ভালোবাসার ব্যাকরণ পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
508

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
#লেখনীতে_মাইসারাহ_আরোহি🌸
[পর্ব ১০] (অন্তিম পাতা)

অন্তিক অন্যদিকে মুখ ঘোরায়।রুহিয়া অন্তিকের নিকট এগিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
‘ক্ষ মাশীলতা একটি মহৎ গুণ।কেউ তার ভুল বুঝতে পারলে তাকে ক্ষ মা করে দেওয়া উচিত।’

অন্তিক উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘হুম।কিন্তু এমন আর কোরো না মা,সহ্য করতে পারবো না।’
এটুকু বলেই অন্তিক চলে যায়।মিসেস সাবিনা দীর্ঘ শ্বা স নেন।বাকিরাও ফিরে যায় নিজ নিজ কক্ষে।
__________________________________
কুয়াশার চাদর জড়িয়ে শীতের আগমন।উত্তুরে হাওয়ায় হিমেল ভাব।কনকনে ঠান্ডায় কুপোকাত জনজীবন।অন্তিক,রুহিয়া,সানফি,অতুল,গুঞ্জন বাড়ির সবাই এবং রুহিয়ার মা-বাবা সকলে মিলে শীতের ছুটি কা’টাতে গ্রামে এসেছে।শহরের শীতের তুলনায় গ্রামে শীত একটু বেশি‌ই।শহরে বড় বড় অট্টালিকা আর জনসমাগমের কারণে শীতের প্রকোপ কম কিন্তু গ্রামের ফাঁকা,খোলামেলা পরিবেশে শুধুই হিমেল হাওয়া।গতকালকের তুলনায় আজ বেশ কুয়াশা।কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারদিক।সবকিছু আবছা,অস্পষ্ট।ক্ষণে ক্ষণে শীতল হাওয়া ব‌ইছে।আর এই শীতের মধ্যে সকাল সকাল হাঁটতে বেরিয়েছে অন্তিক ও রুহিয়া।চতুর্দিক জনমানব শূণ্য।গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটছে দু’জন মানব-মানবী।অন্তিকের পরনে জ্যাকেট,মাথায় টুপি আর রুহিয়া তার গায়ে শুধু শাল জড়ানো।হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দেয় দু’জনে,তৎপর স্হির হয় এক খোলা মাঠের সম্মুখে।রুহিয়া মুচকি হেসে বলে,
‘ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দুগুলো দেখছো,কি চমৎকার তাই না!ইস একটু সূর্যের আলো পড়লে মুক্তোর মতো লাগতো!’

অন্তিক চারিধার অবলোকন করে শীতে শীতে কাঁ পতে কাঁ পতে বললো,
‘যে কুয়াশা আজ সূর্যের দেখা পাবে না।তাছাড়া খুব বাতাস আজ।’

খিলখিল করে হেসে উঠলো রমণী।অন্তিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলো।রুহিয়ার দিকে ভ্রুকুটিমিশ্রিত চাহনি নিবদ্ধ করে বললো,
‘হাসছো কেনো?আমি কি হাসার মতো কিছু বললাম?’

রুহিয়া ডানে-বামে মাথা নাড়ায়।হাসির রেখা অধর কোণে বজায় রেখে বলে,
‘উহু তুমি কথা বলছো ধোঁয়া বের হচ্ছে।ওইজন্য হাসলাম।’

অন্তিক মৃদু হাসলো।রুহিয়া পায়ের স্যান্ডেল জোড়া খুলে খালি পায়ে দাঁড়ালো।অন্তিক ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে বিষয়খানা উপলব্ধি করার প্রয়াস চালালো।খালি পায়ে রুহিয়া এগিয়ে গেলো মাঠের ভেতরের দিকে।অন্তিক কৌতুহলী কন্ঠে শুধালো,
‘কি করছো?’

‘ইচ্ছে পূরণ।আমার খুব শখ ছিলো শীতের সকালে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর হাঁটবো।’

রুহিয়া কন্ঠে ভালো লাগার রেশ প্রকাশিত।অন্তিক পুনরপি বাক্য বাড়ায় না।রুহিয়ার মতো সেও জুতো খুলে খালি পায়ে ঘাসের ওপর দাঁড়ায়।এক হাত বাড়িয়ে দেয় রুহিয়ার পানে।মুচকি হেসে রমণী হাত ধরে প্রিয়তমো পুরুষের।একসাথে পা ফেলে ঘাসের ওপর।কিয়ৎকাল অতিবাহিত হয়।দু’জনে ফের পা বাড়ায় বাড়ির উদ্দেশ্যে।
_________________________________
উঠানে চায়ের কাপ হাতে বসে আছেন শফিকুল ইসলাম ও শামীম আহমেদ।পাশেই ছোট্ট রান্নাঘরটায় সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন মিসেস সাবিনা ও তাসলিমা ইসলাম।এই বাড়িটা মূলত শফিকুল ইসলামের বাবার।কেউ থাকে না তাই পাশের বাড়ির লোকজন দেখে-শুনে রাখে।বছরান্তে শফিকুল ইসলাম একবার আসেন পরিবার নিয়ে।এবারে সবাইকে নিয়ে এসেছেন।বেশ ভালোই লাগছে সবার।উঠান থেকে খানিকটা দূরে অতুল ও গুঞ্জন ঝ গড়া করছে।তাদের ঝ গড়া হলো খেজুরের রস খাওয়া নিয়ে।সানফি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুঞ্জন আর অতুলের ঝগড়া দেখছে।তন্মধ্যে আগমন অন্তিক ও রুহিয়ার।তাদেরকে দেখা মাত্র‌ই সানফি ছুটে গেলো।অন্তিক কোলে তুলে নিলো সানফিকে।গুঞ্জন ও অতুল ঝ গড়া থামালো।সানফি গাল ফুলিয়ে বললো,
‘মা-বাবা তোমরা আমাকে রেখে কোথায় গিয়েছিলে?আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি তোমরা নেই।’

অন্তিক চুমু খায় মেয়ের গালে।স্মিত হেসে বলে,
‘কোথাও যাই নি বেবি,এই সামনে একটু হাঁটছিলাম।বাই দ্যা ওয়ে অতুল তোরা এভাবে ঝ গড়া করছিস কেনো?’

অতুল বির ক্তি মাখা কন্ঠে বললো,
‘আর বোলো না ভাইয়া গুঞ্জন খেজুরের রস খাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে।আমি বলছি এগুলো খাওয়া ঠিক নয়,কত পাখিরা মুখ দেয়।তবুও শুনছেই না।’

গুঞ্জন চোখ গরম করে তাকায় অতুলের দিকে।অতুল থেমে যায়।রুহিয়ার গুঞ্জনের কাছে গিয়ে বলে,
‘গুঞ্জন বোন মন খারাপ করে না।অতুল না ঠিক‌ই বলেছে তোমার খেজুরের রস খাওয়া ঠিক হবে না,আসলে অনেক সময় বাদু’ড় আর পাখিরা মুখ দেয় তো জী বা ণু থাকতে পারে‌।আর তাছাড়া তুমি তো আর একা ন‌ও তোমার মধ্যে একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে তোমার একটু সেইফ থাকতে হবে।তবে আমি তোমায় বলছি আমি করিম চাচাকে বলে রাখবো কাল তোমায় একদম ফ্রেশ রস এনে দেবে,তখন তুমি খেও।আজকে ছে ড়ে দাও বোন।’

রুহিয়ার কথায় গুঞ্জন শান্ত হয়।মুচকি হেসে বলে,
‘ঠিক আছে ভাবি।আমি বরং কালকেই খাবো।’

রুহিয়াও মুচকি হাসে।মিসেস সাবিনা খেতে ডাকেন সবাইকে।সবাই হাতমুখ ধুয়ে একসাথে সকালের নাস্তা সেরে নেয়।
_______________________________
কুয়াশায় আবৃত সন্ধ্যা।কালচে আঁধারের সাথে চারদিক কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে।রাত্রির অনিলে বেশ হিমেল ভাব।অন্তরীক্ষে থালার মতো গোলাকৃতির চাঁদ উঠেছে।কুয়াশার দরুণ চাঁদের উজ্জ্বলতা কম তবুও চারদিকে আলোর অভাব নেই।পূর্ণিমা রাতের মতোই ঝকঝকে চারদিক।হেঁসেল ঘরে তোড়জোড় চলছে পিঠা বানানোর।মিসেস সাবিনা ও তাসলিমা ইসলাম নতুন আটার পিঠা বানাচ্ছেন।চিত‌ই,ভাপা,দুধ-পুলি ও পাটিসাপটার মতো সুস্বাদু পিঠা বানানো হচ্ছে।রুহিয়াও হাত লাগিয়েছে উনাদের সঙ্গে।ঘরের ভেতর গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে সানফি,গুঞ্জন,অতুল ও অন্তিক।শফিকুল ইসলাম ও শামীম আহমেদ টুল নিয়ে হেঁসেলের সম্মুখে বসে রমণীদের পিঠা বানানো দেখছেন।তাসলিমা ইসলাম দু’টো চিত‌ই পিঠা বানালেন।মিসেস সাবিনা বানালেন দু’টো ভাপা পিঠা।তৎপর দু’টো প্লেটে দিয়ে রুহিয়াকে বললেন উনাদের দিতে।রুহিয়া প্লেট দিয়ে এলো উনাদের।আপন মনেই পিঠা খাচ্ছেন দু’জনে।তাসলিমা ইসলাম কিছুটা ঝাঁ ঝা লো স্বরে বললেন,
‘কি ব্যাপার শুধু খাচ্ছোই,বলছো না তো কেমন হয়েছে!’

শফিকুল ইসলাম মুখে আরেক কাম ড় পুড়ে বলেন,
‘হুম বেশ ভালো হয়েছে।’

রাগী দৃষ্টিতে শামীম আহমেদের দিকে তাকালেন মিসেস সাবিনা।রাগ রাগ কন্ঠে বললেন,
‘তোমাকে কি নতুন করে বলতে হবে?বলা যাচ্ছে না ঠিক আছে কি না সব!’

কিঞ্চিত ভীত হন শামীম আহমেদ।পর মুহূর্তেই স্তিমিত গলায় বলেন,
‘না না সব একদম ঠিক হয়েছে।খুব ভালো খেতে।’

উনাদের এহেন কান্ড দেখে মুচকি হাসে রুহিয়া।বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিনজনে পিঠা বানানো শেষ করে।সকলে পিঠা খেয়ে খুব প্রশংসা করে।মিসেস সাবিনা,তাসলিমা ইসলাম দু’জনেই ভীষণ খুশি।শীতের সন্ধ্যাটা এভাবেই আনন্দের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়।
___________________________________
রাত্রি সাড়ে দশটা।শীতকালে এই সময়টাই গ্রামে অনেক রাত।নিস্তব্ধ,নিঝুম চারদিক।গ্রামের প্রায় সকলেই বিভোর গভীর নিদ্রায়।শুধু ক্ষণে ক্ষণে দূর হতে ভেসে আসছে দু একটা কু কুর-শেয়া লের হাঁক।বাড়ির বাকি সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।অন্তিক আর সানফি দু’জনেই শুয়ে পড়েছে।সানফি ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু অন্তিক এখনো জাগ্রত।সে অপেক্ষা করছে রুহিয়ার জন্য।অথচ রুহিয়ার কোনো পাত্তাই নেই।সে যে সেই ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছে এখনো আসার নাম‌ই নেই।অন্তিক বির ক্ত হয়,শোয়া থেকে উঠে বসে।বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘নাহ আমাকেই গিয়ে দেখতে হবে।এই মেয়ে যে কি করে না!’

সন্তপর্ণে বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো অন্তিক।উঠানে দাঁড়িয়ে দূর অন্তরীক্ষের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রমণী।অন্তিক ধীর পায়ে এগিয়ে যায়।পেছন থেকে রুহিয়ার গায়ে শাল জড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘একা একা কি করছো সানশাইন?আর এই শীতে গায়ে কিছু দাও নি কেনো ঠান্ডা লেগে যাবে তো!’

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রুহিয়া।মৃদু স্বরে বললো,
‘একটা জিনিস ভাবছিলাম।’

চমকে অন্তিকের মুখ লাল হলো।পুলকিত হয়ে সে বললো,
‘আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই ভাবছো?’

‘তুমি কি ভাবছো সেটা তো আমি জানি না।কি ভাবছো তুমি হুম?’

ভ্রুযুগল দলা পাকিয়ে কথাখানা বলে রুহিয়া।প্রত্যুত্তরে অন্তিক দুষ্টু হেসে বলে,
‘আমি ভাবছিলাম সানফির জন্য খেলার সাথী আনার প্রসেসিং শুরু করবো।’

অন্তিকের এহেন লাগামহীন কথা শুনে নত মস্তক করে রুহিয়া।লজ্জায় গাল দুটোতে কিঞ্চিত লালচে আভা ফুটে উঠেছে।অন্তিক ঠোঁট কাম ড়ে হাসে।রুহিয়া ঝামটা মে রে বলে,
‘খালি তোমার বা’জে কথা।অতুল আর গুঞ্জনের বেবি আসছে তো।সানফি খেলার সাথী পেয়ে যাবে।আমি আর এসব নিয়ে ভাবছি না,সানফি একাই থাক।’

অন্তিক এগিয়ে যায়।রুহিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মিহি গলায় বলে,
‘আচ্ছা ম্যাডাম ঠিক আছে।তা আপনি কি ভাবছিলেন সেটা বলুন তো।’

‘আমি ভাবছিলাম আমাদের সম্পর্কটার কথা।অনেকটা ব্যাকরণের মতো তাই না!ব্যাকরণ বিষয়টা কিন্তু বেশ জটিল মাথায় একদম ঢুকতেই চায় না ঠিক তেমনি আমাদের সম্পর্কের সমীকরণটাও জটিল ছিলো।অনেক চেষ্টার পর নিয়ম শিখলে যেমন ব্যাকরণ আয়ত্তে আনা যায় ঠিক তেমন‌ই বহু প্রতিকূলতার পর আমরা আবার এক হয়েছি।এইজন্যই আমি ভাবছি আমাদের সম্পর্কটাকে কিন্তু ভালোবাসার ব্যাকরণ বলা যায়।’

মৃদু স্বরে কথাগুলো বললো রুহিয়া।অন্তিক রুহিয়ার বাহুতে হাত রেখে নিজের দিকে তাকে ঘুরিয়ে নিলো।অপলক তাকালো রুহিয়া অন্তিকের চোখের দিকে।শীতল চাহনি পুরুষটির চোখে।রমণী চেয়ে থাকতে পারে না মুখ নামিয়ে নেয়।অন্তিক মৃদু হাসে,দু’হাতে স্পর্শ করে রুহিয়ার চিবুক।শীতল হাতের ছোঁয়ায় কম্পিত হয় রুহিয়ার সর্বাঙ্গ।অন্তিক ওষ্ঠাধর ছোঁয়ায় রমণীর উভয় গালদেশে।পরক্ষণে গভীর ভাবে চুম্বন এঁকে দেয় রুহিয়ার ললাটে।রুহিয়ার চোখের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে অন্তিক মিহি গলায় বলে,
‘ভালোবাসায় আমি ব্যাকরণ বুঝি না
মানি না কোনো নিয়ম
শুধু সহজ-সাবলীল ভাষায় বলতে চাই
আমি ভালোবাসি তোমায়!’

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
(সমাপ্ত)