ভালোবাসার উল্টো পিঠে পর্ব-০৬

0
438

#ভালোবাসার_উল্টো_পিঠে
#ছয়
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

রিদ্ধিমা সুটকেস থেকে গহনার বাক্সটা বের করে সবগুলো গহনা গুণে দেখছে। মাহিদ বিছানায় বসে তাকে দেখতে লাগল।

আজ মাহিদকে খুব হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। রিদ্ধি বাক্সটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “সাত ভরি আছে। তোমার যা লাগে নিয়ে যাও।”

মাহিদ তার হাত ধরে বলল, “আমার খুব লজ্জা লাগছে। যদি সমস্যায় না পড়তাম তবে কখনো তোমার কাছ থেকে গহনা নিয়ে যেতাম না। তবে আমি কথা দিচ্ছি খুব শীঘ্রই আমি এর দ্বিগুণতোমাকে উপহার দেব।”

রিদ্ধি মিষ্টি হেসে বলল, “গহনার দরকার নেই। শুধু তুমি এমনটাই থেকো।”

“সবসময় এমন থাকব।”

★★★

মাহিদ চলে যাওয়ার পর রিদ্ধি ঘর গোছাতে লাগল। আজ তার মন খুব ভালো। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। রিদ্ধি দরজা খুলল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকাল। একবার ভাবল সে কী ভুল শুনেছে! তারপর চোখ গেল দরজার সামনে নিচের দিকে। সেখানে একটা ফুলের বুকে আর ছোট একটা বক্স পড়ে আছে। সেগুলো নিয়ে রিদ্ধি দরজা বন্ধ করে সোফায় বসে এসে নিজেকে নিজে অবাক হয়ে বলল, “কে পাঠিয়েছে এগুলো!”

হঠাৎ চোখ গেল একটা ছোট নীল চিরকুটে। ফুলগুলো টেবিলে রেখে চিরকুটটা খুলে দেখল।

রিদ্ধিমা

আমি চাই আপনি ভালো থাকেন। কিন্তু আসলেই কী ভালো আছেন তো?

এস.এস

রিদ্ধি শেষের দুটো ইংরেজি অক্ষরের এস দেখে অবাক হয়ে গেছে। কে হতে পারে এই লোক! আমার সম্পর্কে এতকিছু কীভাবেই বা জানে! হয়তো এমন কেউ যার নামের প্রথম অক্ষর এস। প্রথমে যে নামটা মাথায় আসল তা হচ্ছে সাহিল। কিন্তু সাহিলের পুরো নাম তো সাহিল রাহমান। তবে কে হতে পারে! তবে কী এই লোকই আমার আর সাহিলের ছবি এডিট করে মাহিদকে পাঠিয়েছে? কিন্তু কেন সে এটা করবে!

আমাকেই বা কীভাবে এতটা চেনে! ভাবতে ভাবতেই ফোনে ম্যাসেজ আসার শব্দ হলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম একটা আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল, “রিদ্ধিমা এহম্মেদ। ফুলের বুকে পছন্দ হয়েছে তো? আপনার পছন্দের ফুল। আই উইশ যদি আমি নিজে হাতে আপনার হাতে দিতে পারতাম! কিন্তু আমাদের দেখা হওয়ার সময় এখনো যে আসেনি।”

লোকটার গলার স্বর খুব সুন্দর। খুব শান্ত ধীরভাবে কথাগুলো বলছে। যেন কোনো কবি কবিতা আবৃত্তি করছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম আমার পছন্দের ফুল লোকটা কী করে জানলো। আর এই এস.এস এর পুরো নামটাই কী? তখনই মনে হলো তাকে জিজ্ঞেস করা দরকার।

“আপনি কে? আমাকে কীভাবে চেনেন? আপনি তো আমার সম্পর্কে অনেককিছু জানেন দেখছি। কিন্তু এটা জানেন কী আমি একজন বিবাহিত মেয়ে। আর একজন বিবাহিত মেয়েকে এভাবে ফুল পাঠানোটা ক্রাইমের মধ্যে পড়ে?”

ভদ্রলোক হাসলেন তার হাসিটা শান্ত মনে হলো। কিন্তু আমার কেন যেন ভয় করল। সে বলল, “আমি কে সেটা না হয় সময়মতো জেনে যাবেন। কিন্তু আপনি বিবাহিত এটায় আমার কিছু আসে যায় না। কারণ আমি এস.এস চাইলে এখন আপনাকে অবিবাহিত হিসেবে প্রমাণ করে দিতে পারি। তবে আমি এত খারাপ মানুষ নই। যা আমার ভালো লাগে তা জোর করে আদায় করতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু হ্যাঁ, অবশ্যই সেটা নিজেই আমার কাছে চলে আসে। আচ্ছা আজ আর নয়, আবার কল দেব।”

আমার পুরো শরীর কাঁপতে লাগল। এ লোকটা কে! কেন এমন করছে! আমাকে কীভাবে চেনে! অনেক ভেবেও এস.এস নামের কোনো পরিচিত কাউকে খুঁজে পেলাম না। নিজেকে অনেক চেষ্টা করেও শান্ত রাখতে পারলাম না। মাহিদ এমনিতেই সাহিলকে নিয়ে আমায় ভুল বুঝছে। এবার এই এস.এস এর কথা শুনলে কী হবে! না আমি আর ভাবতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে ক্রমশ কোনো জালে আমি আটকে যাচ্ছি। কেউ তো আছে যে আমার উপর সারাক্ষণ নজরদারি করছে।

আর ও-ই লোকটাই বা কীভাবে জানলো আমি ভালো নেই? হাজারটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে কোনো ঠিক রাখতে পারছি না।

মাহিদ অল্পতেই রেগে যায়। নয়তো সবটা ওকে বুঝিয়ে বলতাম। এখন ওকে কিছু বলার প্রশ্নই আসে না।

★★★

সব এলোমেলোর মধ্যে হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা ভালো হচ্ছে। সেটা হচ্ছে আমাকে আম্মু কল দিয়েছেন। আম্মুর সাথে কতদিন কথা হয় না। আমার চোখ দুটো আনন্দে ভিজে ওঠেছে। সন্তান যত অন্যায় করুক মা কখনো রাগ করে থাকতে পারে না।

ফোনটা রিসিভ করে চেয়ে কোনো কথা বলতে পারলাম না। অথচ এতদিন ভেবেছি আম্মু কল দিলে তাকে কত কথা বলার আছে। যখনই রান্না করতে গেছি মনে হয়েছে আম্মু তুমি আমার আশেপাশে আছো। আমায় বলছো, “রিদ্ধি এভাবে নয়। রিদ্ধি ওভাবে দাও। কতদিন বলেছি আমার সাথে একটু রান্না ঘরে ঢুকো কই আমার কোনো কথা তো শোনা না। যখন শ্বশুর বাড়ি যাবে তখন মায়ের কথা মনে পড়বে।”

আসলেই সত্যি প্রতিটি মুহূর্তে তোমার কথা মনে পড়ে আম্মু। তোমার শাসন, আদর সব।

আম্মু কয়েকবার ডাকলেন আমায়, “রিদ্ধি? রিদ্ধি?”

কান্নার জন্য মুখ থেকে একটা কথা বের হচ্ছে না আমার। শুধু হিঁচকি উঠছে। আম্মু বুঝতে পেরে নিজেও কাঁদছেন। মা মেয়ে দুজনের কান্না অনেকক্ষণ ধরে চলার পর জড়ানো গলায় শুধু বলতে পারলাম, “আ-ম-ম-ম্মু।”

“কেমন আছিস মা?”

“ভালো। তুমি?”

“আছি।”

“বাবা কেমন আছেন?”

“তোকে ছাড়া যেমন থাকার কথা। তোর বাবার তো ঘুম থেকে উঠেই তোর সাথে ওয়ার্ক আউট করতে বের হত, তুই ডায়বেটিস মেপে দেখতি। আজকাল বললেও শুনে না। ডায়বেটিস মাফে না, প্রেশারও চেক করে না। সবকিছুতে অনিয়ম করছে। আমি কিছু বললে বলে আমার কিছু হবে না। কিন্তু আমি তো জানি তোকে মনে পড়ে বলেই এসব করতে চায় না।”

আম্মুর কথা শুনে বুক ফেটে কান্না আসল। আমি জানি বাবা কখনো নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলেন না। নিজের যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখেন।

একদিন বাবা বলেছিলেন, “আমার তিন ছেলে যদি আমার চোখ হয়। আমার মেয়ে আমার হৃদপিণ্ড। মানুষ চোখ ছাড়া তো বাঁচতে পারে। কিন্তু হৃদপিণ্ড থেমে গেলে বাঁচতে পারেন না।”

ক্রমশ সকল স্মৃতি ভেসে ওঠেছে চোখের সামনে। আর প্রতিনিয়ত আমাকে অপরাধ বোধ তাড়া করছে। বাবাকে আমি এতটা কষ্ট কী করে দিলাম!

আম্মু আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললেন, “রিদ্ধি যা আজ সুন্দর সুখের মুহূর্ত। আগামীকাল কেন তা দুঃখের স্মৃতি হয়ে যায়?

কেন সুখের মুহূর্তগুলো সুখের স্মৃতি হয় না? কেন স্মৃতিতেই সব যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়?”

মায়ের কথাগুলো বুকের ভেতর শেলের মতো বিঁধল। সত্যি তো বর্তমানের সুখ, অতীত হলে সর্বদা দুঃখের কারণ হয়ে যায় কেন?

আমার মা-বাবা নিসন্দেহে পৃথিবীর সেরা বাবা-মা। আমি তাদের কাছ থেকে চাওয়ার আগে সব পেয়েছি। আর আজ মনে হচ্ছে তারা আমার কাছ থেকে চাওয়ার আগেই অনেক অনেক বেশি পেয়েছে। কিন্তু তা সুখ নয়। অসম্মান, আর একজীবন যন্ত্রণা।

আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব মেয়েকে চিৎকার করে বলি, “তোমরা সব করো কিন্তু বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ো সুখী হতে চেয়ো না। সেই সুখ কখনো চিরস্থায়ী হবে না। অনেক অনেক দূর পর্যন্ত শুধুই মরিচীকা মনে হবে। মরিচীকা কখনো সুখ হতে পারে না। তা তো শুধু একটা ভ্রম হয়। যেকোনো মুহূর্তে জীবন থেকে উদাও হয়ে যেতে পারে।”

এখন একটা আফসোস হচ্ছে, ইশ! যদি ষোলো থেকে বিশ বছর সময়টাতে ছেলে-মেয়েদের জীবনে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়া যেত তবে কত রিদ্ধি বেঁচে যেত। বাবা-মাকে কষ্ট দেয়ার মতো মহা পাপ থেকে রক্ষা পেত! আহা জীবন! আহারে জীবন!

চলবে।