ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-০৩

0
1194

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

চেহারায় বিশেষজ্ঞ বিশেষজ্ঞ একটা ছাপ তার।চোখজোড়া গভীর মনযোগী।যেন যেকোনো কিছু সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণে পারদর্শী। চিকন ফ্রেমের সে জ্ঞানী টাইপ চশমার আড়াল দিয়ে চোখজোড়া চেয়ে আছে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে।কোনো কারনে চিন্তিত হয়ে যাচ্ছে চোখজোড়া। কুঁচকে আসা ভ্রুজোড়া আর কপাল দেখেই সে চিন্তার ছাপ বুঝা যাচ্ছে বেশ।
কিছুক্ষণ পর, ঠোট কামড়ে কোনকিছু ভেবে হাতঘড়ি থেকে চোখজোড়া সরিয়ে নিলেন আদ্রিশ ভাইয়া।রাইসা ভাবীর বাহু থেকে প্রেশার মাপক সে যন্ত্রটা খুলে নিলেন তিনি।ছোটবেলায় এই যন্ত্রটা দিয়ে খেলা করতাম।বেশ মজা লাগত।পাম্প দেওয়া সে ছোট্ট বেলুনটাকে ইচ্ছামত পাম্প দিতাম।ফলে সাথে থাকা স্টপওয়াচের মত যন্ত্রটার কাঁটা এদিক ওদিক ঘুরত।এই কাঁটা এদিক ওদিক ঘুরতে দেখাতেই আলাদা এক আনন্দ ছিল।ছোট চাচু ডক্টর বলে দাদুবাড়ীতে একটা স্ফিগমোম্যানোমিটার সবসময় থাকত।এখনও আছে।বাড়ী গেলে হাতের কাছে পেলে আবারো ছোট বেলার সে খেলায় মেতে উঠি।একা একাই।এ খেলার কোনো সঙ্গী প্রয়োজন হত না।
আদ্রিশ ভাইয়ার হাতে যন্ত্রটা দেখে আবারো সে পুরোনো খেলায় মেতে উঠতে মন চাইল।তবে সব ইচ্ছা যে সব জায়গায় খাটাতে নেই এই কথাটা মনেপ্রাণে মেনে নিয়ে আমি আমার ইচ্ছাটাকে বিসর্জন দিলাম।ফলস্বরুপ এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।

“হাই ব্লাড প্রেশার।কিসের এত টেনশন তোমার ভাবী?”

আদ্রিশ ভাইয়া স্টেথোস্কোপটা কান থেকে খুলে নিতে নিতে রাইসা ভাবীর উদ্দশ্যে প্রশ্নটা করল।রাইসা ভাবী অসহায় দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মত ঠোট উল্টে বললেন,
“জানি না।কাল থেকে খুব অস্থির লাগছে।সে অস্থিরতার কারন খুঁজতেই টেনশন বাড়ছে।”

রাইসা ভাবীর বলার ধরনে আদ্রিশ ভাইয়া নিঃশব্দে হেসে দিলেন।স্টেথোস্কোপ আর স্ফিগমোম্যানোমিটারটা ব্যাগে পুরে নিয়ে বললেন,
“টেনশন হওয়াটা স্বাভাবিক।তবে বাচ্চার কথা ভেবে এই স্বাভাবিক কাজটাকেই তোমার অস্বাভাবিক করতে হবে। অর্থাৎ টেনশন বাদ দিতে হবে।ডেলিভারি ডেট তো এ মাসের লাস্টে তাইনা?”

“না।আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি এখন রেস্ট নাও ভাবী।”
এই বলে আদ্রিশ ভাইয়া রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।আর সাথে সাথে আমি রাইসা ভাবীর সামনের চেয়ারে বসে পরলাম।যেখানে এতক্ষণ আদ্রিশ ভাইয়া বসে ছিলেন।
চেয়ারে বসার সাথে সাথে আমি রাইসা ভাবীকে বললাম,
“পুরো একদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো।কালকে যে কত বোরিং সময় কেটেছে!এই নদীও তো বাসায় থাকে না।তুমিই একমাত্র ভরসা।”

রাইসা ভাবীর কিছু বলার আগেই পিছন থেকে হুট করে এসে আদ্রিশ ভাইয়া বললেন,
“এই চাশমিশ, তুমি আমার চেয়ারে বসেছো কেনো!!উঠ উঠ জলদি উঠ।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ বিস্ময়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এ যেন ছোট বাচ্চা সেধে এসে ঝগড়া শুরু করল।
অনেকক্ষণ দাঁড়ীয়ে থাকার পর মাত্রই বসলাম, আর বেয়াদব লোকটা বলে কি না এটা তার জায়গা!
এ মূহুর্তে মোটেও জায়গা ছাড়তে মন চাইলো না।কোথা থেকে যেন এক জিদ এসে ভর করল আমার উপর।আমি চেয়ারে বসে থেকেই কোনোরূপ ভাবনাচিন্তা ছাড়া চোখেমুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম,
“আমি এখানেই বসে থাকব।এক পা ও নড়ব না।আর আপনার চেয়ার এটা কে বলল আপনাকে?একবার এখানে বসেছেন বলেই এটা আপনার হয়ে গেলো?আপনার নামে কি এ জায়গা রেজিস্টার করা নাকি?”

আদ্রিশ ভাইয়া বাঁকা হেসে বললেন,
“জ্বি মিস চাশমিশ। এটা আমার নামেই রেজিস্টার করা।”

হঠাৎ করেই আদ্রিশ ভাইয়ার সম্বোধনে প্রচন্ড রাগ হলো আমার।আমি তেজি সুরে বললাম,
“এই বারবার লাগিয়েছেন কি হুম?চাশমিশ চাশমিশ।আমার একটা সুন্দর নাম আছে।আরবি হরফের নাম।সেটা না বলে আপনি বারবার চাশমিশ বলছেন কেনো আমাকে?আপনি নিজেও তো চাশমিশ। নিজে কানা আবার আমাকে কানা বলতে এসেছে হুহ।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার ভ্রু উঁচিয়ে বুকে দু হাত গুঁজে বললেন,
“জ্বি না মিস চাশমিশ।আমি অলটাইম তোমার মত চোখে চশমা লাগিয়ে ঘুরি না।শুধু কিছু কাজে চশমা পরতে হয়।অলটাইম যারা চশমা পরে তাদেরকেই চাশমিশ বলে।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমার প্রচন্ড রাগ হলো।আমি তেড়ে বসা থেকে উঠে গিয়ে বললাম,
“আর একবার যদি চাশমিশ বলেছেন তো খবর আছে।আমাকে ডাকতে হলে মিম নামে ডাকবেন,নয়ত ডাকার প্রয়োজন নেই।ওসব চাশমিশ বলে খবরদার ডাকবেন না বলে দিলাম।”

আদ্রিশ ভাইয়া ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,
“হুমকি নাকি?”

“হুমকি ভাবেন,আদেশ ভাবেন যাই ভাবেন না কেনো আমাকে আর চাশমিশ বলে ডাকবেন না। মিম বলে ডাকবেন।”

“যাও ডাকলাম না মিম বলে।”

“তো না ডাকলেন,আমার কি!আপনার ডাক শোনার জন্য কি আমি মরে যাচ্ছি নাকি?”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন,
“মিম ইজ এ টু মাচ কমন নেম।দেখা গেল তোমাকে এ নামে ডাকলাম আর আশেপাশে থাকা দশ বারোটা মিম নামক মেয়ে এসে দাঁড়ীয়ে পরলো আমার সামনে।কারন অলিতে গলিতে এ নাম এখন ছড়িয়ে পরেছে।”
এই বলে উনি অট্টহাসিতে ফেটে পরলেন।উনার এ হাসি আমার মোটেও সহ্য হলো না।চরম অপমানজনক এ হাসি।আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
“হোক টু মাচ কমন নেম।আমার ভাল লাগে এ নামটা।সো এ নাম বাদে আমাকে অন্য নামে সম্বোধন করতে আসবেন না।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার জেদি বাচ্চাদের মত বললেন,
“করব করব। হাজারবার করব।”

“করেন করেন। হাজারবার করেন।ওসবে আমি কান দিব না।”
এই বলে আমি ভেঙচি কেটে ক্লান্তির এক নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারটায় বসলাম।বাপরে!কত ঝগড়া করলাম আমি!এ কি সত্যিই আমি নাকি ঝগড়ুটে কোনো ভুত এসে ভর করেছে আমার উপর?আমি তো কখনো এতো ঝগড়া করিনি কারোর সাথে।সর্বোচ্চ আভার সাথে ঝগড়া করেছি। তাও বেশিদূর এগুতে পারেনি।কারন ঝগড়ার সময়ে সব কথা যেন ফুরিয়ে যায়।তবে আজ এত কথা পেলাম কোথায়!কোনো জড়তা বা সংকোচবোধও কাজ করেনি আমার মাঝে এভাবে একটা ছেলের সাথে ঝগড়া করতে!বড্ড আজিব ব্যাপারস্যাপার।নিশ্চয় এ লোকটা নিজের সাথে ঝগড়ার ভুত নিয়ে ঘুরে।

আমি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিলাম।চোখ খুলতেই দেখলাম আদ্রিশ ভাইয়া আমার সামনে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ীয়ে আছে।আমাকে দেখে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
“হয়েছে বিশ্রাম নেওয়া?হয়ে থাকলে আমার রেজিস্টার করা চেয়ার আমাকে ফেরত দাও।”

উফ লোকটা আমাকে একটু শান্তিতে বসতেও দিবে না!আমি চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
“লাগিয়েছেন টা কি!!শান্তি নাই দুনিয়াতে।এ চেয়ার আপনার নামে রেজিস্টার করা কে বলেছে হুম?কোথাও নাম খোদাই করা আছে?”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,
“অবভিয়েসলি। প্রমাণ দেখাতে পারি।প্রমাণ দেখালে আমি যা বলব তাই করতে হবে।”এ কথা শুনে বিস্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে এলো।কথা কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল! এই ‘যা বলব তাই করতে হবে’ বাক্যটা আমার মোটেও পছন্দ না।এই বাক্যটা ভয়ানক একটা বাক্য।এই বাক্য দিয়ে একজন মানুষের দূর্বল জায়গায় আঘাত করতে পারে আরেকজন মানুষ।কারো খুন করতেও যেন দ্বিধাবোধ করে না।
নাহ কিছুতেই এতে রাজি হওয়া যাবে না এতে।আমি এবার বেশ সাহস দেখিয়ে বললাম,
“প্রমাণ দেখান ভাল কথা।আমি আসন ছেড়ে দিব।কিন্তু এই যা বলবেন তাই করতে হবে বিষয়টা আমি মানছি না।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
“কেনো? ভয় পাও বুঝি?”

উনার কথা শুনে আমি লুকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললাম। উনাকে কে বলবে যে আমি আসলেই ভয় পাই।এমনটা উনি জানতে পারলে যে আমার উপর হাসাহাসি করতে পিছপা হবে না তা জানা আছে।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে আমতাআমতা করে বললাম,
“দেখুন,এখানে ভয় পাওয়ার কোনো কারন আসে না।আপনি প্রমাণ দেখাতে চেয়েছেন।প্রমাণ দেখিয়ে চেয়ারটা নিয়ে যাবেন।ব্যস।”

“মোটেও না।আমাকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে তুমি আরামসে বসে থাকবে সেটার শাস্তিস্বরূপ আমি যা বলব তাই করতে হবে।যদি ভিতু না হও তাহলে তো এতে রাজি হয়ে যাওয়ার কথা।কি?ভিতু নাকি তুমি?”

ভিতরে ভিতরে একটু ভয়ে আছি যদিও তারপরেও মেকি সাহস দেখিয়ে বললাম,
“আমি মোটেও ভিতু না।”

“তো?এতে রাজি হতে প্রবলেম কি?এত সাহস থাকলে রাজি হয়ে যাও।”

উফ,ব্যাপক ঝামেলায় পরলাম তো।জীবনে এই প্রথম ঝগড়া করে এত দূর আগালাম।আর এই শেষ মূহুর্তে এসে নাকি আদ্রিশ ভাইয়া আমাকে বাগে নিতে চাইছেন!অসহ্য তো।কিন্তু এতে রাজি না হয়ে আর কি উপায় আছে?শুধু শুধু আমি এই বেয়াদব লোকটার সামনে ভিতু বলে পরিচিত হব কেনো।শেষমেশ রাজিই হতে হবে।এ যেন উভয়সংকট।
আমি বিরক্তির এক নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
“আচ্ছা ঠিক আছে রাজি হলাম।”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার কথা শুনে বিশ্বজয়ের হাসি দিলেন।সাথে সাথে বললেন,
“এখন উঠ চেয়ার ছেড়ে। প্রমাণ দেখাতে হবে তো।”অগত্যা চেয়ার ছেড়ে উঠতে হলো আমাকে।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতেই আদ্রিশ ভাইয়া হাঁটু গুঁজে বসে পরলেন।চেয়ারের ডান পায়ার উপরের দিকটা দেখিয়ে বললেন,
“এই যে দেখো।আমার নাম খোদাই করা।”

বিস্ময়কর হলেও সত্যিই আদ্রিশ ভাইয়ার নাম লেখা ছিল সেখানে।আমি অবাক চাহনিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।আদ্রিশ ভাইয়া এবার বললেন,
“এই কাঠের চেয়ার অনেক আগের।আমার আর ভাইয়ার সেম চেয়ার ছিল বলে ছোট থাকতে এ নিয়ে বেশ মারামারি লাগত।এজন্যই আমি আমার নাম খোদাই করে রেখেছিলাম যাতে আলাদা করে চেনা যায়।তো?এবার প্রমাণ পেলে নিশ্চয়?”

অপমানে মুখ থমথমে হয়ে এল আমার।আমি কোনোরকম অন্যদিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালাম।
আদ্রিশ ভাইয়া এবার উঠে দাঁড়ালেন।আমি ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
“বলুন কি করতে হবে।”

আদ্রিশ ভাইয়া ততক্ষনে চেয়ার নিয়ে রুমের দরজার কাছে চলে এসেছেন।আমার কথা শুনে এদিকে ফিরে বললেন,
“এখন মনে পরছে না।যখন মনে পরবে তখন বলব।তোলা রইলো এটা।”
এই বলে উনি রুম ত্যাগ করলেন।
আদ্রিশ ভাইয়ার এহেন কাজে রাগে আমার মাথার চুল ছিঁড়তে মন চাইল।আবার নিজের উপরও রাগ হলো খুব।কি দরকার ছিল তখনকার ঐ ক্ষনস্থায়ী জিদকে প্রশয় দেওয়া।এমনটা না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেই তো হয়ে যেত।কথায় আছে না,”ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিও না।”এই কথাটাকে কখনও আমি মানি না।সবসময় এর উল্টো পথে চলি।এজন্যই তার পরিনাম হয় এত খারাপ।কিন্তু এখন যা হয়ে গিয়েছে তার ফল তো ভোগ করতেই হবে।কি জানি কি করাবেন উনি আমাকে দিয়ে।
মনের মধ্যে বহমান সে রাগটাকে একটা লম্বা শ্বাস এর সাহায্য উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলাম।

“বাহ মিম,তুমি তো বেশ ভালোই ঝগড়া করতে পারো।”
হঠাৎ রাইসা ভাবীর কণ্ঠ শুনে আমি বাম পাশ ফিরে তাকালাম।এই রুম যে রাইসা ভাবীর তা আমার খেয়ালই ছিল না।
রাইসা ভাবী দু পা গুঁজে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে।উনার চোখেমুখে খুশির ছটা দেখে বুঝতে পারলাম উনি বেশ মজা পেয়েছেন আমাদের ঝগড়া দেখে।এতক্ষণ যে এই মজার জন্যই উনি নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন তা আর বুঝতে বাকি রইল না আমার।
আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম,
“ভাবী,এটা কি ঠিক হলো?তুমি আমার পক্ষে একটু ও কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলে!”

রাইসা ভাবী আমার কথায় তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন,
“এখানে তোমার পক্ষ নেওয়ার মত কিছু ছিল না।যাই বলো,অনেকদিন পর এমন ঝগড়া এনজয় করলাম।ফিলিং শান্তি শান্তি।”

আমি কিছু না বলে রাইসা ভাবীর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলাম।তা দেখে রাইসা ভাবী ফিক করে হেসে ফেলল।কি মিষ্টি সে হাসি!পলাশ ভাইয়া দেখলে নির্ঘাত আরেকদফায় ভাবীর প্রেমে পরতো।

.

নদীর রুমের দক্ষিণ দিকে একটা জানালা আর পূর্ব দিকে একটা জানালা।খাটের সাথে লাগোয়া জানালাটা দক্ষিণ দিকের।আর পড়ার টেবিলের সাথে লাগোয়া জানালাটা পূর্ব দিকের।আমি এ মূহুর্তে দক্ষিণের জানালার ধারে অর্থাৎ বিছানায় বসে আছি।পা দুটো ভাজ করে জানালার রেলিং এ কপাল ঠেকিয়ে মাথা নিচের দিকে করে ফোন চালাচ্ছি।আমার পাশে আরামসে দুপুরের ভাত ঘুম সারছে নদী।
ঘড়িতে সময় এখন দুপুর চারটা।আরো প্রায় ঘন্টাখানেক আগে যে যার কাজ সেরে খাওয়াদাওয়া করে নিজ নিজ রুমে রেস্ট নিতে চলে গিয়েছে।

“বেবি, এখন কি করো তুমি?”

হঠাৎ একটা অস্পষ্ট মেয়েলি কণ্ঠস্বর কানে আসতেই চমকে উঠলাম আমি।আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম আওয়াজটা ঠিক কোথা থেকে আসছে।নাহ,আশেপাশে কেউ নেই।এক নজর নদীর দিকে তাকালাম।ঘুমের মধ্যে সে আবার বিড়বিড় করছে না তো?না,সে তো চুপ। তাহলে কণ্ঠস্বর শুনলাম কোথা থেকে?
একটু পরেই পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো আমার কানে।
“জানালার ধারে বসে আছি।”
কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে বাকি রইল না এটা আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠ।তাহলে গার্লফ্রেন্ড আছে এ বেয়াদব লোকটার।অবশ্য আজকাল গার্লফ্রেন্ড নাই এমন খুব কম ছেলেই আছে।আবার উনার মত দেখতে ছেলেদের গার্লফ্রেন্ড থাকবে না এ বিশ্বাস না করাও এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

ওপাশের মেয়েটির কণ্ঠস্বর শোনার পর বুঝতে পারলাম আদ্রিশ ভাইয়া ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে কথা বলছেন।
মেয়েটি আবারো বলল,
“বেবি?তুমি ঢাকায় কবে আসবে?তোমাকে মিস করছি তো।”

মেয়েটির কথা বলার ঢং এ আমার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেল।ফলস্বরুপ ফিক করে হেসে ফেললাম।সাথে সাথে নিজের দু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম। আদ্রিশ ভাইয়া আবার হাসি আওয়াজ শুনে নিয়েছে নাকি কে জানে।পরক্ষনেই নিজেকে বুঝালাম।শুনে নিয়েছে তো কি হয়েছে।এমন ন্যাকা বাচ্চার কথা শুনলে কে হাসি থামিয়ে রাখতে পারবে শুনি…
মেয়েটার প্রশ্ন শুনে আদ্রিশ ভাইয়া মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক এক আওয়াজ বের করে বললেন,
“আহহা মাহা,মাত্রই গতকাল এসে বাড়ীতে উঠলাম।২/৩মাস তো থাকবোই এখানে।”

মেয়েটার প্রতি আদ্রিশ ভাইয়ার সম্বোধনে বুঝলাম, মেয়েটার নাম মাহা।
আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শোনামাত্রই মাহা নামক মেয়েটা একপ্রকার আর্তচিৎকার করে বলল,
“কি বলছো তুমি!!এতোদিন তোমাকে ছাড়া থাকব কি করে?”

আদ্রিশ ভাইয়া হয়ত কণ্ঠে খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
“ঈদেরছুটিতে যেভাবে থাক সেভাবে থাকবে।”

“ঈদেরছুটি তো মাত্র কয়েকদিনের হয়।আর সেখানে তুমি দুই থেকে তিন মাসের জন্য আসবে না।ভাবতেই আমার কান্না পাচ্ছে।”

মেয়েটার এ কথা কানে আসতেই আমি মনে মনে বললাম,’একটু কান্না করে দেখাও দেখি বেবি।তোমার দুঃখের কান্না শুনে আমরাও একটু দুঃখিত হই।’এই বলে আমি আপন মনে আবারো হেসে ফেললাম।

“আচ্ছা এ টপিকটা এখানে বাদ দেই?আমার মাথা ধরছে খুব।”

“ইশ,আমি তোমার পাশে থাকলে মাথাটা সুন্দর করে টিপে দিতাম।আমার হাতের ছোঁয়ায় তোমার মাথা ব্যাথা পালিয়ে যেত।”

দুজনের এ সো কল্ড প্রেমালাপে আমি আরেকদফা হেসে নিলাম।ন্যাকা গার্লফ্রেন্ড কত প্রকার ও কি কি হতে পারে তা মাহা নামক এ মেয়েটার কথাবার্তায় জানা যায়।অনেকদিন পর আজ বিনোদন পেলাম।লাইফের সেরা বিনোদনের একটি এ কথোপকথন।
বারবার মাহার ঐ ন্যাকা কথাগুলো মনে আসতেই হাসির দমেকে নিজেকে সামলে রাখা দায় হয়ে পরলো আমার জন্য।আজকে যে আমার হাসির ব্যামোয় ধরেছে তা আমাকে দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে।

“বেবি একটা গান শোনাও না প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

“ওকে ওকে শুনাচ্ছি।গিটারটা নিয়ে আসি।”

“ওকে যাও।”

বাহ,তাহলে আদ্রিশ ভাইয়া গানও গেতে পারে!নিজের গার্লফ্রেন্ডকে ডেডিকেট করে নিশ্চয় রোমান্টিক একখানা গান গাইবেন তিনি।ন্যাকামার্কা গান গাইবেন নাকি?আচ্ছা? ন্যাকামার্কা গান বলতে কি কোনো গান আছে?

নিজের মনের মধ্যে চলা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলাম আমি।তখনই গিটারের টুংটাং আওয়াজ কানে এলো।নিশ্চয় আদ্রিশ ভাইয়া সুর তোলার চেষ্টা করছেন।
এক মিনিটের মধ্যে তিনি তার চেষ্টায় সফল হলেন।গিটারে একটা পরিচিত গানের সুর তুললেন তিনি।গানটা পুরোনো, তবে অনেক সুন্দর।
“ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায়…….”
আদ্রিশ ভাইয়াকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে মাহা বেশ বিরক্ত নিয়ে বলল,
“আহা,এসব পুরোনো আমলের বাংলা গান গাইছো কেনো!ইংলিশ গান ধরো।এক কাজ করো, জাস্টিন বিবারের ‘সরি’ গানটা গেয়ে শোনাও।এটা তোমার গলায় শুনতে অনেক ভাল লাগে।”

মাহা’র কথায় আমি প্রচন্ড বিরক্ত হলাম।এত সুন্দর গানটা এভাবে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে ইংলিশ গান গাইতে!যে মানুষটার কণ্ঠে গানের প্রথম দুই লাইন ভাল লাগতে পারে, তার কণ্ঠে বাকি গানটুকুও ভাল লাগবে এটা স্বাভাবিক।তো পুরো গানটা শুনে তারপর ইংলিশ গানের বায়না ধরত।ধ্যাত, মুডটাই নষ্ট করে দিলো মেয়েটা।
আদ্রিশ ভাইয়ার কেমন লেগেছে কে জানে।এপাশ থেকে উনার একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট আমার কানে ভেসে এলো।লোকটা হয়ত কোনো কারনে বেশ বিরক্ত নয়ত মুড ভালো না।
উনি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে গিটারে আবারো সুরে তুললেন।
“You gotta go and get angry at all of my honesty
You know I try but I don’t do too well with apologies
I hope I don’t run out of time, could someone call a referee?……”

®সারা মেহেক

#চলবে