ভালোবাসার উল্টো পিঠে পর্ব-০৫

0
434

#ভালোবাসার_উল্টো_পিঠে
#পাঁচ
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

মানুষের জীবনের ঘটনা প্রবাহ আগে থেকে কেউ জানে না বলেই এত এত ভুল করে। কিন্তু কিছু ভুল করেও শান্তি আছে। জীবনে অভিজ্ঞতা শুরু হয় এই ছোট ছোট ভুল থেকে।

আমি জানি না আমি এখন কোন পর্যায়ে আছি। শুধু জানি আমার সমস্যা থেকে একমাত্র আমি নিজেই বের হতে পারি। সেই চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।

তারপরও জীবনে কিছু বিষয় মেনে নেয়া কষ্টের হয়ে যায়। কিছু মানুষের পরিবর্তন মেনে নেয়া যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আজও আমার চোখের সামনে সেদিন গুলো জীবন্ত।

কলেজের প্রথম দিন গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় ছোট একটা মেয়ে একটা বেলি ফুলের মালা তার সাথে একটা নীল খাম হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

বুঝতেই পারলাম না কে দিয়েছে।

খামটা বইয়ের ভেতর তাড়াতাড়ি করে ঢুকিয়ে মালাটা হাতে ব্রেসলেটের মতো করে পরে বাসার দিকে রওনা দিলাম। সারাটা পথ বুকের ভেতরকার ধুকপুক শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। এর আগে যে প্রেমের প্রস্তাব পাইনি এমন নয়। পেয়েছি। কিন্তু এমন অনুভূতি আমার কোনোদিন হয়নি। ভাবতে লাগলাম আমার হলোটা কী!

বাসায় ঢুকতেই মা জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে ফুল ফেলি কোথায়?”

যেন বুকের ভেতর দশমন বোঝা কেউ চাপিয়ে দিয়েছে এমনভাবে নিজেকে সামলাতে হলো। তারপর নিজেকে সামলে বললাম, “অন্তু দিয়েছে মা।”

মা হেসে রান্নাঘরে চলে গেলেন। দ্রুত নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে খামটা খুলে দেখলাম।

ছোট্ট একটা চিরকুট।

আমার একটা অন্ধকার জগৎ আছে।
সে জগতে আমি একা, বড্ড নিঃসঙ্গ,
সারাদিন শেষে যখন ক্লান্ত পায়ে ঘরে ফিরে আসি।
তখন পুরো ঘরে খুঁজেও একটা মানুষ পাই না,
যাকে আমি আমার সব যন্ত্রণা বলতে পারি।
আপনাকে দেখে কেন যেন মনে হলো আমি আপনাকে সব বলতে পারব।

কিন্তু, আপনার সময় হবে তো?
আমার অন্ধকার জীবনে এগিয়ে চলার জন্য যে আলোটুকু প্রয়োজন। সে আলোটুকু আপনি হবেন তো?

একা অন্ধকারের পথিক মাহিদ

ব্যস এতটুকু লেখায় কী ছিল আমি জানি না। শুধু জানি আমার কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল। যা এর আগে কক্ষনো হয়নি। এভাবে প্রতিদিন কলেজে সেই ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটি ফুল দিয়ে যেতে লাগল। সাথে একটা চিরকুট। সেই চিরকুটের প্রতিটি শব্দ আমাকে দিন দিন ঘায়েল করে নিচ্ছিল। তাই আমিও তাকে উত্তরস্বরূপ একটা চিরকুট দেই। এরপর আমাদের দেখা হলো তার সাথে পরিণয়। লুকিয়ে দেখা করা। সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো ছিল। বিয়ে করা। কিন্তু তার মধ্যে কী যেন হয়ে গেল। একটা দমকা হাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেল। আজ আর মাহিদের চোখকে আমি চিনতে পারি না। সেই চোখে আমার জন্য মায়া ছিল। আর এই চোখে আমার জন্য শুধু ঘৃণা। বাবার কথা না শুনে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় একটা বারও মনে হয়নি আমাদের সম্পর্ক এতটা ঠুনকো। আমি এখনো বিশ্বাস করি আমার মাহিদ এমনটা করতে পারে না। কিন্তু নিজে চোখে যা দেখছি সেটা কে কি বলব জানি না!

কলিং বেলের শব্দে ঘোর ভাঙে আজ অন্তুর কথা মতো নিজে থেকেই তার দিকে এগিয়ে যাব বলে ঠিক করেছি। আয়নায় নিজেকে দেখে নিলাম। দরজা খুলতেই মাহিদের মুখে অন্ধকার। ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে পানি এগিয়ে দিলাম। ও চেয়ারে বসে সে পানি চুপচাপ খাচ্ছে। আমি পেছন থেকে তার কাঁধে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতেই আমার হাতটা এক ঝাটকায় ফেলে দিয়ে বলল, “অফিসে অনেক চাপে আছি এসব ভালো লাগছে না।”

মাহিদ রুমের দিকে চলে গেল। জানি না কেন এতটা অপমান এতটা কষ্ট আমার কোনোদিন লাগেনি। মনে হলো ও ইচ্ছে করে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।

চেয়ারে দপ করে বসে পড়লাম। যেন শরীরে কোনো শক্তি নেই। জরিনা রান্নাঘর থেকে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “ভাবী খাবার দিয়া দিমু?”

“দাও।”

জরিনা আমার কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ভাবী আমার আপনার কষ্ট সহ্য অয় না। আপনে চইল্যা যান বাপের বাসায়। এ দুনিয়াতে সবাই ফেইল্লা দিতে পারলেও মা-বাপ পারে না। এখনো সময় আছে। যদি বাচ্চা একটা পেটে আইস্যা যায় তহন আর চাইলেও যাইতে পারবেন না। সন্তানের মায়া বড় মায়া গো ভাবী।”

জরিনা কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মাথায় ওর হাতটা রাখায় মনে হলো অনেক দিনের চেনা। অনেক আপন। এ বাড়িতে এসে ওকেই পেয়েছি এতটা ভাবে আমার জন্য। আমি ওর হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম, ‘তুমি খুব ভালো জরিনা। খুব ভালো।”

★★★

রিয়ন ক্যাম্পাসে বসে অস্মিতার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘড়ি দেখতে দেখতে বিড়বিড় করছে, “এই মেয়েটা সবসময় অপেক্ষায় রেখে কী শান্তি পায় কে জানে!”

তখনই পেছন থেকে অস্মিতা বলল, “আমাকে গালি দিচ্ছিস তাই তো?”

“তা কী করব! সবসময় তুই লেইট করে আসিস।”

“স্যরি ডিয়ার। আসলে বাসা থেকে তো ভার্সিটি টাইম ছাড়া বের হওয়া যায় না।”

অস্মিতা, রিয়ন একসাথে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। তাদের সম্পর্কটা প্রথমে বন্ধুত্ব ছিল। তারপর তা প্রেমে পরিনত হলো। দুজনের মধ্যে বোঝাবুঝি খুব ভালো। ক্যাম্পাসে তারা ‘পারফেক্ট কাপল’ নামে পরিচিত। দুজন দেখতে যেমন সুন্দর। কথা বলায়ও বেশ স্মার্ট।

দুজনে ক্যান্টিনে গিয়ে বসতেই রিয়নের ফোন বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল রিদ্ধিমার কল। ছোট বেলা থেকেই রিয়ন রিদ্ধিমা ভাই-বোনের থেকেও বন্ধু বেশি। একের-অপরের প্রতি বোঝা পোড়া সবচেয়ে বেশি। আজ পর্যন্ত রিদ্ধিমা কোনোকিছু ভাই থেকে লুকায়নি। রিদ্ধি রিয়নকে সব বলবে বলেই কল দিয়েছে। কীভাবে নিজের সংসার বাঁচাবে তার পরামর্শ চাইবে।

কিন্তু কল দিয়ে সে কিছুই বলতে পারল না। বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস করে কল কেটে দিল।

★★★

রাতে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। মাহিদ অফিস থেকে এসে খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করছে দেখে রিদ্ধিমা খুব খুশি। মাহিদ দুটো গোলাপ এনে তাকে দিল। রিদ্ধিমা গত কয়েকদিন ধরে শাড়ি পরলেও আজ মাহিদের সেটা চোখে পড়ল। এবং সে রিদ্ধিকে কাছে টেনে তার প্রশংসা করল। রিদ্ধি জরিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সব ঠিক হয়ে গেছে জরিনা। মাহিদ আমার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে।”

জরিনাও খুশি হলো সবটা শুনে। রাতে দুজনে একসাথে খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেল। মাহিদ রিদ্ধিকে কাছে টেনে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দাও রিদ্ধি। আসলে এমন একটা ছবি দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি। তাই তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। প্লিজ কিছু মনে করো না। তুমি তো জানো আমার মেজাজ অল্পতেই খারাপ হয়ে যায়। রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না।”

রিদ্ধি খুশিতে মাহিদের বুকে মুখ লুকিয়ে ভেজা গলায় বলল, “এ পৃথিবীতে তোমার দেয়া কষ্ট আমার সহ্য হয় না। যদি কোনোদিন এমন করো আমি তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাব। আর কখনো ফিরে আসব না।”

মাহিদ কথা দিল আর এমন হবে না। তারপর সে বলল, “রিদ্ধি একটা কথা বলার ছিল।”

“বলো?”

“আমার অফিসের কিছু টাকা আমি খরচ করে ফেলেছি। জানো তো নতুন বিয়ে বাসার জিনিসপত্র কিনেছি। আমি আগামী মাসে লোন পাব। কিন্তু এ মাসে কোনোভাবেই সেটা হচ্ছে না। তুমি কী আমাকে সাহায্য করতে পারবে? আমি আগামী মাসেই তোমাকে সব টাকা দিয়ে দেব। প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করো।”

রিদ্ধি বলল, “ঠিক আছে কোনো ব্যাপার না। আমি আসার সময় মা আমার বিয়ের জন্য যে গহনা গুলো বানিয়ে রেখেছেন সেগুলো আমাকে দিয়েছেন। তুমি ওগুলো নিয়ে যাও বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করো। তুমি বিপদে থাকলে এসব গহনা দিয়ে কী হবে! আমার শুধু তোমাকে চাই। ওসব গহনা আমার একদম লাগবে না।”

মাহিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রিদ্ধি স্বামীর ভালোবাসা পেল বলে সুখের নিদ্রায় তলিয়ে গেল। কিন্তু….?

চলবে