হলদে প্রজাপতি পর্ব-০১

0
991

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

এক

চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লালচে সরু রাস্তাটা কিছুদুর গিয়ে হারিয়ে গেছে। ইতস্তত উড়ছে বেশকিছু ছোট ছোট হলুদ প্রজাপতি । আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা সোনাঝুরি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে। উদাস চোখ সামনে দিকে চেয়ে আছি সিঁদুরে দিগন্ত রেখার দিকে। কেন এভাবে শুধু উদাস চোখে চেয়ে রয়েছি সামনের দিকে? ওই সরু রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে ছুটতে তো পারতাম । বেতের মতন মন দুলছে। সেদিকে তাকাতে চাইছি না, তবু বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছে সেই আকাশ নীল ডোরাকাটা শার্টটার দিকে। ক্রমশ চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে সে! পিছন থেকে ডাকবো বলে একবার হাত বাড়ালাম । তবু ডাকা হলো না । আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি চিৎকার করে গলা থেকে শব্দগুলো বার করতে, ওগো যেওনা! কিন্তু না, শত চেষ্টাতেও একটাও কথা মুখ ফুটে বার করতে পারছি না । সেকি অব্যক্ত যন্ত্রনা ! বারবার চাইছি ডাকতে । নিজের সর্বশক্তি সঞ্চয় করে ডাকতে। কিন্তু না, ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে শার্টের নীলচে আভা। ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে …. ! যেতে যেতে সেই দুটো রক্তকাঞ্চন আর একটা শিমুল গাছ মিলে যে ত্রিভুজটা তৈরি করেছে , সেখানে মিশে গেলো । হারিয়ে যাচ্ছে ও! আর দেখতে পাচ্ছিনা । আকাশনীল জামাটার কোণাটুকুও আর চোখে পড়ছে না। পাগলের মত ছুটে গিয়ে হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠতে গেলাম। কিন্তু পারছিনা.. পারছিনা.. পারছিনা.. ! হাতও উঠলো না । পা’ও এগোলো না । গলাও কে যেন পাথর চাপা দিয়ে রুদ্ধ করে দিয়েছে। কোনো স্বর বেরোলো না । সে হারিয়ে গেল । আমি ডাকতে পারলাম না । না, পিছু ডাকতে পারলাম না । ফিরিয়ে আনতেও পারলাম না । তার শরীরটা গাছের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চারিপাশে হলুদ প্রজাপতিগুলো উড়ে উড়ে সব আমার সামনে এসে জড়ো হলো । উড়ছে.. উড়ছে.. সংখ্যায় বাড়ছে…এক দুই তিন.. শত শত .. হাজার হাজার প্রজাপতি উড়ে এলো কোত্থেকে । উড়তে উড়তে তারা যেন ক্রমশ একটা অবয়ব সৃষ্টি করছে । মুখ হাত দেহ.. এ কেমন চেহারা ? এ যে আমার খুব চেনা ! গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠলো অসহ্য দমবন্ধ কষ্ট । হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলাম সেই আকৃতিকে । আর অমনি ঠিক বুদবুদের মতো মিলিয়ে গেল .. প্রজাপতিগুলোও নিমেষের মধ্যে কোথায় সব যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল ।

ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম বিছানায়। অস্বস্তিটা অনেকক্ষণ ধরেই হচ্ছিল । এখন পূর্ণ বোধশক্তিতে উঠে বসলাম । উঠে বসেই চোখ পড়ল সামনের দেওয়ালে। গতবছর হস্তশিল্প মেলা থেকে কেনা আদিবাসী যুবক যুবতীর মুখোশ দুটো ঝুলছে । পোড়া মাটির বানানো । অদ্ভুত শিল্পকলা । বাঁ পাশে চোখ ফেরালাম। নিজের অগোছালো স্টাডি টেবিলটাতে চোখে পড়লো । এরপর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিজেকে আত্মস্থ হতে সময় দিলাম। বুঝলাম, না আমি এখনো সোদপুরের আমাদের সেই টু বি এইচ কে পায়রার খোপের মধ্যেই রয়েছি। পুরুলিয়ার শাল সেগুন পলাশে ঘেরা মাঠে খেলেধূলে ছোট থেকে বড় হয়েছি। ইজের আর ফ্রক পরে সেখানে আমার মেয়েবেলা কেটেছে। এক ডজন বন্ধুর সাথে প্রতিদিন খোলা আকাশের নিচে খেলা করতে করতে কিশোরী বেলা কাটানো মেয়েটা আজকে এই চার দেওয়ালের মধ্যে- ! উফ্, প্রাণটা সবসময় আঁকপাঁক করে মুক্ত হওয়ার জন্য । এইসব ফ্ল্যাটের জীবনযাত্রা আর খাঁচার মধ্যে মানুষকে পুরে রেখে দেওয়া, ঠিক একই । দম বন্ধ হয়ে আসে যেন। তবু এর মধ্যেই নিজেকে বেশ মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিলাম । তারমধ্যে কেন আজকে আবার এই স্বপ্ন ? বেশ তো আজ কত বছর আগে সব-

ক্লান্ত হাতে বেডের পাশে জানলার পর্দাটা সরাতে স্লাইডিং গ্লাসের বাইরে চোখে পড়লো দাঁত বার করে গিলতে আসা ফ্ল্যাটগুলো । তার সাথে চারিদিক কালো করে নামা অঝোর ধারায় বর্ষণ । ও হ্যাঁ , তাইতো , ভুলেই গেছিলাম! আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছিল আজ থেকে নিম্নচাপ শুরু হবে । কিন্তু নিম্নচাপ কি শুধু বাইরে ? আমার মনের ভেতরে-? যাকগে, এসব কথা । হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে সেটাকে অন করলাম । প্রথমেই চোখ আটকে গেল আজকের ডেটটার দিকে । আজকেই তো টোয়েন্টি সেভেন্থ মার্চ ! মাথার প্রতিটা শিরা-উপশিরা যেন চাবুকের বাড়ি খেয়ে সজাগ হয়ে উঠলো । আর তার সাথে সাথেই সমস্ত দেহ , হাত-পা ঠান্ডা হয়ে অবশ হয়ে এল । আজকেই সেই দিন ! চলে এলো যে! আর তো পালানোর কোন রাস্তা নেই । যেতে যে আজকে হবেই । আজকে রাতেই ট্রেন ! থম্ মেরে বসে রইলাম বিছানার ওপরে । পা দুটো এমন অবশ হয়ে গেছে যে সেখান থেকে নামার কথা মনে হলেও, নামতে পারবো বলে বিশ্বাস হলো না যেন।

কটা বাজে? মোবাইল স্ক্রিনে চোখ পড়তেই ডেট এর জায়গাটায় চোখটা এমন আটকে গেছিল যে টাইমটা তখন আর চোখে পড়েনি । এবার আবারও মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে টাইমটা চেক করলাম। সকাল আটটা । একটু দেরী হয়ে গেছে আজ ঘুম থেকে উঠতে । রাতে ভাল ঘুম হয়নি । অস্বস্তির মধ্যে এপাশ-ওপাশ করে রাতের অনেকটা সময় জেগেই কেটে গেছে । ভোররাতের দিকে এসেছিল ঘুম । তাই ভাঙতেও দেরি হয়েছে । কিন্তু আটটা বেজে গেছে দেখেও বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করল না । বেডসাইড জানলার পর্দাটা ভালো করে টেনে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম বিছানার ওপর । ঘুম নয় । ক্লান্তি মিশ্রিত ঝিমুনি । চোখ বন্ধ করে সেইভাবেই পড়ে রইলাম। মা মাঝখানে বারদুয়েক এসে নক করে গেছে উঠে পড়ার জন্য । কিন্তু চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থাকলাম । সাড়া দিতে ইচ্ছে করলো না । মা বোধহয় ভাবলো আজকে আবার মেয়েটার অতখানি জার্নি করে যাওয়া আছে, থাক গে, সকালে যখন একটু বেশিক্ষণ ঘুমোচ্ছে -। বেশি আর ডাকাডাকি করেনি । তবে খুব একটা বেশিক্ষন এভাবে শুয়ে থাকতে পারলাম না। ঘণ্টাখানেক পরে , নটা নাগাদ বেশ তীক্ষ্ণ একটা মহিলা কণ্ঠস্বরে এবার উঠে বসতে হলো। ডাইনিং রুম থেকে ননস্টপ ডাক আসছে । এটা নির্ঘাত বিমলা কাকিমার গলা । মায়ের সাথে কি একটা যেন লতায়-পাতায় জড়ানো সম্পর্ক । উফ , মহিলা পারেও বটে। না হয় এই কমপ্লেক্সেই থাকে , পাঁচ-ছয়টা ফ্ল্যাট পরেই ওর ফ্ল্যাট । কিন্তু তবুও , এই সাতসকালে ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে কারোর আসতে ইচ্ছে করে? নিজের বাড়িতে সাতসকালে কাজও তো কিছু থাকে নাকি? অবশ্য এই মহিলার বা এদের সমগোত্রীয় মহিলার নিজের চরকায় তেল দেওয়ার থেকে অপরের চরকায় তেল দিয়ে বেড়ানোতেই ইন্টারেস্ট বেশি । একবার যখন ধরেছে তখন আর বিছানায় শুয়ে থাকার উপায় নেই ।
দরজা ফাঁক করে একবার বললাম, আসছি!

বলে বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে টয়লেটের কাজকর্ম সেরে বেরোলাম ঘর থেকে । গিয়ে দেখি বিমলা কাকিমা সবুজ রঙের একটা শাড়ি বেশ পরিপাটি করে এই সাতসকালেই নিজের ওই গোলগাল মতো বেঁটেখাটো চেহারাটায় জড়িয়ে , আঁচলখানি কোমরে গুঁজে , হাত কোমরের ওপর রেখে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে মায়ের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে । মা রান্নাঘরে নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু-একটা উত্তর দিচ্ছে । কিন্তু বিমলা কাকিমার উৎসাহে ভাটা নেই। নিজেই একা একা অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে ।

আমি গিয়ে আস্তে করেই বললাম, কিগো কাকিমা ? এত সাত সকালে যে ? বৃষ্টি মাথায় করে ?
আমার গলা শুনে তড়িৎ বেগে মহিলা ঘুরে দাঁড়ালেন ।
কান পর্যন্ত হাসি হেসে বললেন, আর সাতসকালে মা! আজকেই তো চলে যাবি। তা ভাবলাম যাই মেয়েটার জন্য একটু মেটে চচ্চড়ি রান্না করে নিয়ে যাই। খেতে বড্ড ভালবাসে কিনা।
কষ্ট করে হেসে বললাম , তাই নাকি ? মেটে চচ্চড়ি নিয়ে এসেছো ? এই বৃষ্টির দিনে ঝাল ঝাল মেটে চচ্চড়ি দারুন লাগবে ।
— না শুধু মেটে চচ্চড়ি দেওয়ার জন্যই এসেছি ভাবিসনি যেন ।
মনে মনে বললাম, আমি খুব ভাল করেই জানি তুমি কিসের জন্য এসেছো ।
কাকিমা বলেই চললেন , সেই কোন জলপাইগুড়ি চলে যাবি শুনলাম । তবে থেকেই ভাবছি, যাই- যাই-, মেয়েটার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে কে জানে ? আসা আর হয়ে উঠছে না রে । তা, আজকে না এলে আর তো তোর সাথে এখন কবে দেখা হবে না, বল? তাই জন্যই এলাম ।
— ভালো করেছো গো । বোসো না-
আমি ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার এগিয়ে দিলাম ।
উনি চেয়ারটার দিকে আড়চোখে তাকালেন, কিন্তু বসলেন না । বললেন, আর কি বসার সময় আছে রে ? এখনই যেতে হবে । তোর কাকুকে বলে এসেছি ,এই আমি যাব আর আসব ।
মনে মনে হিসাব করে যা বুঝলাম আসা অলরেডি আধ ঘন্টার ওপর হয়ে গেছে । যাওয়া কখন হবে কে জানে ।
কাকিমা এগিয়ে এসে আমার হাতের ওপর হাত রেখে বললেন, তা একা যাচ্ছিস কেন ? বাবা-মা’টাই বা এখানে একা একা কি করবে ? নিয়ে যেতে পারতিস-
— আমি বলেছিলাম গো । একচুয়ালি একটা সেটআপ ছেড়ে অন্য আরেকটা অন্যরকম সেটআপে হঠাৎ করে গিয়ে এডজাস্ট করতে পারা যায় না । তবে আমি বলে রেখেছি। আমি ওখানে গিয়ে একটু গুছিয়ে গাছিয়ে নিই, সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করে নিই , ব্যাপার-স্যাপার দেখে নিয়ে, তারপরে বাবা-মাকে নিয়ে যাব ।
— সেই ভালো , সেই ভালো। বিয়ে তো আর করলি না । করলে আজকে আর নিজেকে একটা প্রাইভেট চাকরির জন্য এভাবে ছোটাছুটি করতে হতো না। বাবা-মা’কে নিয়ে ইনসিকিউরিটি থাকতো না । জামাই-ই এসব দেখে নিত ।

তেঁতো একটা হাসি হাসলাম । এসমস্ত কথার আমার কাছে কোন উত্তর নেই । যেন মেয়েদের চাকরির প্রয়োজন ততক্ষণ, যতক্ষণ না একটা মনের মতো উপযুক্ত ঠেস পাচ্ছে। একটা ঠেস দেওয়ার জায়গা পেয়ে গেলেই আর চাকরি না করলেও চলে। আমি চুপ করে থাকলাম । আমি জানি কাকিমা এবার ট্রাকে ফিরছেন। এই কথাগুলো শোনানোর জন্যই এই বৃষ্টি মাথায় করে একটা ছোট্ট বাটিতে দু’চামচ মেটে চচ্চড়ি নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে হানা দেওয়া ।

আমার ডানহাতটা দুহাতে করে চেপে ধরে রেখেই আড়চোখে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে অল্প একটু গলা তুলে কাকিমা বললেন, সেই ছেলে , যাকে তোমার মেয়ে বিয়ে করল না – শংকর । সে আজকে তার বউ ছেলে নিয়ে দিব্যি আছে গো । প্রমোশন হয়েছে । মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি । মোটা টাকা স্যালারি পায়। অনিতা , ওর বউ, বিয়ের আগে একটা চাকরি করতো । সেটাও তো ছেড়ে দিল। দিব্যি আছে । এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকে। হুঁ বাবা , বলতে পারবে না , আমি তোমার মেয়ের জন্য এলেবেলে সম্বন্ধ করেছিলাম। সে তোমার মেয়ে যতই বিয়ে না করতে চা’ক । সম্বন্ধটা যে আমি খাসা করেছিলাম, সে একদম প্রমাণিত।
তারপর আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে একেবারে করুণার রসে সেঁচা একখানা দৃষ্টি বুলিয়ে নিজের ডানহাতটা আমার গালের ওপর বুলিয়ে দিয়ে বললেন , আজকাল কেমন যেন কালো হয়েছিস । টোটো করে এইসব প্রাইভেট চাকরির জন্য এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালে হবে না ?
বুড়ো আঙুলে করে আমার গালের মাঝখানটা একবার বুলিয়ে নিয়ে বললেন, এখানে আবার একটা কালো মত কি দাগ হয়েছে । ওমা ! এটা তো আগে দেখিনি। স্কিন স্পেশালিস্ট দেখাস। বিয়ে না হয় করিস নি । তা বলে , নিজের এরকম অযত্ন করবি ? একটা বর থাকলে আজকে আর দেখতে হতো না । জোর করে সমস্ত খেয়াল রাখতো ।
আবার মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন , মেয়ের তো মেঘে মেঘে বেলা কম হলো না । আর তো কয়েকটা বছর পরেই চল্লিশ হবে, নাকি গো ?
আমি ছোট্ট করে বললাম , কয়েকটা বছর পরে নয় কাকিমা। একবছর পরেই হবে । তুমি যখন সম্বন্ধটা করেছিলে, তখন ঠিক বয়সই তোমায় বলা হয়েছিল ।

তেঁতো গলায় কাকিমা বললেন , তবে তো চুকেই গেল। বিয়ে’থা আর করবি না বলেই তো মনে হচ্ছে । আর যখন বয়স ছিল, চেহারা ছিল ছিমছাম, তখনই করলি না। এখন আর –
কাকিমার এই হিতাকাঙ্খী মোড়কে বাঁধানো বিষ বাক্যগুলো সহ্য করতে পারছিলাম না আজকে আর । বেশ কিছু বছর ধরেই শুনে আসছি । কাকিমা আমার জন্য একটি সম্বন্ধ করেছিলেন । তা আজ প্রায় বছর দশেক আগেকার কথা। কাকিমার কেমন যেন দূর সম্পর্কের লতায় পাতায় জড়ানো কি একটা হয় । ইন্ডিয়ান সোসাইটিতে এমন একটা ধারণা পোষণ করা হয়, মেয়েদের বিয়ে ‘হয়’, তারা বিয়ে করে না । সেখানে তাদের নিজস্ব মতামত পছন্দ-অপছন্দ বলে কিছুই থাকবে না । সবসময় কেন অপছন্দই হতে হবে ? আমার নিজস্ব মতামত বলেও তো কিছু আছে । আমি নিজের ইচ্ছায় নিজের জীবনটা কাটাতে পারি না? কিন্তু না । আমাদের সোসাইটি এসব এখনও ভাবতে শেখাচ্ছে না । এই আধুনিক যুগেও । আশ্চর্য কান্ড বটে । পাত্রপক্ষের হয়ে নিজে উপযাজক হয়ে সম্বন্ধে এনেছিলেন , তা আবার আমি পাত্রী হয়ে সে সম্বন্ধ ফিরিয়েছি । তাও সে পাত্রী আবার ডানাকাটা পরীও নয় । রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক তাই ।
কাকিমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একটু সরে দাঁড়ালাম । বললাম, বিয়ে করার জন্য তো তোমার কাছে আমি সাধ্যসাধনা করিনি কাকিমা । আমার বাবা-মাও করেনি । কেউ সম্বন্ধটা আনতেই বলেনি তোমায় ।
গোমড়া মুখে কাকিমা বললেন , নিজের মানুষদের আবার কে কবে কি বলে ? ভালো চাই বলেই –

চাপা টেনশনটা বুকের ভেতর রয়েছেই । ইনিয়ে-বিনিয়ে, বেঁকিয়ে-চুরিয়ে , ঘোরানো-পেঁচানো কথাবার্তা সহ্য করতে পারছিলাম না।
বললাম, তোমরা সবাই মিলে এবার আমার ভালো চাওয়াটা একটু বন্ধ করো। তাতেই আমি ভালো থাকবো ।
কাকিমার সঙ্গে কিরকম যেন একটা দূরের সম্পর্ক , আমার ঠিক মাথায় ঢোকেনা । বয়স আমার থেকে খুব একটা বেশি নয় । বছর দশেক হবে। তবে সম্বন্ধের খাতিরে কাকিমাই বলি । সম্বন্ধটা আনার পরে সেটা আমিই রিজেক্ট করে দিয়েছিলাম । পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নয় । আমার বিয়ে করার ইচ্ছে হয়নি , তাই । এই সহজ সাধারণ সত্যিটা কাকিমা এতগুলো বছরেও কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। সময়-সুযোগমতো আমাদের ফ্ল্যাটে এসে একবার করে শুনিয়ে দিয়ে যায়, তা সে আমাকেই হোক, বা মাকে।
কাকিমার মুখটা আমার কথা শুনে হাঁড়ির মত ঝুলে গেল । বলল , ভালো চাই বলেই বলি। অবশ্য এখন আর ভালো চেয়েও লাভ নেই । কেউ আর ভিড়বে না-

সবসময়ই কাকিমা একাই কথা শুনিয়ে যায়। প্রতিবারই মাথা নিচু করে শুনি । কিছুই মুখ ফুটে আজকে এত বছরেও বলা হয়নি । আজকে মনটা এমনিতেই চঞ্চল ছিল । তার ওপরে কাকিমার এই সমস্ত বাক্য আর সহ্য হচ্ছিলো না বলেই কথাগুলো মুখ ফুটে বলে ফেলেছিলাম । কথাগুলো বলে ফেলার পর দেখলাম কাকিমা সযত্নে নিজের যে কুচুটে চেহারাটা মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখে, সেটা অনায়াসে বেড়িয়ে পড়ল । কথার মধ্যে রীতিমতো বিষ।
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম । তাও গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম ,কাকিমা সাতসকালে এসে কেন আবার সেই সব পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছো ? আমার বাবা-মায়ের কোনো অসুবিধে নেই আমার বিয়ে না করা নিয়ে । তুমি কেন তাহলে শুধু শুধু –

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কাকিমা মাঝপথে বাধা দিয়ে এবার নিজের ব্রহ্মাস্ত্রটা ছাড়লেন।
বললেন , বাবা মায়ের জ্বালা তুই কি বুঝবি রে ? তা তোর বাবা-মায়ের আর চিন্তা থাকতো না, তোর যমজ ভাইটা যদি আজকে বেঁচে থাকত।
মায়ের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা যেটা ,সেটা বিমলা কাকিমা খুব ভাল করেই জানে। যখনই কোনরকম বেকায়দায় পড়ে যায়, এই কথাটা রিপিট করে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না । গলার কাছে বাষ্প দলা পাকিয়ে উঠলো । একটা কিছু রিপ্লাই দেওয়ার জন্য মুখ তুলেছিলাম ।

পাশের ঘর থেকে ডাক এল , তরু মা ! একবার আসবি এ’ঘরে ?
গলার দলাপাকানো বাষ্পটাকে ঠেলে ভেতরের দিকে নামিয়ে দিয়ে কাকিমার সাথে আর কোন কথা না বাড়িয়ে, বাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম । দেখলাম , সেই চিরাচরিত দৃশ্য । দক্ষিণের জানালা খোলা । সেদিকেই উদাস চোখে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে বাবা । গায়ে ছিটে ছিটে খাদির পাঞ্জাবি । চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ইজি চেয়ারের ওপর আধশোয়া অবস্থায় দুই হাত ভাঁজ করে বুকের ওপর রাখা। হাতের নিচে রয়েছে-‘ গীতাঞ্জলি’।
বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আয় ! এখানে বোস ।
আমি গুটি গুটি পায়ে গিয়ে বাবার চেয়ারের পাশে মাটির ওপর বসে পড়লাম । বাবা আমার মাথার ওপর হাত রেখে বলল, আজ সকালেই এভাবে কথা কাটাকাটিতে জড়াস না মা । একা একা থাকতে যাবি , মন কেমন করবে । বিক্ষিপ্ত মনে যাবি, আরো খারাপ লাগবে ।
বললাম, বাবা , তুমি এসব নিয়ে এখন ভেবোনা । তোমার শরীর খারাপ করবে ।
কিছুক্ষণ বাপ-বেটি দুজনেই চুপ করে রইলাম । তারপরে বললাম, বাবা , তোমার কিছুদিন আগেই শরীরটা এতো খারাপ করেছিল । এখনও ঠিক করে সুস্থ হয়ে ওঠো নি । আমি ওখানে গিয়ে কিছুটা গুছিয়ে নিই । তারপরে কিন্তু তোমাকে আর মাকে দুজনকেই ওখানে গিয়ে থাকতে হবে । অবশ্য কি যে করব ঠিক ডিসাইড করতে পারছিনা । রাতবিরেতে হঠাৎ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হলে -, ওখানটা তো বেশ রিমোট এরিয়া । তার চেয়ে বরং এখানে কিছু মাস থেকে একেবারে সুস্থ হয়ে নাও । তারপরে তোমাদের নিয়ে যাব।
বাবা কিছু বলল না । শুধু ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । ওঘর থেকে মা আর বিমলা কাকিমার গলার আওয়াজ আসছে । কাকিমার গলা বেশ উত্তেজিত ।
বাবা বলল , দরজাটা একটু বন্ধ করে দিয়ে আয়তো মা । এখানে বস। মনটা শান্ত কর ।
আমি উঠে গিয়ে দরজাটা চেপে বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এসে আবার গুটিগুটি পায়ে সেখানে বসলাম । বাবা আমার মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে মনে মনে কি আশীর্বাদ করল কে জানে । আমার মাথার ওপর নাকটা নিয়ে এসে দীর্ঘ একটা আঘ্রাণ বুক ভরে নিয়ে বলল , ভারী মিষ্টি তোর মাথার গন্ধটা। সেই ছোট্টবেলা থেকে। বুক ভরে নিলেই মনটা ভালো হয়ে যায় ।
দুটো চোখ জলে ভরে এল । মনে মনে বললাম, বাবা তুমি তো আমার ‘শান্তিনিকেতন’ -… আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি,…
মুখে বললাম, বাবা, কি পড়ছিলে ?
বাবা থেমে থেমে বলল , ‘আমার এ ধূপ না পোড়ালে/ গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে/ আমার এ দীপ না জ্বালালে/ দেয় না কিছুই আলো ..
চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল । চুপ করে রইলাম । আর দু’জনের কেউই কোনো কথা বললাম না । আমার মনটা যখন ভারী হয়ে যায় , ভীষণরকম ভারী, কি জানি কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে বাবা সেটা প্রতিবার জেনে ফেলে । আর কোনো না কোনোভাবে পরিশ্রুত করে দেয় । আধঘন্টা মতো সে ঘরেই বসে রইলাম । কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম বিমলা কাকিমা একসঙ্গে অনেক কথা বলতে বলতে চলে গেলেন । মা দরজা বন্ধ করে দিল। শব্দ পেলাম। বারকয়েক ডাকাডাকি করল আমাকে , ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়ার জন্য । আমি সঙ্গে সঙ্গে না উঠলেও কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম সে ঘর থেকে ।

বেলা বারোটা বেজে গেছে । এটা-ওটা যা জিনিসপত্র গোছানোর বাকি ছিল, সমস্তটাই গুছিয়ে নিয়েছি । প্যাকিং কমপ্লিট । বাথরুমে গেলাম স্নান করতে । বাথরুমে ঢুকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বুঝলাম, মনের ভেতর অনেকখানি গ্লানি জমা হয়েছে বিমলা কাকিমার কথাগুলো থেকে । কি অদ্ভুত ! এ সংসারে অন্যের করা দোষ বা দুর্ব্যবহারের কারণে গ্লানি জমা হয় আর একজনের মনে। নাইটিটা খুলে ফেললাম , সঙ্গে অন্তর্বাস । আমাদের বাথরুমে একটু লম্বাটে একটা পুরনো আয়না বসানো আছে । নাভি পর্যন্ত অংশ তাতে দেখা যায় । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজেকে । মুখটা সত্যিই একটু কালো লাগছে বটে । ফর্সা আমি কোনদিনই নই । তবে কালোও লোকে বলে না । মাঝারি গায়ের রং । তবে কি জানি, একটু বেশি কালো লাগলো । সেটা কি সত্যি করেই? নাকি বিমলা কাকিমার বলা কথাগুলোর ইন্ডাক্টিভ এফেক্ট? কে জানে? গালের দাগটার ওপর আঙুল বুলিয়ে দেখলাম । পরিধিতে একটু ছড়িয়েছে গোল হয়ে, কালো ছিটে ছিটে দাগ হয়েছে । গলার পরে বুকের কাছটা আবার একটু বেশি ফর্সা । আবৃত থাকে তো । ট্যান পড়ে না । বরাবরই আমার বুকের কাছটা সাধারণের থেকে বেশি ভারী । বাঁধন নেই মোটে, শিথিল। সত্যি কথা বলতে কি , তাই নিয়ে আমার হীনমন্যতাও রয়েছে। ফিগারটা খুব সুন্দর হোক, এ আর কোন মেয়ে না চায় ? কোনদিন কেউই বলবেনা, আমার ফিগার খুব ভাল ছিল । তবে আজ থেকে দশ কি পনের বছর আগে যে খুঁতগুলো ছিল না, সেগুলোও এখন সংযোজন হয়েছে । কোমরের কাছটায় মেদ জমে ভারী হয়েছে । কোমরের খাঁজ বলে আর কিছু নেই । চেহারাটাও বেশ ভারীক্কি হয়েছে । চুল মোটামুটি ছিল বরাবরই , খুব বেশি কিছু ছিল না, আবার খুব পাতলাও নয় । কিন্তু, এখন বেশ পাতলা হয়ে গেছে । ছোট করে কেটে ফেলেছি । পাতলা চুলে আর কি বিনুনি করব ? আগে কিন্তু বেশ কোমর ছাড়িয়ে একটা বিনুনি হত। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে নিজের চুল, মুখশ্রী ,হাত, গলা, পেট, আয়নায় যতটা দৃশ্যমান, ততটা সাধ্যমতো অনুভব করার চেষ্টা করলাম । আশাহত হলাম । সুন্দরী কোনো কালেই ছিলাম না । তবে হাবেভাবে মুখের ওপর নিজের বয়স জনিত চেহারা নিয়ে কথা শুনতেও হয়নি কখনো । সুশ্রী বলতো লোকে ।

অবাক হয়ে দেখলাম আয়নায় যে মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে তার দুটো চোখ জলে ভরে এসেছে । ঝরে পড়ছে চোখের জল । গালের সেই কালো অংশটা পেরিয়ে নিচে নেমে আসছে । রাগ হল নিজের ওপর। নিজের চেহারার ওপর । সুন্দরী হলাম না কেন ? এত কেন সাদামাটা দেখতে আমি? বয়সটাও কেন ধরে রাখা যায় না ? লোকে বলে মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি । আমার সেখানে আর এক বছর পর পাক্কা দু’কুড়ি বয়স হবে । শাওয়ারটা খুলে দিয়ে বাথরুমে উবু হয়ে মেঝের ওপর বসে পড়লাম । মাথা , দেহের ওপর অবিশ্রান্ত ধারায় বয়ে চলেছে জল । বাথরুমের আউটলেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । স্থির দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম । কতকিছু চলতে লাগলো মনের অতলে । তবুও অন্যের দেওয়া গ্লানি ধুয়ে মুছে গেল কই ? সারাজীবন ধরে আর কতভাবে কতজনের দেওয়া গ্লানি বয়ে বেড়াবো আমি?

ক্রমশ..