ভালোবাসার উল্টো পিঠে পর্ব-০৩

0
503

#ভালোবাসার_উল্টো_পিঠে
#তিন
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

সাহিলের কল রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না আমার। একে তো শরীর খারাপ তার উপর মানসিক চাপে আমি তখন বিধ্বস্ত হয়ে আছি। সবকিছু হয়তো ঠিক হয়ে যেত যদি মাহিদ একটাবার আমাকে বিশ্বাস করত। একটিবার জিজ্ঞেস করতো এসব কতটুকু সত্যি! মানুষের জীবনে টেকনোলজির ব্যবহার যত উন্নত হয়েছে ততই জীবনযাত্রা অনিরাপদ হয়ে ওঠছে।
নয়তো এভাবে এতটা পারফেক্টভাবে কেন ছবিগুলো এডিট করবে!

আমি জানি সাহিল কখনো এমন কাজ করতে পারে না। ও আমার ভালো বন্ধু। এমন বন্ধু আমার ক্ষতি চাইতে কখনোই পারে না। হতে পারে ও আমাকে পছন্দ করে তাই বলে সে আমাকে পাওয়ার জন্য এতটা মরিয়া হতেই পারে না। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম অনেক রাত হয়ে গেছে।

অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পরও মাহিদ এলো না। ভেবেছিলাম রাগ করে চলে গেছে ড্রয়িংরুমে একটুপর ফিরে আসবে। কিন্তু এলো না। আমার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি।

বাবাকে ভীষণ মনে পড়ছে। আমার একটু জ্বর হলে বাবা অস্থির হয়ে যেতেন। রোজা রাখতেন আল্লাহর কাছে সারাক্ষণ দোয়া করতেন যেন আমি সুস্থ হয়ে যাই। আজ বাবা আমার সাথে নেই। বাবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। ফোনটা হাতে নিয়ে বাবার হাতে কল দিতে চেয়েও দিলাম না। এতরাতে বাবাকে কল দিলে তিনি ভাববেন আমি ভালো নেই। আমার গলা শুনলে সব বুঝে যাবেন তিনি। তার কথা অমান্য করে যার কাছে এসেছি সে প্রথম দিন থেকেই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে এটা বাবা বুঝুক আমি চাই না। তাই চুপচাপ বসে রইলাম।

★★★

‘খান ভিলায়’ রিদ্ধিমার বাবা ফারুক খান বারান্দায় বসে আছেন। শায়েলা খান তাকে ডেকে গেলেও তিনি রুমে গেলেন না। মেয়ের কথা খুব মনে পড়ছে।

সন্তানকে নিজের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে মানুষ করার পর সে যখন চলে যায় তার কষ্ট শুধু ভুক্তভোগী বাবা-মাই জানেন। কারণ এ পৃথিবীতে বাবা হওয়ার অনুভূতি একজন পুরুষ বাবা না হওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারে না। একজন অগোছালো, এলোমেলো, খামখেয়ালি মেজাজের পুরুষও সন্তানের জন্মের পর দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। যে ছেলে কোনোদিন নিজেকে কারো জন্য পরিবর্তন করবে না বলে ঠিক করে রেখেছে, সেও বাবা হওয়ার পর নিজেকে পরিবর্তন করার জন্য উঠে-পড়ে লাগে। একজন বাবা কতটা ভালোবাসলে নিজের সব প্রিয় অভ্যাসকে ছেড়ে দিতে পারে। তিনিও পেরেছিলেন। রিদ্ধিমা তার বড় সন্তান। যাকে পেয়ে তিনি পৃথিবীর সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন।

চোখের সামনে ভেসে ওঠেছে সেই ছোট্ট রিদ্ধিমার পুরো বাড়িময় ঘুরে বেড়ানো। প্রথম আধো-আধো বুলিতে বাবা বলে ডাকা। বাবার চারপাশে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ানো। মনে হতে – হতেই তিনি অতীতে স্মৃতিতে হারিয়ে গেলেন। সুন্দর কিছু স্মৃতি তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠল। নিজের অজান্তেই তিনি ফিরে গেলেন সেই সোনালী অতীতে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বের হলো রিদ্ধি-মা! তিনি রিদ্ধিমাকে একসাথে এক শব্দে ডাকেন না। দুটো শব্দে আলাদা করে ডাকেন। কী ভীষণ সুন্দর সেই ডাক।

মেয়েকে ডাকার পর বুঝতে পারলেন এখন আর সে জবাব দেবে না। সে নেই। কোথাও নেই। এমন গম্ভীর, কাঠখোট্টা, রাশভারি মানুষটির দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নামতে লাগল। পৃথিবীর কোনো মেয়ে কী সে যন্ত্রণা বুঝতে পারবে! পৃথিবীর কোনো মেয়ে কী কোনোদিন জানতে পারবে তার চলে যাওয়ায় তাকে জন্ম দেয়া পিতার বুকটা কতখানি খালি হয়! কতখানি হাহাকার করে! পারবে না। পারার কথাও নয়। কারণ সে তো মেয়ে। আর বাবা তো বাবাই হয়।

★★★

সকালে ঘুম থেকে ওঠে রিদ্ধি মাহিদকে তার পাশে ঘুমাতে দেখে। মাহিদের হাত তাকে জড়িয়ে আছে। রিদ্ধিমা কোনোরকম ওঠে। ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে যেতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। জরিনা এসেছে।

ঘরে ঢুকেই প্রথমে রিদ্ধিমার কপালে হাত দিয়ে বলল, “আল্লাহ বাঁচাইছে জ্বর নাই। যদি এহনও আপনের জ্বর থাকতো। ও-ই ব্যাডার ঘরের ব্যাডারে দুই-চাইর কথা শোনাই দিতাম।”

“কাকে কথা শোনাতে?”

“সাহেবরে।”

“না জরিনা কাউকে কিছু বলবে না।”

“অইছে কমু না। কিন্তু আপনে আমারে জারিনা কইয়া ডাকবেন।”

রিদ্ধি হেসে বলল, “আচ্ছা বাবা, জারি-না এবার চলো নাস্তা বানাই।”

চা বসাতে বসাতে রিদ্ধি বলল, “এই জারিনা এ বাসায় আর কেউ আসে না?”

“এমনে তো তেমন কেউ আসে না। শুধু মাঝে মইধ্যে ভাইজানের বন্ধুরা আহে। আর এক খালাতো বোন আইসা তার লগে দেখা কইরা যায়। ভাবী হুনেন ও-ই মায়ারে আমার মোটেও ভালা লাগে না। বেহেয়া কিছিমের। ভাইজান অত পাত্তা দেয় না। কিন্তু হেতি তো তার গায়ে পড়ে আইসা। বিশ্বাস করেন ভাবী আমার মনডা চায় এই ফ্রাইপ্যানডা দিয়া তার মাথায় একখান জোরে ভাডি মারি। বেদ্দব মহিলা কোনহানকার।”

রিদ্ধিমার হাত থেমে গেছে এতক্ষণ জরিনার দিকে নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে রইল। তার শেষের কথা বলা ভঙ্গি দেখে ফিক করে হেসে ওঠল।

তার হাসি দেখে জরিনা বলল, “হাইসেন না ভাবী। এহন থাইক্যা রাশ টাইন্যা ধরেন। ব্যাডা মাইনষের বিশ্বাস নাই। আমার দাদি সবসময় কইতো মাঝে মইধ্যে বাঘ মানুষ পাইলে ছাইড়া দিতে পারে। কিন্তু পুরুষজাত পারে না। বুঝঝেন তো আমি কি কইছি।”

রিদ্ধি হাসি আটকে বলল, “বুইঝঝি জরিনা আপা। ইশ! স্যরি জারিনা আফা। এবার আন্নে কামে মন দেন।”

রিদ্ধির কথা শুনে জরিনাও হাসল। জরিনাকে চুপ করিয়ে দিলেও কথাটা কেন যেন মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারল না সে। চা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। মাহিদ তখনও ঘুমিয়ে। চায়ের কাপ সাইড টেবিলের উপর রেখে মাহিদের পাশে বসে অনেকটা সময় দেখতে লাগল তাকে। ভাবল ঘুমালে মানুষকে এত মায়া লাগে কেন? এত পবিত্র, এত সুন্দর লাগে কেন? যদি চোখ খোলা অবস্থায়ও এমন লাগতো! মাহিদের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিন মনে পড়ে গেল। কত সুন্দর ছিল সে দিনগুলো। সে ভাবল আজ মাহিদের সাথে সবকিছু ক্লিয়ার করবে। আলোচনা করে নিজেদের সবকিছু সমাধান করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এমন সময় মাহিদের ফোন বেজে উঠল।

“রিতি ইজ কলিং।”

রিদ্ধি ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবল এই রিতিটাকে! কখনো তো মাহিদ তাকে এর ব্যাপারে বলেনি। ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেল। কলটা রিসিভ করতেই অপাশ থেকে ভেসে আসল, “এই গাধা কল ধরিস না কেন? কখন আসতে বললি আমি বসে আছি তোর আসার নামই নেই?”

রিদ্ধিমা বলল, “কে বলছেন?”

অপর পাশ থেকে পাল্টা প্রশ্ন আসল, “আপনি কে?”

“আমি মিসেস মাহিদ।”

“স্যরি! কে আপনি?”

“আমি মাহিদের বউ।”

“হোয়াট!”

এমন সময় মাহিদ জেগে উঠল। রিদ্ধিমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল,”কার সাথে কথা বলছো?”

ফোন নিয়ে নিজেই দেখল রিতি কল দিয়েছে। সে বলল, “কেন বলতে গেলে তুমি আমার বউ? মেয়েটা কেঁদে-কেটে একশা করবে!”

রিদ্ধিমা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলছে মাহিদ! কেন বলছে!

চলবে।