয়েছি। নিজের বেতন থেকে কাজের লোক রেখেছি, শপিং করেছি তোমার মেইল ইগো হার্ট হয়েছে। তাই আমাকে প্রতিদিন কথা শুনিয়েছো চাকুরি করে সংসার উচ্ছনে দিচ্ছি সেটা মেনে নিয়েছি। সবার জন্য ইদে রান্না করতে গিয়ে নিজে তৈরি হতে সময় পাই নি মানিয়ে নিয়েছি। এতে মেহমান আর বাড়ির সবার সামনে তোমার নাক কেটে গেছে বলে আমাকে অকর্মার ঢেঁকি বলে অপমান করেছো এটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে তুমি আমার গায়ে যেভাবে কাদা ছুড়েছো তা আমি না মানতে পারবো না মানিয়ে নিতে। তাই আমাকে মাফ করো। আমার মা-বাবা কিংবা আমাকে তুমি সম্মান না দিলেও তোমাকে আর আর তোমার পরিবারের সবাইকে এতকিছুর পরও আমি যথেষ্ট সম্মান করি। তাই উল্টো পাল্টা কিছু বলার আগে উনাদের নিয়ে চলে যাও।
আদৃতা একরকম তার স্বামীকে নিজের ঘর থেকে বের করে দেয়।

রাতে শফিকুল নিজের মেয়েকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করছে কিন্তু লাভ হয় নি।
-বাবা ছোট থকে আমি একটু জেদি। তাই আমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। বরং আমাকে যদি তুমি এভাবে জোর করো তবে আমি এখান থেকেও চলে যাবো।


সবাই হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে।
সরোয়ার আহমেদ সবাইকে আদৃতার নির্দোষ হওয়ার খবর জানায়।
এবার নির্ঝরের আরো অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। মুমু শুধু জ্বলতে থাকে এই ভেবে যে, এতো কিছু করেও নির্ঝরকে হৃদিতার কাছ থেকে সরাতে পারে নি।
তাই আদৃতার নির্দোষ হওয়ার খবরে সে প্রতিবাদ করে বলে,
-বাবা টাকা পয়সা হলে কত কি-না হয়। দেখুন পুলিশকে হয়তো টাকা খাইয়ে এসব রিপোর্ট তৈরি করে একটা গরীব ছেলেকে ফাঁসাচ্ছে। তাছাড়া এই খবরটা সত্য হলে নিশ্চয়ই একইভাবে ছড়িয়ে পড়তো।

সায়েমাও সাথে সাথে প্রতিবাদ করে,
-মাই ডিয়ার ভাবী তোমার মুখে কি ছোটবেলায় কেউ নিমফুলের মধু দিয়েছিলো? না মানে যখনই মুখ খোল এমন কিছু বলো সবার মন বিষিয়ে যায়। শোন আমাদের সমাজ খারাপ খবরকে যতটা গুরুত্ব দেয় ভালো খবরকে ততটা দেয় না। তাইতো এখানে যারা অসভ্য অঙ্গভঙ্গি কিংবা গালি-গালাজ করে তারা ইন্টারনেটে তাড়াতাড়ি ভাইরাল হয় । কিন্তু সত্যিকারে ভালো পারফর্মারদের ফ্যান-ফলোয়ার তৈরি হতে কিংবা তাদের ভিডিও ভাইরাল হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। সেইজন্য আদৃতা আপুর ফেক ভিডিও তাড়াতাড়ি ভাইরাল হলেও তার নিরপরাধ হওয়ার খবর ভাইরাল হয় নি। সোজা হিসাব।

সবাই সায়েমার কথায় সায় দেয় এমনকি সারোয়ার আহমেদও।
-সায়েমা ঠিক বলেছে। আমারও সেরকমই মনে হয়।

সায়েমা সেসব পাত্তা না দিয়ে বলে,
-আর তাছাড়া মুমু ভাবী তুমি কি ভাবো সব সরকারি কর্মকর্তা ঘুষ খায়? নিজের মাইন্ডটা চেঞ্জ করো। সবাইকে নিজের বাবার মতো ভেবো না।

এই কথা শুনে মুমু তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে,
-কি বললে আমার বাবা ঘুষ খায়?

সায়েমা একটু হেসে বলে,
-বুদ্ধিমানের জন্য ইশারা যথেষ্ট।

-অনেক হয়েছে সায়েমা তুমি যখন তখন আমাকে অপমান করবে আমি মনে নিবো না। আমি এক্ষুনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।

সারোয়ার আহমেদ মেয়েকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলে,
-তুমি ভবিষ্যতে মুমুর সাথে এভাবে কথা বলবে না। আর মুমু কথায় কথায় কেউ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো কেন? মনে রাখবে এ বাড়িতে তোমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া কাল বাড়িতে গেস্ট আসবে।

সবাই জানতে চায় কে আসবে? জবাবে সরোয়ার আহমেদ বলে,
– আমি হৃদিতার বাপের বাড়ির সবার কাছে ক্ষমা চাপয়া উচিত। তাই তাদের দাওয়াত করেছি। নাহিদও তার স্ত্রীকে নিয়ে আসবে। তা তোমার মা কোথায়?

-আমার ঘরে হৃদিতাকে খাওয়াচ্ছে।

সায়েমার কথা শুনে বিরক্ত হয়ে ঘরে চলে যায় সারোয়ার।
আর যাওয়ার সময় মনে মনে ভাবে,
-এটা খুব বাড়াবাড়ি করছে নাফিসা। ছেলের বউকে মাথায় তুলছে। আচ্ছা যতটুকু করার ততটুকু করুক, কে না করেছে? নাহয় নির্ঝর একটা অন্যায় করেছে তাই বলে ব্যাপারটাকে এতো জটিল করার কি আছে? আরে স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার তারা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিবে। তা না ছেলেকে এক ঘরে করে রেখেছে, ছেলের বউকে মাথায় তুলছে পরের বাড়ির মেয়ের জন্য।


নাফিসা দুচোখ ভরে নিজের ভরা সংসার দেখছে।
তিন ছেলে তাদের বউয়ের সাথে। এখন তার একটাই দায়িত্ব বাকি মেয়ের বিয়ে। পাত্র দেখা তিনি ইতিমধ্যে শুরু করেছে শুধু মনের মতো খুঁজে পেলেই হলো।

এদিকে মুমু না চাইতেও বার বার নির্ঝরের দিকে তাকাচ্ছে। নীল পাঞ্জাবিতে কি মোহময় লাগছে নির্ঝরকে। তারা তিন ভাইই দেখতে ভালো।

তবে নির্ঝরকে আল্লাহ নিঁখুত করে বানিয়েছেন। যেমন চেহারা তেমন শারীরিক গঠন। না বেশি ফর্সা না একদম শ্যামলা একদম যথোপযুক্ত গায়ের রং। তার উপর নির্ঝরের টানা চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঘন চুলের সাথে চাপ দাঁড়ি আর তার সাথে ভুবন ভুলানো বাঁকা ঠোঁটের হাসিতো আছেই। মুমু আজ বাড়িতে ভিড়ের সুযোগ নিয়ে বার বার নির্ঝরের পাশ ঘেঁষে দাড়াচ্ছে আর নির্ঝরের গা থেকে বের হওয়া আতরের সুবাসে নিজের হৃদয়ের নিষিদ্ধ চাওয়াকে শান্ত করছে।

এদিকে নির্ঝরের মন বড় অশান্ত। কাল থেকে হৃদিতার পাশে ঘেঁষতে পারে নি। সকালে সবার সামনে মাফ চাইলে হৃদিতা বলেছে মাফ করেছে তবু কেন জানিনা নির্ঝর বুঝতে পারে হৃদিতা মন থেকে মাফ করে নি।
নির্ঝরের বার বার মনে হচ্ছে তার চাঁদ তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে । তাকে ভয় পাচ্ছে, সব প্রশ্নের শুধু হ্যাঁ না তে জবাব দিচ্ছে। আর বাপের বাড়ির লোকদের পেয়েতো তাকে ভুলেই গেছে।

আজ সে হৃদিতার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে নীল পাঞ্জাবি পড়েছে। এটা হৃদিতাই কিনে এনেছিলো। সেদিন হৃদিতা নির্ঝরকে নিজের একটা ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলো। হৃদিতা বলেছিলো, সে নীল শাড়ি পড়ে নির্ঝরের হাত ধরে নীল সমুদ্রে হাঁটতে চায়। নির্ঝর হৃদিতার কথা শুনে হেসে বলেছিলো তার সব আশা পূর্ণ করবে। সব ব্যবস্থাও হয়েছিল কিন্তু মুমু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় যাওয়া বাতিল হয়। এরপর নির্ঝর ছুটি পায় নি। তবে এবার যে করেই হোক যাবে।

সবাই বসেছিলো তখন সায়েমা হৃদিতার রিপোর্ট হাতে নিয়ে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাড়ি আসে ।

সে কিছুটা নাটকীয় ভাবে বলে, হৃদিতা মা হতে চলেছে।

খুশিতে সবাই আত্মহারা হয়ে যায়।

নির্ঝর গিয়ে সায়েমাকে জিজ্ঞেস করে,
-তুই মজা করছিস তাই না?

-তোমার কি মনে হয় আমি এমন একটা বিষয়ে মজা করবো? ভাইয়া তুমি বাবা হতে যাচ্ছো। তুমি জানো ডাক্তারকে হাজার বার জিজ্ঞেস করেছি। উনিতো কালকেই ধারণা করেছিলো তাই এতো টেস্ট নিশ্চিত না হয়ে আমাদের কিছু বলে নি। এই দেখো রিপোর্ট।

নির্ঝর রিপোর্টগুলো বার বার দেখতে থাকে।
এদিকে মার্জিয়া আর নাফিসা হৃদিতাকে চুমো খাওয়া শুরু করে।
সারোয়ার আহমেদ সাথে সাথে ঘর থেকে তার মায়ের স্বর্ণের চেইন এনে হৃদিতার গলায় পড়িয়ে দেয়।

এদিকে মুমু নির্ঝরের শান্ত অবস্থা দেখে রাগে কটমট করতে থাকে। আর ভাবে এত প্ল্যানিংয়ের পরও নির্ঝর চুপ তারমানে সে বাচ্চাটাকে মেনে নিয়েছে। তার সব পরিকল্পনা বিফলে গেছে।

আর হৃদিতার বড় জা মানে নাহিদের স্ত্রী সম্পা সবার জন্য মিষ্টি আনে।
সবাইর আগে বাচ্চার মা-বাবার মিষ্টিমুখ করাবে বলে হৃদিতা আর নির্ঝরকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিকে মিষ্টির প্লেট বাড়িয়ে বলে,
-নাও শুরুটা তোমরা করো। বাচ্চার সব কিছুর উপর সবার আসে তার মা-বাবার হক।

এতক্ষণ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকলেও নির্ঝর আর সহ্য করতে পারে না। যাকে ভালবাসলো সেই তাকে ঠকালো?
রাগে কষ্টে মিষ্টির প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে রিপোর্টগুলো হৃদিতার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে,
-চরিত্রহীনা নষ্টা মেয়ে কোথাকার বল এই বাচ্চা কার? কার পাপ আমার উপর চাপাতে চাইছিস?

-চলবে?