ভালোবাসি তারে পর্ব-০৪

0
7681

ভালোবাসি তারে

৪.
ঝুমের মনে এক অদ্ভুদ অনুভূতি হচ্ছে। বুক কাঁপছে তার। যথাসম্ভব নিঃশব্দে নিঝুমের সাথে হাঁটার চেষ্টা করছে ঝুম। বাঁকা চোখে ঝুমের কাঁপাকাঁপি দেখে নিঝুম। প্রশ্ন করে,
— “কাঁপছো কেন?”

ঝুম অপ্রস্তুত হয়ে পরে। ইতস্ততভাবে বলে,
— “না কিছু না। শীত লাগছে একটু।”

নিঝুম শব্দ করে হেসে উঠে। উজ্জ্বল চোখে ঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “এই গরমে শীত লাগছে তোমার! সিরিয়াসলি?”

ঝুম জবাব দেয় না এবার। চুপ থাকে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে তারা। বাজার থেকে অনেক দূর। এদিকটায় মানুষ নেই বললেই চলে। হঠাৎ দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। ঝুম নত মাথা উঠিয়ে আকাশের দিকে তাকায় একবার। অবাক হয়। একটু আগেও না গরমে বেহাল অবস্থা হচ্ছিল সবার? অথচ এখন কালো মেঘে ঢেকে গেছে পুরোটা আকাশ। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। বলতে না বলতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হতে শুরু করল। বাতাসের কারণে বৃষ্টির ফোটাগুলো তীব্র আকার ধারণ করেছে। বোঝা যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর ঝড় বর্ষণ হবে। পিটপিট চোখে নিঝুমের দিকে তাকালো ঝুম। ম্লান কণ্ঠে বলল,
— “আমাদের এখন ফিরে যেতে হবে ডাক্তার। বৃষ্টি বাড়বে।”
নিঝুম আফসোসের সঙ্গে বলল,
— “ফিরে যেতে হবে? বৃষ্টি কমবে না?”
ঝুম মাথা নাড়িয়ে না জানায়। নিঝুম মুচকি হেসে বলল,
— “চলো, ফিরে যাই।”

ঝুমের বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। আচ্ছা, নিঝুমের চোখ জোড়া এত সুন্দর কেন? হাসার কারণে চোখ ছোট ছোট হয়ে গেছে। আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। ঝুম চোখ সরিয়ে ফেলে তৎক্ষনাৎ। নিজের এহেন ভাবনায় নিজেকে বেশ ভাবে গালাগাল করে কিছুক্ষণ।

ঝুম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকায় নিঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ভারি কণ্ঠে বলে,
— “কি হলো? যাবে না?”

ঝুম হকচকিয়ে যায়। পরপরই মাথা নাড়িয়ে দ্রুত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে,
— “হ-হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলুন।”

নিঝুম আবারো হাসে। ঝুমের হাত ধরে ফেলে হঠাৎ। দৌঁড় লাগানো শুরু করে। কেননা, বর্ষণের বেগ বেড়ে গেছে ইতিমধ্যে। এদিকে ঝুম যে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে। সেদিকে কি খেয়াল আছে নিঝুমের? উহু! নেই।

কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বাজারের অনেকটা কাছে পৌঁছে যায় ঝুম আর নিঝুম। বাজারের দিকটায় লোকজনের সমাগম বেশি। নিঝুমকে ঝুমের সাথে দেখলে খারাপ ভাবতে পারে। সুতরাং ঝুমকে নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পরে নিঝুম। হাত ছেড়ে দেয় তৎক্ষনাৎ। নিজের শার্ট ছাড়তে শুরু করে। পুরো কাক ভেঁজা হয়ে গেছে দুজনেই। নিঝুম বলে,
— “তোমাকে আমার সাথে দেখলে সবাই খারাপ ভাববে। তুমি চলে যাও। আমি কিছুক্ষণ পরে যাবো।”

ঝুম যায় না। কাদা যুক্ত রাস্তায় নিঝুমের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। নিঝুম ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। ধমক দিয়ে উঠে,
— “যাচ্ছো না কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
— “আপনি যাচ্ছেন না কেন?”
— “মানে?”
— “আপনারও তো ঠান্ডা লাগবে! আপনি আগে যান। আমার অভ্যেস আছে।”

নিঝুমের হালকা রাগ হয় ঝুমের উপর। চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে সিটিয়ে যায় ঝুম। কথা না বাড়িয়ে ঢোক গিলে দ্রুত পায়ে সামনের দিকে আগাতে থাকে। একটু এগিয়ে আবারো পেছনে ফিরে তাকায় ঝুম। নিঝুম বুকে হাত পেঁচিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝুমের দিকে। ভয় যেন আরেকটু বাড়ে। সামনে ফিরে ঝুম এবার পায়ের গতি আরো বাড়িয়ে দেয়।

______________

দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে এলো। বৃষ্টি থেমে গেছে আধা ঘন্টা আগে। এখন নিধাকে পড়াতে বের হয়েছে ঝুম। মিনিট দশেক পর পৌঁছেও যায় জমিদার বাড়ি। ড্রইংরুমে সবাই বসে আছে। নিধাও। একমাত্র নিঝুম ছাড়া। ঝুম এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিঝুমকে খুঁজে। পায় না। হঠাৎ নিঝুমের বাবা শাখাওয়াত শেখ বলে উঠলেন,
— “কিছু খুঁজছো নাকি?”
ঝুম ভড়কে যায়। দ্রুত মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে ‘না’ জানায়। শাখাওয়াত শেখ কথা বাড়ান না। পত্রিকা পড়তে মনোযোগ দেন আবার। রান্নাঘর থেকে নিঝুমের মা সানজিদা উঁচু গলায় বললেন এবার,
— “ঝুম? এসেছিস? রান্নাঘরে আয় তো একটু।”

ঝুম হাতের ব্যাগটা সোফায় রাখে। টেবিলে ড্রইং করা রত নিধাকে বলে,
— “নিধা, আমার ব্যাগ নিয়ে তোমার স্টাডি রুমে রেখে আসো। আর বইও গুঁছিয়ে রাখো। আমি আসছি একটু পর।”

নিধা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। ঝুম চলে যায় রান্নাঘরে। ঝুমকে দেখে সানজিদা ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন,
— “বুঝলি ঝুম? আমার ছেলে নিঝুমটা না বৃষ্টির পানি একটুও সহ্য করতে পারে না। গ্রাম ঘুরতে আজকে সকালে বেড়িয়েছিল। দুপুরের দিকে বৃষ্টির পানি দিয়ে একেবারে গোসল করে ফিরেছে। এখন সর্দিতে নাক, কান লাল হয়ে গেছে সাহেবের। আমি বলেছিলামও না বেড়তো। আমার কথা শোনে কে?”

ঝুমের মনে খারাপ লাগা আর প্রশান্তি দু’টোই বয়ে গেল। নিঝুমকে এখন সামনে পেলে ঝুম বেশ গর্ব করে বলতো, ‘বলেছিলাম না ডাক্তার, আপনি আগে চলে যান! গেলেন না কেন? উল্টো আমাকে ধমক দিয়েছেন। বেশ হয়েছে আপনার সর্দি হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি।’
ইশ! নিঝুমের সামনে যদি বলতে পারতো ঝুম! নিঝুমের চুপসে যাওয়া মুখ উপভোগ করতে পারতো। আচ্ছা, এমন পরিস্থিতিতে নিঝুমের চোখগুলো কেমন রঙ ধারণ করতো? রেগে গেলে সবুজ, লাল মিশেল হতো? নাকি শীতল হতো চোখের মণি? উত্তর অজানা ঝুমের। তবে মনে মনে একটা ছবি এঁকে ফেলেছে সে। নিঝুমের চোখের ছবি!

ভাবনায় ছেদ করে কফি কাপে ঢালতে ঢালতে সানজিদা বলে উঠলেন,
— “ঝুম মা? তুই তো নিঝুমের রুমের পাশ দিয়েই যাবি। একটু কফিটা নিঝুমকে দিয়ে আসতে পারবি?”

এ যেন মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি। ঝুম তাড়াতাড়ি বলে উঠল,
— “পারবো আন্টি। দিন আমাকে।”

সানজিদা মুচকি হেসে কাপটা দিয়ে দিলেন। ঝুম কাপ নিয়ে চলে গেল। সানজিদা চেয়ে রইলেন ঝুমের যাওয়ার পথে। মেয়েটাকে অদ্ভুদভাবে ভীষণ ভালো লাগে সানজিদার। বেশ ভদ্র, সভ্য মেয়ে ঝুম!

ঝুম কফি হাতে চলে গেল নিঝুমের দরজার সামনে। নক করলো বেশ কয়েকবার। এক মিনিট পর নিঝুমের উত্তর এলো,
— “কাম ইন।”

ঝুম ধীর পায়ে রুমে ঢুকলো। নিঝুম বিছানায় আধ-শোয়া ভাবে বসে আছে। বারবার টিস্যু দিয়ে নাক মুছছে আর হাঁচি দিচ্ছে। ঝুমকে রুমে দেখে নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,

— “তুমি এখানে?”
— “আন্টি কফি দিতে পাঠালো।”
— “ওহ্!”

বলতে বলতেই আবারো হাঁচি দিলো নিঝুম। নাক টেনে বলল,
— “টেবিলে রেখে যাও।”
কথা মতে ঝুমও কফি টেবিলে রেখে দিলো। তবে গেলো না। দাঁড়িয়ে রইলো নিঝুমের পাশে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “আপনার কি বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

নিঝুম অবাক হলো যেন। ঝুমের দিকে তাকালো। পরক্ষপণেই হালকা হেসে বলল,
— “না! ডাক্তারদের কষ্ট হয় না।”

ঝুম ভ্রু কুঁচকায়। তার রাগ হচ্ছে। কটমট কণ্ঠে ঝুম বলে,
— “কেন? আপনি কি মানুষ না? গরু ছাগল?”
— “হ্যাঁ?”

নিঝুম চটে গিয়ে মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো। বলল,
— “কি বললে তুমি?”
ঝুম হাসে। কিছু না বলেই এক দৌঁড়ে চলে যায় রুমের বাইরে। হাপাতে হাপাতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ আছে কি-না। কাউকে না দেখে ঝুম এবার নাক কুঁচকে বিড়বিড় করে উঠে,
— “ডাক্তার না ছাঁই! খালি ধমক আর ধমক! ডাক্তাররা কি এত বদ মেজাজি আর ত্যাড়া হয়? উনি এমন কেন? একদম যাতা!”

_______________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

(রি-চেক করি নি। ভুল-ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)