ভালোবাসা তুই পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
853

#ভালোবাসা_তুই
#শেষপর্ব
#লেখিকা_সাদিয়া_জান্নাত_সর্মি

কিছু ভালো লাগছে না আমার। কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবছি,,
বাইরে আসার পর ছেলে টা আমাকে জিজ্ঞেস করল,

তুমি কি এই বিয়ে তে রাজি আছ?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই উনি আমাকে আবার বললেন,
রাজি থাকো বা না থাকো এই বিয়ে তোমাকে করতে হবে, আমার দিকে তাকিয়ে বলো এখন তুমি কি রাজি?
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু হ্যা সুচক মাথা নাড়লাম। উনি চলে গেলেন, আমি ও চলে এলাম। বাসার ভিতরে আসার পর, আমাদের বিয়ে পড়ানো শুরু করলো কাজি। বিয়ের পর যখন বাসা থেকে আমাকে বিদায় দেবে তখন মা আমার কানে কানে বললেন,এই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিস আর কোন দিন যেন তোর পা এই বাড়ির চৌকাঠে না পরে। তোর বাবার চিহ্ন আজ থেকে এই বাড়িতে চিরদিনের জন্য মুছে গেল, বুঝতে পেরেছিস আমার কথা? আমি মায়ের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে ওনার দিকে তাকালাম। শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম, এতো দিন ধরে তুমি যে আমার উপর অত্যাচার করেছো সেটা শুধু আমি বাবার মেয়ে বলে? মা হাসি মুখে বললেন,হ্যা। আমি আর কিছু বললাম না মাকে যে আমাকে বিয়ে করেছে তার আগেই আমি গাড়িতে এসে বসে রইলাম।

ওখানে দাঁড়িয়ে কাকে দেখছো নুর পাখি? আমি তো এখানে আছি।
পিছন থেকে এমন কথা শুনে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম,
কে আপনি? আমার হাজব্যান্ড এর রুমে কি করছেন?

তোমার হাজব্যান্ড এর রুম মানে? তোমার হাজব্যান্ড কে শুনি?
আমি চুপ করে রইলাম। আমি এখনো আমার গুনধর হাজব্যান্ডের মুখ টাও দেখিনি নিজের উপর রাগ করে। আমার নামে যে অপবাদ উঠেছে তার জন্য মা আমাকে কোন ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেবে না সেজন্য ছেলের মুখ টাও দেখিনি আমি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,

কি হলো বলো আমাকে, তোমার হাজব্যান্ড মহাশয় কে?
আমি থতমত খেয়ে বললাম,
জানিনা, আমি এখনো ওনাকে দেখি নি। তবে আপনি কে হ্যা?

আমি, আমি সেই দুর্ভাগা হাজব্যান্ড যাকে কি না এখনো তার বউ চিনে না।
আমি জিভে কামড় দিলাম।রাগ করার এই ফল হলো, আমার মতো মেয়ের যে রাগ করা মানায় না সেটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে বললাম,

সরি, আমি চিনতে পারিনি আপনাকে।
উনি কিছু না বলে বেলকনিতে এসে পাশের চেয়ারে বসে আমাকেও বসতে বললেন। আমি বসার পর জিজ্ঞেস করলেন,

তুমি জানতে চাইবে না আমি তোমাকে বিয়ে কেন করলাম?

নাহ, চাইবো না।

কেন?

আপনার ইচ্ছা হয়েছে তাই আমাকে বিয়ে করেছেন এটা আবার জানতে চাওয়ার কি আছে?

না, তোমার ভুল ধারণা এটা,আমি তোমাকে তোমার বাবার কথায় বিয়ে করেছি।
ওনার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
বাবার কথা শুনে মানে?

হুম, তোমার বাবার কথায় আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার বা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হওয়ার পর তোমার বাবা তোমার মাকে ছেড়ে চলে যান একথা তুমি জানো তো?

হ্যা জানি।

তোমার বাবা চলে যাওয়ার পর তোমার মা আর বাবার ডির্ভোস হয়ে যায়। আঙ্কেল বাসায় ডির্ভোস পেপার পাঠিয়ে দেন।আর সেজন্যই তোমাকে তোমার মা সহ্য করতে পারে না, সবসময় তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। তোমাকে তোমার মায়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আঙ্কেল আমাকে বলেন তোমাকে বিয়ে করতে। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করা টা একটা কঠিন ব্যাপার ছিল,ভালোয় ভালোয় তোমাকে বিয়ে দিতেন না আন্টি, তোমার উপর অত্যাচার করতে পারবেন না বলে। সেজন্য তোমার মায়ের ফোনে আমি তোমার একটা ভিডিও এডিট করে পাঠাই,যার কারণে এতো সহজে তোমাকে বিয়ে করতে পেরেছি আমি।

আমি ওনার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। আমাকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন,
কি হয়েছে, এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আঙ্কেল কে দেখতে চাও নাকি?যদি দেখতে চাও তাহলে আমি ডেকে আনছি ওয়েট।
বলে উনি চলে গেলেন, আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। আমার বাবা আছে এই কথা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। একটু পরেই উনি চলে আসলেন, বললেন, নুর এইদিকে এসো একটু। আমি ওনার ডাক শুনে তাড়াতাড়ি রুমে আসলাম। এসে দেখি ওনার সাথে আরো একটা মাঝবয়সী মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, কালো কোট আর কালো প্যান্ট পরা। আমি এগিয়ে গেলাম মানুষটির দিকে, অবাক হয়ে দেখছি ওনাকে আমি। আমার চেহারার সাথে অনেকটাই মিল আছে ওনার। আমি আর কিছু না ভেবে মানুষ টাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম,উনিও আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদছেন তিনিও ,এতো দিন পর নিজের মেয়েকে কাছে পেয়ে খুব খুশি নওশাদ আহমেদ। আমি কিছুক্ষণ পর ওনাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম,
এতো দিন পরে কেন এসেছো তুমি?মেয়ের কথা এতো দিন পরে মনে পরলো? এতো দিন পরে মনে হল তোমার যে,ওই ডাইনী মহিলা তোমার মেয়ের উপর অত্যাচার করে?
বাবা চোখ মুছে বললেন,
নারে মা, মনে ঠিকই পরতো তোকে, কিন্তু ও বাড়িতে যেতে আমার রুচিতে বাধে রে, সেজন্যই তো তোকে এতো কষ্টের মাঝে দেখেও দুরে থেকেছি আমি। কিন্তু তুই যখন বড় হলি, তখন আর তোকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারলাম না, নির্ঝর কে দিয়ে তোকে ওই জাহান্নাম থেকে বের করে আনলাম।ক্ষমা করে দিস মা এই অসহায় বাবা টাকে,তোকে এতো দিন ওই মহিলার কাছে রাখার জন্য।
আমি বাবার কথা শুনে হাসলাম, বললাম
এতো দিন ধরে ওর কাছে কষ্ট পাওয়ার পরেও তোমাকে দেখে আমার সব কষ্ট দুর হয়ে গেছে বাবা। তুমি আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?

নাহ, এমন মিষ্টি একটা মাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাই বল?
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম, আর কোন কষ্ট নেই আমার। বাবা থাকতে আর কিসের কষ্ট আমার। আমার আর বাবার কথা শুনে নির্ঝর ফটফট করে বলল,

আঙ্কেল মেয়ে কে পেয়ে কি এখন ওকেই ভালোবাসবেন? এই মেয়ের জামাইয়ের দিকেও একটু নজর দিন। কখন থেকে আপনাদের কথা শুনছি, আমাকে তো দুজনেই ভুলে গেছেন, এখানে যে একটা ভোলাভালা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে সেটা তো খেয়ালই করছেন না।
বাবা নির্ঝর কে বললেন,
তোমাকে ভুলে যাবো কেন? তুমি আমার একমাত্র মেয়ের জামাই, তাকে ভুললে চলবে না, আচ্ছা আমার একটা দরকারি কাজ আছে, আমি আসছি তোমরা কথা বলো।
বাবা চলে গেল।
আমি নির্ঝর মহাশয়ের কথা শুনে বিড়বিড় করে বললাম, ভোলাভালা বাচ্চা হাহ, ভোলাভালা বাচ্চা হলে কি আর এতো বাজে একটা ভিডিও এডিট করতে পারতো? তার উপর আবার আমার আদরে ভাগ বসাতে এসেছে, অসহ্য।
আমি বিড়বিড় করে বললাম, ভোলাভালা বাচ্চা হাহ, ভোলাভালা বাচ্চা হলে কি আর এতো বাজে একটা ভিডিও এডিট করতে পারতো? তার উপর আবার আমার আদরে ভাগ বসাতে এসেছে, অসহ্য।
আমাকে বিড়বিড় করতে দেখে নির্ঝর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

এতো বিড়বিড় করে না সোনা,রাত কিন্তু অনেক বাকি। আন্টির থেকে দিগুন অত্যাচার আমি করতে পারি, মাথায় রেখো কিন্তু।
ছিঃ,কি অসভ্য লোক ছিঃ,লজ্জায় মুখ লাল করে বেলকনিতে চলে এলাম আমি। আমাকে লজ্জা পেতে দেখে নির্ঝর হাসতে হাসতে বলল, লজ্জাবতী গাছ দেখছি আমার ঘরেই আছে।
______________________________
দেখতে দেখতে দুই বছর কেটে গেছে। একটা কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি।কবরটি সাথি আহমেদের,যিনি কিনা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন। একবছর আগে ব্রেইন ক্যান্সার হয়ে মারা যান উনি। মৃত্যুর আগে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন তিনি, সেজন্য আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেটা আর হয়নি। আমি তখন নির্ঝরের সাথে দেশের বাইরে ছিলাম।যখন দেশে ফিরি, তখন জানতে পেরেছিলাম উনি নাকি দুই মাস আগে মারা গেছেন। এই কথা শুনে আমি কাঁদিনি,এক ফোঁটা পানি ও চোখ দিয়ে বের হয় নি আমার।যেই মহিলা আমাকে জন্ম দেওয়া কে পাপ মনে করে তার জন্য চোখের পানি পরবে কেন?আজ এসেছি ওনাকে বলতে যে আমি মা ডাকার জন্য একটা মা পেয়ে গেছি। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী আমাকে তার নিজের মেয়ের মতো ভালো বাসেন, মায়ের অভাব পুরন হয়েছে আমার।আর কখনো এই মহিলাকে মা ডাকার দরকার পরবে না আমার। তখন আমার ফোন এলো, দেখি মা ফোন করেছে, আমি রিসিভ করলাম, রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি, মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

তুই আমাকে না বলে কোথায় গেছিস নুর? অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় কোথায় দৌড়ে বেরাস? আমার চিন্তা হয় না বুঝি?
আমি হাসলাম, বললাম,
মা, আমি তো বাড়ির পাশেই আছি, চিন্তা করোনা তুমি, আমি এক্ষুনি আসছি, বলে ফোন কেটে দিলাম।
কবরের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার মা আমি খুঁজে পেয়েছি সাথি আহমেদ। ওপারে ভালো থাকো তুমি,আর কখনো তোমার কবরের পাশে আসা হবে না আমার। চলে আসলাম আমি, পিছনে পড়ে রইলো নিষ্ঠুর একটা মহিলার কবর।

সমাপ্ত………
(আসসালামুয়ালাইকুম। গল্প টা সমাপ্ত করার জন্য দুঃখিত আমি। নামের সাথে গল্পের কোন মিল নেই, দয়া করে কেউ নামের সাথে গল্পের মিল খুঁজতে যাবেন না। একটু ব্যাস্ত আছি আমি তাই সমাপ্ত করে দিয়েছি)