ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-১৫+১৬

0
908

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৫

চিঠির ব্যাপারে এ বাড়ির কারোর সাথে কোনো কথাবার্তা বলেনি।এ বিষয়টা নিজের মধ্যে চেপে রাখাই ভালো।নদীর সাথে আমার সুসম্পর্ক বজায় থাকলেও এ চিঠির বিষয়ে তার সাথে কথা বলা ভালো হবে না বলে আমার মনে হলো।অবশ্য আমার এ বিষয়ে নদীর সাথে কথা না বলা উচিত মনে হলেও উচিত না এখন।কারন সে কিছুদিন যাবত কোনো একটা বিষয়ে বেশ চিন্তিত থাকে।মাঝেমধ্যেই দেখতে পাই সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।এর কারনটা জিজ্ঞাস করলে সে বিষয়টা এড়িয়ে যায়।তাই আমিও আর জোর করিনি।

আমার অর্ধেক রাতটা কেটে গেলো চিন্তায় চিন্তায়।অর্ণব ভাইয়ার চিঠি দেওয়ার বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে ছোট আর কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলেও আমার কাছে বড় আর অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।টেনশনে আমার রাতের ঘুম অর্ধেক কেড়ে নেওয়ার জন্য এমন ব্যাপারগুলো যথেষ্ট।মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো বেশ কয়েকটা প্রশ্ন।সেদিন অর্ণব ভাইয়া ওসব কথা বলার পরও আজ চিঠিটা কেনো দিলো?তবে কি সেদিন ইচ্ছা করে আমাকে মিথ্যা বলেছিলো যে চিঠিটা ভুলে চলে এসেছিলো?কিন্তু মিথ্যা বলবে কেনো?আবার আজকের চিঠিতে লেখা ছিলো,উনি কারোর উপর জেলাস।এই জেলাসি ভাবটা ঠিক কার উপর?উনি যে বললেন পছন্দের মানুষের সাথে অন্য কেউ কথা বললে এমন জেলাস হয়।তার মানে সত্যিই উনি কি আমাকে পছন্দ করেন?এমনটা হলে জেলাস ভাবটা হওয়া উচিত।আমার ধারণা যদি ঠিক হয়,তাহলে কি উনি আদ্রিশ ভাইয়ার উপর জেলাস?
উফফ,এতো প্রশ্ন অথচ একটারও উত্তর নেই।এতো প্রশ্ন মাথায় নিয়ে থাকলে আমার পাগল হতে বেশি সময় লাগবে না।এমনিতেই কি কম দুশ্চিন্তা করি যে ‘অর্ণব’ নামক নতুন এক দুশ্চিন্তা আমার মাথায় চড়ে বসলো!এসব থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় আমার মাথায় আসছে না।তবে এ দুশ্চিন্তা থেকে যে কয়েকদিনের জন্য মুক্তি পাবো সেটা ভেবেই শান্তি লাগছে।অবশ্য অর্ণব ভাইয়া যতদিনে এখানে ফিরে আসবে ততদিনে আমি আমার বাসায় চলে যেতে পারবো।বাসায় গেলেই এই উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি।তখন ভুলেও অর্ণব ভাইয়ার ম্যাসেজ দেখবো না।এতেই আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।এসব ভেবে স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।কিছুক্ষণের মাঝেই পাড়ি দিলাম ঘুমের রাজ্যে।

.

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে মন ভালো করার মত একটা সংবাদ শুনলাম।আজকে আমাকে মিষ্টি আপুর আব্বু উনাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসবে।মিষ্টি আপুর আব্বু অর্থাৎ তুহিন মামা আম্মুর আরেক খালার ছেলে।আম্মুর এই দুই খালা একই শহরে থাকে।বেশ কয়দিন যাবত বলে উনি আমাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছিলেন।কিন্তু সময় হয়ে উঠেনি এতোদিন।তবে আজ সে কাঙ্ক্ষিত সময়টা এসেছে।

তুহিন মামাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য আমি ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হলাম।এর কারন দুটো।এক.মিষ্টি আপুর সাথে দেখা করা।দুই.আদ্রিশ ভাইয়ার থেকে দূরে যাওয়া।দুই নাম্বার কারনটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় এবং খুশির।কারন আমার মনে যা চলছে তা থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আদ্রিশ ভাইয়ার থেকে দূরে থাকা।এ মূহুর্তে উনার থেকে দূরে থাকার এর চেয়ে বড় সুযোগ আর দ্বিতীয়টা পাবো বলে মনে হলো না আমার।

বড় মামির কাছে ঐ বাড়িতে যাওয়ার নিউজ শোনার পর পরই আমি রুমে এসে খুশি মনে ব্যাগ গুছাতে লাগলাম।নদীর আজ প্রাইভেট বন্ধ বলে সে আমাকে ব্যাগ গুছাতে সাহায্য করলো।তবে খুশি মনে না,দুঃখী মনে।কারন সে আমাকে খুব মিস করবে বলে।অবশ্য সে মিস করার কোনো সুযোগ দিতে চেয়েছিলো না নিজেকে।কারন সেও আমার সাথে তুহিন মামাদের বাড়ি যেতে চেয়েছিলো।কিন্তু ছোট মামি মানা করে দেয়।মামি চায় না নদীর প্রাইভেট মিস যাক।ঐ বাড়িতে যাওয়া মানে যে সপ্তাহ খানেকের জন্য পড়াশোনা লাঠে তোলা তা ছোট মামি বেশ ভালো করেই জানে।

ব্যাগ গুছানোর এক পর্যায়ে বড় মামি নদীর রুমে এসে আমাকে বললো,
“এই বড় ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই।আমি ছোট একটা ব্যাগ দিচ্ছি সেখানে কাপড়চোপড় নিয়ে যাও।”

বড় মামির কথায় খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“কেনো মামি?আমি তো ঐ বাড়ি থেকেই একেবারে বাসায় চলে যাবো।তাহলে ব্যাগ রেখে যাবো কেনো।”

বড় মামি আমার কথা শুনে শাসন করে বললো,
“মোটেও না।ঐ বাড়ি থেকে আবারো এখানে আসবে।কয়েকদিন থেকে তারপর বাসায় যাবে। এজন্য ছোট ব্যাগে কাপড়চোপড় নিয়ে যাও।আমি নিয়ে এসেছি।”
এই বলে মামি আমার সামনে ছোট সাইজের একটা ট্রাভেলিং ব্যাগ রাখলো।নিজ দায়িত্বে বড় ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় ছোট ব্যাগে রাখলো সে।
বড় মামি ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে আমিও রেডি হয়ে নিলাম।রেডি হওয়ার সময়ে আয়নার উপর দিয়ে দেখলাম নদীর উদাস মুখখানি।নদীকে দেখে আমারই ইচ্ছা করছে তাকে জোর করে তুহিন মামার সাথে নিয়ে যাই।কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়।আমাকে একাই ছুটতে হবে।

আমি রেডি হয়ে বের হয়ে আসতেই দেখি তুহিন মামা চলে এসেছেন। সবার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলছেন তিনি।আমাকে দেখেই তুহিন মামা হাসিমুখে জিজ্ঞাস করলেন,
“কেমন আছো মিম?কতদিন পর দেখলাম তোমাকে!”

তুহিন মামার প্রশ্নে আমি বিনয়ী কণ্ঠে বললাম,
“জ্বি মামা,আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?”

“এই তো আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
মিষ্টি বেশ কয়দিন ধরে আমাকে বলেই যাচ্ছে তোমাকে যেন বাড়িতে নিয়ে যাই।যেদিন শুনেছে তুমি মেজ খালার বাড়ি সেদিন থেকেই সে বলে যাচ্ছে আমাকে।ওদিকে আমার সময় হয়না বলে তোমাকে নিয়ে যেতে পারছিলাম না।আজ সে সময় হলো।এবার পুরো দুই তিন সপ্তাহের জন্য আমাদের বাড়িতে থাকবে তুমি। ”

তুহিন মামার কথায় আমি চোখজোড়া বড় বড় করে অবাক কণ্ঠে বললাম,
“না,মামা।অতোদিন থাকবো না।বাসায়ও ফিরতে হবে তো।অনেকদিনই তো ছুটি কাটালাম।দুই বাড়িতে সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ থাকবো। তারপরেই বাসায় চলে যাবো।”

“আচ্ছা,এসব পরে দেখা যাবে।আগে আমাদের বাড়ি চলো তো….”
এই বলে তুহিন মামা বড় মামির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আচ্ছা,ভাবী।আসি তাহলে।ভাইয়ের সাথে তো দেখা হলো না।পরে একদিন দেখা করে নিবো।আজ আর সময়ও নেই।মিমকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই দোকানে যেতে হবে।এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।”

বড় মামি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ভেবেছিলাম মেয়েটাকে অনেকদিন আমার কাছেই রেখে দিবো।কিন্তু আপনি আর তা হতে দিলেন কোথায়।”

“আমি না ভাবী।আমার মেয়েটা।অবশ্য আমিও চেয়েছিলাম মিমকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে।সে সুযোগটাও এসে গেলো।”

“এতোদিন পর আসলেন এ বাড়িতে।একটু ভালোমন্দ খাবার খেয়ে যাবেন, তা না।দৌড়ের উপর এসে মেয়েটাকে নিয়ে আবার দৌড়ের উপর চলে যাচ্ছেন। ”

“কি আর করার…আচ্ছা,ছোট ভাবীকে দেখছি না যে?”

“ওর জ্বর এসেছে।সেরে গিয়েছিলো গতকাল।আবারো আজ ভোর থেকে জ্বর এসেছে বলে। ”

“ওহ আচ্ছা।তো আসি ভাবী।” এই বলে তুহিন মামা আমাকে তার আগে আগে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।তার নির্দেশ অনুযায়ী হাঁটা ধরতেই মনে পরলো বাড়ির সবার থেকে বিদায় নেওয়া উচিত।তাই তুহিন মামাকে বলে আমি সবার থেকে বিদায় নিতে চলে গেলাম।প্রথমে মেজ নানু,তারপর ছোট মামি,তারপর পলাশ ভাইয়া আর রাইসা ভাবী এবং সবশেষে নদীর থেকে বিদায় নিলাম।নদী তো চোখেমুখে উদাসীন এক ভাব নিয়ে বসে আছে।আমাকে সে ঠিকমতো বিদায়ও দিলো না।দেখাতে চাইছে,আমার উপর সে অভিমান করে বসে আছে।কেনো আমি ছোট মামিকে জোর দিয়ে বললাম না।কেনো আমি তাকে ফেলে চলে যাচ্ছি।
অবশ্য আমি চাইলেও তাকে নিতে পারতাম না।যেখানে ছোট মামি মানা করেছে সেখানে দুইদিনের মেহমান হয়ে নদীকে জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়া ভালো দেখায় না।

নদীর রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় অজান্তেই আমার চোখজোড়া চলে গেলো আদ্রিশ ভাইয়ার রুমের দিকে।উনার রুমের দরজা বন্ধ।সকাল থেকে উনাকে দেখিনি।হয়তো ঘুমাচ্ছেন উনি।আচ্ছা?আমাকে যদি যেতে দেখতেন তাহলে উনার অবস্থা কি হতো?
প্রশ্নটা করে আপন মনে হেসে উঠলাম আমি। কি এক বোকার মত প্রশ্নটা করলাম আমি!যেখানে আদ্রিশ গার্লফ্রেন্ড আছে সেখানে এসব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন,অনুভূতি মনের মধ্যে আসা উদ্ভট,অদ্ভুত, দৃষ্টিকটু।আসলে আমার মনটার কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই।কার উপর কি অনুভূতি আসা উচিত তা আমার এ বোকা মনটা বুঝে না।জানি না কখনো বুঝবে কি না।
আদ্রিশ ভাইয়ার রুমের দরজা থেকে চোখ সরাতেই বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।এ দীর্ঘশ্বাস ফেললাম অতি সন্তপর্ণে।

.

তুহিন মামাদের বাসায় আসার পর সবার সাথে গল্পে মেতে উঠলাম আমি।বিশেষ করে মিষ্টি আপুর সাথে সেই যে গল্প গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেছি তা আর বন্ধ করার নাম নেই।রাজ্যের যত গল্প সব দুজনের মাথায় এসে ভর করেছে যেনো।গল্প করার একপর্যায়ে মিষ্টি আপুর আম্মু এসে আমাকে আর মিষ্টি আপুকে দুপুরের খাবারের জন্য ডাক দিলো।তার কথামতো দুপুরের খাবার খেয়ে এসে আবারো গল্প করতে বসলাম আমরা।
কিছুক্ষণ পর আমি,মিষ্টি আপু,কলি,নাঈম মিলে ঘুরতে বের হলাম।কলি আর নাঈম নাসরিন খালামনির দুই ছেলেমেয়ে।তারা জমজ।বয়স আট এর কাছাকাছি।তিন চারদিন হলো তারা দুজন তাদের মামাবাড়ি অর্থাৎ তুহিন মামাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে।

আমরা সবাই মিলে এদিককার বাগানে,পুকুরপাড়ে ঘুরে এলাম।তারপর রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।কলি আর নাঈম আমার আর মিষ্টি আপুর সামনে দিয়ে হেঁটে চলছে।
টুকটাক নানা বিষয়ে গল্প করতে করতে হঠাৎ মিষ্টি আপু বললো,
“মিম, তোমাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা কথা জিজ্ঞাস করতে মন চাইছে।কিছু মনে করবে না তো?”

আমি হালকা হেসে বললাম,
“অবশ্যই না।তুমি নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাস করতে পারো মিষ্টি আপু।”

মিষ্টি আপু আমার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে ইতস্তত কণ্ঠে বললো,
“আদ্রিশ ভাইয়া কেমন আছে?”

মিষ্টি আপুর প্রশ্নে আমি একটু না অনেকটা অবাক হয়েছি।এমন অবাক হওয়ার কারনও আছে।মিষ্টি আপু এত বলেকয়ে ‘আদ্রিশ ভাইয়া কেমন আছে’ তা জিজ্ঞাস করলো কেনো তাই ভাবছি।
আমি একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
“ভালো আছে।”
এই বলে আমি মিষ্টি আপুর দিকে তাকালাম।আপু সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললো।তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে কণ্ঠে কিছুটা সন্দেহ মিশ্রিত করে জিজ্ঞাস করলাম,
“আদ্রিশ ভাইয়ার খবর এভাবে নিলে কেনো?মানে এতো ইতস্তত বোধ করলে কেনো?”

মিষ্টি আপু এবার মাথা তুলে আমাকে এক নজর দেখে নিলো।এরপর আবারো আগের মত মাথা নিচু করে বললো,
“আমি আদ্রিশ ভাইয়াকে পছন্দ করতাম এক সময়।”

মিষ্টি আপুর কথায় আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম।তবে এ অবাক হওয়ার মাত্রা আমার মনের খারাপের মাত্রা থেকে কম।
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আমি মিষ্টি আপুকে জিজ্ঞাস করলাম,
“করতে মানে?এখন করো না?”

মিষ্টি আপু অবনত মাথা নিয়েই বললো,
“না।প্রায় দুই বছর আগে পছন্দ করতাম।তবে এখন করি না।”

মিষ্টি আপুর কথায় আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম।তবে কণ্ঠে যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখে জিজ্ঞাস করলাম,
“কেনো?এখন পছন্দ করো না কেনো?”

মিষ্টি আপু এবার মাথা উঁচু করে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“আদ্রিশ ভাইয়াকে ছোট থেকেই একটু একটু পছন্দ করতাম।একই শহরে থাকার দরুন ঈদ বলো,যেকোনো অনুষ্টান বলো দুই পরিবারের আসা যাওয়া চলতো দুই বাড়িতে।এজন্য উনাকে পছন্দ করাটা স্বাভাবিক মনে হতো আমার কাছে।বছর দুয়েক আগে ঈদের দিন এ পরিবারের সবাই আদ্রিশ ভাইয়াদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো। সেদিন মনে সাহস জুগিয়ে আমার মনের কথা উনাকে বললাম।উনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলো,এসব সম্ভব নয়।উনি আমাকে ছোট থেকে বোনের চোখে দেখে।নদী আর আমি তার কাছে এক।এটা শোনার পর অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।নিজের আত্মসম্মানের উপর আঘাত দিতে চাইনি।তাই এ বিষয়ে উনার সাথে কখনও আর কথা হয়নি।নিজের মনকে বুঝিয়েও দিয়েছি এ কথা।কিন্তু আজ হঠাৎ তোমার কাছে উনার হালচাল জিজ্ঞাস করার সুযোগ পেয়ে গেলাম।সে সুযোগ কাজেও লাগালাম।তুমি কি না কি মনে করবে এজন্য জিজ্ঞাস করতেও ভয় পাচ্ছিলাম।তবুও করলাম।এখন আমার মনে উনার জন্য কিছুই নেই।শুধু উনার খবর জানতে ইচ্ছা করলো এই তো।
আমি আবারও বলছি,আমাকে খারাপ মনে করো না।”

মিষ্টি আপুর কথায় আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।এই ভেবে শান্তি লাগলো যে সে এখন আদ্রিশ ভাইয়াকে পছন্দ করে না।
আমি খানিক সময় চুপ থেকে হালকা হেসে বললাম,
“তোমাকে খারাপ ভাববো কেনো আপু।তুমি তাকে পছন্দ করতেই পারো।তার কথা জিজ্ঞাসও করতে পারো।এতে তোমাকে খারাপ ভাববার কোনো কারন চোখে পরছে না।আচ্ছা এসব বিষয়ে অনেক কথা হলো।দ্রুত বাড়িতে চলো।আজান দিয়ে দিবে আরেকটু পর।”

আমার কথায় মিষ্টি আপু কিছু না বলে মিষ্টি এক হাসি দিলো।রাস্তায় আমাদের আর কথা হলো না।একেবারে বাড়ি এসে হাতমুখ ধুয়ে মিষ্টি আপুর রুমে এসে গল্প করতে বসলাম।

.

মাত্রই সকালের খাবার খেয়ে বসার রুমে এসে বসলাম আমি।মিষ্টি আপু নিজের রুমে একটু কাজ করতে গিয়েছে।আর বাড়ির পিচ্চি দুইটা ওদিকে খেলতে গিয়েছে।

রিমোট হাতে নিয়ে পা দুটো ভাঁজ করে সোফায় বসে টিভি অন করলাম আমি।প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব চ্যানেল দেখা হয়ে গেলো।কিন্তু পছন্দের কিছু পেলাম না।অবশেষে ‘মটু পাতলু’র একটা এপিসোড দেখতে লাগলাম।অনেকদিন কার্টুন দেখি না।তাই আজ দেখলে মন্দ হয়না।

‘মটু পাতলু’র কিছু কিছু সিনে খুব হাসি পাচ্ছে।মুখ চেপে হেসে চলছি আমি।
হঠাৎ আমার সামনে কেউ এসে বললো,
“দ্রুত রেডি হয়ে নাও।এখনই বের হবো আমরা।”

ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি চোখ দুটো একটু কচলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি আদ্রিশ ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।উনার এ হঠাৎ আগমনে আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম।আর উনার কথা আমাকে থ বানিয়ে দিলো।নিজেকে সামলে নিতে একটু সময় লাগলো আমার।
আমি নিজেকে সামলো নিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“আপনি কখন এলেন?আর আমাকে এভাবে রেডি হতে বলছেন কেনো?”

আদ্রিশ ভাইয়া চোখমুখ কুঁচকে আমার দিকে একবার চেয়ে নিলেন।এরপর চুপচাপ আমার পাশে সোফায় বসে পরলেন।সাথে সাথে আমি পা নামিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“আমার উত্তরটা এখনও পায়নি।”

আদ্রিশ ভাইয়া কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন,
“আমি মাত্রই এলাম।আর তোমাকে রেডি হতে বলছি কারন তুমি এখন আমার সাথে বাড়িতে যাবে। ”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি আরেকদফা অবাক হলাম।মাথা তুলে উনার দিকে চেয়ে কণ্ঠে যথাসম্ভব বিস্ময় ভাব ফুটিয়ে তুলে বললাম,
“মাত্রই তো গতকাল এলাম।তো আজকে যাবো কেনো!এখানে কম করে হলেও তিন চারদিন থাকার প্ল্যান আছে।আজকে মাত্র একদিন হলো।”

আদ্রিশ ভাইয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আমার কথার তোয়াক্কা না করে বললেন,
“তো প্ল্যান ক্যান্সেল করো।”

“কেনো কেনো?আমি প্ল্যান ক্যান্সেল করবো কোন দুঃখে?”

“আমার দুঃখে ক্যান্সেল করবে।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম।আমতা আমতা করে বললাম,
“আপনার দুঃখে ক্যান্সেল করতে যাবো কেনো।
আচ্ছা এসব বাদ দিন।আগে।এভাবে হুট করে এসে হুট করে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।আজকে আমার আর মিষ্টি আপুর ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে।সেসব নষ্ট করতে যাবো কেনো…”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হুট করে আমার দিকে একটু এগিয়ে এলেন।ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
“কেউ যে তোমাকে মিস করছে সেটা জানো না?কারোর যে এ নিয়ে মন খারাপ সেটা জানো না?”

আমি এবার ভড়কে গেলাম।তাহলে কি আদ্রিশ ভাইয়া আমাকে মিস করছে? উঁহু, এ হতে যাবে কেনো।আমাকে মিস করার কোনো কারনই নেই উনার কাছে।নিশ্চয়ই নদী মিস করছে আমাকে।আমি স্বাভাবিকভাবেই বললাম,
“কে মিস করছে আমাকে?”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন।পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এটা তো জানার কথা তোমার।
নদী মিস করছে তোমাকে।সাথে আম্মু আর ভাবীও।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় শান্তি পেলাম।মনের মধ্যে থাকা একটুখানি সন্দেহ নিমিষেই দূর হয়ে গেলো।উনার কথায় আমি এক মূহুর্তের জন্য ভেবেই নিয়েছিলাম যে উনি নিজের কথা বলছে।তবে বেয়াদব মনকে বাস্তবতার রাস্তা দেখিয়ে নিজেকে শুধরে নিলাম আমি।
আমি আরো কিছু বলতে চাইলাম তবে মিষ্টি আপুর আম্মুর জন্য তা হলো না।সে রুমে এসে আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।এখানে এভাবে হুট করে আসার কারন জিজ্ঞাস করতেই আদ্রিশ ভাইয়া বললেন,
“নদী খুব জোর করছিলো বলেই ওকে নিতে আসলাম।তার সাথে আবার আম্মুও সায় দিলো।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় মামির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া তাকে এমন বোঝানো বোঝালেন যে শেষমেশ তিনি আমাকে আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে রাজি হলেন।অগত্যা না চাইতেও আমাকে গিয়ো রেডি হতে হলো।হাজারো অনিচ্ছা নিয়ে রেডি হয়ে গেলাম আমি।প্রথম প্রথম মিষ্টি আপু আমাকে এখানে থেকে যাওয়ার জন্য বললেও পরে মামির কথায় রাজি হলো।এতে অবশ্য তার মনটাও খারাপ হলো।কিন্তু কিছু করার নেই।

তিন/চারদিনের সফরে এসে একদিন সফর করে অবশেষে বাড়ির পথে রওনা হলাম আমি।আজকে আদ্রিশ ভাইয়া আর বাইক আনেননি,অটো নিয়ে এসেছেন।এ দেখে বেশ খুশিই হলাম আমি। অবশ্য অটোতে বসার পর সে খুশি বেশিক্ষণ মনে টিকলো না।কারন যে কারনে ঐ বাড়ি থেকে এ বাড়িতে এসে আনন্দ পাচ্ছিলাম সে কারনের সাথে আবারো মুখোমুখি হতে হবে আমার।যে আদ্রিশ ভাইয়ার থেকে দূরে দূরে থাকার প্ল্যানিং এ আছি সেই আদ্রিশ ভাইয়ার সামনাসামনি আবারো পরতে হবে আমার।এসব ভেবেই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে এলো আমার।

বাড়িতে পৌঁছেই সবাই আমাকে দেখে খুব খুশি হলো।বিশেষ করে নদী।তার চোখেমুখে উপচে পরা খুশি দেখেই বুঝে ফেললাম আদ্রিশ ভাইয়া ঠিকই বলেছিলো।
বাড়ির সবার হাসিখুশি চেহারা দেখে আমার বিরক্তি ভাবটা নিমিষেই কেটে গেলো। মন ছেয়ে গেলো একরাশ আনন্দে।

.

রাত প্রায় দশটা বাজে।আমি আর নদী খাওয়াদাওয়া করে এসে মাত্রই রুমে ঢুকলাম। অমনিই বিদ্যুৎ চলে গেলো।প্রচণ্ড বিরক্ত আর রাগে পুরো শরীর রিরি করতে লাগলো।বিদ্যুৎ চলে যাওয়া নদী নিজের ফোন নিয়ে চেয়ারে বসলো আর আমি নিজের ফোন নিয়ে দক্ষিণের জানালাটা খুলে বসলাম।হালকা শীতল স্নিগ্ধ হাওয়া আসা যাওয়া করছে জানালা দিয়ে।কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে সে হাওয়া উপভোগ করে ফোনটা হাতে নিলাম।ফোন হাতে নিতেই নিরাশ হতে হলো।কারন ফোনের চার্জ মাত্র দশ পার্সেন্ট।কম চার্জ দেখে ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে পাশে রাখলাম।

দু হাঁটু ভাঁজ করে তার উপর থুতনি রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে জ্যোৎস্নাবিলাস করতে লাগলাম।
হঠাৎ গিটারের টুংটাং শব্দ কানে ভেসে এলো আমার।কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সে শব্দের পাশাপাশি কানে ভেসে এলো অতি পরিচিত এক কণ্ঠস্বর। আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠস্বর।গিটারের তারের দোলায় নিজের গলা মিলিয়ে গান গাইছেন তিনি।

“রাত নির্ঘুম বসে আছ তুমি
দক্ষিনের জানালা খুলে
যত নির্বাক অভিমান মনে
আজ সবটুকু নিলাম তুলে
এসো তবে বৃষ্টি নামাই
সৃষ্টিছাড়া ভালোবাসায়
এসো তবে জোছনা সাজাই
দু’চোখের তারায় তারায়
রাত নির্ঘুম বসে আছ তুমি
দক্ষিনের জানালা খুলে
যত নির্বাক অভিমান মনে
আজ সবটুকু নিলাম তুলে…….”

পুরো গানটা একপ্রকার ঘোরের মধ্যে শুনলাম আমি।প্রচণ্ড ভালো লাগলো।মনে হচ্ছিলো গানটা আমার জন্যই গাওয়া যেন।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া আমার জন্য গান গাইবেন না।গান গাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা।
আমার মনটা এ বিষয়ে জানে তবুও খানিক সময়ের জন্য এমনটা মনে হয়েছিলো আমার।কিন্তু গান শেষ হতেই আমার সে ভুল ভাঙলো।ওদিক থেকে অস্পষ্ট আওয়াজে এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো আমার।এ শুনে নিজের মনের উদ্দেশ্যে তাচ্ছিল্যের এক হাসি দিয়ে বললাম,
“এসব অবাস্তব আর ভিত্তিহীন আবেগ,ভালোলাগা কোনো কাজের না।এসব শুধু কষ্ট দিতে জানে।আর যার উদ্দেশ্যে এতো কিছু সেই তো অন্যকারোর।তো শুধু শুধু অন্য কারোর আপন মানুষের জন্য এসব অনুভূতি জেগে উঠা আর প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়।আমি কখনও তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হতে চাই না।চাই না আমার মনের অনুভূতিগুলো তৃতীয় হয়ে উঠুক। চাই না নিজের অনুভূতিকে নিজের সামনে ছোট করতে।চাই না আমার আত্মসম্মানের উপর আঘাত হানতে।চাই শুধু এসব আবেগ অনুভূতি থেকে বাঁচতে।যা ভিত্তিহীন। ”

®সারা মেহেক

#চলবে

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৬

সকালের খাবার শেষ করে আমি রুমে নদীর রুমে এসে বসলাম।নদী আমার সাথে রুমে আসেনি। সে গিয়েছে উঠোনে।

কিছুক্ষণের মাঝেই বড় উঠোন থেকে হইচই শুনতে পেলাম।প্রথম প্রথম বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম হইচই শুনে।তবে পরমূহুর্তেই কান খাড়া করে ভালোভাবে সে হইচই এর প্রতিটা শব্দ শোনার চেষ্টা করলাম।শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম বড় উঠোনে কিছু বাচ্চারা চেঁচামেচি করছে।তাদের চেঁচামেচির কারনটা বুঝতে পারলাম না।শুধু আদ্রিশ ভাইয়া আর পলাশ ভাইয়ার নাম শুনতে পেলাম তাদের মুখে।কিছুই বুঝতে না পেরে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম উঠোনে গিয়ে দেখবো কি ঘটছে সেখানে।

আমি বিছানা থেকে নেমে মাত্রই ফ্লোরে পা দিলাম।অমনিই নদী আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো।আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজের হাতে টান অনুভব করলাম।
নদী আমার হাত ধরে বসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।তার এহেন কাজের আগামাথা কিছুই না বুঝতে পেরে তাকে জিজ্ঞাস করলাম,
“এভাবে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো নদী?”

নদী আমার দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
“আজকে বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া ক্রিকেট ম্যাচ খেলবে।তাও একে অপরের বিপক্ষে।এজন্য তোমাকে নিতে এলাম।চলো একসাথে ম্যাচ ইঞ্জয় করবো।”

নদীর কথা শুনে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত তা আমার মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে পারলো না।ফলস্বরূপ প্রতিক্রিয়াহীন চেহারায় আমি নদীর দিকে তাকিয়ে রইলাম।নদীর এতে কোনো ভাবান্তর হলো না।সে রাইসা ভাবীর রুমে এসে আমার হাত ছেড়ে বলল,
“চলো,ভাবীকেও নিয়ে যাই।বরের ম্যাচ দেখবে বসে বসে।”

আমি হাসিমুখে বললাম,
“হুম চলো।বসে বসে বোরিং হওয়ার চেয়ে ওখানে বসে ম্যাচ ইঞ্জয় করা ভালো। ”

আমি আর নদী রাইসা ভাবীর রুমে এসে দেখলাম ভাবী খুব গভীর মনযোগে কাঁথা সেলাই করছে।কাঁথার আকার দেখে বুঝলাম কাঁথাটা নিজের অনাগত সন্তানের জন্য বানাচ্ছে সে।
আমাদের দুজনকে দেখে রাইসা ভাবী মুখ তুলে জিজ্ঞাস করলো,
“কি ব্যাপার?আজ দুজন একসাথে আমার রুমে?কোনো কাজ?”

নদী রাইসা ভাবীর কথায় হালকা হেসে বললো,
“বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া একে অপরের বিপক্ষে ক্রিকেট ম্যাচ খেলবে।ম্যাচের দর্শক হিসেবে তোমাকে নিয়ে যেতে বললো বড় ভাইয়া।”
এই বলে নদী রাইসা ভাবীর হাত থেকে কাঁথাটা সরিয়ে নিয়ে তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো।ওদিকে আমি পাশের টেবিলে রাখা তালপাতার পাখাটা নিয়ে এলাম।নদী রাইসা ভাবীকে ধরে নিয়ে হেঁটে চলছে আর আমি তাদের পিছু পিছু পাখা হাতে নিয়ে হেঁটে চলছি।

উঠোনে এসে চারপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে আমার চোখজোড়া বড় হয়ে এলো।বড় উঠোনের খালি জায়গাটুকুতে প্রায় চার পাঁচজন ছোট ছোট ছেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সবার বয়স নিশ্চয়ই পনেরো ষোল এর মধ্যে।
বাড়ির সামনের খালি জায়গায় অর্থাৎ বাড়ির ডান দিকটায় আদ্রিশ ভাইয়া আর পলাশ ভাইয়া দূরত্ব বজায় রেখে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন।আদ্রিশ ভাইয়ার হাতে ক্রিকেট বল আর পলাশ ভাইয়ার হাতে ক্রিকেট ব্যাট।পলাশ ভাইয়া যেদিকে দাঁড়িয়ে আছেন তার পিছনে ছোট সাইজের তিনটা বাঁশ পরপর গেঁড়ে দেওয়া। সেই বাঁশের পিছনেই উইকেট কিপার হিসেবে একটা ছেলে বসে আছে।

পলাশ ভাইয়া আমাকে,রাইসা ভাবী আর নদীকে দেখে বললেন,
“তোমাদেরই অপেক্ষা করছিলাম।নদী,তুই রাইসাকে সিঁড়ির উপর ভালোভাবে বসিয়ে দে।আর পাশে তুই বস।ওকে বাতাস করার জন্য পাখা এনেছিস তো?”

নদী রাইসা ভাবীকে বসিয়ে দিতে দিতে বলল,
“হুম,মিম আপু এনেছে।”

পলাশ ভাইয়া আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে আবারো আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
“কে কার টিমে?”

পলাশ ভাইয়ার কথা শোনামাত্রই নদী উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
“আমি তোমাদের দুজনের টিমেই।”

“এটা হবে না।যেকোনো একজনকে সিলেক্ট করতে হবে।”

এ কথা শুনে নদীর চোখেমুখের সেই হাসি ভাবটা উড়ে গেলো।মূর্ছা যাওয়া কণ্ঠে সে বললো,
“এটা একদমই ঠিক না।তোমাদের দুজনের মধ্যে এবার কাকে সিলেক্ট করবো আমি!”

পলাশ ভাইয়া ঠোঁট উল্টে বললেন,
“যাকে ইচ্ছা।তবে যেকোনো একজনকে সিলেক্ট করতে হবে।”

নদী পরলো মহা বিপাকে। তবুও বেশ চিন্তা ভাবনা করে সে বললো,
“আমি ছোট ভাইয়ার টিমে।তোমার টিমে রাইসা ভাবী আছে।তাই আমি ছোট ভাইয়ার পক্ষ নিলাম।”

পলাশ ভাইয়া হালকা হেসে রাইসা ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“রাইসার আর বলার দরকার নেই।আমি জানি ও কার টিমে।এবার মিম বলো কার টিমে তুমি।”

পলাশ ভাইয়ার হঠাৎ প্রশ্নে খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম আমি।আমি ভাবিনি আমাকেও এভাবে সিলেক্ট করতে বলবে।কিন্তু এখন বলে দিয়েছে পলাশ ভাইয়া। তাই টিম তো একটা সিলেক্ট করতেই হবে।বেশ কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে আমি পলাশ ভাইয়ার পক্ষে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আদ্রিশ ভাইয়ার পক্ষে যাওয়া সত্যিই আমার জন্য সম্ভব নয়।উনার পক্ষে থাকা মানে আমার বেয়াদব মনকে প্রশ্রয় দেওয়া।উনার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা।যেটা আমি মোটেও চাইনা।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আমি বললাম,
“আমি আপনার টিমে পলাশ ভাইয়া।”

আমার কথায় পলাশ ভাইয়া তো বেশ খুশি হলেন। কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া খুশি হলেন না মনে হলো।যদিও এটা আমি আন্দাজের উপর বললাম।কারন উনার চেহারার হাবভাব দেখে উনার প্রতিক্রিয়া ঠিক বুঝতে পারলাম না।

পলাশ ভাইয়া নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পরতেই আদ্রিশ ভাইয়াও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পরলেন।
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাচ্চাদের মধ্যে একজন নিজের কাছে থাকা একটা বাঁশিতে ফুঁ দিতেই সবাই নিজ নিজ অবস্থানে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো।
কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই আদ্রিশ ভাইয়া পলাশ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বল ছুঁড়ে মারলেন।পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা পলাশ ভাইয়া তার হাতে থাকা ব্যাটকে ঘুড়িয়ে বল পাঠিয়ে দিলেন বাম দিকটায়।চারপাশে আগে থেকেই হয়তো বাউন্ডারি করে রাখা হয়েছিলো। বল সে বাউন্ডারি পার করার আগেই একটা ছেলে এসে তা ধরে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে পাস করলো।ততক্ষণে পলাশ ভাইয়ার এক রান নেওয়া হয়ে গিয়েছে
পলাশ ভাইয়া আবারো নিজের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পরতেই আদ্রিশ ভাইয়া আবারো বল ছুঁড়লেন।এবারের বলে পলাশ ভাইয়া এক ছক্কা মারলেন।সাথে সাথেই আমি আর রাইসা ভাবী ‘ছক্কা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।দুজনের চোখেমুখেই হাসিখুশি ভাব।নদীর চোখেমুখেও এমন ভাব।তবে সে ‘ছক্কা’ বলে চেঁচিয়ে উঠেনি।কারন সে আদ্রিশ ভাইয়া টিমে।
পলাশ ভাইয়া আবারো নিজের জায়গা নিতেই আমি খেয়াল করলাম আমাদের পিছে মেজ নানু,বড় মামি আর ছোট মামি এসে দাঁড়িয়েছে।কখন দাঁড়িয়েছে তা বুঝতে পারিনি।তাদের উপর চোখ সরিয়ে আমি নদীকে জিজ্ঞাস করলাম,
“কয় ওভার খেলা হবে?আর এই বাচ্চারা কার টিমে?”

গভীর মনযোগী নদী সামনের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো,
“দুই ওভাব মাত্র।আর বাচ্চারা দুজনের টিমেই।যখন যে খেলবে তারা তার টিমে।”

আমি আর কিছু না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে লাগলাম।

দুই ওভাব খেলা শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগলো না।পলাশ ভাইয়া মোট চল্লিশ রান করেছেন।এর মধ্যে তিনটা ছয় আর চারটা চার মেরেছেন তিনি।মাঝে বেশ কয়বার উনাকে আউট করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো আদ্রিশ ভাইয়া।কিন্তু পারেননি।এতে অবশ্য আমি বেশ খুশিই হয়েছি।

পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে পলাশ ভাইয়া এবার বল ধরলেন।আর আদ্রিশ ভাইয়া ব্যাট ধরলেন।এদিকে পলাশ ভাইয়া হাতে বল ঘুরাচ্ছেন।ওদিকে আদ্রিশ ভাইয়া ব্যাটটা দিয়ে মাটিতে হালকা হালকা বারি দিচ্ছেন।প্রচণ্ড রোদে চোখমুখ কুঁচকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন উনি।উনার দিকে তাকিয়ে একটু লক্ষ্য করে দেখলাম উনি আমাদের সবার দিকে নয় বরং আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণটা আমি ঠিক ধরতে পারলাম না।
বাচ্চাদের মধ্যে একজন রেডি বলতেই আদ্রিশ ভাইয়া হাত উঁচু করে পলাশ ভাইয়াকে বল পাস করতে নিষেধ করে বললেন,
“দাঁড়াও ভাইয়া।আমার শার্টের হাতা ফোল্ড করে নেই।আগেও করেছিলাম, কিন্তু নেমে এসেছে।”
এই বলে তিনি আমার দিক থেকে নজর সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ব্যাটটা পিছনের বাঁশে হেলান দিয়ে রাখে আবারো আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে পরনের শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে লাগলেন।প্রথমে বাম পাশের হাতা এরপর ডান পাশের হাতা গুটিয়ে নিয়ে কনুইয়ের উপরে রাখলেন।
প্রচণ্ড গরমে ঘামের কারনে আদ্রিশ ভাইয়ার পরনের সাদা শার্টটা উনার শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।চোখেমুখে পরে আছে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা।মাথার সামনের গুটিকয়েক চুল ঘামে ভিজে কপালের সাথে লেপ্টে আছে।সবদিয়ে উনাকে অন্যান্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই ভালো লাগছে এখন।শার্টের হাতা গুটানোর সে ধরণ দেখে আমি আরেকবার উনার উপর ফিদা হয়ে গেলাম। এর আগে ফোন হাতে নিয়ে উনার দাঁড়ানোর ধরণ দেখে ফিদা হয়েছিলাম আর আজকে হাতা গুটানোর এ ধরণ দেখে ফিদা হলাম।মনে মনে স্বগোতক্তি করলাম আমি,’কি মারাত্মক লাগছে উনাকে দেখতে!’ এই বলার পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম আমি।বেশ কয়েকটা গালিও দিয়ে ফেললাম নিজেকে।উনাকে আরেকদফা এভাবে পছন্দ করার কোনো মানে হয়না।এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উনার স্টাইল দেখার কোনো মানে হয়না।এসব ভিত্তিহীন।

চোখ বন্ধ করে লম্বা কয়েকটা শ্বাস টেনে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে খেলা দেখতে মনযোগী হলাম আমি।এতক্ষণে আদ্রিশ ভাইয়ার এক রান নেওয়া হয়ে গিয়েছে।আমি চোখ মেলে তাকাতেই উনি বল এ দ্বিতীয়বার আঘাত করলেন।
আদ্রিশ ভাইয়ার টার্গেট একচল্লিশ রান।ইতোমধ্যে আটত্রিশ রান নেওয়া হয়ে গিয়েছে উনার।শেষ তিনরান আছে।অথচ বল আছে একটা।এই এক বলেই তিনরান নিতে হবে উনাকে।এই শেষ বলে এসে একরা চার মারলেই উনি জিতে যাবেন।টান টান উত্তেজনাপূর্ণ এক মূহুর্ত বিরাজ করছে।উপস্থিত সবার অবস্থা কি জানি না।কিন্তু আমার অবস্থা কি তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি আমি।এ অবস্থায় আমার বুকের ধুকপুকানি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।বারবার আমার মন চাইছে আদ্রিশ ভাইয়া জিতুক।অথচ আমি পলাশ ভাইয়ার টিমে।
আমার বেয়াদব মনটা যে কি পরিমানে চাইছে আদ্রিশ ভাইয়া জিতুক তা আমার মস্তিষ্ক বুঝেই উঠতে পারছে না।

আমার মনের এ ধুকপুকানি আওয়াজের অন্ত ঘটলো শেষ বল এ এসে।যখন আদ্রিশ ভাইয়া ব্যাট ঘুরিয়ে ছক্কা মারলেন।
চারপাশ থেকে বাচ্চারা এসে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন।পলাশ ভাইয়াও হাসিমুখে এসে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন।আর আমি খুশির স্রোতে জোরে জোরে হাত তালি দিয়ে নিজের মনের খুশির বহিঃপ্রকাশ করলাম।কিন্তু পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম আমি। মনে পরলো আমি আদ্রিশ ভাইয়ার টিমে না,পলাশ ভাইয়ার টিমে।সে হিসেবে আমার এখন মন খারাপ হওয়ার কথা।অথচ আমি খুশি হলাম। রাইসা ভাবী আর নদীর অবাক চাহনি দেখে আমার বুঝতে সময় লাগলো না যে ভুল জায়গায় ভুল প্রতিক্রিয়া দেখানোটা এই দুইজন দেখে ফেলেছে।তবে ভাগ্য ভালো আদ্রিশ ভাইয়ার চোখে এ ব্যাপারটা ধরা পরেনি।

বেসামাল এ পরিস্থিতিকে সামাল দিতে আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম,
“আরে পলাশ ভাইয়া নিজের হারেও কত খুশি তা দেখেই আমি খুশি হলাম।মানে আরকি আমি খুশি হলাম এই ভেবে যে ভাইয়ের জিতেই নিজের জিত ধরে নিয়েছে পলাশ ভাইয়া।”
কথাগুলো বলতে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে।কারন ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মস্তিষ্ক শব্দগুচ্ছ ঠিকভাবে সাজিয়ে নিতে পারলো না।ফলস্বরূপ সন্দেহজনক হাবভাবে আমি কথাগুলো বলে ফেললাম।
আমার কথা মানতে যে রাইসা ভাবী আর নদীর মনে চাইলো না তা তাদের ঠোঁট চেপে হাসি দেওয়া দেখেই বুঝতে পারলাম আমি।

পলাশ ভাইয়ার অফিস থেকে ফোন আাসায় উনি দ্রুত রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে পরলেন।রাইসা ভাবীসহ বাকি সকলে নিজ নিজ রুমে চলে গেলেন।তবে নদী আমার সাথে সেখানেই বসে রইলো।
বিদ্যুৎ নেই বলে আমি রুমে না গিয়ে এখানেই বসে আছি।চারপাশে থেকে থেকে বয়ে চলা মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়ায় নিজেকে শীতল করতে ব্যস্ত আমি।আমার সাথে ব্যস্ত নদীও।তবে হাওয়া উপভোগ করার সাথে গল্প করতেও ব্যস্ত আমরা।

হঠাৎ আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠস্বর কানে এলো আমার।
“সবুজ,যেহেতু পলাশ ভাইয়া হেরে গিয়েছে সেহেতু আমরা যা বলবো তাই উনাকে মানতে হবে।ঠিক তো?”

হয়তো সবুজ নামের ছেলেটাই জবাব দিলো,
“জ্বি ভাইজান।”

“তো….যেহেতু পলাশ ভাইয়া নেই সেহেতু উনার ভাগের কাজটুকু করতে হবে উনার পক্ষ নেওয়া মানুষদের।ঠিক তো?”

“জ্বি ভাইজান। ”

এ কথা আমার কানে যেতেই আমি চকিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকালাম। নজরে এলো আদ্রিশ ভাইয়ার ঠোঁট বাঁকানো এক হাসি।উনার এ হাসি আমাকে সব বুঝিয়ে দিলো।এখন যে আমাকে বলি বানানো হবে তা বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারলাম ।কিন্তু উনি করবেন কি তা বুঝতে পারছি না।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাতে থাকা বল ঘুরাতে ঘুরাতে বাঁকা হেসে বললেন,
“রাইসা ভাবী কাজটা করার মতো পরিস্থিতিতে নেই।সুতরাং আমার দেওয়া কাজটা করতে হবে উনার পক্ষ নেওয়া অপর মানুষকে।ঠিক তো নদী?”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে নদী খুশিতে হাত তালি দিয়ে বললো,
“ইয়েস ছোট ভাইয়া।আর সে অপর মানুষটা হলো মিম আপু।রাইট?”

আদ্রিশ ভাইয়া মাথা উপর নিচ করে হালকা হেসে বললেন,
“রাইট।
তো আমি ভেবেছি যে সেই অপর মানুষটাকে খুব সহজ এক কাজ দিবো।”

নদী উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলো,
“কি ছোট ভাইয়া?”

আদ্রিশ ভাইয়া আগের মতোই দু হাত দিয়ে বল ঘুরিয়ে নিতে নিতে বললেন,
“বেশি কিছু না।যাস্ট এক ওভার ম্যাচ খেলতে হবে আমার সাথে।ব্যস।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমার মুখ রক্তশূণ্য হয়ে এলো যেন।উনি যে এতো ভয়ানক একটা কাজ করতে বলবে তা কখনও ভাবিনি আমি।
ক্রিকেট খেলা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।কারন আমি ক্রিকেট খেলতেই পারি না।ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো ঠিকই।কিন্তু একটা বলও ব্যাটে ছোঁয়াতে পারবো না আমি।এমন পরিস্থিতিতে এতোগুলো পিচ্চিবাচ্চার সামনে ক্রিকেট খেলা মানে নিজের ইজ্জত সম্মান নিজ হাতে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া।কিন্তু এদের সামনে সোজাসুজি মানাও করা যাবে না।এমনটা করাও আবার আরেক ইজ্জত খোয়ানো বিষয়।এ যেন উভয় সংকটে পরলাম আমি।

কিছুক্ষণ এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম,
“এই গরমে খেলা সম্ভব নয়।প্রচণ্ড গরম পরছে।একটুও হাওয়া-বাতাস বইছে না।আমার পক্ষে খেলা সম্ভব নয়।”

এই বলেই আমি ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরলাম।হঠাৎ করেই চারপাশে হাওয়া বয়ে যাওয়া শুরু করলো।আমার ইজ্জত সম্মান আজ মাটিতে মেশানোর জন্যই হয়তো মৃদুমন্দ এ হাওয়ার আগমন।
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে এলো আমার।একমাত্র ঠিকঠাক বাহানও এখন বেঠিক হয়ে গেলো।আর কি কোনো বাহানা আছে?

ওদিকে আদ্রিশ ভাইয়া বললেন,
“এখন তো ইজিলি ম্যাচ খেলতে পারবে।তোমার একমাত্র কমপ্লেইনও সঠিক হলোনা। ”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে রাগে উনার মাথার চুল ছিঁড়তে মন চাইলো আমার।দুনিয়ায় আর কোনো কাজ পায়না নাকি!আমি যেসব কাজ করতে পারবো না,কোনোদিন করিনি এমন সব কাজই উনি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।অসহ্যকর লোক একটা।
সবার দৃষ্টির অগোচরে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললাম,
“হাওয়া-বাতাস বইছে ঠিকই। কিন্তু কি পরিমানে রোদ পরেছে দেখেছেন?”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার হাতে থাকা বলটা সবুজের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।নদীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভ্রুজোড়া নাচিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভয় পাচ্ছো নাকি আমার সাথে ম্যাচটা খেলতে?এ ভয়ে আছো যে আমি তোমাকে হারিয়ে দিবো?

এ শুনে আমি দাঁত চেপে মনে মনে বললাম,
” ম্যাচ হেরে যাওয়ার ভয়ে না।ইজ্জত সম্মান হারানোর ভয়ে খেলতে মন চাইছে না।কিন্তু এটা আপনার মতো ত্যাড়া লোককে বুঝাবে কে।”
মনের কথা মনেই রয়ে গেলো।উল্টো চোখেমুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম,
“আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না।এই গরমে আমার খেলতে মন চাইছে না তাই খেলবো না। ”

আদ্রিশ ভাইয়া বললেন,
“গরমের ভয়ে না। হেরে যাওয়ার ভয়ে খেলছো না।এটা ভনিতা না করে সরাসরি স্বীকার করলেই তো হয়।”

“আমি বললাম তো আমার খেলতে ইচ্ছা করছে না।”

“স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুমি ভয় পাচ্ছো। আস্ত ভিতুর লক্ষণ এসব তাই না মনির?”

আদ্রিশ ভাইয়ার পিছন থেকে মনির নামের ছেলেটা বলে উঠলো,
“ঠিক বলছেন ভাই। আপু যে ভয় পাচ্ছে তা আমরা সবাই বুঝতে পারছি।” এই বলে ছেলেটি মুখের হাত দিয়ে লুকিয়ে হাসতে লাগলো।এদিকে আমার অবস্থা এমন যে এখনই সবার উপর আগ্নেয়গিরির অগ্নি বর্ষণ করতে পারলে খুশি হতাম।

আমি কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই নদী উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপু,যাই করো না কেনো,খেলতে তো তোমাকে হবেই।না খেললে এতোগুলো পিচ্চিবাচ্চার সামনে তোমার মানসম্মানের কি হবে ভেবেছো?সবাই তোমাকে ভিতু ভাবছে।সুযোগ পেলো এ নিয়ে তোমাকে ক্ষ্যাপাতেও পারে।সো,ছোট ভাইয়ার সাথে ম্যাচটা খেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তোমার কাছে।”

আমি অসহায় দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছি।নিজেকে এ মূহুর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় এক মানুষ বলে মনে হচ্ছে।এদিকে খেলতে পারি না আবার ওদিকে না খেলেও উপায় নেই।শেষমেশ বেশ চিন্তাভাবনা করে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“এই গরমে আমার কিছু হয়ে গেলে এর সম্পূর্ণ দায়ভার আপনাকে নিতে হবে।”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া এক গাল হেসে ফেললেন।আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে রাজাদের কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে ঝুঁকে নিজের ডান হাত আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আপনার সবকিছুর দায়ভার আমি নিতে রাজি ম্যাডাম।শুধু আপনার হাত আমার হাতে রাখলেই হবে।”

এ শুনে আমি লজ্জায় মিয়িয়ে গেলাম।যদিও এমন লজ্জা পাওয়া উচিত নয়।তবুও লজ্জা পেলাম।সেই সাথে আমার মন অসম্ভব ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো।আদ্রিশ ভাইয়ার প্রতি দিনদিন গড়ে উঠা সে ভালোলাগার দালানে আরেকটা ভালোলাগার ইট গেঁথে গেলো।এটা হলো সম্পূর্ণ আমার অনিচ্ছায়।

®সারা মেহেক

#চলবে