ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-০৫

0
1015

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

অর্ণব ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আমি বিনয়ী কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলাম,
“কিছু বলবেন?”

আমার প্রশ্ন শুনে অর্ণব ভাইয়ার চোখেমুখে হাজারো খুশির ছটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। উনি খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
“কেমন আছো মিম?”

উনার এ প্রশ্নে আমি কিছুটা অবাক হলাম।চেহারায় এত সাজ সাজ রব তুলেছেন এ প্রশ্ন জিজ্ঞাস করার জন্য?
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলাম,
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

অর্ণব ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেেস বললেন,
“আমিও ভাল আছি।”
এই বলে উনি চুপ করে রইলেন।কথোপকথনটা এখানেই শেষ বলে আমি ধরে নিয়েছি। ডান পাশ থেকে মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকালাম।এখনো কোনো অটো আসেনি।ওদিকে নদী ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে।
“একটা জিনিস চাইবো।দিবে?”

অর্ণব ভাইয়ার কথা প্রশ্নে আমি এবার ভড়কে গেলাম।ডান পাশ ফিরে উনার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
“দেওয়ার মত জিনিস হলে অবশ্যই দিব।”
এদিকে মনে মনে ভয়ের এক ডঙ্কা বাজতে লাগল।কি না কি চেয়ে বসেন এই ভেবে।
অর্ণব ভাইয়া ডান হাত ঘাড়ের কাছে ঘষতে ঘষতে বললেন,
“তোমার ফেসবুক আইডিটা দেওয়া যাবে?আমি জানি, তোমার আইডি আছে।নদীর কাছে শুনেছি। বাট ও তোমার আইডির নাম জানে না।তাই তোমার কাছেই চাইতে এলাম।দেওয়া যাবে?অবশ্য না দেওয়ার মত জিনিস চাইনি আমি।আই প্রমিজ,আমি ওসব ছেলেদের মত ডিস্টার্ব করব না।যাস্ট অল্পসল্প একটু কথা বলব
এই তো।দেওয়া যাবে?”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিলেন উনি।আর আমি ভাবলেশহীন চাহনিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।এখন উনাকে আমার আইডি দিতে হবে!এই ভাবতেই বিরক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল আমার।উটকো ঝামেলা তো।কিন্তু না দিয়ে উপায় কোথায়।সরাসরি না করতে ভালো দেখায় না।
এদিকে দিতেও মন চাইছে না ওদিকে কিভাবে না বলব সেটাও ভেবে পাচ্ছি না।সাতপাঁচ ভেবে অর্ণব ভাইয়াকে আইডি দিয়ে দিলাম।এতে যে উনি খুব খুশি হলেন তা উনার চেহারার হাবভাব দেখেই বুঝতে পারলাম আমি।উনাকে আইডি দেওয়ার খুশিতে আমার আর নদীর জন্য উনি অটো ঠিক করে দিয়ে দিলেন।
অটো ঠিক হয়েছে দেখে নদী কথা বলতে বলতেই হেঁটে এসে অটোতে উঠে পরলো।আমিও ওর পিছুপিছু অটোতে উঠে পরলাম।অটো ছাড়বার আগে অর্ণব ভাইয়া আমার উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন।অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভদ্রতাবশত জোরপূর্বক আমিও হাত নেড়ে বিদায় জানালাম।এর বদলে অর্ণব ভাইয়া উপহার দিলেন তৃপ্তির এক হাসি।

বাসায় পৌঁছে শাওয়ার নিয়ে নদী চলে গেলো প্রাইভেট পড়তে।আমি চলে আসলাম মেজ নানুর রুমে।প্রথমে রাইসা ভাবীর রুমে উঁকি দিয়েছিলাম।শরীর একটু খারাপ থাকায় সে এখন ঘুমাচ্ছে। আর পলাশ ভাইয়া তার পাশে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে।
পলাশ ভাইয়া আর রাইসা ভাবী ঢাকার বাসিন্দা। পলাশ ভাইয়ার অফিস ঢাকায় থাকায় বিয়ের পর তিনি রাইসা ভাবীকেও ঢাকা নিয়ে যায়।রাইসা ভাবী প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর তার যত্নআত্তির জন্য পলাশ ভাইয়া আবার এখানে চলে আসেন।পরিচিত লোক থাকায় রিকুয়েস্ট করায় উনাকে আপাতত এখানকার ব্রাঞ্চ অফিসে ট্রান্সফার করা হয়।
আমি প্রথমে অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে রাইসা ভাবীর বাপের বাড়ী থাকার পরও সে শ্বশুরবাড়ি কেনো আছে?মেয়েরা সাধারনত এ সময়ে শ্বশুরবাড়ি থাকতে চায় না।অথচ রাইসা ভাবী রয়েছে।এর কারনটা অবশ্য পরে জানতে পারি।রাইসা ভাবীর বাবা মা দুজনেই মারা গিয়েছে।চাচা চাচির কাছে বড় হয়েছে সে। তাই ভাবীর মতে এ সময়ে আপন চাচির চেয়ে আপন শ্বাশুড়ী বেশি যত্ন নিবে।হচ্ছেও তাই।সে এখানে বেশ আরামে আছে।

মেজ নানুর রুমে গিয়ে দেখলাম সে ঘুমাচ্ছে।এখানে এসেছিলাম গল্প করার আশায় কিন্তু নানু তো ঘুমাচ্ছে।অগত্যা গল্পের আশা ত্যাগ করে রুম থেকে বের হয়ে এলাম।তৎক্ষণাৎ কি মনে করে আবারো রুমে ঢুকলাম।একটু এগিয়ে বুক শেল্ফের সামনে দাঁড়ালাম।কিছু কিছু শেল্ফ একটু খালি খালি মনে হচ্ছে।হ্যাঁ ধরতে পেরেছি। আমার সে অসম্পূর্ণ বইটা সহ আরো কয়েকটা বই গায়েব।বুঝতে বাকি রইলো না বইগুলো কে গায়েব করেছে।
বুক শেল্ফের দিকে আরেক নজর তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম আমি।

.

আজ সকাল থেকেই আকাশের অবস্থা খুব একটা সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না আমার কাছে।ধূসর মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ।যেকোনো সময়ে ঝপাং করে বৃষ্টি নামতে পারে।চারপাশে বয়ে চলছে ঠান্ডা হাওয়া।হয়ত আশেপাশে কোথায় বৃষ্টি হয়েছে।
নদী প্রাইভেট থেকে ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই।সকালের নাস্তা সেরে দুজনে রুমে বসে আছি।আমি জানালার ধারে বিছানার উপর বসে আছি।আর নদী জানালার ধারে পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসে আছে।দুজনের মাঝে চলছে হালকা গল্পগুজব। গল্পের এক ফাঁকে নদী বলে উঠল,
“মিম আপু?বৃষ্টিতে ভিজবে? ”

নদীর প্রস্তাব শোনামাত্রই আমি খুশিতে আটখানা হয়ে বললাম,
“অবশ্যই অবশ্যই। বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে।কিন্তু আম্মু ভিজতে দেয়না বা সময় সুযোগ হয়ে উঠে না।লাস্ট বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম তাও প্রায় ২ বছর আগে।আজকে বৃষ্টি হলে অবশ্যই ভিজবো”

নদী এবার তার চেয়ার ছেড়ে আমার সামনে এসে বসলো।বেশ আনন্দের সুরে বলল,
“আমি তো প্রায়ই বৃষ্টিতে ভিজি।হুম বজ্রপাত হলে সেটা আরেক কথা।”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“ছোট মামি বকা দেয়না বৃষ্টিতে ভেজার জন্য?”

নদী আমার কথা শুনে হেসে ফেললো।হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলল,
“আম্মুর দ্বারা বকা হয় না বুঝছো আপু।খুব বেশি হলে ২ মিনিট একটু বকবে।তাও তেমন কড়া সুরে না।আম্মুর কাছে গিয়ে একটু ইমোশনাল কথাবার্তা বলব,ব্যস আম্মু গলে যাবে।বৃষ্টিতে ভেজার জন্য তাই করি।অবশ্য আম্মুর বদলে দাদি আর চাচি বকে দেয়।কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার প্রচন্ড ইচ্ছা থাকলে ওসব গায়ে মাখি না।”

নদীর কথা শুনে আমি অবাকের আর এক ধাপ উপরে চলে যাই।মনে মনে স্বগতোক্তি করলাম,ছোট মামি কত ভালো!
কণ্ঠে একটু বিস্ময়ভাব প্রকাশ করে বললাম,
“বৃষ্টিতে ভিজে তোমার জ্বর ঠান্ডা লাগে না?”

“আরে না।এখন এসব হয়না।আগে হত।কারন আগে বৃষ্টিতে ভিজতাম না বলে বৃষ্টির পানি স্যুট করত না।কিন্তু এখন প্রায়ই বৃষ্টিতে ভিজি বলে এমনটা হয়না।তোমার এমন কোনো রেকর্ড আছে নাকি?”

“আপাতত নেই।আশা করি সামনেও এমন রেকর্ড গড়বো না যে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে।
আচ্ছা? যেদিন বজ্রপাত হয়, সেদিনও কি বৃষ্টিতে ভিজো? ”

“বেশি বজ্রপাত হলে ভিজি না।অল্পসল্প হলে ভিজি।দোয়া করি,আজ যেন বজ্রপাত না হয়।তাহলে আরামসে বৃষ্টিতে ভিজতে পারব।”

“মামির কাছে পারমিশন নিবে না।”

“পরে নিব।বৃষ্টি তো আগে শুরু হোক।এখন পারমিশন নিতে গেলে যেতে দেওয়ার পসিবিলিটি কমে যেতে পারে।”

“হুম।ঠিক বলেছো।যাই হোক,এখন ওয়েট করতে হবে।”
এই বলে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।প্রায়ই সাথে সাথে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।তা দেখে নদী জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে বাচ্চাদের মত বলতে লাগল,
“ইয়ে……বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। চল আপু, এবার আম্মুর কাছে গিয়ে পারমিশন নিয়ে আসি।”
এই বলে সে আমার হাত ধরে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে আসে।দুই মামি তখন বসে বসে সবজি কাটছে আর নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে।আমাকে আর নদীকপ রান্নাঘরে দেখে দুই মামি কিছুক্ষণ ধরে আমাদের পর্যবেক্ষণ করলো।উনাদের গভীর পর্যবেক্ষণ শেষ হলো কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই।ছোট মামি চোখ নামিয়ে আবারো নিজের কাজে মনযোগ দিলেন।আর বড় মামি ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাস করল,
“কি চাই?”

নদী তা দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“বৃষ্টিতে ভিজতে চাই।”

বড় মামি এবার চোখ নামিয়ে কাজে মনযোগ দিলো।এমন ভাব ধরলো যেন কিছু শুনেননি।ওদিকে আমরা দুজন দাঁড়ীয়ে আছি এই কথার আশায় যে বড় মামি বলবে,’যা বৃষ্টিতে ভিজ।’
কিন্তু এমনটা হলো না।দুজনেই চুপচাপ বসে কাজ করছে।
খানিক বাদে বড় মামি বলল,
“কি হলো?দাঁড়ীয়ে আছিস কেনো?যা বৃষ্টিতে গিয়ে ভিজে আয়।”

বড় মামির কথা শেষ হতে সময় লাগলো তবে নদীর আমাকে টেনে নিয়ে যেতে সময় লাগল না।
“নদী?তুই একা যাবি।মিমকে সাথে নিয়ে যাচ্ছিস কেনো?”

ছোট মামির কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই দুজনে থমকে দাঁড়ালাম।সাথে সাথে আমি পিছনে ফিরে দুই মামির উদ্দেশ্যে বলি,
“প্লিজ মামিরা…আমিও বৃষ্টিতে ভিজি।”

বড় মামি এবার আদেশের সুরে বলল,
“তোমার জন্য বৃষ্টিতে ভেজা বারণ।”

আমি কিছু না বলে অসহায় দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকালাম।আমার চাহনিতেই নদী বুঝে গেলো আমি কি বলতে চাইছি।সে তৎক্ষণাৎ বড় মামির কাছে গিয়ে বলে,
“কেনো চাচি?বৃষ্টিতে ভেজা বারণ কেনো মিম আপুর জন্য?বৃষ্টিতে ভিজলে কি এমন হয়ে যাবে শুনি?”

বড় মামি এবার নদীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওর যদি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আসে তখন ওর মা কে কি জবাব দিব আমি?ওর খেয়াল রাখতে পারিনি, এটা বলব?”

বড় মামির কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।শেষমেশ এতদিন পর বৃষ্টিতে ভেজার সুযোগ হাতছাড়া করতে হবে!নাহ,এ সুযোগ খোয়ানো যাবে না।অন্যান্য দিন বেশ বজ্রপাতসহ বৃষ্টি হয়।কিন্তু আজকে এখন পর্যন্ত বজ্রপাতের আওয়াজ শুনি।এর মানে আজকে মন খুলে বৃষ্টিতে ভেজা যাবে।আর সে সুযোগ হারিয়ে ফেলবো!মোটেও না।
আমি আর দেরি না করে মামির কাছে রিকুয়েস্ট করলাম।কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। পরে অনেক ইমোশনালি কথাবার্তা বললাম।তাদের আশ্বস্ত করলাম যে আমার জ্বর আসবে না।কারন এর আগেও আসেনি।তাই আজও আসবে না।
আমার কথায় দুই মামির মন গললো
এবং অবশেষে তারা রাজিও হলো।

সামনের উঠোনে আমি আর নদী আরামসে বৃষ্টিতে ভিজছি।এ বছরের বৃষ্টির প্রথম ছোঁয়া পেতেই আমার সারা শরীরে কম্পন উঠে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম খুব ঠান্ডাও লেগেছিল আমার।দাঁতে দাঁত বারি খেয়ে কিটকিট আওয়াজ করছিল।সে আওয়াজ থামতেও বেশ সময় লেগেছে।আমার দাঁতের এই কিটকিটানি আওয়াজ দেখে নদীর তো হেসেই গড়াগড়ি খাওয়ার মত অবস্থা।
সে হাসির দমকে কথাই বলতে পারছিলো না।পরে হাসতে হাসতেই সে বলল,
“আপু…তোমাকে দেখে বোঝা গেল শীত কত প্রকার ও কি কি।”

আমি সরু চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমি বেশ শীতচোরা মানুষ।তাই বলে কথা শুনাবা না। হুহ।”

আমার কথা শুনে নদী আবারো হাসতে লাগল।বেশকিছুক্ষন পর তার হাসি থামার পর সে বলল,
“আপু,চলো ঐ আম গাছটার কাছে যাই।”

“চলো।”

বৃষ্টির গতি কম হচ্ছে না।বরং মনে হচ্ছে ধীরেধীরে এর গতি বাড়ছে।আকাশ আগের তুলনায় একটু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।কিন্তু মুষুলধারে বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
নদী আমাকে নিয়ে একটা আম গাছের কাছে এসে বলল,
“আপু,তুমি কি গাছে উঠতে পারো?”

“উঁহু। জীবনেও গাছে উঠিনি।”

আমার কথা শুনে নদী কাছের একটা বড় আম গাছের নিচু ডাল দেখিয়ে বলল,
“এখানে উঠতে পারবে না?তুমি এখানে বসবে আর আমি উপরের ডালে উঠবো।তারপর দুজন মিলে বৃষ্টিতে ভিজবো আর গল্প করব।”

“এখানে উঠা কোনো ব্যাপার না।বাট তুমি অতো দূর উঠবে কি করে?বৃষ্টির জন্য গাছের ডালপাল পিছলা হয়ে যায়নি?”

“হয়েছে তো।কিন্তু অনেক কম।আর আমি পিছালাবো না।আমার অভ্যাস আছে।”
এই বলে সে বাঁদরের মত তড়তড় করে গাছে উঠে গেলো।আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম।ইশ,গাছে উঠার কত শখ ছিল আগে।কিন্তু পারতাম না।এখনও পারিনা।

ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে আমি গাছের নিচু ডালটায় বসলাম।এই ডালটা এত নিচু যে এখানে বসার ফলে পায়ের পাতা দুটো মাটির সাথে লেগে যাচ্ছে।অঝোর ধারায় বৃষ্টি হওয়ার ফলে সে মাটিতে বেশ খানিকটা পানি জমেছে।
আমি গাছের ডালে বসে বসে মনের আনন্দে পা দুটো নাচিয়ে নিচে জমে থাকা পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছি।এদিকে পা চলছে পানি নাচানোর কাজে।ওদিকে মুখ চলছে নদীর সাথে গল্প করার কাজে।মনটা আমার আনন্দে নাচন ধরেছে। কিন্তু আমার মনের এ আনন্দের নাচন একজনের সহ্য হলো না।আর সেই একজন হলেন আদ্রিশ ভাইয়া।
মাথার উপর কালো একটা ছাতা ধরে উনি এগিয়ে এসে আমাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন।উনাকে এখানে আসতে দেখেই আমি দ্রুত ডাল থেকে নেমে গাছের পিছনে লুকিয়ে পরি।এই ভেজা অবস্থায় উনার সামনে থাকা উচিত না বলেই এ কাজটা করা।
আমাকে লুকিয়ে যেতে দেখে উনি শীতল চাহনিতে আমার দিকে এক নজর তাকালেন।পরমূহুর্তেই নদীর উদ্দেশ্যে ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
“এখনি গাছ থেকে নাম বলছি।নাহলে আমি বিকেলে চাচুকে বলে দিব তুই বৃষ্টিতে ভিজছিলি আর গাছেও উঠেছিলি।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে নদী দ্রুত ডাল থেকে নামতে নামতে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
“এই না না ছোট ভাইয়া। আব্বুকে বলো না প্লিজ।আব্বু আমাকে আস্ত রাখবে না।”

নদী নিচে নেমে আমার উদ্দেশ্যে বলল,
“চলো আপু।বাড়ীর ভিতর চলে যাই। ”

নদীর কথা শুনে আমি এক নজর আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।চশমা ছাড়া ঝাপসা দেখছি।তবে অস্পষ্ট নজরে দেখে বুঝলাম, উনাকে এখন একজন কড়া গার্জিয়ানের চেয়ে কম লাগছে না।তবে পরনের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের ফলে অবয়বের দিক দিয়ে পিচ্চি গার্জিয়ান লাগছে।আর ভ্রুকুটি করা গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা দেখে বড় গার্জিয়ান লাগছে।
উনি এক হাত দিয়ে ছাতা ধরে অপর হাত পকেটে গুঁজে ভ্রুজোড়া কুঁচকে দাঁড়ীয়ে আছেন।
আমি নদীকে একটু ইতস্তত করে বললাম,
“আদ্রিশ ভাইয়াকে চলে যেতে বলো না নদী।আমি ভেজা কাপড় নিয়ে উনার সামনে দিয়ে কিভাবে যাব?”

নদী আমার কথা বুঝতে পেরে আদ্রিশ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“ছোট ভাইয়া,তুমি যাও। আমরা তোমার পিছে আসছি।আসলে জামাকাপড় ভেজা বলে….”
নদীর কথা শেষ হতে না হতেই আদ্রিশ ভাইয়া চলে গেলেন।সাথে সাথে আমরাও চলে আসলাম বাড়ীর ভিতর।

.

কিছু না চাইতেই পেয়ে যাওয়া,ব্যাপারটা সবসময় সুখকর হয়না।আমার ক্ষেত্রেও এখন এমনটা হয়েছে।না চাইতেও জ্বরের সাক্ষাৎকার পেতে হচ্ছে।কখনো ভাবিনি এ বৃষ্টির পানিতে ভিজে জ্বর এসে যাবে।তাও আবার অল্পসল্প জ্বর নয়।পুরো বাহিনি নিয়ে নেমেছে সে।
বৃষ্টিতে ভেজার পর আবারো শাওয়ার নিয়ে আসতেই টনটনে করে মাথা ব্যাথা হানা দিলো।তখন অল্প পরিসরে তা থাকলেও দুপুরের খাবারের পর তা বিস্তর আকার ধারণ করে।মাথা ব্যাথা কমানোর জন্য তখন ঘুমিয়ে পরি।পরে সন্ধ্যার একটু পর ঘুম ভাঙতেই খেয়াল করলাম আমার শরীর প্রচন্ড গরম।সাথে হালকা ব্যাথাও ফ্রি।কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি।আমি চেষ্টা করছি বড় মামির কান অব্দি যেন আমার জ্বরের কথা না যায়।কিন্তু বলে না, যে কথা বেশি লুকানো যায় সে কথা বেশি দ্রুত সামনে আসে।আমার জ্বরের বিষয়টাও সেরকম।
সন্ধ্যায় শুয়ে থাকার সময় রাইসা ভাবী আমার পাশে বসে গল্প করার জন্য।নদী তখন পড়ছিল। রাইসা ভাবী কথা বলছিল আর আমি শুনছিলাম।জ্বরের কারনে চোখ খুলতে পারিনি।কথাও কেমন জড়িয়ে এসেছিল।তাই দু একটা কথা বাদে কথা বলিনি।এসব দেখে রাইসা ভাবী আমার কপালে হাত দিয়ে টের পেলো আমার জ্বর এসেছে।সে আর দেরি না করে নদীকে বলল।আর নদী পুরো বাড়ীতে রটিয়ে দিলো আমার জ্বর এসেছে।আমার নিষেধাজ্ঞা প্রচার করতে করতেই এ দুজনের সংবাদ প্রচার করা শেষ।
সবাই একে একে এসে আমার জ্বরের অবস্থা দেখে গেল। ঘুম আর জ্বরের জন্য চোখ বুজে আসছে আমার।তবুও চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করছি।বড় মামি আমার পাশে বসে নিরবে কাঁদছে।আমার এ অবস্থার জন্য নিজেকে দোষারোপ করছে।কথা জড়িয়ে আসার পরও আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি কান্না না করতে। কিন্তু মামি শোনার পাত্র নয়।শেষমেশ আমার অবস্থা দেখে ছোট মামি পলাশ ভাইয়াকে বলল মামিকে রুমে নিয়ে যেতে।
যাওয়ার আগে আদ্রিশ ভাইয়াকে কড়া নির্দেশ দিয়ে গেল,আমাকে যেন রাতের ভাত খাইয়ে ওষুধ খাওয়ানো হয়।কোনো রকমের হেলাফেলা চলবে না।আদ্রিশ ভাইয়া রাজিও হলেন।
উনি এতক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়ীয়ে নিরবে সব দেখছিলেন।চোখেমুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কারনটা স্পষ্ট নয়।
বড় মামি রুমে যেতেই ছোট মামি এক প্লেট ভাত নিয়ে এসে আমার পাশে বসে।ওদিকে ভাত দেখে গা গুলিয়ে আসছে আমার।মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে উঠেছে।ঢোক গিলতেও অসহ্য লাগছে। খুব কষ্টে ছোট মামির কাছ থেকে দু লোকমা ভাত খাওয়ার পর আর খেতে পারলাম না।শরীর একটুও ভালো লাগছে না।ছোট মামি তৃতীয় লোকমা আমার মুখের কাছে আনতেই আমি মুখ ফিরিয়ে কষ্টেসৃষ্টে বললাম,
“মামি,আমি আর খেতে পারছি না।প্লিজ নিয়ে যাও।”

ছোট মামি বেশ আদুরে গলায় বলল,
“আর চার লোকমা খাবে,এই তো।পুরো ভাত খেতে হবে না।শুধু চার লোকমা খাবে।”

“না মামি। প্লিজ।আমি গলা দিয়ে ভাত নামাতে পারছি না।ভালো লাগছে না।”

“দেখো মা,তোমার শরীরের খেয়াল রাখা আমাদের দায়িত্ব।ভাত না খেলে দূর্বল লাগবে।ওষুধ খাওয়ার পর তো আরো দূর্বল লাগবে।”

“আমি সামলে নিব মামি।আজ রাতে ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবো।কিন্তু এখন আমি ভাত খেতে পারব না।”

ছোট মামি হয়ত আরো কিছু বলতেন।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়ার জন্য বলতে পারলেন না।উনি নদীর চেয়ার ছেড়ে উঠে ছোট মামির কাছ থেকে প্লেটটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
“ভাত সম্পূর্ণ শেষ না করে যাবে কোথায় ও।আমি যদি আজ ওকে এ ভাতগুলো খাইয়ে না দিতে পেরেছি তবে আমার নাম আদ্রিশ না।”
এই বলে উনি এক লোকমা ভাত তুলে আমার মুখের সামনে ধরলেন।
আমি হা করে উনার কাজ দেখছি। উনি আমাকে খাইয়ে দিবেন কেনো!আজব তো।
আমি মুখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,
“আমি তো বললাম আমি ভাত খাব না।”

এবার আদ্রিশ ভাইয়া ধমকের সুরে বললেন,
“এই যে এদিকে তাকাও।”

আমি না তাকিয়ে আগের মতই মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।আদ্রিশ ভাইয়া এবার ছোট মামির উদ্দেশ্যে বললেন,
“চাচি, আমার রুম থেকে ওষুধের বক্স আর এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো।একে পুরো ভাত খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি ছোট মামির দিকে তাকালাম।উনার চোখেমুখে সুক্ষ্ম বিস্ময়ের ছাপ।নিশ্চয় আদ্রিশ ভাইয়ার কাজে বিস্মিত তিনি।
মামি চলে যেতেই উনি আবারো আমার মুখে সামনে ভাত নিয়ে খেতে বললেন।এদিকে আমার গালের ভিতরটা আগের চেয়েও তেতো লাগছে।বিরক্ত লাগছে খুব।আমি বিরক্ত নিয়েই জড়ানো কণ্ঠে বললাম,
“আপনি প্লিজ প্লেট নিয়ে যান।আমি খাব না তো।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার এক ধমক দিয়ে বললেন,
“আর একটা কথাও যদি বলেছো তো কানের নিচে দু চারটা ঘা বসিয়ে দিব।ভাত,ওষুধ আর পানি খাওয়া ছাড়া মুখ খুলবে না।নাও হা করো।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথার ধরন শুনে আমি রীতিমত হতভম্ব।উনি আমাকে ধমক দিলেন!কোন সাহসে এ কাজ করলেন উনি!বেয়াদব লোক কোথাকার।
আমি মুখ না খুলেই বসে ছিলাম। তা দেখে আদ্রিশ ভাইয়া আবারো ধমক দিলেন।এবার আমার রীতিমত কাঁদোকাঁদো অবস্থা।এভাবে এ ছেলের কাছে ধমক শুনবো তা কখনও ভাবিনি।মানুষ জ্বরের সময় আশা করে আদরের।আর এখানে আমি এখন বকা শুনছি! চোখজোড়া আমার পানিতে ভিজে এলো প্রায়।আমি কোনোমতে কান্না আটকিয়ে হা করে ভাত মুখে পুরে নিলাম।সাথে সাথে আদ্রিশ ভাইয়ার ঠোটের কোনে দেখতে পেলাম বিজয়ের এক হাসি।তা দেখে রীতিমত আমার শরীর জ্বালাপুড়া করছে।এসবের শোধ আমি তুলবোই এক সময়ে।সেই অপমানের শোধ সাথে এ ধমকের শোধ।সব সুদেআসলে মিটিয়ে দিব।
ভাত খাওয়া শেষে উনি আদুরে একটা হাসি দিয়ে বললেন,
“এই তো লক্ষী মেয়ে।শুরুতে খেয়ে নিলে এই ধমক দেওয়া লাগতো না।”

আমি কিছু না বলে রাগান্বিত চোখে উনার দিকে তাকাই।এতে উনার ভ্রুক্ষেপ নেই।প্লেট রেখে উনি পাশের টেবিল থেকে ওষুধ আর পানি নিয়ে আমার সামনে এসে ধরলেন।মামি বেশকিছুক্ষন আগেই তা রেখে গিয়েছিল।
আদ্রিশ ভাইয়ার হাতের ওষুধ দেখে রীতিমত নাজেহাল অবস্থা আমার।আমি যে বড় ওষুধ ভাঙা ছাড়া খেতে পারিনা তা উনার সামনে কি করে বলব!
আমি ওষুধের দিকে তাকিয়ে আছি বলে উনি এবার বললেন,
“মিশমিশ,এবার ঝটপট ওষুধটা খেয়ে নাও।এবার আর ধমকাতে চাইছি না আমি।”

‘মিশমিশ’!!আমি কি ঠিক শুনছি। নাকি ভুল?উনি কি চাশমিশ বলতে গিয়ে এটা বললেন?আমি কণ্ঠে যথাসম্ভব বিস্ময় প্রকাশ করে জিজ্ঞাস করলাম,
“আপনি কি বললেন?”

উনি স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,
“কি বললাম?”

“এই যে ওষুধ খাওয়ার কথা বলার আগে।”

উনি আমার কথা বুঝতে পেরে বললেন,
“মিশমিশ বললাম।”

“কেনো?”

“আমার ইচ্ছা করেছে তাই।”

“আপনার ইচ্ছাতে সব হয়না।আমি বলেছি আমার নামে ডাকলে ডাকবেন নাহলে না।”

“তো আমিও বলেছিলাম যে তোমাকে ঐ নামে ডাকবো না।তুমি চাও আর না চাও এই চাশমিশ মিমের নাম আমি মিশমিশ দিয়েছি আর সে নামেই ডাকব।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা আমার কানে কেমন যেন অদ্ভুত শোনালো।তবে ভালোও লাগলো।কিন্তু অতিদ্রুত সব কথা চিন্তা করে আমি এ ভালো লাগাটাকে পাশ কাটিয়ে উনার হাত থেকে ওষুধ নিলাম।শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ওষুধ ভাঙার চেষ্টা করলাম।কিন্তু সফল হলাম না।শেষমেশ আর উপায় না পেয়ে আমি মিনমিনে সুরে আদ্রিশ ভাইয়াকে বললাম,
“ওষুধটা একটু ভেঙে দিন না..আমি শক্তি পাচ্ছি না।”
এই বলে আমি মাথা নিচু করে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে ওষুধটা এগিয়ে দিলাম।স্পষ্ট শুনতে পেলাম উনার হাসির শব্দ।আস্তে হাসছেন তিনি।আমি তা বুঝতে পেরেই উনার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালাম।সাথে সাথেই উনি জোরসে হেসে দিলেন।আমার ওষুধ ভেঙে খাওয়া দেখে যে উনার হেসেই কুপোকাত হওয়ার অবস্থা তা আমার মোটেও সহ্য হলো না।আমি রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম,
“দিন আমাকে দিন।আপনার ভাঙা লাগবে না।”
উনি হাসতে হাসতেই প্যারাসিটেমল দুভাগ করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“মিশমিশ,তুমি এত বাচ্চা!!আল্লাহ!আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।তুমি এখনও বাচ্চােদর মত ওষুধ ভেঙে খাও!”এই বলে উনি দু হাত দিয়ে পেট চেপে হাসতে লাগলেন।
অপমানে রীতিমত শরীর জ্বালা অবস্থা আমার।মন চাইছে ঠাস করে উনার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে হাসি বন্ধ করে দেই।বেয়াদব লোক কোথাকার।
আমি রাগে অপমানে ওষুধটা খেয়ে বললাম,
“কোনো জোকস বলেনি আমি যে আপনি এতো হাসছেন।এটা একটা সাধারণ বিষয়।বড় ওষুধ আস্ত খেলে আমার গলায় আটকে যায় বলে এভাবে খাই।ছোট থেকে এ অভ্যাস।বড় হওয়ার পর একবার ট্রাই করেছিলাম আস্ত ওষুধ খাওয়ার।কিন্তু বিফল হয়েছিলাম।
এবার আপনি হাসবেন না কিন্তু।”
শেষের কথাটা রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম।
আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া নিজের ঠোটের উপর আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ করে রইলেন।কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাত্র।তারপর আবারো ফিক করে হেসে ফেললেন।হাসির দমকে যেন উনি উল্টিয়ে যাচ্ছেন।
“মিশমিশ ইজ এ বেবি গার্ল।মিশমিশ ইজ এ বেবি গার্ল….”
এই বলতে বলতে উনি রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।আর আমি রাগে বিছানার চাদর খামচে ধরলাম।

®সারা মেহেক

#চলবে