ভালোবাসার ব্যাকরণ পর্ব-০৭

0
201

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
#লেখনীতে_মাইসারাহ_আরোহি🌸
[পর্ব ০৭]

বিছানার ওপর উঠে বসলো সানফি।মুখে একটা সিরিয়াস ভাব এনে বললো,
‘বাবা আর মায়ের ঝগড়া হয়েছে।ওরা দুজন একে অপরের সাথে কথা বলে না।বাবা সবসময় মা’কে বকে।আমার ভালো লাগে না কাকাই।আমাদের কিছু একটা করতে হবে,বাবা আর মায়ের মধ্যে ভাব করাতে হবে।’

সানফির কথায় গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হলো অতুল।গুঞ্জন‌ও গালে হাত দিয়ে বসে আছে।বেশ কিছু সময় চিন্তা-ভাবনা করার পর অতুল বললো,
‘একটা উপায় আছে।’

সানফি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়,
‘কি উপায় কাকাই?’

‘বলছি তোমরা দু’জনে এদিকে এসো।’

গুঞ্জন ও সানফি অতুলের সন্নিকটে অবস্হান নেয়।অতুল কানে কানে তাদের কিছু বলে।খিলখিল হাসির আওয়াজে মুখরিত হয় চারদিক।তিনজনে একত্রে হাত মেলায়।
________________________________
সূর্য অস্ত যাবার পরপর‌ই আঁধার নেমেছে ধরিত্রীতে।চারিধার আজ নিগূঢ় তমসায় আবৃত।অন্তরীক্ষে দেখা নেই বিঁধুর,নেই কোনো নক্ষত্র ও তারকারাজি।চতুর্দিকেই ঘুটঘুটে অন্ধকার।রাস্তার দু’ধারের ল্যাম্পপোস্ট প্রাণপণ চেষ্টা করছে আঁধার দূরীকরণে।অফিসে নিজ কেবিনে বসে কাজ করছে বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী পুরুষটি।ইদানিং তার কাজের চাপ একটু বেশিই,বাড়ি ফিরতে রোজ‌ই আটটা,ন’টা বাজছে।টেবিলের বাম পাশে পিজরাপোলের আ সামির ন্যায় পড়ে থাকা মুঠোফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো।কাজের মাঝে বাঁ ধা আসায় বেজায় বির ক্ত হলো অন্তিক।ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাতে নিলো ফোনখানা।স্ক্রিনে ভাসমান বাড়ির ল্যান্ড লাইন নম্বর।কলখানা রিসিভ করে কানে ধরতেই অন্তিক শুনতে পেলো সানফির কা ন্নাভে জা কন্ঠস্বর।
‘বাবা বাঁ চাও আমাকে,আমার ভীষণ ভ য় করছে।আমি বাড়িতে একা,বাড়িতে কেউ নেই।বাবা প্লিজ তুমি তাড়াতাড়ি এসো।’

বাক্যদ্বয় বলেই সানফি হু হু কেঁদে ফেললো।অন্তিকের উৎকন্ঠা দ্বিগুণ হলো।সে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
‘সোনা তুমি একদম ভ য় পেও না আমি এক্ষুনি আসছি।’
তৎক্ষণাৎ অন্তিক টেবিলের ওপর থেকে গাড়ির চাবিখানা নিয়ে দ্রুততার সহিত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
______________________________
ঘুটঘুটে অন্ধকার বসার ঘরটায়।সারা বাড়িতে কোথাও আলো নেই।অতিরিক্ত অন্ধকারের দরুণ কিছুই দেখা যাচ্ছে না।তবুও টিপে টিপে পা ফেলছে রুহিয়া।হঠাৎ করেই বেশ জোরেই কোনোকিছুর সাথে ধা ক্কা লাগে রমণীর।তৎক্ষণাৎ সে ‘আহ্’ বলে ওঠে।ফোনের ফ্লাশ লাইট অন করে অন্তিক।রুহিয়াকে দেখা মাত্রই বিস্ময় চিত্তে বলে,
‘তুমি!’

কপালে হাত বোলাতে বোলাতে রুহিয়া মৃদু স্বরে বললো,
‘হ্যাঁ আসলে আম্মুর কাছে গিয়েছিলাম সানফি ফোন করে বললো বাড়িতে কেউ নেই ওর খুব ভয় করছে।সেজন্য‌ই তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম।কিন্তু চারদিকে এত অন্ধকার কেনো?’

অবাকে কিংকর্তব্যবিমুঢ়‌ অন্তিক।এক‌ই কথা সানফি দু’জনকে কেনো বলেছে সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না তার।চিন্তায় ললাটে তিনটে ভাঁজ ফেললো অন্তিক।শান্ত স্বরে বললো,
‘সানফি তো আমাকেও সেইম কথা বলেছে।বাই দ্যা ওয়ে তুমি ফ্লাশ অন করো নি কেনো?অন্ধকারে ভূ ত,পে ত্নির মতো হাঁটছো!’

‘মনে ছিলো না।যাই হোক সানফিকে খুঁজতে হবে।মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়েছে।সানফি…সানফি সোনা তুমি কোথায়?’

গলার স্বর বাড়িয়ে সানফিকে কয়েকবার ডাকলো রুহিয়া।কিন্তু সানফির কোনো সাড়া নেই।রুহিয়া,অন্তিক দু’জনেই বিস্মিত হলো।পুনরপি রমণী ডাকলো সানফিকে কিন্তু এবারেও চারদিক নিস্তব্ধ,নীরব।সহসা বন্ধ হলো সদর দরজা।দরজা বন্ধ হ‌ওয়ার আওয়াজে পেছনে ঘুরে তাকালো দুজনে।আলো জ্ব লে উঠলো বসার ঘরের।সেই সাথে ভেসে এলো সানফির।
‘বাবা-মা আমি যেখানেই থাকি তোমাদের আমি দেখতে পাচ্ছি।শোনো তোমরা সবসময় একে অপরের সাথে ঝগ’ড়া করো এই বিষয়টা আমার ভালো লাগে না।তাই আমি চাই তোমরা দু’জনে ভাব করো।’

চক্ষুকোটর চতুর্দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সানফিকে খোঁজার প্রয়াস করে অন্তিক ও রুহিয়া।কিন্তু কোথাও সানফিকে না পেয়ে দুজনেই হতাশ হয়।অন্তিক মৃদু স্বরে বলে,
‘বেবি কেনো এমন হাইড এন্ড সিক খেলছো?বেরিয়ে এসো না।বাবার কিন্তু খুব টেনশন হচ্ছে।’

‘উহু বললাম তো আমি ঠিক আছি আর তোমাদের দেখতেও পাচ্ছি।তোমরা এখান থেকে কোথাও যাবে না।যাই হোক এবারে তোমরা দু’জনে ভাব করো দু’জনের সাথে।’

রুহিয়া এবার উদ্বি গ্ন গলায় বলে,
‘সোনা তুমি বেরিয়ে এসো না।দেখো তোমার জন্য আমি চকোলেট এনেছি।’

সানফি কিছুটা বির ক্ত হয়ে বলে,
‘উহু বললাম না তোমরা আগে ভাব করো।হ্যান্ডশেক করো দু’জনে।’

অন্তিক রা গী দৃষ্টিতে তাকালো রুহিয়ার দিকে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘এসব তোমার কাজ তাই না?সানফিকে তুমি‌ই এসব করতে বলেছো!’

এহেন কথায় রুহিয়ার‌ও রাগ লাগে।সে চোখ রাঙিয়ে দাঁত কটমট করে বললো,
‘আমার খেয়ে তো কাজ নেই যে এসব করতে যাবো।আমি এসব করি নি।’

‘উফ বাবা-মা তোমরা আবার ঝগড়া করছো,এমন করলে আমি কিন্তু বেরোবোই না।’

সানফির কথায় ভীত হয় দু’জনেই।বাধ্য হয়ে হ্যান্ডশেক করে একে অপরের সঙ্গে।সানফি পুনশ্চ বলে,
‘এভাবে না হাসতে হবে।স্মাইল করো দু’জনে।’

একে অপরের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো দু’জনে।অন্তিক অনুরুদ্ধ কন্ঠে বললো,
‘এবার তো এসো।’

‘না এখনো তোমাদের ভাব হয় নি।আমি ফ্রেন্ডসদের সাথে ভাব করলে তাদের হাগ করি।তোমরাও হাগ করো।’

‘সানফি এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসো বলছি।’

কিছুটা রেগেই কথাখানা বললো অন্তিক।প্রত্যুত্তরে সানফিও তেজ দেখিয়ে বললো,
‘ঠিক আছে আমায় বকছো তো আমি আর বেরোবোই না।থাকো তোমরা।আমায় তো কেউ লাভ করো না।’

মহা মুশকিলে পড়েছে অন্তিক।সে জানে তার মেয়ের জেদ সম্বন্ধে।উপয়ান্তর না পেয়ে অন্তিক হুট করেই রুহিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।ঘটনার আ কস্মি কতায় হতভম্ব হলো রমণী।শ্রবণ হলো পুরুষটির হৃদস্পন্দন।ধুক ধুক আওয়াজ হচ্ছে,রুহিয়া চোখের পলক ফেললো।শোনা গেলো সিটি এবং করতালির আওয়াজ।তৎক্ষণাৎ অন্তিক ছেড়ে দিলো রুহিয়াকে।অতুল হাসতে হাসতে বললো,
‘বাহ অবশেষে ভাব হলো দু’জনের।ভাইয়া চিন্তা করিস না সানফি আমাদের কাছে আছে।আমি আর গুঞ্জন ওকে নিয়ে গুঞ্জনের বাবার বাড়ি যাচ্ছি।মা আর বাবাও আজ গ্রামেই থাকবে।বাড়ি ফাঁকা বুঝলি,আজকে দু’জনে স্পেশাল টাইম স্পেন্ড কর।সব দূরত্ব মিটিয়ে নে।অল দ্যা বেস্ট ব্রো।বাই।’

‘আরেহ অতুল শোন….অতুল।’

অন্তিক বেশ কয়েকবার ডাকলো অতুলকে।কিন্তু ততোক্ষণে অতুল সানফি ও গুঞ্জনকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।এতো সময় তারা বাইরে দাঁড়িয়ে মাউথ স্পিকারের সাহায্যে এসব করছিলো।পুরো ব্যাপারখানা বোধগম্য হতেই সোফায় বসে পড়লো অন্তিক।এইটুকু মেয়েও তাকে বোকা বানালো ভাবতেই অন্তিকের অবাক লাগছে।অপরদিকে রুহিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অন্তিকের মুখের দিকে।অন্তিক চোয়াল শ ক্ত করে ধ মকের সুরে বলে ওঠে,
‘এভাবে তাকিয়ে আছো কিসের জন্য ডানা গজিয়েছে আমার?’

কেঁ পে ওঠে রুহিয়া।মলিন মুখে বলে,
‘কিছু না।’

অন্তিক ঠাঁয় বসে রয় সোফায়।পা থেকে জুতো-মোজা খুলে ফেলে।গলার কাছ থেকে শার্টের দু’টো বোতাম আনলক করে,ইন ছেড়ে দিয়ে ভালোভাবে হেলান দিয়ে বসে চোখজোড়া গ্রথন করে।রুহিয়া ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।অতঃপর বসার ঘরের ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে যায় রাতের খাবার বানানোর উদ্দেশ্যে।রাইস কুকারে চাল দিয়ে গ্যাসের চুলায় তরকারি রান্না করছে রমণী।হুট করেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে।ফলস্বরূপ অসাব’ধানতাবশত গরম কড়াই হাতে লাগে তার।পু ড়ে যায় হাতের কিছু অংশ।রুহিয়া চিৎকার দিয়ে ওঠে।অবিলম্বে রান্নাঘরে ছুটে এলো অন্তিক।রুহিয়ার নিকট এসে উদ্বি গ্ন কন্ঠে বললো,
‘সানশাইন তুমি ঠিক আছো?কি হয়েছে তোমার?’

অপলক তাকালো রুহিয়া অন্তিকের দিকে।আজ কয়েকবছর পর অন্তিক তাকে সানশাইন বলে সম্বোধন করলো।ভাবতেই রমণীর অধর কোণে দৃশ্যমান হলো হাসির রেখা।রুহিয়া মৃদু স্বরে বললো,
‘কতদিন পর ডাকলে সানশাইন বলে।’

বেশ অপ্রতিভ হয় অন্তিক।প্রসঙ্গ এড়িয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
‘হাত পু ড়ে গিয়েছে তোমার!ওষুধ লাগাতে হবে।আমার সাথে এসো।’

চুলা বন্ধ করে রুহিয়াকে নিয়ে বসার ঘরে এলো অন্তিক।তৎপর ঘর থেকে ওষুধ এনে পরম যত্নে ফুঁ দিয়ে রুহিয়ার হাতে লাগিয়ে দিলো।রুহিয়া শুধু অনিমেষ তাকিয়ে দেখছে অন্তিক’কে।অন্তিক শানিত কন্ঠে বললো,
‘চুপচাপ এখানে বসে থাকবে।অনেকখানি পু ড়ে গিয়েছে।একটুও তো সাবধান হতে পারো না।’

‘আমি এখানে বসে থাকলে রান্না কে করবে?খেতে হবে তো নাকি!বাইরে থেকে যে খাবার আনবে তার‌ও তো উপায় নেই,গেইট আ টকে দিয়ে গিয়েছে অতুল।’

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো রুহিয়া।অন্তিক এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
‘বলা শে ষ হয়েছে?তোমাকে কিছু করতে হবে না।আমি পারবো রান্না করতে।তুমি এখানেই থাকো।’

রুহিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অন্তিক সোজা রান্নাঘরে চলে যায়।পুনরায় চুলা অন করে রান্না করতে থাকে।রুহিয়া বসার ঘর থেকে দেখছে সব।এমনিতেই গরম পড়েছে তার ওপর রান্নাঘরে আরো গরম সবমিলিয়ে অন্তিক ঘেমে নেয়ে একাকার।বারবার হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে সে।রুহিয়া মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায়।ঘর থেকে হাত পাখা এনে রান্নাঘরে আসে।এক হাত দিয়ে বাতাস করতে থাকে অন্তিক’কে।অন্তিক আড়চোখে দেখে তবে মুখে কিছু বলে না।

পনেরো মিনিট পরে ভাত,তরকারি সব রান্নাই শেষ হলো।অন্তিক টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।তন্মধ্যে রুহিয়া দুজনের প্লেটে খাবার বাড়লো।অন্তিক ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে এসে চেয়ার টেনে বসে এক লোকমা ভাত মুখে দিলো।পাশাপাশি চেয়ারে বসে খাওয়ার চেষ্টা করছে রুহিয়া।ডান হাতটা পু ড়ে যাওয়ায় খেতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে তার।বিষয়খানা নজর এড়ালো না অন্তিকের।সে এক লোকমা ভাত রুহিয়ার মুখের সামনে ধরে বললো,
‘হাতে প্রেসার দেয়ার দরকার নেই।আমি খাইয়ে দিচ্ছি,খেয়ে নেও।’

চমকিত চাহনিতে তাকালো রুহিয়া।অন্তিক তাকে খেতে ইশারা করলো।রুহিয়া মুখে নিলো খাবারটুকু।জলে পরিপূর্ণ হলো অক্ষিকোটর।অশ্রুসিক্ত নয়নে অন্তিকের দিকে তাকিয়ে রুহিয়া মৃদু স্বরে বললো,
‘আজ‌ও আমায় আগের মতোই ভালোবাসো তাহলে এতো দূরত্ব কিসের?কিসের এতো ঘৃ ণা,এতো অপছন্দ?’

থমকে যায় অন্তিক।দৃষ্টি ম্লানভাবে নিবদ্ধ হয়।থমথমে মুখে শান্ত স্বরে অন্তিক বলে,
‘সব তো তোমার জন্যেই।তুমি যদি ছেড়ে না যেতে তবে সবকিছুই অন্যরকম হতো।’

চলবে
[ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।]
ধন্যবাদ ___________💛