ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-১১+১২

0
161

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-১১+১২

‘জুঁই জানিস! আমি একজনকে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু মানুষটা এতো গর্দভ। কিচ্ছু বুঝে না। গাধাটাকে কি করে বুঝানো যায় বলতো।’

‘কোন গাধা?’

‘তোদের পরিচিত এক গাধা!’

সামান্তা আপুর চোখে মুখে ভালো লাগার রেশ। ঠোঁটে ঝলমলে হাসি। আমি আগ্রহ নিয়ে তার পানে চেয়ে রইলাম। তার উত্তরের অপেক্ষায়। আপু দু দিকে হাত ছড়িয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলো। তারপর একসময় বললো,

‘কাউকে বলবি না তো? কেউ জানে না কিন্তু।’

‘বলবো না!’

‘ফাইজান গাধাটাকে।’

বৃষ্টির বেগ হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। কাছে কোথাও বিকট শব্দে বাজ পড়লো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে আপু হাতে টান দিল। তারপর এক দৌঁড়ে চিলেকোঠার ঘরে পৌঁছে গেলাম। চিলেকোঠার ছাদে উঠার জন্যে আলাদা সিঁড়ির ব্যবস্থা। সেই সিঁড়িতে বসে পড়লো সামান্তা আপু। আমায় নিশ্চুপ দেখে হাসলো। ভেজা চুলের পানি সরিয়ে বললো,

‘বিশ্বাস করলি না জুঁই?’

‘কবে থেকে এসব আপু?’

‘অনুমান করতো! ফাইজান কে আমি কতদিন হলো ভালোবাসি।’

‘জন্মের পর থেকে?’

‘তুইও তো দেখি গাধা!’

আপু হেসে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড পর হাসি থামিয়ে বললো,

‘ফাইজানের সাথে দেখা-ই তো হলো কয়েক বছর আগে। বুঝলি! সে বড় আম্মুর নিজের সন্তান না। বড় আব্বুর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান।’

এই ঝড় বৃষ্টির বিকেলে দ্বিতীয় বাজ পড়লো যেন। আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। কি বলছে এসব? আপু দীর্ঘ সময় নিল না। আমার চোখে মুখে ফুটে উঠা সব প্রশ্ন দূর করতে বলতে শুরু করলো।

‘শোন তাহলে। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। ঝড়-বৃষ্টির এক সন্ধায় ফাইজান প্রথম এ বাড়িতে এলো। বড় আব্বুর সাথে। বড় আব্বু সবাইকে ডেকে বললো যে, এটা তোমাদের বড় ভাই। ফাইজান ওর নাম। বাড়ির বড়রা বেশ স্বাভাবিক। কিন্তু ছোটরা ভীষণ অবাক। পরে আস্তে আস্তে শুনলাম এটা বড় আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান।

বড় আম্মুকে দাদা-দাদী সবাই পছন্দ করে সংসারে এনেছিল। অনেক বড় ঘর থেকে। বছর দুই পরে রাজ ভাইয়া গর্ভে আসে। ওই সময় বড় আব্বু দাদুর পুরোনো কিছু জমি জমার কাজে গ্রামে গিয়েছিলো। সেখানে এক মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে। সবার অগোচরে। বছর না ঘুরতেই ফাইজান ভাই হয়। আরো একটা মেয়ে নাকি ছিল। ছোটবেলায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। রাজ ভাইয়া আর ফাইজানের বয়সের তফাৎ খুব নয়। সমবয়সী প্রায়!’

আমি অস্ফুট স্বরে বললাম,

‘ফাইজান ভাইয়ের মা কোথায় তাহলে?’

‘তাকে আমরা কেউ দেখিনি। বড় আব্বু ঢাকা থেকে তাদের খরচ পাঠাতো। মাঝে মধ্যে নাকি যেত। বড়রা জানতো এসব। আমরা পরে শুনেছি। তিনিও নাকি মারা গেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ফাইজান একা হয়ে পরে। বড় আব্বু তাকে তখন এ এ বাড়িতে নিয়ে আসে।’

আমি বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলাম। এসব কি শুনালো আপু? এতো বড়লোক পরিবার। তবুও লুকোনো কত ছবি। লুকোনো কত দীর্ঘশ্বাসের গল্প। সামান্তা আপু মন খারাপ করে বললো,

‘ফাইজান ভাইয়ের অনেক কষ্ট আছে। গোপন দুঃখ আছে। শুনেছি তার মা নাকি বছরের পর বছর দুশ্চিন্তা করে করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। যার সবটা দায় বড় আব্বুর। এজন্য সে বড় আব্বুর মুখের পানে তাকায় না। বড় আব্বুর অবস্থানকালে বাড়িতে পা রাখে না। দেখেছিস, সবার অমতে গিয়ে খুলনা ভর্তি হয়েছে।’

‘তাহলে বড় মার সন্তান একটা?’

‘হ্যাঁ। রাজ ভাইয়া। সে-ও বড় আব্বুর ঘটনা শোনার পর রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে।’

‘রাজ ভাইয়া কত বছর হলো বিদেশ?’

‘যখন প্রথম যায় তখন জাবিরের সমান ছিল। এসএসসি পাসের পর গেছে।’

হুঁ হুঁ করে বাতাস বইছে। তোলপাড় করা বাতাস। গাছের ডালপালা দাপাদাপি করছে। ভেজা কাপড়ে রয়েছি অনেকক্ষণ হলো। শীতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সামান্তা আপুকে তাড়া দিলাম।

‘আপু চলেন নিচে যাই।’

‘এখনি যাবি? আরেকটু ভিজি চল।’

‘আমার শীত লাগছে আপু। দাঁতে দাঁত আটকে আসছে।’

সত্যি সত্যি কথা পেঁচিয়ে যাচ্ছে। শীতে ক্রমাগত কাঁপছি। আপু আর বাঁধ সাধলো না। দুজন নিচে নেমে এলাম।

সে রাতে আমার জ্বর এলো। আকাশ পাতাল এক করে। সেকি জ্বর! নিজের দেহের তাপমাত্রা নিজের কাছে অসহ্য লাগছিল। চোখে ঘোলা ঘোলা দেখি সব। বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ রাখতে পারি না। আবার বেশিক্ষণ চোখ খোলা রাখতে পারি না। কি যে কষ্ট!

জ্বরের মধ্যে আলাদা এক ঘোরের জগতে চলে গেলাম যেন! মস্তিষ্ক জুড়ে কত পুরোনো স্মৃতি। কতশত জল্পনা-কল্পনা। চারপাশে আমার গ্রাম ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে আমার বাড়ি। আমার শৈশব! আমার ছোটবেলা! কখনো বা রাফি ভাই। একের পর এক ছবি ভেসে উঠছিল। ঘোলা চোখে একবার দেখলাম আমি বারান্দায় শুয়ে আছি। মাটির উপর বিছানা পাতানো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। উঠোনে বড় আপা পুতুলকে নিয়ে খেলা করছে। খানিক বাদে বাদে আপা পুতুলের সুরে সুর মিলিয়ে হেসে উঠছে। সেজো আপাকে কোথাও দেখছি না। আমি সেজো আপাকে দেখলাম অনেক পর। আপা যখন পাশে এসে বসলো তখন চারপাশে ঘন অন্ধকার। আপার সুন্দর চাঁদের মতো মুখটা পর্যন্ত দেখতে পারছি না। আমি দূর্বল গলায় বললাম,

‘আপা চারপাশে এতো আঁধার কেন?’

‘পৃথিবীর সব আলো নিভে গেছে। কিছু নির্দিষ্ট মানুষের জন্য! তার মধ্যে আমরা আছি জুঁই। তবে পৃথিবীর আলো ফুরায়নি। আলো জ্বলছে। ও আলো আমাদের জন্য নয়। ও আলো চোখে পড়লে আমাদের চারপাশ আরো ঝাপসা হয়ে আসে।’

আমি আকুল সুরে বললাম,

‘বুঝি না আপা। একটু সহজ করে বলো না! তুমি বরাবর একই রকম থেকে গেলে আপা। এমন সব কথা বলো।’

আপা উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো সেই ভয়ংকর রাতের দৃশ্য। যে রাতে ঘুমানোর জন্য ঘরে পা রেখে চার চারটে নিষ্প্রাণ দেহ আবিস্কার করেছিলাম।

চোখ বেয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি দূর্বল দেহ নিয়ে বিছানায় লুটিয়ে আছি। এতটুকু নড়ার শক্তি নেই। কানের কাছে কেউ ফুল বলে ডাকছে। একবার মনে হলো সালেহা খালা। পরক্ষণে মনে হলো এটা তো মায়ের কণ্ঠ! আমি আরো অন্ধকারে তলিয়ে গেলাম।

_________

দিন চারেক পর আমি সুস্থ হয়ে হলাম। শরীরের দুর্বলতা যদিও রয়ে গেছে! শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছি। এটা নজরে পড়লো শুধু সালেহা খালার। খালার কি যে আফসোস। ইদানিং আমার পরিশ্রম আরো বেড়ে গেছে। জাবির নাকি নিজে থেকে হোস্টেলে গেছে। তার আম্মু যে আমার গায়ে হাত তুলেছে তা জানতে পেরেছে। কে বলেছে জানি না। তবে সেটা নিয়ে নাকি রাগারাগি করেছে। যার জন্য তার আম্মুর সব রাগ আমার উপর। প্রতিটা মুহূর্ত কথা শোনায়। পরিষ্কার কাপড় আবার ধুতে দেয়, রাত বিরাতে গরম পানি, চা, কফি সহ যত ধরনের হেনস্থা আছে সব করায়। সব সহ্য করছি। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

সেদিন রাতে ফাইজান ভাই ফোন দিয়ে আমাকে চাইলো। সালেহা খালার বাটন ফোনে। আমি জড়তা নিয়ে ফোন কানে নিলাম। সালাম দিতে সে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ফুলি? তোর নাকি জ্বর এসেছিল? আমাকে জানাস নি কেন রে? জ্বর আছে এখনো?’

আমি আশ্বস্ত করে বললাম,

‘জ্বর নাই। সেরে গেছে। আপনি কেমন আছেন ভাই?’

‘আমি ভালো আছি। জ্বর আসলো কি করে? অনেক পরিশ্রম হয়ে গেছে তোর?’

‘উঁহু। একদমই না!’

আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম। ফাইজান ভাই বা জাবির। কেউ আমার পক্ষ নিয়ে দু-তিন কথা বললে দিনশেষে তার অত্যাচার আমাকে সহ্য করতে হয়। তারা তো সবসময় পাশে থাকে না। বাড়ি থাকে না!

ফাইজান ভাই ফোন রাখলো কয়েক মিনিট পর। তার কথা শুনে মনে জোর পেলাম। অদৃশ্য শক্তিতে নিজের ভেতরটা পুলকিত হলো। বিছানা গুছিয়ে দ্রুত বই নিয়ে বসলাম। আমায় পড়াশুনা করতে হবে। কঠোর হতে হবে। ধৈর্যশীল হতে হবে। সামনের দিনগুলো মোকাবেলা করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম।

___________

‘আজ মঙ্গলবার। গ্রীষ্মের শেষ প্রায়! বছর দুই আগে আজকের এই দিনে আমি অচেনা এক শহরে পা রেখেছিলাম। তখন সাথে কিছু ছিল না। ছিল শুধু বিক্ষিপ্ত মন, ভাঙ্গা হৃদয়, এক বুক দুঃখ আর প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা। ইতোমধ্যে এতগুলো দিন কেটে গেছে। এখনো সাথে তেমন কিছু নেই। শুধু শক্ত মন আর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া।

ও হ্যাঁ! যে খুশিতে আজ ডায়েরি লিখতে বসা। দুদিন আগে পরীক্ষার ফল বের হয়েছে আমার। এসএসসি পরীক্ষার ফল। এ+ মিস হয়েছে। তবে অনেক ভালো জিপিএ নিয়ে পাস করেছি। সামান্তা আপু, জাবির ওদের এসএসসি রেজাল্টের থেকে আমার রেজাল্ট ভালো। ফাইজান ভাই ভীষণ খুশি হয়েছে। সালেহা খালার ফোনে কল দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালো। ভাইয়ের মাস্টার্স পরীক্ষা চলে। কিছুদিন পর ছুটি পেলে চলে আসবে। আমায় ভালো কলেজে নাকি ভর্তি করিয়ে দিবে বলেছে। জাবির একবার……..’

‘জুঁই। কোথায় গেলি?’

বড় মা ডাকছে। আমি ডায়েরি বন্ধ করে দ্রুত লুকিয়ে ফেললাম। গভীর রাতে লেখা যাবে। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে বের হলাম। বড় মা রান্নাঘরের সামনে ছুটোছুটি করছে। এগিয়ে যেতে ধমকে উঠলেন।

‘এতো কাজ বাইরে। ঘরে গিয়ে বসে আছিস কেন? কাজে হাত দে।’

‘করছি।’

বড় মা আবার ছুট শুরু করলেন। আমি আশপাশে এক নজর তাকালাম। চারপাশে চেঁচামেচি আর শোরগোলের আওয়াজ। এ বাড়িতে আজ একটা বিশেষ দিন। আত্মীয় স্বজন দিয়ে ভরা। যার বেশিরভাগ আমার অচেনা। গত দুই বছরে যাদের জীবনে দেখিনি তারাও উপস্থিত।

আজ এই বিশেষ দিনের প্রধান আকর্ষণ রাজ ভাইয়া। তিনি বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরছেন। অনেকগুলো বছর পর। আত্মীয় স্বজন সবাই উন্মুখ হয়ে আছে। তাকে দেখবে বলে।

বাহিরের খোলা বাগানে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বড় বড় পাতিলে করে রান্না বসানো। এক রান্না হচ্ছে। এক খাওয়া হচ্ছে। হুলস্থুল অবস্থা! ফাইজান ভাইয়ের বাবা আজাদ রহমান খান। তিনিও আজ বাড়িতে। তার সাথে উপস্থিত রাজনীতির বড় বড় নেতারা। তাদের জন্য বিশেষ উপায় আলাদা রান্না করা হচ্ছে। আরেকটা রান্না হচ্ছে। রাজ ভাইয়ার জন্য। এই রান্নাটা বড় মা নিজে করছে। আমি গিয়ে তাকে সাহায্য শুরু করলাম।

‘বুবু, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো।’

‘পারবো না। এনে খা।’

‘এনে দাও না!’

‘দেখছিস না কাজ করি।’

রান্নাঘরের বাইরে জাবির আর সামান্তা আপুর গলা শোনা যাচ্ছে। পানি নিয়ে দুই ভাইবোন তর্ক করছে। জাবির হোস্টেল থেকে এসেছে। গতকাল! বড় মা ভাজা ইলিশ উল্টাতে উল্টাতে বললো,

‘জাবিরকে পানি দিয়ে আয়। ফ্রিজ থেকে বোতল নিয়ে যা।’

‘দিচ্ছি।’

ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করলাম। বোতলের পানি বেশি ঠান্ডা। গ্লাসে অর্ধেক ঠেলে বাকি অর্ধেক জগ থেকে মিশিয়ে নিলাম। সামান্তা আপু সোফায় বসে এক বাচ্চার হাতে মেহেদি দিচ্ছে। পাশে জাকারিয়া মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ডাইনিং এ জাবির বসে ছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে পানির গ্লাসটা সম্মুখের টেবিলে রাখলাম। চলে আসার জন্য উদ্যত হতে জাবির বললো,

‘মানুষ কুত্তা-বিলাইকে খেতে দিয়েও দু-চার মুহুর্ত দাঁড়ায়। আর তুই? বড়লোক হয়ে গেছিস? খাবো না পানি। নিয়ে যা!’

‘অনেক কাজ পড়ে আছে। বিকেল হয়ে আসছে। রাজ ভাইয়া এসে পড়বে।’

দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। জাবির বড় হয়ে গেছে। আগে চেহারায় অস্থিরতা ছিল। এখন নেই। গম্ভীর হয়ে এসেছে। ক্লিন শেভড এ কেমন অদ্ভুত লাগছে। অচেনা লাগছে। আমি বসার ঘরে নজর রাখছিলাম শুধু। জাবিরের আম্মু দেখে না ফেলে যেন। ছেলেটার থেকে দূরে দূরে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। আর কোনো ঝামেলা না হোক। আমি ব্যস্ততা দেখিয়ে বললাম,

‘আমি যাই।’

‘খাবার এনে দে। সকাল থেকে খাইনি।’

বাইরের বাগানে খাবারের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। বিয়ে বাড়ির মতো চেয়ার টেবিল বসানো। সেখানে না খেয়ে ঘরে কি খাবে?

‘কি আনবো? বাগানে রান্না….’

‘রান্নাঘরে যা থাকে নিয়ে আয়।’

আমি সরে এলাম। বড় মাকে বলে প্লেটে খাবার নিলাম। পাঠিয়ে দিলাম সালেহা খালাকে দিয়ে। আর বের হলাম না।

___________

এয়ারপোর্টে রাজ ভাইয়াকে আনতে যাওয়া গাড়ি ফিরলো সন্ধার আগে আগে। যাকে আনতে যাওয়ার জন্য এতো আয়োজন। সেই রাজ ভাইয়া বাদে বাকি সবাই ফিরেছে। এক কান দু কান করে সারা বাড়ি রটে গেল। এয়ারপোর্ট থেকে সে পালিয়েছে। বাথরুম ব্যবহার করার কথা বলেছিল। বাথরুমে ঢুকতে দেখা গেছে। কিন্তু কখন বের হয়েছে, কোথায় গেছে আর হদিস পাওয়া যায়নি।

বড় মা শুনে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। ভয়ংকর রেগে গেল একজন। রাজ ভাইয়ার বাবা। সব দোষ গিয়ে পড়লো বড় মায়ের উপর। তাকে বকাঝকা করে বের হয়ে গেলেন তিনি। সবাইকে চিন্তিত দেখে আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজন বিদায় হলো। সন্ধ্যার পর পর বাড়ি খালি প্রায়। যাকে নিয়ে এতো আনন্দ, উৎফুল্লতা তার অনুপস্থিতি সব মাটি করে দিলো। জাবির আর সামান্তা আপু কয়েক সেকেন্ড পর পর ফোন দিতে লাগলো। সবগুলো নাম্বার বন্ধ!

সবাই অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করল। বসার ঘরে রইলো এই আশায় যে হয়তো রাজ ভাইয়া ফিরবে। একা ফিরবে। পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে ফিরবে হয়তো। কিন্তু সে ফিরলো না। একসময় ক্লান্ত হয়ে সবাই ঘুমাতে গেল।

ড্রয়িং রুমের কলিং বেল বাজল। একবার, দুবার! রাতের শেষ ভাগ তখন। আমি চমকে উঠলাম। সবেমাত্র চোখ বুজে এসেছিল। ধড়ফড় করে বিছানায় বসে পড়লাম। পাশে সালেহা খালা গভীর ঘুমে। খালাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললাম,

‘খালা কলিং বেল বাজছে। কেউ এসেছে!’

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-১২

‘খালা কলিং বেল বাজছে। কেউ এসেছে!’

সালেহা খালার গভীর ঘুম। একবার ঘুমিয়ে পড়লে দিন দুনিয়ার খেয়াল থাকে না। তার পাশে আমি কত রাত কেঁদে বুক ভাসিয়েছি। সে কিচ্ছু টের পায়নি। দিনের বেলা প্রায়ই তাকে কপাল কুঁচকে বলতে দেখা যেতো,

‘কি রে ফুল? চোখ ফোলা ক্যা? পোকায় কামড় দিছে?’

আজও ঘুম ভাঙলো না। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আপনা-আপনি উঠে পড়বে। কলিং বেল আর বাজছে না। বার দুয়েক বেজে চুপ হয়ে গেছে। আমি রুম থেকে বের হলাম। ড্রয়িং রুমে আবছা আলো। সিঁড়ির নিচে জিরো বাল্ব জ্বলছে। তার আলোতে যতটুকু অন্ধকার দূর হয়! আমার চিন্তার মাঝে তৃতীয় বার কলিং বেল বাজলো। সদর দরজার পানে চেয়ে রইলাম আমি। কিন্তু অন্য সময়ের মতো দৌঁড়ে গিয়ে খুললাম না। কে না কে! যদি চোর ডাকাত হয়?

হুট করে কানে শব্দ এলো। ধুপধাপ করে পা ফেলার শব্দ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে জাবিরকে চোখে পড়লো। হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। সিঁড়ির সম্মুখে আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো,

‘তুই বাইরে কেন? ঘুমাস নি?’

‘কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। এইজন্যে বের হলাম। কেউ এসেছে বোধ হয়।’

পরক্ষণে বললাম,

‘আপনি নিচে নামলেন কেন? কলিং বেলের শব্দ তো উপর তলায় যায় না।’

‘রাজ ভাইয়া অনেকবার ফোন দিয়েছে। ঘুমিয়ে ছিলাম বলে টের পাইনি। পরে হয়তো কলিং বেল বাজিয়েছে।’

‘রাজ ভাইয়া?’

চমকে উঠলাম আমি। উৎফুল্ল হয়ে বললাম,

‘তাহলে বড় মা, সামান্তা আপু, বাকি সবাইকে ডেকে দেই।’

তড়িঘড়ি করে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখতে হাতে টান পড়লো। জাবির থামিয়ে দিয়ে বললো,

‘ভাইয়া বারণ করেছে। কাউকে জানাতে নিষেধ করেছে।’

আশ্চর্য! কপাল কুঁচকে এলো আমার। এসব কোন ধরনের ফাজলামো? তার জন্য বাড়ির এতগুলো মানুষ চিন্তিত। আর সে কিনা সবাইকে নিয়ে মজা করছে। ভীষণ রাগ উঠলো আমার। জাবিরের হাতের ফোন কাঁপছে। দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। দরজা খুলতে আবছা অন্ধকার সাথে নিয়ে এক ছেলে প্রবেশ করলো। মুখটা অল্প অল্প পরিচিত। ছবিতে কয়েকবার দেখেছিলাম। সামান্তা আপুর ফোনে।

জাবির উচ্ছ্বসিত হয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা মৃদু আর্তনাদ করলো। ব্যথাতুর আর্তনাদ। জাবির দ্রুত ছেড়ে দিল।

‘কি হয়েছে ভাইয়া? এ অবস্থা কেন?’

রাজ ভাইয়া স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বললো,

‘ছোট্ট অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। পুরনো বন্ধুদের সাথে একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। মাওয়া হাইওয়েতে। বাইক অ্যাকসিডেন্ট করেছি।’

‘ডাক্তারের কাছে যাওনি?’

‘ধুর! এইটুকু ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো!’

আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্যথা অল্প নয়। হাতে পায়ের উন্মুক্ত অংশে বেশ কয়েক জায়গা চামড়া ছেঁড়া। থুতনীর নিচে কাটা দাগ। সারা দেহে মাটি। তবুও কেমন শক্ত হয়ে রয়েছে। আমার কেন জানি মনে হলো এই ছেলের ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা অসীম! আমার ভয় হতে লাগলো। যাদের ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা সীমাহীন, প্রকৃতি ঘুরেফিরে তাদেরই বেশি দুঃখ দেয়।

‘এসো ভাইয়া। বসো সোফায়।’

জাবিরের হাত ধরে কয়েক পা এগোতে থমকে গেল ছেলেটি। সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণে আমায় খেয়াল করলো। কপাল কুঁচকে বললো,

‘ও কে? তোকে না বলেছি কাউকে জানাবি না!’

‘ও জুঁই!’

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। এগিয়ে গিয়ে বললাম,

‘এ বাড়িতে কাজ করি। বছর দুই হলো।’

জাবিরের অসম্পূর্ণ কথা পূর্ণ করলাম। রাজ ভাইয়া কিছু বললো না। সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। পানি এগিয়ে দিল জাবির। পানি খেয়ে সে সোফায় শুয়ে পড়লো। জাবির সরে এসে আমায় ডাক দিল।

‘জুঁই?’

‘হুঁ?’

‘খাবার কিছু থাকলে গরম করে দে তো একটু। শব্দ হয় না যেন!’

মাথা নেড়ে রান্নাঘরে গেলাম। ফ্রিজ ভর্তি খাবার। সব রাজ ভাইয়ার জন্য রান্না করা হয়েছিল। কেউ ছুঁয়ে দেখেনি। আমি নিঃশব্দে সেগুলো গরম করলাম।

ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে রাজ ভাইয়া খেল। আয়েস করে। খাওয়া শেষ করে জাবিরের রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। আমাকে শাসিয়ে বললো,

‘এই পিচ্চি! আমি যে এসেছি কেউ যেন না জানে! জানলে কি হবে? চাকরি নট হয়ে যাবে।’

‘কাউকে বলবো না।’

‘ঠিক তো?’

‘হুঁ!’

নিশ্চিত হতে রাজ ভাইয়া হাঁটা ধরলো। জাবির তার পিছু পিছু। দুই জন উপরে চলে গেল। সদ্য বিদেশ ফেরত ছেলেটার মতি গতি কিছু বুঝলাম না। নিজের বাড়ি, নিজের ঘর, নিজের পরিবার। অথচ এত নাটক করার কি আছে? সামান্তা আপু একবার বলেছিল, রাজ ভাইয়া আর ফাইজান দুজন দুই মেরুর। সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের। ফাইজান ভাই যেমন দায়িত্বশীল, পড়ুয়া, জ্ঞানী আর সুশীল। রাজ তেমনি একগুঁয়ে, পড়াশুনায় ফাঁকিবাজ আর উচ্ছৃংখল স্বভাবের। তার এই বিপরীত স্বভাবের জন্য সবাই তাকে আর ফাইজান ভাইকে তুলনা করতো। তার বাবা বকাঝকা করতো। সব মিলিয়ে ফাইজান ভাইয়ের সাথেও তার সম্পর্ক ভালো না। দুই ভাইয়ের যোগাযোগ নেই কত বছর হলো!

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব গুছিয়ে রাখলাম। থালাবাসন ধুয়ে টেবিল আগের মত পরিষ্কার করলাম। সব সমাপ্ত করে যখন রুমে ঢুকলাম তখন চারিদিকে ফজরের আযান পড়ছে!

_________

পরদিন বাড়ির সবার ঘুম ভাঙলো দেরিতে। কাল অর্ধেক রাত জেগে থাকার দরুণ সকালের নাস্তা কেউ খেলো না। দুপুরের পর পর সবাই নিচে নামলো। আমি আর খালা ডাইনিং সাজিয়ে রেখেছিলাম। সবাই খাওয়া শুরু করলো। বড় মা আজ আরো দেরিতে নামলো। ফ্রিজ খুলতে তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

‘রাজের জন্য যে আলাদা করে রান্না করছিলাম সে খাবার কই?’

বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। বড় মা অল্প অল্প করে বেশ কয়েক পদ করেছিল। রাজ ভাইয়া খেতে খেতে বেশিরভাগ বাটি খালি করেছে। আমি কি জবাব দিবো এখন? বড় মায়ের স্বভাব বুঝি না আমি। এই ভালো, তো এই অন্যরকম! তার ব্যবহার আকাশের মতো ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। প্রথম দিকে খারাপ লাগতো। এখন সয়ে এসেছে।

বড় মা ডাইনিং এ এসে সালেহা খালা কে জিজ্ঞেস করল। খালা উত্তর দিতে পারলো না। সব দোষ গিয়ে পড়লো আমার উপর। সঙ্গে সঙ্গে দাদী বলে উঠলো,

‘এই মাইয়া খাবার চুরি কইরা খাওয়া শিখ্যা গেছে। কি সব্বনাশ!’

দাদীর বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু গলার তেজ বাড়ছে বৈকি কমছে না। মুহূর্তে হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল। যার যার মতো চেঁচামেচি শুরু করলো। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম জাবিরের কথা বলি। বলি, রাতের বেলা জাবির খেয়েছে!

‘কি হয়েছে? এতো চেঁচামেচি কিসের? খাবার আমি খেয়েছি। রাতেরবেলা!’

সবগুলো চোখ একত্রে পেছন ঘুরল। আমিও তাকালাম। কয়েক হাত দূরে রাজ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। ছেঁড়াফাড়া জিন্স। সাথে উদ্ভট টাইপের ফতুয়া। টেলিভিশনে দেখানো মানুষদের মতো লাগছে তাকে। থুতনীর কাটা দাগ লাল হয়ে এসেছে।

‘রাজ?’

বড় মায়ের সুরে সবার ধান ভাঙলো। অনেকগুলো বছর পর সাক্ষাৎ। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বড় মা দৌঁড়ে গিয়ে রাজ ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরলেন। তার পিছু পিছু সবাই খাবার ছেড়ে চলে এলো। মুহূর্তে একের পর এক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হলো চারপাশ। হৈ-হুল্লোড় লেগে গেল। তার শব্দে যে দু-চারজন উপরে ছিল তারাও নেমে এলো। বড় মা কাদঁছে!

কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘কোথায় গিয়েছিলি তুই! এইভাবে সবাইকে দুশ্চিন্তায় রেখে।’

রাজ ভাইয়া তাকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলো। ছেলেটা পাগল নয়তো? আমাকে কাল শাসিয়ে গেল যেন কাউকে না বলি। এখন দুপুর হতে না হতে নিজে হাজির! তবে ভালোই হয়েছে। আর কোনো লুকোচুরি করতে হবে না।

আমি কিছুটা পিছিয়ে এলাম। সামান্তা আপু নেই। কোন দরকারে সকালে বের হয়েছে। এসে রাজ ভাইয়া কে দেখে ভীষণ খুশি হবে। জাবির এক কোণায় বসে ফোন টিপছিল। পায়ের উপর পা তুলে। চোখে চোখ পড়তে সরে গেলাম।

_________

বড় মায়ের বাপের বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে। বাড়ির সবার। আলতাফ মামার ছেলের জন্মদিন। বড়সড় অনুষ্ঠান হবে। সবাই আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। কে কি ড্রেস পরবে, কি করবে, কখন যাবে ইত্যাদি। জাবিরকে হোস্টেল থেকে আসতে বলা হলো। রাজ ভাইয়ার বাড়ি ফেরা উপলক্ষে কয়েকদিনের জন্য এসেছিল। সপ্তাহ খানেক হলো আবার হোস্টেলে ফিরে গেছে। সে এলো না। শুনলাম পরীক্ষা চলছে।

অনুষ্ঠানের আগের দিন রাতেরবেলা সামান্তা আপু আমায় তার রুমে নিয়ে গেল। বাহারি ডিজাইনের জামা কাপড় বের করলো। কোনটা তার সাথে ভালো মানাবে জানতে চাইলো। সবগুলো জামা চোখ ধাঁধানো সুন্দর। আমি বেছে বেছে ধূসর জামাটা দেখিয়ে বললাম,

‘আপু এটা বেশি সুন্দর।’

‘তাহলে এটা আমি পরবো। বাকি গুলো থেকে একটা পছন্দ করে নে তুই। কালকের জন্য!’

‘কি?’

অবাক হলাম আমি। আপু একগোছা জামা এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘এগুলো পছন্দ হয় না? কোনো একটা নিয়ে নে। কাল গায়ে দিয়ে যাবি আমাদের সাথে।’

‘আমি তো যাচ্ছি না আপু।’

‘যাবি না মানে? সবাই যাবো আর তুই বাসায় থাকবি? এক চড় দিবো।’

সত্যি বলতে ও বাড়িতে যেতে আমার মন টানছে না। গেলে আলতাফ মামার সামনে পড়তে হবে। তার ব্যবহার, গা ঘেঁষা স্বভাব ভীষণ অস্বস্তিকর। এ বাড়িতে এলে সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে থাকি। আর কাল কিনা তার নিজের বাড়ি যেতে হবে। আমি কিছুতেই যাবো না।

‘জুঁই?’

নিচ থেকে কেউ নাম ধরে ডাকছে। এ বাড়ির পরিচিত নাম এটা। যখন যে খুশি ডাকে। দৌঁড়ে যেতে হয়। তার কাজ শেষ হতে না হতে আবার আরেকজন ডাকে। সামান্তা আপুর সাথে কথোপকথন অসমাপ্ত রেখে নিচে নামলাম।

ডাক দিয়েছে জাবিরের আম্মু। জুলি আন্টি। বসার ঘরে টেবিলে বসে পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন তিনি। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তাকালো। এক পলকের জন্য। তার কলমের নিব ক্রমাগত চলছে। খাতার বেশিরভাগ লাইন ঘঁষে ঘঁষে কেটে দিচ্ছে। আমি ঢোক গিললাম। না জানি কোন বেচারার খাতা! তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন,

‘এতো রাত হয়ে গেছে। ছাদের শুকনো কাপড় কে আনবে? আমি আনবো?’

‘আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।’

ছুট দিলাম ছাদের দিকে। এতো ভুলোমনা হয়ে গেছি! সন্ধ্যা হয়েছে সেই কখন। অথচ কাপড় তোলার কথা মনে নেই। ছাদের দরজা ভেড়ানো ছিল। ভারী পাল্লা। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। রাতের বেলা খুব কম আসা হয় ছাদে। আসলেও সামান্তা আপুর সাথে। লুকিয়ে! একা নয়।

সম্পূর্ণ ছাদ ফাঁকা। দরজার ওখানে বাল্ব লাগানো। তার আলো ক্ষীণ। চারপাশটা অত্যধিক নির্জন। আবছা অন্ধকার। কেমন ভয় হতে লাগলো। ঝড়ের গতিতে এক হাতে কাপড় টেনে আরেক হাতে জড়ো করলাম। চলে আসার জন্য পা বাড়াতে কেউ ডেকে উঠলো।

‘জুঁইফুল নাকি?’

মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হলো। তাকিয়ে দেখি চিলেকোঠার ছাদে রাজ ভাইয়া বসে আছে। পা ঝুলিয়ে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। অন্ধকার বলে আর কিছু নজরে এলো না। আমি কিছু বললাম না। হাঁটা শুরু করতে বললো,

‘শুনলাম তোমার নাকি ফাইজানের সাথে বেশ সখ্যতা। ওর মধ্যে কি এমন আছে যে সবাই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এক দেখায় শিষ্য হয়ে যায়। বলো তো! ওর সিক্রেট কি? ওর কি এমন আছে যা আমার মধ্যে নেই?’

রাজ ভাইয়ার কথা কেমন পেঁচানো। হতাশা জড়ানো। ভয় হতে লাগলো আমার। যেভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে! আমি ক্ষীণ সুরে বললাম,

‘বড় মা ডাকছে। আমি যাই।’

যাই বলে আর দেরি করলাম না। পড়ি কি মরি করে ছুটে এলাম। তবে রাজ ভাইয়ার প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলল।

__________

পরদিন সকাল থেকে সাজগোজ শুরু হয়ে গেল। আমি আমার মতো কাজ করছিলাম। রাজ ভাইয়া উপর থেকে কফির হুকুম করেছে। বানিয়ে সালেহা খালাকে ডাক দিলাম। খালা এলো। কফির মগ হাতে নিয়ে বললো,

‘তুই যা ফুল। ওদের সাথে ঘুইরা আয়। ভালো লাগবো। কতগুলান দিন হইলো শুধু ঘরের মধ্যি আছস।’

খালার অভিমত সঠিক। সেই যে বোর্ড পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে পা রেখেছি। এর মধ্যে কয়েক মাস কেটে গেছে। আর বের হওয়া হয়নি। ঘরের মধ্যে কাজ করে গেছি। সবাই আনন্দ করে যাচ্ছে। খালা হয়তো ভাবছে আমার মন খারাপ। তা ঠিক। মন খারাপ কিছুটা! কিন্তু যাওয়া যাবে না। আমি কাজে মনোযোগ দিয়ে বললাম,

‘যাবো না খালা। সবাই গেলে বাড়িতে কে থাকবে!’

‘আমি থাকবো মাইয়া। একজন থাকলেই হইলো।’

‘তোমারে একা রেখে যাবো না।’

খালা আর জোর করলো না। মন ভার করে চলে গেল। রান্নাঘরে এলো বড় মা। উসখুস করে একবার জিজ্ঞেস করলেন,

‘যাবি নাকি রে জুঁই?’

আমি না করতে তিনি যেন বড় বাঁচা বাঁচলেন। হাসি হাসি মুখে তিনি বের হতে ছুটে এলো সামান্তা আপু। একটানে আমার হাত থেকে পালং শাকের আঁটি নিয়ে নিল। শাক কাটছিলাম ফ্রিজে রাখার জন্য। সে কাটতে দিলো না। দাঁড় করিয়ে বললো,

‘এক্ষুণি রেডি হবি তুই জুঁই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে।’

দুপুরের আগে আগে সবাই বের হলো। হ্যাঁ! সাথে আমিও আছি। সামান্তা আপু ছাড়েনি। জোর জবরদস্তি করে নিয়ে এলো। জিদ করে। আমি না গেলে সে-ও নাকি যাবে না। তার এই পাগলামিতে সবাই রেগে গেলেও একজন মানুষ ভীষণ খুশি হলো। সালেহা খালা!

লোকসংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দুইটা গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজ ভাইয়াকে দেখলাম আমাদের সামনের গাড়িতে উঠলো। সামান্তা আপুকে নিয়ে আমি পিছনের গাড়িতে বসলাম। সামনে দুজন বসে পড়েছে। ড্রাইভার আর ফাইজান ভাইয়ের বাবার বন্ধু লতিফ আঙ্কেল। পারিবারিক বন্ধু। এ বাড়িতে যাতায়াত অনেক তার। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন তিনি। তাকে ছাড়া কিছুই হয় না যেন! আমাদের দেখে হাসি হাসি মুখে কথা বললেন। ড্রাইভিং সিটের পেছনে বসলাম আমরা। মাঝে জাকারিয়াকে দিয়ে একপাশে আমি। আরেক পাশে সামান্তা আপু।

গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে আমার পাশের দরজা খুলে গেল। খুললো রাজ ভাইয়া। একপলক আমাকে দেখে বললো,

‘জুঁইফুল নাকি! দেখি ওদিকে চেপে যাও তো। সামনের গাড়িতে জায়গা নেই।’

আমি গলা উচুঁ করে বাহিরটা দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম রাজ ভাইয়ার বাবা! পরে বুঝলাম কেন সে সামনের গাড়ি ছেড়ে চলে এলো।

‘এখানে বসে পড়ো ভাইয়া। দারুণ মজা হবে। জুঁই এদিকে সরে আয়।’

আমি কিছু বলার আগেই ফোড়ন কাটলো সামান্তা আপু। ভারী খুশি হয়ে গেল। উৎসাহ পেয়ে রাজ ভাইয়া আর অপেক্ষা করলো না। মুহূর্তের মধ্যে আমার গা ঘেঁষে বসে পড়লো।

(চলবে)