ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-০৪

0
1083

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

হঠাৎ করেই অসমাপ্ত সে বইটা পড়তে খুব ইচ্ছা করছে।মনটা বড্ড আকুপাকু করছে আমার।শেষের আর ৪/৫টা পৃষ্ঠা বাকি আছে।এখন খুব করে পড়তে মন চাইছে। কিন্তু পড়ব কি করে।ঐ বেয়াদব লোকটা তো নিজের পার্সোনাল বই বলে বইটাকে উপরে তুলে রেখেছে। আচ্ছা? একবার কি মেজ নানুর রুমে চুপিচুপি গিয়ে বইটা পড়ে আসব?উঁহু, এমনটা করা মোটেও উচিত হবে না।মনে রাখতে হবে এটা অন্যের বাড়ী।চোরের মত কাজ করা একদমই উচিত না।আচ্ছা? নদীকে কি একটু রিকুয়েস্ট করব বইটা এনে দেওয়ার জন্য?হুম।তাকে রিকুয়েস্ট করা যেতে পারে।সে নিশ্চয় বইটা ইজিলি এনে দিতে পারবে।বা আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে যদি পারমিশন চেয়েও বইটা নেয় তাহলে আদ্রিশ ভাইয়া নিশ্চয় দিবে।মানা করবে না।
যেই ভাবা সেই কাজ।আমি নদীর রুম থেকে উঠে সোজা ড্রইংরুমে গেলাম।সেখানে গিয়ে আমাকে হতাশ হতে হলো একটু।কারন নদী একা নেই রুমে।আদ্রিশ ভাইয়া আর পলাশ ভাইয়াও আছেন।তিনজনে মিলে গল্পগুজব করছে।
কিছুক্ষণ ড্রইংরুমের দরজার বাইরে দাঁড়ীয়ে রইলাম। ভাবতে লাগলাম এখনই নদীকে ডাকব।নাকি পরে ডাকব।পরেই ডাকি তাকে।এখন ভাইদের সাথে গল্পে মশগুল সে।সেখান থেকে নদীকে ডেকে আনা ভাল দেখায় না।
এসব ভেবে আমি পিছন ফিরে নদীর রুমের দিকে যেতে নিলাম।হঠাৎ পিছন থেকে পলাশ ভাইয়া ডেকে উঠলেন,
“কি মিম?বাইরে দাঁড়ীয়ে কেনো?ভিতরে আসো।”

পলাশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি থমকে গেলাম।আবারো পিছনে ফিরে ঠোটে জোরপূর্বক এক হাসি ফুটিয়ে বললাম,
“না ভাইয়া।আপনারাই গল্প করুন।”

“কোনো দরকারে এসেছিলে?”

পলাশ ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই আদ্রিশ ভাইয়া ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।কিন্তু সেদিকে আমি তোয়াক্কা না করে বললাম,
“আসলে নদীর সাথে একটু কথা ছিল আমার।”

আমার কথা শোনামাত্রই নদী সোফা থেকে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ীয়ে বলল,
“কি কথা আপু?”
আমি নদীকে রুমের বাইরে বের করে নিয়ে দরজার আড়াল দাঁড়ীয়ে ফিসফিস করে বললাম,
“আসলে আমি না মেজ নানুর রুমের ঐ বুক শেল্ফ থেকে ‘ত্রাতিনা’ নামের বইটা পড়ছিলাম।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া এসে আমার কাছ থেকে বইটা হুট করে নিয়ে যায়।বলে এটা নাকি উনার পার্সোনাল লাইব্রেরি।এখান থেকে পারমিশন ছাড়া বই নেওয়া যাবে না।তো আমিও আর বিষয়টা ঘেটে দেখেনি।কিন্তু হুট করে বইটা পড়তে খুব ইচ্ছা করছে। লাস্টের ৪/৫ পেজ বাকি ছিল মাত্র।দশ মিনিট লাগবে সর্বোচ্চ। তুমি কি একটু বইটা এনে দিতে পারবে?”

আমার কথা শুনে নদীকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল।তারপর কি যেন চিন্তা করে বলল,
“আচ্ছা আমি ছোট ভাইয়ার কাছে পারমিশন নিয়ে বইটা এনে দিচ্ছি। ”

নদীর কথা শুনে আমি বিনয়ী হেসে বললাম,
“আচ্ছা যাও।”
নদী আমাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে রুমে চলে গেল।আমি আর দরজার আড়াল থেকে বের হলাম না।তবে মাথা এগিয়ে রুমের ভিতরের সব কর্মকাণ্ড দেখতে লাগলাম।

নদী রুমে গিয়েই আদ্রিশ ভাইয়াকে বলল,
“ছোট ভাইয়া, তোমার লাইব্রেরি থেকে ‘ত্রাতিনা’ নামের বইটা কি দেওয়া যাবে?যাস্ট দশ মিনিটের জন্য।”

সাথে সাথেই আদ্রিশ ভাইয়া সন্দেহজনক সুরে প্রশ্ন করলেন,
“কেনো?কি করবি দশ মিনিটের জন্য?”

নদীর অকপট স্বীকারোক্তি,
“মিম আপু পড়বে।শেষের কয়েক পাতা বাকি আছে মাত্র।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার নিজের হাতের ফোনটা ঘুরাতে ঘুরাতে বেশ মুড নিয়ে বললেন,
“যার দরকার সে এসে চাইলেই তো পারে।এভাবে অন্যকে পাঠানোর মানে কি।”

“আরে ছোট ভাইয়া, এত কথা বাদ দাও আর বইটা দাও।মাত্র দশ মিনিটের জন্য পার্সোনাল কে পাবলিক করে ফেলো।”

আদ্রিশ ভাইয়া যেন ঠিক করেই নিয়েছেন বইটা আমাকে দিবে না।তাই তো নদীকে তিনি বললেন,
“ঐ বইটা দেওয়া যাবেনা।ঐ টা একান্তই আমার পার্সোনাল বই।সব বই পাবলিক করলেও ঐ বইটা সহ আরো কয়েকটা বই আমি পাবলিক করব না।কারন বইগুলো আমার কাছে স্পেশাল।হ্যাঁ, যদি একান্তই তার ইচ্ছা থাকে বইটা পড়ার তাহলে আমাকে এসে রিকুয়েস্ট করলেই আমি তাকে দিয়ে দিব।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে শেষ আশাটুকুও পানিতে ভেসে গেলো।সাথে এসে জড়ো হলো উনার প্রতি রাগ।নিজেকে কি মনে করেন উনি হ্যাঁ।একটা বইই তো চেয়েছি। এতো নাটক করার কি আছে।কি এমন জিনিস আছে ঐ বইতে।এতো কিসের স্পেশাল বই। আর শখ কত!উনাকে গিয়ে রিকুয়েস্ট করব তাও আবার বইয়ের জন্য!জীবনেও না।ভুলেও উনাকে রিকুয়েস্ট করব না।আজ সকালের ঝগড়ার পর তো মোটেও না।রাগে বিড়বিড় করে নিজেকেই এসব বলতে লাগলাম আমি।

“তাহলে বই দিবি না ওকে?”পলাশ ভাইয়া আদ্রিশ ভাইয়াকে জিজ্ঞাস করলেন।

ঢিট আদ্রিশ ভাইয়ার অতি সহজ জবাব,
“উঁহু।আমি তো বললামই, যদি বইটা এতোই পড়তে ইচ্ছা করে তো আমাকে এসে রিকুয়েস্ট করুক আমি দিয়ে দিচ্ছি। ”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি দাঁতে দাঁত চেপে গলার স্বর একটু জোরে করে উনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম,
“লাগবে না কারোর স্পেশাল বই।সে তার স্পেশাল বই নিয়েই পরে থাকুক।আমি কাউকে রিকুয়েস্ট করতে যাব না।দরকার নেই কারোর স্পেশাল বই পড়ার।”
এই বলে আর এক মূহুর্তও সেখানে দাঁড়ীয়ে না থেকে আমি নদীর রুমে চলে আসলাম।আমি রুমে ঢুকার পর পরই নদীও আমার পিছু পিছু রুমে ঢুকলো।নদীকে দেখে আমি স্বাভাবিক স্বরে বললাম,
“কি ব্যাপার নদী?তুমি এখানে যে?আড্ডা দেওয়া শেষ?”

আমি ততক্ষণে বিছানায় এসে বসেছি। সাথে সাথে নদী আমার পাশে এসে বসে আকুতির স্বরে বলল,
“এই আপু,প্লিজ প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না।আমার উপর রাগ করো না প্লিজ।আমি ট্রাই করেছি তো বাট ভাইয়া দিলো না।”

নদীর কথা শুনে আমি মুচকি হেসে ওর হাতে হাত রেখে বললাম,
“তোমার উপর রাগ করব কেনো শুনি?তুমি কি রাগ করার মত কিছু করেছো নাকি?রাগ তো হয়েছে আদ্রিশ ভাইয়ার উপর।বইটা দিলে কি এমন হয়ে যেত?কি এত স্পেশাল বই ওটা?এক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বই এত স্পেশাল কি করে হতে পারে?”

নদী কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ছোট ভাইয়ার পার্সোনাল বুক শেল্ফ ওটা।বইয়ের কালেকশন দেখে বুঝতেই পারছো বইয়ের প্রতি ভাইয়ার কত ঝোঁক।প্রচুর বই কালেক্ট করত।এমবিবিএস পড়াকালীন সময়েও অনেক বই কালেক্ট করেছে। আগে ওর রুমেই বুক শেল্ফটা ছিল। পরে দাদির ইসলামিক বইয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে থাকলে দাদির সুবিধার কথা ভেবেই শেল্ফটা দাদির রুমে আনা হয়।
আগে ছোট ভাইয়া এটাকে ‘পার্সোনাল পার্সোনাল’ বলত না।একদিন ছোট ভাইয়ার এক মামাত বোন বেড়াতে আসে বাড়ীতে।তার আবার ছোট একটা ছেলেও ছিল।মারাত্মক দুষ্টু। সারা বাড়ীর অবস্থা নাজেহাল করে তুলেছিল। এতে সে ক্ষান্ত হয়নি।ভাইয়ার শেল্ফ থেকে তার শখের কয়েকটা বই ছিঁড়ে ফেলে একদম।সেই থেকে ভাইয়ার কড়া নির্দেশ,বাড়ীর লোকজন ছাড়া কেউই তার বুক শেল্ফে হাত লাগাবে না।অবশ্য দাদি ছাড়া কেউ হাতও দেয়না।কারন এ বাড়ীর কেউই তেমন বই পড়ে না।তবে ঢাকা থেকে আসার পর পলাশ ভাইয়া আর তার বউ দু একটা বই পড়ে।এই আরকি।এবার বুঝছো আপু?”

নদীর কথা শুনে মনে মনে বললাম,’ওহ এই কাহিনি।ব্যাটা তাহলে বইপাগল।ভালো তো।কিন্তু স্পেশাল বই আবার কি?’

আমি বিনয়ী হেসে বললাম,
“হুম বুঝেছি।কিন্তু স্পেশাল বইয়ের ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।”

নদীর ভ্রুজোড়া চিন্তায় খানিকটা কুঞ্চিত হয়ে এল এবার।বেশ ভাবুক স্বরে সে বলল,
“সেটা তো আমিও বুঝছি না।ভাইয়ার এত প্রিয় বইয়ের মধ্যে আবার স্পেশাল বইও আছে সেটা আজ জানলাম।”

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই বড় মামির গলার স্বর কানে ভেসে এলো।রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে সে।তার ডাক শুনে আমি আর নদী কথা না বাড়িয়ে ডাইনিং এ চলে আসলাম।

খাবার খাওয়ার এক ফাঁকে ইদ্রিস মামা আমাকে বললেন,
“বাড়ীতে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছ,ঠিক না?”

ইদ্রিস মামার কথায় আমি ভাত মাখিয়ে নিতে নিতে বললাম,
“ঠিক বিরক্ত হচ্ছি তা না।একা একা ভাল লাগছে না।নদী সকালে প্রাইভেটে পড়তে যায়।তারপর রাইসা ভাবীরও শরীর ভাল না সব মিলিয়ে একা একাই বেশি সময় কাটে।দুই মামি আর নানুও আমাকে রান্নাঘরে যেতে দেয়না।কারন আমি বেড়াতে এসেছি। এজন্য আমাকে কোনো প্রকার কাজ করতে দেওয়া যাবে না।”
এই বলে আমি চোখেমুখে হালকা দুঃখী একটা ভাব ফুটিয়ে তুললাম।

আমার কথাগুলো শুনে সবাই অল্পবিস্তর হেসে নিলো।বড় মামি আমার সামনে থাকা গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
“আমি তোমাকে জোর করে এখানে রেখেছি কাজ করার জন্য না।ঘুরাফিরা করবে,রাইসা আর নদীর সাথে আড্ডা দিবে।এভাবে সময় কাটাবে।ব্যস।”

মেজ নানু এবার নদীর উদ্দেশ্যে বলল,
“এই নদী,কালকে তুই মিমকে তোদের কলেজ দেখাতে নিয়ে যাবি।সকালের পড়া শেষ করেই ওকে নিয়ে কলেজে যাবি।”

নানুর কথায় ইদ্রিস মামা সায় দিলেন।তিনি বললেন,
“হুম।এটা ভাল হবে।জানো মা?ঐ কলেজটা আমাদের গুষ্ঠির কলেজ।”

মামার কথা শুনে আমি প্রশ্নবোধক চাহনিতে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।আমার চাহনি বুঝতে পেরে ইদ্রিস মামা খানিকটা হেসে বললেন,
“ঐ কলেজে তোমার নানা পড়েছে, মানে আমাদের আব্বা পড়েছে।আমরা দুই ভাই পড়েছি।পলাশ আর আদ্রিশও পড়েছে।আর এখন নদী পড়ছে।”

মামার কথা শুনে আমি মৃদু হেসে দিলাম।

.

নদী মাত্রই টিউশনি থেকে ফিরেছে।ফিরে এসেই কি এক হুলস্থুল কারবার শুরু করল সে!
সকালের নাস্তা খেয়ে আমি নদীর রুমে শুয়ে ছিলাম।এসেই সে আমার কানের কাছে বলতে লাগল,
“এই আপু,উঠো।তাড়াতাড়ি রেডি হও।আমরা এখনই বের হবো।”
এই যে তিনটা লাইন সে যে কয়বার জপেছে সেই জানে।ওদিকে অলস আমি আস্তেধীরে কাজ করছি।
বেশ অলস ভঙ্গিতে বিছানা ছেড়ে উঠলাম।ওয়াশরুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হলাম।তারপর ফ্যানের নিচে বসে গা শুকাতে লাগলাম।অন্যান্য দিনের মত আজও গরম পরছে বেশ।
আমি বেশ অলস ভঙ্গিতে কাজ করছি। ওদিকে নদী নিজের মত আমাকে কথার মাধ্যমে ঠেলছে। বাসায় থাকলেও কেউ না কেউ আমাকে ঠেলতো।কারন আমি বড্ড অলস প্রকৃতির মানুষ।দিনদিন এ অলসতা আমাকে প্রচন্ড রকমের জেঁকে ধরছে।

“ও আপু গো…তোমার কি হলো?”

হিজাবে শেষ পিনটা লাগিয়ে নিকাব বাঁধতে বাঁধতে বললাম,
“হুম হয়ে গিয়েছে।চলো যাওয়া যাক।”
এই বলে বিছানায় রাখা ফোনটা পার্সে ঢুকিয়ে নিলাম।ততক্ষণে নদীরও রেস্ট নেওয়া শেষ হলো।রুম থেকে বেড়িয়ে বড় মামি আর ছোট মামিকে বলে সে বেড়িয়ে পরলো আমাকে নিয়ে।
মেজ নানুর বাড়ীর পেছনটায় যেমন একটা উঠোন আছে।তেমনি সামনেও প্রকাণ্ড এক উঠোন আছে।পিছনের উঠোনের চেয়ে সামনের উঠোনের দৈর্ঘ্য প্রস্থ অনেকটাই বেশি।এ উঠোনের বেশিরভাগ জুড়েই আছে আম আর লিচু গাছ।প্রচন্ড গরমে এখানে সময় কাটানো বেশ সুখকর একটা ব্যাপার।যদিও আমি এখানে আসার পর থেকে এখানে তেমন সময় কাটাই নি।

উঠোন ছেড়ে পাকা রোডে নেমে আসতেই নদী একটা অটো থামালো।অটোওয়ালাকে কলেজের ঠিকানা বলে অটোতে উঠে পরলো নদী।তার পিছুপিছু আমিও উঠলাম।

মেজ নানুর বাড়ী প্রধান শহর থেকে একটু দূরে।অনেকটা গ্রামের মধ্যে।অটোতে করে এখান থেকে শহরে আসতে সময় লাগে পাঁচ মিনিটের মত।আমি আর আম্মু যেদিন আসি সেদিন বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ীতে আসতে সময় লেগেছিল পনেরো মিনিটের একটু কম।

১০ মিনিটের মধ্যেই আমি আর নদী কলেজে পৌঁছে গেলাম।অটোর ভাড়া চুকিয়ে গেটের কাছে আসতেই আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখে ছোটখাট একটা ধাক্কা খেলাম আমি। উনি এখানে কি করছেন!আবার উনি যে একা তা নন।সাথে অর্ণব ভাইয়াও আছে।
বাইকের গায়ে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে ফোন চালাচ্ছেন উনি।গায়ে ধবধবে সাদা রংয়ের শার্ট, যার হাতা প্রায় কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা।যার ফলে হাতের কালো লোমগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে।সাথে পরেছেন জিন্সের প্যান্ট। বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে তিনি ফোন চালাচ্ছেন।সেদিনকার মতই, এক হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজানো এবং অপর হাত ফোনে।উনার উপর যেন এ স্টাইলটা মানায় বেশ।কি জানি কেনো,তবে এ স্টাইল যেন উনার নিজস্ব, একদম নিজস্ব।

“ছোট ভাইয়া তুই এখানে!”আমাকে পিছনে ফেলে নদী আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে যেতে যেতে কথাটা বলল।
নদীর কথা কানে পৌঁছানো মাত্র আদ্রিশ ভাইয়া ফোন থেকে মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকালেন।শুধু যে তাকালেন তা নয়, মাথা খারাপ করা এক হাসিও দিয়ে দিলেন।আর জীবনে এই প্রথম কারোর হাসি দেখে আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।আমি খেয়াল করলাম আমার হৃদস্পন্দন ধীরেধীরে স্বাভাবিক এর চেয়ে একটু বেশিই দ্রুত গতিতে হচ্ছে।এবং এই প্রথম সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও কারোর উপর ক্রাশ খেলাম আমি।
গ্রীষ্মের খরতাপের সে রোদ্দুর আদ্রিশ ভাইয়ার সাদা শার্টে প্রতিফলিত হয়ে উনার চোখেমুখে আছড়ে পরছে।এ কারনে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের সে চেহারা এখন তুলনামূলক বেশ ফর্সা দেখাচ্ছে।সাথে গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর চোখে রোদচশমা।সব মিলিয়ে কিলার একটা লুক।আর ঠোটের সে হাসির কথা নাহয় নাই বললাম।কি আছে ঐ হাসিতে কে জানে।আচ্ছা? আদ্রিশ ভাইয়া কি কারো মার্ডার করতে বের হয়েছেন নাকি?তা নয়ত কি।উনার এ লুক এ স্টাইল দেখে যে নির্ঘাত শত শত মেয়ে মারা পরবে তা বোধদয় উনার জানা নেই।
আমার সাথে কি হচ্ছে কে জানে।যে মানুষটাকে সহ্য করা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যায় আজ তাকে দেখেই আমি কুপোকাত হলাম!আমি তো বলেছিলাম কিছুতেই উনার এ সর্বনাশা হাসি দেখে মুগ্ধ হওয়া যাবে না।কিন্তু আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি আমার হৃদস্পন্দনের গতি।আশেপাশের সবকিছু যেন উল্টাপাল্টা লাগছে।সবটাই অগোছালো আর ঝাপসা আমার কাছে।চিন্তা শক্তিও যেন লোপ পেয়ে বসেছে।
হঠাৎ-ই এক নিষিদ্ধ ইচ্ছায় আমার সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল।আর সে নিষিদ্ধ ইচ্ছাটা হচ্ছে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ীয়ে উনাকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা।আচ্ছা? আমার এ নিষিদ্ধ অবাধ্য ইচ্ছা কি পূরণ করা সম্ভব?প্রশ্নটা করার সাথে সাথে আমার ভিতর থেকে কে যেন চিৎকার করে বলতে লাগল,’সম্ভব নয় এটা।এ ইচ্ছা পূরণ হবার নয়।’

“এই মিম আপু,ঠিক আছো তো?শরীর কি ভালো লাগছে না? কোথায় হারিয়ে গেলে?”
নদীর কণ্ঠস্বর শুনে আমি চমকে উঠলাম।এতক্ষণ আমি কোথায় ছিলাম!স্বপ্ন দেখছিলাম নাকি?দিবাস্বপ্ন? এটা কি আদৌ হয়?একটা মানুষকে সামনে দেখে তার রূপের বর্ণনা করা, নিজের অনুভুতির বর্ণনা করা কি দিবাস্বপ্নের মধ্যে পরে?আচ্ছা?আদ্রিশ ভাইয়া কি সত্যিই এসেছেন নাকি আমার মাথা খারাপ হওয়ায় আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি?
“এই আপু,আমার টেনশন হচ্ছে তো।কি হলো তোমার!”
আমার হাত ঝাঁকিয়ে কথাটা বলল নদী।আমি তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিলাম।নদীর চেহারার দিকে খেয়াল করে দেখলাম, কোনো এক কারনে তার মুখটা বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।সে কারনটা নিশ্চয় আমি।
আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
“আমি একদম ঠিক আছি।চলো কলেজের ভিতরে যাই।”

আমার এই কথাটাই যেন নদী এতক্ষণ ধরে শুনতে চাইছিল।আমার দিকে তাকিয়ে সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম আপু।সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছিলাম বাট তুমি রেসপন্সই করছিলে না।”

নদীর কথার প্রতিউত্তর আমি আর দিলাম না।কি-ই বা বলতাম।আমি যে দাঁড়ীয়ে দাঁড়ীয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছি সেটা বলে লজ্জার মুখে পরা মোটেও ঠিক না।

নদীকে নিয়ে কলেজের গেটের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে আমার চোখ গেল সেই বাইকের দিকে।এ কি!সত্যিই বাইকটা আছে!তার মানে কি সত্যিই আদ্রিশ ভাইয়া এসেছে! তাহলে কি আমি এতক্ষণ উনার দিকে এমন হ্যাবলার মত তাকিয়ে ছিলাম!উনি কি এটা খেয়াল করেছেন?করেছেন নিশ্চয়।ছিঃ কি লজ্জা।উনি আমাকে কি না কি ভাবছেন কে জানে।ছিঃ বেহায়া মেয়ে কোথাকার।

কলেজের প্রধান ফটক পেরিয়েই আদ্রিশ ভাইয়ার দর্শন হলো।মানুষটা খুব মনযোগ সহকারে ফোনে কথা বলছে।হাত নাড়িয়ে ফোনের ওপাশে কাকে যেন কি বুঝাচ্ছেন তিনি।হঠাৎ আদ্রিশ ভাইয়ার ফোনের দিকে তাকাতেই আমার মনে পরে গেল, কাল তো উনি উনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেছেন।আমি তো বেমালুম ভুলে বসেছি যে উনার গার্লফ্রেন্ড আছে। ছিঃ মিম একটা সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসের উপর এত নজর দিলি কিছুক্ষণ আগে!
মাহা’র কথা মনে আসতেই আমি গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আদ্রিশ ভাইয়ার উপর যে ক্রাশ খেয়েছি সেটা ভুলে গেলাম।এতে যে আমার কষ্ট হলো তা নয়।আমার সাথে এমনটা এর আগেও হয়েছে।এমন অনেক ক্রাশের গার্লফ্রেন্ড থাকতে দেখেছি।অন্য মেয়েকে পছন্দ করতে দেখেছি। আমার কাছে নতুন কিছু না এটা।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কোনো কষ্টই হলো না আমার।তবে চিরপরিচিত সে লজ্জার অনুভুতি জেঁকে ধরছে আমাকে।আদ্রিশ ভাইয়া যদি বুঝে ফেলে আমি উনাকে অতক্ষণ ধরে দেখছিলাম তাহলে নিশ্চয় বেহায়া মনে করবেন আমাকে।নাহ,এত ভাবলে তো টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।এখন এসব ভুলে ঘুরাঘুরিতে মনযোগী হওয়া উচিত।

নদীর সাথে পুরো কলেজ ঘুরলাম।সাথে স্কুলও ঘুরলাম।এখানে স্কুল আর কলেজ একসাথে বানানো হয়েছে। বিশাল এক জায়গা জুড়ে এ প্রতিষ্ঠান।বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাসের মাঠ।আশেপাশে কিছু ছোট গাছগাছালি রয়েছে।স্কুলের দিকে রয়েছে বিশাল এক বটগাছ।দেখলেই কেমন যেন গা ছমছম করে।
পুরো স্কুল আর কলেজ আমি আর নদী একসাথে ঘুরেছি।ওদিকে আদ্রিশ ভাইয়া আর অর্ণব ভাইয়া বসে আড্ডা দিচ্ছেলেন।নদীর কাছে জানতে পারলাম উনাদের এখানে আসার কারন।ছোট মামি পাঠিয়েছেন আদ্রিশ ভাইয়াকে। কারন তিনি বেশ ভয়ে আছেন নদী আমাকে নিয়ে ঠিকমত ঘুরতে পারবে কি না।কোথায় হারিয়ে বা কোনো বিপদে পরে যাবে কি না।এজন্যই বডিগার্ড হিসেবে আদ্রিশ ভাইয়াকে পাঠিয়েছে।উনি আবার আসার সময় নিজের সাথে অর্ণব ভাইয়াকেও নিয়ে এসেছেন।

সেই বটগাছের কাছে আসতেই নদী আদ্রিশ ভাইয়াকে ডাকলো।তার ডাকার কারনটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
“ছোট ভাইয়া… আমার আর মিম আপুর কয়টা ছবি তুলে দাও না।এখানে ছবি তুললে ব্যাকরাউন্ড ভিউটা অনেক সুন্দর হবে।”
আমি নদীর কথা শুনে চমকে উঠলাম।সে আদ্রিশ ভাইয়াকে ডেকেছে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য!একাই তো তুলতে পারত।নাহয় আমাকেই বলত।তাই বলে আদ্রিশ ভাইয়াকে ডেকে আনলো কেনো।উনার সামনে ছবি তোলা আমার পক্ষে সম্ভব না।এমনি দাঁড়ীয়ে থাকা কোনো ব্যাপার না।তবে ছবি তোলা অনেক বড় ব্যাপার।আমি কখনোই উনার সামনে ছবি তুলতে পারবো না।কারন লজ্জা লাগার অনুভুতিটা একটু বেশিই আছে আমার।কোনো কাজিনের সামনে ছবি তুলতেই আমার মধ্যে সামান্য অস্বস্তি এসে ভিড় করে।সেখানে উনার সামনে ছবি তোলা সম্ভবই না।
নদী ছবি তোলার জন্য ঠিকঠাক ভাবে দাঁড়াচ্ছে। আমি ইচ্ছা করে কণ্ঠে বেশ অস্বস্তি প্রকাশ করে বললাম,
“নদী,তুমিই ছবি তুলো।আমি তুলবো না।আমার ইচ্ছা করছে না।”

নদী চট করে আমার হাত ধরে চোখ বড় বড় করে বলল,
“সে কি!কেনো ইচ্ছা করবে না।আচ্ছা, দুই একটা ছবি তুলবে যাস্ট।”

“না নদী।প্লিজ।তুমি একাই তুলো।”

আমার কথা শুনে নদী এবার কাঁদোকাঁদো চেহারা করে বলল,
“প্লিজ মিম আপু।শুধুমাত্র দুটা।”

নদীর চেহারা হাবভাব দেখে হাজারো অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাজি হতে হলো আমাকে।অগত্যা তার পাশে দাঁড়ীেয় পরলাম।এতক্ষণ যে আমাদের এ নাটক বেশ মজা নিয়েই আদ্রিশ ভাইয়া দেখছিলেন তা উনার ঠোটের হাসি দেখেই বুঝতে পারলাম।

আমি নদীর পাশে স্টিল হয়ে মূর্তির মত দাঁড়ীয়ে পরলাম।ছবি তোলার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখনই নদী বিস্ময় নিয়ে বলল,
“এই আপু,তুমি কি নিকাব বেঁধেই ছবি তুলবে নাকি!”

আমি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলাম,
“হুম।কেনো?কোনো সমস্যা?”

“হুম সমস্যা।তুমি চলে গেলে তোমার ছবি দেখব।তখন কি এই নিকাব পরা ছবি দেখে মন ভরবে বুঝি? ”

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই আদ্রিশ ভাইয়া কণ্ঠে খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
“এই তোর ড্রামা কি শেষ হলো?কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবি আমাকে?আমাকে কি তোর পার্সোনাল ফটোগ্রাফার মনে হয় নাকি?”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি খানিকটা বিব্রতবোধ করলাম।কিন্তু তা নদীর দৃষ্টিগোচর হলো না।সে এক প্রকার জোর করেই আমার নিকাবটা খুলতে খুলতে বলল,
“এই দেখ,ছোট ভাইয়া বকা শুরু করে দিয়েছে।এবার মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আমার স্মৃতির ছবিটাকে পারফেক্ট করে তোলো।”
আমি এখনও নদীর দিকে তাকিয়ে আছি।কেনো যেন সামনে তাকাতে মোটেও ইচ্ছা করছে না।ওদিকে নদী সামনের দিকে তাকিয়ে মুখে একটা কৃত্রিম হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো।আর আমি এ হাসি হাসবো না বলেই নদীর কাঁধের উপর দিয়ে ওপাশের দোলনার দিকে তাকিয়ে আছি। যা স্কুলের ছোট বাচ্চাদের জন্য বানানো।
কয়েক সেকেন্ড সেদিকেই তাকিয়ে রইলাম।হঠাৎ কানে একটা কথা ভেসে এলো।

“হেই মিশমিশ,ওদিকে কি দেখছ?সামনে তাকাও।”

কথাটা কানে আসতেই আমার কি হলো কে জানে, আমি চট করে সামনে ঘুরে তাকালাম।সাথে সাথেই আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ক্যামেরায় দুটো ক্লিক পরলো।
আমার কানে এখনও সে সম্বোধনটা ঘুরছে।আচ্ছা?এটা তো আমার নাম না।একটা অপরিচিত সম্বোধন।তাহলে আমি ঘুরে তাকালাম কেনো?আমার জন্য না সম্বোধনটা। তবুও যেন মনে হলো আমার উদ্দেশ্যেই এ সম্বোধনটা করা হয়েছে। আদ্রিশ ভাইয়া তো আমাকে চাশমিশ বলে ডাকে।তাহলে মিশমিশ শুনলাম কেনো?হয়ত উনি চাশমিশই বলেছেন।আমার কানেই হয়ত সমস্যা।এসব বুঝ নিজেকে বুঝিয়ে ছবি তোলার পর্ব শেষ করলাম।কলেজ থেকে বেড়িয়েই আদ্রিশ ভাইয়া কি একটা কাজে পাশের এক দোকানে চলে গেলেন।নদী আর আমি এসে রাস্তার পাশে দাঁড়ীয়ে পরলাম অটোতে উঠার উদ্দেশ্যে।বেশকিছুক্ষন যাওয়ার পরও কোনো অটো পেলাম না।এদিকে গরমে আমার অবস্থা নাজেহাল।মনেপ্রাণে চরম বিরক্তি নিয়ে পাশে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলাম আমি।অর্ণব ভাইয়া আমার পাশে দাঁড়ীয়ে আছে।চোখেমুখে উনার কিছু একটা চাওয়ার আকুতি দেখা গেলো।কিন্তু কি চাওয়ার থাকতে পারে তা বুঝলাম না আমি।

®সারা মেহেক

#চলবে