ভালোবাসার ব্যাকরণ পর্ব-০৯

0
225

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
#লেখনীতে_মাইসারাহ_আরোহি🌸
[পর্ব ০৯]

‘মা তুমি তো আমায় ভালোবাসো না।তুমি তো আমায় ছে’ড়ে চলে গিয়েছিলে।কখনো আমার খোঁজ‌ও নেও নি,আমায় মনেও করো নি।আমায় একটুও ভালোবাসো না তুমি।তুমি খুব ব্যাড মা।’

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে নিষ্প্রভ চোখে তাকালো রুহিয়া।রমণীর অন্তঃকরণ তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে,মুখ ফুটে বের হচ্ছে না কোনো শব্দ।সে শুধু নিষ্প্রভ,নিষ্প্রাণ চাহনিতে সানফির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।অন্তিক এক পলক তাকালো রুহিয়ার আননপানে।মলিন মুখখানি দেখে বক্ষস্হল যেনো মোচড় দিয়ে উঠলো।অবিলম্বে অন্তিক বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।ধম কের সুরে মেয়ের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘এসব কোন ধরণের কথা সানফি?কি শিখিয়েছে তোমায় এসব কথা?’

অন্তিকের ধমকে কেঁ পে ওঠে সানফি।তৎক্ষণাৎ সে মাথা নিচু করে।রুহিয়া মৃদু স্বরে অন্তিক’কে বলে,
‘ওকে ধমক দিচ্ছো কেনো!ও তো ছোট,ওকে এভাবে বোলো না।সানফি সোনা তুমি আমার কাছে এসো।’

রুহিয়া হাত বাড়িয়ে দেয়।সানফি গিয়ে জড়িয়ে ধরে রুহিয়াকে।ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকায় অন্তিকের দিকে।অন্তিক শান্ত কন্ঠে বলে,
‘না রুহিয়া,শাসন না করলে ও খারাপ হয়ে যাবে।আমার মেয়ে তো এমন ছিলো না,ওকে তো এসব বলার শিক্ষা দি‌ই নি আমি।কিন্তু ও এসব শিখলো কোথায়?সানফি বলো কে এসব বলেছে?’

অন্তিকের শান্ত কন্ঠে সুপ্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ।সানফি আরেকটু শ ক্ত করে রুহিয়াকে আঁকড়ে ধরলো।মলিন মুখে ক্ষীণ স্বরে সানফি বললো,
‘স্যরি মা আমি এসব বলতে চাই নি।আমাকে তো দিদান এসব বলেছে।দিদান বলেছে তুমি খুব বা’জে,আমায় ভালোবাসো না।আমি খুব ক’ষ্ট পেয়েছিলাম তাই তোমায় বলেছি।আমার ওপর রাগ কোরো না মা।’

প্রচন্ড বিস্মিত হলো অন্তিক ও রুহিয়া।একে অপরের দিকে তাকালো বি স্ফো রিত চোখে।অবাকের শীর্ষে পৌঁছে অন্তিক বলে উঠলো,
‘মা তোমায় এসব কথা বলেছে সানফি?তুমি সত্যি বলছো?’

সানফি উপরনিচ মাথা নাড়ায় যার অর্থ সে সত্যি বলছে।অন্তিক আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না।হনহন করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।রুহিয়াও সানফিকে নিয়ে তার পিছু পিছু পদচারণা করে।রুহিয়া ডাকে কয়েকবার অন্তিক’কে কিন্তু কোনো লাভ হয় না।অন্তিক তাতে কর্ণপাত না করেই সোজা বসার ঘরে চলে আসে।মিসেস সাবিনা,শামীম আহমেদ ও গুঞ্জন তিনজনে পাকোড়া খেতে খেতে টিভি দেখছেন।অন্তিক’কে দেখে মিসেস সাবিনা বলে উঠলেন,
‘কিছু বলবি বাবা?’

নিজেকে সং য ত রেখে অন্তিক শান্ত কন্ঠে বলে,
‘হুম বলার জন্য‌ই তো এসেছি।তুমি সানফিকে কি বলেছো মা?কেনো তুমি রুহিয়ার নামে বা’জে কথা বলেছো ওর কাছে?তুমি জানো না ও ছোট,এই নিয়ে ওর মনে কতোটা ইফে ক্ট পড়বে!’

দৈবাৎ এহেন কথা শোনায় অপ্রতিভ হলেন মিসেস সাবিনা।দাঁড়িয়ে গিয়ে ভড় কে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকালেন অন্তিকের মুখের দিকে।অন্তিকের চোখের শীতল চাহনি,কিন্তু মুখে স্পষ্ট ক্রোধের ছাপ।শামীম আহমেদ উঠে দাঁড়ালেন উনার সাথে সাথে গুঞ্জন‌ও দাঁড়িয়ে পড়লো।মিসেস সাবিনা এক পলক তাকালেন সানফির দিকে।সানফি শ’ক্ত করে রুহিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।মিসেস সাবিনা স্পষ্ট গলায় বললেন,
‘হুম আমি বলেছি,ঠিকই তো বলেছি অন্তিক।ও তো তোকে রেখে চলে গিয়েছিল।দুই দিন আগেও তো ওকে সহ্য করতে পারছিলি না তাহলে আজ কেনো ব‌উয়ের প্রতি এতো দরদ দেখাচ্ছিস!’

বি স্ফো রিত নয়নে তাকালো অন্তিক।কিছুটা জোরেই বলে উঠলো,
‘মা!তুমি এমন কেনো করছো?তুমি তো রুহিয়াকে সবসময় সাপোর্ট করতে আর আজ তুমি-ই এমন কথা বলছো!মা আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিলো।…বাই দ্যা ওয়ে রুহিয়া যে আমায় ছে ড়ে চলে গিয়েছিল সেটা তোমায় কে বললো?আমি তো তোমাদের বলেছিলাম আমি-ই ওকে চলে যেতে বলেছি।তুমি জানলে কিভাবে?’

বাক্যদ্বয় বলে অন্তিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো মিসেস সাবিনার দিকে।আরেকদফা অপ্রতিভ হলেন মিসেস সাবিনা।পেছন থেকে শোনা গেলো অতুলের কন্ঠস্বর।
‘ভাইয়া কাকে কি বলছিস তুই!যে তোদের ভু’ল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেছে সে তো পুরো ঘটনাটা জানবে সেটাই স্বাভাবিক।আর ভাইয়া মা ভাবিকে সাপোর্ট কখনোই করে নি,ওগুলো তো ছিলো মায়ের নাটক।’

অতুলের কথায় সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার দিকে।অতুল সামনের দিকে এগিয়ে এলো।অন্তিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘এসব তুই কি বলছিস অতুল?’

অতুল মৃদু স্বরে বলে,
‘আমি‌-ই ঠিকই বলছি ভাইয়া।তোদের মধ্যে কি হয়েছিলো সেটা আমরা কেউই জানতাম না,তুই কখনো আমাদের বলিস নি।সবসময় বলেছিস তুই ভাবিকে চলে যেতে বলেছিস তাই ভাবি চলে গিয়েছে।কিন্তু কখনোই বলিস নি আসল কারণটা।অথচ মা আজ বেফাঁস কথাটা বলে ফেললো।কারণ মা নিজেই তো এসব করেছে।এই সবকিছু মা তানি আপুর সঙ্গে মিলে করেছে।শুরু থেকেই মা রুহিয়া ভাবিকে তোর স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারে নি শুধু উপরে উপরেই ভালো আচরণ করতো আর মনের মধ্যে ছিলো আরেক।এভাবেই মা সবসময় সবার কাছে ভালো সেজে আড়ালে তোদের সম্পর্কে ভাঙ ন ধরাতো।কি মা আমি ঠিক বলছি তো?’

সকলের দৃষ্টি থমকায় মিসেস সাবিনার দিকে।সকলের‌ই কৌতুহল মিসেস সাবিনার মুখ থেকে সবটা শোনার।অন্তিক আর ধৈর্য রাখতে পারে না।মিসেস সাবিনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘অতুল যা বলছে সব সত্যি মা?চুপ করে থেকো না মা উত্তর দাও।’

মিসেস সাবিনা উপর নিচ মাথা নাড়ালেন।অন্তিক বিস্মিত হলো।বাকিদের‌ও ঠিক এক অবস্থা।মিসেস সাবিনার চোখ হতে এক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।অন্তিক পুনশ্চ বললো,
‘এসব করার কারণ টা কি মা?একটু বলবে প্লিজ।’

কিয়ৎক্ষণ বিরাজ করে নীরবতা।মিসেস সাবিনা নীরবতা ভে ঙে ক্ষীণ স্বরে বলেন,
‘আমি তোকে সুখী দেখতে চেয়েছিলাম।আমি জানতাম তুই তানি’কে পছন্দ করিস।কিন্তু তোর বাবা তানি বিদেশ যাবার পর জোর করে রুহিয়ার সঙ্গে তোর বিয়ে দিলো।আমি জানি বিয়েতে তুই রাজি ছিলি না।তোর কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছিলো না সেজন্য আমি চাইছিলাম রুহিয়াকে এখান থেকে সরাতে।সে কারণেই তানির কথামতো আমি এসব করেছি।আমি তোর সুখের জন্য এসব করেছি অন্তিক।’

অন্তিক তৎক্ষণাৎ ক্রো ধিত স্বরে বললো,
‘সুখী হবো তাও আবার তোমার সো কল্ড ভাগ্নিকে নিয়ে,সিরিয়াসলি মা!তোমায় কে বলেছিলো মা আমি সুখী ন‌ই?নিশ্চয়ই তোমার ভাগ্নি।হুম আমি মানছি রুহিয়ার সঙ্গে বিয়েতে আমার মত ছিলো না কিন্তু আমি অসুখী কখনোই ছিলাম না।বরং ওর সাথে বিয়ের পর আমার জীবনে সুখ ফিরে এসেছিলো,যথেষ্ট সুখে-শান্তিতে ছিলাম আমি।ক ষ্ট তো তোমার ভাগ্নি আমায় দিয়েছে।নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে আমায়।আমায় ধোঁ কা দিয়ে বিদেশ গেলো,ওখানে গিয়ে নিজের বয়ফ্রেন্ডকে বিয়েও করলো আবার এদিকে আমার সংসার ভা ঙার জন্য ছক‌ও বানালো,বাহ অসাধারণ!তোমার ভাগ্নির নাম গিনিস বুকে থাকা উচিত,অ্যাওয়ার্ড দেয়া উচিত ওকে।সেই সাথে তোমাকেও অ্যাওয়ার্ড দেয়া উচিত মা।অন্যের কথা শুনে কিভাবে পারলে নিজের ছেলের ক্ষ’ তি করতে?আজ তোমার জন্য‌ই আমার এই অবস্থা,তোমার জন্য‌ই এতগুলো দিন সানফি ওর মাকে কাছে পায় নি।ছি্হ মা আর কিছু বলার মুখ রাখলে না আমার।’

কথাগুলো বলে দীর্ঘ শ্বা স ছাড়লো অন্তিক।মিসেস সাবিনা নীরবে নতমুখে চোখের জল ফেলছেন।শামীম আহমেদ অতুলকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমি এতো কথা কিভাবে জানলে অতুল?’

‘আজ বিকেলে মা ফোনে কাউকে এই কথাগুলো বলছিলো তখন‌ই শুনেছি আমি।’

‘ছি্হ সাবিনা এমন জঘন্য কাজ করলে তুমি!ছেলে,ব‌উমাদের সামনে আমার মা থা হেট করে দিলে।’

রেগেই কথাখানা বললেন শামীম আহমেদ।মিসেস সাবিনা তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলেন রুহিয়ার কাছে।রুহিয়ার হাত ধরে তিনি কান্নাভেজা গলায় বললেন,
‘আমায় ক্ষ মা করে দাও ব‌উমা।খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছি আমি।আমি বুঝতে পারি নি ভালো করতে গিয়ে এত বড় খারাপ করে ফেলবো।’

রুহিয়া উনার চোখের জল মুছিয়ে দেয়।শীতল কন্ঠে বলে,
‘ক্ষ মা চাইতে হবে না মা।আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন এতেই হবে।’

মিসেস সাবিনা কৃতজ্ঞতা সূচক তাকালেন রুহিয়ার দিকে।রুহিয়া মুচকি হাসলো।উনি ফের এগিয়ে গেলেন অন্তিকের দিকে।নতমুখে বললেন,
‘পারলে আমায় ক্ষ মা করে দিস বাবা।’

অন্তিক অন্যদিকে মুখ ঘোরায়।রুহিয়া অন্তিকের নিকট এগিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
‘ক্ষ মাশীলতা একটি মহৎ গুণ।কেউ তার ভুল বুঝতে পারলে তাকে ক্ষ মা করে দেওয়া উচিত।’

চলবে
[ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।]
ধন্যবাদ __________💜