ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-২৩+২৪

0
145

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-২৩+২৪

মনের কোনো এক কোণে প্রিয় মানুষটাকে না পাওয়ার তীব্র আফসোস সারাজীবন থেকে যাবে। ভালোবাসায় এতো যন্ত্রণা কেন?

সামান্তা আপুকে বিদায় দেওয়ার পর সবাই মনমরা হয়ে রইলো। জুলি আন্টির কান্না এখনো থামেনি। দাদী বিলাপ করে কাঁদছে। বড় মা তার পাশে বসে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন,

‘শুধু রাতটুকু অপেক্ষা মা। ভোর হলে দেখতে যাবেন তো আপনি। এখন কান্না করবেন না। অসুস্থ হয়ে যাবেন।’

বড় মা ঠিকই বলেছে। দাদীর শরীর দিন কে দিন ভেঙ্গে যাচ্ছে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে। গলার সেই তেজ আর নেই। তবে মানুষটা তার নাতি-নাতনীদের ভীষণ ভালোবাসে। সামান্তা আপুর চলে যাওয়ায় ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে।

ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের অনেকে রয়ে গেছে। কাল বৌভাতে যাবে। তার অপেক্ষা! কেউ কেউ জামা কাপড় কোনটা পরবে তার পরিকল্পনা করছে। আমি ঘরে চলে এলাম। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। আজ অনেক বেশি কান্না করা হয়েছে। সাথে ছুটোছুটি করে কাজ করেছি। এখন শরীর ভেঙ্গে আসছে। সাথে জ্বর জ্বর অনুভূত হলো। কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরখ করলাম। গা গরম! আর দেরি করলাম না। গুটিশুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নতুন জামা গায়ে রয়ে গেল। পরণের থ্রি পিসটা সামান্তা আপু পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল। আমারো অনেক পছন্দের। পছন্দের জামাটা গায়ে দিয়ে ঘুমালে কুঁকড়ে যাবে। মনে দুঃখ হলেও পাত্তা দিলাম না। কত পছন্দের জিনিসই তো হারিয়ে গেল। তবুও তো বেঁচে আছি!

মাথার ভেতর দুরন্ত বেগে কিছু ছুটে চলেছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ব্যথায় দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। হাঁসফাঁস লাগছে! বুকের ওড়নাটা সরাতে বিকেল বেলার ঘটনা মনে পড়ে গেল। শরীর ঘিন ঘিন করে উঠলো। দুচোখ বেয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়লো। এই কুৎসিত ঘটনা টা কী কোনোদিন কাউকে বলা হবে? আমি জানি হবে না! কিছু জিনিস কখনো কাউকে বলা যায় না। রাজ ভাইয়া যে আমায় চুমু খেয়েছিল সেটা কোনোদিন কাউকে বলতে পারবো? পারবো না!

আচমকা মুখভর্তি বমি পেয়ে গেল। একলাফে উঠে বাথরুমের দিকে দৌঁড় শুরু করলাম। কোনরকমে বাথরুম অবধি পৌঁছে বমি করে দিলাম। আজ সারাদিন তেমন খাওয়া হয়নি। দুপুরে একটু খেয়েছিলাম তার সবটা বেরিয়ে গেল। নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়ালাম। কুলি করে, হাতেমুখে পানি ছিটিয়ে বের হলাম। আসার আগে বাথরুমের মেঝে ধুয়ে দিয়ে আসলাম।

রুম অন্ধকার করে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে আলো জ্বলে উঠলো। বন্ধ চোখজোড়া আরো কুঁচকে গেল। কপালে বিরক্তির কিছু রেখা দৃশ্যমান হলো। তার মাঝে খালার কণ্ঠ কানে এলো,

‘ফুল কী হইছে তোর? এমন কইরা শুইয়া আছস ক্যান?’

‘ঘুম পাচ্ছে খালা। ক্লান্ত অনেক। অনেক রাত হয়ে গেছে তো।’

খালাকে মাথা ব্যথার কথা বললাম না। বমির কথাও বললাম না। চিন্তিত হয়ে পড়বে। সে বলল,

‘জামাডা খুইলা শুইতি। নতুন জামা পইরা ঘুম হইবো?’

‘হবে খালা। তুমি বাহিরের দিকটা একটু দেখো। আমার খোঁজ করলে বা কোনো কাজ করতে হলে তুমি করে দিয়ো।’

‘আচ্ছা। ঘুমা তুই।’

আর কথা বাড়ালাম না। মটকা মেরে পড়ে রইলাম। খালা গায়ের কাপড় পাল্টে পুরাতন কাপড় পরে নিল। যাওয়ার সময় বাল্ব বন্ধ করে গেল। বলল,

‘গরমের মধ্যে ফ্যান ছাড়া নাই কান? ছাড়বো?’

‘না। থাক খালা!’

বাহির থেকে দরজা ভেড়ানোর শব্দ কানে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে পরে রয়েছি আমি। মাথা ব্যথার যন্ত্রণা অসহ্য পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হাতুড়ি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে ভেতরে দেখি কী হয়েছে। একহাতে চুল টানতে লাগলাম। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। সেই পরিচিত কর্কশ সুর। ফোন হাতের নাগালের বাইরে। টেবিলের উপর রাখা। রিসিভ করতে হলে উঠতে হবে। এতটুকু যদি শক্তি থেকে থাকে! তবুও সামান্তা আপুর কথা ভেবে অনেক কষ্টে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিলাম। দেখি রাজ ভাইয়ার নাম্বার। ক্ষনিকের জন্য উত্তেজনায় হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেলো।

রাজ ভাইয়া এতদিন ফোন দেয়নি। এতোবড় একটা কাজ করেও ঘাপটি মেরে বসে ছিল। আমি ক্ষীণ আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। এতোবড় একটা ঘটনা ঘটিয়েছে। সাথে আমার নাম জড়িয়েছে। নিশ্চয়ই আমায় জানাবে। কিছু একটা বলবে। কিন্তু কিছু জানায়নি। ইচ্ছে করে ফোন ধরলাম না আজ। বালিশের নিচে দিয়ে রাখলাম।

দ্বিতীয় বার ফোন বেজে উঠলো। রাজ ভাইয়া বাড়ি নেই। সামান্তা আপুর সাথে গেছে। জাবির আর সে দুজনেই গেছে। আপু অনেক বেশি কান্না করছিল। অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে তাদের যাওয়া। নওশাদ আঙ্কেলও সাথে গেছেন। আঙ্কেলের রাতে চলে আসার কথা।

নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হতে ফোন কেটে গেল। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। মস্তিষ্কে কিছু একটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তবুও কিছুক্ষণ অপেক্ষায় রইলাম। ভেবেছিলাম আরেক বার ফোন দিলে রিসিভ করবো। কিন্তু আর ফোন বাজলো না। এখন প্রায় মধ্যরাত। রাজ ভাইয়া হয়তো ভেবেছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পাশ ফিরে বালিশে মাথা রাখলাম।

_________

দুপুরের আগে আগে বাড়ি সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল। সবাই দল বেঁধে সামান্তা আপুর বৌভাতের অনুষ্ঠানে গেছে। অনুষ্ঠান নাকি বড়সড় কোনো কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত হয়েছে। মুখে মুখে শুনলাম শুধু। আমার যাওয়া হলো না।

বড় মা একবারও যেতে বললেন না। বলার কথা না। রাজ ভাইয়া ওই অনুষ্ঠানে রয়েছে। আমার যাবার প্রশ্নই উঠে না। যাওয়া হলো না সালেহা খালারও। বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল সব পরিষ্কার করতে হবে। পুরো দুই তলা ধুয়ে মুছে সাফ করতে হবে। গোছগাছ করে রাখতে হবে। আজ নতুন জামাই আসবে।

আমি আর খালা কাজে লেগে পড়লাম। সন্ধার পর সামান্তা আপুকে নিয়ে ফিরবে। তার আগে আগে সব গুছিয়ে রাখতে হবে। আবার হরেক পদের রান্না করতে হবে। আমরা ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

দুপুরের পর পর সাত আট জন অপরিচিত লোক এলো। রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম আমি।তাদের সাথে এক মধ্য বয়স্কা মহিলা আছে। আজাদ আঙ্কেল তাদের সবাইকে উপরে নিয়ে গেলেন। বড় মা আর জুলি আন্টি বাড়ি ছিল। তারা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের হালকা নাস্তা করিয়ে অন্যান্য খাবার দাবার রান্না শুরু করলো। খানিক আগে ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস বের করে রেখেছিলাম। সেটা ধোয়া শুরু করলেন বড় মা। হঠাৎ জুলি আন্টি আমায় বাইরে ডাকলেন।

রান্নাঘর থেকে বের হলাম। আন্টি দরজার ওপাশে ছিল। আমার হাতে কয়েকটা ব্যাগ ধরিয়ে দিল। বলল,

‘ভালো করে গোসল করে এগুলো পরে নাও।’

জুলি আন্টি আমায় তুই তুকারি করে ডাকতো। আজ হঠাৎ তুমি বলায় কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলাম। পরক্ষণে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম,

‘এগুলো কী?’

বড় বড় তিনটে ব্যাগ। মুখ আটকানো। ভেতরে কী আছে দেখা যাচ্ছে না। সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। মনে অবশ্য ক্ষীণ আশা জাগলো। সামান্তা আপুর বৌভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বলছে? আপুর বিয়ে উপলক্ষে সবার জন্য দামী দামী শপিং করেছে। হয়তো আমার জন্যও! আন্টি হঠাৎ ইতস্তত করে বলল,

‘আজাদ ভাই ডাকে তোমায়। ওগুলো ঘরে রেখে আসো।’

আজাদ আঙ্কেল কে ভীষণ ভয় পাই আমি। আবার সমীহ করি। তুমুল রাগ তার। রেগে গেলে হিতাহিত বোধ থাকে না। প্রায়ই বড় মায়ের গায়ে হাত তুলে। প্রথমদিকে ভারী অবাক হলেও এখন অবাক হই না। সহজ হয়ে এসেছে বিষয়টা। এ বাড়িতে আছি দীর্ঘদিন। কিন্তু আঙ্কেল তেমন করে কখনো আমার সাথে কথা বলেনি। আজ যখন আলাদা করে ডেকেছে নিজের অজান্তে ভয় পেয়ে গেলাম। কেন জানি মনে হলো রাজ ভাইয়া ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে।

আঙ্কেল তার নিজের ঘরে। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এ ঘরে প্রায় আসা হয়। ঘর গোছগাছ করা আর পরিষ্কার করার জন্য। কিন্তু তখন আঙ্কেল থাকেন না। আজ ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকতে বিস্ময় এসে গ্রাস করলো। সালেহা খালা আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে এক নজর দেখে খালা দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

আমি মৃদু স্বরে সালাম দিলাম। আঙ্কেল বিছানায় বসে ছিলেন। আমায় দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। টেবিল থেকে চশমাটা চোখে পড়ে ফের বিছানায় বসলেন। বললেন,

‘যা বলার সালেহাকে বলে দিয়েছি। আবার বলছি। বিয়ের ব্যবস্থা করেছি তোমার। আজই বিয়ে হবে।’

বুকের ভেতর আঁতকে উঠল। শরীর জমে এলো। বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইলাম। মাথা ঝিমঝিম করছে। তিনি বললেন,

‘বিয়ের বয়স হয়ে গেছে তোমার। কাজের লোকদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাড়ির মালিকের। বড় ঘরে বিয়ের ব্যবস্থা করেছি। ছেলের অঢেল টাকা পয়সা। ধন সম্পদের অভাব নেই। বাড়ির কাজের লোকের জন্য যতটুকু করা দরকার তার চেয়ে বেশি করেছি। তুমি আমার মেয়ের মতো। আজ একটা নিজের মেয়ে থাকলে এতটুকু করতে হতো। সেটা মনে করে সব আয়োজন করেছি। বিয়েটা করে নাও!’

‘কী বলছেন এসব আপনি?’

জড়ানো গলায় বললাম আমি। ধপ করে আঙ্কেলের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। সাদা চশমার বাহির দিয়ে সে আগুনের হল্কা বের হচ্ছে যেন। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। বললেন,

‘সালেহা মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলো। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রেডি করে ফেলো। আমাকে আবার একবার সামান্তার রিসেপশনে যেতে হবে।’

‘জ্বি ভাইজান।’

কিছু বলতে যাচ্ছিলাম আমি। খালা হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো। অথর্বের মতো সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। শরীর কাঁপছে থরথর করে। এটা কী শুনলাম? বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমায়? এভাবে? শ্বাসনালি আটকে আসছে যেন! খালা টেনে রুমে নিয়ে গেল। বলল,

‘মনে মনে এই ভয়ডা পাইতেছিলাম। জোর কইরা বিয়া না দিয়ে দেয়! হেইডাই হইলো। কী করবি এহন? আর কোনো পথ আছে?’

বোধশূন্য হয়ে বসে রইলাম। চিন্তা ভাবনার সমস্ত শক্তি লোপ পেয়েছে। বিয়ে শব্দটা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল। খালা হঠাৎ পাশে বসে পড়লো। হাত চেপে ধরে বলল,

‘ফুল, পালিয়ে যা। টিহা পয়সা কিছু আছে তোর কাছে?’

আমি ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। টাকা পয়সা কিছু নেই। আব্বার চিকিৎসার সময় সব শেষ হয়ে গেছে। খালা অসহায়ের মতো পায়চারি করলো। খানিক বাদে বলল,

‘ফাইজান রে জানাবি?’

ফাইজান ভাইকে জানিয়ে কোনো লাভ নেই। তার নতুন সংসার হয়েছে। সন্ধি ভাবির মনোভাব ভাইয়ের মতো না। আমাকে নিয়ে তাদের মধ্যে অশান্তি হবে। তা চাই না আমি। তবুও আর কোনো উপায় চোখে দেখছি না। চারিদিকে শুধু অন্ধকার যেন! কিছুক্ষণ বিমূঢ় থেকে অবশেষে তাকে ফোন দিলাম। একবার, দুবার, তিনবার! কল ঢুকলো না। ফাইজান ভাইয়ের ফোন বন্ধ। অসহায়ত্বে চারপাশ ভরে গেল। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। খালা পাশে বসে স্বযত্নে চোখ মুছে দিল। বলল,

‘বিয়াডা না হয় কইরা নে ফুল। এ বাড়ির ছায়া অনেক আগে উইড়া গেছে। রাজ এই পরিবারের বড় ছেলে। বলতে গেলে একমাত্র সন্তান। ওর ভালোর লাইগা যা করা দরকার সব করবো। তুই বিয়া না করলে হয়তো মাইরা লাশ গুম কইরা দিবো।’

আমি নিরুত্তর। খালা নিজে থেকে বলল,

‘পড়াশুনাডা তো ভালো মতো করার সুযোগ পাস নাই। এবারে যা পরীক্ষা দিছস আইসা বললি তিনডাতে ফেল আসবো।’

বড় মা এলো। খালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘তুই রান্নাঘরের দিকটা দেখতো। মাংস বসিয়ে আসছি।’

খালা অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে গেল। বড় মা এগিয়ে এলেন। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। অনুরোধ করে বললাম,

‘বড় মা আমি এখনি বিয়ে করতে চাই না। দয়া করে কিছু একটা করুন। বিয়ে করতে চাই না আমি।’

‘জুঁই শান্ত হ।’

বড় মা কাছে এসে বসলেন। বললেন,

‘বিয়ে করবি না কেন? মেয়েদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তার স্বামীর বাড়ি। তার স্বামী সবচেয়ে আপন। এই যে এখন তোর অনিশ্চিত জীবন, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ! এসব কিচ্ছু থাকবে না। স্বামীর সংসারে গেলে নিজের মতো সব করতে পারবি। এমন পরাধীনতায় দিন কাটাতে হবে না। নিজের সংসার যেভাবে পারিস সেভাবে সাজাতে পারবি। গুছিয়ে নিতে পারবি। এর চেয়ে সুন্দর কিছু আছে?’

কান্না থামছে না আমার। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বিয়ে, স্বামী, সংসার এসব নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। সব বুঝি আজ ভেঙ্গে চূড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এতো কষ্ট কোথায় রাখবো? বড় মা ফের বললেন,

‘রাজ তোর প্রতি দূর্বল না জুঁই। ওর বাবার প্রতি প্রচন্ড রাগ, তীব্র আক্রোশ। ওর বাবার সম্মান ধূলিসাৎ করার জন্য তোকে বিয়ে করতে চাইছে। সেই আক্রোশ থেকে এমন একটা কাজ করতে চাইছে। যদি এমনটা হতো যে রাজ তোকে সত্যি সত্যি পছন্দ করে তখন না হয় ভেবে দেখতাম। যদিও সেটা কখনো সম্ভব ছিল না।’

‘কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে কিভাবে করব বড় মা। এটা কী করে সম্ভব?’

‘তোকে এ বাড়িতে রাখা নিরাপদ নয়। সামনে সিটি কর্পো’রেশনের নি’র্বাচন। সেই নি’র্বাচনে জয়লাভের জন্য তোর আঙ্কেল দিনরাত পরিশ্রম করছে। আর ছেলেটা? বাবাকে পেছন থেকে টেনে হিচড়ে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে।’

কান্নার বেগ বেড়ে গেলো আমার। তাদের বাবা ছেলের দ্বন্দ্বে আমার জীবন কেন বলি হবে? বড় মা হঠাৎ হাত জড়িয়ে ধরলেন আমার। বললেন,

‘পাগলামি করিস না জুঁই। বিয়েটা করে নে। আমি খোঁজ খবর নিয়েছি। ছেলেটা ভালো। তোর আঙ্কেলকে অনেক সম্মান করে। তোকে ভালো রাখবে। আর তুই যদি পড়াশুনা করতে চাস সেটাও করাবে।’

আর পড়াশুনা! কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। জীবন থেকে পালিয়ে যেতে মন চাইছে। মায়ের আঁচলের তলায় লুকোতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকালাম। বড় মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। গাঢ় মমতা মাখিয়ে বললেন,

‘তোকে দুই বছরের বেশি হলো দেখছি। দেখেশুনে বড়ো করেছি। আমি তোর মায়ের মতোই। আমি বলছি বিয়েটা করে নে। তোর খারাপ হবে না! দুয়া করি, অনেক সুখী হবি।’

বড় মা বের হয়ে গেলেন। ভেতরে ঢুকলেন জুলি আন্টি। এসে তাড়া দিলেন তৈরি হওয়ার জন্য। আমি খুব করে বুঝতে পারছি রাজ ভাইয়া, জাবির, সামান্তা আপু এরা আসার আগে ভাগে কাজ সেরে ফেলবে। এখন কী করণীয় আমার? রাজ ভাইয়া যে তার বাবাকে দুঃখ দেওয়ার জন্য আমায় বিয়ে করতে চেয়েছে সেটা আমিও জানি। তাই বলে আমি কী করে এখন অচেনা একজনকে স্বামী বলে কবুল করে নিবো?

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। জুলি আন্টি আবার তাড়া দিল। এক সেকেন্ডের জন্য সে রুম ত্যাগ করলো না। সালেহা খালাও আর এলো না। শেষমেশ আন্টির ধমকা-ধামকিতে কাপড় পাল্টাতে হলো। গোসল না করা হলো না। জুলি আন্টি এমনিতে শাড়ি পরিয়ে দিল। পুরোটা সময় আমি নিরবে কেঁদে গেলাম।

চারিদিকে আসরের আযান পড়ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে যাবো। কোথায় যাবো জানি না। কিন্তু পালাতে হবে আমায়। তড়িৎ গতিতে উঠতে গিয়ে বাঁধা পড়লো। জুলি আন্টি এখনো আমার পাশে বসে। এক সেকেন্ডের জন্য একা ছাড়েনি। সেই সময় কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলাম। খুব করে উপলব্ধি করলাম পালানোর সব রাস্তা বন্ধ! কোনো উপায় রাখেনি তারা।

রুমের বাইরে কী হলো জানি না। খানিক বাদে বয়স্ক এক কাজী এলো। সাথে আরো কয়েকজন। সবাই সম্মিলিত হয়ে বার বার কবুল বলতে বললো। আমি ঝাপসা চোখে চারিদিকে তাকালাম। কোথাও কাছের কেউ, আপন কেউ চোখে পড়লো না। আব্বা-মা, বড় আপা, সেজো আপা কেউ নেই! বড় আপা একবার বলেছিল, জ্যোতির বিয়েতে অনুষ্ঠান করা হবে না। জুঁই, তোর বিয়েতে বড় করে অনুষ্ঠান করবো। এক গ্রাম লোক দাওয়াত দিবো। বুঝলি, কোনো উপহার নিবো না! সবাইকে বলবো খেয়ে আমার ফুলের মতো বোনটার জন্য দুয়া করে যাবেন। কেমন হবে বলতো? কোনো একদিন অতো টাকা হবে না?

বাস্তবতা নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। এর থাবা থেকে দরিদ্র, অসহায় কখনো মুক্তি পায় না।

কানের চারপাশে সবাই কবুল বলার জন্য অস্থির করে তুলছে। অবশেষে আমি মুখ খুললাম। তীব্র অভিমান নিয়ে, ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে কবুল বলে দিলাম। তৃতীয় বার কবুল বলার সময় প্রথম কানে আসলো যাকে স্বামী বলে স্বীকার করে নিলাম সে সোহরাব নামের কেউ!

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব__২৪

তৃতীয় বার কবুল বলার সময় প্রথম কানে আসলো যাকে স্বামী বলে স্বীকার করে নিলাম সে সোহরাব নামের কেউ। অবশেষে সবাই খুশি হলো। বয়স্ক কাজীর সুরে সুর মিলিয়ে কয়েকজন আলহামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করলো। তারা বের হয়ে যেতে জুলি আন্টি নড়েচড়ে উঠল। এতক্ষণ আমায় আটকে রাখা তার হাতটা ঢিলে হয়ে এলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। যেন বড়ো কোনো ঝামেলা ঘাড় থেকে নামলো। বড় মাকে কি যেন বলে বের হয়ে গেল সে।

বিয়ের কাগজ পত্রের কী ব্যবস্থা করলো জানলাম না। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘর খালি হয়ে গেল। সম্পূর্ণ ফাঁকা! আমি ঝাপসা চোখে এদিক সেদিক তাকালাম। বার বার সেজো আপার কথা মনে পড়ছে। আপা নিশ্চয়ই দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। আমার দুঃখ দেখে! আমার চেঁচিয়ে তাদের ডাকতে ইচ্ছে হলো। সে রাতে কেন মরণ হলো না আমার? তাহলে তো এই দুঃখের সাগরে জীবন তরী আটকে যেতো না। নিজের অনিচ্ছ্বায় কবুল বলতে হতো না! আমার পড়াশুনা না জানা মা তবুও বিয়ের সময় সেজো আপার মতামত জিজ্ঞেস করেছিল। বড় আপার বিয়ের সময় আপা রাজি কি না জানতে চেয়েছিল। অথচ এতো এতো শিক্ষিত মানুষজন একটি বারের জন্য আমার মতামতের প্রয়োজন অনুভব করলো না। আমার জীবন এমন হলো কেন?

ডাইনিং এ খানাপিনা চলছে। আমার ঝাপসা চোখ জোড়া রুমের দেয়ালে আটকা রইলো। দেয়ালের একপাশে ছোটখাটো একটা জানালা আছে। দেড়-দুই হাত লম্বা জানালা। তা দিয়ে বাহিরের আলো তেমন প্রবেশ করে না। তবুও আমার ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা। প্রায় রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। উদাস দৃষ্টি ঘুরপাক খেতো বাহিরের অন্ধকারে! পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। আমার কতশত নির্ঘুম রাতের সাক্ষী এই জানালা।

সেই জানালার ওপাশ থেকে শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে কুকুরের ডাক! প্রায়ই ওপাশে একটা একটা নেড়ি কুকুর দেখতাম। আজ কী ওর মন খারাপের দিন? কেমন আকুল হয়ে ডাকছে। বিষণ্ণ সে কণ্ঠ থেকে দুঃখ ঝরছে। মনে হচ্ছে ইনিয়ে বিনিয়ে কাদঁছে। চারিদিক নিঃস্তব্ধ! সেই নিঃস্তব্ধতার পর্দা চিঁড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। খালা দরজার বাহির থেকে ছুটে এলো। এসে বুকে আগলে নিল। তাকে জড়িয়ে আমি মরা কান্না কাঁদলাম। আমার স্বপ্ন মরে গেছে! ভালোবাসা মরে গেছে। এতগুলো বছরের সাজানো সংসার মরে গেছে! আমি বাঁচবো কী নিয়ে!

তখন সন্ধ্যা হয়নি। কয়েকজন মিলে আমার সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল। এতটুকু স্মৃতিচিহ্ন রাখলো না। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। বড় মা একসময় বললেন,

‘ওরা বের হয়ে পড়েছে জুঁই। চল!’

বড় মায়ের ভেজা গলা। আমি প্রতিত্তরে কিছু বললাম না। আমার যা ক্ষতি হওয়ার তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম। তাদের পিছু পিছু এসে বড়সড় এক মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। সালেহা খালা কাছে এলো না। আমি টের পেলাম দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে সে। আমি মনে মনে তার থেকে বিদায় নিলাম। খুব করে বুঝতে পারলাম এ বাড়িতে আমার আর ফেরা হবে না। কোনোদিনই না!

গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে বাড়িটার দিকে তাকালাম। কতশত স্মৃতি এই বাড়িতে জমা রয়ে গেল। এরা কী মনে রাখবে আমায়? এ বাড়ির ইট পাথর কখনো কী স্মরণ করবে? আমার কথা ভেবে দুঃখ পাবে? পাবে না! বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত ছাড়া পৃথিবীতে কেউ কাউকে চিরদিন স্মরণ রাখতে পারে না। দিনশেষে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কাছে সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। এ বাড়ির সমস্ত স্মৃতি পায়ে পিষে রেখে এগিয়ে চললাম। শুধু ছাদের এক কোণে পড়ে রইলো মৃতপ্রায় জুঁই ফুলের চারাটা। গাছটাতে কেউ এখন পানি দিবে?

শেষ বেলায় মঈন চাচার কথা মনে পড়লো। চাচা সামান্তা আপুর বৌভাতের অনুষ্ঠানে গেছে। গাড়ি নিয়ে। সে জানলো না এপাশে কি হয়ে গেল।

গাড়ি চলা শুরু করেছে। মাইক্রোবাসের পেছনে ছয়জনের বসার মতো জায়গা। আমি বাদে আরো তিনজন বসেছে। জায়গা অনেক ফাঁকা রয়েছে। জানালা ঘেঁষে বসা আমি। আমার বামপাশে বসেছে সেই মধ্য বয়স্কা মহিলা। রান্নাঘর থেকে যাকে দেখেছিলাম। আমি তখনো নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছি। তিনি হাত চেপে ধরে বললেন,

‘কান্না করে না মা! কী নাম তোমার?’

আমি রুদ্ধ গলায় জবাব দিলাম,

‘জুঁই!’

‘বাহ! সুন্দর নাম। যাদের ফুলের নামে নাম হয় তারা মানুষও ফুলের মতো নরম হয়। পবিত্র আর সুন্দর হয়। এইটা কিন্তু কথার কথা না! একশো ভাগ সত্যি কথা।’

পরক্ষণে তিনি বললেন,

‘ওহ্ হো। আমার পরিচয় বলা হয় নাই। আমি সোহরাবের ফুপি। একমাত্র ফুপি। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নারায়ণগঞ্জের উত্তর দিকের এক স্কুলে শিক্ষকতা করি।”

ফুপি থামলেন। আমাকে উৎসাহহীন দেখে চুপ হয়ে গেলেন। খানিক বাদে আমায় রেখে নিজেদের মধ্যে কথার আদান প্রদানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি বিমূঢ় হয়ে বাইরে তাকালাম। কাচের ওপাশে একটা সন্ধ্যা নামার প্রস্তুতি চলছে। অস্তগামী সূর্য কমলা রঙের হয়ে গেছে। এই ভরা সন্ধায় এরা কোথায় নিয়ে চলেছে আমায়? এই বিধিলিপিতে আর কী কী লেখা আছে?

________

কতক্ষণ গাড়িতে ছিলাম হিসাবে নেই। গাড়ি যখন থামলো ততক্ষনে চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। অন্ধকারের গভীরত্ব দেখে বুঝতে পারলাম রাত ঢের হয়েছে। সদ্য নতুন পরিচয় পাওয়া ফুপি পাশ থেকে উঠে পড়লেন। আগে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। আমার দরজার এপাশে এসে খুলে দিলেন। বললেন,

‘গাড়ি থেকে নামো তাইলে।’

আমি নামলাম। তিনি হাত ধরে এগিয়ে চললেন। পেছন ঘুরে একবার বললেন,

‘সোহরাব ব্যাগ গুলো উপরে নিয়ে আয়।’

তখনো আমি সোহরাব নামের মানুষটিকে দেখিনি। ফুপুর সাথে গেট অবধি পৌঁছাতে একটা মেয়ে ছুটে এলো। আধুনিক বেশভূষা। অন্ধকারে বয়স ঠাওর করতে পারলাম না। সে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,

‘আমি নাহার। সোহরাবের বড় বোন।’

আমি ধরা গলায় তাকে সালাম দিলাম। সে কাছে টেনে নিল। বলল,

‘ভেতরে চলো। রুমে গিয়ে কথা হবে। ফুপি চলো তো!’

লম্বা মতন এক ছেলে এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। এসে ঝরঝরে সুরে বলল,

‘আপা। উপরে চলো। গেটের সামনে এভাবে কেউ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে? আশপাশের বাসা থেকে সবাই উঁকি দিচ্ছে। ভেতরে গিয়ে কথা বলো।’

বলে সে আমাদের আগে আগে গেল। আমি পেছন থেকে এক নজর দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তাহলে এই ছেলেটির সাথে আমার বাকি জীবনটা কাটাতে হবে? এমন অচেনা, অজানা একজনের সাথে পথ চলতে হবে? কেমন হবে এ চলা?

ছোট্ট একরুমে বসে আছি। জায়গা কম হলেও গুছিয়ে রাখা। বিছানা পত্র চকচকে। রুমের সাজসজ্জা না থাকলেও প্রয়োজনীয় সব জিনিস দেখা যাচ্ছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম সব। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। কাল এই সময়ে সামান্তা আপুর সাথে ছিলাম। আপু একটু পর পর কান্না করছিল। তার চোখের জল সযত্নে মুছে দিচ্ছিলাম। এখন আমার চোখের জল মুছে দেওয়ার কেউ নেই। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জীবনে কতবড় ঘটনা ঘটে গেল। বিয়ে করে নিয়েছি আমি! কারো বউ এখন আমি। স্মরণ হতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।

নাহার আপু রুমে এলো। বড় হাসিখুশি চেহারা। এবারে সে একা নয়। তার সাথে বাচ্চা এক মেয়ে। মেয়েটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আশা তোমার মামী। নতুন মামী এটা!’

ভদ্রতা সুলভ মেয়েটাকে কাছে টানলাম। কাছে এলো না সে। হাত থেকে ছুটে দূরে সরে গেল। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। তার বড়বড় চোখ দুটো অবাক হয়ে আমায় দেখছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার পুতুলের কথা মনে পড়ে গেল।

‘জুঁই। খিদে পায়নি? চলো ভাত খাবে।’

আমি মাথা নাড়লাম। ভাত গলা দিয়ে নামবে না। ক্ষুধা লেগেছে কি না তার অনুভব শক্তি নেই। নাহার আপু জোর করলো। বলল,

‘চলো কয়েক লোকমা খাবে। আশা তোমার মামীকে ডাকো তো। বলো, চলো মামী। ভাত খাই!’

আশার মধ্যে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে আগের মত বড়বড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। বিস্ময় নিয়ে দেখছে নতুন অতিথিকে। নাহার আপু হঠাৎ দুঃখ নিয়ে বলল,

‘আশার আব্বু অসুস্থ। অ্যাকসিডেন্ট করে পা ভেঙ্গে ফেলেছে। মাথায় চোট পেয়েছে। পাঁচটা স্টিচ দিতে হয়েছে। হাঁটাচলা করতে পারে না। তাকে এই অবস্থায় রেখে তোমাদের বিয়েতে উপস্থিত হতে পারলাম না। তবুও গতকাল সাথে থেকে কিছু শপিং করেছি।’

খটকা লাগলো আমার। গতকাল বিয়ের বাজার-ঘাট করে রেখেছে? তার মানে সবটা পরিকল্পিত। আজাদ আঙ্কেল হয়তো সোহরাবকে আমার ব্যাপারে অনেক আগে থেকে বলে রেখেছে। মনঃক্ষুণ্ণ হলো আমার। দৃষ্টি নত করে রইলাম।

‘চলো ভাত খাবে।’

‘আমি কিছু খাবো না আপা।’

ভেজা গলায় উত্তর দিলাম। নাহার আপা টেনে দাঁড় করাল। বলল,

‘আচ্ছা না খেলে। জোর করছি না। চলো, আশার আব্বুর সাথে দেখা করে আসো।’

তার সাথে যেতে হলো আমায়। কয়েক হাত ড্রয়িং রুম। সেখানে সোফায় ফুপি বসে ছিল। বিশ্রাম করছে। আমি আপার পিছু পিছু বড় ঘরটাতে ঢুকলাম। ক্ষীণ সুরে সালাম দিলাম। সালামের উত্তর এলো সঙ্গে সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি একের পর এক প্রশ্ন করলো। আমি দম বন্ধ রেখে তার কৌতূহল মেটালাম। একসময় সে প্রশ্ন পর্বে বিরতি নিল। আমায় ফুপি রুমে নিয়ে এলো। তার থেকে যতটুকু শুনলাম তাতে বুঝলাম আমি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় আছি। তিন রুমের এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া করা। সোহরাব অনেক আগে থেকে তার বড় বোনের সাথে থাকে। বিয়ে করে বউ নিয়ে সেই বোনের ফ্ল্যাটেই উঠেছে!

বিছানার পায়ের কাছে জানালা আছে। একপাশের কাচ সরানো। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। তিন তলার উপর থেকে রাতের শহর দেখা যাচ্ছে। সেই শহরের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। এমন একটা শহরে রাফি ভাইয়ের সাথে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখেছিলাম। তা আর হলো কই! এ শহর বড্ড বেঈমান। এ পৃথিবী বেঈমান। ঝাপসা দৃষ্টিতে দুঃখ ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সফল হলাম না।

রুমে আমি ব্যতিত আর কেউ নেই। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগ গুলো এনে মেঝেতে রাখা হয়েছিল। ছোট ব্যাগটা হাতড়ে ফোন খুঁজলাম। পেয়ে গেলাম দ্রুত। অনেক রাত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ও বাড়িতে সবার জানার কথা। কেউ ফোন দেয়নি? খোঁজ নেয়নি আমার? অন্তত মঈন চাচার খোঁজ নেওয়ার কথা। চাচা আজাদ আঙ্কেলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে না। চাকরি চলে যাবে। মাস শেষে যে মোটা অংকের মাইনে পায় সেটা আর থাকবে না। তবে কিছু না বললেও মনে মনে খুবই দুঃখ পাবে।

ফোন বন্ধ ছিল। কে কখন বন্ধ করেছে খেয়ালে নেই। পাওয়ার বাটন চেপে ধরে চালু করলাম। কল লিস্ট গিয়ে কল করতে থমকে যেতে হলো। সিম কানেক্টেড হচ্ছে না। হয়তো সিম ঢিলে হয়ে গেছে। ফাইজান ভাই তখন ফোন তুলছিল না বলে ঢিল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। তখন হয়তো ঢিলে হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে ব্যাটারি খুলে ফেললাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ফোনে সিম নেই। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। নিশ্চয়ই কেউ একজন ফোনের সিম খুলে নষ্ট করে ফেলেছেন। যাতে কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারি! চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত জল গড়িয়ে পড়লো। হাঁটু ভাঁজ করে মাথা রাখলাম। ও বাড়ির সাথে তাহলে আমার সব সম্পর্ক শেষ। সত্যি সত্যি শেষ!

‘ওভাবে মেঝেতে বসে আছেন কেন?’

পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো। উষ্মদায়ক সুর! ভেতরের শীতলতা খানিক হ্রাস পেল। হাঁটু থেকে মাথা তুললাম আমি। সামান্য ঘাড় ঘুরাতে পুরুষ অবয়ব ভেসে উঠলো। বাল্বের পরিপূর্ণ সাদা আলোয় অবশেষে মানুষটাকে দেখলাম। কেউ পরিচয় না করিয়ে দিলেও আমি বুঝতে পারলাম ইনি সেই সোহরাব। স্কুলে একবার ম্যাডাম সোহরাব-রুস্তমের গল্প শুনিয়েছিল। শাহনামা! মহাবীর রোস্তমের সাহসী পুত্র সোহরাব। যে কি না বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিল। একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। মনে অহেতুক প্রশ্ন জাগলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই সোহরাব কতটা সাহসী? সে কি আমায় ভালো রাখার যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে?

‘বিছানায় গিয়ে বসুন। ঠান্ডা লেগে যাবে।’

দ্বিতীয় বার উষ্মতা ছড়িয়ে বলে উঠলো সে। আমি তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। কোনো প্রতিত্তর না করলেও তার অবাধ্য হলাম না। মেঝে ছেড়ে উঠে বিছানায় গিয়ে বসলাম। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। এমন অপরিচিত একজনের সাথে কী করে ঘর করবো!

তখনো নিঃশব্দে কাঁদছিলাম আমি। ভেজা গাল শুষ্ক হওয়ার ফুরসত পাচ্ছে না। তার আগেই আবার ভিজে উঠছে। আমার কান্না দেখে সে কিছু বললো না। আমার পাশ দিয়ে আলনার কাছে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে কাপড় চোপড় নিয়ে বের হয়ে গেল।

গায়ে ভারী কাজের একটা শাড়ি আমার। বিয়ের সাজ বলতে পরণের এই শাড়িটুকু চিহ্ন। আর ছিটেফোঁটা সাজ নেই। উল্টো কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে উঠেছে। মুখ তেল চিটচিটে। গতকাল রাতে মাথা ব্যথা ছিল বলে হাতের তালু বোঝাই করে তেল দিয়েছিলাম চুলে। মা যখন বেঁচে ছিল তখন মাথা ধরলে মা তেল দিয়ে দিতো। চুলে তেল মালিশ করতে করতে সূরা পড়ে ফু দিতো। অলৌকিক ভাবে কিছুক্ষণ পড়ে ব্যথা কমে যেতো।

গায়ের ভেতর কুটকুট করছে। কেউ এসে শাড়ি পাল্টাতে বললো না। একসময় আমি নিজে থেকে কাপড় পাল্টে একটা তাঁতের শাড়ি পড়লাম। এই শাড়ি সালেহা খালার। কোন ফাঁকে ব্যাগে পুড়ে দিয়েছে জানি না। কিন্তু শাড়িটা খালা আমাকে সাথে নিয়ে কিনেছিল।

বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলাম। চোখের ভেতর জ্বালা করছে। কাপড়ের আঁচল দিয়ে ঘষা দিচ্ছিলাম। এমন সময় দ্বিতীয় বার সোহরাব ভেতরে ঢুকলো। ফিটফাট পোশাকের সোহরাবকে দেখে আমার সন্দেহ হলো। এই ফ্ল্যাট, এই বাড়ির মানুষজন, সোহরাব এদের সবাইকে দেখে মোটামুটি উচুঁ পরিবারের মনে হচ্ছে। তারা কেন আমার মতো কাজের লোককে বিয়ে করে আনলো? তারা কী জানে না আমি ও বাড়িতে কাজ করতাম! নাকি লোভে পড়ে?

দরজা বন্ধ করে সোহরাব এগিয়ে এলো। কাছাকাছি এসে বলল,

‘তোমার নাম জুঁই, না? তোমায় প্রথম দেখেছিলাম কয়েক মাস আগে। আজাদ ভাই একটা কাজে ডেকেছিল। কাজ শেষ করে আসার সময় ড্রয়িং রুমে চোখ পড়েছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখা। তুমি খেয়াল করনি। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে টিভি দেজছিলে। ওই প্রথম কাউকে এতো মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখতে দেখলাম।’

শেষ করে সোহরাব হেসে ফেললো। তার কথাবার্তা যে তুমিতে চলে এসেছে হয়তো সে খেয়াল নেই। কিংবা আছে! ইচ্ছে করে তুমি বলছে। আমি বরাবরের মতো নিশ্চুপ। তবে এতটুকু বুঝলাম এই ছেলে আজাদ আঙ্কেলের পেছন পেছন ঘুরঘুর করে। টুকটাক রাজ’নীতিতে যুক্ত আছে হয়তো। এমন ছেলেরা আজাদ আঙ্কেলকে ভাই বলে ডাকে। সেই ভাইয়ের জন্য জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়!

আমার ভাবনার মাঝে সোহরাব অকপটে পাশে এসে বসল।

(চলবে)