ভালোবাসার উল্টো পিঠে পর্ব-০৭

0
395

#ভালোবাসার_উল্টো_পিঠে
#সাত
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

দুইমাস পর।

রিদ্ধি ভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরি করে। মাহিদ অফিসের জন্য যখন বের হয়। তখন রিদ্ধিও তার সাথে বেরিয়ে আসে। একজন অফিসে একজন ভার্সিটিতে চলে যায়।

রিক্সা থেকে নামতেই রিদ্ধি দেখল। ভার্সিটির গেটের সামনে অনেকগুলো গাড়ি লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবল আজ বোধহয় স্পেশাল কেউ এসেছে। তার শরীর আজকাল ভালো যাচ্ছে না। সারাক্ষণ দূর্বল লাগে। আজ একটু বেশিই খারাপ লাগছে। ধীরে ধীরে রিক্সা থেকে নেমে গাড়িগুলো পার হয়ে ভেতরে যেতে লাগল।

ক্যাম্পাসের মাঝখানে একজন লোককে ছাত্ররা ঘিরে রেখেছে। ভিড়ের জন্য লোকটার চেহেরা দেখা যাচ্ছে না। সে ভাবল হয়তো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা হবে। সে খুব বিরক্ত হলো। এসব রাজনীতি তার একদম পছন্দ নয়। অকারণে এরা পরীক্ষা আটকে রাখে। পড়াশোনার ক্ষতি করে। কিছু কিছু ছেলে অতিমাত্রায় হিরো সাজতে গিয়ে যুব সমাজের ক্ষতি করে যাচ্ছে।

তার ক্লাস পশ্চিম ভবনের চারতলা। ঠিক সে জায়গায় ভিড়। এখন এদের এড়িয়ে যেতে হবে। মাথায় ওড়না টেনে সামনে এগিয়ে গেল সে। কিন্তু হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল। শরীর দূর্বল তার উপর মাথা ব্যাথা। আচমকা কী যেন হলো সে মাথা ঘুরে পড়ে গেল।

ভিড় ঠেলে একজন লোক দৌঁড়ে তার কাছে আসল। সবাই ও-ই লোকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারণ এই ব্যাক্তিই এত মানুষের মধ্যমণি ছিলেন। লোকটা দ্রুত এসে রিদ্ধির মাথাটা ধরতে গিয়েও ধরলেন না। হাতটা গুটিয়ে নিলেন। পাশের একটা মেয়েকে ইশারা করলেন রিদ্ধিকে ধরার জন্য। মেয়েটা আসার আগেই অন্তু দৌঁড়ে এলো। রিদ্ধির মাথাটা নিজের পায়ের উপর রেখে গালে হাত দিয়ে বার কয়েক ডাকল। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

ও-ই ভদ্রলোক অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, “দেখে মনে হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া অনিয়ম করছে। শরীর বেশ দূর্বল। পাশে তো হসপিটাল আছে সেখানে নিয়ে যাওয়া দরকার। আপনার বন্ধু?”

শেষের কথাটা অন্তুকে উদ্দেশ্য করে বলল।

“জি আমার বন্ধু।”

“আপনি যদি চান আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। এখানে আমার গাড়ি আছে। পাশের হসপিটালে উনাকে নিয়ে যেতে পারি।”

অন্তুর কাছে এর থেকে ভালো অপশন আর ছিল না। রিক্সা করে নিয়ে যেতে সমস্যা হবে। আর গাড়ি ডাকতে ডাকতে সময় লাগবে। তারচেয়ে বরং লোকটার গাড়ি করে যাওয়াই ভালো।

“জি আমার কোনো সমস্যা নেই।”

রিদ্ধিকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। ভদ্রলোক নিজেই ড্রাইভ করে নিয়ে গেলেন। অন্তু ঠিক খেয়াল করল লোকটাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। ড্রাইভিং সিট থেকে বারবার রিদ্ধিকে দেখছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো আপনজন অসুস্থ তাই তিনি এমন ছটফট করছেন। অন্তুর নিজেরও চিন্তা হচ্ছে তাই সে কিছু বলল না।

হসপিটালের সামনে আসতেই অন্তু দেখল কয়েকজন নার্স রোগীর সিট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক তাদের ইশারা করলে তারা এসে রিদ্ধিকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

অন্তু একটু অবাক হলো। ভাবতে বাধ্য হলো কে এই লোক! কোনোভাবে কী রিদ্ধির পরিচিত!

অন্তু পেছন থেকে তাকে বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আজ আপনি না থাকলে কী যে হত?”

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “আমি উনার কেউ না। তিনি অসুস্থ হয়েছেন বলেই এখানে নিয়ে এসেছি। এর জন্য ধন্যবাদ না দিলেই খুশি হব।”

বলতে বলতে লোকটা হাসলেন। অন্তু না চাইতেও খেয়াল করল লোকটার হাসিটাও তার মতোই গাম্ভীর্যে ভরা! অথচ সুন্দর!

অন্তু রিদ্ধির কাছে গেল। একজন ডাক্তার তাকে দেখে বললেন, “দুশ্চিন্তা করেন তিনি তাই না? ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করে না। শরীর ভীষণ দূর্বল।”

রিদ্ধিকে স্যালাইন দেয়া হলো। অন্তু মাহিদকে কল দিল। কিন্তু সে কল রিসিভ করল না। প্রায় তিন ঘণ্টা পর বাইরে এসে অন্তু দেখে লোকটা তখনও আছে।

একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। ডাক্তার যখন লোকটাকে নাম ধরে ডাকলেন। সে অবাক হয়ে গেল।

বিড়বিড় করে বলল, “শাহেনেওয়াজ শেখ!” এই নামটা তো খুব পরিচিত মনে হচ্ছে!

ভাবতে ভাবতেই ভদ্রলোকের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “মিস অন্তরা, রাইট?”

“জি একদম ঠিক, আমি অন্তরা।”

এমন সময় নার্স এসে অন্তকে বলল, “আপনার বন্ধুর জ্ঞান ফিরেছে। আপনাকে ডাকছে। আর মাহিদ কে?”

“ওর হাসব্যান্ড।”

“উনি তাকেও খুঁজছেন।”

“আচ্ছা চলুন আমি দেখছি।” নার্সকে যেতে বলে অন্ত ভদ্রলোককে বললেন, “আপনি আমাদের অনেক উপকার করেছেন। আসুন না, রিদ্ধির সাথে দেখা করে যাবেন?”

ভদ্রলোক সেই হাসিটা হেসে বললেন, “আজ নয়, আমার একটু তাড়া আছে। অবশ্যই মিস রিদ্ধিমার সাথে দেখা করব। দেখা যে করতেই হবে।”

শেষের কথাটা বলার সময় তার মুখটায় রহস্য খেলা করে গেল। ডাক্তার থেকে বিদায় নিয়ে তিনি চলে গেলেন। অন্তু তার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা ভাবল। তারপর কেবিনের দিকে চলে গেল।

“রিদ্ধি এখন কেমন লাগছে?”

“ভালো। মাহিদকে জানাসনি?”

অন্তুর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সে চাইছে না রিদ্ধি আর দুশ্চিন্তা করুক। ও বলল, “নারে মাহিদ ভাই তো কল রিসিভ করেননি। করলে নিশ্চয়ই চলে আসতেন। তিনি তো কিছুই জানেন না।”

রিদ্ধির সুন্দর মুখখানায় মেঘের ছায়া পড়ল।

★★★

অন্তু রিদ্ধিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। জরিনাকে বলে গেল আজকে যেন সে থেকে যায়।

সেদিন গহনা গুলো বিক্রি করার পর মাহিদ বেশ খুশি ছিল। রিদ্ধিকে কয়েকদিন ভালোই যত্ন করেছে। তার পর মুখে তেমন কিছু না বললেও তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। দেরি করে বাসায় ফিরে। রিদ্ধি খাবার নিয়ে বসে থাকে কিন্তু রাত একটায় বা দুটোয় এসে সে জানায় বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে।

কখনো কখনো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এসে রিদ্ধিকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলে। তাই তো নানা চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া না করেই তার শরীরের এই বেহাল অবস্থা। কিছুকিছু বিষয় এতটা সেনসেটিভ যে সে চেয়েও কাউকে বলতে পারছে না।

রিদ্ধি খাটের হেড বোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। এমন সময় জরিনা গরম দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকল।

তার পাশে বসতেই রিদ্ধি বলল, “আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না জরিনা।”

“এরাম কইর‍্যা না খাইয়া অসুখ বাঁধাইলে কেউ দেখবো না ভাবী। এহনো সময় আছে আপনে নিজের কথা ভাবেন। বাপের বাসায় চইল্যা যান। ভাই জানের মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না।”

“ও বোধহয় অফিসে কোনো ঝামেলায় আছে। তাই আমাকে বলতে পারছে না। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও আগে এমন ছিল না। ও আমাকে অনেক ভালোবাসে।”

জরিনা আর কিছু বলল না। একে তো শরীর খারাপ তার উপর কোনো খারাপ কথা শোনাতে ইচ্ছে করল না। সে ভাবল আমরা মেয়েরা বড্ড সরল ভাবী। আমরা স্বার্থ আর ভালোবাসার তফাৎ বুইঝতে পারি না। যহন বুঝি, তহন আমাগো সব রাস্তা বন্ধ হইয়া যায়। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি আপনের জীবন যেন এমন না অয়।

জরিনা জোর করে অর্ধেক দুধ রিদ্ধিকে খাইয়ে দিল। রিদ্ধির ফোন বেজে উঠল। আননোন নম্বর।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনার শরীর কেমন এখন?”

রিদ্ধি গলার স্বর চিনতে পারল। সেই লোকটা। সে অস্ফুটে বলল, “এস.এস?”

“জি একদিনেই চিনে ফেলেছেন দেখে ভালো লাগল। বলছি শরীর ভালো তো এখন?”

রিদ্ধি অবাক হয়ে বলল, “আপনি কীভাবে জানেন আমি অসুস্থ? আপনি কী আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছেন?”

“না, তা করছি না। কিন্তু আপনার আমার দেখা ভাগ্য করাচ্ছে কী করব বলুন?”

“কী বলতে চাইছেন আপনি? দেখুন আমার জীবনে এমনিতেই অনেক সমস্যা। দয়া করে আর বাড়াবেন না।”

“আজ আপনাকে একটা কথা দিচ্ছি। আমি শুধু আপনার জীবনে সমস্যা সমাধানের জন্য আসব, সমস্যা তৈরি করার জন্য নয়।”

“আমি আপনার সমাধান চাইছি না।” রিদ্ধির গলা চড়ল।

“মিস, রিদ্ধিমা হায়দার। আপনি এত উত্তেজিত হবেন না। শরীরের হাল এমনিতেও ভালো না। আমি ফোন রেখে দিচ্ছি। আজকে আপনাকে অনেক উইক দেখাচ্ছিল নিজের খেয়াল রাখুন। এ দুনিয়ায় নিজেকে নিজের দেখতে হয়। অন্য কেউ স্বার্থ ছাড়া দেখবে না।”
আর, হ্যাঁ, আপনি মা হতে চলেছেন। এখন আপনার উচিত অন্যজনের কথাও ভাবা।”

ওদিক থেকে কল কেটে দিল। রিদ্ধি হাত শিথিল হয়ে আসল। সত্যি ও মা হতে চলেছে! চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই দুঃখের পরে সুখ লিখেছেন। সে পেটে হাত দিয়ে তার অস্তিত্ব পাওয়ার চেষ্টা করছে। ও ভাবল, “এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি বোধহয় মা হওয়া।”

মুহূর্তে তার সব কষ্ট কোথায় যেন চলে গেল। সাথে সাথে অন্তুকে কল দিল। ও কেন একবারও খবরটা দিল না। তাছাড়া ডাক্তারের কাছে কীভাবে নিয়ে গেল সব জানতে হবে।

কল দিতেই রিসিভ হলো। “আমি এখনই তোকে কল দিতাম। কেমন লাগছে এখন?”

“ভালো। কিন্তু তুই আমাকে সত্যিটা কেন বললি না?”

“কী সত্যি?”

“আমি মা হতে চলেছি।”

“সেটা বলার জন্যই এখন কল দিতে চাচ্ছিলাম। ভাবলাম আগে একটু স্থির হয়ে নিবি তারপর বলব। কিন্তু তোকে কে বলল?”

রিদ্ধি সত্যিটা কেন যেন বলতে পারল না। তারপর বলল, “মেডিসিন নেয়ার জন্য প্রেসক্রিপশন দেখলাম সেখানে রিপোর্ট আছে।”

“ওহ আচ্ছা।”

“আচ্ছা আমাকে কীভাবে হাসপাতালে নিয়ে গেলি?”

অন্তু সবটা খুলে বলার পর রিদ্ধি অবাক হয়ে গেল। সে বলল, “লোকটা কে? আমার জন্য এতকিছু কেন করলেন?”

“আমি জানি না। তবে তার নাম শাহনেওয়াজ শেখ। নামটা আমার চেনা চেনা লাগছিল। কিন্তু বাসায় এসে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম এই নামের আমাদের দেশের কোনো রাজনীতিবিদ আছে কিনা। আব্বু জানালেন রাজনীতিবিদ নেই। কিন্তু একজন মাফিয়া আছেন। যার নাম শাহনেওয়াজ শেখ। সংক্ষেপে এস.এস। কিন্তু বিশ্বাস কর ও-ই লোকটা কিছুতেই সে হতে পারে না। দেখতে যেমন হ্যান্ডসাম। কথা বার্তা মার্জিত।”

রিদ্ধির কানে কোনো কথা যাচ্ছে না। শুধু অস্ফুট স্বরে বলল, “এস.এস মানে শাহনেওয়াজ শেখ!”

চলবে