বেড়ী পর্ব-০৯

0
2763

#বেড়ী পর্বঃ৯
#লেখায়ঃপ্রজাপতি(Nosrat Monisha)

-নিজে সংসার করতে পারিস নি তাই আমার সংসারটাও ভাঙতে চাইছিস? নির্ঝরকে কেন এসব বললি?
হৃদিতার কথায় আদৃতার মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না বরং সে হৃদিতাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে বলে,
-তোর যত ইচ্ছা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার কর আমি তোকে ভুল বুঝবো না।

হৃদিতা হঠাৎ বোনকে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। এমন গগণ বিদারী চিৎকার যে কারও কলিজা কাঁপানোর জন্য যথেষ্ট। মেয়ের চিৎকার শুনে শফিকুল আর মার্জিয়া দৌড়ে এসে দেখে হৃদিতা আদৃতাকে জড়িয়ে কাঁদছে। শফিকুল সহ্য করতে পারে না। সবার সামনে যদি কেঁদে ফেলে তাই তড়িঘড়ি নিজের ঘরে চলে যায়।

হৃদিতা বোনকে সামলাতে গিয়ে নিজেও কেঁদে দেয়। ছোটবেলা থেকে আদৃতার সব আবদার তার মায়ের কাছে আর হৃদিতার আবদার তার বোনের কাছে। আদৃতা আর হৃদিতার সম্পর্ক যেন বোনের নয় মা-মেয়ের।
নিজের কলিজার টুকরো মেয়েদের এমন হাল মার্জিয়া আর সহ্য করতে পারে না তাই সেও চলে যায়।

কিছুক্ষণ পর হৃদিতা শান্ত হয়ে পড়ে। তারপর আস্তে আস্তে বলে,
-আপু বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু করি নি।

মাথায় হাত বুলিয়ে আদৃতা বলে,
-আমাকে বলতে হবে না আমি জানি আমার বোন কেমন।

কান্না করতে করতে হিচকি তুলতে তুলতে হৃদিতা বলে,
-সেটাতো নির্ঝরও জানে তার স্ত্রী কেমন । সে তো জানে আমি…
তাহলে আমাকে কেন বিশ্বাস করছে না?কেন আমাকে তাড়িয়ে দিলো?

আদৃতা দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-কিছু কিছু পুরুষের অন্তরে এই অবিশ্বাস বীজ আগে থেকেই বপন করা থাকে। আমাদের ভাগ্য খারাপ দুজনের কপালেই আল্লাহ এমন সন্দেহ প্রবণ পুরুষ লিখেছেন।

-কিন্তু আপু আমি যে নির্ঝরকে বড্ড ভালবাসি। তাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো?

-সময় সবকিছু শিখিয়ে দেয়। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।


নির্ঝর ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকালো। তার মনে হলো হৃদিতা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে বিছানার পাশে থাকা মগটা ছুড়ে আয়নাটা ভেঙে দেয়। আয়নাটা টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
-কেন করলে আমার সাথে এমন? চলে যাও। ও যাবেনা তাইতো? আমার দুরবস্থার মজা দেখতে চাও? ঠিক আছে থাকো তুমি এখানে আমিই চলে যাচ্ছি।

ভাঙা টুকরোগুলো মাড়িয়ে বারান্দায় চলে যায়।
রাতের গভীরতার সাথে সাথে নির্ঝরের একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতাও গভীর হতে থাকে।
একটার পর একটা সিগারেট শেষ করতে থাকে।
এদিকে কাঁচের টুকরো বিঁধে যে তা পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে সেদিকে তার কোন খেয়ালই নেই।


সকালে নির্ঝরের কোন সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ঘরে আসে সবাই। পুরো ঘরের জিনিস ভাঙা কাঁচ ছড়ানো চারদিকে রক্ত দেখে সবাই ভয় পায়। তারপর নির্ঝরকে বারান্দায় অজ্ঞান পড়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দেয়।

ছেলে বউয়ের শোকে আধমরা হয়ে গেছে এমন খবর চারদিকে ছড়াতে পারে তাই ডাক্তারকে বাড়িতেই ডেকে নেয় সারোয়ার আহমেদ। ডাক্তার এসে ঘা পরিষ্কার করে ওষুধ দিয়ে যায়। একটা ঘুমের ইনজেকশনও দেয়। আর বলে যায় তাকে যেন কোন ভাবে উত্তেজিত করা না হয়।

এদিকে নির্ঝরের শিয়র থেকে নড়ছে না মুমু। কিন্তু নির্ঝরকে নিয়ে সবাই এতো চিন্তিত যে তার এই অদ্ভুত ব্যবহারের দিকে কেউ নজর দিচ্ছে না।

সবাই সবার কাজে বের হয়ে গেলো। বাড়িতে নাফিসা আর মুমু রয়ে গেলো। মুমু একইভাবে নির্ঝরের পাশে বসে তাকিয়ে রইলো। তার বুকের ভেতরটা মোচড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে একরাতে নির্ঝর ভীষণ অচেনা হয়ে গেছে। তার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে ।
মুমু শুধু মনে মনে বলছে,
-আমার নির্ঝরের এমন অবস্থার জন্য তুমি দায়ী হৃদিতা। দরকার হলে তোমাকে খুন করবো তাও এ বাড়িতে কিছুতেই তোমাকে ফিরতে দেবো না।


শরীর দুর্বল থাকার জন্য রাতে ঘুম হলেও সকাল থেকে হৃদিতার খুব অস্থির লাগছে। তার বার বার মনে হচ্ছে নির্ঝরের তাকে প্রয়োজন। তাই সে আবার ফোন করলো নির্ঝরকে।
কিন্তু নির্ঝর তখন ঘুমে অচেতন। ফোন বাজতে দেখে মুমু দেখলো হৃদিতা ফোন করেছে।
এবার নিরাপদ ভাবে নিজের চাল দেয় মুমু। ফোন শ্বাশুড়িকে ধরিয়ে দেয়।

একজন মা কখনোই নিজের সন্তানের ক্ষতি সহ্য করতে পারে না। যে ব্যক্তি তার সন্তানের ক্ষতির জন্য দায়ী সেই ব্যক্তি নিজের অজান্তেই সেই মায়ের শত্রুতে পরিণত হয়।
তাই এখন নাফিসার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হৃদিতা।
-কেন ফোন করেছো? এতকিছু করে শান্তি হয় নি? আর কি চাও আমার ছেলেকে মেরে ফেলতে?

-মা এসব কি বলছেন আপনি? আমি কেন এমন করবো।

-তাহলে কেন ফোন করেছো?

-মা একবার বুঝতে চেষ্টা করুন আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হয়েছে।

-হ্যাঁ ভুলতো হয়েছে আর সেটা আমি খুব তাড়াতাড়ি শুধরে দিবো। তৈরি থেকো নির্ঝর তোমাকে তালাকের কাগজ পাঠাবে। কোন ঝামেলা না করে সই করে দিবে।

-একটু দয়া করুন। আমার সন্তানকে নিজের বাবার হক থেকে বঞ্চিত করবেন না।

-কে বঞ্চিত করছে? যাও না যাও বিয়ের আগে যার সাথে মুখ কালো করেছো তার কাছে যাও বলো তোমার সন্তানকে পিতৃপরিচয় দিতে। এসব নিয়ে বা কোন কিছু নিয়েই আর কোনদিন এখানে ফোন করবে না। নির্ঝর তোমার সাথে কথা বলতে চায় না। তুমি যদি আমার ছেলেকে আবার ফোন করো তবে আমি মা হয়ে অভিশাপ দিচ্ছি তোমার পেটের বাচ্চার কোনদিন ভালো হবে না।
বলে নাফিসা ফোন কেটে দেয়।


ঘুমের মধ্যে নির্ঝর বার বার হৃদিতাকে ডেকে উঠে। কিন্তু জেগে উঠার পর একেবারে শান্ত হয়ে যায়।


রাতে মুমু নিজের ঘরে গেলে নিরব তাকে কোন ভনিতা ছাড়া প্রশ্ন করে,
-তুমি গতকাল সকালে কেন বের হয়েছিলে?

-হঠাৎ আমাকে জেরা করছো যে?

-জেরা না সোজাসাপটা প্রশ্ন করছি। আজ তুমি কেন বের হয়েছিলে কি না?

নির্ঝরের অবস্থার জন্য মুমুর মেজাজ এমনি ভালো না। তার উপর নিরবের প্রশ্ন শুনে সে আরও ক্ষেপে গেলো।
-ইচ্ছে করছিলো তাই বের হয়েছিলাম এখন কি করবে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাবে?

-তুমি কি এমন কোন কাজ করেছো যার জন্য তোমার ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলা উচিত।

-দেখো তোমার এই হেয়ালি গুলো আমার পছন্দ হচ্ছে না। এমনিতেই আমি নির্ঝরকে নিয়ে অনেক চিন্তায় আছি।

-সে তুমি থাকতেই পারো এ বাড়িতে তো তুমি একজনকে নিয়েই চিন্তা করো।

মুমু চেঁচামেচি শুরু করে,
-একদম আমার সাথে ডাবল মিনিং কথাবার্তা বলবে না। যা বলার ডিরেক্টলি বলো। আর আমাকে আর নির্ঝরকে নিয়ে সন্দেহ হলে নিজের যাও ভাইকে জিজ্ঞেস করো গিয়ে।

-ওকে আর কি বলবো বলো? যখন নিজের হাঁড়িতেই ফোটা তখন অন্যজনকে বলে কি হবে? চার বছর তোমাকে সহ্য করেছি। আমার সাথে তুমি যা করেছো আমি মাফ করে দিয়েছি। তবে হৃদিতাকে সবার সন্দেহ করার পিছনে যদি তোমার হাত থেকে থাকে আমি কিন্তু তোমাকে ভুলেও মাফ করবো না।

-মানে? কি বলতে চাও তুমি আমি ষড়যন্ত্র করে হৃদিতার সংসার ভেঙেছি?

-মুমু একটা কথা আমি এখনো বিশ্বাস করি হৃদিতার চরিত্রে কোন দাগ নেই। তবে সত্যিটা কি তা তো আল্লাহ জানে । আমি শুধু একটা আন্দাজ করেছি মাত্র। দোয়া করো যাতে আমার ধারণা ভুল হয়। কারণ মিথ্যা দিয়ে সত্য ঢেকে রাখা যায় না। সে দিনের আলোর মতো প্রকাশিত হবেই।


চার দিন কেটে যায়। সবাই সবকিছু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। সায়েমা, নাহিদ, সম্পা, নিরব সবাই নির্ঝরকে বোঝাচ্ছে যে রিপোর্টে ভুল হতে পারে।
নিরবতো সকাল বিকাল ভাইকে এটা বোঝাতে ব্যস্ত হৃদিতা কতো ভালো মেয়ে।
মুমু বেশ খুশি। সে সেজেগুজে নির্ঝরের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত সেটা ভিন্ন কথা যে নির্ঝর ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
শ্বাশুড়ির কথায় ভয় পেয়ে আর নির্ঝরকে ফোন করে নি হৃদিতা।
এদিক সময়ের সাথে সাথে নির্ঝর অনুভব করতে থাকে, হয়তো হৃদিতা নির্দোষ। তাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিত। তাই নির্ঝর আরেকবার হৃদিতার টেস্ট করানোর সিদ্ধান্ত নেয় । যেহেতু বাড়িতে সর্বক্ষণ মুমু তার সাথে থাকে তাই এই কথাটাও প্রথমেই সে মুমুকেই জানায়।

মুমুর ঠান্ডা বুদ্ধির মেয়ে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণে রেখে সায় দেয়।
তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-একটা কাজ করো হৃদিতার বাপের বাড়ি না গিয়ে সরাসরি কলেজে যাও। আজ থেকেতো বোধহয় প্রি-টেস্ট পরীক্ষা। তুমি সেখানে ওকে বুঝিয়ে নিয়ে যাবে। তুমি একা না পারলে আমিও যাই ওকে রাজি করাতে সহজ হবে। অবশ্য তোমার আপত্তি না থাকলে।

-আরে আপত্তি থাকবে কেন? এটাই ভালো। আমি যে ব্যবহার করেছি তাতে ও রাজি না হতেই পারে তুমি গেলে ভালোই হবে।

-হুম তাতো হবেই। তবে একটা কথা বলি বাড়ির মানুষ হৃদিতাকে যতটা ভালো ভাবে সে ততটা নয়। লোকে বলবে আমি জা তাই তাকে হিংসে করি তাই বলি নি। তবে এখনকার দিনে ফাইভ সিক্সের মেয়েদেরও বিএফ থাকে সেখানে হৃদিতা ইন্টারমিডিয়েটে পড়ুয়া। তাট উপর যথেষ্ট সুন্দরী। তার আগে কোন প্রেম ছিলো না এটা একটু অবিশ্বাস্য। দেখো আমরা যে ওদের সম্পর্কে তেমন খোঁজ খবর নেই নি সেটাতো সবার জানা তাই বলছিলাম।
যাই হোক আমি গেলাম আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। তুমি অফিস যাও আমি বরং দুপুরে সোজা তোমার অফিসে চলে যাবো।

প্রায় নিভে যাওয়া আগুনে ঘি ঢেলে মুমু চলে গেলো।


সময়মতো হৃদিতার কলেজের সামনে পৌঁছায় মুমু আর নির্ঝর। সেখানে গিয়ে তারা দেখে হৃদিতা একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।

-চলবে?