ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-১৩+১৪

0
948

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৩

আমরা বাড়িতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।আজকের বিকেলটা ভুলার মত নয়।বরং সারাজীবন মনে রাখার মত কিছু অনুভূতি,কিছু মূহুর্তের সমন্বয় আজকের বিকেল।নিঃসন্দেহে অতুলনীয় এক বিকেল।

রাতের খাবার খেয়ে ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই শরীরে একটা ঘুমুঘুমু ভাব চলে এলো।চোখজোড়া আর খোলা থাকতে চাইলো না।ক্লান্ত শরীরের সাথে ক্লান্ত চোখজোড়াও বন্ধ হয়ে এলো।সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে এলো সেই মূহুর্ত যখন আদ্রিশ ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলো,’মিশমিশ?সময়টাকে এখানে থমকে দিলে কেমন হতো?মন্দ হতো না নিশ্চয়ই?’
কানের কাছে শুধু উনার কণ্ঠ ঝংকার তুলতে লাগলো।সাথে মনেও যে কিছু একটা হতে লাগলো সেটাও টের পেলাম।তবে গুরুত্ব দিলাম না।এ অগুরুত্বপূর্ণ অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয় না।নিজেকে ছোট করার কোনো মানে হয়না।আমি এসবে কখনো নিজেকে জড়ায়নি, সামনেও জড়াবো না।নিজের লিমিটের মধ্যে থাকতে জানি।আত্মসম্মানকে গুরুত্ব দিতে জানি।আর যেখানে সে আগে থেকেই অপর একজনের সাথে জড়িয়ে আছে সেখানে আমার এসব অনুভূতির কোনো মানে হয় না।
চোখ খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

.

প্রাইভেট শেষে নদী বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া করে টিভি দেখতে বসলো।তার সাথে আমিও যোগ দিলাম।কিছুক্ষণ পর বড় মামি রুমে এসে নদীর উদ্দেশ্যে বললো,
“নদী,শুধুশুধু টিভি দেখছিস কেনো?মিমকে নিয়ে একটু ঘুরে এলেই তো পারিস।”

নদী সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কোনো কাজ করতে হবে চাচি?”

নদীর এ প্রশ্নের জন্যই যেন বড় মামি প্রস্তুত ছিলেন।তিনি চাপা হাসি দিয়ে বললেন,
“হুম।রাহেলা ভাবীর জন্য একটু খাবার নিয়ে যেতে হবে তোকে।”

নদী চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“বুঝেছি তো…. তোমার কথাবার্তার ধরন দেখেই বুঝতে পারি কি চাও তুমি। আর কি চলে তোমার মনে। ”

বড় মামি মৃদু হেসে নদীর পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বললো,
“মেয়ে বলে কথা।মায়ের মনের খবর সে জানবে না তো কে জানবে।তুই মিমকে নিয়ে রাহেলা ভাবীর বাড়ি গিয়ে খাবার দিয়ে আসবি আর আমাদের নতুন বাড়িটাও দেখিয়ে আনিস ওকে।”

নদী বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ালো।এরপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“চলো মিম আপু।তোমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ”

আমি কিছু না বলে নদীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলাম।

রাহেলা চাচি বড় মামিদের প্রতিবেশী। সম্পর্কে তারা কোনো আত্মীয়স্বজন নয়।অথচ ব্যবহারে মনে হবে তারা যেন আত্মীয়। নদীর সাথে অতি মিশুক ভাব,আমার সাথে যথেষ্ট আন্তরিকতার ভাব আমাকে এটা ভাবতে বাধ্য করেছে।সে বাড়ির ছোট্ট এক সদস্যের সাথে ইতোমধ্যে আমার একটু ভাব খাতির জমতে শুরু করেছে।ছোট্ট সে সদস্যের নাম পরী।নামটা যেমন মিষ্টি,দেখতেও তেমনি মিষ্টি।রাহেলা চাচির একমাত্র ছেলের একমাত্র মেয়ে সে।আমি যতটুকু সময় সেখানে ছিলাম তাতে মনে হয়েছিলো পরী এ বাড়ির সকলের চোখের মণি।প্রচণ্ড ভালোবাসে তাকে সবাই।

রাহেলা চাচির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি আর নদী বড় মামিদের নতুন বাড়ি দেখার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম।এক মিনিটেরও কম সময়ে সেখানে পৌঁছে গেলাম।
নতুন বাড়িটা পুরো ইট সিমেন্টের তৈরী।একতলা বাড়ির দোতলায় ছাদ বানানো হয়েছে।বাইরে থেকেই দেখতে পারলাম ছাদের রেলিঙ দেওয়া হয়নি।অবশ্য পরে দিবে হয়তো।কারন বাড়ির কাজ এখনও অনেক বাকি।
নদীর সাথে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখলাম মাত্র ইট দিয়ে গাঁথুনি দিয়ে প্রতিটা রুম আলাদা করেছে।পুরো বাড়ির কাজ সম্পূর্ণ শেষ হতে এখনও কয়েক মাস সময় লাগবে।
নদী একে একে আমাকে প্রতিটা রুম দেখালো।রান্নাঘর,ড্রইংরুম,ডাইনিং,বড় মামিদের রুম,ছোট মামিদের রুম,পলাশ ভাইয়ার রুম,আদ্রিশ ভাইয়ার রুম,নদীর রুম আর গেস্ট রুম।সবদিয়ে বাড়িটা বেশ বড়সড়।

“ছোট ভাইয়ার জন্যই বাড়িটা এত জলদি জলদি করা।নাহয় আরো পরে বাড়ি বানানোর কাজে হাত দিতো আব্বু আর চাচু। ”

আদ্রিশ ভাইয়ার রুমের দক্ষিণের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে পরতেই নদীর কথাটা শুনলাম আমি।তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“উনার জন্য এত জরুরী ভিত্তিতে বাড়ি করা কেনো?”

নদী আমার সামনে জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“ছোট ভাইয়ার বিয়ে দিবে তো তাই।নতুন বউ নতুন বাড়িতে এসে উঠবে।এজন্যই এত জরুরী ভিত্তিতে সব করা।”

আদ্রিশ ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনতেই আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো।স্পষ্ট টের পেলাম আমার মনে ক্ষুদ্র এক কষ্টের অনুভূতি তৈরী হলো।কিন্তু এসব অনুভূতিকে পাত্তা দিলাম না আমি।না দেওয়ারও কারন আছে।
এসব অনুভূতিকে পিষে গুড়িয়ে ফেললেই আমার জন্য ভালো।কারন এ অনুভূতি ভুল জায়গায় ভুল মানুষের উপর তৈরী হচ্ছে।
প্রথম প্রথম আদ্রিশ ভাইয়ার স্টাইল, চেহারা দেখে ভালো লেগেছিলো। কিন্তু এখন তা নয়।এখন উনাকে দেখতে পারলেই ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে।এ অনুভূতিটা নতুন,একটু আলাদা।
রোজ রোজ একটু একটু করে এ অনুভূতি আমি অনুভব করতে পারিনি।অনুভব করতে পেরেছি গতকাল।ভুল বললাম,এর আগেও একটু অনুভব করেছি।তবে তাকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। গতকালও এ অনুভূতি আমাকে জেঁকে ধরে।আমার মন একপ্রকার বাধ্য করে এ অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে। কিন্ত আমিও কম নয়।মনের কথা মানবো না।কারন এ মন বেশিরভাগ সময় ভুল আর নিষিদ্ধ পথে পা বাড়ায়।এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।

“চলো আপু,তোমাকে আমাদের পুকুর দেখাই।”

হঠাৎ নদীর কথায় হুঁশ ফিরে এলো আমার।আমি যে এতক্ষণ গভীর এক চিন্তায় মত্ত ছিলাম তা তাকে বুঝতে দেয়নি।ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললাম,
“আচ্ছা চলো।”

নদী আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা বড় পুকুরের কাছে নিয়ে এলো।পুকুরটা পুরোনো বাড়ির কাছে তবে নতুন বাড়ি থেকে দূরে।নদীর কথায় জানতে পারলাম পুকুরটা মেজ নানাভাইর ব্যক্তিগত ছিলো।এখন তা দুই মামার হয়ে গিয়েছে।।
পুকুরটা বেশ বড়সড় আর গভীরও হয়তো।পুকুরে ঘাট বাঁধা আছে।সিঁড়িও আছে।আমি আর নদী গিয়ে ভেজা সিঁড়ির উপর বসলাম।কিছুক্ষণ পরই গোসল করবো বলে নির্দ্বিধায় সেখানে বসে পরলাম।আমরা বসেছি পানি থেকে দুই সিঁড়ি উপরে।সেখানে বসে পা দুটো পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে রাখলাম।কি শীতল সে পানি!রৌদ্রতপ্ত এ দুপুরে পানির উপরিভাগ হালকা একটু গরম।তবে পা ডুবিয়ে দিলেই বুঝা যায় পানি কত শীতল!

বেশকিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ সময় কাটালাম।হঠাৎ কোনরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই নদীকে জিজ্ঞাস করলাম,
“আদ্রিশ ভাইয়ার বিয়ে এত তাড়াতাড়ি দিবে যে?”

প্রশ্নটা করেই মনে মনে নিজেকে কয়েকটা গালি দিয়ে নিলাম।এ প্রশ্ন করার কোনো মানেই হয়না।কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়া কথাবার্তা বলা যে কবে ঠিক হবে আল্লাহ জানে!প্রতিবার এ নিয়ে আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় পরতে হয়,তবুও নিজেকে শুধরে নেইনা আমি।অত্যন্ত খারাপ একটা গুণ আমার।
নদী কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,
“দাদি ছোট ভাইয়ার বউকে খুব দেখতে চায়।দাদির ভয় হলো যে,সে মরার আগে ছোট ভাইয়ার বউকে আদৌ দেখতে পারবে কি না। ”

“নানুর অবস্থা এতোটাও খারাপ নয় যে মরার কথা বলবে। ”

“এখন খারাপ।তবে মাঝেমাঝে খুবই খারাপ অবস্থা হয়ে যায়।ছোট ভাইয়াকে দাদি খুব ভালোবাসে।তাই ভাইয়ার বিয়েটা তাড়াতাড়ি করিয়ে দিতে চায়।”

নদীর কথা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলাম।কিছুক্ষণ বাদে জানা সত্ত্বেও একটা প্রশ্ন করে বসলাম আমি।
“উনার জন্য মেয়ে ঠিকঠাক?মানে উনি কি কাউকে পছন্দ করে?বা মামি উনার জন্য কাউকে পছন্দ করে রেখেছে?

“এসব বিষয়ে আমি জানি না।ভাইয়ার পছন্দ আছে নাকি জানা নেই।এসব বিষয়ে কখনো কথা উঠেনি আর আমরাও জিজ্ঞাস করিনি।
আর চাচির ব্যাপার হলো,সে মনের নজর দিয়ে মেয়ে খুঁজবে।কাউকে বলবে না।চাচির কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে ছোট ভাইয়াকে বলবে।আর ছোট ভাইয়া সম্মতি জানালে তখন ঘটা করে সবাইকে পছন্দের মেয়ের কথা জানাবে।”

আমি একটু শব্দ করে হেসে বললাম,
“ভালোই তো তাহলে।”

নদী আরো কিছু বলতে চাইছিলো।কিন্তু বলতে পারলো না। তার আগেই কে যেন বলে উঠলো,
“এই ভরদুপুরে এখানে কি করছিস নদী?”

পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে আসতেই পিছন ফিরে দেখলাম আদ্রিশ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন।হাতে ফোন,দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিনে।সবসময় ফোনে কি করেন উনিই জানেন।উনাকে বেশিরভাগ সময় আমি ফোনের দিকে চেয়ে থাকতে দেখেছি।

নদী উনার প্রশ্নের জবাব দিলো,
“দেখছো না বসে আছি।গল্পগুজব করছি।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার ফোন থেকে মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“এখানে বসে এত কিসের গল্পগুজব?”

“ঐ বাড়ি,বি…….” নদীকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম,
“ঐ বাড়ির বিষয়ে কথা বলছিলাম। কবে বাড়ি হবে,কবে সবাই উঠবে তা নিয়ে।”
এই বলে আমি লুকিয়ে ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেললাম।নদী যদি বিয়ের বিষয়টা আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে তুলতো তাহলে সেটা খুব দৃষ্টিকটু দেখাতো।আর এভাবে উনার বিয়ের বিষয়ে আমরা কথা বলছি সেটা জানলে উনি উল্টাপাল্টা কিছু মনে করলে তখন!

আমার কথা হয়তো আদ্রিশ ভাইয়ার হজম হয়নি।তাই তো আগের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরো একটু কুঁচকে এলো।তবে মূহুর্তেই সে ভ্রুজোড়া তার পূর্বের অবস্থা ফিরে পেলো।এর কারনও আছে কারনটা হলো উনার ফোনে হুট করে একটা কল এলো।ফোনের স্ক্রিনের দিকে একবার তাকিয়ে আবারো আমার দিকে তাকালেন তিনি।সে অবস্থাতেই কল রিসিভ করে উল্টো পথে হাঁটা ধরলেন তিনি।
আদ্রিশ ভাইয়া চলে যেতেই আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।নদীর দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বললাম,
“এভাবে উনার সামনে বিয়ের কথা তুলতে গেলে কেনো?আমরা মানে বিশেষ করে আমি যে উনার বিয়ের বিষয়ে কথা বলছি,এটা উনি জানলে বিষয়টা খারাপ হয়ে যেত না?”

নদী কি বুঝলো কে জানে?একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“হুম তা তো ঠিক বলেছো।”

নদীর এ অন্যমনস্ক ভাবটা আমার কাছে খুব একটা সুবিধার মনে হলো না।মেয়েটা কি কিছু ধরতে পারলো নাকি!!

.

গতকালকের পর আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে আর দেখা হয়নি।দুপুর আর রাতের খাবার সময়ও না।কোথায় ছিলো কে জানে।অবশ্য উনার সাথে এখন কম দেখা করাই ভালো।যত কম দেখা হবে আমার অনুভূতিটা তত ভোঁতা হয়ে আসবে।কি অদ্ভুত না?নতুন নতুন এক অনুভূতির সাথে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার আগেই তাকি পিষে গুড়িয়ে ফেলতে ব্যস্ত আমি।অনুভূতিগুলোকে তীক্ষ্ণ, সুক্ষ্ম করার বদলে ভোঁতা করতে ব্যস্ত আমি। এমনটাই করা উচিত আমার।এটাই আমার জন্য মঙ্গলজনক।

আজ সকাল থেকে রাইসা ভাবীর চোখেমুখে খুশির ছটা দেখা যাচ্ছে।কারন অনেকদিন পর কেউ তার বাবার বাড়ি থেকে কিছু আনতে যাবে।রাইসা ভাবীর চাচি নাকি বলেছে, রাইসা ভাবীর পছন্দের অনেক রান্না করেছেন তিনি।কিন্তু সে খাবার পাঠানোর মানুষ পাচ্ছে না।ভাবীর একমাত্র চাচাতো ভাই শহরের দিকে গিয়েছে কাজে।আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে যাবে।এই গরমে তো আর এতক্ষণ খাবার ভালো থাকে না। তাই এ বাড়ি থেকে কাউকে ঐ বাড়িতে গিয়ে খাবারগুলো আনতে বলেছে।পলাশ ভাইয়া অফিসের কাজে সকাল সকাল চলে গিয়েছে বলে ঐ বাড়িতে এখন আদ্রিশ ভাইয়াকে পাঠানো হচ্ছে।

কিছুক্ষণ আগে বড় মামির সাথে ঐ বাড়িতে পাঠানোর জন্য হাঁসের গোশত আর রুটি টিফিনবাক্সে ভরে দিয়ে এলাম।ছোট মামি একটু অসুস্থ আর নদী বাড়ি নেই।এজন্যই বড় মামির কাজে এটুকু সাহায্য করতে পেরেছি।
কাজ শেষ করে মাত্রই রুমে এসে বসলাম আমি।একপ্রকার হুড়োহুড়ি করে বড় মামি হুট করে রুমে এসে বললো
“মিম,রেডি হয়ে নাও।”

এ সময়ে কেনো রেডি হবো তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তাই বড় মামিকে জিজ্ঞাস করলাম,
“এ সময়ে রেডি হবো কেনো মামি?কোথায় যাবো?”

বড় মামি ব্যস্ত হয়ে বললো,
“আহহা,এত প্রশ্ন করো কেনো?যা বললাম তাই করো, যাবো এক জায়গায়।”

বড় মামির কথায় আর ফিরতি প্রশ্ন না করে বাধ্য মেয়ের মত রেডি হয়ে নিলাম।আমাকে দেখে মামি বললো,
“চলো এবার।আদ্রিশ সেই কখন থেকে বসে আছে?”

বড় মামির কথায় ছোটখাট একটা ঝটকা খেলাম আমি।কথার মর্মার্থ উদ্ধার করতে না পেরে জিজ্ঞাস করলাম,
“মানে?কোথায় যাবো আমরা?”

বড় মামি আমার হাত ধরে বাইরে এনে বাড়ি থেকে বেরুতে বেরুতে বললো,
“আদ্রিশ বেরই হতে যাচ্ছিলো তখন হঠাৎ রাইসা বলল,তোমাকেও ওর সাথে পাঠিয়ে দিতে।ওদের বাড়িটা একটু ঘুরে আসবে।আশেপাশে একটু ঘুরে আসবে।শুধু শুধু বাসায় বসে থেকে কি লাভ। ”

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি থ বনে গেলাম।কি রিয়েকশন দিবো বুঝে উঠতে পারলাম না।এখন আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে ঐ বাড়িতে পাঠাবে আমাক!ঘুরতে পাঠাবে!কি এক মহাযন্ত্রনা।যার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চাই সেই কাছে এসে পরে।সবকিছু এত দ্রুত হয়ে গেলো যে আমি ওখানে যেতে মানা করারও সুযোগ পেলাম না। বড় মামি এটা আগে বললে যদিও মানা করার সুযোগ থাকতো।এখন তো তাও নেই।

উঠোনে এসে দেখলাম রাইসা ভাবী মাথায় ঘোমটা দিয়ে পেটের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।আর আদ্রিশ ভাইয়া বাইকে বসে ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে দু হাত চুল সেট করছেন।আমার উপস্থিতি হয়তো উনি টের পেয়েছেন।তাইতো একনজর আমার দিকে তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে মনযোগী হলেন তিনি।

রাইসা ভাবীর পাশে এসে দাঁড়াতেই রাইসা ভাবী হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“যাও মিম,আমার বাবার বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসো।ওদিকে অনেক ঘুরার জায়গা আছে।এখান থেকে মাত্র আধ ঘন্টার পথ।তুমি শুধুশুধু বাড়িতে বসে আছো বলে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার আইডিটা দিলাম। ভালো করেছি না?”

ভাবীর প্রশ্নে আমার জবাব দিতে মন চাইলো,’মোটেও ভালো কাজ করোনি ভাবী।উল্টো আমাকে নতুন এক মুসিবতের দিকে ঠেলে দিলে তুমি।এমনটা করলে কেনো!’
এ জবাব মনেই থাকলো।মুখ ফুটে বের হলো না।

বড় মামি এবার আমাকে বললো,
“যাও মিম,বাইকে চড়ে বসো।”

বড় মামির কথায় আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম।বাইকে চড়বো মানে!আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে বাইকে চড়বো আমি!হতেই পারেনা।এ মানুষটার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করছি।আর পরিস্থিতি নাকি উনার কাছেই আমাকে ঠেলে দিচ্ছে!

আমি কণ্ঠে যথাসম্ভব বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম,
“বাইকে কেনো!!অটোতে যাবো না?”

আমার এ বিস্ময়কর ভাব উপস্থিত কেউই হয়তো আশা করেনি।তাইতে তিনজনেই একসাথে হেসে উঠলো।
বড় মামি হাসতে হাসতেই বললো,
“তোমার বড় মামা বললো,বাইকে একটু সমস্যা হয়েছে বলে।তাই আদ্রিশকে দিয়ে মেকানিকের কাছে একটু সেরে নিবে। যাওয়ার পথেই বলে সে দোকান পরে।সেখান থেকেই সারিয়ে নিবে।”

“বাইকে সমস্যা থাকলে বাইকে যাওয়ার কি দরকার?সমস্যা থাকার পরেও বাইক চলবে কি করে?”

আমার প্রশ্ন করা দেখে বড় মামি শব্দ করে হেসে বললো,
“বাইক চলতে কোনো সমস্যা হবে না বলে।আর আদ্রিশ যেহেতু বেরই হচ্ছে আর ওদিকেই যাচ্ছে তাই বাইকটাই নিয়ে যাচ্ছে।বুঝছো?”

বড় মামির যুক্তি মেনে নিয়ে ফুঁস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি।বিরক্ত লাগছে সব।
কি এক যন্ত্রণা!আজ সব এতো অনিচ্ছায় হচ্ছে কেনো!বাইরে যাবো না,তাও যাওয়া হচ্ছে।আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে যাবো না,তাও যাওয়া হচ্ছে।বাইকে চড়বো না, তাও চড়তে হচ্ছে!আর কি কি অনিচ্ছায় করতে হবে কে জানে।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমি বাইকের দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখেমুখে হাজারো বিরক্তি প্রকাশ করেছি।তবে তা আদ্রিশ ভাইয়ার নজরে এলো না।
খিটখিটে মেজাজ নিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে বাইকে উঠে বসলাম আমি।ডান হাত নিজের পায়ের উপর রেখে বাম হাত রাখলাম বাইকের পিছনের ঐ অংশে।
আমার বসে পরার পরপরই আদ্রিশ ভাইয়া বাইক স্টার্ট দিলেন।তবে তা চালানোর আগে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
“কারোর মার্ডার হলে আমি দায়ী না।বিনা দোষে আমাকে মার্ডারের সাজা দিলে আমি বলবো,তুমি হাত গুটিয়ে বসে ছিলে।সেফটি হিসেবে আমার কাঁধে হাত রাখোনি।”
আদ্রিশ ভাইয়ার প্রথম কথার আগামাথা বুঝতে না পারলেও পরের কথার মানে বুঝলাম।উনার কাঁধে হাত রাখতে হাজারো অস্বস্তি এসে আমাকে ঘিরে ধরবে তা জানা আছে।তাই হাত না দিয়ে আগের মতোই রইলাম আমি।

আমাকে এভাবে থাকতে দেখে আদ্রিশ ভাইয়া বললেন,
“মিশমিশ,আমার কাঁধে হাত রেখে ভরসা করতে পারো।ট্রাস্ট মি,খারাপ কিছু হবে না।এ চলার পথের সঙ্গী হিসেবে এটুকু ভরসা করতেই পারো।আশাহত হবে না।”

®সারা মেহেক

#চলবে

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৪

মাত্রই রাইসা ভাবীর বাবার বাড়ি পৌঁছালাম।আধ ঘন্টার পথ পার করতে সময় লেগেছে প্রায় এক ঘন্টা।কারন পথে মেকানিকের দোকানে বাইক সারতে থামতে হয়েছিলো।

এ বাড়িতে আসার পর রাইসা ভাবীর চাচি আমাদের বেশ খাতির যত্ন করলেন। তার আন্তরিকতা আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে।প্রথমে আমাকে আর আদ্রিশ ভাইয়াকে একসাথে দেখে একটু ইতস্তত বোধ করছিলেন উনি।হয়তো আমাদের একসাথে খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি উনি।তবে এ বিষয়টা যাতে আমরা বুঝতে না পারি সেজন্য উনি যথেষ্ট চেষ্টাও করেছেন।তবুও আমি সেটা ধরতে পেরেছি।আদ্রিশ ভাইয়া বিষয়টা ধরতে পেরেছেন নাকি কে জানে।

রাইসা ভাবীর চাচি আমাদের নাস্তা দিয়ে বাকি রান্নাবান্না শেষ করতে গেলেন।এদিকে যে উনি আমাকে বিপদে ফেলে গেলেন তা বোধদয় উনার জানা নেই।একটা খাট,টিভিসেট,একটা আলনা আর একটা সোফা সেট নিয়ে রুমটা পরিপূর্ণ আকার ধারণ করেছে।ঐ একটা সোফা সেটেই আমি আর আদ্রিশ ভাইয়া পাশাপাশি বসে আছি।প্রচন্ড বিরক্তি আর অস্বস্তি লাগছে আমার।কিছুক্ষণ আগে বাইকে চড়ে কম অস্বস্তি লাগেনি।সেই অস্বস্তি আবারো এসে আমাকে ঘিরে ধরলো।মেজ নানু বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে আমি এক ছুট দিয়ে এ রুম থেকে বেড়িয়ে যেতাম।কিন্তু এখানে চাইলেও তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।একটু নড়াচড়া করতেও অস্বস্তি লাগছে।মহা যন্ত্রনা তো!এভাবে রোবটের মত নড়াচড়া ছাড়া কারোর পাশে বসে থাকা যায় নাকি!তবুও আমাকে বসে থাকতে হচ্ছে।

বিরক্তির চরম মাত্রায় থাকলে হয়তো মানুষ একটা ঘরের প্রতিটা বস্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।আমার ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে।বিরক্তি আর অস্বস্তির চরম মাত্রায় আছি বলে এ ঘরের প্রতিটা জিনিস একদম জহুরির নজরে পরখ করে দেখছি আমি।শুধু আমার পাশে বসা মানুষকে বাদ দিয়ে আমি সবই দেখছি।

পুরো ঘরটা পরখ করে দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেলো বিছানার কাছের জানালায়।জানালাটা বন্ধ ছিলো বলে চোখে পরেনি হয়তো।আমি কোনোরূপ চিন্তা ভাবনা ছাড়াই উঠে গিয়ে বিছানার কাছের সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে পরি।জানালা খুলে দিতেই হুর হুর করে বাতাস ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।কেটে যায় সমস্ত অস্বস্তি, বিরক্তি।সমাপ্তি ঘটে দমবন্ধকর এক পরিবেশের।এতক্ষণ যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু এখন স্বস্তি লাগছে।আরাম অনুভব করছি।

“আরে আদ্রিশ ভাই যে! কেমন আছেন?”

হুট করে অপরিচিত এক কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই পিছনে ফিরে তাকাই আমি।সেদিকে তাকাতেই দেখলাম সাধারণ ড্রেসআপে একটা ছেলে আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে হ্যান্ডশেক করে উনার পাশে বসলো।মানুষটা কে হতে পারে তা একটু আন্দাজ করলাম আমি।উনি হয়তো রাইসা ভাবীর চাচাতো ভাই।কিন্তু উনার তো দুপুরের পর আসার কথা ছিলো।তাহলে সকালের দিকে উনি কি করছেন?

আদ্রিশ ভাইয়া স্বাভাবিকভাবে বললেন,
“তোমার না দুপুরের পর আসার কথা ছিলো রাসেল?”

আদ্রিশ ভাইয়া সম্বোধনে বুঝতে পারলাম রাইসা ভাবীর চাচাতো ভাই উনিই এবং উনার নাম রাসেল।
রাসেল ভাইয়া এবার হালকা হেসে বললেন,
“কাজ এখনও বাকি আছে।তবে তা রাতের দিকে পিছিয়ে নেওয়া হয়েছে।এজন্যই এখন বাসায় চলে এলাম।তো আপনি কেমন আছেন ভাই?”

আদ্রিশ ভাইয়া বিনয়ী কণ্ঠে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?”

“আল্লাহ রেখেছে ভালোই।”

“এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে না?”

“জ্বি ভাই।”এই বলে রাসেল ভাইয়া মুখ তুলে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“মেয়েটাকে চিনতে পারলাম না ভাই। ”

আদ্রিশ ভাইয়া ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে একনজর তাকিয়ে আবারো রাসেল ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এক আত্নীয় হয়।ভাবীর কথায় তোমাদের বাড়িতে ঘুরাতে নিয়ে এলাম।”

রাসেল ভাইয়া হালকা হেসে বললেন,
“তাহলে বসে আছেন কেনো ভাই?চলেন ঘুরতে নিয়ে যাই আপনাদের দুজনকে।”

আদ্রিশ ভাইয়া আবারো আমার দিকে তাকালেন।কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে থাকার পর বসা থেকে উঠে বললেন,
“যাওয়ার কি ইচ্ছা আছে?থাকলে ওভাবে রোবটের মত দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটা ধরো।নাকি কোলে তুলে নিয়ে যাবো?”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম।কয়েক মূহুর্ত একদম বাকশূন্য হয়ে পরলাম আমি।
ছিঃ ছিঃ রাসেল ভাইয়ার সামনে কিসব বললেন উনি!তওবা তওবা।লোকটা চরম মাত্রায় খারাপ।উনার এ কথার জন্য রাসেল ভাইয়া নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কিছু মনে করছেন।হ্যাঁ,মনে করছেন তো।তাইতো উনার চোখেমুখে চাপা এক হাসি বিরাজ করছে।উনি যেমন উল্টাপাল্টা ভাবছেন এমন উল্টাপাল্টা কিছুই নেই আমাদের মাঝে।অথচ……..দুজনের পথ দুদিকে।

আমি আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।চোখ দিয়ে উনার উপর আগুনের গোলা বর্ষন করতে পারলে ভালো হতো।আমার চোখের আগুনে উনি ঝলসে যেতেন।তখন বুঝতো এমন কথা বলার মজা।

আমি কিছু না বলে সেই জানালাটা বন্ধ করে আদ্রিশ ভাইয়া আর রাসেল ভাইয়ার পিছু পিছু হাঁটা ধরলাম।

রাইসা ভাবীর চাচিদের বাড়ি থেকে বেরুতেই বিস্তর এক ধানক্ষেত চোখে পরলো।ধানক্ষেতের ওপর দিকে রয়েছে বিশাল বড় এক বাগান।রাসেল ভাইয়া বললেন,ঐ বাগানটা তাদের নিজস্ব কাঠবাগান।আদ্রিশ ভাইয়াকে ঐ বাগান ঘুরে আসার প্রস্তাব দিলেন তিনি।আদ্রিশ ভাইয়াও রাজি হয়ে গেলেন।

ধানক্ষেতের আইল দিয়ে আমরা তিনজনে হেঁটে চলছি।প্রথমে আদ্রিশ ভাইয়া,তার পিছে রাসেল ভাইয়া আর তার পিছে আমি।আদ্রিশ ভাইয়া আর রাসেল ভাইয়া নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল।আর আমি চুপচাপ হেঁটে চলছি।এ মূহুর্তে বিরক্তিতে দুটো গল্পবাজের মাথা ফাটাতে ইচ্ছা করছে।সেই যে রাইসা ভাবীর চাচি আমাকে রেখে গিয়েছে তখন থেকে চুপচাপ বসে আছি,দাঁড়িয়ে আছি।মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।আসলে কথা বের করার সুযোগ পাচ্ছি না। এতক্ষণ চুপচাপ থাকতেই তাই বিরক্ত লাগছে।

আজকের দিনটা বেশ রৌদ্রজ্জ্বল এক দিন।তবে রোদ পোহাবার মত দিন নয়। বরং রোদ থেকে বাঁচবার দিন।কারন আজকে রোদের তেজ স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বেশিই।আমি মাথা উঁচু করে ঠিকঠাকমতো তাকিয়ে থাকতে পারছি না।ফলে মাথা নিচু করে হাঁটতে হচ্ছে।ওদিকে পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার।এজন্য একটু অস্বস্তিও হচ্ছে।তবে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা হালকা শীতল বাতাস শরীরে একটু স্বস্তি বয়ে আনছে।নাক মুখ দিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ঠোঁটের উপরে জমে থাকা ঘামের বিন্দুগুলো মুছে নিলাম আমি।

“তো আপু….কেমন আছেন আপনি?”

হঠাৎ কারোর কণ্ঠস্বর শুনে একটু চমকে উঠলাম।কণ্ঠস্বরটা পরিচিত নয়।অপরিচিত।এই অপরিচিত কণ্ঠস্বরের সাথে পরিচিয় হতে দ্রুত মাথা তুলে সামনে তাকালাম আমি।
সামনের তাকিয়েই রাসেল ভাইয়ার হাস্যজ্জল মুখখানি দেখতে পেলাম।হাঁটতে হাঁটতে উনি দাঁড়িয়ে পরেছেন।ফলে আমাকেও দাঁড়িয়ে পরতে হলো।
উনার হাসি দেখে আমি ভদ্রতার এক হাসি দিয়ে বললাম,
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?”

“জ্বি আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আপু আপনার নামটা জানা হলো না। ”

“জ্বি আমার নাম মিম।”

“বাহ,সুন্দর নাম তো।অবশ্য আরবী হরফের নামগুলো সুন্দর না হয়ে উপায় আছে নাকি। ”

আমি প্রতিউত্তরে কিছু না বলে চোখেমুখে মৃদু হাসির ভাব ফুটিয়ে রাখলাম।রাসেল ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকো এবার বললেন,
“চলুন,আরেকটু হাঁটলেই বাগানের ভেতর যাওয়া যাবে।সেখানে অনেক সুন্দর বাতাস বইছে।আদ্রিশ ভাই কথা বলতে বলতে সেদিকটাই গেলো।”

রাসেল ভাইয়ার কথা শুনে বুঝতে পারলাম আদ্রিশ ভাইয়ার ফোন এসেছে।এজন্যই উনারা দুজন আপাতত গল্প করা বাদ দিয়েছেন।
রাসেল ভাইয়া আর আমার মধ্যে চলার পথে টুকটাক কথাবার্তা হলো।বাগানে পৌঁছেই উনি আমাকে বাগানের সব গাছগুলো দেখাতে লাগলেন।এ বাগানে কাঠের গাছসহ আমগাছ, লিচুগাছ এবং আরো নানা ধরনের ছোট বড় গাছ রয়েছে।আমার পুরো বাগানের সব গাছ চেনা হয়ে গেলো কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শেষ হলো না।উনি এখনও ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছেন।ভুলক্রমে চোখাচোখি হওয়ার ভয়ে উনার দিকে আমি একবারও চেয়ে দেখিনি।
বাগানের যে অংশ দিয়ে ধানক্ষেতের শুরু হয়েছে সে অংশে আমি আর রাসেল ভাইয়া গল্প করতে করতে দাঁড়িয়ে পরলাম।এদিকে বেশ হাওয়া বইছে।ফলে গরমের সেই অস্বস্তি ভাবটা একদম কেটে গিয়েছে।
রাসেল ভাইয়ার সাথে কথাবার্তা বলে বুঝলাম তিনি খুব মিশুক প্রকৃতির মানুষ।কারোর সাথে একটু খাতির হয়ে গেলেই তিনি তার মনের কথা সে মানুষটার সামনে তুলে ধরে।এই যেমন আমার সামনে উনি উনার গার্লফ্রেন্ডের সম্পর্কে প্রায় সবটাই বললেন।এমনকি ছবি পর্যন্তও দেখালেন।এ বিষয়ে আরো কথাবার্তা হলো।
কথায় কথায় জানতে পারলাম রাসেল ভাইয়া রাইসা ভাবীকে খুব ভালোবাসেন।রাইসা ভাবীও কম ভালোবাসেন না।এ বাড়িতে যতদিন সে ছিলো একজন আদর্শ বড় বোনের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিলো।এখনও প্রায় প্রতিদিন দুই ভাই বোন ফোনে কথাবার্তা বলে।রাসেল ভাইয়ার সময়ের স্বল্পতার কারনে তিনি রাইসা ভাবীর সাথে দেখা করার তেমন সুযোগ পান না।
রাসেল ভাইয়ার সাথে আরো বেশ কিছুক্ষণ নানা টুকটাক নানা বিষয়ে কথা বললাম।কথার মাঝেই হঠাৎ আদ্রিশ ভাইয়া এসে উপস্থিত হলেন।চোখেমুখ লাল হয়ে আছে উনার।এ লাল হয়ে থাকার কারনটাও চট করে ধরে ফেললাম আমি।রোদের জন্য রাসেল ভাইয়ার মত যে উনারও চোখমুখ লাল হয়ে আছে তা এমনিতেই বুঝা যায়।

আদ্রিশ ভাইয়া এদিকে এসেই ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া করলেন।উনার তাড়া করা দেখে রাসেল ভাইয়া আমাদের দুজনকে নিয়ে আবারো বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন।
বাড়ি এসে আদ্রিশ ভাইয়া আর আমি হালকা একটু খাওয়াদাওয়া করে বেড়িয়ে পরলাম।রাইসা ভাবীর চাচি আমাদের কাছে দিয়ে দিলেন হরেক রকমের পদের রান্নাবান্না। সেসব নিয়ে বাইকে উঠাও হলো আরেক ঝামেলা।তবুও কষ্টেসৃষ্টে খাবারগুলো নিয়ে বাইকে চড়ে বসলাম আমরা।

আদ্রিশ ভাইয়া এবার আর আগেকার মত ধীরে বাইক চালাচ্ছিলেন না।বরং স্বাভাবিক এর চেয়ে একটু বেশিই জোরে চালাচ্ছিলেন।মেইন রোডে এত জোরে বাইক চালানোয় ভয়ে আমি আদ্রিশ ভাইয়ার কাঁধের কাছের শার্টের অংশটুকু জোরে চেপে ধরি।একপর্যায়ে উনি একটু বাঁক নিতে আমার ভয় আরো বেড়ে গেলো।ভয়ে আমি এবার উনার শার্টসহ কাঁধ জোরে চেপে ধরি।এতেও আমার মনের আতঙ্ক আর ভয় মিটলো না।মনে হচ্ছে এই বুঝি পরে যাব বাইক থেকে।রাস্তার যানবাহনগুলোকে ওভারটেক করতেই উনার এ বাঁক নেওয়া।

আমি ভয়ে আর না পেরে আদ্রিশ ভাইয়াকে বললাম,
“একটু আস্তে বাইক চালান।পরে যাবো তো আমি।”

চারপাশের বাতাসের সাই সাই আওয়াজের ফলে আদ্রিশ ভাইয়ার সম্পূর্ণ কথা কানে এলো না আমার।শুধু শুনতে পেলাম,’খাবারগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।’
আমি এটা শুনে আর কথা বাড়ায়নি।জোরো বাইক চালানোর ফলে আধ ঘন্টার রাস্তা কমে পনেরো মিনিটের রাস্তায় পরিণত হলো।

বাড়িতে ফিরেই আমি নদীর রুমে চলে এলাম।ভয়ে আমার প্রাণপাখি উড়ো উড়ো অবস্থা। পণ করলাম সুস্থ সবল থাকতে আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে কোনোদিনও বাইকে চড়বো না।আজ উনি যেভাবে বাইক চালাচ্ছিলেন তাতে বারবার মনে হচ্ছিলো এই যাত্রাই আমার শেষ যাত্রা। তবে ভাগ্যক্রমে এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছি আমি।

রাইসা ভাবীর বাড়ি থেকে ফিরেই মেজ নানু,বড় মামি,ছোট মামি,রাইসা ভাবী আর নদীর সাথে গল্প জুড়ে দিলাম।সেখানে আমার কেমন খাতির যত্ন হলো তা রাইসা ভাবী বেশ ভালো করেই শুনলো।সে আমার প্রতি তার চাচির ব্যবহারে যে বেশ খুশি হয়েছে তা তার চোখেমুখের হাসির রেখাই বলে দিচ্ছে।

.

দুপুরের খাবার খাওয়া শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই জানালার কাছে একটা কাগজ চোখে পরলো আমার।কিছুক্ষণ সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম।পরে আলসেমিতে ঘেরা শরীর নিয়ে উঠে বসে কাগজটা হাতে নিলাম আমি।সুন্দর করে ভাঁজ করা কাগজটার ভাঁজ খুলতেই অবাক হয়ে গেলাম আমি।আবারো সেই আগের মত চিঠি!উপরের সম্বোধন দেখে মূহুর্তেই ধরে ফেললাম চিঠিটা অর্ণব ভাইয়া দিয়েছে।চিঠির সম্বোধনের সাথে পুরো চিঠিটা পড়ে আমার অবাক হওয়ার মাত্রা আরো বেড়ে গেলো।

“মাধবীলতা,
বহুদিন পেরিয়ে গেলো চিঠির মাধ্যমে তোমার খোঁজ নেয়নি।আমাকে তো বেমালুম ভুলে বসেছো তুমি।কিন্তু আমি তোমাকে ভুলিনি।সেজন্যই আজ আবারো চিঠিটা দেওয়া।
একটা অভিযোগ আছে তোমার বিরুদ্ধে।মস্ত বড় অভিযোগ।
তুমি আমার চিঠিটা সেদিন দুমড়েমুচড়ে ফেলে দিয়েছিলে কেনো?আমার দেওয়া সে চিঠিতে লেখা কবিতা কি তোমার ভালো লাগেনি?ভালো লাগেনি আমার সে সম্বোধন? ভালো না লাগলেও আমি তোমাকে এ নামেই ডাকবো।

আচ্ছা,মাধবীলতা, একটা প্রশ্ন করবো।উত্তর দিবে?কারোর প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া কি খারাপ?আমি যতদূর জানি এটা খারাপ।
জানো কি?আমার দ্বারা এ খারাপ কাজটা হচ্ছে।আমি প্রচন্ড ঈর্ষান্বিত বোধ করছি। আমি কখনও এমনটা অনুভব করিনি।রাগ,ক্ষোভ, কষ্ট থাকলেও ঈর্ষা করা আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি।অথচ সে অসম্ভব জিনিসও আমার দ্বারা আজ সম্ভব হয়ে গেলো।কি করে কে জানে।এ ঈর্ষান্বিত ভাবটা প্রথম অনুভব করলাম আমি।আচ্ছা, এ ঈর্ষান্বিত ভাবটা কি এর আগে কখনও তুমি অনুভব করেছো?আমি জানি না তুমি কখনও অনুভব করেছো কি না।তবে আমি আজ প্রথমবার এমন ধরনের ঈর্ষা অনুভব করলাম।আর এ অনুভবটা কেমন জানো?এ অনুভব এমন যে মনে হবে তোমার ভেতরটা জ্বলতে শুরু করেছে।কেউ তোমার ভেতরটা কেটে ছিড়ে ফেলছে।এমন অনুভূতি কখন হবে জানো?যখন তোমার পছন্দের মানুষের সাথে অন্য কাউকে কথা বলতে দেখবে।

এসব অনুভূতি নতুন আমার জন্য।আগে কখনও অনুভব করেনি।জানতাম না এসব অনুভূতি এতোটা ভয়ংকর।জানি না আর কত ভয়ংকর সব অনুভূতির সাক্ষাৎকার পেতে হবে।

জানো,মাধবীলতা, আমি এসব লেখার সময় কেমন যেন বাচ্চা হয়ে যাই।মাঝে মাঝে অনুভূতিগুলো একদম সাজাতে পারিনা।আবার মাঝেমাঝে অনুভূতিগুলো একদম মনমত সাজাতে পারি।আজ আমি একদম সাজাতে পারিনি।আজ আমি তুলে ধরতে পারছি না আমার ভেতরকার দহন।তোমাকে জানাতে পারছি না আমার ভেতরে চলা সব নিত্যনতুন অনুভূতির তালিকা।কিভাবে জানাবো সেটাও জানি না।আমি নিজেই ঠিক বুঝছি না আমার ভেতরকার পরিবর্তন, অনুভূতি।

আজ আর কিছু লিখতে পারছি না।
ওহ হ্যাঁ,এ চিঠিটা ভুলেও ফেলে দিবেনা।এটা আমার অনুভূতি দিয়ে গড়া এক চিঠি।পারলে এটার উত্তর দিও।তবে ফেলে দিওনা।এমনটা করলে সবার অগোচরে নয়,সবার সামনে দিয়ে তোমাকে চিঠিটা দিবো আমি।”

চিঠিটা শেষ হতেই একটা শুকনো ঢোক গিললাম আমি।চিঠিটা কিছুতেই আমার বোধগম্য হলো না।অর্ণব ভাইয়া সেদিন ঐ কথা বলার পর আজ এ চিঠি কেনো দিলো?কেনো এসব লিখলো?তাহলে আমি সেদিন যা আন্দাজ করেছিলাম তাই ঠিক?অন্তত চিঠির লেখাগুলো পড়ে সেটাই মনে হচ্ছে।

নাহ,এসব সহ্য করার মত নয়।অর্ণব ভাইয়ার সাথে কথা বলে সবটা পরিষ্কার করা দরকার।এসব ভেবেই আমি ফোনটা হাতে নিলাম।ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে অর্ণব ভাইয়াকে ম্যাসেজ দিতে যাবো।কিন্তু তার আগেই উনার ম্যাসেজ চোখে পরলো।আজ ভোরের দিকে ম্যাসেজ দিয়েছেন উনি। লিখেছেন,’মিম,তোমার সাথে অনেকদিনই দেখা হবে না।আমি এক মাসের জন্য নেপালে যাচ্ছি ফ্যাক্টরির কিছু কাজে।ফেসবুক,ম্যাসেঞ্জারও আনইন্সটল করে দিচ্ছি।কারন এ দুটো থাকলে আমি কাজে মনযোগী হতে পারবো না।সো খবর নেওয়ার কোনো অপশনও থাকলো না।আমার ফিরে আসতে হয়তো এক মাস সময় লাগবে।ততদিনে হয়তো তুমি বাসায় ফিরে যাবে।তোমার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না।যাওয়ার আগে দেখা করে যেতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তাড়াহুড়ো করায় তা সম্ভব হয়নি। অনেক কথা বললাম,ভালো থেকো।আর আমার জন্য দোয়া করো।”

ম্যাসেজটা দেখে প্রচণ্ড রাগ হলো আমার। এত জরুরী একটা বিষয়ে বোঝাপড়া করবো অথচ সে ম্যাসেজই দেখবে না!কি এক যন্ত্রনা!
রাগে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেললাম।মাথায় ঘুরছে হাজারো প্রশ্ন।খুব কনফিউজড হয়ে পরলাম এসব কিছু নিয়ে।মাথা কাজ করাও যেন বন্ধ করে দিচ্ছে।সব উল্টাপাল্টা লাগছে।বিরক্তিকর………

®সারা মেহেক

#চলবে