ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-১৯+২০

0
402

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_১৯
©জারিন তামান্ন

ক্রিং ক্রিং শব্দে ধ্যান ভাংলো পলকের। অবরুদ্ধ অতীতের চৌকাঠ পেরিয়ে ফিরে এলো বাস্তবের দোরগোড়ায়। সামনে একটা রিক্সা দাঁড়ানো। সেটাই হর্ণ দিয়ে ডাকছে পলককে। পলক রিক্সাওয়ালার দিকে তাকাতেই রিক্সাওয়ালা বললো,
_যাইবেন নাকি আপা?
_হু.? অন্যমনস্কভাবে বললো পলক।
_তা কই যাইবেন?
_মিরপুর এগা..বলতে গিয়েই থেমে গেল পলক। চকিতেই মনে পড়ে গেল এখন তো তারা মিরপুর থাকে না। বড় বোন অন্তরার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পাড়া প্রতিবেশিদের কথায় ওখানে স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে গেছিল। তাই বছর ৩ আগেই ওই এলাকাটা ছেড়ে এসেছিল তারা। এখন শান্তিনগরের একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকা ওরা। এটা খেয়াল হতেই পুনঃরায় রিক্সাওয়ার মুখের দিকে তাকালো সে। রিক্সাওয়ার কপাল কুচকে আছে। সম্ভবত পলকের কথাটা না বুঝতে পেরে কিংবা বাকিটা শুনতে চাওয়ার তাগিদে। রিক্সাওয়ার ভাব দেখে এবার চট করেই বললো পলক,
_শান্তিনগর। ভাড়া কত?
_৫০ টাকা।
_আচ্ছা,চলেন। বলেই রিক্সায় উঠে গেল পলক। চোখজোড়া বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল একটা। তারপর,সযত্নে আবার তালা ঝুলিয়ে বন্ধ করে দিল অতীতের দরজাটা। এখন অনাগত নতুন জীবন নিয়ে ভাবা উচিৎ তার। অতীত যতই ঘাটবে ততোই রক্তক্ষরণ ঘটবে কেবল। আর ফলাফল, সে আবার ভেঙে পড়বে।দুর্বল হয়ে যাবে আরও বেশি। তিন -তিনটা বছর সময় লেগেছে তার এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে।এখন নতুন করে আর দুর্বল হবে না সে। কিছুতেই না।-নিজের মনে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলো পলক।

___________________________________

বুবু,,দেখ.. এই পাঞ্জাবিটা বেশি সুন্দর না? ধবধবে সাদা রঙের মাঝে সাদা সুতোর কাজ করা একটা পাঞ্জাবি দেখিয়ে বললো নিশাত।
_ধুর….হলুদে কেউ এমন সাদা পাঞ্জাবি পড়ে নাকি রে নিশু। তুই হলুদের মাঝে কিছু দেখ। আর তাড়াতাড়ি কর। শেরওয়ানি আর স্যুটের কাপড়গুলাও তো এখনো কেনা বাকি। আর বাদ বাকি জিনিসের তো এখনো খবরই নাই। ও.. আল্লাহ এত এত জিনিস কেনা বাকি.. কখন কিভাবে সব হবে কে জানে! -নিশাতের হাতে সাদা পাঞ্জাবিটা দেখে বিরক্তির সুরে সেটা নাকচ করে দিয়ে কথাগুলো বললেন শাহনাজ বানু।

_ওও হো, মা! আজকাল হলুদে হলুদ রংই পড়তে হবে এমন কোন নিয়ম নাই। নিউ ট্রেন্ডে তো নীল, সবুজ,সাদা, সিলভার গোল্ডেন সব ধরণের রঙ চলে। আর তুমি কি না সেই মান্ধাতালের ট্রেন্ড নিয়া পইড়া আছো!

_তুই চুপ কর তো,,সব কিছুতেই বেশি বুঝিস দুই আঙুল। যেটা বলছি কর। আর এই সাজি, তুই হাত পা গোটায়া বসে আছিস ক্যান…দেখ দেখ… পাঞ্জাবি পছন্দ কর জলদি।_কপট রাগ দেখিয়ে বললেন শাহনাজ বানু।

শাহনাজ বানুর এহেন অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো পলক। তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল দোকানে এক সাইডে থাকা ছেলেদের পাঞ্জাবীর কালেশনের দিকটায়। ঘুরে ঘুরে পাঞ্জাবি দেখছিল সে সিফাতের গায়ে হলুদের জন্য। হঠাৎই কুসুম হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবিতে চোখ আটকে গেল পলকের। পাঞ্জাবীর সাথে সাদা রঙের ধুতি পায়জামা। সাদা হলুদ,গোল্ডেন কালারের সুতোর কাজ করা বেশ সুন্দর পাঞ্জাবিটা। সিফাত লম্বাচওড়া মানুষ। সু-স্বাস্থ্যের অধীকারী। তার শরীরে বেশ মানাবে পাঞ্জাবীটা। এই ভেবেই মুচকি হেসে হাতে নিল পাঞ্জাবিটা। ওটা নিয়ে মা আর নিশাতের কাছে যেতে যেতেই সবুজ রঙের আরেকটা পাঞ্জাবিটা তে নজর গেল পলকের। ওটা দেখেই মনে পড়ে গেল পলাশের কথা। সবুজ রঙ পলাশের খুব প্রিয়। পলকের বিয়ে অথচ পলাশ নেই। আজ তার ভাইটা কাছে থাকলে নিশ্চয় নিজ হাতে বোনের বিয়ের একেকটা আয়োজন করতো। কিন্তু,এই পলকের বিয়ের জের ধরেই ভাইটা আজ তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ৩ বছর হয়ে গেছে ভাইকে দেখেনি সে। কোন যোগাযোগ নেই তার সাথে। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো পলকের। চট করেই একহাতে চেপে মুছে নিল উপচে পড়তে চাওয়া কষ্টগুলোকে।মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিল সে। তারপর এগিয়ে গেল পাঞ্জাবিটার কাছে। চুপচাপ পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে দেখলো পাঞ্জাবিটা পলাশের সাইজের কিনা। বর্তমানে ভাই তার কোন মাপের জামা কাপড় পড়ে জানা নেই পলকের। তাই আগের মাপের আন্দাজেই নিয়ে নিল পাঞ্জাবিটা। ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে আলাদাভাবে প্যাক করালো ওটাকে। বিলটাও পে করলো নিজ নামে। তারপর, ওখানকার লোকগুলোকে অনুরোধ করে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করলো ওটাকে। বললো,যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে।
তারপর সিফাতের জন্য পছন্দ করা পাঞ্জাবীটা নিয়ে ফিরে গেল নিশাত আর শাহনাজ বানুর কাছে।

পাঞ্জাবিটা বেশ পছন্দ হলো নিশাত আর শাহনাজ বানুর।তারপর ঘুরে ঘুরে সিফাতের জন্য শেরওয়ানি আর স্যুটের কাপড়ও কেনা হয়ে গেল। কিন্তু বিপত্তি বাধলো স্যুট বানাতে গিয়ে। সিফাতের শরীরের মাপ লাগবে। আর জুতোটাও কেনা বাকি। তাই ঠিক হলো সিফাত দেশে ফিরলে এই কাজ দুটো করা হবে। এছাড়াও সিফাতের জন্য বেশ দামী একটা ঘড়ি আর কয়েকটা শার্ট প্যান্ট এর কাপড় কেনা হলো। এরপর রুকু, সারা, রেহনুমা, রেহানা আর সিফাতের মামী দিলারার জন্যও পছন্দ করে শাড়ি কেনা হলো। আর তাদের পরিবারের ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবী। এরপর, টুকটাক শপিং শেষ করে বাড়ি ফিরে এলো তারা।

____________________________________

রাতে খাওয়ার পর্বশেষে বাবার ঘরে একবার উঁকি দিল পলক। বাবা বিছানায় বসে খাতা কলম আর ক্যালকুলেটর নিয়ে কি যে হিসাব করছে।কিন্তু এত রাতে কিসের হিসেব নিকেশ করতে বসেছেন তিনি দূর থেকে দেখে বোঝা গেল না সেটা। দরজায় টোকা দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল পলক। হিসেবের খাতা থেকে দরজার দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেন আমজাদ আলী। এক পলক দেখেই পুনঃরায় চোখ রাখলেন হিসেবের খাতাটায়। পলক এবার খানিক কেশে গলা ঝেড়ে বললো,
_বাবা আসবো?
_এসো।-কাঠকাঠ গলায় বললেন তিনি। আসলে তিনি আগে থেকেই চুপচাপ স্বভাবের। সবার সাথে কথাও কম বলেন। মেয়েদের মধ্যে অন্তরা ছিল তার ভীষণ আদরের।কিন্তু সেই মেয়েটাই সমাজের কাছে তার মাথা নিচু করে দিয়ে পালিয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে। আর অন্তরার ওমন কাজের ফল সরূপ পলকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওই এইট পাস ক্রিমিনাল ছেলেটার সাথে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন তিনি । এই ঘটনার কারণে সে মনে মনে বেশ লজ্জিত। আজও অপরাধবোধে ভোগেন এই নিয়ে।সেদিনের পর থেকে পলকের সাথে কথা বলতে গেলেই লজ্জা, অনুশোচনা,অপরাধবোধ এসে ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু বাবা হয়ে সন্তানের সামনে নতজাত হতেও বাঁধে তার। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না তিনি পলকের সাথে। তাই, তার এই রাগ অনুশোচনা অপরাধবোধকে তিনি রুক্ষতার আড়ালে লুকাতেই এমন কাঠকাঠভাবে কথা বলেন পলকের সাথে।

বাবার অনুমতি পেয়ে ধীর পায় ঘরে প্রবেশ করলো পলক।কিন্তু যেটা বলতে এসেছে সাহস করে সেটা বলতে পারছে না সে। তাই বাবার মুখোমুখি হয়ে খাটের এক কোণায় গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। মেয়েকে কিছুক্ষণ ধরে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খাতায় চোখ রেখেই আমজাদ আলী জিজ্ঞেস করলেন,
_কিছু বলবে? -শান্ত এবং বেশ গম্ভীর শোনালো তার কণ্ঠস্বর।
বাবার এহেন কথায় তটস্থ হয়ে গেল পলক। কিছুটা ঘাবড়েও গেল সে। তারপর খানিক ইতস্তত করে বললো,
_হ্য..এ্যা..হ্যাঁ। একটা কথা বলার ছিল তোমাকে। না আসলে একটা অনুরোধ ছিল তোমার কাছে।

মেয়ের এহেন কথা আর বলার ভাবে এবারে মেয়ের দিকে চোখ তুলে চাইলেন আমজাদ আলী। কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন মেয়েকে। তারপর, অতিব শান্ত কন্ঠে বললেন,
_বলো।
বাবার এহেন শান্তভাবও যে ভীষণ ভয়ংকর লাগলো পলকের কাছে। নিষিদ্ধ কোন কিছু চাইবার আগে যেমন আড়ষ্টতা আর ভয় কাজ করে পলকেরও ঠিক তেমনটাই অনুভব হলো সেই মূহুর্তে। তারপরেও মনে সাহস জুগিয়ে মুখ খুললো সে।
_আ…আ..মি বলছিলাম কি প…অ..অ..প..
_এত আমতা আমতা করছো কেন, যা বলবে সোজাসুজি বলো। বেশ বিরক্তির স্বরে বললেন আমজাদ আলী।
_হ্যাঁ…বলছি। বলছিলাম যে..
মেয়ের এমন হাবভাব দেখে তার দিকে এবার কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে চাইলেন তিনি। বাবার এহেন দৃষ্টি আরও ভয় পাইয়ে দিল পলককে। তাই এবার একটানে কথাটা বলে ফেলবে বলে মনে মনে ঠিক করলো সে। তাই পুনঃরায় নিজের কথাটা বাবাকে বলার জন্য লম্বা একটা শ্বাস নিল। নিজেকে প্রস্তুত করলো। তারপর বললো,
_বলছিলাম যে…পলা…এটুকু বলেই বাবার মুখের দিকে চাইলো পলক। আমজাদ আলী গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পলকের মুখের দিকে।সে কি বলবে সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। কিন্তু, বাবার এহেন চাহনী দেখে এবার হড়বড়িয়ে খুব দ্রুত বেগে পলক বললো,
_পলাশীর যুদ্ধ কবে যেন হয়েছিল বাবা?

পলকের প্রশ্নটা শুনে বেশ অবাক হলেন আমজাদ আলী। মনে মনে চমাকালেও খানিক। তার মনে হচ্ছে পলক এ কথা বলতে আসেনি। কিন্তু এখন সে অন্য কথাই বা কেন বলছে? মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে তার ছাপ পড়তে দিলেন না।পলকের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন হিসেবের খাতায়।এবং বরাবরের মতোই গম্ভীর আর কাঠকাঠ গলায় বললেন,
_১৭৫৭ সালে।
_অহ…আচ্ছা। থ্যাংক ইউ। তুমি কাজ করো বরং। আমি আসছি।
পলকের কথার প্রত্যুত্তরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না আমজাদ আলী।কিন্তু পলক ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে তিনি বললেন,
_পলাশের নাম নেওয়াও বারণ এ বাসায়। তাই বিয়েতেও তার বা তার পরিবারের কারোর আসারও প্রশ্নই উঠো না। এই নিয়ে আর কখনো কিছু বলতে এসো না।

পলক স্তব্ধ। বিস্ময়ে হতবিহ্বল। সেই সাথে এইভাবে ধরা পড়ে যাওয়ায় কিছুটা ভয়ও হলো মনে। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো পলক। তারপর এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলো সে মনে মনে। যা হওয়ার হোক…কথাটা যখন বাবা বুঝতে পেরেই গেছে, তাহলে তাকে রাজি করানোর একটা চেষ্টা এবার না করলেই নয়। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল পলক। এবারে পেছন ঘুরে দেখলো তার বাবা আগের মতোই হিসাব কষতে ব্যস্ত।ক্যালকুলেটরে অনবরত আঙুল চলছে তার। হতাশ হয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল বাবার দিকে। খাটের কাছে গিয়ে আরও একটা দুঃসাহসিক কাজ করলো সে।
____________________________

এক পা বাইরে ঝুলিয়ে খাটে বসে কাজ করছিলেন আমজাদ আলী। পলক সেখানে বসে আস্তে করে সরাসরি তার পা জড়িয়ে ধরলো। আচমকা এমন আলতো হাতের স্পর্শে হকচকিয়ে গেলেন তিনি। দ্রুত খাতা থেকে চোখ সরিয়ে নিচে তাকাতেই সেখানে পলককে আবিষ্কার করলেন তিনি।অন্তরা আর পলাশের অধিক নৈকট্যের কারণে পলক আর নিশাতের সাথে বরারই বেশ কিছুটা স্নেহের দূরত্ব ছিল তার। স্ত্রীসহ চার চারটে সন্তানের ভরণ পোষণের দায়ভার নিয়ে মধ্যবিত্তের সংসার চালানোর চিন্তা আর আয় রোজগারের ব্যবস্থাতেই দিন গেছে তার। পলক আর নিশাত খুব বেশি কাছে পায়নি বাবাকে। আর অন্তরা আর পলাশের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরে যাবতীয় ঘটনায় তিনি আরও বেশি গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে।তাই তাদের সম্পর্কের মাঝে আড়ষ্টতার একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয়ে গেছে। যে দেয়াল টপকে যাওয়ার সাহস না পলক বা নিশাত কেউ কখনো করেছে আর না আমজাদ আলী নিজে সে দেয়াল ভেঙে মেয়েদের সাথে এই দূরত্ব কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছেন। তাই আচমকা এসে পলকের এভাবে পা জড়িয়ে ধরায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন তিনি। তবুও গলায় যথেষ্ট কাঠিন্য রেখে তিনি বললেন,

_আহ…সাজি! কি করছো তুমি? উঠো এখনি।

পলক তার জায়গায় অনড়। বাবার কথা যেন তার কানেই গেল না। জড়তা আর বিরক্তিতে এবার তিনি ধমকে উঠলে মেয়েকে।
_আহ…সাজিই! উঠো বলছি। এসব কি ধরণের আচরণ।পা ছাড়ো। উঠো তুমি!
_বাবা,প্লিইইইইজজ!!
পলকের কন্ঠ শুনে থমকে গেলেন তিনি। পলকের কন্ঠ ভেজা। তার মেয়েটা কাঁদছে। তারপরেও, গলায় গম্ভীর্য ধরে রেখেই তিনি মেয়েকে থামানোর চেষ্টা করলেন।
_সাজিইই!
বাবার এহেন গম্ভীর কন্ঠের আদেশও পলককে থামাতে পারলো না।কাঁদতে কাঁদতেই সে বলতে লাগলো,

_বাবা, প্লিজ! তুমি আর রাগ করে থেকো না। মাফ করে দাও ভাইয়াকে। বাড়ি ফিরে আসতে বলো । প্লিজ বাবা!তুমি একবার বললেই চলে আসবে ভাইয়া। তুমি শুধু একবার বলো,,,প্লিজ বাবা…একটা সুযোগ দাও ভাইয়াকে। মানুষ ভুল করলেও তাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়, সেখানে ভাইয়া তো নিরুপায় ছিল। তুমি তাকে ফিরিয়ে আনো না বাবা। আমার বিয়ে অথচ আমার একমাত্র ভাইটাই থাকবে না…এমন কি করে হয় বাবা…? তুমি তাকে একটা সুযোগ দাও দেখবে…

_তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সাজি। কিন্তু সে সেটা…

_ভাইয়া নিরুপায় ছিল বাবা। তুমি জানো ভাইয়ার একটা মেয়ে আছে। ২ বছর বয়স। সেই মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্যই সেদিন আমাদের ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল সে। তুমিই বলো বাবা…কোন বাবা কি পারে নিজের সন্তানকে মরে যেতে দিতে? আর ওই মেয়েটাতো পৃথিবীর আলো অবদি দেখেনি তখন। তাকে সুস্থভাবে এই পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্যই সেদিন বাধ্য হয়েছিল আমাদের ছাড়তে। আর তুমিই বলো ভাইয়া তখন কি করতো? ভাবীর গর্ভে অনিশ্চিত একটা জীবনের পথে ছেড়ে দিত তার সন্তানকে? তুমি হলে পারতে? কোন বাবা কি পারবে সেটা? বাবা তুমি প্লিজ..

এবারে আর সহ্য করতে পারলেন না তিনি পলকের এসব কথা। তাই রাগে বিরক্তিতে চিৎকার করে ডাকলেন তার স্ত্রীকে।
_শানু….শানু….

রান্নাঘরে গোছগাছ করছিলেন শাহনাজ বানু। আচমকা স্বামীর এহেন ডাকে হন্তদন্ত হয়ে নিজের ঘরে ছুটে এলেন তিনি। ঘরে পা রাখতেই থমকে গেলেন তিনিও। পলকে এভাবে বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। বাবার এমন প্রলয়ঙ্কারী ডাকে এতক্ষণে ছুটে এসেছে নিশাতও। পলক আর বাবার এহেন অবস্থা দেখে সেও ভড়কে গেছে রীতিমত। ব্যাপারটা ঠিক কি ঘটেছে বুঝে উঠতে পারলো কেউই। হতবিহ্বল নয়নে তাকিয়ে দেখছে আমজাদ আলী আর পলককে। এদিকে শাহনাজ বানুকে ঘরে দেখতে পেয়েই কঠিন গলায় তিনি আদেশ করলেন স্ত্রীকে।
_তোমার মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যাও শানু। এসব নাটক আর ভালো লাগছে না আমার।

মাকে দেখতে পেয়ে পলকের কান্না, আহাজারি এবার বিলাপে রূপ নিল। কান্নার মাত্রাও বেড়ে গেল তার। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
_মা…ও..মা। তুমি বোঝাও না একটু বাবাকে। বলো না বাবাকে ভাইয়াকে যেন ফিরিয়ে আনে। অনেক তো হলো মা…৩ টা বছর হয়ে গেছে এখন তো ফিরিয়ে আনতে বলো ভাইয়াকে। ক’দিন পরেই আমার বিয়ে। চলে যাবো তো এই বাড়ি ছেড়ে আমি। আমার শেষ চাওয়া হিসেবেই তোমরা ফিরিয়ে আনতে বলো না ভাইয়াকে। বলো না মা প্লিজ..

এবারে আমজাদ আলীর ধৈর্য্যের সীমা পুরোপুরিভাবে অতিক্রম করে গেল। ধমকে উঠলেন তিনি স্ত্রীকে।

_কি হলো? কি বললাম তোমাকে? নিয়ে যাও নিজের মেয়েকে। আমার আর সহ্য হচ্ছে না এসব।

স্বামীর এহেন হুংকারে কেঁপে উঠলেন শাহনাজ বানু। স্বামীকে তিনি যেমন ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন তেমনি তার রাগকেও ভীষণ ভয় হয় তার। শান্তশিষ্ট মানুষের রাগ বরাবরই ভয়ংকর। তার স্বামীর বেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে পলককে ধরলেন তিনি।

_সাজি…কিসব পাগলামি করতেছিস..উঠো।

_মা প্লিইইজ..

_সাজি…উঠ বলতেছি।

কিন্তু পলক তার জায়গায় অনড়। কিছুতেই সেখান থেকে সড়ানো যাচ্ছে না তাকে। শাহনাজ বানু বকে ধমকেও তাকে উঠাতে পাড়ছেন না।মায়ের এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো নিশাত। তারপর একরকম টেনে হিচড়েই তুলে নিয়ে তাকে বের করে নিয়ে গেল ঘর থেকে।

আমজাদ আলী ওভাবেই কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলে ওখানে। মন মস্তিষ্কে হাজারো চিন্তা,অতীতের কথা, ভুল ঠিকের হিসেব এসে উঁকি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। পলকের সাথে তার কিছুটা দূরত্ব থাকলেও সন্তান হিসেবে তাকেও কম ভালোবাসেন না তিনি। হয় তো প্রকাশ করেন না সেভাবে। কিন্তু পলকের প্রতিও তার স্নেহ কাজ করে। ছোট থেকেই বেশ শান্তশিষ্ট তার এই মেয়েটি। নিশাত কিছুটা চটপটে হলেও পলক একদম চুপচাপ স্বভাবের। কখনো কোন কিছুর জন্য আবদার করেনি।জেদ করেনি। অন্তরাকে তার তুলনায় বেশি আদর স্নেহ করেছেন তিনি। এ কথা নিজেও স্বীকার করেন।তারপরেও কখনো এতটুকু অভিযোগ সে করেনি।অথচ এই মেয়েটার সাথেই তিনি বরাবর অন্যায় করে এসেছেন।
প্রথম বিয়ের সময় বিয়ে করতে না চেয়ে এভাবেই মায়ের পা জড়িয়ে কাঁদতে দেখেছিলেন তিনি পলককে। প্রথমবারের মত ওভাবে হাউমাউ কেঁদেছিল মেয়েটা তার। কিন্তু তার মন গলেনি। ক’দিন পরেই আবার বিয়ে এই মেয়েটার। এবারে তিনি কোন অবিচার করেননি মেয়ের সাথে। কিন্তু, সারাজীবন তার কাছে কোন কিছুর আবদার না করা মেয়েটাই চলে যাওয়ার আগে এমন এক আবদার করলো।এভাবে কান্না কাটি করলো। অথচ আজও তিনি ফিরিয়ে দিলেন মেয়েকে। নিজের আত্ম অহংকার, রাগ আর কাঠিন্যের দেয়াল ভেঙে মেনে নিতে পারলেন না মেয়ের এমন আহাজারি ভরা আবদারটুকু। জীবন সত্যিই বড্ড বিচিত্র। একজীবনেই কত সময় কত চরিত্রে কত রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। কত ছোট ছোট চাওয়া আবদারকেও অহং এর তলায় পিষে ফেলতে হয়।এগিয়ে যেতে হয় সময়ের স্রোতের সাথে লড়াই করে।
জীবনের এত রূপ রঙ নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় হাঁপিয়ে উঠলেন আমদাজ আলী। ক্লান্তি আর বিষাদে ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী তিনি। স্ট্রেস একদম নিতে পারেন না। একটু আগের ঘটনায় অতীতের অনেক কথাই ভাবা হয়ে গেছে তার।বড্ড বেশিই ক্লান্ত লাগছে এখন। আস্তে করে বিছানা থেকে নেমলেন তিনি। খাতা বন্ধ করে চশমাটা খুললেন চোখ থেকে। ওগুলো সাইড টেবিলের উপর রেখে ঘরের আলোটাও নিভিয়ে দিলেন। দরজার কাছে গিয়ে একবার বোঝার চেষ্টা করলেন ওদিককার অবস্থাটা। পলকের ঘরটা তার ঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরেই। তবুও চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু পলকের কান্না বা কারও কোন কথার আওয়াজ..কিছুই শুনতে পেলেননা। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন বিছানার দিকে। সোজা হয়ে শুয়ে কপালে হাত রেখে চোখ বুঝলেন।কিন্তু, সে চোখে আদৌও ঘুম নামলো কিনা বোঝা গেল না।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_২০
©জারিন তামান্না

রাত ৩:১৯ বাজে। আই.সি.ইউ এর সামনের করিডোরে পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে পলক আর তিয়ান। পলকের চেহারা বিধ্বস্ত। চোখ মুখ ভীষণরকম ফোলা এখনও।ওড়না জড়ানো মাথার গন্ডি পরিয়ে অবাধ্য কিছু চুল এলোমেলো হয়ে কিছুটা আঁড়াল করে রেখেছে পলকের বিধ্বস্ত মুখখানি। তিয়ানও বেশ ক্লান্ত। হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথা নিচু করে দু হাতে চোখ মুখ চেপে ধরে আছে। ঘুম পাচ্ছে তার। কিন্তু, পলককে একা জাগিয়ে রেখে ঘুমিয়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না তার। পলক নিস্তব্ধ। ঠিক এই রাতটার মতোই। মাঝরাত হওয়ায় নাইট ডিউটিতে থাকা কিছু ডাক্তার আর নার্স ছাড়া তেমন কেউ জেগে নেই। আর আই. সি. ইউ এর দিকটায় পেশেন্ট আর এটেনডেন্স ছাড়া একেবারেই কেউ নেই। তাই এখানে নিঃস্তবদ্ধতাটা একটু বেশিই। ওভাবে বসে থাকতে থাকতেই একসময় তিয়ান বললো,

_আমি ভেবেছিলাম আগের থেকে শক্ত হয়ে গেছো তুমি।কিন্তু তুমি তো..বলেই খানিক নিঃশব্দেই হাসলো তিয়ান।
রাতের ওই নিস্তদ্ধতায় আচমকা তিয়ানের ওই শান্ত কণ্ঠস্বরেও যেন গা’য়ে কাটা দিয়ে উঠলো পলকের। চমকে তাকালো সে তিয়ানের দিকে। সে তখনো একই ভাবে বসা।হতবাক চোখে তাকিয়ে তাকে দেখছে পলক। একটুবাদে সোজা হয়ে বসলো তিয়ান। পাশ ফিরে চাইলো পলকের দিকে। একইভাবে হাসলো সে আবারও। পলকের চোখ বিচলিতভাবে তিয়ানের সারা মুখে বিচরণ করছে ক্রমশ। তিয়ানকে বোঝার চেষ্টা করছে সে।কিংবা তিয়ানের কথার অর্থটা! একটা সময় ছিল যখন এই হাসি হাসি মুখটা বড্ড নির্মল আর শুদ্ধ মনে হতো পলকের কাছে।কিন্তু এই মূহুর্তে সেই একই মুখ একই মানুষটাকে বড্ড দুর্বোধ্য লাগছে তার কাছে। বিগত কয়েক ঘন্টায় বা আজ গোটা দিনটায় এই মানুষটাই যেভাবে তাকে আগলে রেখেছে বা পাশে থেকেছে আর এখন যেভাবে কথা বলছে তাতে বড্ড অচেনা লাগছে তাকে। অথচ তিন বছর আগে যদি এইভাবেই পাশে থাকতো তবে হয় তো সব কিছু আজ অন্যরকম হতো।
____________________________________
ফ্ল্যাশব্যাক..

সকাল ৬:৩৭ বাজে। তিয়ান সবেমাত্রই জগিং শেষ করে নিজের রুমে এসেছে।রোজ জগিং থেকে ফিরেই একগ্লাস ফ্রেশ জুস খাওয়ার অভ্যাস তার। তারপর শাওয়ার নিয়ে ব্রেকফাস্ট করে তৈরী হয়ে নেয় অফিসের জন্য। ৮’৩০ টার মাঝেই বেরিয়ে পড়ে সে। ৯ টা থেকে অফিস জয়েন করে।রোজকার প্রায় একই রুটিন তার। কিন্তু,আজ সূর্যি মামা তেজ কিছুটা বেশিই । তাই রুমে এসেই আগে চট করে শাওয়ার নিয়ে নিল সে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছিল তিয়ান। ঠিক তখনই বিছানার উপর রাখা ফোনটার রিংটোন শোনা গেল। এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল তিয়ান। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখেই মুচকি হাসলো সে।কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কলদাতার উচ্ছ্বাসিত গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

_হ্যালো..জানেমান…মেরি জানে জিগার…মেরি একলতা বয়ফ্রেন্ড.. মাই বেস্টু….How are you yrr?

_বিয়ে করে এক বাচ্চার মা হয়ে গেলি,তবুও তোর টমবয় টোন আর উইমেন টোন হলো না রে বিথু!! সকৌতুক হাসতে হাসতে বললো তিয়ান।

_আরেএ রাখ তোর বিয়ে আর বাচ্চা! ও তো ঐ ফাজিলটা ক্যাম্নে ক্যাম্নে জানি আমারে নিজের প্রেমে বশ করলো তারপর বাপেরে পটায়া বিয়েও করে ফেললো। আবার বছর যাইতে না যাইতেই বাচ্চার মাও বানায় দিল। নইলে তুই ছাড়া অন্য কোন ছেলের সাহস ছিল নাকি আমারে টাচ করার? আর বাচ্চার মা বানানি তো বহুত দূরের কথা!

_হা হা হা…..বিথির কথা শুনে সজোরে হেসে দিল তিয়ান।
_ওই ব্যাটা হাসছ ক্যান! যা সত্যি তাই তো কইলাম।
_আচ্ছা যা।মানলাম তোর কথা। এখন বল, কেমন আছিস তুই? কবির, নোরা.. কেমন আছে ওরা?
_আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি সবাই। তুই কেমন আছিস? কেমন লাগতেছে তোর…এত বছর পরে দেশে ফিরা?
_আমিইই..হুম,আছি ভালোই। দেশে ফিরে ভালোই লাগছে।বাবার বিজনেস দেখাশোনা করছি।নিজের মাইক্রোসফটের বিজনেসটাও সেট আপ করছি এখানে।এছাড়াও পুরোনো কত কিছুই তো রয়ে গেছিল এই দেশে। রোজ দিন সেসবের সাথে পুনঃরায় সাক্ষাৎ হচ্ছে। নতুন করে দেখছি সেসব।চিনছিও! বিষাদভরা কন্ঠে বললো তিয়ান। আর তার কথা এবং গলার আওয়াজেই কিছু একটা আন্দাজ করে নিল বিথি। তারপর,খানিক ভাবলো কি যেন একটা।এরপর সরাসরি তিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,

_সাজির সাথে দেখা হইছিল তোর?

তিয়ান যেন জানতোই যে বিথি এই প্রশ্নটা তাকে করবেই। তাই সেও প্রস্তুত ছিল উত্তর দেওয়ার অপেক্ষায়। তাই কোন রকম কোন ভণিতা ছাড়াই ঝটপট উত্তর দিল।

_হ্যাঁ,,,দু বার দেখা হয়েছে। তবে দুবারই তা আনএক্সপেক্টেড ছিল।একরকম ভাগ্যচক্রেই দেখা হয়ে গেছে বলে বলতে পারিস।

_তো কি বললো সাজি? I mean…how did she react?

এই প্রশ্নের জবাবে তিয়ান পলকের সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা,পলকের ব্যবহার সবকিছু খুলে বললো বিথিকে। শেষে এও বললো,

_Finally she completely forgot whatever we had once..& moved on so beautifully. অনেক বেশি বদলে গেছে রে বিথি…পুরোপুরি ভুলে গেছে আমাকে,আমাদের সম্পর্কটাকে। ওর একটুও খারাপ লাগে না আমাকে ফেইস করতে। মেন্টালি অনেক স্ট্রং হয়ে গেছে ও। তিয়ানের কন্ঠে চাপা কষ্ট ছলকে পড়ছে,যেটা দূর দেশে বসেও ফোনের ওপারে ঠিক বুঝতে পারলো বিথি। কিন্তু, সেও জানে যে এখন সত্যিই আর কিছুই করার নেই। পলকের এই আচরণ তিয়ানের প্রাপ্য…আর এই সাবলিল জীবনটা পলকের! অথচ তিয়ান তখন ওভাবে ফিরিয়ে না দিলে আজ তাদের গল্পটা হয় তো অন্যরমক হতো। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে চুপ হয়ে গেছে বিথি। ফোনের ওপারে বিথির কোন রেসপন্স না পেয়ে তিয়ান প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,

_Anyway…leave it. তা তুই কি একেবারে সেটেল হয়ে যাবি কানাডায় নাকি দেশে ফেরার প্ল্যান আছে কোন?

_না রে…কবির এখানেই প্রফেসরের জবটা করতে চায়।ওর বাবার বিজনেসটাও এখানে। উনি ওটা ছেড়ে অন্য কোথাও শিফট হবে না। তাছাড়া,যার জন্ম থেকেই এইখানে থেকে অভ্যাস সে কি আর বাংলাদেশের মত জায়গায় সহজে এডজাস্ট করতে পারবে! তবে পলকের বিয়েতে দেশে আসার একটা প্ল্যান আছে অবশ্য। আসলে তো দেখা হবেই তোর সাথেও। বিয়েতে আসবি তুই?
_হ্যাঁ,,দেখি! সিফাত ভাইয়া এত করে যখন বলেছেন.. তখন দেখা যাক! যেতে পারি।
_আচ্ছা। তবে একটা কথা বলি দোস্ত.. তুই বিলিভ করিস আর নাই করিস সাজি কিন্তু তোকে ভুলে নাই একটুও। সেই আগের মতোই ভালবা..
_না রে বিথু।এমন কিছুই অবশিষ্ট নাই আর। যে মেয়েটা আমাকে নিজের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতেও দ্বিধা করে , সে আর কিছুতেই আমাকে….। তাছাড়া, she has already moved on in her life. Now I ‘m simply just nothing to her.

_উহু…দোস্ত…তুই ভুল বুঝতেছি।

_নাহ…আমি ঠিকটাই বুঝেছি। তুই আর এটা নিয়ে কথা বাড়াস না প্লিজ।

_এই না…তুই এই ভাবে সাজি রে ভুল বুঝতে পারিস না। ওয়েট…আমি সাজি রে কান্টেক্ট করতেছি.. তুই নিজেই শোন সে কি বলে। বলতে বলতেই বিথি কন্টাক্ট লিস্ট থেকে ডায়াল করলো পলকের নাম্বারে। তিয়ান যেন কিছু বলতে গিয়েও বললো না। কোন না কোনভাবে সেও চায় পলক তাকে নিয়ে কি ভাবে সেটা জানতে। তাই চুপ করে থেকে বিথির কাজটাকে সাপোর্ট করলো সে

শান্তিনগর,সকাল ৭:১৩ মিনিট।

গতরাতের ঘটনার পর সবারই প্রায় নির্ঘুম রাত গেছে ও বাড়ির।কিন্তু,ব্যক্তিগত কোন কারণে পেশাগত জীবন তো আর থামিয়ে রাখা যায় না।আর তা যদি হয় অন্যের অধীনে কাজ করার মত। পলককেও তাই গতরাতের কষ্ট, ক্লান্তি ভুলে তৈরী হতে হচ্ছে স্কুলে যাওয়ার জন্য। রাতভর কেঁদেছে পলক।ফলসরূপ চোখ লালচে হয়ে আছে। দেখলে যে কেউ ধরে ফেলবে সে যে কেঁদেছে। প্রশ্নও করবে হয় তো কি হয়েছে জানতে চেয়ে। তখন কি জবাব দেবে সে?! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল আর এই কথাগুলোই ভাবছিল পলক। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ধ্যান ভাংলো তার। সাইড টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়েই দেখলো বিথি কল করেছে। কানাডায় তখন বিকেল। তবে বিথি তো জানে যে এসময় পলক স্কুলের জন্য বেরিয়ে পড়ে।আজ খানিক দেরি হয়ে গেছে তাই এখনো বাসায় সে। কিন্তু আজ এ সময় তার ফোন কল দেখে কিছুটা বিচলিত হলো পলক। মনে মনে প্রশ্ন জাগলো তার, “সব ঠিক আছে তো ওখানে? ” এটা ভাবতে ভাবতেই রিসিভ করলো সে কলটা।।রিসিভ করতেই তার স্বভাবসুলভ স্বরেই বিথি বললো,

_কি রে বাঁশপাতা নিরামিষ, কেমন আছিস তুই?
_এই তো..তুই? পলকের নিষ্প্রতিভ কন্ঠস্বর। যেটা খুব স্পষ্ট ভাবেই জানান দিচ্ছে যে ঠিক নেই সে। বিথিও বুঝতে পারলো সেটা। খটকা লাগলো তার।তিয়ানের কারণেই কি তবে…?আর কিছু ভাবলো না সে। সরাসরি প্রশ্ন করলো পলককে।

_সব ঠিক আছো তো রে সাজি?

_হ্য…পুরোটা আর বলা হলো না পলকের। তার আগেই বাবা মায়ের ঘর থেকে ভয়ার্তক কন্ঠে সজোরে মায়ের ডাক শুনতে পেল পলক।সাজি…নিশাত নামে ডেকে যাচ্ছেন বারবার। মূহুর্তেই কিছু না ভেবেই ফোন হাতে নিয়েই ছুটলো ও ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকতেই তার মনে হলো মূহুর্তেই পুরো পৃথিবী থমকে গেছে তার। বাবা সোজা হয়ে শুয়ে আছে আর মা সমানতালে তার হাত পায়ের তালু ঘঁষছে আর ডাকছেন। কিন্তু বাবার কোন সাড়া নেই। নিথর শরীরে পড়ে আছে বিছানায়। মনে হচ্ছে খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তিনি। তাই মায়ের এত জোরালো ডাকও তার কর্ণগোচর হচ্ছেনা। কোন সাড়া দিচ্ছেন না তিনি। মায়ের এহেন জোর গলার ডাকে ছুটে এসেছে নিশাতও। সারারাত জেগে ছিল সে।পলককে সামলেছে। তাই ভোর রাতের দিকে চোখ লেগে এসেছিল তার। পলকের ঘরেই ঘুমিয়েছিল। ঢুলুঢুলু চোখে আড়মোড়া ভাংতে ভাংতে ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো সে। ঘুম না ছোটা গলায় জিজ্ঞেস করলো সে।
_কি হইছে? এভাবে চেঁচাইতেছো ক্যান আম্মা? শাহানাজ বানুর কোন খেয়াল নেই সেদিকে। তিনি তার মতো করে একবার সাজি..একবার নিশাতের নাম ধরে ডেকে যাচ্ছেন তখনো। আবার মাঝে মাঝে হাত পায়ের তালু ঘঁষতে ঘঁষতেই ডাকছে আমজাদ আলীকে। কিন্তু তার কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

ওদিকে ফোনের ওপাশে তিয়ান আর বিথি দুজনেই কানেক্টেড তখনো। ওরা সব শুনতে পাচ্ছিল কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলনা ঠিকভাবে। শুধুমাত্র আন্দাজ করতে পারছিল যে ও বাড়িতে খারাপ কিছু হয় তো ঘটেছে। তিয়ান চুপ করে আছে। কিন্তু বিথি আর পারলো না। ফোনের ওপাশ থেকে পলককে ডেকে যাচ্ছে সে।
_হ্যালো…সাজি….হ্যালো???? হ্যাঁ রে সাজি…Are you there? শুনতে পাচ্ছিস তুই? কি হইছে ওখানে? এই সাজিইই….

পলক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সাথে ঠেস দিয়ে। নিজের মাঝে নেই সে। ফোনের ওপাশের মানুষটার কথাও কানে যাচ্ছে না তার। কিন্তু, নিশাত সেটা ঠিকই শুনতে পেল। সার্বিক পরিস্থিতিতে ঘুম ছুটে গেল তার। বোন আর মাকে ওই অবস্থায় দেখে অস্থির হয়ে উঠলো সে। পলকের কোন নড়চড় নেই। বুবু.. বুবু বলে ডাকলো সে দুবার। পলক সাড়া দিল না। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মা আর বাবার দিকে। পলকের কোন সাড়া না পেয়ে তাকে ছেড়ে দ্রুত গিয়ে মায়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো নিশাত। বুঝার চেষ্টা করলো ঠিক কি হচ্ছে বা হয়েছে। আমজাদ আলীর কোন রেসপন্স নেই দেখে তাকে ধরে দেখলো নিশাত। হাত পা বেশ ঠান্ডা। ভয় পেয়ে গেল সে। দ্রুত নার্ভাস চেক করলো কিন্তু সেটাও বুঝতে পারলো না। তাই শেষমেশ নাকের কাছে আঙুল নিয়ে দেখলো শ্বাস চলছে কিনা। হ্যাঁ,,,শ্বাস চলছিল। কিন্তু খুব ধীর গতিতে। সেন্স নেই। তা দেখে এবার সজোরে ডাকলো পললকে সে।
_বুবুউউ….আব্বাকে হাসপাতালে নিতে হবে রে। এম্বুলেন্স রে কল দে। এইই বুবু….

পলকের হুশ হলো এবারে। নড়েচড়ে উঠলো সে। দ্রুত পায়ে ছুটে গেল জ্ঞানহীন শুয়ে থাকা আমজাদ আলীর কাছে। জোরে জোরে তাকে ঝাঁকাচ্ছে আর ডাকছে।
_বাবা…ও বাবা….কি হলো তোমার? ও বাবা….উঠো না। প্লিজ বাবা…কথা বলো। বাবাআআ….আমি প্রমিস করতেছি আর কখনো কিচ্ছু আবদার করবো না তোমার কাছে। তুমি প্লিজ উঠো..ও বাবা..
পাগলের মত বিলাপ করছে আর ডাকছে তার বাবাকে। আর তা দেখে শাহনাজ বানু ফুঁসে উঠলেন যেন,

_হতচ্ছাড়ি..এখন ডাইকা কি করবি? শান্তি হইছে না তোর এবার? মানুষটা রে শেষ কইরা ছাড়লি। এখন আবার এম্নে ডাকাডাকি করতেছিস। সাড়া তো দিবে না দিবে না তো সাড়া….শেষ কইরা দিলি মানুষটারে…সর্বনাশী… এবার যা ভাইয়ের গলা জড়ায় ধইরা বইসা থাক। বাপে রে শেষ করলি এহন ভাইয়ের কাছে যা। আর কোন বাঁধা রইলো না তোর…

স্বামীর এহেন অবস্থা দেখে বোধ বুদ্ধি হারিয়ে পলকে যা নয় তাই বলে বকে যাচ্ছেন শাহনাজ বানু। কিন্তু পলক সে সব পাত্তা না দিয়ে নিজের মত ডেকে যাচ্ছে তার বাবাকে।এদিকে, একদিকে বোনের পাগলামো আর অন্যদিকে মায়ের এমন কথা প্রচন্ড রকম বিরক্ত হয়ে গেল নিশাত। মানুষটা সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে, হাসপাতালে নেওয়া দরকার আর এরা দুজনে নিজেদের মত পাগলামি শুরু করছে। এবার আরও দেরি হলে হয়তো সত্যি সত্যি শেষ হয়ে যাবে মানুষটা। তাই রাগে বিরক্তিতে নিজেই মায়ের ফোন থেকে ফোন করলো হাসপাতালে।

_হ্যালো, ঢাকা মেডিকাল কলেজ হাসপাতাল? জ্বী, একটা এম্বুলেন্স লাগবে। ইমার্জেন্সি। প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করুন। হ্যাঁ…এড্রেস লিখুন.. বলেই বাসার এড্রেস দিয়ে এম্বুলেন্স কল করলো নিশাত। ওদিকে ফোনে কানেক্টেড থেকে বিথি আর তিয়ান দুজনেই শুনলো সবটাই। বুঝলো যে পলকের বাবার কিছু একটা হয়েছে যার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে তাকে। ওদিকে পলক আর তার মা আর্তনাদ করে কাঁদছে। নিশাত কোন রকমে ফ্রেস হয়ে নিল। এম্বুলেন্সও চলে এসেছে। আমজাদ আলীকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।

ফোনে কানেক্টেড থেকে সবটাই শুনছে দুজন মানুষ। কোলাহল, আর্তনাদ আর নিশাতের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।মা আর বোনকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য বোঝাচ্ছে সে।একটা সময় কিভাবে যেন ডিসকানেক্ট হয়ে গেল কলটা। কিছু সময় নিরব কাটলো বিথি আর তিয়ানের। তারপর বিথি কিছু বলতে যাচ্ছিল তিয়ানের উদ্দেশ্যে, তখনই..
_তিয়ান..
_I’m going there. তুই পলকের সেলফোনের নাম্বারটা টেক্সট কর আমায়। Fast.রাখছি। Bye.

বিথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দিল তিয়ান। দ্রুত রেডি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

ওদিকে কল ডিসকানেক্ট হয়ে যাওয়ার পর বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল বিথি। কিন্তু তিয়ান ওখানে যাচ্ছে শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল সে। আবার কিছুটা দুশ্চিন্তাও হচ্ছে তার। তিয়ানকে দেখে পলক বা তার ফ্যামিলি কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে সেটা ভেবে। নোরার কান্নার আওয়াজে চিন্তার চরকা থামিয়ে দিল বিথি। ঘুম ভেঙে গেছে তার রাজকন্যার। ১১ মাস বয়স তার। ঘুম ভেঙে মা কে কাছে না পেয়ে কাঁদছে সে। অতগ্যা বেলকোনি থেকে ঘরের দিকে পা বাড়ালো বিথি। যেতে যেতে পলকের নাম্বারটা ম্যাসেজ করে দিল তিয়ানকে। মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো যেন সব ঠিক হয়ে যায়।

____________________________________

ঢাকার জ্যাম ঠেলে দ্রুত ড্রাইভ করে হাসপাতালে পৌঁছালো তিয়ান। গাড়ি পার্ক করে এসে বিথির পাঠানো নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু,রিসিভ হলো না কলটা।বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরেও রিসিভ করলো না পলক। তিয়ান একজন মাইক্রোসফট ইঞ্জনিয়ার। তাই নাম্বার ইউজ করে লোকেশন ট্রেস করে নিল সে সহজেই।লোকেশন ট্রেস হলো হাসপাতালের এড্রেসেই। অর্থ্যাৎ, পলক হাসপাতালে চলে এসেছে। ম্যাপ দেখে দেখে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকলো তিয়ান। রিসিপশনের কাছে গিয়ে থামলো সে। চারিদিকে রোগী , নার্স ওয়ার্ডবয় মানুষের ছুটোছুটি আর কোলাহল।কিন্তু পলকে দেখতে পারছে না তিয়ান।আরও চিন্তা হচ্ছে এখন তার। কোথায় গেল মেয়েটা? কি অবস্থা তাদের সবার?!

এসব ভাবতে ভাবতেই তিয়ানের চোখ গেল দ্রুত পায়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে ছুটে আসা পলকের দিকে। ডাক্তার কি কি যেন বললো। তারপর চলে গেল। বড্ড দিশেহারা দেখালো পলককে। একহাত কোমড়ে দিয়ে আর অন্য হাত দিয়ে কপাল চেপে কি যে ভাবলো কিছু সময়।কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো তিয়ান। তারপর কোথাও যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পলকের হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিল তিয়ান। ভীড়ের মাঝে অচমকা এমন হাত ধরায় চমকে গেল পলক।চকিতেই পেছন ফিরে তাকালো সে। তিয়ানের হাতের মুঠোয় নিজের হাতটা দেখে হতবাক হয়ে গেল একদম। কিন্তু, খুব বেশি সময় না দিয়ে ওভাবে পলকের হাত ধরেই দ্রুত পায়ে হেঁটে তাকে ভীড় থেকে টেনে বের করে নিয়ে এলো তিয়ান। কিছুটা ফাঁকা জায়গায় এনে দাঁড় করালো তাকে। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

_ডাক্তার কি বললো? কি অবস্থা আংকেলের এখন? নিশাত আর আন্টিই বা কই?
প্রথমত তিয়ানকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছিল পলক,এখন তার প্রশ্নগুলোয় আরও বেশি অবাক হলো। কারণ, তিয়ান এমনভাবে বলছে যেন সবকিছু সে জানে আর তারও আসার কথা ছিল এখানে। পলকের মুখে কোন কথা নেই। অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে তিয়ানের মুখের দিকে। তা দেখে পলকের ধরে রাখা হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিলো তিয়ান যাতে পলক স্বাভাবিক হয়।হাত ঝাঁকুনি দেওয়ায় আর পলকের নিজের ওপর ব্যালেন্স না থাকায় আরও এক পা কাছে এগিয়ে এলো সে তিয়ানের। তিয়ানকে আরও কাছ থেকে দেখতে পেয়ে হুশ হলো পলকের। চোখ নামিয়ে তিয়ানের হাতের মুঠোয় ধরে রাখা তার হাতটা দেখলো একবার। আর সাথে সাথেই এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল হাতটা। দু কদম পিছিয়ে সরে দাঁড়ালো তিয়ানের কাছ থেকে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সে। দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে নিচের দিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।তবুও, দ্রুত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”তু..তুমি এখানে? “তিয়ান এসবে একটুও অবাক হলো না। কারণ সে জানে এই সময় তার ক্ষেত্রে এটাই পলকের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তাই সেও শান্ত স্বরেই জবাব দিল।
_সেসব পরে বলছি…আগে বলো আংকেল কোথায়?
_তুমি বাবার কথা জানো কি করে? সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করলো পলক।
_বিথির আর তোমার সাথে কানেক্টেড ছিলাম ফোনে। তখন শুনেছি। -ঝরঝরে গলায় বললো তিয়ান।
পলক হতভম্ব।তারমানে বিথি ইচ্ছে করেই… আর কিছু ভাবার সুযোগ হলো না পলকের। তারাগেই স্বশব্দে বেজে উঠলো হাতের ফোনটা। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো নিশাত ফোন করেছে। একমূহুর্ত দেরি না করে ঝটপট ফোন রিসিভ করলো পলক। ফোনের ওপাশে নিশাত কি বললো শুনতে পেলনা তিয়ান। শুধু পলকে বলতে শুনলো,”তুই থাক ওখানেই..আসতেছি আমি”। বলেই কল কেটে দিল সে। তারপর, পেছন ঘুরে সোজা হাঁটা দিল। তিয়ান কিছু বুঝতে না পেরে সেও পিছু পিছু গেল পলকের। জেনারেল ওয়ার্ডের সামনে স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়েছে আমজাদ আলীকে। সাথে নিশাত আর শাহনাজ বানু দাঁড়িয়ে আছে। সকাল তখন ৮:৪৫ বাজে।ওখানে যেতেই নিশাত বললো, ইমার্জেন্সির ডাক্তার নাস্তা করতে গেছে।আর অন্য ডাক্তার ১০ টায় আসবে রাউন্ড দিতে।তার আগ পর্যন্ত আমজাদ আলীকে এখানেই রাখতে হবে বাইরে। পলক যে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে আসছিল সেই ডাক্তারের ডিউটি শেষ হওয়ায় তিনিও চলে গেছেন রোগী দেখবে না বলে।সরকারী হাসপাতালে যা হয় আর কি! পলক পুরোপুরি হতাশ। বাড্ড দিশেহারা লাগছে তার। কি করবে না করবে বুঝতে পারছেনা।

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনলো তিয়ান। তারপর ফোন বের করে কল করলো কাউকে। মিনিট পাঁচেক পরে পলকের কাছে এসে তাড়া দিল তাকে। বললো,
_পলক চলো।
_কোথায়? অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো পলক। _আংকেলকে বার্ডেমে শিফট করবো। আমার এক ফ্রেন্ডের বড় ভাই আছেন ওখানে। উনার সাথে কথা বলেছি আমি। উনি as soon as possible আংকেলকে নিয়ে যেতে বলেছেন। এখন চলো তাড়াতাড়ি। নিশাত আন্টিকে নিয়ে আসো। আমি বাইরে এম্বুলেন্স রেডি করতে বলছি। এসো। বলেই ওখান থেকে চলে গেল তিয়ান।

নিশাত আর শাহনাজ বেগম দুজনেই অবাক। ছেলেটা কে?আচমকা কোথায় থেকে এসে বলছে আমজাদ আলীকে অন্য হাসপাতালে নিবে। পলকে আর তাদের সবাইকেও চিনে। কে হয় ছেলেটা পলকের? মনে এসব প্রশ্ন জাগলেও খুব বেশি ভাবার সুযোগ ছিল না তখন।তাই, নিশাত শুধু জিজ্ঞেস করলো,”বুবু কে রে উনি? “সহসা ওমন পরিস্থিতিয়ে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলো না পলক। শুধু বললো,”ও তিয়ান”। তারপরেই ওর ফোনে কল এলো একটা। আননোন নাম্বার দেখে সেকেন্ড কয়েক দেখে চিনার চেষ্টা করলো নাম্বারটা । কিন্তু চিনলো না। তাও রিসিভ করলো কলটা। রিসিভ করে কিছু বলার সুযোগ পেল না সে। তার আগেই ওপাশ থেকে কলদাতা বললো,
_কোথায় তোমরা? আমি বাইরে ওয়েট করছি, তাড়াতাড়ি এসো। কথা আর গলার আওয়াজে বুঝলো যে তিয়ান কল দিয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিল পলক।
_হ্যাঁ,আসছি। বলেই তাড়া দিল মা আর বোনকে। এরপর আমজাদ আলীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ওখান থেকে।

এম্বুলেন্সে আমজাদ আলীর সাথে নিশাত আর শাহনাজ বানুকে পাঠিয়ে দিয়ে পলককে নিজের সাথে গাড়িতে নিয়ে নিল তিয়ান। শুরুতে পলক যেতে আপত্তি করলেও তিয়ানের চোখ রাঙানো আর মায়ের কথায় তার আপত্তি ঢপে টিকেনি। অগ্যতা বাধ্য হয়ে তিয়ানের সাথেই যেতে হলো তার। গাড়িতে যেতে যেতেই তিয়ান বললো,
_Don’t worry. There they have the best dr.s of this country . Uncle will get the best treatment & get well soon.

তিয়ানের কথার বিপরীতে কিছুই বলল পলক। চুপচাপ গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে রইলো। গতকাল থেকে বেশ ধকল গেছে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে এখন। পলকের কোন সাড়া না পেয়ে পাশ ফিরে তাকে দেখলো একবার তিয়ান। চোখমুখের অবস্থা বড্ড কাহিল। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। তাই আর বিরক্ত করলো না তাকে। চুপচাপ ড্রাইভ করে এম্বুলেন্সের পিছু পিছু হাসপাতালের দিকে গেল।

হাসপাতাল পৌঁছে তিয়ান নিজ দায়িত্বে ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে।তারপর চেকআপ আর যা যা টেস্ট প্রয়োজন ছিল সব করিয়ে এডমিট করালো আমজাদ আলীকে।যাবতীয় টেস্ট চেক আপের পর ডাক্তার বললেন হার্ট এ্যাটাক হয়েছে তার। কিন্তু,এটা দ্বিতীয় বারের মত। সম্ভবত ৩ বছর আগেই প্রথম বারের মত হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল।ওটা মাইনর হার্ট এ্যাটাক হওয়ায় বুঝতে পারেনি হয় তো। কিন্তু এবারেরটা বেশ সিরিয়াস। তাই রোগীর কন্ডিশন কিছুটা ক্রিটিকাল।রোগী এখনো সেন্সলেস। আইসিইউ রাখা হবে। আর ৭২ ঘন্টার আগে কিছুই বলতে পারবে না তারা।

ডাক্তারের কথা শুনে মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়লেন শাহনাজ বানু। প্রচুর কান্নাকাটি করছেন তিনি।নিশাত সামলানোর চেষ্টা করছে তাকে। পলক ডাক্তারের কথাগুলো ভাবছে।৩ বছর আগে অর্থ্যাৎ পলাশের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর যখন বাবা বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন তখনই কি তবে প্রথম এ্যাটাক হয়েছিল? অথচ তারা কেউ কিছুই বুঝতে পারেনি। আমজাদ আলী ডাক্তার দেখিয়েছিলেন কিন্তু।এ ব্যাপারে কিছু বলেনি তাদের। তারমানে তিনি জেনেও লুকিতে গেছেন? আর কিছু ভাবতে পারলো না পলক। কান্নায় ভেঙে পড়লো ওখানেই। তার জন্যই আজ আবার অসুস্থ হলো বাবা। বাবা এমনিতেই হাই ব্লাড প্রশারের রোগী। তার উপর গত রাতের কথাগুলো ইফেক্ট করেছে তাকে ভীষণভাবে। স্ট্রেস নিতে না পেরেই হয় তো এমন অবস্থা হয়েছে তার। পলককে কাঁদতে দেখে তিয়ান ভাবলো হয় তো বাবার এমন অবস্থা শুনে কাঁদছে সে। তাই তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করলো সে।
_পলক…কি করছো তুমি এটা? তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে আন্টি আরও বেশি স্ট্রেসড হয়ে পড়বেন। চুপ করো।
তিয়ানের কথায় পলকের কান্না থামলো না। তিয়ানও আর বাঁধা দিল না। কাঁদুক একটু। মন হাল্কা হবে। এদিকে নিশাত চুপচাপ দেখছে সব। তিয়ানকে সে চিনে না। পলকের সাথে তিয়ানের পরিচয় বা সম্পর্ক কি তাও জানে না। শুধু সকাল থেকে এই মানুষটাকেই দেখছে তাদের বাবার জন্য ছুটাছুটি করতে। তাদের সাহায্য করতে। আর এখন পলককেও সামলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু,কে এই মানুষটা? আর কেনই বা এত সাহায্য করছে তাদেরকে? নিশাতের প্রশ্ন তার মনেই রয়ে গেল। এই মূহুর্তে এসবের উত্তর দেবার মত কেউ নেই।পরে সময় সুযোগ বুঝে পলককে জিজ্ঞেস করতে হবে।

এখন বিকেল ৫ টা বাজে। সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে কারও কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। আমজাদ আলীকে আই.সি.ইউ তে শিফট করা হয়েছে। ওখানে নার্স আর ডাক্তার ছাড়া বাইরের কারও প্রবেশ নিষেধ। তাই হাসপাতেলে এত মানুষ থাকার কোন প্রয়োজন নেই। এসব ভেবেই তিয়ান পলককে বললো,
_পলক উঠো। ক্যান্টিনে যাই চলো। তোমাদের সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি হয় তো। এখন কিছু খেয়ে নিবে চলো। আর আন্টি আর নিশাতকে বলে বাড়ি পাঠিয়ে দাও। রাতে এত মানুষ থাকার প্রয়োজন নেই এখানে।

তিয়ানের কথায় ওর মুখপানে একবার চাইলো শুধু।তারপরেই মুখ ফিরিয়ে নিল। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল নিশাত আর শাহনাজ বানুর কাছে। তাদের বুঝিয়ে নিয়ে গেল ক্যান্টিনে। যাওয়ার আগে ছোট্ট করে তিয়ানকেও বললো, এসো।

ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে জোর করে অল্প কিছুটা খাইয়ে নিল তিয়ান তাদের দুজনকে। কিন্তু পলক কিছুতেই কিছু মুখে দিল না। তার নাকি ভালো লাগছে না। তা দেখে তিয়ান নিজেও কিছু খেলো না। রাতের জন্য কিছু খাবার প্যাক করিয়ে নিল সে। তারপর পলককে বললো,
_আন্টি আর নিশাতকে নিয়ে যাচ্ছি আমি। বাসায় ড্রপ করে দিয়েই চলে আসবো। সাবধানে থেকো তুমি। আর কিছু লাগলে ফোন করে দিও।

তিয়ানের কথা শুনে শাহনাজ বানু বললেন,
_না..না বাবা। তোমার কোথাও যেতে হবে না। আমরা তিন জনই থাকবো এখানে। তুমি বরং বাসায় চলে যাও। সারাদিন অনেক কষ্ট করছো আমাদের জন্য।

_না আন্টি। আপনি আর নিশাত বাড়ি ফিরে যান। রাতে এখানে কাউকে এলাউ করে না। কিন্তু, আলিফ ভাইয়াকে বলে আমি ম্যানেজ করে নিবো। পলক থাকুক।আর আমিও থাকবো ওর সাথে। ওর অসুবিধা হবে না কোন। আপনারা বরং গিয়ে রেস্ট করুন কিছুটা। কাল সকালে আসবেন আবার।
তিয়ানের কথায় সায় দিয়ে পলক বললো,
_হ্যাঁ,মা। তোমরা বরং যাও এখন। আমি আছি এখানে।তারপর তিয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,
_তুমিও চলে যাও। সারাদিন অনেক করেছো। ধন্যবাদ। বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো।
পলকের এহেন এগুয়ে কথার পিঠে প্রতিবাদ করে নিশাত কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু তিয়ান চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিল। পলককে বললো,
_ওকে, ফাইন। তারপর নিশাতকে বললো, নিশাত আন্টিকে নিয়ে এসো। আমি গাড়ি বের করছি। বলেই চলে গেল ওখান থেকে। একটুপর নিশাত আর শাহনাজবানুও চলে এলো ওখান থেকে।

ঘন্টা দেড় পর হাতে দু’কাপ কফি নিয়ে পলকের সামনে এসে দাঁড়ালো তিয়ান। পলক তখন আই.সি.ইউ এর পাশের চেয়ারে বসা। মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবছে সে। দৃষ্টি ফ্লোরের সাদা টাইলসে নিবদ্ধ ছিল। হঠাৎ সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়ানো একজোড়া জুতোর দিকে চোখ পড়তেই মুখ তুলে চাইলো সে। সামনে গরম ধোঁয়া ওঠা কফির গ্লাস সমেত তিয়ানকে দেখতে পেল । তাকে দেখে শুকনো হাসলো তিয়ান। একটা কফির গ্লাস পলকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
_নাও,ধরো।
পলক কিছু বললো না। চুপচাপ কফির গ্লাসটা হাতে নিল। পলক গ্লাসটা হাতে নিতেই আরেকটা গ্লাস নিয়ে পলকের পাশে গিয়ে বসলো তিয়ান। পাশের খালি সিটে রাখলো নিজের গ্লাসটা। তারপর ব্লেজারের পকেট থেকে এক প্যাকেট কেক বের করে এগিয়ে দিল পলককে। বললো,

_একেবারে খালি পেটে কফি খাওয়া ঠিক হবে না। দুই এক পিস কেক খাও আগে।

পলক অবাক তিয়ানের কাজ কর্মে। এতক্ষণ চুপ করে সব দেখলেও এবারে আর চুপ রইলো না সে।মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
_আবার কেন এসেছো তুমি? বলেছিলাম তো আমি সব ম্যানেজ করে নিবো। সারাদিন যতটা হেল্প করেছো ইনাফ ছিল। আর কিছু…
_তুমি এখন আর আমাকে বন্ধু নাই ভাবতে পারো পলক,কিন্তু আমি এখনো তোমাকে নিজের বন্ধু মানি।সেই সাথে নিজের খুব কাছের একজনও। তাই তোমার জন্য কিছু করতে বা বলতে আমার আগে যেমন তোমার কোন পারমিশনের প্রয়োজন হতো না তেমনি এখনো হয় না। আর সব কিছুর আগে পরে আমরা বন্ধু থাকবো আজীবন.. এটা তুমিই বলেছিলে। এখন তুমি সব ভুলে যেতে পারো কিন্তু আমার কাছে সব আগের মতই আছে। তাই বাড়তি কোন কথা বা তর্কে যাবা না। চুপচাপ খাও এখন।

তিয়ানের এসব কথার পরে আর কিছুই বলতে পারলো না পলক। চুপচাপ হাত বাড়িয়ে নিল কেকের প্যাকেটটা। তিয়ান মাত্রই কফিতে চুমুক দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই কেকের প্যাকেটটা খুলে তার সামনে ধরলো পলক। বললো,
_সারাদিন তোমারও কিছু খাওয়া হয়নি।খালি পেটে কফি খাওয়াটা ঠিক হবে না।
পলকের কথা শুনে তার মুখের দিকে চাইলো তিয়ান। চোখ মুখে ক্লান্তির গভীর ছাপ। কিন্তু মুখের ভাব নির্বিকার। তা দেখে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো তিয়ান। এক পিস কেক তুলে নিয়ে পলককে ইশারা করলো খেতে।

রাতে একপ্রকার জোর করেই ক্যান্টিন থেকে অল্প বিস্তর খাইয়ে এনেছে তিয়ান পলককে। তারপর থেকেই এভাবে চুপচাপ বসেছিল তারা আই. সি. ইউ এর সামনে। আর তখনই তিয়ান বললো,
__আমি ভেবেছিলাম আগের থেকে শক্ত হয়ে গেছো তুমি।কিন্তু তুমি তো..

____________________________________

বর্তমান,

কিছু মূহুর্ত ওভাবেই কাটলো। দুজনের দৃষ্টি দুজনের ওপর স্থির।তিয়ানের মুখে রহস্যময় হাসি আর পলকের চোখ মুখে জুড়ে সে রহস্যভেদ না করতে পারার বিচলতা। খানিকবাদে তিয়ান আরেকটু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
_কি দেখছো পলক?
পলকের ঘোর কাটলো তিয়ানের প্রশ্নে।চকিতেই মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যপাশে। তারপর, গম্ভীর স্বরে বললো, “কিছু না”।
তিয়ান আবারও হাসলো ।তবে এ হাসি স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের হাসি। সেটাও তার নিজের প্রতি। পলক নামের এই মেয়েটার সাথে প্রতারণা করার শাস্তিসরূপ এই তাচ্ছিল্য তার প্রাপ্য বলেই সে মেনে নিয়েছে। ঠিক সেদিন থেকেই যেদিন সিফাতের সামনে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছিল “বন্ধুও বলতে পারেন” বলে। কিন্তু,এভাবে বললেই কি বন্ধুত্বটা শেষ হয়ে যাবে?তাদের ভালোবাসাটা প্রেম নাম পাওয়ার আগে বন্ধুত্বের ছিল।প্রেমের সম্পর্কটা নাম না পেলেও বন্ধুত্বটাও কি নামহীন হয়ে গেছে? আদৌ হয় কি কখনো?! তিয়ানের রায়ে সেটা “একেবারেই না”। কিন্তু,পলকও কি সেটাই ভাবে? ভেবে পায় না তিয়ান। ফলাফল বুকচিরে বেরিয়ে আসে আজীবনের এক ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস।

চলবে…