ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-১১+১২

0
949

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১১

বিকেলে আমি নদীর কাছে শুধু একবার বলেছিলাম আমাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাও।ব্যস এই শুনেই সে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।অনেকদিন যাবতই তার মন কোথাও ঘুরতে যেতে চাইছিলো বলে।কিন্তু প্রাইভেট আর পড়ার চাপে ইচ্ছা সত্ত্বেও তা পারেনি।আজকে আমার এ প্রস্তাব তার মনটাকে একদম উস্কে দিলো।আগামীকাল সে ঘুরতেই যাবে এই মনস্থির করে সে বসলো।কিন্তু কোথায় ঘুরতে নিয়ে যাবে আমাকে?কিছুক্ষণ এ নিয়ে ভাবাভাবির পরও নদী ঠিক বুঝতে পারলো না কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়।অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিলো এ বিষয়ে বড় মামা আর ছোট মামার সাথে কথা বলবে।

সন্ধ্যার নাস্তার পরে বড় মামা ও মামি এবং ছোট মামা ও মামি একসাথে টিভি দেখতে বসে।প্রথমেই চারজন গভীর মনযোগে খবর দেখেন।এরপর বাংলায় অনুবাদ করা তুর্কিস ড্রামা দেখেন।
নদী আমাকে সাথে করে ড্রইংরুমে আসলো।আমার সাথে কোথায় ঘুরতে যাবে সে উদ্দেশ্যে কথা বলবে মামা মামিদের সাথে।
টিভিতে সন্ধ্যার খবর চলছিলো।আমাদের দুজনের উপস্থিতি টের পেয়েই চার জোড়া প্রশ্নবিদ্ধ চোখ স্থির হলো আমাদের উপর।এতে সামান্য ভড়কে গেলাম আমি।তবে অতি দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলাম।
বড় মামা আমাদের দেখে নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা উপরে তুলে বললেন,
“কিছু বলবে মা?”

আমি ঠিক কি বলবো বুঝতে না পেরে নদীর দিকে তাকালাম।সাথে সাথে নদী মুখস্থবিদ্যার মত বলে দিলো,
“আমি আর মিম আপু কোথাও ঘুরতে যেতে চাই।কিন্তু জায়গাটা ঠিক করতে পারছি না।অনেজ চিন্তাভাবনা করেও পেলাম না।অবশেষে তোমাদের শরণাপন্ন হলাম।এবার তোমরাই আইডিয়া দাও।”
নদীর কথার ভাবে আমি মুখ টিপে হেসে দিলাম।বাকি সবাই একটু শব্দ করেই হেসে দিলো।
ছোট মামা আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?সোফায় এসে বস।”

ছোট মামার আদেশ শুনে দুজনে বাধ্য মেয়ের মত সোফায় বসে পরলাম।সাথে সাথে বড় মামা আমাদের দিকে চোখমুখ কুঁচকে চিন্তিত মুখে তাকালেন।কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকেই চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে বললেন,
“তাহলে আমার মেয়ে দুটো ঘুরার জায়গা পাচ্ছে না।কোথায় এদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া যায় বলতো ইলিয়াস।”
ছোট মামার উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বড় মামা।তিনি সাথে সাথে উত্তর দিলেন না।কিছুক্ষণ এ নিয়ে ভাববার পর চট করে বলে দিলেন,
“আরে,বাড়ির কাছের বিলে ঘুরতে গেলেই তো হয়।”

ছোট মামার কথায় বড় মামা সায় দিলেন।চেহারা বেশ হাস্যজ্বল এখন।ছোট মামি কাঁথা সেলাই করতে করতে বললো,
“এটাই ভালো হবে।বাড়ির কাছ থেকেই ঘুরাঘুরি শুরু করা উচিত।আর ঐ বিলটা দেখতে অনেক সুন্দর।একবার গেলে মনে হবে বারবার যাই।”

বড় মামি যোগ করলেন,
“আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।কাল যদি আল্লাহর রহমতে বৃষ্টি হয় তাহলে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার মজাটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।”

সবার কথা শুনে মনে হলো আগামীকাল বিলে ঘুরতে যাওয়াই ভালো হবে।সবার কথা শুনে লোভ লেগে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই সেখানে গিয়ে বসে থাকি।
কিন্তু এ খুশির মাঝে হঠাৎ মনে পরলো,নদী তো সেই বিলে গিয়েছে নিশ্চয়।তাহলে আবারো সে যেতে চাইবে?এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাস করা উচিত।নদী যেতে না চাইলে আমিও যাবো না।
আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞাস করলাম,
“নদী?তুমি মনে হয় বিলে আগে ঘুরতে গিয়েছো।আবারো কি যাবে?”

নদী মুখে সৌজন্যমূলক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“একবার গেলে কি দ্বিতীয়বার যাওয়া যায় না?বরং ঐ সুন্দর মনোরম পরিবেশে আরেকবার যেতে পারলে আরো খুশি হবো।”
কিছুক্ষণ থেমে সে আবারো বলল,
“আমার না বিলের কথা মনেই ছিলো না।বাড়ির পাশের সৌন্দর্য রেখে আমি দূরদূরান্তে ঘুরার সব জায়গা মনে মনে খুঁজেছি। বোকার মত কাজ করা যাকে বলে।”

নদীর কথায় আমি নিঃশব্দে হেসে উঠলাম।বড় মামা এবার আমাদের উদ্দেশ্যে বলল,
“ঘুরতে যাবে ভালো কথা।কিন্তু ওদের দায়িত্ব নিয়ে ঘুরতে নিয়ে যাবে কে?আমি আর ইলিয়াস তো আগামীকাল নতুন বিল্ডিং এর কাজের তদারকি করবো একটু।অনেকদিন ওদিকটায় যাওয়া হয়না।তাহলে পলাশ অথবা আদ্রিশ এর দায়িত্বে যাক ওরা।”

বড় মামি কিছুক্ষণ ভাববার পরে বললেন,
“পলাশের যাওয়ার দরকার নেই।সপ্তাহে একদিনই তো ও রাইসার সাথে সবসময় থাকে।আর এখন রাইসার অবস্থা খুব একটা ভালোও না।পলাশের সাথে সময় কাটানো জরুরি ওর জন্য।তার চেয়ে ভালো হবে আদ্রিশের দায়িত্বে ওদের পাঠানো হোক।”

বড় মামির কথা শেষ হওয়া মাত্রই বড় মামা উঁচু গলায় আদ্রিশ ভাইয়াকে ডাকলেন।একবার,দুবার,তিনবার,চারবারের বার উনার রুম থেকে আওয়াজ এলো,’আসছি আব্বু।’এই বলারও প্রায় মিনিট দুয়েক পর আদ্রিশ ভাইয়া ড্রইংরুমে এসে উপস্থিত হলেন।
উনাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।চেহারার ধরন যেন রাতারাতি পাল্টে গিয়েছে।মাথার অগোছালো চুল, ঘুমুঘুমু চোখজোড়া যা কষ্টেসৃষ্টে মেলে রাখা হয়েছে,গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। সব মিলিয়ে উনাকে সদ্য যৌবনে পা রাখা এক যুবকের ন্যায় দেখাচ্ছে।নাহ,যুবক বললে একটু বেশি হয়ে যাবে।উনাকে দেখাচ্ছে একজন কিশোরের ন্যায়।নাহ,এটা আবার কম হয়ে যাচ্ছে। ধ্যাত,উনাকে কোনো কাতারেই ফেলা যাচ্ছে না।তবে ঘুমুঘুমু চেহারা দেখে মনে হচ্ছে উনার বয়স বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে।পরনের কালো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর কালো টিশার্ট বয়সটা কমাতে বেশ সাহায্য করেছে। আচ্ছা? উনি কি বয়স কমানো ওষুধ খাচ্ছেন? নাকি এর পিছনে অন্য রহস্য আছে?অদ্ভুত!

আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখে বড় মামি হেসে বললেন,
“আদ্রিশ?তুই এই সময়ে ঘুমিয়েছিলি!”

আদ্রিশ ভাইয়া দরজার কাছ থেকে বড় বড় পা ফেলে এসে বড় মামার পাশে সোফার উপর বসলেন।যেটা একদম আমার সামনে।
সবার সামনে লম্বা একটা হাই তুলে তিনি বললেন,
“হুম।পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরেছিলাম।”
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে চোখেমুখে চরম বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে তুলে বললেন,
“তোমরা জানো,এভাবে কেউ আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললে খুব রাগ হয়।আর আব্বু সেই ডেকেই যাচ্ছিলো।থামবারই নাম নেই।আমার কাঁচা ঘুমটাকে ভাঙিয়ে দিলো সে।”এই বলে বড় মামার দিকে চোখমুখ কুঁচকে তাকালেন উনি।সাথে সাথে বড় মামা উনার মাথায় গাট্টা মেরে বললেন,
“ব্যাটা,এখন কি ঘুমানোর সময়?ঘড়ি দেখে সময়মত ঘুমালে কেউ এভাবে জাগিয়ে দিতো না।”

আদ্রিশ ভাইয়া আরেক দফা হাই ছেড়ে বললেন,
“আচ্ছা কিসের জন্য ডেকেছিলে তা বলো।”

“কালকে তো শুক্রবার।তুই নদী আর মিমকে নিয়ে ঐ বিলটায় ঘুরতে যাবি।”

আদ্রিশ ভাইয়া কণ্ঠে সামান্য বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন,
“এই বলার জন্য ডেকেছিলে আমাকে!”

বড় মামা একদম স্বাভাবিক সুরে বললেন,
“হুম।কেনো অন্যকিছু আশা করেছিলি?”

আদ্রিশ ভাইয়া সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার আর নদীর দিকে একটু রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“আচ্ছা নিয়ে যাব ওদের।কালকে সকালের নাস্তার পর বের হবো।”
এই বলে উনি চলে গেলেন।উনি যে আমাদের দুজনের উপর যে রেগে আছেন তা বেশ ভালোমতোই বুঝলাম।রেগে যাওয়ার কারনটাও স্পষ্ট,উনার অসময়ের ঘুম অসময়ে ঘুমিয়ে দিয়েছি বলে।যাই হোক,এ নিয়ে আর মাথা ঘামানোর কিছু নেই।কাল তো বেড়াতে যাচ্ছি সেটাই যথেষ্ট।

.

“এই নদী উঠ জলদি জলদি।দেখতো দুপুর বারোটা বেজে গিয়েছে।বিলে ঘুরতে যাবি না?আমার সময় নেই তো।জলদি ওঠ।এত ঘুমাস কেনো?”
ঘুমের মাঝে এক পুরুষালি কণ্ঠ কানে ভেসে আসতেই আমার ঘুমটা একেবারে ভেঙে গেলো।কিন্তু ঘুমুঘুমু ভাবটা ধরে রাখার জন্য চোখ মেলে তাকালাম না।
ওদিকে পুরুষালি সে কণ্ঠটা আবারো কানে ভেসে আসলো।তবে এবার জোরেশোরে কানে বাজতে লাগলো এবং সেই পুরুষালি কণ্ঠে প্রকাশ পেলো অতিদ্রুততা।
“নদী…তোদের আজকে তাহলে বিলে যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে গেলো!!আল্লাহ!!১২ টা বেজে গেছে।নদী উঠ জলদি।”

আমি দ্রুত চোখ মেলে হুড়োহুড়ি করে উঠে বসলাম।পাশে তাকিয়ে দেখি নদীও বসে আছে।উদভ্রান্তের মত। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হুট করে ঘুম ভেঙে গেলে যা হয় আরকি।আমার অবস্থাও নদীর মত।
চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সজাগ হতে কিছু সময় নিলো আমার মস্তিষ্ক। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে দেখলাম আদ্রিশ ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।সচারচর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।এক হাত প্যান্টের পকেটে অপর হাত ফোনে।
আমাদের উপর থেকে চোখ সরিয়ে আদ্রিশ ভাইয়া নদীকে তাড়া দিলেন,
“যা,তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে।এক্ষুনি বের হবো।ঘড়ির দিকে একবার চেয়ে দেখ।সাড়ে বারোটা বাজতে চললো।”
এই বলে আদ্রিশ ভাইয়া ফোন চালানোয় ব্যস্ত হয়ে পরলেন।
আমি বালিশের কাছ থেকে চশমাটা নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বারোটা পনেরো বাজে।এতক্ষণ আদ্রিশ ভাইয়ার মুখে সময়ের কথা শুনলেও ঘড়ি দেখার পর তা বিশ্বাস হতে চাইলো না।বারোটা বাজলো কি করে!ফজরের নামাজ পরে কিছুক্ষণের জন্যই তো ঘুমিয়েছিলাম মাত্র।তাতেই এত সময় পার হয়ে গিয়েছে!মনে হচ্ছে মাত্রই তো ঘুমিয়েছি।চোখে এখনও ঘুম লেগে আছে।আজ সবার কি হয়েছে কে জানে।নদীও উঠেনি।আমিও উঠেনি।আবার মামিরাও ডাকতে এলো না!আজিব ব্যাপারস্যাপার!

নদী কয়েক সেকেন্ড আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।আমি মাথায় ঠিকঠাক মত ওড়না দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম।আর আদ্রিশ ভাইয়া ফোন হাতে গিয়ে বসলো নদীর পড়ার চেয়ারে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চার্জার থেকে ফোনটা নিলাম।ফেসবুকে একটু ঢুকবো বলে ফোনটা অন করতেই মাথায় একটা বাজ পরলো যেন।ছয়টা নয় বাজে। মানে কি!আদ্রিশ ভাইয়া তো বললো বারোটা বাজে।আবার ঘড়িতেও দেখলাম একই সময়।কিন্তু ফোনে আলাদা সময় কেনো?যতদূর মনে পরে আমার ফোনের সময় একদম ঠিকঠাক।আর সময় স্লো হলেও ছয় ঘন্টা স্লো হয় নাকি!মাথায় কিছুই ঢুকছে না।চোখ দুটো আঙ্গুল দিয়ে একটু কচলে নিয়ে আবারো সময় দেখলাম। একদম ঠিকঠাক।আচ্ছা?জানালা খুলে একবার বাইরের পরিবেশ দেখবো কি?হুম তাই দেখা উচিত।

আমি ফোনটা বিছানায় রেখে দ্রুত দক্ষিনের জানালাটা খুলে দিলাম।জানালা খুলেই মাথায় আরেকদফা বাজ পরলো।চারপাশে এখনো আবছা অন্ধকার।সূ্র্য উঠতে শুরু করেছে মাত্র।তাহলে কি আদ্রিশ ভাইয়া মিথ্যা বললো!
আমি চট করে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকাই।সাথে সাথে আদ্রিশ ভাইয়া ফোনের দিকে চেয়েই বলে উঠলেন,
“যা যা দেখছো আশেপাশে তার সবটাই ঠিক দেখছো। তোমার ফোনের সময়ও ঠিক আছে।মাত্র ছয়টা দশ বাজে।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথাবার্তা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।এতবড় মিথ্যা কথা বললেন কেনো উনি!শুধুশুধু এত সকালে উঠানোর মানেটা কি!
সকালের ঠান্ডা ঠান্ডা মস্তিষ্ক রাগে গরম হয়ে এলো।আমি তেড়ে গিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বললাম,
“এসব মিথ্যা কথা বলার মানে কি!আমাদের দুজনকে শুধুশুধু মিথ্যা বলে জাগিয়ে তুললেন কেনো?তাও আবার এত সকালে!”

আদ্রিশ ভাইয়া ফোন থেকে মাথা তুলে বাঁকা হেসে বললেন,
“তোমরা দুজন যা করেছো তাই ফেরত দিলাম।”

“মানে?আমরা দুজন কি করলাম?”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।চোখেমুখে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব তুলে বললেন,
“গতকাল আমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়েছিলে মনে আছে?”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।গতকালের জন্য আজ আমাদের ঘুম নষ্ট করলেন!
আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই নদী ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো।তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে সব জেনে গিয়েছে।সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ছোট ভাইয়া আবারো!এর আগেও দুদিন এমনটা করেছিলে। আজ আবারও!গতকাল তো আমি ঘুম ভাঙায়নি। চাচু ভাঙিয়েছে।তাহলে আজ আমাদের ঘুম নষ্ট করলে কেনো?”

আদ্রিশ ভাইয়া ফোন পকেটে ঢুকিয়ে আমাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“তোদের দুজনের জন্যই তো আমার কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। তোদের বিলে যাওয়ার প্ল্যানিং না থাকলে আমি আরামসে ঘুমাতাম। তো দোষ তোদেরই।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি কি রিয়েকশন দিবো তা বুঝতে পারলাম না।নদীকে কিছু বলতে যাব তার আগেই আদ্রিশ ভাইয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ইটস কলড রিভেঞ্জ।
নদী?তোর রুমের ঘড়ির সময়টা ঠিক করে নিস।আর বিকেলে রেডি থাকিস।খাওয়াদাওয়া করেই বের হবো।”
এই বলে তিনি আর দেরি না করে রুমের বাইরে চলে গেলেন।
আমি হতবাক দৃষ্টিতে নদীর দিকে চেয়ে রইলাম।নদী আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ছোট ভাইয়া এমনই।ওর কোনো ক্ষতি হলে সেটা সুদেআসলে বুঝে নিবে।এমন রিভেঞ্জ সে কতবার নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।সবচেয়ে বেশি নিয়েছে এই ঘুম ভাঙানো নিয়ে।এর আগেও দুইবার আমার ঘুম এভাবে মিথ্যা বলে ভাঙিয়েছে। আজও তাই হলো।আমি শুধু সময়মত বুঝতে পারিনি ভাইয়ার চাল তাই এমনটা হলো।”

কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না আমি।এমনটা কেউ করে!কতবড় বেয়াদব, ফাজিল, বজ্জাত লোক!আজকে আমার উপর রিভেঞ্জ নিলো,এরপরে আমিও রিভেঞ্জ নিবো।শুধু সময় আর সুযোগের অপেক্ষা।
মনে মনে একদম পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে লম্বা এক শ্বাস ফেললাম।

®সারা মেহেক

#চলবে

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১২

দুপুরের খাবারের পর আমি আর নদী রেডি হয়ে নিলাম।আদ্রিশ ভাইয়া গিয়েছেন অটো ঠিক করতে।অটো ঠিক হয়ে গেলেই তিনি নদীর ফোনে কল করে আমাদের বেড়িয়ে আসতে বলবেন।
আদ্রিশ ভাইয়ার উপর সকালের রাগটা একদম কমে গিয়েছে।তবে উনার কাজকর্ম সব মনে রেখেছি।তখন আদ্রিশ ভাইয়া চলে যেতেই আমি আর নদী আবারো শুয়ে পরেছিলাম।টানা আড়াই ঘন্টার ঘুম সম্পন্ন করে তারপর উঠি।

নদীর ফোনে আদ্রিশ ভাইয়া কল করে বললেন আমাদের বেড়িয়ে আসতে।উনার আদেশমত আমরা দুজন বেড়িয়ে পরলাম।কর্দমাক্ত উঠোনে পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই দেখি আদ্রিশ ভাইয়া অটোর পাশে তার সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন।জানিনা কেনো,যতবারই আদ্রিশ ভাইয়াকে এ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি ততবারই ভালো লাগে।এ ভঙ্গিতে উনাকে স্বাভাবিক এর চেয়ে একটু বেশিই সুদর্শন দেখা যায়।এটা কি শুধু আমার চোখে নাকি কে জানে।

আমি আর নদী অটোতে উঠে বসতেই আদ্রিশ ভাইয়াও অটোতে বসে পরলেন।তিনি বসলেন ড্রাইভারের পাশের সিটে।আমরা বসে পরতেই অটো ছেড়ে দেয়।
অটো চলছে আপন গতিতে।কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া দ্বিতীয়দফার বৃষ্টিপাত পরিবেশকে আরো শীতল এবং স্নিগ্ধ করে তুলেছে।চারপাশে বয়ে চলছে ঠান্ডা হাওয়া।অটো চলার কারনে সে হাওয়া স্বাভাবিক এর চেয়ে একটু বেশি গতিতে চোখেমুখে বারি খাচ্ছে। এতে অবশ্য ভালোই লাগছে আমার।অন্তত ভ্যাঁপসা গরমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে।
গ্রামের পাকা রাস্তার দু ধার ধরে রয়েছে হরেক রকমের গাছ।কিছুকিছু গাছ ছোট।আবার কিছুকিছু গাছ বড়।আছে কয়েকটা বটগাছও।বৃষ্টির ছোঁয়ায় এসব গাছের প্রতিটা পত্র পল্লব তাদের চিরচেনা সবুজ রঙ ফিরে পেয়েছে।নিজস্ব রঙ ফিরে পেয়ে হয়তো তারা একটু বেশিই খুশি।এজন্যই তো হাওয়ার তালে নেচে বেড়াচ্ছে তারা।তাদের এ নৃত্যের ধ্বনি কানে খুব সুমধুর ঠেকছে।চোখ বন্ধ করে হাওয়ার সাথে ভেসে আসা এ ধ্বনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করলে এক অকল্পনীয় অনুভূতি অনুভব হবে।

গাছের এ নৃত্যের তালে কিছুক্ষণ পর যোগ দিলো রাস্তার পাশের জমিতে বেড়ে উঠা ধান গাছগুলো।শীতল সে হাওয়ায় ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।এর ফলে সে শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মত।আমি চোখ বন্ধ করেই সেসব শুনছি।
কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম পানির কলকল ধ্বনি।নিশ্চয় পাশে পুকুর আছে।এই ভেবেই চোখ খুলে ডান দিকে তাকালাম আমি।সত্যিই এপাশে পুকুর রয়েছে।বেশ বড়সড় একটা পুকুর।বহমান সেই শীতল হাওয়া পুকুরের পানিতে উৎপন্ন করছে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ।এ ঢেউয়ের তালে নিজেদের ভাসিয়ে নিয়ে দূরে সরে দিচ্ছে কচুরিপানাগুলো।এদের ঢেউয়ের তালে দুলতে দেখে হঠাৎ মনে হলো,ইশ,আমিও যদি এত হালকা হতাম!এদের মত এ ঠান্ডা পানিতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারতাম,ভাসিয়ে রাখতে পারতাম।আহা, কি আনন্দ!!
চলমান অটোতে বসে বসে কয়েক সেকেন্ড পুকুরের সে সৌন্দর্য উপভোগ করলাম আমি।গ্রামীণ পরিবেশের এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একের পর এক স্নিগ্ধকর রূপ দেখিয়ে চলছে আমাকে।কখনো দূরের সেই ধানক্ষেত, কখনো ছোটবড় পুকুর,কখনোবা দূরে অবস্থিত ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়েঘর,কখনো দূরের আকাশে পাখির উড়ে বেড়ানো।সবই এক মায়াজালে ডুবিয়ে দিচ্ছে যেন।

প্রায় দশ মিনিট পর বিলের কাছে এসে অটো থামলো।আমরা তিনজন একে একে নেমে পরলাম।আদ্রিশ ভাইয়া অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নদীর পাশে এসে দাঁড়ালেন।
বিলের ধারে প্রচুর হাওয়া বইছে। পরনের বোরকা, হিজাব ঠিক করে রাখা দায় হয়ে পরেছে।আমি অটো থেকে নেমেই বোরকা ঠিক রাখার কসরত করতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ বিলের ধারে দাঁড়িয়ে রইলাম তিনজন।আদ্রিশ ভাইয়া আর নদী কি করছে জানি না।তবে এখানে দাঁড়িয়ে বিলের এ পরিবেশের যতটুকু সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় তার সবটুকুই আমি করছি।
নাম না জানা এ বিলে বয়ে চলছে ছোটখাটো কিছু নৌকা।যার দুধারে দুজন বসা।হালকা ধূসর কালো মেঘে ছেয়ে থাকা আকাশের প্রতিবিম্ব পরছে বিলের পরিষ্কার পানিতে।অন্ততপক্ষে আমার কাছে বিলের পানি যথেষ্ট পরিষ্কার মনে হচ্ছে। দূর আকাশে দেখা যাচ্ছে শেষ বিকেলের সূর্যের আলোকছটা। যদিও সূর্যের বেশিরভাগ অংশ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে।তবে বেড়িয়ে আসতে কতক্ষণ। বেড়িয়ে আসার পর নিশ্চয়ই তার সোনালী রঙে রাঙিয়ে তুলবে চারপাশ।নিশ্চয়ই সে সোনালী রঙে আমাকে মাখিয়ে স্বর্ণালী করে দিবে সূর্যিমামা।

“এখানে দাঁড়িয়ে থেকেই সময় কাটানো হবে নাকি নৌকায় চড়ে বিলটা একটু ঘুরে দেখাও হবে?”

আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠস্বর কানে আসতেই আমি স্বর্গীয় সে সৌন্দর্য অনুভব করা থেকে বেড়িয়ে এলাম।
নদী উৎফুল্ল কণ্ঠে আদ্রিশ ভাইয়াকে বললো,
“অবশ্যই ছোট ভাইয়া।নৌকায় না চড়লে এখানে আসার সৌন্দর্যটাই মিস হয়ে যাবে।”

নদীর কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন,
“আচ্ছা, তোরা এখানে দাঁড়া।আমি ঐ মাঝির সাথে কথা বলে আসি।”

“আচ্ছা, ভাইয়া যাও।”

আদ্রিশ ভাইয়া আমাকে ডিঙিয়ে চলে গেলেন সেখানকার স্থানীয় এক মাঝির সাথে কথা বলতে।উনি চলে যেতেই নদী আগের মতই বলল,
” চাচি একদম ঠিক বলেছিলো আপু,তাইনা?”

নদীর কথা বুঝতে না পেরে বললাম,
“কোন কথা?”

“এই যে বৃষ্টি হলে বিলের সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়।”

“হুম।একদম ঠিক বলেছে বড় মামি।আমি তো বিলের এ সৌন্দর্য দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না।মন বলছে এখানেই একটা ঘর বানিয়ে থেকে যাই।”

আমার কথায় নদী শব্দ করে হেসে উঠে বললো,
“আমি না কখনো এ সময়ে বিলে ঘুরতে আসিনি।মানে বৃষ্টির পরবর্তী সময়ে।আজও যদি না আসতাম তাহলে কত সৌন্দর্যই না মিস হয়ে যেত।”

নদীর কথায় প্রতিউত্তরে আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আদ্রিশ ভাইয়া এদিকে চলে এলেন।নদীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“চল,নৌকা ঠিক হয়ে গিয়েছে।”এই বলে উনি ঐদিকে আবারো হাঁটা ধরলেন।

আদ্রিশ ভাইয়ার আদেশে আমরা দুজন উনার পিছুপিছু হেঁটে গেলাম।নৌকার কাছে আসতেই দেখলাম এক নৌকা সম্পূর্ণ খালি। আর অপর নৌকায় বারো তেরো বছরের একটা ছেলে বসা।আদ্রিশ ভাইয়া নদীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“তুই ঐ পিচ্চির নৌকায় গিয়ে বয়।”

নদী বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আমি মানে!মিম আপু কোথায় বসবে?”

আদ্রিশ ভাইয়া স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলেন,
“কেনো?আমরা সাথে বসবে।”

এবার আমার বিস্ময়াভিভূত হওয়ার পালা এলো।আমি আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে বসবো?কোন দুঃখে?

নদী এবার বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
“আমরা দুজন যে প্ল্যান করে এসেছি একসাথে ঘুরেবেড়াবো।সেটার কি হবে?”

আদ্রিশ ভাইয়া নদীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করলেন,
“তুমি কি সাঁতার পারো?”

আমি মাথা নামিয়ে মিনমিনে সুরে বললাম,
“না পারিনা।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার নদীকে বললেন,
“দেখ,ও সাঁতার পারে না।তাহলে তোর সাথে এক নৌকায় ওকে পাঠাই কি করে?”

নদীর সহজ স্বীকারোক্তি,
“আমি তো পারি।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার একটু বিরক্ত হলেন।নদীর মাথায় গাট্টা মেরে বললেন,
“তোর মাথার তার আসলেই ঢিলা।ও ডুবে গেলে তুই ওকে বাঁচাতে পারবি?নিজে এক বাচ্চা আর সে কি না আরেক বাচ্চাকে বাঁচাবে?জীবনেও পারবি না।”

উফ,আবার সেই ‘বাচ্চা’! মন চাইছে আদ্রিশ ভাইয়ার মাথা ফাটাই।নিজেকে বোধদয় বুড়ো ভাবে। এজন্যই তো উনার কাছে সবাই বাচ্চা।

নদী এবার মাথা নিচু করে গলা নামিয়ে বলল,
“পারবো তো ছোটভাইয়া। ”

নদীর কথায় আদ্রিশ ভাইয়া এবার চরম বিরক্ত হলেন।কণ্ঠে যথাসম্ভব বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
“নৌকা চালাতে পারিস?বৈঠা ধরতে পারিস?”

নদী আর কোনো জবাব দিতে পারলো না।মাথা তুলে না বোধক মাথা নাড়ালো।
আদ্রিশ ভাইয়া তা দেখে হয়তো খুব খুশি হলেন।নদীকে আঙ্গুল দিয়ে ঐ পিচ্চিটার নৌকায় যেতে বললেন।নদী ভাইয়ের কথায় বাধ্য মেয়ের মত সেই নৌকার অপর ধারে গিয়ে বসলো।মেয়েটার যে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে তা তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম।তবে আমি যে খুশি হয়েছি তা না।উল্টা প্যারা লাগছে সব।এখন আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে পুরো সময় এ বিল ঘুরে দেখবো!শান্তিতে যে কোনো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবো না তা জানা আছে।

নদী নৌকায় চড়ে বসতেই আদ্রিশ ভাইয়া অপর ছোট নৌকায় গিয়ে দাঁড়ালেন।অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনার পিছুপিছু আমিও চললাম।আদ্রিশ ভাইয়া নৌকার এ ধারে বসে আছেন।আমি নৌকার এ ধারে স্বাভাবিকভাবে উঠতে চাইলাম।কিন্তু বোরকার জন্য পারলাম না।শেষমেশ বোরকা একটু উঁচু করে ধরে সামনে পা রাখলাম।তৎক্ষনাৎ আদ্রিশ ভাইয়া নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন।ঘটনার আকস্মিকতায় এ হাত বাড়ানোর কারনটা বুঝতে কিছু সময় লাগলো।ততক্ষণে আদ্রিশ ভাইয়া চোখ দিয়ে ইশারা করে আমাকে নিজের হাতে হাত রাখতে বললেন।আবারো অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনার হাতে হাত রেখে নৌকায় চড়ে বসলাম।
ওদিকে নদী যে নৌকায় বসেছে সে নৌকা চলতে আরম্ভ করেছে।আমাদের নৌকাও চলতে আরম্ভ করলো।

মেরুন কালারের শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরহিত যুবকের হাতে বৈঠা দেখে একটু হাসি পেলো বটে।তবে কোনো এক কারনে ভালোও লাগলো।জেল দিয়ে সেট করা চুল,হাতে লেদারের ঘড়ি আর পরনের কাপড়চোপড় এর কারনে আদ্রিশ ভাইয়াকে ডিজিটাল মাঝি দেখাচ্ছে।বাহ ডিজিটাল মাঝি!নিজেই হেসে উঠলাম এ নামকরণে।

“কি হলো?হাসছো কেনো?”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি একটু চমকে উঠলাম।আমি যে হেসে উঠেছি উনি জানলো কি করে?আমার তো মুখ বাঁধা তাহলে?
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“আপনি বুঝলেন কি করে?”

আদ্রিশ ভাইয়া মুচকি হেসে পাশ ফিরে বললেন,
“না বুঝার কি হলো?”

“আমি তো….”
আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন,
“এখানে নিকাব খুলতে পারো।আশেপাশে তেমন কেউ নেই।”

আমি আশেপাশে এক নজর বুললাম।আসলেই কেউ নেই।নিকাব খুলাই সমীচীন হবে।চারপাশে বয়ে চলা এ শীতল হাওয়া একটু চোখেমুখে না মাখলে প্রাকৃতিক এ পরিবেশে ঘুরতে আসাটাই বৃথা।
আমি আস্তে করে নিকাব খুলে নিজের হাতে আঁটসাঁট করে রাখলাম। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে বিলের সকল সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে পুরে নিতে উদ্যত হলাম।

“বললে না? কি কারনে হাসছিলে?”

আদ্রিশ ভাইয়ার প্রশ্ন শুনে আমি উনার দিকে তাকালাম।ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম উনার চোখেমুখে এক অদ্ভুত আনন্দ খেলা করছে।যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু একটা পেয়ে বসেছেন। কিন্তু কি সেটা?আচ্ছা,আমার কি যায়আসে, কি সেটা।জেনে লাভ নেই।বরং আদ্রিশ ভাইয়ার উপর কোনোরকমের রাগ ক্ষোভ না দেখিয়ে সময়টাকে উপভোগ করা উচিত।উনার উপর এ রাগ,মুড দেখিয়ে কিছুই হবে না।বরং এখানকার সৌন্দর্যটাই মিস করে যাব।

আমি একটু স্বাভাবিক হয়ে বললাম,
“আমি তখন হাসছিলাম আপনাকে দেখে।”

আদ্রিশ ভাইয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“কেনো?আমাকে কি জোকার মনে হচ্ছে? ”

আমি একটু শব্দ করে হেসে দিলাম।বললাম,
“আপনাকে ডিজিটাল মাঝি মনে হচ্ছে। ”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার আমার চেয়েও শব্দ করে হেসে দিলেন।উনার এ হাসির শব্দ চারপাশের খালিখালি পরিবেশের কারনে কেমন যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কানে ভেসে আসলো।
“এমনটা মনে হওয়ার কারন?”

“আপনার ড্রেসআপ।”

এরপর আদ্রিশ ভাইয়া আর কিছু বললেন না।খানিক বাদে বললেন,
“তো ম্যাডাম?এই ডিজিটাল মাঝির নৌকায় উঠে আপনার অনুভূতিটা কেমন হচ্ছে? ”

আমি মুচকি হেসে উত্তর দিলাম,
“জ্বি অনেক ভালো লাগছে।”

আদ্রিশ ভাইয়া হাসিমুখে বললেন,
“আপনি কি আবারো এই ডিজিটাল মাঝির ভাড়া করা নৌকায় উঠতে রাজি হবেন?”

আদ্রিশ ভাইয়ার প্রশ্ন শুনে আমি থমকে গেলাম।প্রশ্নটা কানে শুনতে যতটা স্বাভাবিক মনে হলো হৃদয় দিয়ে শুনতে ঠিক ততোটাই অস্বাভাবিক মনে হলো।এ প্রশ্নের জবাব আমি কি দিবো?জবাব দেওয়ার মত কি প্রশ্ন এটা?নাহ,জবাব দেওয়ার মত নয়।তার চেয়ে বরং চুপ থাকাটাই শ্রেয়।

আদ্রিশ ভাইয়ার প্রশ্নের জবাব দিলাম না।আশেপাশে তাকিয়ে বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম।এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম,নদী যে নৌকায় চড়েছে তা আমাদের নৌকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে।কিন্তু একই সাথে নৌকা চলা শুরু করলো তো।তাহলে কি আদ্রিশ ভাইয়া ধীরে নৌকা চালাচ্ছেন? হয়ত।কারন উনি তো আর এতে অভ্যস্ত নয়।নাহ,অনেক হয়েছে এসব দুনিয়াবি বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি। এসব না করে আমি এখন স্বর্গীয় কিছু সৌন্দর্য উপভোগ করবো।
কিছুক্ষণ চোখজোড়া বন্ধ করে লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিয়ে চোখজোড়া খুললাম।সাথে সাথেই আদ্রিশ ভাইয়ার হাসিমাখা মুখে নজরে এলো।কি মারাত্মক সেই হাসি।একদম ঘায়েল করে দিবে যেন।ধ্যাত,আবারো এসব বিষয়ে ডুবে যাচ্ছি আমি।এই বেয়াদব লোকটা আমাকে ডিস্ট্র্যাক্ট করতেই এমন করে যাচ্ছে নিশ্চয়।কিন্তু আমি ডিস্ট্র্যাক্ট হবো না।
আদ্রিশ ভাইয়ার উপর থেকে চোখ সরিয়ে আমি পানির দিকে তাকালাম।কি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এ পানি!একটু স্পর্শ করে দেখবো কি?
আমার মন থেকে তৎক্ষণাৎ জবাব এলো,’ভালো কাজে পারমিশন নিতে হয়না।’ আমি আনমনে হেসে বিলের সে পানিতে হাত ডুবালাম।কি ঠাণ্ডা সে পানি!শরীরে মৃদু শিহরণ জাগিয়ে তুলে।হৃদয়টাকে শীতল পরশে ডুবিয়ে দেয়।বাম হাত দিয়ে ব্যাগ আর নিকাব ধরে রেখে ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে রাখলাম।স্রোতের বিপরীত দিকে আমার হাত রয়েছে।ফলে পানিতে বারি খাচ্ছে।
অনেকক্ষণ এভাবে হাত রাখার পর হঠাৎ মন চাইলো একটু পানি ছিটিয়ে দেই আশেপাশে।মনের সে ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই ডান হাত দিয়ে পানি উঠিয়ে বিলের সে পানি আবারো বিলকেই ফেরত দিলাম।তবে এদিক ওদিক ছিটিয়ে।আমি এখন নিজের মধ্যে মত্ত।চারপাশে কি হচ্ছে তা আমার দেখতে মন চাইছে না।

আচমকা সোনালী এক আলোর ছটা চোখেমুখে পরতেই চোখজোড়া বা হাত দিয়ে বন্ধ করে নেই।কয়েক সেকেন্ড এভাবে রাখার পর বুঝতে পারলাম এ সোনালী আলোর উৎস কি।এ আলোর উৎস শেষ বিকেলের নরম সে সূর্যিমামার দেহ থেকে।ধীরেধীরে বা হাত চোখ থেকে সরিয়ে সূর্যের দিকে তাকালাম।এ আলো সয়ে নিতে কিছু সময় নিলো আমার চোখজোড়া। তবে খুব বেশি সময় না।কারন এ আলো কড়া নয়।বরং নরম।স্নিগ্ধ মনোমুগ্ধকর। বৃষ্টির পরে এই কড়া সূর্যের রূপ একদম নরম তুলতুলে হয়ে যায়।তার তেজি ভাবটা যেন একদম নাই হয়ে যায়।

শেষ বিকেলের হালকা ধূসর সাদা মেঘের আড়াল থেকে এ সূ্র্যের রশ্মি চারপাশকে পুরোপুরি সোনালী রঙে রাঙিয়ে দিলো।বিলের বহমান এ পানিতে সোনালী রঙ পরে কি চিকমিক করেছে!চোখ ধাঁধানো এক ঔজ্জ্বল্যতা ছাড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।দূরের নৌকাগুলো এ সোনালী পরিবেশে স্বর্ণালী রূপ ধারণ করেছে।পানির প্রতিবিম্ব আমার চোখেমুখে পরায় নিশ্চয় আমিও সেই স্বর্ণালী রূপ ধারন করেছি।

“মানুষ বহুরূপী হয়,ঠিক না মিশমিশ?”

হঠাৎ আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে আমি একটু চমকে গেলাম।আমি তো বেমালুম ভুলেই বসেছি আমার সামনে জলজ্যান্ত এক মানুষ বসে আছে!আমি এতোটা মন্ত্রমুগ্ধের মত সব চেয়ে চেয়ে দেখছি!
আদ্রিশ ভাইয়ার প্রশ্নের জবাব কি দেওয়া যায় তাই ভাবছি। তার চেয়েও বেশি ভাবছি উনার এ প্রশ্ন করার কারন।
আমি আমতাআমতা করে বললাম,
“ঠ-ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা।”

আদ্রিশ ভাইয়া এ কথার দিকে না গিয়ে অন্য কথায় গেলেন।
“আজকের আবহাওয়া,এ পরিবেশটা মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর তাইনা?”

আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,
“তা আর বলতে….এ আবহাওয়া, এ পরিবেশের সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয়না।একদম অতুলনীয়। ”

“উঁহু, ভুল বললে।এ পরিবেশের সাথে মানুষের রূপের তুলনা হয়।বরঞ্চ কিছু কিছু মানুষের রূপ এ পরিবেশের চেয়েও স্নিগ্ধ, সুন্দর।অতুলনীয়। শুধু তা পরখ করার নজর থাকলেই হয়।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠটা একটু অন্যরকম শোনালো।কেমন যেন নেশালো ধরনের। ধ্যাত,এমন হবে কেনো!আমার মাথাটা আসলেই গিয়েছে। তবে আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠটা আমার মনে কোনো এক সুক্ষ্ম অনুভূতির ঢেউ তুলে দিলো।সেই সুক্ষ্ম অনুভূতিটা কি তা ঠিক ধরতে পারলাম না।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়ার কথার দিক পাল্টানো উচিত বলে মনে হলো।তাই কথা ঘুরানোর জন্য আমি বললাম,
“এভাবে বৈঠা চালাতে আপনার হাত ব্যাথা করছে না?”

আদ্রিশ ভাইয়া মুখ লুকিয়ে হেসে বললেন,
“একটু আধটু্ অভ্যাস আছে তো তাই সমস্যা হচ্ছে না।”

“বাড়িতে আসলেই বুঝি নৌকা চালান?”

“হুম।এখানকার সব বন্ধুরা মিলে রাতে নৌকা চালিয়ে আড্ডা দেই।”

“কবে থেকে পারেন?”

“স্কুলে থাকতে ঝোঁকের বশে শিখেছিলাম।সেই থেকে পারি।”

“ওহ।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না।কথা বাড়ানোর মত আর কিছু নেই বলেই চুপ করে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর আদ্রিশ ভাইয়া বললেন,
“মিশমিশ?সময়টাকে এখানে থমকে দিলে কেমন হতো?মন্দ হতো না নিশ্চয়ই? ”

®সারা মেহেক

#চলবে