ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-১৭+১৮

0
414

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_১৭
©জারিন তামান্না

৩ দিন হলো সিফাত ট্রেনিং এর জন্য ইউএস চলে গেছে। ১ মাস চলবে ট্রেনিং। তারপর, ফর্মালিটি শেষ করে দেশে ফিরতে সময় লেগে যাবো আরও কয়েকটা দিন।সে আকদ করে রেখে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও পলকের বাবা সেটা নাকচ করেছেন। তিনি চান,সিফাত ট্রেনিংটা শেষ করে ভালোভাবে আগে দেশে ফিরুক তারপর আগের প্ল্যান অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকতা করে তবেই তিনি মেয়ে বিদায় করবেন।

তাছাড়া একমাস পর বিয়ে হওয়ায় বিয়ের প্রস্তুতি আর খরচ নিয়েও বেশ চিন্তায় ছিলেন তিনি। যদিও সিফাতদের পক্ষ থেকে বিয়ে নিয়ে তেমন কোন চাহিদা নেই,অনুষ্ঠানটাও তাদেরই ফার্ম হাউজে হচ্ছে, তবুও সামাজিকতা বলে একটা ব্যাপার থেকে যায়। সিফাতদের মত এত আয়োজন, খায়-খরচা করতে না পারলেও মেয়েকে একেবারেই শূন্যহাতে তো শশুড় বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারেন না তিনি। কিন্তু এসব চিন্তার পরেও ছেলেপক্ষের কথার উপর কথা বলতে পারেননি। একে তো সব জেনেও তারা যেচে পড়ে এসে মেয়ে নিতে চাইছে,তারপর যদি তার কথায় কিছু মনে করে বিয়েটা নিয়ে কোন আপত্তি করে! তাই একমাসের অল্প সময়েও তিনি বিয়েটা দিতে রাজি হয়েছিলেন। তবে,এখন বিয়েটা পিছিয়ে যাওয়ায় তিনি বরং কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। হাতে মাস দুই সময় পাওয়া গেল। এবার ধীরেসুস্থে তিনি বিয়ের প্রস্তুতি নিতে পারবেন। তাই বিয়েটা আরও দুই মাস পরে হবে বলে ঠিক করেছে দুই পরিবারের সদস্যরা।

তবুও,এ নিয়ে সিফাতের কিছুটা মন খারাপ রয়ে গেছে। তিয়ানের সাথে দেখা হওয়াকে কেন্দ্র করে পলকের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা অজান্তেই একটা অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি করেছিল সিফাতের মনে। তারওপর আবার বিয়েটাও পিছিয়ে গেল আরও দুমাস। সে ভেবেছিল অন্তত আকদ করে রেখে যাবে। পলককে নিজের করে তবেই নিশ্চিন্ত মনে পাড়ি দেবে অন্যদেশে। কিন্তু,পলকের বাবা সেটা চায়নি বলে সেও আর কিছু বলেনি এই নিয়ে। ট্রেনিং এ যাওয়ার আগে মাত্র ৭দিন সময় পেয়েছিল সে।যার জন্য অফিসের কাজ গুছিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।বেশ ব্যস্ত সময় গেছে তার সেই দিন গুলোয়। পলকের সাথেও আর যোগাযোগ হয়নি কোন। কিন্তু তাই বলে যাওয়ার আগে পলকের থেকে একবার বিদায় নেবে না,এমন তো আর হয় না! তাই চলে যাওয়ার আগের রাতে অফিস শেষে বাসায় ফিরে কল করলো পলককে।
________________________________

রাত তখন ১২:৭ বাজে। পলক তখনও স্টাডি টেবিলে বসা।১ দিন পর তার ক্লাসের বাচ্চাগুলোর সাপ্তাহিক ক্লাসটেস্ট। প্রশ্নপত্র তৈরী করছিল সে। ঠিক তখনই টেবিল কাপিয়ে ভাইব্রেশন মোডে বেজে উঠলো ফোনটা। হাতের কাছ থেকে খানিকটা দূরেই রাখা ছিল ফোনটা।প্রশ্ন লিখতে লিখতে একনজর তাকালো সে ফোনটার দিকে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা দেখে বেশ অবাক হলো সে। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে নিল সে। এতরাতে সিফাতের কল করার কথা নয়। “কোন সমস্যা হলো কি?” -কথাটা ভাবতে ভাবতেই রিসিভ করলো কলটা। তারপর স্বভাবসুলভ শান্ত স্বরে সালাম দিল,
_হ্যালো…আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম মৃন্ময়ী। একটা ফোনের ডেটা অন করুন তো। কল দিচ্ছি আমি।-বেশ জলদি জলদি বললো সে কথাগুলো।যেন কোন কিছুর কারণে বড্ড তাড়ায় আছে সে।
_আচ্ছা। -বলেই কল কেটে দিল পলক। তারপর ফোনের ডেটা অন করলো। অপেক্ষায় রইলো সিফাতের কলের। ডেটা অন করার মিনিট দুই পরেই সিফাতের হোয়াটস অ্যাপ নাম্বার থেকে কল এলো পলকের ফোনে। ভিডিও কল করেছে সে।

ভিডিও কল দেখতেই আজ বেশ তটস্থ হয়ে গেল পলক। সেদিনের ওড়নার ঘটনাটায় ঢের শিক্ষা হয়েছে তার। তাই কল রিসিভ করার আগে ওড়নাটা ঠিকঠাক করে জড়িড়ে নিল গা’য়ে। তারপর ধীরেসুস্থে রিসিভ করলো কলটা। কিন্তু, কল রিসিভ করার পর ফোনের ও পাশে আর কাউকে পাওয়া গেল না। ভ্রু কুচকে গেল পলকের। ফোনটা বিছানার দিকে তাক করে রাখা,মুখোমুখিভাবে। বিছানার উপর এক কোণে একটা বড় লাগেজ রাখা।মনে হচ্ছে, লাগেজ গোছানো হচ্ছে।কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।কিন্তু সেখানে সিফাত নেই। একনজর চোখ বুলালো পলক ঘরটায়। বিছানার দিক থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, বেশ ছিমছাম,গোছানো ঘর বলে মনে হলো তার কাছে।

বিছানার কাছ ঘেঁষে একটা সাইড টেবিল রাখা। টেবিলের উপর লম্বা একটা ল্যামসেড। সিফাতের একটা ছবি ফ্রেম করা। পাইলটের ইউনিফর্ম পড়া।চোখে সানগ্লাস আর মাথায় ক্যাপ। পলিশড সুজ।প্লেনের সামনে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কি সুন্দর প্রাণোচ্ছল হাসি। ছবিটা দেখে মনে হলো বেশ আগের। কিছুটা অন্যরকম লাগছে তাকে। ছবিটার সামনেই একটা ওয়ালেট,ঘড়ি আর গাড়ির চাবি রাখা। ব্যাস..এর চাইতে বেশি আর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। পলক যখন ঘর পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত তখনই এক ঝলকে সিফাত ক্রস করে গেল ক্যামেরাটার সামনে দিয়ে। পলকের ধ্যান ভাংলো এতে। এরপরেই শোনা গেল সিফাতের কথার আওয়াজ।

_Hey…Mrinmoyi. কেমন আছেন আপনি?
কথাটা বলতে বলতেই কোথাও একটা যাচ্ছিল সিফাত।কিন্তু, সিফাত ক্যামেরা ক্রস করে যাওয়ার সময় যতটুকু তাকে দেখা গেছে তাতেই একপ্রকার থতমত খেয়ে গেছে পলক। মেরুন রঙের একটা টি-শার্ট আর আর ছাই রঙা থ্রি-কোয়াটারে একটা প্যান্ট পড়া। পায়ে ঘরে পড়ার স্লিপার। প্যান্টের কারণে হাঁটু থেকে সিফাতের ফর্সা লোমশ পায়ের বেশ অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। যেটা দেখেই পলকের চক্ষুচড়কগাছ! দুই একটা হার্টবিটও মিস করলো সে। লজ্জায় দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল । মনে মনে বললো,
_সমস্যা কি এই মানুষটার! যখন দেখো আমাকে লজ্জায় ফেলার উপক্রম করে। সেদিন ওড়না আর আজ…ভাবতেই লজ্জায় খিঁচে চোখ বুজে এলো তার।একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে ধাতস্ত করলো নিজেকে। এরপর সিফাতকে অনুসরণ করে চাইলো বিছানার দিকে।

এবারে ক্যামেরার সামনে স্থিরভাবে দেখা মিললো সিফাতের।বেশ লম্বা চওড়া এই মানুষটা। লাগেজের সামনে দাঁড়ানোর ফলে এখন আর পাগুলো দেখা যাচ্ছে না সেভাবে। যাক, এবার আর অস্বস্তি হবে না মানুষটার দিকে তাকাতে। -ভেবেই মৃদু হাসলো পলক নিজ মনে।তারপর পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকালো সে সিফাতের দিকে।ভাজ করা কয়েকটা টি-শার্ট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাগেজের সামনে। হয়তো লাগেজে ভরার জন্যই এনেছে। তা দেখে পলক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সিফাতের দিকে। মূলত সিফাতের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে।পলকের ওভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে তার দৃষ্ট অনুসরণ করে সেও তাকালো তার হাতের দিকে। তারপর, একগাল হেসে দিয়ে খানিক উঁচিয়ে পলকে টি-শার্টগুলো দেখিয়ে বললো,
_প্যাকিং চলছে। কাল সকালের ফ্লাইট। অথচ, অফিসের কাজের ব্যস্ততায় প্যাকিংটাই করা হয়নি এখনো। -বলেই টি-শার্টগুলো লাগেজে গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে গেল সে। তারপর,ওগুলো গোছাতে গোছাতেই বললো,
_তোহ..মিস. মৃণ্ময়ী! কেমন আছেন আপনি? দিন কাল কেমন যাচ্ছে আপনার? আর হ্যাঁ,স্যরি…এত রাতে কল করার জন্য।।আসলে হয়েছে কি এতদিন ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। মাস দেড়েকের জন্য যাচ্ছি তো। অফিসের কাজ গুছিয়ে দিয়ে না গেলে বাবার সমস্যা হতো।আর ওখানে গেলে ট্রেনিং এ বিজি হয়ে যাবো। কখন সময় হবে না হবে কন্টাক্ট করার কে জানে। আর,যাওয়ার আগে আপনার সাথে একবার দেখা করে যাবো না সেটা কি করে হয় বলুন! আপনি তো ভুলেও একবার কল করবেন না জানি। আপনার তো মনেই পড়ে না আমাকে। কিন্তু, আমি তো মিস করি আপনাকে। তাই অগ্যতা বাধ্য হয়ে আমাকেই এতরাতে ভিডিও কল করতে হলো।-বলেই খানিক ফিচলে হাসলো সিফাত। তার টি-শার্টগুলো গোছানো শেষ।তারপর আবার এসে ক্যামেরা ক্রস করে চলে গেল কোথাও। একটু পরেই ফিরে এলো হাতে আরও কয়েক সেট শার্ট প্যান্ট নিয়ে। পলক ধারণা করে নিল, ওপাশটায় বোধয় আলমারি।

এতক্ষণ যাবৎ, পলক চুপচাপ দেখে যাচ্ছে সিফাতের কান্ডকারখানা। সিফাত যে অতক্ষণ ধরে এত বকবক করছে সেটার বিপরীতে কোন কিছুই বলেনি সে। হঠাৎ সে খেয়াল করলো সিফাত বেশ চিন্তিত মুখে লাগেজ থেকে কিছু কাপড় একবার বের করছে আবার ঢুকাচ্ছে। তিন চারবার এমন করার পর পলক জিজ্ঞেস করলো,
_এডজাস্ট হচ্ছে না ওগুলো?
কাপড়গুলো রেখে ফোনের দিকে চাইলো সিফাত। অসহায় মুখ করে ডা’য়ে বা’য়ে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। খানিক বিচলিত ভঙ্গিতে পলক বললো,
_দেখি,দেখান তো আমাকে..
আচমকা পলকের এমন একটা কথা শুনে অবাক হলো সিফাত। মনে মনে কি যেন ভেবে মৃদু হাসলো সে। তারপর এগিয়ে এসে ফোনটা লাগেজের কাছে নিয়ে গেল। লাগেজের ভেতরটা দেখালো পলককে। পলকও চোখ বুলিয়ে নিল লাগেজটায় একবার। তারপর বললো,
_প্যান্টগুলো লম্বা করে নিচের দিকে দিয়ে প্যাক করুন। আর ওগুলোর উপর একসাইডে আপনার শার্ট, আর অন্যসাইডে টি -শার্ট গুলো রাখুন। ইউনিফর্ম গুলো শার্টের সাথে রাখুন। বাকি যতটা জায়গা থাকবে সাইডে ওখানে আপনার টুকিটাকি জিনিসগুলো আরামসে এডজাস্ট হয়ে যাবে। আর আপনার টাওয়ালটা কাপড়ের উপরে বিছিয়ে নিলেই সুন্দর মত এডজাস্ট হয়ে যাবে সবটা।-বলেই নিজের কাজে নিজেই খুশি হয়ে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে হাসলো সে। সিফাত মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে হাসি।এই প্রথম সে পলককে এভাবে হাসতে দেখছে। প্রেয়সীর মুখে এই হাসি রোদ্দুরে বৃষ্টির মতোই শুদ্ধ আর স্নিগ্ধ লাগলো তার। সিফাতকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে থমকে গেল পলক। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল সে। তা দেখে সিফাতও তটস্থ হলো। হাল্কা কেশে গলা ঝেড়ে বললো,
_আ..আব… হ্যাঁ। দু মিনিট ওয়েট করুন। আমি প্যাকিংটা শেষ করে নেই। আর বিছানায় রাখা বাকি কাপড়গুলো আলমারিতে তুলেই আসছি। তারপর, আরামসে কথা বলবো আপনার সাথে। বলেই,তার সেই ভুবন ভুলানো হাসিখানা হাসলো পলকের উদ্দেশ্য। পলক মুগ্ধ হয়ে দেখলো সে হাসি। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
_জ্বী।
পলকের সম্মতি পেয়ে সিফাত গিয়ে ফোনটা আবার আগের জায়গায় রাখলো। যেখান থেকে সিফাতকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। পলক দেখছে সিফাতকে। মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মানুষটা বড্ড গোছালো। নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করে। কি সুন্দর সব কিছু ম্যানেজ করে চলে। আর এই মানুষটাই কি না তার মত সাধারণ একটা মেয়েকে পছন্দ করলো নিজের জন্য। কথাটা ভেবে আপনমনেই হাসলো পলক।তবে,এই হাসি সিফাতকে নিজের জন্য পাওয়ার খুশিতে নাকি তাকে চাওয়ার জন্য সিফাতের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করে ছিল কে জানে!
_________________________________

সিফাতের প্যাকিং শেষ। লাগেজ লক করে সাইড টেবিলের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখলো সে। অতঃপর এসে বসলো সোফায়। ফোনের মুখোমুখি। তারপর বললো,
_এই জন্যই বোধয় লোকে বলে একটা বয়সের পর প্রত্যেক ছেলেরই একটা বউ থাকা লাগে। সময় অসময়ে ইন্সট্যান্টলি এইসব টুকটাক হেল্প,সাজেশনের জন্য হলেও লাগে। আজ আমিও প্রমাণ পেলাম সেটার। বলেই সজোরে হাসলো সে।

পলক লজ্জা পেয়ে গেল সিফাতের কথায়। মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসতে লাগলো সে আপন মনেই।সে হাসির কিছুটা ফুঁটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণেও।

তারপর সিফাতের কথায় মুখ তুলে চাইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।

_ভেবেছিলাম খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে পার্মানেন্টলি নিয়ে আসবো এ ঘরের মালকিন করে। আমার সমস্ত দায়িত্ব আপনার হাতে তুলে দিয়ে রিল্যাক্স করবো এবার কিছুটা। আপনাকে চিরতরে কাছে পাওয়ার লোভেই মাত্র একমাস পরেই বিয়েটা করতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু হায়..কি কপাল আমার! তা আর হতে দিল কই!-বেশ দুঃখ আর আফসোস করেই কথাগুলো বললো সিফাত।

_জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এসব তো সম্পূর্ণ রিযিকের ব্যাপার। এসব নিয়ে মন খারাপ বা আফসোস করতে নেই।-শান্ত কন্ঠে বললো পলক।

_মৃন্ময়ী! ঘোর লাগানো কন্ঠে ডাকলো সিফাত।

এহেন ডাকে শিউরে উঠলো পলক।একটা তীক্ষ ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল তার মেরুদন্ড বেয়ে। সহসা কিছু বলতে পারলো না সে। কিন্তু, সিফাত বললো। আর সিফাতের বলা কথাটা মূহুর্তেই স্তব্ধ করে দিল পলককে।
_এত দুর্লভ কেন হচ্ছেন আপনি? এত কেন অপেক্ষা করতে হচ্ছে আমার আপানাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য! তবে কি শুধু আমি একাই চাইছি আপনাকে নিজের জন্য…আপনি কি চাইছেন না আমার হতে?

বেশ কিছুটা সময় স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো পলক সিফাতের মুখপানে।সিফাতও তাকিয়ে আছে পলকের দিকে। তার মুখে হতাশা আর চাপা কষ্টের ছাপ।করুণ ওই মুখখানা দেখলে যে কারোর বুকের ভেরতটায় হু হু করে উঠবে।চোখে অদ্ভুত এক ঘোর। বড্ড শান্ত অথচ ঘোর লাগা সে চোখের দৃষ্টিতে একধ্যানে তাকিয়ে থাকাও দায়। পলকও পারলো ওই যন্ত্রণা মাখা করুণ মুখ আর শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। চকিতেই চোখ নামিয়ে নিল সে। তারপর, শান্ত ধীর স্বরে বললো,

_চাই!তবে,আগে আপনি ভালোভাবে আপনার ট্রেনিং শেষ করে আসুন।এরপরে, আপনি যা চান তাই হবে। অপেক্ষায় থাকবো আমি।-বলেই লাজুক হাসলো পলক।

পলকের বলা কথাগুলো এক পশলা বৃষ্টির মতো মূহুর্তেই সিফাতের সব হতাশা,আফসোস ধুয়ে মুছে দিল।বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো এসে ঝরঝর করে ভিজিয়ে শান্ত করে দিল তার অশান্ত মনের যত কারবার।অদ্ভুত এক সুখানুভূতি এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। এখন বেশ স্বস্তি লাগছে তার। ফুরফুরে লাগছে খুব।প্রত্যুত্তরে এক প্রশান্তির হাসি উপহার দিল সে পলককে।

সিফাতের এই হাসি ছুঁয়ে দিল পলককেও। সিফাতকে শান্ত করতে পেরেছে সে।এখন স্বস্তি পাচ্ছে সে নিজেও।আর এই স্বস্তি হাসি হয়ে ফুঁটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে।আর চকিতেই তা ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত চোখে মুখেও।
________________________________

গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে স্কুলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিয়ান। চোখে কালো সানগ্লাস।হাতে ফোন নিয়ে কিছু একটা ঘাঁটাঘাঁটি করছে সে। একটু পরে স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজতেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো বাচ্চারা। এত এত বাচ্চাদের মধ্যে ফাইয়াজের জন্য অপেক্ষা করছে সে। ফাইয়াজ তার ভাইয়ের ছেলে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আজ স্কুলে খেলতে গিয়ে পড়ে গেছিল সে। হাতে হাঁটুতে কিঞ্চিৎ ছিলে গেছে নাকি। তাই বাড়িতে ফোন করা হয়েছিল যেন গার্ডিয়ান এসে নিয়ে যায়। এই অবস্থায় স্কুল বাসে সব বাচ্চাদের সাথে পাঠাতে চায়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ।

তার ভাই আর ভাবী দুজনেই কর্পোরেট অফিসার।মূলত তারা কলিগ ছিল।আর সেখান থেকেই দুজনের পরিচয়।অতঃপর,প্রণয় আর তারপর বিয়ে। দুজনেই ব্যস্তমানুষ। কাজ ছেড়ে আসা অসম্ভব।তাই, অগ্যতা তিয়ানকেই আসতে হয়েছে অফিস ছেড়ে। ছুটি হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ভীড়টা কিছুটা হাল্কা হয়ে এলো। তারপরেই, ফাইয়াজকে দেখা গেল। একজন মেয়ের হাত ধরে কিছুটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে আসছে গেটের দিকে। হাতে আর হাঁটুতে ব্যান্ডেজ করা।মুখটা কাঁদোকাঁদো তার। বেশ ভালোই চোট লেগেছে বোধয় বেচারার।কিছুটা কাছে আসতেই মেয়েটা কে সেটাও অবগত হলো তিয়ান। মেয়েটা আর কেউ নয়..পলক!কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গেল সে। অবাক নয়নে চেয়ে আছে পলকের দিকে। আচমকা আবার এখানে পলকের সাথে তার দেখা হয়ে যাবে এটা সে কখনোই ভাবেনি। চোখের সানগ্লাসটা খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। গায়ের ব্লেজারটাও টেনেটুনে খানিকটা ঠিক করে নিল। প্রায় একেবারে কাছাকাছি আসতেই ফাইজায়কে জিজ্ঞেস করলো কার সাথে যাবে সে। ফাইয়াজও আঙুল উঁচিয়ে ইশারায় তিয়ানকে দেখালো। এতক্ষণ পলকের সমস্ত ধ্যান ফাইয়াজের উপর ছিল। তাই তিয়ান যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা সে খেয়ালই করেনি। কিন্ত,ফাইয়াজকে অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই থমকে গেল পলকও। তিয়ানকে মুখোমুখি আবার দেখতে পাওয়াটা একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার তার জন্যও। যেই মানুষটার থেকে সে দূরে থাকতে চায়,এড়িয়ে যেতে চায়..সেই ঘুরেফিরে তার সামনে চলে আসছে। এতদিন পরে যখন সব ভুলে সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে, জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে পা রাখতে চলেছে কিছুদিন বাদেই…ঠিক তখনই কেন অতীতের দাফন করা অধ্যায়টা নতুন করে উন্মোচিত হচ্ছে তার জীবনে? যেই মানুষ, যেই মুখটাকে সে ভুলতে বসেছিল সেই বা কেন সামনে আসছে আবার?- আচকা ওখানে তিয়ানকে দেখে নানান ভাবনায় ডুব দিয়েছিল পলক।আর তখনই হাতে টান পড়লো তার। ঘোর কাটলো ফাইয়াজের কথার আওয়াজে। পলককে থমকে যেতে দেখে হাত ঝাঁকিয়ে ডাকছে তাকে।

_মিস. মিস…
_হ্যাঁ,বাবা?
_এইটা আমার চাচ্চু।আমি তার সাথেই যাবো।-তিয়ানকে দেখিয়ে বললো ফাইয়াজ।

ফাইয়াজের কথায় তিয়ান বুঝলো পলক ফাইয়াজের টিচার। তারপরেও শিওর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো পলককে,
_পলক তুমি…?
_ফাইয়াজের ক্লাস টিচার।-তিয়ানকে দেখেই ভেতর ভেতর বেশ অস্থির লাগছিল পলকের। তবুও,নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে তিয়ানের প্রশ্নের জবাব দিল সে।
_অহ,আচ্ছা। -তিয়ান বললো।
_হুম।
_তো,কেমন আছো তুমি?
_ভালো আছি।আপনি?
আচমকা পলকের মুখে তুমি থেকে আপনি সম্বোধনটা শুনেই কেমন যেন লাগলো তিয়ানের। তারপরেও,ব্যাপারটাকে ছাপিয়ে জবাব দিল পলকের প্রশ্নের।
_Hmm…I’m fine also.তারপরেই, ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
_Hey…fazz.. what’s up, buddy?
_Not good buddy. see…বলেই হাত আর পায়ের ব্যান্ডেজগুলো দেখালো তিয়ানকে। এরপর, পলক বললো,
_আ…ওকে স্কুলের মেডিকেয়ার থেকে প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে। কিছুটা ছিলে গেছে জাস্ট। একটু ব্যাথা থাকবে হয় তো দুই একদিন।রেগুলার ওয়েন্টমেন্ট লাগেলেই ঠিক হয়ে যাবে। & Dr. said, nothing to worry. He will be fine soon. বলেই ফাইয়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পলক।
_ok..thanks. -মুচকি হেসে বললো তিয়ান।
_Buddy…let’s go.. naa!! I need rest.
_Yeah..sure buddy. Come here.-বলেই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তিয়ান ফাইয়াজকে। ফাইয়াজ কাছে আসিতেই গাড়ির দরজা খুলে দিল সে। গাড়িতে উঠার আগে ফাইয়াজ পিছন ঘুরে হাত নাড়িয়ে পলকের উদ্দেশ্যে বললো,
_Bye, miss.
_Bye, dear. Take care. -বলেই হাত নাড়িয়ে সেও বিদায় জানালো ফাইয়াজকে। তারপরেই ফাইয়াজ গাড়িতে উঠে বসলো। সে গাড়িতে বসতেই দরজা লাগিয়ে দিল তিয়ান। তারপর,পলকের উদ্দেশ্যে বললো,
_ভালো থেকো পলক।আসছি।
তবে প্রত্যুত্তরে পলক কিছু বললো না। চোখ নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়ি রইলো ওখানে। পলকের থেকে কোন জবাব না পেয়ে কিছুটা হতাশ হলো তিয়ান। এরপর আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
______________________________

একধ্যানে তিয়ানের গাড়িটার চলে যাওয়া দেখলো পলক। মিনিটের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেল গাড়িটা।কিন্তু,গাড়িটা ওখান থেকে চলে যাওয়ার পরেও ওখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সে। মনে চলছে অজস্র স্মৃতির আনাগোনা। অনেক অনেক পুরোনো যন্ত্রণারা ধারালো আলপিনের মত বুকের মাঝে এসে বিঁধছে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে দাফন হওয়া অতীতের কবর থেকে।তবে কি আজও স্মৃতিগুলো,যন্ত্রণাগুলো তেমনই সতেজ..জীবত আছে ,ঠিক যেমনভাবে নিজের মাঝে দাফন করে নিয়েছিল সে?-কথাটা ভাবতেই ভেতর ভেতর বিষাক্ত এক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল পলক। বুকচিরে বেরিয়ে এক কালো দীর্ঘশ্বাস।

আজকের দেখা হওয়াটা সেদিনের মতই অপ্রত্যাশিত ছিল,যেদিন বহু বছর পর শপিং মলের সামনে দেখেছিল। আবার ঠিক সেদিনের মতোও, যেদিন বেশ অপ্রত্যাশিত ভাবেই পলকের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তিয়ানের।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_১৮
©জারিন তামান্নস

ওই মেয়ে তোর সমস্যা কি বল তো? সারাক্ষণ এত পড়াশোনা নিয়া ডুইব্বা থাইক্কা বিদ্যাসাগরের কোন জন্মের উত্তরাধিকারী হইয়া যাইবি তুই, হ্যাঁ? চল উঠ এখন,চল আমার সাথে।
_আহ বিথি! এমন করতেছিস ক্যান দোস্ত? হায়ার ম্যাথের এই প্রবলেমটা করা এখনো বাকি,কিন্তু আমি এই ম্যাথটা কিছুতেই সলভ করতে পারতেছিনা রে! লাস্ট দুইদিনে এই এক অংক নিয়া অর্ধেক খাতা শেষ কইরা ফেলছি।কিন্তু কিছুতেই পারতেছিনা।আসলে আমারই কপাল খারাপ। নইলে ঘুইরাফিইরা রেজা স্যারের আন্ডারেই আমারে পড়তে হইলো? আশেপাশের একটাও তো এই সেটের প্রশ্ন পায় নাই,যে কাউকে দেখায়া সলভ কইরা নিবো। তোরে দিলাম তুইও পারলি না। এখন আমি কারে দেখাবো এইটা? কাল ম্যাথ এ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া লাগবে অথচ… -বিথির জোরাজোরিতে তার দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে অসহায় মুখে বললো পলক। পলকের এমন করুন অবস্থা দেখে বেশ মায়া হলো বিথির। কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু একটা ভাবলো। তারপর চট করেই বললো,
_এই,দাঁড়া..আসতেছি আমি। বলেই ক্লাসরুম থেকে একছুটে বেরিয়ে গেল বিথি।
_আরে..কই যাস?? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পলক।

কিন্তু বিথি সেটার কোন জবাব না দিয়েই ক্লাসরুমের দরজা থেকে বেরিয়ে গেছে ততোক্ষণে। পলক হতাশ হয়ে একটা শ্বাস ফেলে আবার মনোযোগ দিল অংকের সলিউশন বের করতে।

বিথি আর পলক বেস্ট ফ্রেন্ডস। বলতে গেলে পলকের একমাত্র ক্লোজ ফ্রেন্ড বিথি আর বিথির একমাত্র মেয়ে বান্ধুবী পলক।বয়কাট চুলের টমবয় টাইপের মেয়ে বিথির মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব খুব একটা জমে না। তাই, ছোটবেলা থেকে ছেলেদের সাথেই বেশি মেলামেশা তার। স্কুল লাইফ থেকেই ছেলেদের সাথে ক্রিকেট , ব্যাটমিন্টন, ফুটবল খেলে অভ্যস্ত। মেয়ে হয়েও এভাবে ছেলেদের দলে খেলতে পারার একটা বিশেষ কারণ আছে অবশ্য।পরিবারের একমাত্র মেয়ে হলেও মেয়ে কম ছেলেই বেশি বলা চলে তাকে। তবে, হাতে গোণা কয়েকটা ছেলের সাথেই তার বেশি চলাফেরা। কিন্তু, কলেজে আসার পরে ন্যাকা ন্যাকা মেয়েদের থেকে দূরত্ব রাখতে গিয়ে রোজ পলকের সাথেই এক বেঞ্চে বসতো সে। তারপর টুকটাক কথা,একসাথে বসা সব মিলিয়ে কিভাবে কিভাবে যেন পলকের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওর।তাই পলকের যে কোন সমস্যায় সে আর কাউকে পাক আর না পাক বিথি নামের মেয়েটাকে সে সবসময়ই পায়।আর বিথিও বড্ড ভালোবাসে মেয়েটাকে। পরিচয় মাত্র ১১ মাসের হলেও খুব ভালো বন্ডিং ওদের।

একটু সময় যেতে না যেতেই দৌঁড়ে এসে ক্লাসরুমের দরজায় দাঁড়ালো বিথি। হাঁপাচ্ছে সে। কিছুটা দম নিয়ে পলককে ডকলো সে।

_ওই সাজি ওঠ..ওঠ। খাতা কলম নিয়া আয় জলদি।
আচমকা বিথির এহেন কথা শুনে পিছনে ফিরে তাকালো পলক। দেখলো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। খুব তাড়ায় আছে। তাকে এমন অবস্থায় দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল পলকের। জিজ্ঞেস করলো,
_কই গেছিলি তুই?
_আরে কথা কম ক…খাতা কলম নিয়া আয় তো। তাড়াতাড়ি।
_আরে..আশ্চর্য কই যাবো খাতা কলম নিয়া?
_ধুর,বড্ড বেশি বকস তুই একেকসময়।

পলকের কথায় বিরক্ত হয়ে বলতে বলতে ক্লাসেরুমে ঢুকলো বিথি। তারপর, পলকের সামনে থেকে খাতা কলম তুলে নিলো চকিতেই। টেনে তুললো পলকেও। একরকম টেনেটুনেই বের করলো তাকে বেঞ্চের বাইরে। এরপর, টানতে টানতেই নিয়ে গেল ক্লাসরুমের বাইরে। আচমকা বিথির এহেন কান্ডে পলক কিছু বলার সুযোগই পেল না। কিন্তু,কিছুটা পথ যেতেই হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল সে। পলকের থেমে যাওয়া দেখে থেমে গেল বিথিও। পেছন ফিরে পলকের দিকে তাকাতেই পলক রাগ রাগ মুখে জিজ্ঞেস করলো,

_কই নিয়ে যাইতেছিস তুই আমারে এভাবে?

_তোর ম্যাথের সলিউশন আনতে। -হাসি হাসি মুখ করে ফুল এটিটিউড নিয়ে বললো বিথি।

বিথির কথা আর ভাব দেখে ভ্রু কুচকে গেল পলক। “আবার কি কোন খোরাফাতি আইডিয়া বের করলো নাকি এই মেয়ে!”মনে মনে ভাবলো পলক।তারপর সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলো বিথিকে,
_মানে?
_আরে মেরি মা! what’s ur problem yr!সোজা বাংলা কথা বুঝস না তুই?বললাম তো তোর ম্যাথের সলিউশন আনতে যাইতেছি। এখন বেশি পকপক না কইরা চল তো,দেরি হইলে পরে সলিউশন বাড়ি চইলা যাইবো। তারপর ভালা কইরা এসাইনমেন্ট জমা দিস তুই। বলেই খাতা কলম পলকের একহাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার আগের মত টানতে টানতে নিয়ে গেল তাকে। কিন্তু এবারেও পলক কিছুই না বুঝলো না বিথির কথা। অগ্যতা বাধ্য মেয়ের মত বিথির পিছু পিছু যেতে বাধ্য হলো সে।
________________________________

দু’তলার সিঁড়ি বেয়ে নামতেই নিচে সিঁড়ির কাছে কয়েকটা ছেলেকে দেখা গেল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। এদের মধ্যে একটা ছেলেকে দেখা গেল কাঁধের এক সাইডে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল শ্যামলাবর্ণের, বেশ লম্বা মত দেখতে ছেলেটা। চুলগুলো একসাইডে সিঁথি করে জেল দিয়ে সুন্দর মত সেট করা।দাঁড়ি কামিয়ে মুখটা ক্লিন সেইভ করা। মুখের আদলে বেশ সুদর্শন দেখতে ছেলেটি। সিঁড়ির গোড়ায় মুখোমুখি হয়ে বাকিদের মাঝ বরাবর দাঁড়ানো সে। ছেলেটার মুখ নড়ছে অনবরত। সম্ভবত চুইংগাম চিবুচ্ছে। কথা বলতে বলতেই চুইংগাম ফুলিয়ে বেশ বড় আকারের বেলুন বানিয়ে ফেললো ছেলেটা। বড় হতে হতেই একসময় ঠাস করে ফেটে গেল ওটা।আর সাথে সাথেই ছিটকে দু কদম পিছিয়ে গেল পলক। শেষের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে পিছাতে গিয়ে সিঁড়ির সাথে লেগে ব্যালেন্স বিগড়ে গেল তার। টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পরের সিঁড়িতেই বসে পড়লো পলক।আচমকা অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা ঘটে গেল সেখানে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ওই ছেলেটাও।মুখের চারপাশে ছড়িয়ে লেগে আছে চুইংগাম। ওটা ঠিক করতেও ভুলে গেছে সে।বিথিও পুরো তাজ্জব বনে গেছে। পলকের পাশেই দাঁড়ানো সে। হতভম্ব পলক নিজেও।সেই সাথে বেশ অপ্রস্তুত এবং লজ্জিতও। সামান্য একটা চুইংগামের বেলুন ফাটায় এভাবে ভয় পেয়ে যাবে এটা সে কখনোই ভাবেনি। আসলে আচমকা বিথি ছেলেটার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিল আর বেলুনটাও ঠাস করে ফেঁটে গেল যে ওটার শব্দে পলক ভয় পেয়ে গেছে।আর ভয়ে পিছিয়ে যেতে গিয়েই এমন একটা কান্ড ঘটলো।

ব্যাপারটা কি হলো সেটা বুঝে উঠতে সেকেন্ড কয়েক সময় লাগলো সবার। তারপরেই মুখের চুইংগামটা ঠিক করে পলকের উদ্দেশ্যে ছেলেটা বললো,
_Hey…are u ok?
ছেলেটার কথায় হুঁশ হলো বিথির।নড়েচড়ে উঠলো সে। তারপর একটানে টেনে তুললো পলকেও। তুলেই দিল এক ঝাড়ি।
_ওই মাইয়া, কি করলি তুই এইডা?এই জন্যই তোরে বলি বেশি বেশি খা। বাঁশপাতার মত শরীর। টুকা দিলেই পইড়া যাস খালি ধুপধাপ। বলতে বলতেই পেছন দিক থেকে পলকের ইউনিফর্মে লাগা ধূলা ঝাড়তে শুরু করলো সে।ওভাবে পড়ে যাওয়ার ফলে এমনিতেই বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল পলক। আর এবারে বিথির এহেন কথা আর কাজে লজ্জায় গুটিয়ে গেল একেবারে। চট করেই হাত ধরে থামিয়ে দিল বিথিকে। আচমকা এভাবে হাত ধরে আটকে দেওয়ায় ভ্রু কুঁচকে গেল বিথির। বেশ বিরক্তি মাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
_কিহ?!

কিন্তু পলকের মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বিথির হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। বিথি এবারে বেশ বিরক্ত হলো।এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল হাতটা। তারপর বললো,
_সমস্যা কি তোর? এইভাবে হাত ধরস ক্যান,হাড়গোড় তো সব ভাইঙ্গা যাইবো আমার।

এবারেও পলক চুপ। লজ্জায় কিছুই বলতে পারছে না সে। শুধু ওখান থেকে কিভাবে চলে আসা যায়, কতক্ষণে চলে আসতে পারবে সে এই নিয়ে উশখুশ করছে । বিথি আর তার সাথের মেয়েটিকে এবার ভালো করে দেখলো ছেলেটি। মেয়েটির মনের অবস্থাটা বুঝি বুঝতে পারলো সে। তাই পরিস্থিতি সামলে নিতে বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বললো,
_ওই তোরা যা এখন । আমার ফিরতে লেট হবে।বিকালে স্যারের বাসায় দেখা হবে। আর মিজান,(তাদের মধ্যে একজন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে)তুই বাফু রে বলিশ আমার ফিজিক্সের খাতা যেন নিয়া আসে ওইখানে । আজকে তো আসলো না ব্যাটা ক্লাসে।
_আচ্ছা। তুইও চইলা আসিস টাইম মত।-মিজান নামের ছেলেটি বললো।
_ওকে। যা তোরা এখন। Bye.বলে ছেলেগুলোকে বিদায় দিল সে।
_Bye. বলেই বিথি, পলক আর ওই ছেলেটাকে রেখে বিদায় নিল বাকি ছেলেগুলো। ছেলেগুলো যেতেই পাশ ফিরে বিথি আর পলকের দিকে তাকালো ছেলেটি। পলককে আপাদমস্তক ভালো করে দেখলো একবার। যদিও এর আগে বিথির সাথে বেশ কয়েকবার দেখেছে সে মেয়েটিকে,ক্লাসেও দেখেছে অনেকবার.. কিন্তু কখনো খুব একটা খেয়াল করে দেখেনি সে। দেখার বিশেষ প্রয়োজন মনে হয়নি তার। ক্লাসের এত এত মেয়ের ক্রাশ সে। তার সাথে কথা বলার জন্য হুমিড়ি খেয়ে পড়ে তারা। সব সুন্দরী মেয়েরা পালা বদলে তার গার্লফ্রেন্ড হয়।তার বর্তমান গার্লফ্রেন্ড সিন্থিয়া। বেশ স্মার্ট এবং সুন্দরী।তার সাথে থেকে আর ফ্রি টাইমে বাকিদের সাথে ফ্লার্ট করার পর এমন চুপচাপ নিরামিষ টাইপ মেয়েকে দেখার সময় কই তার! কিন্তু, আজ এমন একটা পরিস্থিতির কবলে পড়ে মেয়েটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একে এক নজর না দেখলেই নয়। তাই, পা থেকে মাথা অবদি একনজর দেখলো সে পলককে। শ্যামলা চামড়ার শুকনো বদনে সাদা কলেজ ড্রেস পড়া, সাদা এপ্রণে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা। লম্বা চুলে দুটো বেণী করে সামনে এনে রেখেছে।চোখের পাপড়িগুলো বেশ ঘন মেয়েটার। কিন্তু এত কিছুর মাঝে ছেলেটার চোখ আটকে গেল পলকের ঠোঁট জোড়ায়। কিছুটা পুরু আর প্রান্তবন্ত একজোড়া ঠোঁট। বাদামি রঙের ওই ঠোঁটজোড়া বেশ চিকচিক করছে। লিপজেল দেওয়া বলেই বোধয় এমন লাগছে। তবে সুন্দর লাগছে। হাতে খাতা কলম নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ অস্বস্তিতে আছে বেচারি।তার হাবভাবে বুঝতে পারলো ছেলেটা। এরপর,পলকের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বিথিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_কই দে তোর খাতাটা। কই সমস্যা হইতেছে দেখি।
_সমস্যা আমার না। সমস্যা এই বাঁশপাতার। পলককে দেখিয়ে বললো বিথি। তারপরে তার হাতে থাকা পলকের খাতাটা এগিয়ে দিল ছেলেটির দিকে। একে তো এতগুলো ছেলের সামনে এরকম একটা বাজে ব্যাপার ঘটলো আজ। তারবপর এই ছেলেটার সামনেই বারবার বাঁশপাতা বলছে বিথি তাকে।এই নিয়ে মনে মনে খুব রাগ হলো তার বিথির উপর। ওদের দুজনের আড়ালেই রাগে দুঃখে একটা ভেংচি কাটলো বিথিকে।

হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিল ছেলেটা। কলম দিয়ে ভাগ করে রাখা পাতাটা খুলে চোখ বুলালো তাতে।
ছেলেটা যখন খাতা দেখায় ব্যস্ত,সেই মূহুর্তে বিথির হাত ধরে টান দিল পলক। আচমকা টানে পাশ ফিরে তাকালো বিথি।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পলকের মুখ পানে চাইতেই তাকে কিছুটা কাছে টেনে আনলো পলক। তারপর ছেলেটিকে দেখিয়ে খানিক ফিসফিসিয়ে বিথিকে জিজ্ঞেস করলো,
_ওই.. এইটা কে? আর আমার খাতা তারে ক্যান দিলি?
পলকের এহেন প্রশ্নে একটুও অবাক হলো না বিথি।কারণ সে জানেই পলক একটু নিরামিষ টাইপের। ক্লাসের কোন কোন মেয়ের সাথে তার টুকটাক আলাপ থাকলেও ছেলেদের একটারকেও সে চিনে না। বিগত ১ বছর ধরে একসাথে ক্লাস করার পরেও এই ছেলেটিকেও সে চিনতে পারেনি। তাই পলকের এমন স্টুপিড প্রশ্নে বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে বরং দাঁত ক্যালিয়ে হেসে দিল বিথি।তারপর বেশ গর্বিত স্বরে বললো,
_এই হইলো আমাদের ব্যাচের জিনিয়াস বয়। তানভীর আহমেদ।ডাকনাম তিয়ান।সাথে ফুল ব্যাচের মেয়েদের ক্রাশ সে। এ্যান্ড আমার অনলি ওয়ান বয় বেস্টু। অবশ্য তুই ক্যাম্নে জানবি তুই তো আবার বাঁশপাতা, নিরামিষ একটা। বই পত্র আর স্যার ম্যাডামদের মুখদর্শন ছাড়া অন্য কোথাও নজর দ্যাস না।বলেই ভেংচি কাটলো একটা।এরপর বললো,” ম্যাথে খুবই ভালো। ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষার সময় ভাইরাস জ্বরে পইড়া বাংলা এক্সামটা একটু খারাপ হইছিল বেচারার। যার জন্য ১ নাম্বারে পিছায়ায় গিয়া সেকেন্ড হইছে। নয় তো বাকি দুই টার্মে ওর মার্কসই হাইস্ট ছিল আমাদের তিন সেকশন মিলায়া।” কথাটা বেশ আফসোস করেই বললো বিথি। “তুই জাস্ট দেখ এবার ক্যাম্নে এক চুটকিতেই তোর এই প্যাঁচমারা ম্যাথ আনপ্যাঁচ করে দিবে ও।”-হাতে তুড়ি বাজিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললো সে।

খাতায় চোখ থাকলেও কান দুটো খাঁড়া রেখে তাদের কথাগুলো ঠিকই শুনছিল তিয়ান। এরমাঝে পলক তাকে চিনে না এই ব্যাপারটায় বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে। পুরো কলেজের মেয়েরা তার নাম জপে দিন রাত আর এই মেয়ে কিনা…!! ভেতর ভেতর বেশ আহত হলো সে। তার ইগোতেও বেশ জোরেসোড়েই লেগলো ব্যাপারটা। কিছুটা রাগও হলো তার পলকের উপর। মনে মনে একবার আওড়ালো সে,”বাঁশপাতা নিরামিষ কোথাকার! ” তারপর, ওদের দুজনের কথা শেষ হতেই তিয়ান খাতা থেকে চোখ তুলে চাইলো। পলককে উদ্দেশ্য করে বললো, তুমি কি শিওর প্রবলেমটা কারেক্ট লিখছো?
_হ্য..এ্য..এ্যা..হ্যাঁ! কিছুটা অপ্রস্তুতভাবে বললো পলক।
_উউউউমমম.. না, বোধয়। একটা স্কয়ার মিসিং। তুমি রিচেক করে দেখো। মে বি তুমি ভুল কোয়েশ্চেন লিখেছো। যার জন্য সঠিক সূত্র চুজ করতে পারছো না।
পলক কি বলবে বুঝতে পারলো না। তার দৃঢ় বিশ্বাস সে ম্যাথের প্রশ্নটা ভুলভাল তোলেনি খাতায়। কয়েকবার দেখেছে সে প্রশ্নটা। কিন্তু,এই ছেলে তো ভিন্ন কথা বলছে। চিন্তায় পড়ে গেল পলক।পলককে চুপ থাকতে দেখে তিয়ান বললো,
_তুমি কোয়েশ্চেন পেপারটা নিয়ে আসো তো দেখি আমি।
তিয়ানের কথা শুনে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো পলক। যেন কোন দুঃসাধ্য সাধনের কথা বলা হয়েছে তাকে। পলককে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিথি বললো পাশ থেকে।
_ওই সাজি। কি বললো তিয়ান। যা! বিথির কথায় হুশ হলো পলকের। চমকে উঠে বললো,
_হ্যাঁ…যাচ্ছি। বলেই উল্টো ঘুরে সিঁড়িতে উঠে গেল সে।
_আর হ্যাঁ,,আসার সময় ব্যাগগুলাও নিয়া আসিস একেবারে।কাজ শেষে এখান থেকেই বেরোয়া পড়বো।
_আচ্ছা। বলেই ওখান থেকে চলে গেল পলক।পলক যেতেই তিয়ান বললো,

_এই মেয়ে তোর ফ্রেন্ড ক্যাম্নে হয় রে বিথি? এতো পুরাই তোর উল্টা।
_আর বলিশ না। এরসাথে আমার ক্যাম্নে ক্যাম্নে যেন ভাব হইয়া গেছে। আর এইটাও আছে!কি বুইঝা যে আমারে সহ্য করে আল্লাহ মালুম।বলেই ব্যাঙ্গাত্মক হাসলো বিথি। তারপর বললো,তবে যতযাই বলিশ..মেয়েটা খুবই ভালো। মনের দিক থেইকা খুবই নরমসরম। চুপচাপ আর ঠান্ডা স্বভাবের। একটু সহজ সরল টাইপের বাট স্টুডেন্ট বেশ ভালো। তবে,এর বন্ধুবান্ধব নাই খুব একটা। ছেলেদের থেইকা তো দশ হাত দূরত্ব রাইখা চলে। বলেই ফিচলে হাসলো সে। তবে তার শেষ কথার ইঙ্গিতটা যে তিয়ানের উদ্দেশ্যেই ছিল তা তিয়ান বেশ বুঝলো। তারপরে, বিথির লেগ পুলিং করে বললো,

_হ্যাঁএএ…এই জন্যই তো তোর মত টমবয় ফ্রেন্ড নিয়া ঘুরে।তুই থাকতে আর অন্য ছেলের কি দরকার। আর তোরও তো একমাত্র মেয়ে বান্ধুবী বোধয়, যার সাথে এত্তভাব। ঠিকই আছে অবশ্য,তোদের আর আলাদা করে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড লাগে না। বলেই সজোরে হেসে দিল তিয়ান।

তিয়ানের এহেন কথা আর হাসি চকিতেই গা’য়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল বিথির। চেঁচিয়ে উঠলো সে। হুমকির সুরে বললো,
_এএএএএইইইই……মুখে লাগাম দে ব্যাটা।কি যা তা কইতাছোস।তোর উপ্রে পিছলায় পড়া ওইসব ন্যাকা ন্যাকা কইন্না গো থেইকা ঢের ভালা আমি। আর আমার বেষ্টুও। একদম উল্টাপাল্টা কিছু কইবা না আমাদের নিয়া।

বিথির এহেন হুমকিতে আরও খানিক হাসলো তিয়ান।যেন বেশ মজা পেয়েছে সে বিথির কথায়। তারপর হাসতে হাসতেই বিথির দিকে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে নিল। তারপর হাতদিয়ে বিথির বাহুতে দুখান চাপড় মেরে বেশ রসিকতার সুরে বললো,
_ওরেএএ আমার বিথুমনাটা। রাগ করতেছো কেন।তুমি হইলা আমার রিয়েল গার্লফ্রেন্ড। মানে মেয়েবন্ধু।আমার বেস্টু। আর বাকি সব তো জাস্ট টাইমপাস।ওমন হাজারটা আসলে গেলেও তোমার জায়গা নেওয়ার সাধ্য কারও নাই।বুঝলা?

তিয়ানের কথায় ভেংচি কেটে মুখভার করে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল বিথি। তা দেখে তিয়ান বুঝলো বেশ ক্ষেপেছে মেয়েটা। তার মুড নরমাল করতে এবারে বেশ নরম গলায় বললো সে,
_আর রইলো তোর ওই বাঁশপাতা নিরামিষ বান্ধুবীর কথা..তোর মত একটা ফ্রেন্ড থাকতে অন্য কাউকে প্রয়োজন নাই বলেই তোর সাথে এত ভাব ওর। তুই একাই একশ। যেমন আমার জন্য তেমনি ওর জন্যও।
এবারে তিয়ানের কথায় অভিমান গললো বিথির। মৃদু হেসে চাইলো তিয়ানের মুখপানে।সেও হাসছে। ছেলেটার হাসিটা বেশ সুন্দর। মনে মনে ভাবলো বিথি। তারপর ওভাবে দাঁড়িয়েই এটা ওটা নিয়ে কথা বলছিল ওরা।
ওদের ওই কথোপকথনের মাঝেই নিচে নেমে এলো পলক।কিন্তু তিয়ান আর বিথিকে ওই অবস্থায় দেখে দুই সিঁড়ি আগেই থেমে গেছে । বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে সে। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।

হঠাৎই তিয়ানের চোখ পড়লো পলকের উপর। পলককে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিথিকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। তিয়ানকে হঠাৎ এভাবে সরে যেতে দেখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও দেখলো পলককে। তিয়ানের সাথে সম্পর্কটা তার স্কুল লাইফ থেকে।তার জন্যই মেয়ে হয়ে নির্ভয়ে ছেলেদের সাথে এত মেলামেশা তার। তাই তাদের বন্ধুত্বটাও বেশ গাঢ় আর সাবলিল।এসব কাছে টানা, জড়িয়ে ধরা তিয়ানের বেলায় একদম স্বাভাবিক তিয়ান ও তার কাছে। কিন্তু সেই তিয়ানের জায়গায় অন্য কোন ছেলে হলে বিথির প্রতিক্রিয়া পুরাই দেখার মত। যার ফলে ছ্যাচড়া টাইপের ছেলেরা বেশ এড়িয়েই চলে তাকে। তবে,তিয়ান যে বিথির এতটা ভালো বন্ধু এসবের কিছুই পলক জানে না। তাই,পলক তাদের ওভাবে দেখার পরেও বিশেষ কিছুই হয়নি এমন ভাব করে চটপটে গলায় বললো,
_ওখানে ওভাবে সঙের মত দাঁড়ায় আছিস ক্যান..নিচে নাম। প্রশ্ন দে তিয়ানের কাছে।

পলক কিছু বললো না,চুপচাপ শুধু তিয়ানের দিকে এগিয়ে দিল প্রশ্নপত্রটা। তিয়ানও স্বাভাবিক ভাবে হাত বাড়িয়ে নিল প্রশ্নটা। পলকেও একনজর দেখলো সে।এরপর,মনোযোগ দিয়ে প্রশ্নপত্রটায় চোখ বুলালো।
_এই তো শেষে এক্সের উপর স্কয়ার আছে। বইয়ের সেলাইয়ের ভাজে পড়ে গেছে। এই জন্য তুমি খেয়াল করো নাই। আচ্ছা,আসো…ক্লাসরুমে গিয়ে বসি। আমি সলভ করে দিচ্ছি। তুমি দেখো জাস্ট। বলেই পাশের ফাঁকা ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ালো তিয়ান।
সে ওখান থেকে কিছুটা দূরে যেতেই বেশ গর্বিত সুরে বিথি বললো,
_দেখলি!!বলছিলাম না,,ব্যাটা একটা জিনিয়াস। প্রশ্ন দেইখাই বুঝছে ভুল আছে। এখন দেখিস ফটাফট ক্যাম্নে তোরে বুঝায় দিবে এইটা। চল,চল.. বলেই তাড়া দিল সে পলককে।এবারেও পলক কিছু বললো না। চুপচাপ বিথির পিছু পিছু চলে গেল ক্লাসরুমটায়।

বেশ সুন্দর করে অংকটা বুঝিয়ে দিল তিয়ান। শুধুমাত্র একটা স্কয়ারবে জন্য কি পরিমাণ বেকার খাটতে হয়েছে তাকে এই ভেবেই মনে মনেই খানিক মাথা চাপড়ালো পলক। অংক বুঝানো শেষে,তিয়ান যখন জিজ্ঞেস করলো অংক বুঝেছে কিনা পলক খুব বেশি কিছু বললো না। তার স্বভাবসুলভ শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,
_জ্বী, বুঝেছি।ধন্যবাদ ।
প্রত্যুত্তরে তিয়ান কিছু বললো না। শুধু মুচকি হাসলো একটু।

খাতা বই নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিল পলক। তারপর বিথিকে বললো,
_তুই কি বাসায় যাবি এখন নাকি অন্যকোথাও যাওয়ার আছে তোর?
_না রে,বাসায়ই যাবো। তিয়ানের সাথে যাবো আজকে।তুই চলে যা একাই।
_আচ্ছা। বলেই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো ওখান থেকে।
________________________________

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক এক করে আজকের ঘটনাগুলো মনে করতে থাকলো পলক। তিয়ানকে সে আগে কখনো দেখেনি।অথচ তারা ক্লাসমেট। ক্লাসের সেকেন্ড প্লেসটাও তার। অথচ পলক সেটা জানেও না। অবশ্য সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম দিন যখন পরিচয় পর্ব হয়েছিল সে অনুপস্থিত ছিল। তাই প্রথম ৪ টা প্লেস একনাগাড়ে ছেলেরা পেয়েছে কিন্তু ফার্স্টবয় ইফানকে ছাড়া কাউকে চিনে না সে।ইফানকেও চিনে শুধুমাত্র মাঝে মধ্যে স্যার ম্যাডামরা আহ্লাদ করে স্টেজে ডাকে বলে। ক্লাস ক্যাপ্টেনও সে। সেই সুবাদেই মুখটা চেনা। আর আজ তিয়ান নামের ছেলেটাকে চিনলো সে। কি হাবভাব ছেলেটার। আর বিথিটাও যে কি! পলক জানে যে সে একটু টমবয় টাইপের। মেয়েদের চাইতে ছেলেদের সাথেই তার বন্ধুত্ব বেশি। কিন্তু কখনো কোন ছেলের সাথে এত ঘনিষ্ঠ হতে দেখেনি সে। কিন্তু আজ! কিভাবে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তিয়ানের সাথে। মেয়েটা বড় হলেও এসব চালচলের বুদ্ধি হলো না একটুও। মনে মনে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই হেঁটে যাচ্ছিল পলক।কিন্তু হঠাৎই একটা হ্যাচকা টানে ফুটপাতের রাস্তা থেকে নিচে নেমে গেল সে। কিছুটা ধাতস্ত হয়ে সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির মুখের দিকে তাকায়েই দেখলো তিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ খারাপ হলো তার। এভাবে কেউ কাউকে টান মেরে নিচে নামায়?তার থেকেও বেশি মেজাজ খারাপ হলো তিয়ানকে দেখে।এই ছেলের কি মেয়ে ছোঁয়ার স্বভাব নাকি? লুচু টাইপ স্বভাব ব্যাটার। তখন বিথিকে কিভাবে ধরছিল আর এখন আমাকে…মনে মনে কথাটা ভাবতেই বেশ ঝাঁঝালো গলায় কিছু বলার প্রস্তুতি নিল সে। কিন্তু মুখে রা কাটার আগেই তিয়ান বললো,

_তোমার কি কানে সমস্যা আছে? সেই কখন থেকে পিছন পিছন ডাকছি কোন রেসপন্স নেই। মেইন রোডে এভাবে চললে কখনো কোন গাড়ি এসে হর্ণ দিলেও তো শুনবা না। বেচারা ড্রাইভার তখন উপায় না পেয়ে তো সোজা ঠুকে দিয়ে চলে যাবে তোমাকে। টেরও পাবে না। যাক গে,এই নাও তোমার কলম। ফেলে চলে আসছিলা। এটার জন্যই ডাকছিলাম।
পলক হতভম্ব! সে কি ভাবলো আর এটা কি ঘটলো।
তিয়ান তাকে ডেকেছে অথচ সে শুনতেই পায়নি। আর সেই জন্য ওভাবে হাত ধরে টেনে নামিয়েছে। হতভম্ব চোখো তাকিয়ে আছে সে তিয়ানের বাড়িয়ে দেয়া কলমের দিকে। কিন্তু সেটা যে হাত বাড়িয়ে নিতে হবে সে খেয়াল তার নেই। পলককে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো তিয়ান।কিন্তু, কোন কিছু না বলেই পলকের ডান হাতটা তুলে ওটার মুঠোয় গুঁজে দিল সেটা। তারপর, হুট করে একটা রিক্সা ডেকে পলককে বললো,
_ওঠো।
পলক আরেক দফা হতভম্ব। এবারে সে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো তিয়ানের দিকে। কি বলে এই ছেলে! রিক্সায় ক্যান উঠবে সে।আর এই ছেলেই বা তাকে রিক্সায় কেন উঠতে বলতেছে? কিডন্যাপ করার প্ল্যান করতেছে না তো আবার!কিডন্যাপ করে কি করবে সে? আজকাল তো কত রকম নিউজ হয় এমন। কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে… আর ভাবতে পারলো না পলক। মনে মনে কথাগুলো ভেবেই ভয়ে গা’য়ে কাটা দিয়ে উঠলো তার।এরমাঝে তিয়ান জিজ্ঞেস করলো,
_বাসা কই তোমার?
_হ্য.. এ্যা..হ্যাঁ..?
_জিজ্ঞেস করছি বাসা কই তোমার? থাকো কোথায়?
_ক্যা..এ..এনো?বেশ ঘাঁবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো পলক।
_কারণ রিক্সাটার তোমাকে বাসায় ড্রপ করার জন্য বাসার এড্রেসটা লাগবে।
_না..না..রিক্সা লাগবে না। আমি এমনিতেই চলে যেতে পারবো।পলকের কন্ঠে ভয় তখনো স্পষ্ট।কিন্তু পলকের এই অবস্থা দেখেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেল তিয়ান। কিন্তু, সেটা প্রকাশ করলো না পলকের সামনে। তারপর বেশ নরম গলায় বললো,
_দেখো.. সাজি..
_পলক। আমার নাম পলক। খুব দ্রুত কন্ঠে বললো পলক।
_আচ্ছা বেশ,পলক। তোমার মে বি শরীরটা ভালো নেই। তুমি যেভাবে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলে যে কোন সময় একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারতো। এখনো এর সম্ভাবনা কম নয়। তুমি বরং রিক্সায় করে চলে যাও।
_না..আমি ঠিক আছি একদম। এমনিই চলে যেতে পারবো।
_কেন? রিক্সায় কি সমস্যা? ভাড়া নেই সাথে? আচ্ছা, ওটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। বাট প্লিজ তুমি রিক্সায় করেই যাও।
‘ভাড়া নেই?’ কথাটায় বেশ লাগলো পলকের। তার কাছে ভাড়া নেই এমনটা ভাবার কি আছে? আশ্চর্য! আর তিয়ানকেই বা কে বলেছে ভাড়া দিয়ে দিতে। হুট করে এসে এত কনসার্নই বা দেখাচ্ছে কেন সে!

এদিকে ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিক্সাওয়ালা বিরক্ত হয়ে তাড়া দিল।
_কি মামা যাইবেন না? না গেলে কন, আমার তো খালি খাঁড়ায় থাওনের কাম নাই। অন্য ভাড়া লমু তাইলে।
রিক্সাওয়ালার তাড়ায় এবার পলকের উপর মেজাজ খারাপ হলো তিয়ানের। ধমক দিয়ে বললো,
_বাসার এড্রেস বলো!
কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো পলক। ভয়ে একবার আশপাশটা দেখলো সে। ভর দুপুর হওয়ায় মানুষজন নেই খুব একটা। এতে কিছুটা স্বস্তি পেল পলক। নইলে মাঝ রাস্তায় এত বড় মেয়েকে কেউ ধমকাচ্ছে এটা দেখলে কি ভাবতো লোকে! বেশ লজ্জায় পড়তে হতো তাকে। তারপর, আস্তে করে বললো,
_মিরপুর ১১।
_আচ্ছা,ওঠো এখন।
এবারে আর আপত্তি করলো না পলক। রাস্তায় আর তামাশা করতে চায় না সে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো। আর সে উঠে বসতেই নিজের ওয়ালেট থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করো রিক্সাওয়ালাকে দিলো। বললো,
_এইটা ধরো।
ভাড়া দিতে দেখে পলক চেঁচিয়ে উঠলো।
_এইই…না! ভাড়া আমি দিবো।তোমার দেওয়া লাগবে না।যথেষ্ট আছে আমার কাছে।
পলকের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না তিয়ান। পুনঃরায় রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বললো,

_নাও…আর ওকে সাবধানে বাসায় পৌঁছায় দিবা মামা। দাঁড়াও একমিনিট। বলেই রিক্সার পিছনে গিয়ে কি যেন একটা করলো সে। তারপর সামনে এগিয়ে এসে রিক্সাওয়ালাকে বললো,
_রিক্সার নাম্বার নিয়া রাখলাম মামা। কোন গড়বড় হইলে সোজা থানায় ফোন যাবে।
_কি যে কন মামা..এইটা আমগোর রোজকার কাম।এই দিয়াই প্যাট চালাই। আর এই আমগোর মত মানুষরেই সন্দেহ করতেছেন..
_কিছু মনে কইরো না মামা।আজকাল দিন অনেক খারাপ। কাউকে সহজে বিশ্বাস করা যায় না। তাই আর কি…যাই হোক,,আর দেরি করো না, যাও এখন।
তারপর রিক্সার হুট টেনে লাগিয়ে দিয়ে পলককে বললো,
_সাবধানে যেও।
তারপর রিক্সাওয়ালাকে বললো, আগাও মামা।

পলক পুরোদস্ত হতভম্ব।তিয়ানের কাজে কথায় পুরোদমে হতবাক সে। আর তার এই হতভম্বিতাকে এবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে রিক্সাওয়ালা বললো,
_ভাইগ্না তো দেহি খুব সোহাগ করে আপনেরে।ভালাবাসে খুব।আইজকাইলকার দিনে এমন সোহাগ হগ্গলে পায় না গো আম্মাজান।খুব কপাল আইন্নের।

পলকের চক্ষুচড়কগাছ। কি বলতেছে রিক্সাওয়ালা এইসব। পলক আর তিয়ান….ও আল্লাহ….

চলবে…