ভালোবাসার উল্টো পিঠে পর্ব-০৪

0
447

#ভালোবাসার_উল্টো_পিঠে
#চার
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

মাহীদের কথাটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি বলে গেল সে এটা!

আমি তার বউ এটা শুনে অন্য কেউ কেন কষ্ট পাবে! তার মানে কী জরিনার কথাই ঠিক? রিতির সাথে তার কোনো সম্পর্ক রয়েছে? মস্তিষ্ক খালি হয়ে গেছে আমার। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। মাহিদ বারান্দায় মেয়েটাকে কল করে মানাচ্ছে বোধহয়। এভাবে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আজ সব নিয়ে কথা বলতেই হবে। মাহিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওর হাতটা ধরতেই সরিয়ে দিল।

“তুমি কেন এমন করছো মাহিদ?”

“কেমন করছি? সবকিছু তুমি করে আমায় জিজ্ঞেস করছো আমি কেন এমন করছি?” মাহিদের গলা চড়ল।

“আমার সাথে সাহিলের কোনো সম্পর্ক নেই এটা তোমার চেয়ে বেশি কে জানে? তারপরও বিয়ের রাত থেকে এমন কেন করছো?”

“ছবিগুলো দেখার পরও কথা বলতে লজ্জা করছে না তোমার? বেহেয়া মেয়ে কোথাকার।” মাহিদ হনহনিয়ে নিজের কথা বলেই চলে গেল। আমার কোনো কথাই শুনতে চাইল না।

অনেকটা সময় আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। এক জায়গা থেকে নড়তে পারছি না। জীবনের এই মোড়ে এসে অনেক কিছুই অজানা আমার। মানুষকে চেনার ক্ষমতা আমার খুব কম। কারণ ছোট বেলা থেকে বইয়ে মুখ গুজে কাটিয়ে দিয়েছি। বাইরের মানুষের সাথে খুব একটা মেশার সুযোগ কোনোদিন হয়নি। ফলস্বরূপ এখন আমি পরিস্থিতিগুলো মোকাবেলা করতে পারছি না। আমার জীবন শুধু বাবা-মা আর ভাইদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আমি এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারছি না।

আমার এখন কী করা উচিত ভাবতে ভাবতে চোখের কোল জলে ভরে গেল। অনেকক্ষণ ঠাঁয় বসে রইলাম।
মাহিদ বেরিয়ে গেছে। হঠাৎ ফোনের শব্দ কানে আসল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম সাহিল। রিসিভ করব না ভেবেও করে ফেললাম।

“আমি তোর কী ক্ষতি করেছি বল তো? তুই কেন আমার জীবনটা শেষ করে দিচ্ছিস?”

সাহিল যেন আকাশ থেকে পড়ল, “কী বলছিস তুই! বিয়ে করেছিস অথচ একটুও বললি না। কোথায় আমি রাগ করব তা না উল্টো আমার উপর রাগ?”

“নাটক করবি না সাহিল। সব জেনেও নাটক করছিস?” আমার গলা ক্রমশ চড়তে লাগল।

“কী হয়েছে তোর রিদ্ধি? এসব কী বলছিস? বিশ্বাস কর আমি সত্যি কিছু জানি না।”

একদম ভালো সাজতে আসবি না। আমি জানি তুই আমাকে পছন্দ করিস কিন্তু এটা জানতাম না তুই এমন হতে পারিস!”

“হোয়াট’স রঙ উইদ ইউ রিদ্ধি? তুই এটা কীভাবে ভাবতে পারিস?”

“কেন ভাববো না তোর জন্য আমার আর মাহিদের সংসার শুরুর আগেই ভেঙে যাচ্ছে। মাহিদ আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এটা কীভাবে মানি আমি?”

সাহিল অবাক হয়ে বলল, “প্রথমত আমি কোনো ছবি পাঠাইনি। তারপর রইল তোর সংসারের কথা। আ’ম স্যরি টু সে। এটা কেমন সংসার রিদ্ধি যা গড়ার আগেই ভাঙন ধরে। এটা কেমন ভালোবাসা রিদ্ধি যেখানে কোনো বিশ্বাস নেই! আমি তোকে কষ্ট দিতে চাই না। আবার এ-ও চাই না তোর সম্মান ধূলোয় মিশে যাক। আমি তোকে কথা দিচ্ছি কে তোর ক্ষতি চায় তাকে আমি খুঁজে বের করব। আর তোকে প্রমাণ করে দেব আমি কাউকে ভালোবাসলে তার সবটা ভালোবাসি। সে আমার না হলেও আমার ভালোবাসা বা সম্মান তার প্রতি এতটুকু কমে যায় না। বরং আগের মতো তোকে সম্মান করি। তোকে কারো সাথে এক বিছানায় দেখলেও আমি এটা ভাবব তুই নিজের ইচ্ছায় এটা করতেই পারিস না, এর পেছনে কোনো কারণ আছে। সেখানে তোর দুই বছরের প্রেমিক যাকে ভালোবেসে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সব ছেড়েছিস সে সামান্য একটা ছবি নিয়ে এসব করছে! কী অদ্ভুত তাই না?”

সাহিলের বলা প্রতিটি শব্দ সত্যি। কিন্তু সে সত্য আমার সহ্য হলো না। প্রকৃতপক্ষে মানব জনমে মানুষ মিথ্যা তো খুব সহজে মেনে নেয়। কিন্তু সত্য মেনে নিতে নারাজ। কারণ সত্য সর্বদা অপ্রিয় হয়। কিছুক্ষণ থেমে রইলাম। তারপর মনে হলো আমার স্বামীকে কেউ অপমান করছে। তার ভালোবাসা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে এটা আমি কী করে সহ্য করি বলুন তো?

তাই তো আচমকা কী যেন হলো আমার চিৎকার করে বললাম, “আমার সম্পর্ক নিয়ে তোকে জাজ করার অধিকার কে দিয়েছে? আগে তুই প্রমাণ কর এসব তুই করিসনি। ছবিগুলো মিথ্যা তারপর আমার সাথে কথা বলতে আসিস।”

কল কেটে দেয়ার পর বুক ফেটে কান্না আসল। নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। সাহিলকে রাগ করে অনেক কথা শুনিয়ে দিলেও ওর বলা কথাগুলো যে মিথ্যে নয় সেটা সবাই বুঝবে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যখনই মাহিদ নামক মানুষটার চেহেরা আমার সামনে আসতে লাগল আমার মনে হলো ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। যে করেই হোক সব ভুলবোঝাবুঝির অবসান করে আমি আমার সংসার ঠিক করবোই। বাবার বাড়ি থেকে বড় মুখ করে বেরিয়েছি তাদের সামনে কিছুতেই সবকিছু মিথ্যে হতে দিতে পারি না।

আমি জানি বাবা মাহিদকে ভালো মানুষের কাতারে ফেলেন না। কেন এমনটা ভাবেন তার কারণও আমি জানি না। কিন্তু আমিও বাবাকে ভুল প্রমাণ করব। একদিন বাবাই বলবেন তুই কোনো ভুল করিসনি। তোর জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত ছিল মাহিদকে স্বামী রূপে গ্রহণ করা।

আমার এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবন আমি ঠিক করে নেব। কেউ একজনকে দরকার যাকে আমি আমার সবকিছু সহজে বলতে পারব এবং সে আমার বেস্ট সাজেশন দিতে পারবে। এটা ভাবতেই অন্তুর কথা মনে পড়ে গেল। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ও আমাদের সম্পর্কে সব জানে। দেরি না করে ওর নম্বরে কল দিলাম।

“হ্যালো, নতুন বউ কেমন আছিস বল? আমি তো ভাবলাম নতুন নতুন বিয়ে করেছিস ডিস্টার্ব না করি।”

বিয়ের পর বন্ধুদের এমন কথা বলাটা খুব স্বাভাবিক কিন্তু কেন জানি না এ কথাটা আমার বুকে কাঁটার মতো বিঁধছে। নিজেকে সামলে সব খুলে বললাম অন্তুকে। সব শুনে ও অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। আসলে এটাই স্বাভাবিক। ও জানত আমাদের সম্পর্ক কতটা সুন্দর ছিল। মাহিদ আমার জন্য কতটা পাগল ছিল। তার এমন পরিবর্তন অন্তুকেও কম আহত করেনি।

অন্তু অনেক ভেবে বলল, “দেখ হয়তো এমন ছবি দেখে মাহিদ ভাই নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি তুই নিজে থেকে উনাকে বোঝানোর চেষ্টা কর। নিজের জায়গা ছেড়ে দিস না। পৃথিবীতে সব উপেক্ষা করা গেলেও ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা বিধাতা মানুষকে দেননি। তিনি নিশ্চয়ই সব ঠিক করে নেবেন। যখন দেখবেন তুই তার প্রতি কেয়ারিং, তোর কাছে তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি তখন তিনি বুঝতে পারবেন তুই এমনকিছু করতে পারিস না।”

অন্তুর কথা ভেবে দেখলাম এবং সেটাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভাগ্যে কী আছে জানি না। তবে এটা ঠিক জানি যে সম্পর্কে সাফাই দিতে হয়। যে সম্পর্কে নিজেকে সৎ প্রমাণ করতে হয়। সে সম্পর্ক কতটা মজবুত! কতটা দীর্ঘস্থায়ী! কিন্তু নিজের কর্মের ফল ভুগতে তো হবেই!

চলবে।