ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-০৭

0
980

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

“এই মাধবীলতা,
চিনো কি আমায় যে তোমাতে মত্ত হতে চাই?
চিনো কি আমায় যে তোমাতে হারিয়ে যেতে চাই?
চিনো কি আমায় যে তোমার একটুখানি পরশ পেতে চাই?
চিনো কি আমায় যে তোমার স্পর্শে তৃষ্ণা মেটাতে চাই?”

চিঠিতে লেখা কবিতার প্রতিটি শব্দ আমার মনে ভয়ের এক নতুন ঢেউ জাগিয়ে তুললো।হৃদপিন্ড তুমুল গতিতে ছুটে চলছে।হাত পা অল্পবিস্তর কাঁপছে।
হুট করে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগে উঠল,এ চিঠিটা কি আদৌ আমার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে?এ রুম তো আমার নয় নদীর।তাহলে কি চিঠিটা তার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছে?হুম এটাই হতে পারে।এমনটা না হলেও এখন এমনটা হতেই হবে।অন্ততপক্ষে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হলেও এটা হতে হবে।কিন্তু যদি এমনটা না হয়?যদি চিঠিটা আমার উদ্দেশ্যেই পাঠানো হয়ে থাকে?কিন্তু আমাকে চিঠি কে দিবে?অর্ণব ভাইয়া?কিন্তু সে কেনো চিঠি দিতে যাবে তাও আবার এমন সম্বোধনে?আজ দুপুরেই তো কথা হলো তার সাথে।এরপরও এমন ধরনের চিঠি পাঠানোর মানে কি?উফ,মাথা ধরে গেলো আমার।যত্তসব দুশ্চিন্তার মেশিন এসে আমার কাছেই জড়ো হয়।
এমন নাম ঠিকানাবিহীন এক উড়োচিঠি দেখে কিছু বুঝার উপায় নেই যে কে কার উদ্দেশ্যে চিঠিটা পাঠিয়েছে।এদিকে ভয় হচ্ছে ওদিকে টেনশনও হচ্ছে।তাহলে নদীকে কি একবার জিজ্ঞাস করা উচিত যে সে কাউকে পছন্দ করে কি না?বা তাকে কেউ পছন্দ করে কি না?কিন্তু এসবের একটাও যদি না হয় তখন তো এই চিঠির ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে।আর এমনটা হলে যদি সবাই আমাকে খারাপ ভাবে!না থাক দরকার নেই এসব বিষয়ে জানানোর।আমি বরং চিঠিটা ফেলে দেই।হুম এটাই ভালো হবে।
“এই মিম আপু,নাস্তা খেতে আসো।”
হঠাৎ নদীর কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই ভয়ে বুকটা ধ্বক করে উঠল।সাথে সাথে হাতে থাকা চিঠিটা দ্রুত জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম।ওদিকে নদী ডেকেই চলছে।তাই আমি আর দেরি না করে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে ডাইনিং এ চলে আসলাম নাস্তা করতে।

.

সারারাত আমার ঘুম হয়নি সে উড়োচিঠির দুশ্চিন্তায়।আমি চাইতাম আমার জন্য কেউ এমন কবিতা লিখুক। এরও আগে চাইতাম লুকিয়ে লুকিয়ে কেউ একজন আমাকে চিঠি লিখুক।কিন্তু এসব চাওয়া আজ নিমিষেই খতম হয়ে গেল সেই উড়োচিঠি পেয়ে।ভালো লাগার কোনো অনুভূতি তো হলোই না বরং ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো।

সকালে খাওয়াদাওয়া শেষে আমি নদীর রুমে এসে সময় কাটাতে লাগলাম।নদী প্রাইভেট থেকে এসে খাওয়াদাওয়া করে পড়তে বসেছে।তার বিকেলের প্রাইভেটের পড়া শেষ করার জন্য।এদিকে আমি ফোন চালাচ্ছি। হঠাৎ মেসেঞ্জারে অর্ণব ভাইয়ার আইডি থেকে মেসেজ এলো।উনার রিকুয়েস্ট গতদিনই একসেপ্ট করেছি।এরপর কোনো কথা হয়নি।কিন্তু আজ কথা কেনো?এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই উনার মেসেজ ওপেন করলাম।
“কেমন আছো মিম?”

অর্ণব ভাইয়ার প্রশ্নের সোজাসুজি জবাব দিলাম,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও ভালো আছি।
আচ্ছা,তোমাকে একটু কল করা যাবে?”

“কেনো?মেসেজে বললে কি সমস্যা?”

“কথাটা জরুরী। মেসেজে ভালোভাবে বলা সম্ভব না।কলে কথা বলতে সমস্যা হলে বলো,এখনই এসে দেখা করে কথা বলছি।”

“না না দরকার নেই।আপনি কলই করুন।”
অগত্যা এতেই রাজি হতে হলো।একটু বিরক্তও লাগছে উনার উপর।কি এতো জরুরী কথা বলবে কে জানে।
নদীর সামনে কথা বলতে কেমন যেন লাগবে বিধায় আমি উঠে বাড়ীর পিছনের ছোট্ট উঠোনটায় চলে আসি।আমার সেখানে পৌঁছানোর সাথে সাথে অর্ণব ভাইয়া মেসেঞ্জারে কল করলেন।কল রিসিভ করার সাথে সাথেই আমার কানে ভেসে এলো চিন্তিত এক কণ্ঠস্বর।
“মিম?তুমি কি কোনো কাগজ পেয়েছো?”
আমি বুঝতে না পেরে বললাম,
“কোন কাগজের কথা বলছেন আপনি?কিসের কাগজ?”

অর্ণব ভাইয়া এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“যাক বাবা।বেঁচে গেলাম।তুমি লেখাগুলো দেখোনি।”

অর্ণব ভাইয়ার কথা শোনামাত্রই গতকালের সেই উড়োচিঠির কথা মনে পরে গেলো আমার।তাহলে কি এই উড়োচিঠির মালিক অর্ণব ভাইয়া?

“আর যদি দেখেই থাকো,তবে ভুলে যাও সে কাগজের কথা।কি লেখা ছিলো তাও ভুলে যাও।কারন কাগজটা আমি ইচ্ছাকৃত পাঠায়নি।অন্য একটা কাগজের সাথে উল্টাপাল্টা হয়ে গিয়েছিল। আমার চাচাত ভাইকে দিয়ে অন্য একটা কাগজ পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ভুলে অন্য কাগজ নিয়ে গিয়েছে।”

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেললেন উনি।এদিকেও আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।সারারাতের টেনশনটা দূর হলো আপাতত।তার মানে ঐ চিঠি অর্ণব ভাইয়া পাঠিয়েছে তবে ভুলক্রমে।ওসব চিঠি দিয়ে কোনো কাজও নেই।আমি তো তা ফেলে দিয়েছি।এবার আর দুশ্চিন্তা নেই।
“মিম?তুমি কি কাগজের লেখাগুলো সত্যি পরেছো?”
অর্ণব ভাইয়ারসন্দেহের সুরে হঠাৎ করা প্রশ্নের আমি হুট করে জবাব দিয়ে দিলাম।
“না ভাইয়া আমি কোনো লেখা পড়িনি।”

“যাক ভালো।আচ্ছা তাহলে রাখছি। কাজ আছে।”

“জ্বি আচ্ছা ভাইয়া।”এই বলে আমিই খট করে লাইন কেটে দিলাম।মনের মধ্যে শান্তির পায়রাগুলো উড়ছে।কত যে টেনশনে ছিলাম তা আমিই জানি।এমন অপরিচিত জায়গায় এসে এমন চিঠি পাওয়া কারোর পক্ষেই কাম্য নয়।আমার পক্ষেও নয়।

আমি ফোনটা হাতে নিয়ে রুমে চলে এলাম।ভাবতে লাগলাম অর্ণব ভাইয়া তাহলে কবিতাও লিখে?কবিতাটা কার উদ্দেশ্যে লিখতে পারে?যার উদ্দেশ্যেই লিখুক এখন মনে হচ্ছে কবিতাটা বেশ সুন্দর।আগে কবিতা পড়তে মোটেও ভালো লাগতো না আমার।তবে ইদানিং কবিতা পড়তে বেশ ভালোই লাগে।এই যেমন এখন হুট করে দু চার লাইনের ছোট্ট কবিতাগুলো পড়তে মন চাইছে। আমার মনের ইচ্ছা পূরণ করতেই বিছানায় বসে নেটে কয়েকটা কবিতা সার্চ দিলাম।

.

বিকেলের প্রাইভেট থেকে ফিরবার পথে নদী দুটো কোন আইসক্রিম কিনে আনে।একটা তার জন্য অপরটা আমার জন্য।প্রথমে সে রাইসা ভাবীর জন্যও আনতে চেয়েছিল।কিন্তু ভাবী প্রেগন্যান্ট বলে আর আনেনি।

আমি আর নদী বড় উঠোনের ছায়া দেওয়া একটা আম গাছের নিচে দাঁড়ীয়ে মনের সুখে আইসক্রিম খাচ্ছি।সাথে আইসক্রিম নিয়ে নানা গল্পও করছি।
সূর্য্যিমামা এখন গোধূলি লগ্নে।চারপাশে মিষ্টি সোনালী আভা ছেয়ে আছে।নদীর চোখেমুখে সোনালী এক আভা ছড়িয়ে পরেছে। তার ফর্সা মুখটা এখন হালকা তামাটে বর্ণ ধারন করেছে। খুব সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে।

চারপাশে মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আমার আর নদীর ছেড়ে দেওয়ার চুলগুলো অবাধ্য নাচন ধরেছে।নদী তার চুল খোলা রেখেছে ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করার জন্য।আর আমার চুলগুলো আমি খোলা রেখেছি শুকিয়ে যাওয়ার জন্য।দুপুরের পর থেকে এখনও পুরোপুরি শুকায়নি।আশোপাশে কেউ নেই বলে নিশ্চিম্তে চুল খোলা রেখেছি।

“কি খাচ্ছিস নদী?”
আমাদের কথার মাঝেই কোথা থেকে যেন আদ্রিশ ভাইয়া টপকালেন।উনার হুট করে এমন টপকানো দেখে আমি একটু চমকে উঠলাম।খোলা চুলের উপরই দ্রুত মাথায় ওড়না দিয়ে নিলাম।পরনের চশমাটা নাকের ডগার কাছে চলে এসেছিল প্রায়।বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা যথাস্থানে রেখে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।চোখেমুখে যথাসম্ভব বিরক্তিভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম।যাতে উনি তা দেখে বুঝতে পারেন,উনার উপস্থিতিতে আমি চরম বিরক্ত।এমনটা মনে হলে যদি এ জায়গা ছাড়তো তাহলে ভালো হতো।কিন্তু উনি জায়গা ছাড়লেন না।বরং আরো শক্তপোক্তভাবে যেন এখানে নিজের খুঁটি গেড়ে দিলেন।আমার মুখের হাবভাব দেখেও হয়ত না দেখার ভান করলেন উনি।অসহ্য বেয়াদব লোক একটা।

আদ্রিশ ভাইয়া এক হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছেন।অপর হাত বাইরে।ড্রেসআপ দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই বাইরে থেকে ফিরেছেন উনি।
উনি আমার দিকে এক নজর ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে নদীকে বললেন,
“বাচ্চাদের আইসক্রিম খেতে হয় না জানিস না?এরা জ্বর বাঁধিয়ে ফেলতে পারে তো।”
এই বলে উনি বাঁকা হাসলেন।আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ইঙ্গিতটা আমার দিকেই করা হয়েছে।
আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
“একদিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছি বলে এই না যে ঠান্ডার ধারের কাছে গেলেই আমি আবারো জ্বর বাঁধাবো।আর একটা কথা কানে ঢুকিয়ে বসিয়ে রাখুন।আমি মোটেও বাচ্চা নই।”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া মুখ লুকিয়ে হেসে নিলেন।ওদিকে নদী নিজের মত আইসক্রিম খাচ্ছে।আইসক্রিম গলে যাবার ভয়ে আমি আর কথা না বাড়িয়ে আইসক্রিম খেতে লাগলাম।

এতক্ষণ আদ্রিশ ভাইয়া চুপ করে দাঁড়ীয়ে ফোন চালাচ্ছিলেন।হঠাৎ করেই কি ভেবে উনি নদীর মাথায় গাট্টি মেরে বললেন,
“এসব কি অখাদ্য খাচ্ছিস নদী?ছি,এসব কেউ খায়।কেঁচো,পোকামাকড় দিয়ে বানানো জিনিস খাচ্ছিস! ছি,ইয়াক।”
মূহুর্তেই গা গুলিয়ে এলো আমার।আইসক্রিম খাওয়ার মাঝপথেই তা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে আনলাম আমি।নদীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে অসহায় দৃষ্টিতে আইসক্রিমের দিকে চেয়ে আছে।কোনের একদম শেষাংশ খাচ্ছিলো সে।

আমাদের দুজনের অবস্থা বুঝতে পেরে প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো আদ্রিশ ভাইয়ার উপর।উফ,আমার শান্তি লোকটা একটুও সহ্য হয়না।কোন জন্মের শত্রু ছিলাম উনার কে জানে।শান্তিতে একটু আইসক্রিমও খেতে দিল না আমাকে।কি দরকার ছিল এসব গা ঘিনঘিন করা কথাবার্তা বলার।উনার কথাগুলো কানের কাছে বাজতে লাগলো আর ওদিকে পেটের মধ্যে গুলিয়ে যেতে লাগলো সব।আমার এ অবস্থা দেখে উনার চোখেমুখে ফুটে উঠলো শয়তানি এক হাসি।নিশ্চয় উনি মনে মনে ভেবেছেন উনার কথায় প্রভাবিত হয়ে আইসক্রিমটা ফেলে দিবো আমি।আর এতেই উনি জিতে যাবেন।নাহ, এমনটা মোটেও হতে দেওয়া যাবে না।আমার শান্তি নষ্ট করে উনি জিতে যাবেন, তা হতে দেওয়া যায়না।

নিজেকে শক্ত করে চোখেমুখে ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব ফুটিয়ে নদীর উদ্দেশ্যে বললাম,
“আরে নদী,এমন মুখ করছো কেনো।কেউ এমনটা বলবে আর সেটাই হয়ে যাবে তা হয় নাকি।তুমি কি সত্যি সত্যি ভেবে নিয়েছো নাকি যে এত পরিচিত কোম্পানির আইসক্রিম এসব দিয়ে তৈরী?আরে নূন্যতম একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতেও তো এসব করবে না।তুমি খাও তো।”
এই বলে আমি আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কিছু কিছু মানুষের কাজই হলো বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা।”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া মুখ বাঁকিয়ে হেসে দিলেন।আমার দিকে তাকিয়ে চোখেমুখে শয়তানি এক ভাব ফুটিয়ে তুলে নদীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভালোমত আইসক্রিম খা নদী।চিবিয়ে চিবিয়ে খা।চেটেপুটে খা।”

নদী এবার অসহায় কণ্ঠে বলল,
“ছোট ভাইয়া,তুমি কিন্তু বেশি বেশি করছো।শুধুশুধু আমাদের আইসক্রিম খাওয়ার মজা নষ্ট করছো তুমি।”

“মজা নষ্ট করলাম কোথায়।যা সত্য তাই বলছি।মানতে হলে মান, নাহলে না মান।”

আমি এবার একটু রাগান্বিত সুরে বললাম,
“নদী তুমি খাও তো আইসক্রিমটা।শুধুশুধু শেষের সবচেয়ে মজার অংশ মিস করো না।মনে করো,কিছুই শুনোনি তুমি।আমিও এমনটাই করছি।”
এই বলে আমি কোনের শেষের অংশটুকু খেয়ে ফেললাম।আমার দেখাদেখি নদীও এক নিঃশ্বাসে শেষাংশটুকু খেয়ে ফেললো।
খাওয়া শেষে আমি আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে বিজয়ী ভঙ্গিতে তাকালাম।বড় শান্তি লাগছে মনের ভেতর। উনাকে হারাতে পেরে মনটা নেচে বেড়াচ্ছে।
আমার এ শান্তি শান্তি ভাব হয়তো উনার সহ্য হলো না।তাই তো কিছু না বলে শুধু একটু হাসি দিয়ে চলে গেলেন বাড়ীর ভেতর।

.

সকাল প্রায় এগারোটা বাজে।বাড়ীতে কারেন্ট নেই।এতক্ষণ রাইসা ভাবীর সাথে রুমে বসে গল্প করছিলাম।কিন্তু প্রচন্ড গরমে আর রুমে থাকতে ইচ্ছা করছিলো না।তাই রাইসা ভাবীকে বলে বড় উঠোনে চলে আসলাম।উদ্দেশ্যে আম গাছের ছায়ায় দাঁড়ীয়ে থেকে ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করা।
নদী এখনও প্রাইভেট থেকে ফিরেনি বলে একাই এখানে আসতে হলো।

বড় আম গাছের নিচের নিস্তব্ধ পরিবেশে দাঁড়ীয়ে দাঁড়ীয়ে সময়টা উপভোগ করছি। ঘামে ভিজে থাকা পরনের সালোয়ার কামিজ খুব শীঘ্রই শুকিয়ে যেতে শুরু করলো।
জামাকাপড় শুকিয়ে যাওয়ার পর চোখজোড়া বন্ধ করলাম আমি।মনমস্তিষ্ক শান্ত করার চেষ্টায় হাত দুটো দুপাশে প্রসারিত করলাম।চারপাশে হওয়া প্রতিটা শব্দ কান পেতে শুনতে লাগলাম।সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর শব্দ শুনার চেষ্টা করলাম।
কখনো মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছে প্রতিটা গাছের মগডাল।কখনো হালকা ঝড়ো হাওয়ায় ঝরে পড়ছে গাছের পাতা।এই হাওয়ায় দুলছে প্রতিটা গাছের পাতা।সৃষ্টি হচ্ছে মনোমুগ্ধকর এক আওয়াজ।সে আওয়াজ ভাষায় বর্ণনা করার নয়।সে আওয়াজ শুধুই কর্ণপাত করে অনুভব করার।আশেপাশে চলছে পাখির মিষ্টি কিচিরমিচির আওয়াজ।তারা যেন আমাকে কিছু বলতে চাইছে।হয়তো তাদের সুখ দুঃখের গল্প করতে চাইছে আমার সাথে।
কোথা থেকে যেন পানির ঢেউয়ের আওয়াজ পাচ্ছি।হয়তো আশেপাশে কোথাও নদী বা পুকুর আছে।এ মূহুর্তে নিজেকে সে পানিতে ভিজিয়ে দিতে মন চাইছে।যদিও সাঁতার জানিনা।তবে সে ঠান্ডা পানিতে ভিজে শরীর মন ঠান্ডা হয়ে যেত।

আমার চোখজোড়া এখনও বন্ধ।আশেপাশের পরিবেশ প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করার জন্য এমনটা করে রাখা জরুরী।খুব কাছে,হুম খুব কাছে মৃদু ডানা ঝাপটানোর মত আওয়াজ পেলাম।চারপাশে এখন হাওয়া বইছে না।একদম নিস্তব্ধ নিরব।এজন্যই হয়ত সেই ডানা ঝাপটানোর আওয়াজটা খুব ভালো করে শুনতে পাচ্ছি।এই আওয়াজের উৎপত্তি খুঁজতেই চোখজোড়া খুলে এদিক ওদিক তাকালাম।দেখতে পেলাম একটা হলুদ রঙা প্রজাপতি তার নরম ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে আসছে।উড়তে উড়তে আমার সামনের ডালে এসে বসলো।কি সুন্দর আর স্নিগ্ধ তার রঙ।মন চাইছে ছুঁয়ে দেই।তার ডানার হলুদ রঙে নিজেকে রাঙাই।কিন্তু সে তো বসে থাকার নয়।ছোঁয়ার চেষ্টাতেই ফুড়ুৎ করে উড়াল ধরবে।তাও চেষ্টা করতে দোষ কি।
আমি হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করলাম।কিন্তু দুষ্টু প্রজাপতি তা করতে দিলো কোথায়।যা ভেবেছিলাম তাই করলো।দিলো এক উড়াল। আমিও তার যাবার পানে তাকিয়ে রইলাম।

হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ উচ্চ শব্দ আমার কানে এসে বারি খেলো। মূহুর্তেই সব মুগ্ধতা হারিয়ে গিয়ে মনটা বিরক্তিতে তেতো হয়ে উঠলো।কণ্ঠটা পরিচিত।একদিন শুনেছিলাম।হুম ধরতে পেরেছি।আদ্রিশ ভাইয়ার জিএফ মাহার আওয়াজ।সেই ন্যাকা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ তার।
চরম বিরক্তি নিয়ে আশেপাশে তার শব্দের উৎপত্তির কারনটা খুঁজতে লাগলাম।শীঘ্রই পেয়েও গেলাম।আমার বাম দিকে আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখতে পেয়েই বুঝলাম উনি মাহার সাথে ফোনে লাউডস্পিকারে কথা বলছেন।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার থেকে একটু দূরে উনাদের বাড়ীর ড্রইংরুমের কাছের আম গাছের নিচে আছেন।
পরনে সাদা চিকন স্লিভের গ্যাঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।চোখমুখ কুঁচকে বাইক পরিষ্কার করছেন আর গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছেন।
ওপাশে মাহা প্রতিটা কথার শুরুতে ‘বেবি’ শব্দটা যোগ করছে।য়া চরম মাত্রায় বিরক্তিকর এবং হাস্যকর।মাহার কথার ঢং এ মূহুর্তেই ফিক করে হেসে দিলাম আমি।খুব জোরে হাসতে মন চাইছে আমার।পেটের ভেতর হাসিরা কিলবিল করছে।শুধু যথা সময়ে মুখ দিয়ে বের হবার পালা।
হাসতে হাসতেই এক পর্যায়ে একটা কুবুদ্ধি মাথায় এলো।আদ্রিশ ভাইয়াকে অপমান করার সেরা একটা সুযোগ পেলাম আমি।এই মাহাকে দ্বারাই অপমান করবো উনাকে।
আমাকে সেদিন অপমান করা আর বাচ্চা বলে রাগানোর শোধ আজ তুলবোই।

লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম।মাহা এখনও ওপাশ থেকে ন্যাকা আওয়াজে কথা বলে যাচ্ছে।
“বেবি,তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
“বেবি, তুমি আসলে আমরা সিলেটে ঘুরতে যাবো।”
“বেবি, তুমি আসলে আমি তোমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিব।”

কতশত ফিউচার প্ল্যানিং!বাব্বাহ!প্রতিটা কথা মনে হাসির খোরাক জুগায়।আমি এবার বেশ জোরে হেসে ফেললাম।এতক্ষণে আমি আদ্রিশ ভাইয়ার বিপরীত দিকের ছোট্ট লিচু গাছটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ীয়ে পরেছি।
উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জোরে জোরে হেসে চলছি আমি।কারন উনার দৃষ্টি আকর্ষন করতে না পারলে আমি যে কথাগুলো বলবো, সেগুলো বলে খুব একটা লাভ হবে না।

আমার হাসি দেখে আদ্রিশ ভাইয়া বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মাহার ফোন কেটে দিলেন।সাথে সাথে বললেন,
“এখানে কোনো জোকস চলছে?”

উনার কথা শুনে আমি হাসি চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলি,
“ইশ রে,ছোট্ট বেবিটা কত কষ্ট করছে।”

আমার কথায় উনার কুঁচকানো ভ্রুজোড়া আরো কুঁচকে এলো।আমার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উনি।

আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে চেহারায় নকল এক সহানুভূতির ছাপ তুলে ধরে বললাম,
“ইশ,ছোট্ট বাবুটা এই গরমে কত কষ্ট করে বাইক পরিষ্কার করছে! বাচ্চাদের দিয়ে কি কেউ এসব করায়!আহা রে বাচ্চাটার কত কষ্ট। বাচ্চাটা তার বাচ্চা গার্লফ্রেন্ডের কাছে যেতে চাইছে তাই না?”
এই বলে পেট চেপে হাসতে লাগলাম আমি।কোনোমতেই হাসি থামাতে পারছি না।আমার এতক্ষণের কথায় নিশ্চয় আদ্রিশ সব বুঝে ফেলেছে। হুম, সত্যিই বুঝে ফেলেছে।উনার রাগান্বিত চেহারা দেখে তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমি।
এ মূহুর্তে উনার রাগী চেহারা আমার হাসির উপরে কোনো প্রভাব ফেললো না।আমি আবারো আগের মতই চেহারায় সহানুভূতি ফুটিয়ে তুলে বললাম,
“এই যে ছোট্ট বাচ্চা।ললিপপ খাবে? বলো বলো ললিপপ খাবে?নাকি তোমার ছোট্ট গার্লফ্রেন্ড ঢাকা থেকে পার্সেল করে পাঠাবে?নাকি আমি বাজার থেকে ললিপপ এনে দেবো?এই এই,তোমার বাচ্চা গার্লফ্রেন্ড কি এখানে এসে তোমাকে ললিপপ খাইয়ে দিবে বলো?”

কথাগুলো বলে মাথা নিচু আবারো হাসিতে ফেটে পরলাম আমি।খুব শান্তি শান্তি অনুভুতি পাচ্ছি।আদ্রিশ ভাইয়ার করা অপমান আর কথাগুলোর বদলে এমন অপমান করতে পেরে হাওয়ায় ভাসছি যেন।বলেছিলাম না,এর শোধ একদিন তুলবোই।আজ শোধ নিয়েই ফেললাম।আহ,অনেকদিন পর শান্তি পাচ্ছি মনে।
ওদিকে আদ্রিশ ভাইয়ার অবস্থা কেমন কে জানে।নিশ্চয় অপমানে মুখ থমথমে হয়ে আছে। মাথা নিচু করে আমার অপমান করে বলা কথাগুলো ভাবছে নিশ্চয়।আমি আরো কিছু অপমানজনক কথা বলার জন্য মাথা তুলে তাকালাম।সামনে তাকিয়েই চমকে উঠলাম আমি।ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার।আদ্রিশ ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়ীয়ে আছেন!তাও আবার দূরে না।আমার বেশ খানেকটা কাছে।তবুও বেশ কয়েক ইঞ্চি দূরে।

উনার চেহারায় রাগের ছাপ স্পষ্ট।উনার এ অবস্থা দেখে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে।এখন একটু পানি খেতে পারলে জান ফিরে পেতাম যেন।কিন্তু, ভাগ্য খারাপ।খাওয়ার মত পানি এখানে নেই।
আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখে একটা শুকনো ঢোক গিললাম আমি।ভাবতে লাগলাম,’নিশ্চয় আমি একটু বেশিই বলে ফেলেছি।এখন এখান থেকে কেটে পরতে হবে।রাগের মাথায় আবার উনি কি না কি বলে বসেন।’
পরমূহুর্তেই আবার আমার মাথায় এলো,উনার সামনে নিজেকে দূর্বল দেখানো চলবে না।নিশ্চিত এর সুযোগ নিয়ে পরে আমাকে অপমান করবে।নানা কথা শুনাবে।নাহ,এসব সহ্য করা সম্ভব নয়।এখন নিজেকে শক্ত করার পালা।কিছুক্ষন এখানে দাঁড়ীয়ে থেকে কোনো একটা বাহানায় ভেতরে চলে যাবো।

যা ভাবলাম তাই করলাম।সেখানেই ঠায় দাঁড়ীয়ে রইলাম।মাথা উঁচু করে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে,তবুও নিজেকে সাহসী দেখানোর জন্য তা করলাম।
আদ্রিশ ভাইয়া কোনো কথা বলছেন না। চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়ীয়ে আছেন।চোখেমুখে সুক্ষ্ম রাগের ছাপ স্পষ্ট।

কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ীয়ে থাকার পর আমি আর পারলাম না।বাড়ীর ভেতরে যাওয়া উচিত এখন।যেই ভাবা সেই কাজ।আমি পাশ ফিরে বাড়ীর ভেতরে যেতে নিলাম।কিন্তু পারলাম না।আদ্রিশ ভাইয়া আমার পিছনের লিচু গাছে হাত ঠেকিয়ে আমার পথ আগলে ধরলেন।মূহুর্তেই আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো।হৃদপিন্ডটা ধরাম ধরাম করে আওয়াজ তুলতে লাগলো।কিছু না ভেবেই আমি পাশে ফিরে পিছনের দিক দিয়ে যেতে নিলাম।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া অপর হাত দিয়ে সে পথও আটকে দিলেন।এবার আমার ভয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল।মস্তিষ্ক যেন পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিলো।সে শুধু একটা কথাই আওড়াতে লাগলো,’মিম,তোর পালানোর রাস্তা বন্ধ।’
দুজনের মাঝে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে হালকা একটু ঝুঁকে এলেন।ঠোটের কোনে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললেন,
“মিশমিশ,এবার কোথায় পালাবে?আমার থেকে পালানোর আর সুযোগ নেই।নাউ ইউ আর ট্র্যাপড।”

®সারা মেহেক
#চলবে
(বি:দ্র:শুরুর কবিতাটা সম্পূর্ণ আমার নিজের তৈরী।কখনো কবিতা লিখিনি।এই প্রথম এখানেই চেষ্টা করেছি।ভালোও হতে পারে।খারাপও হতে পারে।পছন্দ হলেও কেউ আমার অনুমতি এবং কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না দয়া করে।)