ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-১৩+১৪

0
198

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-১৩+১৪

উৎসাহ পেয়ে রাজ ভাইয়া আর অপেক্ষা করলো না। মুহূর্তের মধ্যে আমার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। এটা কি হলো? বিমূঢ় হয়ে তাকালাম একবার। রাজ ভাইয়া পাত্তা দিল না। দরজা বন্ধ করে আয়েস করে বসলো। এদিকে কাঁচুমাচু হয়ে গেলাম আমি। ভেতরটা অস্বস্তিতে টইটুম্বুর হয়ে গেল। সামান্তা আপুর ওপাশে গিয়ে বসলে কী খুব ক্ষতি হয়ে যেত? এখন এতখানি পথ যাবো কি করে!

গাড়ি চলা শুরু করেছে। জাকারিয়া ধুমছে গেম খেলছে। এই পিচ্চি সিক্সে পড়ে। কিন্তু ফোনের প্রতি নেশা মারাত্মক। সামান্তা আপু কাউকে মেসেজ করছে। তার চোখে মুখে সেই লাজুক হাসি। আমি না দেখেও বুঝলাম ফাইজান ভাই। ফাইজান ভাই বাড়ি এসেছিল সাত-আট মাস আগে। তার বাবা আজাদ আঙ্কেল কোনো অফিসের কাজে কিছুদিন বাড়ি ছিল না। তখন এসেছিল। ফাইজান ভাই থাকাকালীন সেই গুটি কয়েক দিন সামান্তা আপুর খুশি ধরে না। দু-চোখ জুড়ে মুগ্ধতা শুধু। একটা নির্দিষ্ট মানুষের জন্য মুগ্ধতা। চট করে ধরে ফেলা যায়। শুধু ধরতে পারে না ফাইজান ভাই।

আমার বামপাশে রাজ ভাইয়া। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। কোনো জড়তা নেই। এইদিকে আমি উসখুস করছি শুধু। উনার বাহুতে বাহু আটকে আছে। খালি ডানদিকে চেপে যাচ্ছিলাম। আমায় ক্রমাগত নড়তে দেখে একসময় বিরক্ত হলেন তিনি। মুখ উঁচিয়ে বললেন,

‘সমস্যা কি? এতো নড়াচড়া করছো কেন? কনসেনট্রেট করতে পারছি না।’

আমি প্রতিত্তর করতে পারলাম না। তবে জলের মতো স্থির হয়ে এলাম। সামান্তা আপু এবারে তাকালো। ফোন রেখে বললো,

‘ভাইয়া কিছু বললে?’

‘বলিনি।’

রাজ ভাইয়ার উত্তরে সে বললো,

‘তুমি ফোন রাখো তো ভাইয়া। চলো গল্প করি। তোমার জার্মানির কথা বলো।কোনো বিদেশিনীকে পছন্দ করোনি? কারো প্রেমে পড়নি?

‘আরে ধুর! ওদের মধ্যে পছন্দ করার মতো কিছু নেই। প্রেম তো দূরের ব্যাপার। এই ধর বাঙ্গালী মেয়েরা। এদের ক্ষণে ক্ষণে নাক ফোলানো দেখে প্রেমে পড়া যায়, এদের অস্বস্তির সমুদ্র দেখে প্রেমে পড়া যায়, এদের নিশ্চুপতা উপলব্ধি করেও প্রেমে পড়া যায়।’

সামান্তা আপু হেসে ফেললো। বললো,

‘তোমার মতি-গতি কিছু বুঝি না। জব করবে না কোনো? বিয়ে করবে কবে?’

‘বিয়ে? তোকে বিদেয় না করে বিয়ে করবো কিভাবে?’

‘আমি সারাজীবন তোমাদের বাসাতেই থাকবো। কোথাও যাচ্ছি না!’

আপুর লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠ। আর কিছু বললো না সে। কাচের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। রাজ ভাইয়া ধরতে পারলো না তার আদরের বোনটা ফাইজান ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। জানতে পারলে ভীষণ অবাক হবে।

গাড়ি চলছে মাঝারি গতিতে। বেশিদূর এই গতি ধরে রাখতে পারলো না। জ্যামে আটকে পড়লো। ড্রাইভারের পাশে বসা লতিফ আঙ্কেল বাহিরটা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল। দেখে হতাশ সুরে বললো,

‘দুপুর টাইম এখন। এই জ্যাম সহজে ছাড়বে না।’

সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। তার দেখাদেখি সামান্তা আপুও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। গাড়ির ভেতরে এসি চলছে। ভেতরে শীত শীত। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা কত নির্বিকার। এদিকে আমার নাজেহাল অবস্থা। হয়তো আমার এসি তে থেকে অভ্যাস নেই বলে! গায়ের ওড়নাটা ভালো মতো পেঁচিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।

___________

বহুদিন পর রাফি ভাইয়ের সাথে দেখা। স্কুল থেকে ফেরার পথে। তাকে দেখে আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। কি যে ভালো লাগল। রাফি ভাই রাস্তার বিপরীত পাশে ছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। বললো,

‘তোর সেজো আপা কেমন আছে?’

‘ভালো আছে রাফি ভাই। আপনি কেমন আছেন?’

আমার উৎসাহী কন্ঠের বদৌলতে রাফি ভাই শান্ত, স্নিগ্ধ সুরে বললো,

‘ভালো আছি।’

বলে সে অপেক্ষা করলো না। হাঁটা ধরলো। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। হুট করে পেছন ঘুরে তাকালো। চোখের পলকে কাছে এসে কিছু একটা বললো। আমার বোধগম্য হলো না। বার বার জিজ্ঞেস করলাম আমি। সে আর উত্তর দিল না। হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন।

ধপ করে চোখ খুললাম। ঘুম উধাও হতে বুঝলাম যে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। কি যে মন খারাপ হয়ে গেল! দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে আমার বামপাশের ব্যক্তি নড়েচড়ে উঠলো। চমকে গেলাম আমি। ছিটেফোঁটা ঘুম যা ছিল ছুটে গেলো মুহূর্তে। বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার মাথাটা রাজ ভাইয়ার কাঁধে রাখা। এক লাফে সোজা হয়ে বসলাম। সরলরেখার মতো সোজা! ভয়ে ভয়ে সমস্ত গাড়িতে নজর বুলালাম। কেউ দেখে ফেলেনি তো? না! কেউ দেখেনি। লতিফ আঙ্কেল, সামান্তা আপু এখনো ঘুমায়। জাকারিয়াও ঘুমিয়ে পড়েছে। তার সম্পূর্ণ ভর আমার কাঁধের উপর। আড়চোখে রাজ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। অবশেষে চিন্তার ঝড় একটু থামলো। যাক, রাজ ভাইয়া এই দুঃসাহস খেয়াল করেনি। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে সহজ হয়ে এলাম। হঠাৎ কানে ভেসে এলো অত্যন্ত ক্ষীণ এক সুর।

‘এতদিন আমি মেয়েদের বুকে ঘুমিয়েছি। আজ প্রথম উল্টো হলো। উঠলে কেন জুঁইফুল? কাঁধে মাথা রাখো, বুকে ঘুমাও। ভালোই তো লাগছে।’

কয়েক সেকেন্ডের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। আস্তে আস্তে শরীর জমে এলো। নিজের অসাবধানতার জন্য নিজের উপর প্রচন্ড রাগ উঠলো। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হলো।
________

গাড়ি এসে থামলো ঝলমলে এলাকায়। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে কমিউনিটি সেন্টারে। রাজকীয় ভাবে সেন্টার সাজানো হয়েছে। হরেক রঙ লাইট, ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম আমি। আগে কত কিছু জানতাম না। এই শহর মানুষ চিনিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আরো অনেক কিছু শিখিয়েছে। এই শহরে কত রঙ্গিন জিনিস দেখলাম।

সামান্তা আপুর সাথে সাথে ভেতরে ঢুকলাম। রাজ ভাইয়া, জাকারিয়া ভেতরে ঢুকে আলাদা হয়ে পড়লো। বিশাল বড় হলরুম। ভেতরে প্রচুর মানুষ। মেয়েগুলো এতো সুন্দর সুন্দর জামা পড়েছে! জীবন্ত পুতুল মনে হচ্ছে সবাইকে। আমি মুগ্ধ হয়ে সব দেখতে লাগলাম। সামান্তা আপু দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ। কাকে যেন দেখে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। খানিক বাদে আপু আমায় বললো,

‘জুঁই, ও তনুকা। আমার বেস্টফ্রেন্ড। তোকে ওর কথা কত বলেছি।’

আমি সালাম দিলাম। তনুকা আপুর নাম অনেক শুনেছি। ছবিতে একবার দেখেছি। তার সাথে সামান্তা আপুর বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন। দুজন এখন একই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তনুকা আপু কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেল। সাথে সামান্তা আপুও। আমি এক কোণায় চেয়ারে বসে রইলাম। সামান্তা আপু ফলের জুস আরো কি সব খাবার দিয়ে গেছে। জুস খেতে খেতে আমি চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিলাম। দক্ষিণ দিকে বড় স্টেজ সাজানো। বেলুন দিয়ে ভর্তি। সেখানে বছর দশেকের এক ছেলে বসে। আমি আন্দাজ করলাম এটা আলতাফ মামার ছেলে। মামাকে কোথাও দেখছি না। একটু স্বস্তি পেলাম। হলরুমে গান বাজছে। সুমধুর! ভাষা অজানা আমার। তবে সুর শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পাশে চেয়ার টানার শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি রাজ ভাইয়া এসে বসে পড়েছে। ভয়ানক বিরক্ত হলাম আমি। কিন্তু আমার এই লুকোনো বিরক্তি তাকে স্পর্শ করলো না। সে আমার সামনের টেবিলে থাকা অর্ধ গ্লাস জুস কাছে টেনে নিল। তাতে মুখ দিয়ে বললো,

‘কেমন লাগছে? বোর হচ্ছো না?’

‘হচ্ছি না। ভালো লাগছে।’

ক্ষীণ স্বরে বলে চুপ হয়ে গেলাম। বড় মা রাজ ভাইয়াকে আমার পাশে দেখলে রেগে যাবে। এ বাড়ির ছেলেগুলো আমার পিছু লাগে কেন? একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না! প্রচন্ড রাগ হলো। রাজ ভাইয়া তাড়া দিল।

‘কথা বলছো না কেন?’

আমি তবুও চুপ রইলাম। এবারে বললো,

‘আমি কি এতই তুচ্ছ যে কথা বলা যাবে না? আচ্ছা এক কাজ করো। তোমার প্রিয় ব্যক্তি নিয়ে কথা বলি। ফাইজানের ব্যাপারে বলো।’

আর সহ্য করা যাচ্ছে না। বাড়ির কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। উঠে দাঁড়াতে রাজ ভাইয়া হাত চেপে ধরলো। কান্না পেয়ে গেলো আমার। মোচড়ামুচড়ি করতে সে একটানে পূর্বের জায়গা বসিয়ে দিলো। সম্মুখে দৃষ্টি রেখে বললো,

‘আমি দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকতে পারি না বুঝেছ। এখানে কথা বলার মানুষ পাচ্ছি না। সেজন্য তোমায় জোর করছি।’

বরাবরের মতো আমার নিরুত্তর তার উৎসাহ কমাতে পারলো না। সে ফলের জুসে শেষ চুমুক দিয়ে বললো,

‘আচ্ছা তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?’

‘কোনো লক্ষ্য নেই।’

‘ভেরি গুড। লক্ষ্য ছাড়া জীবন সবচেয়ে সুখের। যখন যা ঘটবে মেনে নিবে। ব্যস! লাইফ বিন্দাস! এরচেয়ে শান্তির জীবন নেই। লক্ষ্য থাকা মানে তুমি অস্থির ইলেকট্রন। যতদিন না তোমার লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে ততদিন তোমার মনে শান্তি নেই। তুমি স্থির হতে পারবে না।’

‘আপনার জীবনের লক্ষ্য কি?’

প্রশ্নটা করেই ফেললাম। রাজ ভাইয়া কিয়ৎক্ষণ মৌন রইলো। তারপর বললো,

‘নির্দিষ্ট একজন কে অসুখী করা। আমার কাছের একজন, আপন একজন মানুষকে অসুখী করা। মানুষটা বড় পাপ করেছে বুঝলে! কিন্তু তারপরও দিব্যি সুখে রয়েছে। এটা একদম সহ্য হচ্ছে না আমার।’

রাজ ভাইয়ার চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। চেহারা জুড়ে তীব্র ঘৃণা। ভীত হয়ে গেলাম আমি। কাকে অসুখী দেখতে চায় সে? কার প্রতি এতো ঘৃণা জমিয়ে রেখেছে?

আমাকে উঠতে হলো না। রাজ ভাইয়া নিজে উঠে চলে গেল। হঠাৎ করে আলতাফ মামাকে চোখে পড়লো। গেস্টদের অ্যাপায়নে ব্যস্ত তিনি। এতো এতো নামী-দামী মানুষের ভিড়ে আমাকে চোখে পড়ার কথা না। তবুও নিজেকে যথা সম্ভব লুকিয়ে রাখলাম।

টেবিল জুড়ে সুস্বাদু খাবার। সবাই নিজের ইচ্ছে মতো খাচ্ছে। সন্ধ্যার পর নাকি কেক কাটা হবে। আলতাফ মামার বউকে দেখলাম। খুবই সুন্দর! সদ্য ভার্সিটিতে পড়ুয়া তরুণীদের মতো লাগে। অথচ দুই বাচ্চা তার। আমার ভাবনার মাঝে কোথা থেকে যেন বড় মা এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

‘খেয়েছিস জুঁই?’

‘হ্যাঁ! খেয়েছি।’

‘বসে থাক তাহলে। হারিয়ে যাবি। কোথাও যাস না!’

‘ঠিক আছে।’

বড় মা চলে গেলেন। আমি সামান্তা আপুকে খুঁজলাম। আপু কোথাও হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। হুট করে আমার বড্ড একা লাগতে লাগলো। বিষণ্ণ একা! মনে হলো এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। সত্যি নেই!

__________

চারিদিকে গান বাজছে। গানের তালে তালে কেউ কেউ নাচছে। আমার মাথা ধরে গেছে। সেই যে কেক কাটার পর গান শুরু হয়েছে। এখনো থামছে না। নিজের সিদ্ধান্তের উপর রাগ হলো। আফসোস হলো। কেন যে আসতে গেলাম। এসব আমার জায়গা না। একদম না! বাড়ি যাওয়ার জন্য মন উতলা হয়ে উঠলো।

ওয়াশরুমে যেতে হবে একটু। কিন্তু একা যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। সামান্তা আপুকে দ্বিতীয় বার খুঁজলাম। ব্যর্থ হলাম। এতো বিশাল হলরুমে কোথাও খুঁজে পেলাম না। হুট করে রাজ ভাইয়া এসে কাছাকাছি দাঁড়ালো। বললো,

‘কিছু লাগবে? কাউকে খুঁজছো?’

‘সামান্তা আপু। আপুকে একটু দরকার ছিল।’

‘ও ব্যস্ত আছে। আমায় বলো।’

আমি চুপ হয়ে গেলাম। মাথা নেড়ে বুঝালাম কোনো দরকার নেই। হঠাৎ করে সে জিজ্ঞেস করলো,

‘ওয়াশরুমে যাবে? এসো আমার সাথে।’

কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলাম। একসময় তার পিছু পিছু গেলাম। বেশিদূর গেল না সে। দূরে দাঁড়িয়ে বললো,

‘আমি এখানে আছি। যাও, ভয় নেই।’

তার ভয় নেই শব্দটা শুনে বিশেষ ভালো লাগলো। মনের বিষণ্ণ ভাব অনেকটা কমে গেলো। হাতমুখ ধুতে মিনিট কয়েক সময় লেগে গেলো। ওয়াশরুম হতে বের হয়ে দেখি রাজ ভাইয়া নেই। যেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানটা খালি। আশপাশে এক নজর দেখে চলে গেলাম।

সেন্টারে এসে কিছুটা হালকা হলাম। গান বন্ধ হয়েছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সামান্তা আপু ছুটে এলো। চিন্তিত মুখে বললো,

‘তোকে কখন থেকে খুঁজছিলাম। কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’

‘ওয়াশরুমে গেছিলাম একটু। বাড়ি যাবেন না আপু? রাত বেড়ে যাচ্ছে যে!’

‘হ্যাঁ যাবো। বড় আম্মু বোধ হয় থাকবে। রাজ ভাইয়া কে দেখেছিস?’

‘এদিকে ছিল। কিছুক্ষণ আগে দেখেছিলাম।’

‘জাবির ফোন দিয়েছিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো।’

‘ওহ্!’

‘ওদিকে চল। তোকে একটা জিনিস দেখাবো। একটা ছেলে অনেকক্ষণ হলো ফলো করছে আমাকে। কিন্তু কিছু বলছে না। চিনি না ছেলেটাকে। আয় তোকে দেখাই।’

আমার অনিচ্ছা সত্বেও টেনে নিয়ে চললো সামান্তা আপু। ছেলে অবধি পৌঁছাতে পারলো না। তার আগে সেন্টার থেকে এক নারী কন্ঠের চিৎকার ভেসে এলো। থমকে গেল সমস্ত হলরুম। মানুষজন একে অপরের মুখপানে তাকালো। প্রায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এক মেয়ে অগোছালো ভাবে দৌঁড়ে ওয়াশরুমের দিক থেকে বের হলো। কাছে আসতে দেখি তনুকা আপু। চমকে গেলাম আমি। সামান্তা আপু দৌঁড়ে গিয়ে তনুকা আপুকে জড়িয়ে ধরলো। জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে রে তনুকা? এমন করছিস কেন?’

তনুকা আপুর পেছন পেছন ওয়াশরুম থেকে বের হলো রাজ ভাইয়া। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন ততক্ষনে জড়ো হয়েছে। সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কি জানার আগ্রহ সবার। তনুকা আপুর বাবা-মা সম্মুখে এলেন। মেয়েকে কাছে টেনে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,

‘কি হয়েছে? বল মা?’

রাজ ভাইয়ার বাবা আজাদ আঙ্কেলও চলে এলেন। সান্ত্বনা দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে? কিছু দেখে ভয় পেয়েছ মা?’

তনুকা আপু মুখ খুলল। চোখ মুখ মুছে রাজ ভাইয়ার দিকে আঙুল তুলল। বললো,

‘ওই ছেলেটা আমার সাথে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করেছে।’

হলরুমে ছোট খাটো বাজ পরে গেল যেন। সবাই আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাকালো রাজ ভাইয়ার দিকে। আমিও বিমূর্ত হয়ে চেয়ে রইলাম। রাজ ভাইয়া বরাবরের মতো নির্বিকার। পূর্বের জায়গা দাঁড়িয়ে ঘন ঘন মাথার চুলে আঙ্গুল বুলাচ্ছে। যেন কিচ্ছু হয়নি।

হুট করে কয়েকজন তরুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। মুখ দিয়ে বিশ্রী কিছু বলে তেড়ে গেল। রাজ ভাইয়া অবধি পৌঁছাতে পারলো না। তার আগে কয়েকজন থামিয়ে দিল। একজন বললো,

‘ও আজাদ আঙ্কেলের ছেলে।’

রাজ ভাইয়া দীর্ঘদিন হলো বিদেশে বলে অনেকে তাকে চিনে না। তনুকা আপুও হয়তো চিনে না। এসব কিছুর মধ্যে আমি আজাদ আঙ্কেলের দিকে তাকালাম। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে তার। কপালের রগ ফুটে উঠেছে। এতো সম্মান, পরিচিতি তার। ছেলের সামনে গিয়ে দাঁত চেপে বললেন,

‘এসব কি শুনছি? মেয়েটা কী বলছে এসব?’

রাজ ভাইয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দিল। বেশিক্ষণ সে হাসি ধরে রাখতে পারল না। ঠাস করে চ’ড় বসিয়ে দিলো আঙ্কেল। দ্বিতীয় বার হাত উঠানোর আগে রাজ ভাইয়া কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তবে দাঁড়ালো না। শিস বাজাতে বাজাতে বের হয়ে গেল।

পুরো সেন্টার জুড়ে গুঞ্জন। রাজ ভাইয়ার নাম ধামাচাপা পড়ে আজাদ আঙ্কেলের নাম মুখে মুখে উচ্চারিত হলো। আঙ্কেল লজ্জা আর রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। এক সময় তনুকা আপুর কাছে গেলেন। তার বাবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাইলেন। বললেন,

‘খুবই দুঃখিত। ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে। ছোটবেলা থেকে বিদেশে বড় হয়েছে। ক্ষমা করবেন ভাই সাহেব।’

অনুষ্ঠান আর জমলো না। ছোট্ট একটা ঘটনা সুর কেটে দিয়ে গেছে। আঙ্কেল আর এক মুহুর্ত দেরি করলেন না। সবাইকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা করলেন। ফেরার পথে কারো মুখে রা নেই। বড় মা এখনো স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। তার অতি আদরের সন্তান এমন জঘন্য কাজ করবে মেনে নিতে পারছে না। আমিও মেনে নিতে পারছি না। একটা মানুষের কতটা অধঃপতন হলে এমন কাজ করে?

________

সেদিন রাতের বেলা ঘুম ভেঙে গেল আমার। কান্নাকাটির শব্দে। সালেহা খালাকে জোরেশোরে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দিলাম। খালা হুড়মুড় করে উঠলো।

‘কি হইছে রে? ডাকাত পড়ছেনি?’

‘খালা কে যেনো কান্না করছে। দ্রুত বাইরে বের হও।’

খালা বাইরে বের হলো। তার পেছনে পেছনে আমি। বের হতে ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। বড় মা সিঁড়ির কাছে গড়াগড়ি করে কাঁদছে। সবাই উঠে এসেছে। খালা গিয়ে বড় মাকে আগলে নিল। ধরাধরি করে তাকে সোফায় বসিয়ে দিলাম। দৌঁড়ে গিয়ে পানি আনলাম। জুলি আন্টি, সামান্তা আপু সবাই নিচে নেমেছে। আজাদ আঙ্কেল বিচলিত হয়ে ফোনে কথা বলছে। পর পর কয়েকজনের সাথে। সামান্তা আপুর আব্বু নামলো একটু পর। ঘুম ঘুম চোখে আঙ্কেলের পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে ভাই?’

‘রাজকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। থানা থেকে ফোন দিয়েছিল।’

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ১৪

‘রাজকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। থানা থেকে ফোন দিয়েছিল।’

বলে চুপ হয়ে গেল আজাদ আঙ্কেল। আমি একজন পরাজিত বাবাকে দেখছি। যার সমস্ত চেহারা জুড়ে হতাশা। কণ্ঠে বিষাদের সুর। যার কথায় শয়ে শয়ে মানুষ উঠাবসা করে, যার পেছনে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ ঘোরে, যার একটু ইশারায় কতকিছু ঘটে যায় সেই মানুষটা সংসার জীবনে পরাজিত। নিজের সন্তান কথা শোনে না। তাকে মানুষ করতে পারেনি। রাজ ভাইয়া বিদেশে গিয়ে পড়াশুনা করেনি। তার কোনো ডিগ্রি নেই। দেশ থেকে মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা পাঠাতো। সব উড়িয়ে ফিরে এসেছে। ছেলেটার জন্য বড় মা এই বয়সে কতদিন মার খেয়েছে। সব অজানা হয়তো!

সামান্তা আপুর আব্বু নওশাদ আঙ্কেল ভীষণ রেগে গেছেন। রাগার কথা! তিনি কপাল কুঁচকে বললেন,

‘ছেলেটা এমন করছে কেন? দেশে ফিরেই একের পর এক ঝামেলায় জড়াচ্ছে। সব জায়গা আপনার নাম ব্যবহার করছে। এতে তো আপনার সম্মানহানি হচ্ছে ভাই। আজকের এই ঘটনা নিয়ে যদি নিউজ হয়? সামনে ইলেকশন।’

হ্যাঁ কয়েক মাস পর নাকি ইলেকশন। আজাদ আঙ্কেল মনোনীত হয়েছেন। তার প্রচারণা চলছে। প্রতিদিন মিছিল, সমাবেশ হচ্ছে। এসবের মধ্যে রাজ ভাইয়া ক্রমাগত অঘটন ঘটিয়ে যাচ্ছে। আজাদ আঙ্কেল বিচলিত সুরে বললেন,

‘নওশাদ বের হ। লোকজন জানাজানি হওয়ার আগে রাজকে নিয়ে আসতে হবে।’

‘হ্যাঁ চলেন!’

কিছুক্ষণের মধ্যে দুজন বেরিয়ে পড়লো। বাকি সবাইকে বসার ঘরে রেখে আমি চলে এলাম। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। এদের পারিবারিক ব্যাপারে না থাকাই শ্রেয়। আমি সামান্য কাজের লোক।

বিছানায় শুয়ে আছি ঠিকই। কিন্তু ঘুম এলো না সহসা। আব্বার কথা মনে পড়ছে। আব্বা ভালো আছে তো? আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল একবার। প্রায় বছর খানেক আগে। আর কোনো খোঁজ নেই। মাঝে মাঝে আমি এ বাড়ির ড্রাইভার চাচার থেকে আব্বার তথ্য নেই। চাচা বলে, আব্বা ভালো আছে। আমার কেমন অস্থির লাগে তখন। মনে হয় আব্বা ভালো নেই।

‘ফুল ঘুমাইছোস?’

‘না খালা। কিছু বলবে?’

খালা বাল্ব জ্বালালো। তার শিথান থেকে তেলের বোতলটা নিল। নারকেলের তেল। হাজারী বাগের পীর সাহেবের পবিত্র ফু দেওয়া তেল। মাথা ব্যথার ওষুধ! খালা মাঝে মাঝে সেখানে যায়।

‘কিছু বলবে?’

খালা হঠাৎ আফসোস নিয়ে বললো,

‘কত্তো বড় বাড়ি, কত্ত টিহা পয়সা। কত্তো নামডাক। এত্তো বড়লোক, ধনী। আশপাশের মানুষ মনে করে না জানি এ বাড়ির মানুষ কত্তো সুখী। কিন্তুক দেখছোস? ভিত্রের চিত্র কেমন ছ্যাড়াব্যাড়া। একজন আরেকজনরে দুই চোউক্ষে সহ্য করতে পারে না। বড় বুয়ের সোয়ামির সাথে মিল নাই। খালি ঝগড়া লাইগা থাকে। কত কষ্ট হগ্গলের। এরেই বলে জীবন।’

খালা ঠিক বলেছে। উচ্চপদস্থ দের দেখে আমরা সব সময় হা হুতাশ করি। মনে করি, না জানি কত সুখে আছেন তারা! না জানি কত আনন্দে আছেন তারা। কিন্তু অন্দরমহলের চিত্র ভিন্ন। এতটা ভিন্ন যে কেউ চট করে আন্দাজ করতে পারবে না। ইট পাথর দিয়ে তৈরি বন্দিশালায় লুকোনো কতো দুঃখ, কতো কষ্ট! কতশত আলাদা আলাদা গল্প।

সেই গভীর রাতে আমি আবিষ্কার করলাম পৃথিবীর কেউ ভালো নেই। কেউ সুখে নেই।

পরদিন শুনলাম রাজ ভাইয়াকে রাতের আঁধারে ফিরিয়ে এনেছে। পুলিশ তাকে একা ধরেনি। সাথে আরো দুজন বন্ধু ছিল। মদ খেয়ে নাকি বেপরোয়া ভাবে বাইক চালাচ্ছিল। ফুটপাতের কাউকে আঘাতও করেছে। রাতের ট্রাফিক পুলিশ ধরে থানায় দিয়েছিল।
__________

ফাইজান ভাই এসেছে। তার মাস্টার্সের পরীক্ষা হয়েছে অনেক দিন হলো। এখন চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে। কোনো এক পরীক্ষার ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ঢাকা এসেছিল। বড় মা অনেক বলে কয়ে বাড়ি আনলো। বড় মায়ের এই ব্যাপারটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। ফাইজান ভাই তার নিজের সন্তান না। তবুও অনেক ভালোবাসে।

কিছুদিন হলো রাজ ভাইয়া বাড়িতে আছে। সারাক্ষণ নিজের রুমে থাকে। বের হয় না। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। তবে মাঝে মধ্যে খাবার টেবিলে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ভাতের প্লেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে যায়। এই ছেলেটা তার মাকেও পছন্দ করে না। বুঝলাম তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। সেজন্যে তার প্রতি এতো ক্ষোভ। মা কি করেছে? কিচ্ছু করেনি! তবুও এই মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে।

ফাইজান ভাই এসেছে পরশু রাতে। দুই ভাইয়ের দেখা হলো পরদিন দুপুরে। খাবার টেবিলে। কত বছর পর দেখা! অথচ কোনো কথা নেই! একজন আরেকজনের দিকে তাকাল না পর্যন্ত। এক পর্যায়ে রাজ ভাইয়া খাবার প্লেট সরিয়ে রেখে চলে গেল। এই হলো দুই ভাইয়ের সম্পর্ক!

দুপুরের খাবার চুলায়। রান্না করছি আমি আর খালা। বড় মায়ের শরীর ভালো না। তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। সামান্তা আপু এলো কিছুক্ষণ পর। বললো,

‘জুঁই চা বানিয়ে দে তো। দুই কাপ।’

‘দিচ্ছি আপু।’

‘রান্না কতদূর রে? একটু বের হবো আমরা।’

আমি প্রশ্ন করলাম না। কাজের লোকদের এতো উৎসাহ ভালো না। আপু নিজে থেকে ফিসফিস করে বললো,

‘আমি আর ফাইজান ভাই বের হবো, বুঝলি! তাকে বলেছি আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। অনেক রিকোয়েস্টের পর রাজি হয়েছে।’

‘খুবই ভালো।’

স্মিত হেসে বললাম আমি। চা হয়ে গেছে প্রায়। কয়েক মিনিট পর ছেকে কাপে ঢাললাম। আপু সালেহা খালাকে তাড়া দিল। বললো,

‘রান্না তাড়াতাড়ি শেষ করো খালা। খেয়ে বের হবো।’

‘করতাসি। হইয়া যাইবো।’

আপু চায়ের কাপ নিয়ে উপরে গেল। আমি রান্নায় মন দিলাম।

সেদিন সন্ধার পর পর ফাইজান ভাই আর
সামান্তা আপু ফিরলো। আপুর মন ভার। চোখ মুখ কেমন ফোলা ফোলা মনে হলো। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। আপু কি কান্না করেছে? ফাইজান ভাই তো বেশ স্বাভাবিক। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পিছিয়ে এলাম।

আপু রাতে খেলো না। সবাই অনেক বার বললো। জোরাজুরি করলো। কিছুতেই কিছু হলো না। সে হাসিমুখে না করে দিলো। অজুহাত দেখাল, বাহির থেকে নাকি খেয়ে এসেছে। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। আপু কি তবে ফাইজান ভাইকে মনের কথা বলেছিল? হয়তো! ভাইয়া রাজি হয়নি বোধ হয়। পছন্দের মানুষ, প্রিয় মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যান সহ্য করা যায় না! আপুর না জানি কত কষ্ট হচ্ছে!

টেবিল গুছিয়ে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে রাতে ঘুমানোর বন্দোবস্ত করছিলাম। এমন সময় ফাইজান ভাই নিচে নামলো। গ্লাসে পানি ঢেলে কয়েক চুমুক খেয়ে বললো,

‘ফুলি, কাল ভোরে আমি চলে যাবো।’

‘সেকি! এতো তাড়াতাড়ি কেন?’

চমকে উঠলাম আমি। সে এসেছে সবেমাত্র দুদিন হয়েছে। এখনি চলে যাবে! আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না ফাইজান ভাই। গ্লাসের বাকি পানিটুকু শেষ করে বললো,

‘তোকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যাবো ভাবছিলাম। কিন্তু আমার সময় হবে না। মঈন চাচাকে বলে দিয়েছি। তোকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবে।’

মঈন চাচা এ বাড়ির ড্রাইভার। আমার সাথে ভালো সম্পর্ক। সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু উনার এতো দ্রুত চলে যাওয়া মন সায় দিল না। তবুও মাথা নাড়লাম। বললাম,

‘ঠিক আছে।’

‘খাবার দাবার কিছু আছে নাকি রে?’

আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,

‘হ্যাঁ আছে। আপনি খাবেন? বেড়ে দিবো?’

‘আমি খাবো না। সামান্তা কে পারলে কিছু খাইয়ে আয়। বাহিরে কিছু খায়নি। মিথ্যে বলছে।’

‘ওহ্। আচ্ছা। খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’

ভাইয়া চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। শেষ মুহূর্তে বললো,

‘তোর বয়স অল্প ফুলি। ভুলত্রুটির বয়স এটা। সাবধানে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবি। এখন যেটা সঠিক মনে হবে, কয়েক বছর পর গিয়ে দেখবি সেটা সঠিক ছিল না। ঝোঁকের মাথায় কিছু করে বসবি না। আমাদের দোষ কোথায় জানিস? একটা নির্দিষ্ট বয়স হলেই নিজেকে ম্যাচিউরড ভাবি। আসলে ম্যাচুরিটি জিনিসটা পরিবর্তনশীল। তোর এখন যেটা উত্তম বলে মনে হবে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার জন্য আফসোস করতে হবে। বার বার মনে হবে কেন এই কাজ করেছিলাম। এইজন্য যা করবি ভেবে চিন্তে করবি। কখনো ফ্যান্টাসিতে ভুগবি না। বাস্তব জীবনে ফ্যান্টাসির জায়গা নাই।’

‘হুঁ!’

মাথা নত করে জবাব দিলাম। ভাই ফের বললো,

‘রাজের থেকে দূরে থাকবি। অনেকটা সময় বিদেশে কাটিয়েছে। বলা যায় না!’

সে চলে গেল। আমি তার গমনপথের দিকে চেয়ে রইলাম। ফাইজান ভাই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। কথাবার্তা চমৎকার। আচার-আচরণ অত্যন্ত সুশীল। এমন ছেলে সব মেয়ের কল্পপুরুষ। সেখানে সামান্তা আপুর প্রেমে পড়া অস্বাভাবিক নয়। সে আরো কাছে থেকে দেখেছে। একজন পরিপূর্ণ পুরুষকে!

প্লেটে খাবার নিয়ে আপুর রুমে গেলাম। দরজায় মৃদু শব্দ সৃষ্টি করলাম। আপু খুললো না। আমি হাল ছাড়লাম না। নক করে গেলাম। অবশেষে আপু দরজা খুললো। আমাকে দেখে বেশ রেগে গেল। বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘বলেছি না খাবো না? অযথা বাড়াবাড়ি করছিস কেন?’

মুখের সামনে দরজা বন্ধ করতে নিতে আমি ঝটপট বললাম,

‘ফাইজান ভাই খাবার পাঠিয়েছে!’

আপু দরজা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল। থমথমে মুখে সরে গেল। আমি ভেতরে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিলাম। খাবারের প্লেটটা টেবিলে রেখে বললাম,

‘আপনি এখনি ভাইকে বলতে গেলেন কেন আপু? আরো পরে বলতেন!’

‘আমি কি ইচ্ছে করে বলেছি নাকি? বলছিলো চাকরির ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে। চাকরি হয়ে গেলে বিয়ে করে ফেলবে। সেজন্য বলে দিয়েছি!’

আপু বালিশে মুখ গুঁজলো।

‘ভাই কি উত্তর দিয়েছে?’

‘বললাম আমি আপনাকে পছন্দ করি। অনেক বছর হলো ভালোবাসি। আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করবেন না। শুনে ফাইজান ভাই কী করলো জানিস? রাস্তার মাঝে চ’ড় বসিয়ে দিলো।’

আপুর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। আর কিছু বলতে পারলো না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি কিছু বললাম না। সময় দিলাম। আপু নিজেকে সামলে নিলো দ্রুত। খাটে হেলান দিয়ে বসে বললো,

‘রাজ ভাইয়া ছোটবেলা থেকে উড়নচণ্ডী স্বভাবের। কিন্তু ফাইজান? এ বাড়িতে আসার পর থেকে এতো যত্ন নিত আমার! স্কুলে দিয়ে আসা, পড়াশুনা দেখিয়ে দেওয়া, খাবার কম খেলে ধমকা-ধামকি করা! তার এত যত্ন পেতে পেতে কবে ভালোবেসে ফেলেছি একটুও টের পাইনি। তুই বল জুই! উনার মতো এতো যত্ন কে করবে আমার? উনার মতো এতো ভালো কে বাসবে? উনার মতো এতো আবদার কে মিটাবে? কেউ না! ফাইজান পৃথিবীতে একজনই হয়!’

আপু এক বুক হাহাকার নিয়ে বললো,

‘পৃথিবীতে কারো বিকল্প কেউ হতে পারে না। উনার বিকল্প আমি কোথায় খুঁজে পাবো বলতে পারিস? ঠিক আরেকটা ফাইজান আমি কোথায় পাবো!’

আপু কাদঁছে! ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। ঠিক এমন ভাবে আমি কেঁদেছিলাম বহুদিন আগে। এক মধ্যরাতে। যেদিন আবিষ্কার করেছিলাম রাফি ভাই আমাকে নিয়ে নয়। অন্য একজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্নে আমি নয়, অন্য কারো পদচারণা! কি যে কষ্টের। চোখ ভিজে উঠলো আমার। এ জীবনে কি আমি রাফি ভাইকে ভুলতে পারবো? আমার প্রথম অনুভূতি, আমার প্রথম ভালোবাসা! যাকে ঘিরে আমার সুপ্ত আবেগ একটু একটু করে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। তাকে ভুলতে পারবো?

________

সময় রংধনুর মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক সূর্য উঠছে। দিন গড়িয়ে রাত নামছে। আবার সূর্য উঠছে! সময়ের পরিক্রমায় আস্তে আস্তে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সামান্তা আপু স্থির হয়ে এসেছে। আগের সেই ছটফট স্বভাব নেই। প্রফুল্লতা ঢাকা পড়েছে কোনো গভীর দুঃখের আস্তরণে। রাজ ভাইয়া বাড়ি নেই অনেকদিন হলো। বাবার সাথে বড়সড় ঝগড়া করে ফুপির বাড়ি গেছে। এখনো ফেরেনি।

এতসব পরিবর্তনের মধ্যে আমার কলেজ শুরু হয়েছে। মানবিকে ভর্তি হয়েছি অনেকদিন হলো। ঘরের কাজ সামলে ক্লাস করার চেষ্টা করছি। তবে হাঁপিয়ে উঠেছি। বেঁচে থাকা দিন কে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জীবনের প্রতি তিক্ততা এসে গেছে। এতো বিষাক্ত লাগে বেঁচে থাকা!

তবুও কাজ করতে হয়। ক্লাসে যেতে হয়! এমনি এক দিনে দুপুর বেলা কলেজ থেকে ফিরতে খালা টেনে নিয়ে গেল। ঘরে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

‘ফাইজান বিয়ে করছে। হুঁনছোস নি?’

(চলবে)