ভালোবাসার সন্ধিক্ষণ পর্ব-০২

0
252

#ভালোবাসার_সন্ধিক্ষণ
#পর্ব_২
#গল্পছোঁয়া Jannatul Ferdous Mahi

ব্লাড নেওয়ার সময় এগিয়ে আসলে শরীরে এধরণের অসহ্যকর যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়।
প্রতিভার মনে হচ্ছে ওর শরীরেের ভেতরে কোনো পোকা কিটকিট করে কামড়াচ্ছে,এই যন্ত্রনা সহ্য করা ক্রমশ কষ্টকর হয়ে পরছে ওর জন্য,নিজের মা কে জানাবে সেই ইচ্ছে টাও নেই,কারণ ওর মা চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পরবে।
বিছানায় মোচড়ামুচড়ি করতে করতে প্রতিভা একসময় সেন্স হারিয়ে ফেলে।রাত ৯টার দিকে প্রতিভার মা ফাতেমা বেগম খাবার খাওয়ার জন্য প্রতিভাকে ডাকতে এসে দেখে প্রতিভা বিছানায় বিধ্বস্ত এলেমেলো ভাবে সুয়ে আছে,ফাতেমা বেগম মনে করেছেন প্রতিভা ক্লান্ত থাকায় হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে,মেয়েকে বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও কোনো সাড়া না পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন তিনি,পানির গ্লাস নিয়ে এসে প্রতিভার চোখেমুখে বেশ কয়েকবার পানির ছেটা দিলে নড়েচড়ে উঠলো প্রতিভা,ফাতেমা বেগম নিজের মেয়ের হাত-পা ঘষছেন,পাখা বাতাস করছেন,কি রেখে কি করবেন বুঝতে পারছেন না তিনি।প্রতিভার সেন্স আসতেই নিজের মা’কে এমন পাগলের মতো আচরণ করতে দেখে অস্ফুটস্বরে কোনোরকমে বললো..

–আম্মু,চিন্তা করোনা আমি ঠিক আছি
ওই শরীরের ভেতরে কামড়াচ্ছিলো একটু,তুমিতো জানো রক্ত নেওয়ার সময় হয়ে এলে এধরণের প্রবলেমস হয়

–তুই একবার আমাকে ডাকতে পারতিস মা,এভাবে কেন কষ্ট গুলোকে লুকাস বলতো

প্রতিভা ওর মায়ের কোলে মাথা দিয়ে ওর মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরলো..

–আম্মু,আমি ঠিক আছি
এতসহজে এত তাড়াতাড়ি তোমার মেয়ে মরবেনা গো

–বালাইছাট,এসব কথা মুখেও আনবিনা,কথায় কথায় মরার কথা কেন বলিস বলতো,তুই ছাড়া এ পৃথিবীতে আমার কে আছে বল,তুই এসব বললে আমার বুকের ভেতর কি হয় তুইতো বুঝিসনা

–সরি আম্মু
আজকে কি রান্না করেছো বলোতো,পায়েস করেছো??

–জানিসতো মা,আমি যখন তোর বয়সী ছিলাম,আমার বন্ধুবান্ধবরা বলতো আমি নাকি খুব ভালো দুধ-পায়েস রান্না করতে পারি,কিন্তু আমার কপালটা দেখ নিজের মেয়েকে সেটা কখনও খাওয়াতে পারলামনা,চিনি পানি দিয়ে তোকে পায়েস রান্না করে খাওয়াতে হয় (দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের পানি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে)

–আম্মু,পানি দিয়ে রান্না করা পায়েসও অনেক সুস্বাদু হয়,মায়ের হাতের কোনো রান্নাই খারাপ হয়না।
আমাদের মতো মানুষদের যে লৌহ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ,দুধে আয়রনের পরিমানটা অনেক, তাইতো খাইনা আম্মু,তুমি এত মন খারাপ কেন করো বলোতো,আমিতো বেশ আছি।

–কাল পরশুতো রক্ত নেওয়ার দিন তাইনারে মা,আবার তোর শরীরে সুই ফোটাবে

–পরশুদিন ম্যাডিকেলে যাব,নার্স অবশ্য এখনও কিছু জানায়নি,দেখা যাক ব্লাড পাওয়া,যায় কিনা,আল্লাহ ভরসা,আল্লাহ নিরাশ করবেনা আমাকে।

–তাই যেন হয়,২ব্যাগের জায়গায় কমছেকম এক ব্যাগ হলেও যেন রক্ত পাই আল্লাহ দেখো তুমি।
খেতে চল মা,তোর জন্য পানি পায়েস আর করোলা ভাজি করেছি,তোর জন্য বেশ উপকারী

–মাই ফেবারিট
তুমি খাবার বাড়ো,আমি মাগরিবের কাযা নামাজ আর এশার নামাজ টা পরে আসছি কেমন।

–আচ্ছা ঠিক আছে।

প্রতিভা নামাজ শেষ করে মায়ের সঙ্গে মজা করে খাবার খেয়ে নিলো,একটা নাপা এক্সট্রা খেয়ে নিলো যাতে সামান্যতম হলেও ভালো লাগে।খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে এসে ৩টা জামা নিয়ে বসলো প্রতিভা,আজকে রাতের মধ্যেই এই জামাগুলোতে ফুল তুলতে হবে,হাতের কাজ শেষ করতে পারলে এই জামা তিনটার জন্য বেশ অনেকটাই মূল্য পাওয়া যাবে,কালকে মিষ্টি নামের মেয়েটার জন্মদিন,এতো করে বলেছে না গিয়েও উপায় নেই,বাচ্চা মেয়েটার জন্য কিছুতো কিনতে হবে,এছাড়াও পরশুদিন মিনিমাম ১ব্যাগ হলেও রক্ত কিনতে হবে,ভাগ্যক্রমে ২ব্যাগ পাওয়া গেলে আলহামদুলিল্লাহ।
বিছানায় ২টা বালিস একটার ওপর আরেকটা রেখে প্রতিভা মনযোগ দিয়ে কাজ শুরু করলো।


সকাল ৮টার দিকে প্রতিভার মা প্রতিভাকে ডাকতে এসে দেখে হিজাব পড়া অবস্থায় প্রতিভা বালিসে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে,চিন্তিত হয়ে প্রতিভাকে কয়েকটা ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকালো প্রতিভা।

–কিরে এভাবে সুয়ে ছিলি যে,শরীর ঠিক আছে তোর,আবার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো মা? (চিন্তিত হয়ে)

–শান্ত হও আম্মু,আমি ঠিক আছি কিছু হয়নি।ফজরের নামাজ শেষে জামাটা নিয়ে বসেছিলাম,কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি,আর অল্প একটু বাকি আছে,তুমি যাও এটুকু শেষ করেই আসছি আমি (মুচকি হেসে)

–এতো চাপ কে নিতে বলেছে তোকে,নিজের দিকে একবার দেখেছিস শরীরটা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

–এটা নরমাল আম্মু
আমাদের মতো থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগিদের জন্য খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া,অবসাদে ভোগা,ফ্যাকাসে ত্বক,শ্বাসকষ্ট এগুলো খুবই স্বাভাবিক,রক্ত অধিক হারে ভেঙে যায় বলে অনেকের ক্ষেত্রে জন্ডিস হয়ে ত্বক হলুদ হয়ে যায়,সেখানে তোমার মেয়ে যথেষ্ট সুস্থ আছে,এতেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো।

–এই বয়সে কত বুঝিস তুই,অন্যরা তো সহজে মেনে নিতে পারেনা নিজের সমস্যা গুলোকে,মানসিক ভাবে ভেঙে পরে

–তুমিকি জানো,কোনো অবস্থাতেই মানসিক ভাবে দূর্বল হতে নেই,নিজেকে কখনও দূর্বল মনে করা যাবেনা,যেমন পরিস্থিতিই আসুকনা কেন সৃষ্টিকর্তার ওপর আস্থা রাখতে হবে এবং নিজেকে শক্ত করতে হবে।

–হুম,একদম ঠিক বলেছিস কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই সেটা বোঝেনা,অল্পতেই ভেঙে পরে।

–আম্মু শোনো,আজকে সন্ধায় একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠান আছে,বাচ্চা মেয়েটা আর ওর মা বারবার করে আমাকে বলেছে,না গেলেই নয়,সন্ধার দিকে যাব কেমন

–একা ওই ভরসন্ধ্যায় যাবি?

–তুমিও যাবে আম্মু,আমাদের মা মেয়ে দুজনকেই যেতে বলেছেন আন্টি

–আচ্ছা ঠিক আছে,পরে দেখা যাবে।এখন হাতের কাজ রেখে খেয়ে নিবি আয়,পরে করিস

–তুমি খাইয়ে দাও,আমি হাতের কাজটা শেষ করি,এই জামাটাই শেষ।


সন্ধ্যায় বোরকা,নেকাব পরে তৈরি হয়ে নিলো প্রতিভা আর ওর মা ফাতেমা বেগম,বাজার থেকে একটা বার্বিডল কিনে সিএনজি করে দুজনেই মিষ্টির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো,গলির মুখ অবধি পৌঁছে সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে সিএনজি থেকে নামলো ওরা,এখন সমস্যা হলো মিষ্টির বাড়িটা কোনটা সেটা প্রতিভার অজানা,সাইড ব্যাগ থেকে স্যামফোনি কম্পানির নিজের ছোট বাটন ফোনটা বের করে মিষ্টির মায়ের নম্বরে কল করলো প্রতিভা,১ম বারে রিসিভ না হলেও ২য় বারো কল রিসিভ করলেন মিষ্টির মা।
তিনি প্রতিভা কে অপেক্ষা করতে বলে কল কাটলেন,কিছুক্ষণ পরে মিষ্টির মা নিজেই এসে প্রতিভা আর ওর আম্মুকে সঙ্গে করে নিজেদের বাসায় নিয়ে আসলেন।
প্রতিভাকে পেয়ে মিষ্টির খুশি যেন ধরেনা,মিষ্টির বয়সী আরও অনেকগুলো বাচ্চা রয়েছে,মিষ্টি প্রতিভার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে ওর সব ফ্রেন্ডসদের সাথে প্রতিভাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে,তারপর প্রতিভাকে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজেও পাশের চেয়ারে বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো,বাচ্চা মানুষ একা এই চেয়ারের নাগাল পাচ্ছে না বসবে কি করে।
প্রতিভা মিষ্টি কে কোলে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো..

–ড্রেস টা কে কিনে দিয়েছে মিষ্টি সোনা?

–বাবাই কিনে দিয়েছে,আমাকে কেমন লাগছে বলোনা আপ্পি

–তুমিকি জানো,এই রেড ফ্রগে তোমাকে রেড এঞ্জেল মনে হচ্ছে

–সত্যিই আমাকে পরির মতো লাগছে (খুশি হয়ে)

–হুম,একদমন।
এই ছোট্ট এঞ্জেল পরির জন্য আমার তরফ থেকে এই ছোট্ট একটা গিফট।

মিষ্টি প্রতিভার থেকে গিফট বক্সটি নিয়ে তখনই খুলে ফেললো,একটা বার্বিডল পেয়ে সে ডলের কপালে চুমু দিলো।

–কি মিষ্টি সোনা,পছন্দ হয়েছে?

–হুম,আমার অনেক পছন্দ হয়েছে,এই ডল টা তোমার মতোই সুন্দর আপ্পি (প্রতিভার গালে চুমু দিয়ে)

এবার আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,কেক কাটার সময়।মিষ্টির একপাশে মিষ্টির বাবা-মা আরেক পাশে প্রতিভা দাঁড়িয়ে রয়েছে,চারপাশে মিষ্টির ফ্রেন্ডস ও তার বাবা-মায়েরা ঘিরে দাড়িয়ে আছে।মিষ্টি কেক কেটে সবার প্রথমে প্রতিভার দিকে কেকের টুকরো বাড়িয়ে দিলো,কিন্তু প্রতিভা যে এটা খেতে পারবেনা।

–মিষ্টি সোনা,তুমি জানোতো আমি অসুস্থ,আমি এই কেক খেতে পারবোনা বাবু,তুমি তোমার বাবা-মা কে খাওয়াও কেমন,আমি পাশেই আছি (মুচকি হেসে)

–কেন আপ্পি,অল্প একটু খাও,একটুখানি,প্লিজ

–না সোনা,ডক্টরের বারণ।

প্রতিভা আর কিছু না বলে সেখানে থেকে সরে এসে একটা চেয়ারে বসলো,কেক কাটার পর্ব শেষ হলে মিষ্টির মা একটা প্লেটে অল্প একটু কেকের টুকরো,তেহারি,এক পিচ সিদ্ধ ডিম এনে প্রতিভার হাতে দিলো।

–এগুলো কি করবো আন্টি

–অল্প করে হলেও খাও,কিছু হবেনা

–না আন্টি,আমাদের যে অধীক লৌহযুক্ত/আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া একদম নিষিদ্ধ,এই ডিম,গরুর মাংস,কেকে থাকা ডিম সবকিছুই যে অধিক আয়রন সমৃদ্ধ খাবার।
আমরা থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগিরা অন্যের থেকে নিয়মিত রক্ত গ্রহন করে বেঁচে থাকি।দেখা যায় একদিকে যেমন রক্ত নিচ্ছি,অন্যদিকে দেহে লৌহ বা আয়রন জমা হচ্ছে,আমরা যদি এরপরও অধিক আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাই তাহলে দেহে অত্যাধিক লৌহ বা আয়রন জমে অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে,এর ফলে ডায়াবেটিস,হার্টফেইলর ইত্যাদি মারাত্মক সমস্যা দেখা দেবে,তাই ডাক্তারের নির্দেশ মতো আমার মতো প্রতিটি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগিদের অতিরিক্ত লৌহ/আয়রন সমৃদ্ধ খাবার পরিহার করে চলতে হয়।

–তাহলে কি খাবে বলো,আমি সেই ব্যবস্থা করছি,কোনকোন খাবার তুমি খেতে পারবে?

–আমাদের খাদ্যের একটা তালিকা আছে আন্টি…..

To be continue….