ভালোবাসার ব্যাকরণ পর্ব-০৮

0
208

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
#লেখনীতে_মাইসারাহ_আরোহি🌸
[পর্ব ০৮]

থমকে যায় অন্তিক।দৃষ্টি ম্লানভাবে নিবদ্ধ হয়।থমথমে মুখে শান্ত স্বরে অন্তিক বলে,
‘সব তো তোমার জন্যেই।তুমি যদি ছেড়ে না যেতে তবে সবকিছুই অন্যরকম হতো।’

আরো একবার বিস্ময় চিত্তে তাকালো রুহিয়া।অন্তিক দীর্ঘ শ্বা স ছাড়লো।কৌতুহলী কন্ঠে রুহিয়া বললো,
‘আমি তোমায় ছেড়ে গিয়েছিলাম অন্তিক?আর ইউ সিরিয়াস?’

অন্তিক মৃদু হাসলো।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বেসিনে হাত ধুয়ে ঘরের দিকে পদচারণা করলো।রুহিয়াও উঠে দাঁড়ালো।মিনিট দুয়ের ব্যবধানে ফিরে এলো অন্তিক।রুহিয়ার পানে একটা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিয়ে শানিত কন্ঠে বললো,
‘তুমি ছেড়ে যাও নি বলছো,তাহলে দেখো এই চিঠিটা চিনতে পারো কি না!’

কৌতুহল নিয়ে অন্তিকের হাত থেকে কাগজটা নেয় রুহিয়া।কাল বিলম্ব না করে পড়তে থাকে শুভ্র রঙা কাগজে কালো রঙের দ্বারা লিখিত শব্দগুলো।পুরনো হ‌ওয়ায় লেখার কিছু জায়গায় কালি লেপ্টে গিয়েছে।তবে রুহিয়ার বোধগম্য হতে অসুবিধা হলো না।সে স্পষ্ট পড়লো,
‘আমি আর এই সম্পর্কটা বয়ে বেড়াতে চাই না,তোমার সঙ্গে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তাই তোমার মেয়েকে রেখে আমি‌ চলে যাচ্ছি।আমায় খোঁজার চেষ্টা কোরো না,আমি খুব ভালো থাকবো।’

চিঠিখানি পড়ে ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েছে রুহিয়া।অন্তিক তার পাশে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করছে।রুহিয়া খানিকটা বিস্ময়ের স্বরেই বলে,
‘এটা তো সেইম আমার হাতের লেখা।কিন্তু বিশ্বাস করো অন্তিক এটা আমি লিখি নি।তুমি একটু ভালোভাবে দেখো কয়েকটা অক্ষর একদম অন্যরকম,আমি এমন করে লিখি না।অন্তিক এটা আমার লেখা চিঠি নয়।’

রুহিয়া ভালো করে চিঠিটা দেখালো অন্তিক’কে।অন্তিক গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো সেটা।তার বোধগম্য হলো রুহিয়া মিথ্যে বলছে না কেননা অনেকগুলো অক্ষর‌ই অন্যরকম যা রুহিয়ার হাতের লেখার থেকে ভিন্ন।অন্তিক স্হির অচঞ্চল দৃষ্টিতে রুহিয়ার মুখের দিকে তাকালো।রুহিয়া ম্লান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘এতো সহজে লেখাটা আমার মনে করে নিলে অন্তিক?ভাবলে আমি তোমাকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে চলে গিয়েছি?একবারো সত্যি-মিথ্যে যাচাই করলে না?’

অন্তিক নিঃশব্দে চোখের পলক ফেলে।কপালে হাত দিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
‘বিশ্বাস করতাম না যদি না এই ছবিগুলো দেখতাম।’

কথাখানা বলে অন্তিক রুহিয়ার সামনে তিনটা ছবি মেলে ধরে।যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রুহিয়া একটা ছেলের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে আছে।অন্তিক পুনশ্চ ঠান্ডা গলায় বললো,
‘এগুলো দেখার পর আর কোনো কিছু যাচাই করতে ইচ্ছে করে নি।তোমায় বলেছিলাম না রুহিয়া আমি সব সহ্য করতে পারবো কিন্তু তোমাকে অন্য কারোর সঙ্গে দেখতে পারবো না।তাই এই ছবিগুলো দেখার পর আমার মা থায় আর কিছুই আসে নি।’

বাক্যদ্বয় বলে ফের কপালে হাত রাখে অন্তিক।রুহিয়া অপলক অন্তিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ওটা আমার চাচাতো ভাই আরিয়ান।ওই ছবিটা অনেকদিন আগের।মনে আছে আমাদের বিয়ের কিছুদিন পর তোমায় বলেছিলাম বিদেশ থেকে আমার এক ভাই আসবে,আমি দেখা করতে যাবো।তুমি তো তখন শুনতেও চাও নি আমার কথা,তখন তো আমাকে মানতে পারো নি।ওটা সেদিনের‌ই ছবি।’

রুহিয়ার কথা শুনে থমকে গেলো অন্তিক।হতবিহ্বল দৃষ্টিতে সে তাকালো রমণীর বদনপানে।রমণীর চোখের কোণে চোখের জল স্পষ্ট।অন্তঃকরণ কেঁ পে উঠলো পুরুষটির।সে পুনরপি দেখলো ছবিখানা।বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ছবিটা দেখার পর অন্তিক বুঝতে পারলো রুহিয়া ঠিকই বলছে,ছবিটা আগের।অন্তিক ফের নির্নিমেষ তাকায় রুহিয়ার দিকে।ধরে আসা গলায় বলে,
‘বারবার অবিশ্বাস করতে চেয়েছি কিন্তু তোমার অনুপস্থিতি আমায় বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে।তুমি যদি ফিরে আসতে তাহলে আমায় এসব বিশ্বাস করতে হতো না।কিন্তু তুমি তো আসো নি,আমি রোজ তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।সবাই কত কথা বলেছে আমি শুনি নি। অথচ তারপরেও তুমি ফিরে আসো নি।এক পর্যায়ে আমি বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করি সবটা।’

রুহিয়া নাক টানে।চোখের জল মুছে বলে,
‘জানি কান ভাঙানোর লোকের তো অভাব নেই।তবে তুমি জানতে চাও কেনো ফিরি নি আমি!আমিও বাধ্য হয়েছিলাম অন্তিক,চাইলেও পারি নি।তুমিও আমায় চাও নি অন্তিক।’

‘এসব তুমি কি বলছো?ক্লিয়ারলি বলো একটু।’

অন্তিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়‌।রুহিয়া উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হুম বলছি।সেদিন তো বাড়িতে কেউ‌ই ছিলো না।সানফিকে নিয়ে শুয়ে ছিলাম আমি।ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে চোখটা লেগে গিয়েছিল।আমার ঘুম ভা ঙে ফোনের রিংটোনের শব্দে।আননোন নম্বর থেকে কল এসেছিল আমি রিসিভ করতেই শুনতে পাই পুরুষালি কন্ঠস্বর।আমাকে বলা হয় তুমি এ ক্সি ডেন্ট করেছো আমি যেনো তাড়াতাড়ি হস পিটালে যাই।কথাটা শুনে মা থা কাজ করে নি আমার।মা’কে কয়েকবার ফোন করি‌।কিন্তু মা ফোন ধরে নি।দিকবেদিক শূণ্য হয়ে সানফিকে রেখেই হসপিটালে যেতে হয় আমায়।’

এটুকু বলে একটা দম নিলো রুহিয়া।অন্তিক এখনো কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।রুহিয়া আবারো বলতে আরম্ভ করলো,
‘সিএনজি নিয়ে হসপিটালে যাবার পর রিসিপশন থেকে আমায় বলে ৩০৫ নম্বর রুমে যেতে।আমি তড়িঘড়ি ৩০৫ নম্বর রুমে যাই।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ওই রুমটা ছিলো একদম ফাঁকা।আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ একজন আমার শরীরে একটা ইন জেক শন পুশ করে।আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।কতক্ষণ অচে তন ছিলাম জানিনা যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে আবিষ্কার করলাম হসপিটালের বেডে।সারা শরীর অবশ হয়ে ছিলো,না পারছিলাম হাত-পা নড়াতে না পারছিলাম কথা বলতে।এর‌ই মাঝে একজন নার্স আর ডক্টরের কথোপকথন কানে আসে আমার।দরজার আড়াল থেকে উনারা বলছিলেন তুমি-ই নাকি এসব করেছো,এসব কিছু নাকি তোমার প্ল্যানেই করা!উনারা আরো বলে তুমি আমাকে পছন্দ করো না,শুধু মাত্র বাচ্চার জন্য আমায় ইউজ করেছো।এখন বাচ্চা হবার পর নিজের ঘাড় থেকে নামানোর জন্য মিথ্যে বলে আমায় হসপিটালে নিয়ে এসেছো আর ডক্টরদের বলেছো ভুলভাল ওষুধ দিয়ে আমার মা থা খারাপ করে দিতে।’

‘বিলিভ মি সানশাইন আমি এসব কিছুই করি নি।আমি তো জানি-ই না এসব।আজকেই প্রথম শুনছি।এসব অন্য কেউ করেছে,আমি এসব করি নি।কিন্তু এরপরে তুমি বাড়িতে কেনো এলে না,আমায় তো সোজাসুজি বলতে পারতে!’

অসহায় দৃষ্টিতে কথাগুলো বললো অন্তিক।প্রত্যুত্তরে রুহিয়া মৃদু স্বরে বললো,
‘সম্ভব হয় নি।হসপিটাল থেকে কোনো রকমে পালিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।বাড়িতেই আসছিলাম তোমার মুখ থেকে সবটা শোনার জন্য কিন্তু হঠাৎ করে রাস্তায় আম্মুর সঙ্গে দেখা হয়,জানতে পারি আব্বু ভীষণ অসুস্থ। তৎক্ষণাৎ আম্মুর সাথে বাসায় যাই।আব্বুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।এখানকার ডক্টররা বলেন বিদেশে নিয়ে যেতে।আম্মুর তো পাসপোর্টে‌ সমস্যা তাই আমাকেই যেতে হয় আব্বুর সঙ্গে।তখন এমন একটা ক্রা’ইসিস ছিলো যে আমি চাইলেও তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নি আর ওইসব কথা শোনার পর নিজের মনকে বোঝাতেও পারি নি।ভীষণ অভিমান হয়েছিলো।দুই বছর আব্বুকে নিয়ে সিঙ্গাপুর থাকার পর বাংলাদেশে ব্যাক করি।বিদেশে গিয়ে তোমার নম্বরে অনেক কল করেছি কিন্তু কল যেতো না।আর বাংলাদেশে আসার পর শুনলাম তুমি নাকি বলেছো আমি যেনো আর কখনো তোমার সামনে না যাই। অভিমান হয়েছিলো জানো তাও সানফির জন্য,তোমায় ভালোবাসার জন্য নি র্ল জ্জের মতো তোমাদের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলাম কিন্তু আফসোস সেখানে গিয়ে শুনি তোমরা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে গিয়েছো।ব্যাস চেষ্টা করেও লাভ হয় না কিছুই।তবে তিনমাস আগে আব্বুর ট্রান্সফারের জন্য রংপুর আসতে হলো।’

নীরবতায় ছেয়ে গেলো কক্ষ।চারদিকেই পিনপতন নীরবতা।রুহিয়ার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা।অন্তিকের‌ও চক্ষুদ্বয় লাল বর্ণ ধারণ করেছে।একে অপরের দিকে স্হির অচঞ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে দু’জনে।কিয়ৎকাল নীরবতায় অতিবাহিত হলো।নীরবতা ভে ঙে অন্তিক বললো,
‘এসব আমি করবো তোমার মনে হয়?আমাদের দুজনকেই ভুল বোঝানো হয়েছে।দুজনকে একে অপরের চোখে খারাপ বানানো হয়েছে।আর এই ভুল বোঝাবুঝির দরুণ এই অবস্থা আমাদের।’

করুণ চোখে তাকায় রুহিয়া।চোখের জল মুছে স্বগোক্তি করে,
‘হ্যাঁ অন্তিক এবার বুঝলে তো পুরো ব্যাপারটা।এ বাড়িতে আসার আমি বুঝেছিলাম কিছু একটা মিস আন্ডারেস্টিং আছে কিন্তু তুমি তো শোনোই নি আমার কথা।আমায় তো সহ্য‌ই করতে পারো না,ঘৃণা করো।’

কথাগুলো বলে ম্লান হাসে রুহিয়া।অন্তিক কাল বিলম্ব না করে জড়িয়ে ধরে রুহিয়াকে।রুহিয়ার মাথায় হাত রেখে বক্ষমাঝারে ঠেকিয়ে নেয়।পুরুষটির চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়।অসহায় কন্ঠে সে বলে,
‘আ’ম স্যরি সানশাইন,আ’ম ভেরি স্যরি।ক্ষ মা করে দাও আমায়।’

রুহিয়া অন্তিকের বুকে মাথা রেখে রিনরিনিয়ে বলে,
‘আমিও স্যরি।তবে একটা কথা প্লিজ সবটা আবার আগের মতো করে নেও না আমি আর পারছি না এসব সহ্য করতে।আমি সানফি আর তোমাকে নিয়ে সুখে থাকতে চাই।’

অন্তিক দু’হাত শিথিল করে।হাত দুখানা রুহিয়ার দু গালে রাখে।অপলক তাকায় রুহিয়া অন্তিকের দিকে।অন্তিক আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় রমণীর ললাটে।মা থা নাড়িয়ে বলে,
‘আমিও তোমাকে চাই।আমার আর সানফির জন্য তুমি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।প্লিজ আমাদের ছে ড়ে যেও না।’

রমণী উপর নিচ মা থা নাড়ায়।অন্তিক পুনরপি আলিঙ্গন করে নিজ প্রেয়সীকে,আগলে নেয় বক্ষমাঝে।
_______________________________
ধরিত্রীতে প্রত্যুষের সূচনা হয়েছে কিয়দংশ পূর্বে।পূর্ব দিগন্তে দেখা মিলেছে তপনের।তীব্র হলদেটে আলো জানালার গ্লাসে প্রতিফলিত হয়ে এসে পড়ছে রমণীর মুখশ্রীতে।কিয়ৎক্ষণ ধরেই বির ক্ত হচ্ছে রমণী।এখন আর স‌ইতে না পেরে বির ক্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে চোখ মেললো সে।ধীরে ধীরে ওঠার প্রয়াস করলো।কিন্তু সফল হলো না।কেননা রুহিয়া দেখলো এক শক্তপোক্ত হাত তাকে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে ঘুমুচ্ছে।ওষ্ঠাধর প্রসারিত হয় রুহিয়ার,আলতো ভাবে সে স্পর্শ করে ঘুমন্ত অন্তিকের ললাট।পরম যত্নে একবার হাত বুলিয়ে দেয়।পরক্ষণেই মুচকি হেসে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা। থেকে নেমে দাঁড়ায়।দু পা এগিয়ে গ্লাসের পর্দা টেনে দেয়।অন্তিক কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে আবারো ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দেয়।
______________________________
সন্ধ্যা সাতটা।বিছানায় বসে সানফির চুল বেঁধে দিচ্ছে রুহিয়া।রুহিয়ার পাশেই অন্তিক বসে অফিসের ফাইলপত্র দেখছে।আজ সকালেই বাড়ির সব সদস্য ফিরে এসেছে।রুহিয়া সানফির চুলগুলো দু’পাশে ঝুটি করে দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘সানফি সোনা তোমার চুল বাঁ ধা হয়ে গিয়েছে।’

পেছনে ঘুরলো সানফি।রুহিয়ার মুখোমুখি হয়ে বসলো।কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো রুহিয়া।সানফি গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললো,
‘মা তুমি তো আমায় ভালোবাসো না।তুমি তো আমায় ছে’ড়ে চলে গিয়েছিলে।কখনো আমার খোঁজ‌ও নেও নি,আমায় মনেও করো নি।আমায় একটুও ভালোবাসো না তুমি।তুমি খুব ব্যাড মা।’

চলবে
[ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।]
ধন্যবাদ ____________💛