ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-২১+২২

0
156

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-২১+২২

‘মিরপুরে বাসা নিয়েছি তো। সেখানে কিছুদিন থেকে আসবি। তোর ভাবি খুলনা গিয়েছিল। গতকাল ফিরেছে।’

ফাইজান ভাইয়ের কথা শুনে খেই হারিয়ে ফেললাম। পাগল নাকি! বড় মা সহ বাড়ির সবাই মেরে ফেলবে আমায়। না হয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। সবাই মুখিয়ে রয়েছে। সুযোগের অপেক্ষায়। ছিটেফোঁটা ভুল হলে আর রক্ষা নেই। ঢাকা শহরে কাজের লোকের অভাব পড়েছে নাকি! আমি জোরালো নিষেধ করে বললাম,

‘যেতে পারবো না আমি। বাড়িতে কত কাজ এখন।’

‘সালেহা খালা আছে। কাজ হয়ে যাবে। তুই চল।’

‘এভাবে যাওয়া যায়? বাড়ির কেউ জানে না। মেরে ফেলবে একদম।’

‘আরে গাধা! সবাই জানে। বাড়িতে গেছিলাম তোকে আনতে। খালা বললো কলেজে তুই। এজন্য এখানে আসলাম। মাকে বলেছি তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো। আর ভয় নেই। বেশি দূরের পথ নয়। এখান থেকে সরাসরি মিরপুরের বাসে উঠবো।’

দো মনা করতে করতে অবশেষে রাজি হলাম। ফাইজান ভাইয়ের বউকে দেখার তীব্র লোভ হলো। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। শেষমেশ তার সাথে বাসে উঠে পড়লাম।

পাশাপাশি বসে আছি দুজন। তবুও যোজন যোজন দূরত্ব। এখনো তার সাথে সহজ হয়ে কথা বলতে পারি না। জানালা ঘেঁষে চুপচাপ বসে রইলাম। কাচ সরানোর জন্য ইতি-উতি করতে ফাইজান ভাই বাম হাতে টেনে খুলে দিল। তৎক্ষনাৎ বাতাসের ঝাপটা এসে গায়ে লাগলো। ঘর্মাক্ত দেহটা আস্তে আস্তে শীতল হয়ে উঠলো। মিরপুর কতদূর জানা ছিল না। ফাইজান ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?’

‘ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাবো। তুই খাবি কিছু? খিদে পায়নি?’

‘না! এখন খাবো না।’

সে আর কিছু বললো না। পকেট থেকে ফোন বের করে হাতে নিল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেললাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পাশ থেকে ফাইজান ভাইয়ের গলা ভেসে এলো। ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। আমি মনোযোগ দিতে পারলাম না। এভাবে রাজি হয়ে গাড়িতে উঠলেও মনে প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়? কিচ্ছু করতে পারবো না আমি। রাস্তায় গিয়ে পঁচে মরতে হবে। বুক চিঁড়ে আফসোসের সুর ভেসে এলো।

‘আপা শসা খাইবেন?’

আমি আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। বাচ্চামতন এক ছেলে। আমার দিকে কাটা শসার প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়েছে। চেহারা ময়লাযুক্ত। গায়ের গেঞ্জির কত জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। মলিন মুখ জোড়ায় তীব্র আক্ষেপ। এই আক্ষেপ বেঁচে থাকার আক্ষেপ। দারিদ্রতার সাথে প্রতিনিয়ত যুঝতে থাকার আক্ষেপ। বুকে ব্যথা অনুভূত হলো আমার। কি কষ্টের জীবন!

ফাইজান ভাই একটা শসার প্যাকেট কিনে হাতে ধরিয়ে দিল। দিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। আমি হাতের কাটা শসার দিকে অপলক চেয়ে রইলাম।

________

মোটামুটি বড়সড় এক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ফাইজান ভাই। ছয় তলা উচুঁ বিল্ডিং। তাকালে আকাশ দেখা যায় না। বেলকনিতে শুকাতে দেওয়া কাপড় চোপড় চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে দু একটা বেলকনিতে অবশ্য সবুজ গাছপালা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো। তিন তলার ডানদিকের বেলকনির গ্রিল ধরে বাচ্চা এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরণে টকটকে লাল পোশাক। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। পুতুল বেঁচে থাকলে এতবড় হয়ে যেতো! আপা আপা বলে ডাকতো। হৃদয়ে গেঁথে থাকা সূক্ষ্ম এক ব্যথা নড়াচড়া করে উঠলো।

‘চল।’

ফাইজান ভাইয়ের ডাকে হুঁশ ফিরলো। তার পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলাম। পানির তেষ্টা পেয়েছিল সেই সকালে। পরীক্ষার মাঝে। খাতায় লিখতে লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আবার সেই তেষ্টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। গলা শুকিয়ে মরুভূমি! পা চলতে চাইছে না। টেনে টেনে সিঁড়ি উঠলাম। চার তলা অবধি পৌঁছাতে পা ধরে এলো। আর পারছিলাম না। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,

‘আর কয় তলা উঠতে হবে?’

ফাইজান ভাই হাসলো। বাচ্চাদের মতো অবুঝ হাসি। আমার আগে আগে যাচ্ছিল সে। হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ঘুরে বলল,

‘পৌঁছে গেছি। পাঁচ তলায় বাসা। এতো উপরে বাসা নিয়েছি বলে তোর ভাবি বকা দেয়। দিনের মধ্যে কতবার যে কথা শোনায়!’

সিঁড়ির বাম পাশের ফ্ল্যাট। ফাইজান ভাই কলিং বেল চাপলো। মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে গেল। যেন দরজার ওপাশে কেউ অপেক্ষারত ছিল। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। আবিষ্কার করলাম ছিপছিপে গড়নের এক মেয়ে। কলাপাতা রঙের থ্রি পিস পরিহিত। খুবই সাধারণ দেখতে। তবুও এই সাধারণের মাঝে কোথাও অসাধারণ কিছু রয়েছে। হয়তো সেই অসাধারন কিছু ফাইজান ভাইয়ের দৃষ্টি কেড়েছে। আমি বিনয়ের সাথে সালাম দিলাম। সে উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন আছো জুঁই?’

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিলাম। সে আমার নাম ধরে ডাকলো দেখে অবাক হলাম। ছোটখাটো এক ফ্ল্যাট। দুইটা রুমের মাঝে কয়েক হাত ড্রয়িং রুম। ড্রয়িং রুমের একপাশে রান্নাঘর। রান্নাঘরের সাথে ছোট্ট বাথরুম। কয়েক সেকেন্ডে নজর বুলিয়ে নিলাম। ভাবি গেস্ট রুমে বসতে দিল আমায়। ফাইজান ভাই ড্রয়িং রুম থেকে গলা উঁচিয়ে বলল,

‘হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয় ফুলি। বিকেল হয়ে গেল। দুপুরে তো খাসনি।’

ভাবি তার সাথে সায় মিলিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ। ফ্রেশ হয়ে নাও। শুনলাম তোমার পরীক্ষা চলছিল। কেমন দিয়েছো?’

‘ভালো দিয়েছি ভাবি।’

তাকে ভাবি ডাকতে কেমন যেন লাগলো। সে দু চারটে কথা বলে চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উঠে গিয়ে জানালার পাল্লা সরিয়ে দিলাম। জানালা দিয়ে অনেকখানি আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মন বিষণ্ণ হয়ে এলো। এমন একটা ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন ছিল আমার। সে সংসার সাজাতে কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। রাফি ভাই আর আমার সংসার হবে। টোনাটুনির ছোট্ট সংসার। এক পৃথিবী ভালোবাসায় ভরপুর থাকবে সে সংসার। মাঝে মধ্যে মান-অভিমান হবে। সে সব কাজ ফেলে অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। রাত জেগে আরো কতশত স্বপ্নে বিভোর থাকতাম! এখন স্বপ্ন দেখার সময় নেই। প্রিয় মানুষও নেই।

তবে আমার সে স্বপ্ন দেখার দিনগুলো রঙ্গিন ছিল। ভীষণ আনন্দের ছিল। তখন কারণে অকারণে হাসতাম। সবকিছুতে আনন্দ খুঁজে পেতাম। এখন স্বপ্ন ছাড়া জীবন বর্ণহীন কষ্টের। জ্বালাময় ব্যথার! স্বপ্ন ছাড়া বেঁচে থাকার যন্ত্রণা সবাই বুঝে না।

ড্রয়িং রুমে ফাইজান ভাই একটু পর পর সন্ধি বলে ডেকে উঠছে। সন্ধি এটা দিয়ে যাও, ওটা দিয়ে যাও! সন্ধি ফোন খুঁজে পাচ্ছি না, ছাই রঙা টিশার্ট খুঁজে পাচ্ছি না ইত্যাদি। আমি এপাশে আফসোসের মালা গাঁথতে লাগলাম। কেউ কী কোনোদিন এমন আদর মেখে আমায় নাম ধরে ডাকবে?

_________

গোছগাছ করা রুমের একপাশে ঝকঝকে বিছানা। এতো বড় বিছানায় ঘুমানো হয়নি কখনো। ও বাড়িতে ছোটো-মোটো এক খাটে আমি আর সালেহা খালা ঘুমাই। আগে খাট ছিল না। মেঝেতে ঘুমাতাম। এরপর কেউ বলে হয়তো খাটটা এনেছে। আজ বিশালাকার বিছানায় আমি একা। বাল্ব বন্ধ করে এসে দ্রুত শুয়ে পড়লাম। তবে শান্তি পেলাম না। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। চরম অস্বস্তি। ও বাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখানে একদম ভালো লাগছে না।

ঘুমানোর জন্য সবেমাত্র চোখ বুজেছি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে উঠলো। পুরনো বাটন ফোনের বিদঘুটে শব্দ। বালিশের চিপা থেকে দ্রুত বের করলাম। দেখি অচেনা নাম্বার। আব্বার ফোন এটা। কেউ কল করলে ধরি না। কল ধরে সবাই আব্বাকে খুঁজবে। সে তো নেই!

আমার ভাবনার মাঝে কল কেটে গেল। মিনিটের কাটা গত হওয়ার আগেই আবার ফোন বেজে উঠলো। বিকট শব্দ! ফাইজান ভাইয়ের রুম থেকে যদি শোনা যায়? তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলাম। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কে বলছেন?’

‘জুঁইফুল আমি!’

এইটুকুই। আর কিছু বলতে হলো না। তাতেই আমি চিনে গেলাম। বিস্ময় নিয়ে বললাম,

‘রাজ ভাইয়া আপনি? এতো রাতে কেন ফোন দিয়েছেন?’

‘দরকার আছে। কোথায় আছো তুমি?’

‘মিরপুরে। ফাইজান ভাইয়ের এখানে।’

বলে চুপ হতে গেলাম। রাজ ভাইয়া কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ রইলো। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। সে কোনো কারণে ফাইজান ভাইকে পছন্দ করে না। চোখের বালি মনে করে। এখানে আছি বলে নিশ্চয়ই রেগে যাবে। পরক্ষণে মনে প্রশ্ন জাগলো। কেন রেগে যাবে সে? তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ও বাড়ির সামান্য কাজের মেয়ে। ওপাশের নিঃশব্দতা ভেঙ্গে ভেসে এলো,

‘কবে বাড়ি আসবে?’

‘জানি না। ফাইজান ভাই কয়েকদিন থাকতে বলেছে।’

‘কালকের মধ্যে বাড়ি চলে আসবে। প্রয়োজন আছে।’

কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম,

‘কি প্রয়োজন? কার প্রয়োজন?’

‘এলে বুঝতে পারবে। অনেক বড় সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখো।’

আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল। হাতের ফোনটার দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলাম। রাজ ভাইয়া কি বলছে এসব? কিসের সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে? মনে একাধিক অপশন এলো। কোনোটাই যুতসই মনে হলো না। তার সাথে তো আমার তেমন বন্ধুত্ব বা কথা বলা কোনোটাই হয়নি। তবুও কি সব বললো! নাম্বার কোথা থেকে নিয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছি। সামান্তা আপু অথবা সালেহা খালা। কারো থেকে নাম্বার জোগাড় করেছে। কিন্তু এত আয়োজন করে কি বলতে চায় সে? ভয় হতে লাগলো আমার। বালিশে মাথা রাখলাম ঠিকই। কিন্তু ঘুম এলো না।

________

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে টের পেলাম মাথা ধপধপ করছে। চোখ জ্বালা করছে। রাতে সত্যি সত্যি ঘুমাতে পারিনি। শেষরাতের দিকে শুধু ঘুম এসেছিল। চোখ মুছে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাইরে মোটামুটি অন্ধকার। ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। জানালার গ্রিলে মাথা রেখে বসে রইলাম। আস্তে আস্তে সমস্ত রাতের ক্লান্তি দূর হতে লাগলো। ভেতর ও বাহির শান্ত হয়ে এলো।

ড্রয়িং রুমে কথাবার্তার আওয়াজ হচ্ছে। বুঝতে পারলাম ওনারা উঠে গেছে। আমি এখনি বের হবো কি না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি। আবার বাইরে গিয়ে একটু কাজ করলে ভালো হতো। লাট সাহেবের মতো বসে থাকার জন্য আসিনি তো। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। বন্ধ দরজার উপর কান রাখলাম। ড্রয়িং রুমে কি কথাবার্তা হচ্ছে সেটা ঠাওর করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারলাম না। কথা বোঝা যাচ্ছে না। শেষমেশ আস্তে করে দরজা খুলে বের হলাম।

ফাইজান ভাই ড্রয়িং রুমের টেবিলে বসে ল্যাপটপে কিছু করছিল। আমাকে দেখে ল্যাপটপ থেকে চোখ সরালো। বলল,

‘আজ কি কলেজে যাবি?’

‘ভাবছি ক্লাসে যাবো না। গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ ক্লাস হবে না!’

‘ওহ্। না গেলি তাহলে।’

ফাইজান ভাই আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিল। আমি কিছুক্ষন ইতস্তত করে বলে ফেললাম,

‘ও বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছে। আজই ফিরতে বলেছে।’

‘কে ফোন দিয়েছে?’

ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করলো সে। চেয়ে আছে সন্দিহান দৃষ্টিতে। আমি চট করে উত্তর দিতে পারলাম না। উত্তর না পেয়ে সে নিজে থেকে বলল,

‘ও বাড়িতে আর না গেলি। আমাদের এখানে থাক। একদিন গিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে আসলে হবে। আমি একটু পর অফিস যাবো। তোর ভাবি সারাদিন একা একা থাকে। তুই থাকলে ভালো লাগবে।’

ফাইজান ভাই বললে কি হবে। আমি জানি আমি থাকলে সন্ধি ভাবির ভালো লাগবে না। নতুন বিয়ে করেছে তারা। অনেক স্বপ্ন নিয়ে! হয়তো নিজেদের মত সংসার করবে। নিজেদের মতো সময় কাটাবে। আমি উটকো ঝামেলা। আমার জন্য তাদের সর্বদা তটস্থ থাকতে হবে। আরো কত ঝামেলা। গতকাল রাতে খাওয়ার সময় ফাইজান ভাই আমার প্লেটে একটা চিংড়ি তুলে দিয়েছিল। সন্ধি ভাবির মুখটা কেমন চুপসে গিয়েছিল তখন। ভাই হয়তো খেয়াল করেনি। কিন্তু আমার নজরে ঠিক পড়েছে। আমার এখানে থাকা সমীচীন নয়। তাছাড়া আমি নিজে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। ও বাড়িতে আমার নিজস্ব একটু জায়গা আছে। আমার কিছু আপন মানুষ আছে। তাদের সঙ্গ ভালো লাগে। তাদের কথাবার্তা ভালো লাগে। তাদের ছেড়ে থাকা অসম্ভব!

সন্ধি আপু রান্নাঘরে ছিল। বের হয়ে ড্রয়িং রুমে আসতে ভাই বলল,

‘সন্ধি! জুঁই কে বলছি থেকে যেতে। তুমি কী বলো?’

‘থাক। ভালো হবে। অনেকটা সময় একা একা থাকতে হয় আমাকে।’

মুখে বললেও ভাবির কেমন মিইয়ে যাওয়া গলার স্বর। সে স্বরে লুকোনো ভয়। যদি থেকে যায়! ফাইজান ভাই এবারো কিচ্ছু টের পেল না। সে ভীষণ খুশি হয়ে উঠলো। উৎসাহ দিলো থেকে যাওয়ার জন্য। সন্ধি ভাবির কথাবার্তা শুনে বুঝেছি আমি যে তাদের বাড়ির কাজের লোক সেটা জানে না। মনে হলো বড় মায়ের দূর সম্পর্কের কোনো বোনের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছে। ফাইজান ভাইয়ের পাতানো বোন বলে পরিচয় দিয়েছে।

বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে রুমে এলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আজকের দিনটা থেকে কাল ভোর হলে চলে যাবো। সালেহা খালাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব।

_________

পরদিন সকাল বেলা ফাইজান ভাইয়ের সাথে বের হলাম। সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অনেক কষ্টে বাসা থেকে বের হয়েছি। আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে সে অফিস গেল। বিকেল বেলা অফিস শেষ করে আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে বলেছিল। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। আজ সকালেই ফিরতে হবে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাসে উঠে তবে শান্তি পেলাম।

বাস একেবারে আমার কলেজের সামনে থামবে। সেখান থেকে বাড়ি পৌঁছানো সমস্যা হবে না। তবুও ফাইজান ভাই বার বার করে বলে দিল। পৌঁছে যেন তাকে ফোন দেই। রাজ ভাইয়া পরশু দিন রাতে ফোন দিয়েছিল। ভেতরে কৌতূহল ঢুকিয়ে দিয়ে চুপ হয়ে গেছে। আর কোনো খোঁজ নেই। একটা ফোন নেই! বাসের সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম।

কলেজের মোড়টাতে বাস থামলো। নেমে হেঁটে বাড়ি অবধি পৌঁছে গেলাম। বাইরের গেটে দারোয়ান মামা নেই। ফাঁকা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। কলিং বেল চাপলাম। একবার চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। সালেহা খালার কানে গেলে দৌঁড়ে এসে খুলে দিবে। সময় অতিক্রান্ত হলো। সুন্দর এক মিউজিক বেজে শব্দ মিলিয়ে গেলো। কেউ দরজা খুললো না। দ্বিতীয় বার সুইচে চাপ দিলাম। অন্য গানের মিউজিক বেজে উঠলো। খালা দরজা খুলছে না কেন? এতো সময় তো লাগার কথা না।

এপাশে দাঁড়িয়ে আঙ্গুলের নখ কামড়ানো শুরু করলাম। অবশেষে দরজা খুলে গেল। কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখতে পেলাম। খালা আমায় দেখে ভারী অবাক হলো। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কী করছিলে খালা? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’

‘তুই আজ আইবি বইলা আইবি না? ফোন করতি!’

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘কিছু হয় নাই। ঘরে আয়।’

খালাকে চিন্তিত মনে হলো। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভয় হতে লাগলো আমার। আমার অবর্তমানে কোনো অঘটন ঘটেনি তো? চট করে জাবিরের কথা স্মরণ হলো। বছর খানেক আগে জাবির একটা বই উপহার দিয়েছিল। সেই বইয়ের প্রথম পাতায় কিছু লেখা। সেই লেখা কারো নজরে আসেনি তো? কিন্তু বইটা তো আমি লুকিয়ে রেখে গেছি। খালার পিছু পিছু ঘরে ঢুকলাম।

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_২২

খালার পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলাম। সমস্ত বাড়ি নিঃশব্দ। কেমন থমথমে। শরীর বারংবার শিউরে উঠলো। বসার ঘরে কেউ ছিল না। রান্নাঘরে থালাবাসন নাড়াচাড়ার শব্দ হচ্ছে। ওদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে খালা হাত চেপে ধরলো। একপ্রকার টেনে নিয়ে রুমে ঢুকলো। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,

‘খালা কী হয়েছে? এমন করছো কেন?’

খালা গলার স্বর নামিয়ে বলল,

‘কেলো হইয়া গেছে। রাজ কি করছে হুঁনছোস?’

‘কী করেছে?’

‘গতকাইল রাতে সবাই খাইতে বসছে। হগ্গলে আছে। এই সময় রাজ উপর থেইকা নিচে নামলো। সরাসরি কইলো, আমি বিয়া করতে চাই। সামান্তার বিয়ের জন্য আয়োজন করা হচ্ছে। একসাথে দুটো বিয়ে হলে সমস্যা হওয়ার কথা না। বিয়া করবো ভালো কথা। কেউ কেউ মনে মনে খুশি হইলো। ওর দাদী জিগাইলো, খুবই ভালো। অবশেষে একটু বুদ্ধির উদয় হইছে। কাল থেকে মেয়ে দেখা শুরু করি। কিন্তু রাজ হুইনা কইলো, মেয়ে ঠিক করা আছে। জুঁইকে বিয়ে করতে চাই।’

পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হলো। বুকে একের পর এক হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। কোনো রকমে বললাম,

‘এসব কী বলছো খালা?’

‘হ। পোলার মাথা খারাপ হইয়া গেছে। এইডা কখনো সম্ভব? এইগুলা বাস্তবে কখনো হয়? আজাদ ভাই তো প্রথমে চিনতেছিল না যে জুঁই কে! যখন হুনছে তুই খুব রাইগা গেছে। কাল ভাতের প্লেট ছড়ায় ছিটায় চইলা গেছে। রাজও রাগারাগি কইরা বাড়ির বাইরে গেছে। আর ফিরে নাই। তোরে নাকি বিয়া করবই করবো।’

কান্না পেয়ে গেলো আমার। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। এ বাড়ির সবাই এখন নিশ্চিত আমায় মেরে ফেলবে। রাজ ভাইয়া এটা কী করেছে! মাথা খারাপ নাকি তার? এটা তো কখনো সম্ভব নয়। জীবন নাটক সিনেমা পেয়েছে? নাটক সিনেমা হলে এতকিছু হারাতে হতো না আমায়। রাফি ভাই ঠিক আমায় বুঝতো। আমার ভালোবাসার বিনিময়ে আমায় ভালোবাসতো। নিজের পরিবার হারাতে হতো না আমায়। জীবনে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতো না। জীবন ভীষণ নিষ্ঠুর! কণ্টকাকীর্ণ পাহাড়ের চূড়া। দিনশেষে যেখানে শুধু দুঃখের জায়গা হয়। এখানে সুখের স্থান নেই। ভুলবশত একটু আধটু সুখ এসে উঁকি দিতে বড়সড় কোনো দুঃখ এসে তাকে পিষে মেরে ফেলে। নতুবা চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় গভীর অতলে।

খালা অসহায় কণ্ঠে বলল,

‘কী করবি এহন ক তো? সুযোগ বুইঝা ওরা তো বাড়ি থেইকা বের কইরা দিবো। কই যাবি তহন?’

আমি দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকালাম। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। গাল ভিজে উঠলো। রাজ ভাইয়ার এই একটা কথা আমায় যে কোথায় দাঁড় করাবে ভাবতে গলা শুকিয়ে এলো। খালার হাত চেপে ধরে বললাম,

‘খালা কী করবো এখন? ওরা নিশ্চিত মেরে ফেলবে আমায়। মেরে লাশ গুম করে দিবে। কেউ টের পাবে না। ঢাকা শহরে নিত্যদিন কত মানুষ মারা যাচ্ছে। কতজন খুন হচ্ছে। কে খবর রাখছে তার।’

ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম। খালা মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিল। বলল,

‘থাক কাঁদিস না। দেহি কি করা যায়।’

কান্না থামলো না। রান্নাঘর থেকে বড় মায়ের গলা ভেসে আসছে। থমথমে সুর। খালাকে ডাকছে। খালা মাথার চুল খোঁপা করতে করতে বের হয়ে গেল। আমি বিমূর্ত হয়ে বসে রইলাম। এর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? ওরা কী সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে? সমস্ত রাগ গিয়ে রাজ ভাইয়ার উপর পড়লো। এই কাজ কেন করেছে সে!

কিছুক্ষণ পর মুখ ধুয়ে বের হলাম। রান্নাঘরে বড় মা রয়েছে। ভেতরে ঢুকলাম প্রচন্ড ভয় নিয়ে। খালা পাটায় ডাল বাটছে। মসুর ডাল। পিয়াজু হবে হয়তো। বড় মা কি যেন ভাজছে। উঁকি দিয়ে দেখলাম শাক। আমি খালার কাছে গিয়ে আস্তে করে বললাম,

‘খালা আমি ডাল বাটি। তুমি অন্য কিছু করো।’

খালা বাটা থামিয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। বড় মা-ও খুন্তি হাতে পেছন ঘুরে তাকালো। এক পলক দেখে আবার ভাজি নাড়তে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। খালা পাটা ছেড়ে উঠে বলল,

‘নে কর। ভালো কইরা বাটিস।’

‘হুঁ!’

বসে পড়লাম। ভয়ে ভয়ে রইলাম। বড় মা কিছু বলে কি না! কিন্তু কিছু বললো না। অভিমান করেছে হয়তো। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। আমি নির্দোষ। তবুও সব দোষ, সব অভিযোগ আমার ঝুলিতে পড়বে। রাজ ভাইয়ার মতলব বুঝতে পারছি না। সে কী আমার ভালো করতে চাইছে? নাকি আরো ক্ষতি করতে চাইছে? ভালো চাইলে তো এই পদক্ষেপ নিত না।
দুশ্চিন্তায় ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগলাম।

_________

সামান্তা আপুর বিয়ের তোড়জোড় চলছে। মাঝে আর দুটো দিন আছে। পরিকল্পনা মাফিক সব হচ্ছে। সমস্ত বাড়ি লাইটিং করা হচ্ছে। বাগানে রান্নার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন ইতোমধ্যে এসে গেছে। বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড। এসবের মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকজনের মুখ চুপসানো। যারা রাজ ভাইয়ার ব্যাপারটা নিয়ে এখনো চিন্তিত। রাজ ভাইয়া একগুঁয়ে। ছোটবেলা থেকে একরোখা। নিজে যা ভালো মনে করে বরাবর সেটা করে এসেছে। প্রচন্ড অবাধ্য! যার জন্য সবাই চিন্তায় আছে। কিন্তু আমি তো বিয়ে করছি না তাকে। আমি না চাইলে তো আর সে জোর করে কবুল বলাতে পারবে না।

ডাইনিং এর টেবিল পরিষ্কার করছিলাম। ছোট ছোট বাচ্চারা খেয়েছে। এখন বড়রা খেতে বসবে। ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছিলাম। এমন সময় জাবির এসে ডাক দিল।

‘জুঁই।’

আমি উত্তর দিলাম। জাবির হোস্টেল থেকে গতকাল এসেছে। তার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়নি। এখন ভার্সিটিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রচন্ড পড়ার চাপ। তাকে দেখলেই বোঝা যায়। আমি ভেজা কাপড়টা চিপে বললাম,

‘কিছু লাগবে?’

‘হ্যাঁ। চা বানিয়ে খাওয়া তো।’

‘এই দুপুর বেলা? ভাত খাবেন না এখন?’

‘চা খেয়ে ভাত খাবো।’

আমি কিছু বললাম না। জাবির আনমনে বলল,

‘কতদিন হলো তোর হাতের বানানো চা খাই না। ভীষণ মিস করেছি।’

আমি কাজে মনোযোগ দিলাম। তার কথা কানে তুললাম না। জাবিরকে দেখে মনে হচ্ছে সে রাজ ভাইয়ার ঘটনা জানে না। সে এসেছে গতকাল। তাকে জানানো হয়নি হয়তো। এটা কী জানানোর মতো ঘটনা? লজ্জাজনক ব্যাপার! বিশিষ্ট রাজ’নীতি’বিদ আজাদ রহমানের ছেলে কি না কাজের মেয়ের প্রতি দূর্বল। তাকে বিয়ে করতে চায়। এসব জানানো যায়? যত কম মানুষ জানবে তত ভালো!

জাবির এখনো যায়নি। বাড়ি ভর্তি মানুষ। এই ছেলে কাজের মেয়ের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করছে। কেমন দৃষ্টি কটু দেখতে। রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে আনতে বললাম,

‘আপনি গিয়ে বসুন। আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা। তাড়াতাড়ি করিস।’

জাবির অবশেষে চলে গেল। কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রাজ ভাইয়া বাড়ি নেই। তার সাথে আমার এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। কিছু যে জিজ্ঞেস করবো সে সুযোগ পাইনি। সবার মনে আগুন লাগিয়ে দিয়ে কোথায় পালিয়ে আছে কে জানে! সামান্তা আপুও আমায় এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বাড়ির সবার মুখ গম্ভীর। কিন্তু কেউ এই বিষয় তুলেনি। আমি যেন কিছু জানি না এমন ভাব সবার। এতে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে।

তবুও মনের কোনো এক কোণে ভয়। তীব্র খচখচানি। সামান্তা আপুর বিয়ের জন্য সবাই চুপচাপ আছে। বিয়েটা সমাধা হতে গেলে বড়সড় ঝড় আসবে। সেই ঝড়ে এ বাড়ির আশ্রয় উড়ে যেতে পারে। চিরদিনের জন্য। তখন কী হবে!

_________

আজ ধুমধাম করে সামান্তা আপুর গায়ে হলুদ হয়েছে। কাল বিয়ে। বাহিরের বাগানে বক্স বাজছে। হৈ-হুল্লোড় আর চেঁচামেচিতে নাজেহাল দশা। বসার ঘরে লোকে লোকারণ্য। রান্নাঘরে আমরা কয়েকজন পেঁয়াজ, রশুনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলাম। তখন জাকারিয়া এলো দৌঁড়ে। আমার কাছে এসে বলল,

‘তোমায় বুবু ডাকে। এক্ষুণি যেতে বলেছে।’

বলে পিচ্চি ভো দৌঁড় দিল। কারণ জিজ্ঞেস করার সময় পেলাম না। সামান্তা আপু কেন ডাকছে? আপুর কাছে তো অনেকে রয়েছে। এদিকে কত কাজ। সব কেটে রাখতে হবে। আবার রাতের জন্য রান্না করতে হবে। একবার রান্না হয়েছিল। সব শেষ। একের পর এক লোক আসছে। তাদের খেতে দিতে হবে। খালাকে বলে উঠে এলাম। আশপাশে জাবিরকে চোখে পরলো না। হয়তো বাগানে রয়েছে। অনেক দায়িত্বশীল ছেলেটা। একমাত্র বোনের বিয়ে! সুন্দর মতো বেশ কয়েকটা দিক সামলাচ্ছে।

আনমনে উপরে উঠছিলাম। সিঁড়ির কাছে রাজ ভাইয়ার সাথে দেখা হলো। ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলেও পরক্ষণে হেঁটে উপরে গেলাম। চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে। সে কিছু বলার সুযোগ পেল না। আমিও না!

সামান্তা আপু রুমে একা ছিল। হাঁটু ভাঁজ করে বিছানায় বসে। তার কাছের বান্ধবীদের দাওয়াত করেনি। অথচ বিয়েটা যদি তার প্রিয় মানুষটির সাথে হতো কত আনন্দে থাকতো সে। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে কত মজা করতো। তার স্বপ্নের কোনো এক অংশে হয়তো হাসিখুশি এক বিয়ের চিত্র ছিল। সময় সব পাল্টে দিয়েছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম,

‘একা বসে আছেন কেন? আপনার মামাতো বোনেরা ছিল। ওনারা কই?’

‘বের করে দিয়েছি। বলেছি আমি একটু ঘুমাবো। মাথা ব্যথা করছে। ব্যাস! ওরা চলে গেছে।’

‘সত্যি সত্যি মাথা ব্যথা করছে আপনার? ওষুধ খাবেন?’

‘বুকে ব্যথা করছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি জুঁই।’

চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আপুর কাছে যেতে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। তার দুহাত ভর্তি মেহেদী। প্রগাঢ় রঙের। বাম হাতের তালুতে আকাশ নামটা জ্বলজ্বল করছে। আপু আরেক হাতে সেই নাম ঘষে উঠানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমি বাঁধা দিলাম। বললাম,

‘এমন করছেন যেন আপু? শান্ত হোন।একটু শান্ত হোন।’

টেবিলের উপর থেকে পানি এনে দিলাম। কয়েক ঢোক খেয়ে আপু শান্ত হলো। দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা বললো না। একসময় মাথার এলোমেলো চুলগুলো কাঁটা দিয়ে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল,

‘চল ছাদ থেকে ঘুরে আসি।’

চমকে গেলাম আমি। আপু ছাদে উঠবে কেন? তার মন এখন বিক্ষিপ্ত। যদি কোনো অঘটন ঘটায়? আমি রাজি হলাম না। বললাম,

‘অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন যেতে হবে না। বিয়ের কনেদের এতরাতে বাইরে বের হতে হয় না। ভূত-প্রেত ভর করে।’

আপু হেসে উঠলো। ক্ষীণ হাসির ঝংকারে শরীর দুলে উঠলো তার। বলল,

‘তুই ভয় পাচ্ছিস জুঁই। তাই না? যদি ছাদে থেকে লাফ দেই! আরে পাগল। একভুল মানুষ জীবনে একবারই করে। তুই জানিস, ঘুমের ওষুধ গুলো খাওয়ার পর যখন জ্ঞান হারাচ্ছিলাম, গভীর কোনো অতলে ডুবে যাচ্ছিলাম। তখন বার বার মনে হচ্ছিল কেউ এসে আমায় বাঁচাক। আল্লাহর কাছে বার বার সাহায্য চাইছিলাম। বেঁচে থাকার জন্য কত আকুতি করেছিলাম। ওই ভুল আর করছি না!’

ছাদের পথে পা বাড়ালাম দুজন। যাওয়ার সময় আপুর ছোট খালামণি দেখলো। বলল,

‘কোথায় যাস রে?’

‘ছাদে যাই। রুমে গরম লাগছে খালামনি।’

আপুর উত্তরে সে বলল,

‘তাড়াতাড়ি চলে আসিস। বেশিক্ষণ থাকবি না কিন্তু।’

আপু মাথা নেড়ে সায় দিল। ছাদে উঠে আসলাম আমরা। ছাদে শীতল বাতাস বইছে। আকাশ অন্ধকার। চাঁদ নেই। দু চারটে তারা মিটিমিটি আলো দিচ্ছে। সে আলো এতটা ক্ষীণ যে এই নিকষ কালো অন্ধকার দূর হচ্ছে না। আপু চুপচাপ আকাশের পানে চেয়ে রইলো। একসময় বলল,

‘তোর ফোনটা দে তো জুঁই।’

খানিক আশ্চর্য হলাম। কিন্তু কারণ জিজ্ঞেস করলাম না। ওড়নার গিঁট খুলে ফোন বের করে দিলাম। আপু হাতে নিয়ে বলল,

‘ফাইজান ভাই হলুদের অনুষ্ঠানে কেন এলো না বল তো?’

‘জানি না! ব্যস্ত হয়তো। কাল আসবে।’

আপু তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিল। বলল,

‘আসবে না। কালও আসবে না। আমি জীবন বাজি রেখে বলতে পারি।’

প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমারো মনে হচ্ছে ফাইজান ভাই আসবে না। আপু কল লিস্টে গিয়ে ফাইজান ভাইকে ফোন দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো,

‘হ্যালো ফুলি। বল কি খবর?’

আপু ফোন কানে নিয়ে বলল,

‘আমি সামান্তা!’

সরে এলাম আমি। বেশ দূরে চলে এলাম। উপরের অন্ধকার আকাশ যেন মিটিমিটি হাসছে। তার ছায়ায় থাকা মানুষদের দুঃখ দেখে বড় আনন্দ পাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ গত হলো। আপু হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘আপনি কাল না এলে আমি কবুল বলবো না!’

বলে সে ঠাস করে ছাদের মেঝেতে বসে পড়লো। দৌঁড়ে কাছে গেলাম আমি। হাতের ফোনটা ছুঁড়ে রেখে আপু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দুহাতে মুখ ঢেকে অবিরত কান্না করে গেল। তার গা ঘেঁষে বসে থাকা ছাড়া কিছু বলার পেলাম না।

________

দুপুরের দিকে বরযাত্রী এলো। বাড়িতে তখন লোক সমাগম। পার্লার থেকে কয়েকজন এসে আপুকে সাজিয়ে দিয়েছে। সারাটা দিন আপু মূর্তির মতো রইলো। কারো সাথে কথা বললো না। কিছু খেল না। মাঝে মধ্যে উৎসুক দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। আমি জানি নির্দিষ্ট একজনকে খুঁজছিল। কিন্তু সেই একজন তখনো এসে পৌঁছায়নি। তার নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে একজনের জন্য অপেক্ষা লক্ষ্য করলাম। এই অপেক্ষা শেষ অপেক্ষা। এই চোখ দুটো আজকের পর থেকে বাধ্য হবে অন্য একজনের অপেক্ষায় থাকতে। তখন হাজার চাইলেও এই মানুষটার অপেক্ষায় থাকা হবে না!

বিকেলের দিকে কাজী এলো। বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। পুরোটা সময় অনেক ভয়ে ছিলাম। আপু কবুল বলতে গিয়ে হয়তো কান্না করবে। সহজে বলতে চাইবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে কাজীর সাথে সাথে পর পর তিনবার কবুল বলে দিল। একফোঁটা চোখের জল ফেললো না। কেমন পাথরের মতো রইলো। ভয় হতে লাগলো আমার।

ঘরভর্তি মানুষ। আমি বেরিয়ে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে কারো হাত এসে বু’কে লাগলো। ভয়ে চমকে উঠলাম আমি। গা ঘিনঘিন করে উঠলো। তাকিয়ে দেখি রাজ ভাইয়ার মামা। আলতাফ মামা! অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। যেন কিচ্ছু হয়নি! কিন্তু আমি জানি উনি ইচ্ছে করে এই কাজ করেছে। ঘৃনা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছুটে বেরিয়ে এলাম। কান্না পেয়ে গেল। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খানিক কাঁদলাম। এ বাড়ির কেউ জানলো না। কেউ টের পেল না!

সন্ধার আগে আগে বাড়ি খালি হতে লাগলো। আজাদ আঙ্কেলের পরিচিত অনেক ব্যক্তি বর্গ এসেছিল। তারা খেয়ে তখনই চলে গেছে। সন্ধার পর বরযাত্রী রওনা করার জন্য উঠলো। ফাইজান ভাই তখনো আসেনি। কয়েক বার ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি। জাবির নিজে থেকে গাড়ি নিয়ে মিরপুর গিয়েছিল। তাকে আনতে! খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। ফাইজান ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তালা। তারা নাকি খুলনা গিয়েছে। এই সংবাদ সামান্তা আপুর কানে গেছে।

পরিশেষে, বিদায়ের সময় সামান্তা আপু হাউমাউ করে কান্না করলো। সারাদিনের সমস্ত কাঠিন্যতা গলে তরল হয়ে গেল। আর আড়ালে রাখতে পারলো না নিজেকে। শক্ত খোলসে আবৃত রাখা নিজেকে মেলে দিল সবার সামনে। কান্না করতে করতে অসুস্থ প্রায়! তাকে ধরে বরযাত্রীর গাড়িতে তুলে দিল। বাগানের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আমি স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেখলাম। একটা মেয়ের এতগুলো বছরের সাজানো সংসার ভেঙ্গে যেতে দেখলাম। বুকের ভেতর দহনে পুড়ে উঠলো।

এই মানুষটা তবুও বেঁচে থাকবে। নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুনবে। একটা গভীর ক্ষত সারাজীবন নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখবে। মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ মনে করে বালিশ ভিজাবে। শ্রাবণঝরা সন্ধায় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়বে। কোনো একাকী বিষণ্ণ বিকেলে হুট করে মনে পড়ে যাবে। মনের কোনো কোণে জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে কাছে না পাওয়ার আফসোস সারাজীবন থেকে যাবে। ভালোবাসায় এতো যন্ত্রণা কেন?

(চলবে)