ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-৩১+৩২

0
388

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_৩১
©জারিন তামান্না

সকাল থেকেই নানান মানুষের আগমনে, কথার গুঞ্জনে মুখোরিত ফার্ম হাউজ।কারণ, আজ পলক আর সিফাতের গায়ে হলুদ।শাহনাজ বানু নিশাতকে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেছেন কিন্তু তার কোন পাত্তা নেই। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। এতবড় বাড়িতে সহজে কাউকে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল।তাই হলুদের বাটি নিয়ে তিনি নিজেই ছুটলেন পলকের ঘরের দিকে।

পলকের ঘরে পৌঁছেই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন শাহনাজ বানু।মিলি, নাজিয়া, নিশাত বসে দিব্বি আড্ডা দিচ্ছে।আর ওদিকে উনি ডেকে ডেকে হয়রান হয়েও কাউকেই পেলেন না। মেজাজ খিঁচে গেল তার। চেঁচিয়ে বললেন,
_এই তোদের আক্কেল বলে কিছু নাই? বলি এইটা যে বিয়ে বাড়ি সেটা খেয়াল আছে কারো? আমি একা হাতে সব করতে করতে হিমশিম অবস্থা আর তোরা এইখানে বইসা গল্প করতেছিস! আর সাজি কই? ওর যে আজ গায়ে হলুদ সেইটা কি মনে আছে তার??

শাহনাজ বানুর এমন ভয়ানক ঝাড়ি খেয়ে তটস্থ হয়ে গেল সবাই। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে গেল সবাই। মিলি আমতা আমতা করে বললো,
_ইয়ে..মানে..চাচী,বুবু তো প্রাপ্তিকে খাওয়াতে নিয়ে গেছে। বললো,প্রাপ্তিকে গোসল করায়া আসবে একেবারে।
মিলির কথা শুনে খেঁকিয়ে উঠলে শাহনাজ বানু। বললেন,
_ওই হতিচ্ছাড়ির আর জ্ঞান বুদ্ধি হইলো না। অথচ আজ গেলে কাল বিয়ে করে চলে যাবে এই মেয়েটা। এই নাজি বলি,তোর তো এইটুকু জ্ঞান করা উচিৎ ছিল যে ওর হলুদ একটু পরে। মিলি তুই যা তো মা, প্রাপ্তিকে খাওয়া। আর সাজিরে পাঠা রেডি হইতে।
_হ্যাঁ,,চাচী যা…যাইতেছি। বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে। পলাশের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

মিলি গিয়ে দেখলো নিশাত প্রাপ্তিকে খাওয়াচ্ছে। তা দেখে তাকে তাড়া দিয়ে বললো,
_বুবুউউ,,,তুমি যাও এখন। চাচী খুব বকাঝকা করতেছে। রেডি হও যাও।
_হ্যাঁ,,যাবো। প্রাপ্তিকে খাওয়ানো শেষ প্রায়। ওরে গোসল করাবো তারপরে। একেবারে রেডি করে রেখে যাই ওরে। পরে সময় পাই না পাই।
_না,,তুমি যাও। বাকিসব আমি করে দিবো। যাও এখন প্লিজ। নয় তো চাচী আবার বকবে।
মিলির আকুতি মিনতিতে পলক যেতে বাধ্য হলো। আর মিলি খাবারের বাটিটা নিয়ে প্রাপ্তিকে খাওয়ানোর চেষ্টায় লেগে গেল।

প্রাপ্তিতে খাইয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছে মিলি।টাওয়াল দিয়ে ওর মাথা মুছে দিতে দিতে এটা সেটা নিয়ে কথা বলছিল সে। তখনই ঘরে ঢুকতে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে গেল পলাশ। দূর থেকেই দেখলো কতটা যত্ন করে প্রাপ্তিকে লোশন লাগিয়ে জামা পড়িয়ে তৈরী করে দিল মিলি। তারপর, এটা সেটা বলে তার সাথে খেলছে। মিলি এসেছে পরে থেকেই প্রায় সময় এমনটা দেখছে পলাশ।খুব করে আগলে রাখছে প্রাপ্তিকে। মিলি প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুখেই দরজায় পলাশকে দেখতে পেল। কাজের দৌড়াদৌড়িতে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে মানুষটা।তাকে দেখে মিলি জিজ্ঞেস করলো,
_তুমি এখানে? কিছু লাগবে?
_এইটা আমার ঘর মিলি। বাইরে থেকে এলাম। রেডি হবো। সাজির হলুদ শুরু হবে একটু পরে।
_অহ,হ্যাঁ। আমার খেয়াল ছিল না আসলে।তুমি যাও। আমি যাচ্ছি প্রাপ্তিকে নিয়ে।
_হু যা।

মিলি বেরিয়ে যেতেই বাথরুমে ঢুকে গেল পলাশ। গোসল সেরে বেরোতেই দেখলো সার্ভেন্ট হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পলাশ অবাক হলো বেশ। কারণ সে তো বলেনি শরবতের জন্য। তাহলে কে বললো? ভাবে পেলে না সে। তাই সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,
_মিলি ম্যাডাম দিতে বলেছিলেন।
পলাশ অবাক হলো। তারপর কি যেন একটা ভেবে মুচকি হেসে হাতে নিল শরবতের গ্লাসটা।

__________________________________

ছাদে একটা জায়গা জুড়ে বিশাল স্টেজ করা হয়েছে। কিন্তু স্টেজের মাঝ বরাবরই হালকা নেটের পর্দা দিয়ে পার্টিশন করে দু ভাগ করা হয়েছে। প্ল্যান অনুযায়ী সিফাত আর পলকের হলুদ একই সাথে একই জায়গায় হবে। হলুদ আর সাদার কম্বিনেশনে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে স্টেজসহ পুরো ছাদটা। নানারকম রঙ বেরঙের ফুলের গন্ধে সুবাসিত হয়েছে পুরো ছাদ,বাড়ি।বসন্তের মৃদুমন্দ হাওয়া আর ঝলমলে সকাল মুখোরিত করে রেখেছে পরিবেশ। বেলা ১০ টায় হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা। এখন বাজে বেলা ৯’৪৮ মিনিট। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। সিফাত আগেই তৈরী হয়ে চলে এসেছে ছাদে। পড়নে তার পলকের পছন্দ করা সাদা আর কুসুম হলুদের পাঞ্জাবীটা।তার একটু পরেই মাথার উপর সামিয়ানা ধরে পলকের তিনভাই আর কবির মিলে ধীরে ধীরে নিয়ে এলো পলককেও।পড়নে তার সিফাতের পছন্দ করা কুসুম হলুদ আর অফ হোয়াইটের শাড়িটা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত নানান ফুলের হালকা ডিজাইনের বিভিন্ন গয়না দিয়ে সাজানো হয়েছে তাকে। সিফাত মুগ্ধ, মাতাল..ঘোর লাগা নয়নে দেখছে তার মৃন্ময়ীকে। কি অপূর্ব লাগছে তাকে! সে যতটা কল্পনা করেছিল,তার থেকেও বেশি মানিয়েছে শাড়িটা তাকে। সিফাতের মনে হলো যেন ভিজে মাটির আগে ঝলমলে সোনা রাঙা রোদ্দুর এসে জুড়ে বসেছে।আস্ত মায়াবতী লাগছে তার মৃন্ময়ীকে । দু বাড়ির তত্ত্ব দেখার পর সবাই অবাক হয়েছিল পলকের আর সিফাতের পছন্দ এক হওয়ায়। অনেকে তো মুখে মুখে বলেই দিয়েছে,,তারা রাজযোটক। এই জন্যই এত মনের মিল তাদের।

পলক আসতেই দুবাড়ির হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল।
সিফাত আর পলককে একই স্টেজে পাশাপাশি বসিয়ে হলুদ লাগানো হচ্ছে। কিন্তু,মাঝে সাদা নেটের পর্দা দেওয়ায়..না সিফাত আর না পলক,,কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে ঠিক মতো।দুই পরিবারের সবাই এক এক করে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে সিফাতকে।সেই সাথে এক এক করে বাকি সবাইও হলুদ ছোঁয়ালো তাদের।অভিনন্দন ও শুভ কামনা জানালো নতুন জীবনের জন্য। রুকু, ইয়ানা মিলে খুব করে হলুদ মেখেছে সিফাতের হাতে, গালে। বাদ যায়নি পলকও। প্রত্যেকেই সিফাতকে ছোঁয়া হলুদ নিয়ে পলককে ছুঁয়ালো। এটা দেখে সিফাত বললো,
_ আরে…সবাই আমাকে লাগানো হলুদ মৃন্ময়ীকে কেন লাগাচ্ছে? উনার সামনেও তো হলুদের বাটি রাখা!
সিফাতের কথা শুনে মিসেস. রেহানা বললেন,
_বরের ছোঁয়ানো হলুদ কনেকে ছোঁয়াতে হয় রে বাবা!
এতে স্ত্রী স্বামীর স্পর্শ, ভালোবাসা নিজের শরীরে মাখে,তার হবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে বলে বলা হয়।তাই তোর হলুদ পলককে ছোঁয়ানো হচ্ছে। (গল্পের স্বার্থে একপ্রকার কাল্পনিক সংস্কার)
_অহ আচ্ছা।Quiet interesting!তারপর, রুকুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_এই আপা,, আবার হলুদ লাগা তোরা আমাকে। আর এবার মৃন্ময়ীকে লাগানো হলুদ লাগাবি। মৃণ্ময়ী একা কেন শুধু ভালোবাসা গায়ে মাখবে, আমি কি দোষ করেছি। নে লাগা হলুদ।
সিফাতের এহেন কথা আর বাচ্চামোতে হাসির রোল পড়ে গেল ওখানে।ভাইয়ের এমন আহ্লাদে সারা মুখ ভেঙিয়ে চলে গেল অন্য দিকে। আবিদ গেল তার পিছু পিছু। দিহান মজা করে বললো,
_আরেএএ শালাসাহেব…আমি তো ভেবেছিলাম ভালোবাসার ‘ভ’ও বোঝেন না আপনি। তাই জন্য জীবনের এতগুলো সময় একা পার করেছেন কোন নারী সঙ্গ ছাড়াই। আর এখন তো দেখছি আপনি আমার আর আবিদের থেকেও বেশি রোমান্টিক! -তার কথায় আরেকদফা হাসির রোল পড়ে গেল ওখানে। আর তার কথায় হাসতে হাসতেই সিফাত বললো,
_যার জন্য স্বয়ং মৃন্ময়ী অপেক্ষায় ছিল, সে অন্য কোন নারী সঙ্গে কি করে জড়াতো বলুন তো ডিয়ার দুলাভাই! আমার এই দীর্ঘজীবনের নিঃসঙ্গতার সাধনার প্রাপ্তিই তো আমার মৃন্ময়ী! বলেই পাশ ফিরে পর্দার আড়ালে পলকের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো সে। তার সে হাসিতে ছিল পরিপূর্ণতার পরিতৃপ্তি! কিন্তু পলক মাথা নীচু করে রেখেছে। তাই তার মুখটাও ঠিক মত দেখা হলো না সিফাতের।

সিফাতের কথায় সবাই মুগ্ধ। সবাই খুশি মনে হাসছে। শুধু হাসি নেই পলকের মুখে। তার দু চোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে কাজলকালো নোনাজল।
_________________________________

সিফাতের কথামত তাকে আরও একবার হলুদ লাগানো হলো। পলকের গায়ে ছোঁয়ানো হলুদ। সবাই যার যার মতো হলুদ ছোঁয়ালো তাদের দুজনকে। কেবল তিয়ান ছাড়া।কিন্তু,শেষ পর্যন্ত বেশ হৈ হুল্লোড় আর হাসি আনন্দেই হলুদের অনুষ্ঠানটা শেষ করা হলো। হলুদ শেষ হতেই সিফাত ও পলককে পাঠানো হলো গোসলের জন্য। পলকের ঘরটা দোতালায় দেওয়া হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে লম্বা করিডোর ধরে কিছুটা ভিতরের দিকে ঘরটা। পলক যখন ঘরে যাচ্ছিল আচমকা তার হাত ধরে টেনে আঁড়ালে নিয়ে গেল কেউ। আচমকা টানে টাল সামলাতে না পেরে উক্ত ব্যক্তিটির বুকে গিয়ে পড়লো পলক। জামা আঁকড়ে ধরলো ব্যক্তিটির। পলকের হাতে লেগে থাকা হলুদ লেগে গেল ব্যক্তিটির গায়েও।পলক ধাতস্ত হওয়ার আগেই খানিক ফিসফিসিয়ে কন্ঠে বলা ব্যক্তিটির কথা শুনতে পেল পলক।
_এভাবেই সারাজীবন আঁকড়ে ধরে রাখবে আমায়, পলক?
গলার অয়ওয়াজেই পলক বুঝে গেল এটা তিয়ান। আর সেটা বুঝতেই চট করে ছেড়ে দিল তিয়ানের খাঁমচে ধরা পাঞ্জাবীর অংশটুকু।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বললো, কি শুরু করেছো তুমি তিয়ান! কাল রাতেও বলেছি তোমাকে,আর এখনো বলছি,,,তুমি যা চাইছো সেটা আর সম্ভব না এখন। নিজেকে শক্ত করো। বলেই সেখান থেকে চলে আসার জন্য পিছন ফিরতেই তাকে পিছন থেকে জাপটে ধরলো তিয়ান। পলকের পেটে একহাত দিয়ে চেপে ধরে মিশিয়ে নিল নিজের সাথে। তিয়ানের এহেন কাজে রাগ করে পলক কিছু বলতে যাচ্ছিল তাকে,তখনই তার বাহুতে ভিজে কিছুর অনুভব হতেই সেখানে তাকালো সে। তিয়ান নিজের মুঠো ভরা হলুদ নিয়ে ধীরে ধীরে পলকের বাহুতে লেপ্টে দিয়েছে। তিয়ানের এহেন স্পর্শও বড্ড রুক্ষ ঠেকলো পলকের কাছে। হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে পলকে বললো,
_যেটা সম্ভব নয়,,সেটা অসম্ভব কিছুও নয় পলক।তুমিই তো বলেছিলে,একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগে ভাগ্যও একটা শেষ সুযোগ দেয় আমাদের। আমরাই কেবল সেই সুযোগটা ছেড়ে দিয়ে চলে যাই। একবার সেই ভুল করতে বাধ্য হয়েছিলাম,,,এবার আর নয়!
পলক কিছু বলতে পারলো না,,কেবল কয়েক ফোঁটা নোনা বিসর্জন দেওয়া ছাড়া।

_আমার গায়ে তো তুমিই হলুদ ছোঁয়ালে। নাও,এবার তোমায় হলুদ ছোঁয়ানোটাও হয়ে গেল। সেটাও আমার হাতে আর আমারই ছোঁয়া! তিয়ানের বলা এই কথাটায় রীতিমত শিউরে উঠলো পলক। দ্রুত হাতে তিয়ানের হাতের বাঁধন আলগা করে ছুটে চলে গেল ওখান থেকে।
___________________________________

নিজের ঘরে ঢুকেই সরাসরি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো পলক। আয়নার তাকিয়ে দেখলো নিজেকে। সারা গায়ে হলুদ লেগে আছে তার। এই হলুদে মিশে আছে সিফাতের অস্তিত্ব আবার তিয়ানেরও। কি হচ্ছে তার সাথে এসব! সব তো ঠিক ছিল।তিয়ানও মেনে নিয়েছিল তাদের ভাগ্য..তাদের বিচ্ছেদকে। তাহলে এখন কেন আবার নতুন করে এমন পাগলামো করছে সে!

_মৃন্ময়ী!

পলকের মাঝে যখন এতসব চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে আসা ঘোর লাগা কন্ঠের ডাকে থমকে গেল সে। আয়নায় তাকিয়ে দেখলো বিছানায় সিফাত বসা। চকিতেই পেছন ফিরে তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো সে।ভীষণ রকম শান্ত দেখাচ্ছে সিফাতকে। এভাবে তাকে দেখে বেশ ভয় পেল পলক।এই মূহুর্তে তার উপস্থিতি মোটেও কাম্য ছিল না পলকের। তাছাড়া তার ঘরে আসতে গেলে তো করিডোর পেরিয়ে আসতে হয়,আর একটু আগে সেখানেই তিয়ান তাকে…!আচ্ছা,,সিফাত কি দেখেছে কিছু?তার জন্যই কি পলকের কাছে এসেছে?এটুকু ভাবতেই ভেতর ভেতর ভয়ে গুটিয়ে গেল সে। পলকে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সিফাত। তারপর শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
_কই ছিলেন এতক্ষণ?
_আআআ…মি..
_হ্যাঁ,আপনি। কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? বলতে বলতেই পলকের দিকে এগিয়ে আসছিল সিফাত। সেটা দেখে অস্থিরতা বেড়ে গেল পলকের। মনে মনে ভয় পাচ্ছে ভীষণ।সিফাত কি তবে জেনে গেল সবটা? ভুল বুঝলো তাকে?
_নীচে থেকে এ ঘরে আসতে এত সময় তো লাগার কথা নয় আপনার। আপনি জানেন সেই কখন থেকে এখানে বসে আছি আমি? বলতে বলতেই খুব কাছে এসে দাঁড়ালো সে পলকের।
_ক্যা..এএএ…কেন?
_আপনার অপেক্ষায়। ঘোর লাগানো কন্ঠে বললো সিফাত।তার চোখে মুখে অদ্ভুত ঘোর। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে সে, তার হলুদ রাঙা মৃন্ময়ীকে। সারা মুখে, হাতে হলুদ লেপ্টে আছে তার। ভিজে মাটির গায়ে আড়ছে পড়া সোনালী রোদ্দুরের মত ঝলমল করছে এ হলুদ তার মৃন্ময়ীর শরীরে। তারপর ড্রেসিং টেবিলের উপর এক হাত রেখে দাঁড়ালো সে পলকের মুখোমুখি। ধীরে ধীরে আরও কাছে এগিয়ে যেতে থাকলো সে পলকের। সিফাতকে এভাবে কাছে আসতে দেখে পিছিয়ে যেতেই ড্রেসিং টেবিলের সাথে ঠেকে গেল সে। পেছানোর আর জায়গা না পেয়ে পেছনের দিকে ঝুঁকে গেল খানিকটা। তার চোখে মুখে ভয়,,বিভ্রান্তি। সিফাত কি করতে চাইছে বুঝতে পারছে না সে।পলক যত পেছনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল সিফাতও ঝুঁকে আসছিল তার মুখের দিকে। একটা সময় সিফাতকে নিজের খুব কাছে অনুভব করলো পলক।পলকের নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে ক্রমশ। সিফাতের তপ্ত নিশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে তার সারা চোখ মুখে। সিফাতের চোখে মৃন্ময়ীর ঘোর।আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো পলক। সিফাত আবারও মুগ্ধ হয়ে দেখলো তার মায়াবতী মৃণ্ময়ীকে। তার চোখ মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো প্রশান্তির হাসি। পলকে ওই অবস্থায় দেখে মৃদু হাসলো সিফাত। তারপর পলককে ছাপিয়ে তার পেছনে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা হলুদের বাটিটা হাতে তুলে নিল সে। পলকের ভয়ার্তক মুখটা দেখে আবারও হাসলো খানিকটা আলতো করে।

একটা সময় পর নিজের কাছাকাছি সিফাতের উপস্থিতি টের না পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইলো পলক। আর তারপরেই নিজের পায়ে কারো স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলো পলক।চট করেই চাইলো নীচের দিকে।

ফ্লোরে নীচু হয়ে বসে আছে সিফাত। তার দুহাতে হলুদ। সেই হলুদ নিয়ে আলতো করে ছুঁইয়ে দিলো শাড়ির ফাঁক গেলে বেরিয়ে থাকা পলকের পায়ে। হলুদ ছুঁইয়ে দিয়েই পলকের মুখপানে চাইলো সিফাত।তার মুখে ভর করে আছে রাজ্যের সুখানুভূতি। আর পলক বিস্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে সিফাতের ওই হাসি হাসি সুখী মুখখানির দিকে।পলকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি হাসি মুখেই সিফাত বললো,
_এই হলুদ রাঙা স্নিগ্ধ পায়ে আমার জীবনের চৌকাঠে আপনাকে স্বাগতম, মৃন্ময়ী! শুভ হোক আপনার নতুন জীবনের পথচলা।- বলেই তার ভুবনভুলানো হাসিখানা হাসলো সে পলকের মুখপানে চেয়ে।

বিস্মিত আর হতবাক নয়নে তাকিয়ে পলক দেখলো সেই হাসিখানা। কিন্তু,সিফাতের কথা বা কাজের বিপরীতে সহসা কিছুই বলে উঠতে পারলো না সে।স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। তাকে ওভাবে চুপ করে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়ালো সিফাত। পলক রোবটের মত চেয়ে দেখলো সেই দৃশ্যটুকুও। কিন্তু,তাও মুখে কিছুই বললো না সে। সিফাতও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো পলকের সামনে। পলকের কিছু বলার অপেক্ষায়। কিন্তু,পলক নির্বাক।চোখ টলমল করছে তার।কিছুটা সময় নিরবেই গেল তাদের। তারপরও পলককে এভাবে চুপ থাকতে দেখে এবার সিফাত বললো,
_সারা গায়ে হলুদে মাখামাখি হয়ে আছে। যান, গোসল সেরে নিন। বলেই পলকের কোন কিছু বলার অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেল সে। নির্বাক দর্শকের মত চেয়ে সেটুকু দেখলো পলক। যতক্ষণ না সিফাত তার চোখের আড়াল হলো পলক তাকিয়ে দেখলো তাকে। সিফাত চোখের আঁড়াল হতেই ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফিরিয়ে একবার তার পায়ের দিকে চাইলো পলক। সেখানে সিফাতের ছোঁয়ানো হলুদ লেগে আছে। সেটা দেখে পলকের কি যেন হলো। ধপ করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো ফ্লোরে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে। বড্ড অসহায় লাগছে তার। প্রথম ভালোবাসা নাকি কখনো ভোলা যায় না।তিয়ানকে সে ভালোবাসে এখনো…এ কথা যতটা না সত্যি ঠিক ততোটাই সত্যি এটাও যে সিফাতকে উপেক্ষা করাটাও তার জন্য অসম্ভব এখন!

___________________________________

মেহন্দি হে রাচনেওয়ালী
হাতো মে গেহরী লালী
ক্যাহে সাখিয়া আব কালিয়া
হাতোমে খিলনেওয়ালী হে
তেরি মানকো জীভানকো
ন্যায়ী খুশিয়া মিলনেওয়ালী হে..

ছাদে এরেঞ্জ করা স্পিকারে গান বাজছে। গানের তালে তালে মেতে উঠেছে সব মেয়েরা। হলুদের জন্য করা স্টেজটাতেই পলককে মাঝে বসিয়ে তার দু পাশে বসে হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে মিলি আর নিশাত। নাজিয়া রুকুর হাতে মেহেদী লাগাচ্ছে। বিথি লাগাচ্ছে রিয়া দিয়ার হাতে।এই দুই বোনকে নিয়ে হিমশিম অবস্থা তার। দুজনেই দুজনের সাথে ঠুকাঠুকি লাগিয়েছে কে আগে দিবে এই নিয়ে। প্রথম প্রথম সহ্য করলেও পরে তার টমবয় ফর্মে ফিরে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে তাদের দুজনকে। এখন দুজন মুখ ফুলিয়ে বসে আছে বিথির সামনে আর বিথি এক হাত করে করে পালাক্রমে দুজনকেই মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে। কবির কিছুটা দূরে নোরাকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে আছে। সিফাত ছাদেই ছিল।রিহানের সাথে মিলে কালকের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করছে। পলাশ নীচে আছে। কালকের রান্নার জন্য কেটারারদের সাথে ব্যস্ত। বয়স্করা সব নীচে। কেউ কেউ বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত।কেউ কেউ মেতে উঠেছে খোশগল্পে। ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে স্মোক করছিল তিয়ান। রিহানের ফোন কল আসায় কোথায় যেন গেল সে। ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে তাতে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে সিফাতও স্টেজের দিকেই যাচ্ছিল।কিন্তু,তিয়ানকে এভাবে একলা এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেল সে। জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো চুপচাপ। তিয়ান একবার পাশ ফিরে দেখলো সিফাতকে। কিন্তু,কিছু বললো না। সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে তার ধোঁয়া ছড়িলে দিল বাতাসে। তার এমন উদাসিনতা দেখে সিফাত বললো,
_এখনো ভালোবাসো মৃন্ময়ীকে?
তিয়ান চমকালো না সিফাতের এহেন প্রশ্নে।বরং স্বাভাবিক স্বরেই জবাব দিল।
_হ্যাঁ,,খুব।
_কতদিনের রিলেশনশিপ ছিল তোমাদের?
_২’৫ বছর।
_আর ব্রেকআপ হয়েছে ৩ বছর!
_বাধ্য হয়ে করেছিলাম।পরিস্থিতির শিকার হয়ে ছাড়তে হয়েছে আমাকে আমার শ্যামকন্যাকে।
_যা হয় ভালোর জন্যই হয়। মৃন্ময়ী মুভ অন করে গেছে তিয়ান! আর এখন তুমিও..
_She still loves me. ও বাধ্য হয়ে করছে এই বিয়েটা।
_মৃন্ময়ী স্বেচ্ছায় করছে এই বিয়েটা।
_আচ্ছা,আমি যদি এখন নিজের জায়গাটা ফেরত চাই, অন্যায় হবে কি সেটা?
_খুউউউব। সিফাতের নির্বিকার জবাব।
_কিন্তু,আমি যে চাই পলক আমার হোক।
_সে তুমি চাইতেই পারো তিয়ান,কিন্তু মৃন্ময়ী তা চায় না।
_আর যদি পলক নিজেই চায় আমাকে?
_মৃন্ময়ী চায় না এমন।
_আপনি পলককে কি আমার থেকেও বেশি চেনেন ভাইয়া?
_অবশ্যই না। তবে তুমি যে পলককে চিনো সে ৫ বছর আগের আর আমি যে মৃন্ময়ীকে চিনি সে তোমার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার ৩ বছর পরের!
_৫ টা বছর ধরে ভালোবাসি আমি ওকে,আর আপনি..
_তোমার ভালোবাসাটা ৫ বছরের আর আমারটা ৫ মাসের। কিন্তু,তুমি যাকে ভালোবাসো সে তোমাকে ভালোবাসে না আর। সে এখন কেবলই আমার মৃন্ময়ী।
_পলক আমাকেই ভালোবাসে শুধু। আর আজও সে চায় আমাকে।
_তুমি মৃন্ময়ীকে ভুল বুঝছো তিয়ান।
_আর যদি আমি সঠিক হই,,পলক চায় আমার হতে তাহলে? কি করবেন আপনি তখন?
_well….সেক্ষেত্রেও আমি আমার তরফ থেকে ছাড়বো না মৃন্ময়ীকে। ইন ফ্যাক্ট আমি কখনোই কোন অবস্থাতে মৃন্ময়ীকে ছাড়তে পারবো না। তবে,যদি একান্তই সে চায় তোমাকে তাহলে আমাকে ঠকিয়েই তাকে তোমার হতে হবে।
_পলক আপনাকে ঠকালে সেটা মানতে পারবেন আপনি?
_পারবো। কষ্ট হবে,,তবে মনে সন্তুষ্টিও থাকবে যে, মৃন্ময়ী আমাকে ঠকিয়ে হলেও সুখী হতে পেরেছেন।
_বেশ,,তাহলে পলক আপনাকে ছেড়ে যেতেই পারে, তাই না?.
_উনি যাবেন না।
_আর যদি যায়?
_আমি যেতে দিবো।কারণ, মানুষ আর মুক্ত আকাশের পাখি,,জোর করে তো আর ধরে রাখা যায় না কাউকেই!কিন্তু,মৃন্ময়ী যাবে না জানি আমি। বলেই তিয়ানের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো সে।
_Overconfidence! -তাচ্ছিল্যের হাসিসমেত বললো তিয়ান।
_No…not actually. It’s called faith. & I trust my Mrinmoyi.
_That’s good…but still if she wanna come with me? যদি কাল বিয়েটা পলক আপনাকে নয়..আমাকে করে, তাহলে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সিফাত। তারপর বিষাদ ভরা কন্ঠে বললো,
_মৃন্ময়ী যেখানে সুখী সেখানে আমিও।সে যদি তোমাকে বেছে নেয়,তাহলে আমিও মেনে নেব সেটা।
_এত উদারতা?
_এটা ভালোবাসা। বুঝবেনা তুমি! বলেই আলতো হেসে তিয়ানের পিঠ চাপড়ে দিলো সে।তিয়ানও আলতো হাসলো।হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনে পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালো তারা।

_ ভাইয়া আপনি এখানে? আর ওদিকে আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান সব্বাই। রুকু আপা ডাকছে। চলুন..চলুন।হন্তদন্ত হয়ে বললো রিয়া দিয়া।
_এত জরুরি খোঁজ কিসের,ছোট বউরাণীরা??
_সাজিবুর হাতে মেহেদী দিয়ে আপনার নাম লেখা হয়েছে,,ওটা খুঁজে বের হবে আপনাকে। তাই খোঁজ চলছে। রিয়া দিয়া অস্থির গলায় জবাব দিল।

_আচ্ছা,ঠিক আছে। চলো। হাসতে হাসতে বললো সিফাত। তারপর তিয়ানকে বললো,
_চলো তিয়ান,অবিবাহিত বউ দেখে আসি আমার। বলেই সকৌতুক হাসলো সিফাত।
তিয়ান কিছু বললোনা,কেবল সিফাতের পিছু পিছু সেও গেল স্টেজের দিকে।
__________________________________

আজ পলকের বিয়ে।বিয়েতে আমন্ত্রিত সব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের আগমনে মুখোরিত পুরো ফার্ম হাউজ। সকাল থেকে একের পর এক মানুষ এসে ভীড় করছে পলকের ঘরে। তার সাথে কথা বলছে,,দিচ্ছে নানান পরামর্শও। কেউ কেউ বা এটা সেটা বলে রসিকতা করছে পলকের সাথে।তাদের কথা,পরামর্শ আর রসিকতার রসাতলে ডুবে রীতিমত বেলাহ অবস্থা পলকের। এরমধ্যেই নাজিয়া এসে তাড়া দিল সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। পলকের গোসল দেওয়া দরকার এখন। তারপর আবার রেডি হতে হবে। যদিও পার্লারে যাওয়ার তাড়া নেই কোন। সিফাত বলেছে পলককে কোন ভারী মেকআপ না দিতে। প্রতিটা অনুষ্ঠানে যেমন বাসায়ই সেজেছে তেমনই সাজবে। মৃন্ময়ীকে তার ন্যাচারাল লুকেই ভালো লাগে। তবুও,,বিয়ে বলে কথা! সাজতে কিছুটা সময় তো লাগবেই আজ। তাই ঘর খালি করে পলককে গোসলের জন্য পাঠালো নাজিয়া।

গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে রুমে এলো পলক। পড়নে তার খয়েরী রংএর একটা সুতি শাড়ি। চুল মুছে সামনে তাকাতেই হঠাৎ সে দেখলো তিয়ান দাঁড়িয়ে আছে ড্রেসিং টেবিলের কাছে। হাতে পলকের বিয়ের শাড়িটা। ওটায় হাত বুলিয়ে দেখছে।আয়নায় চোখ পড়তেই তিয়ানও দেখলো পলককে। আলতো হাসলো সে। অবাক নয়নে তাকিয়ে সে হাসিটা দেখলো পলক। তার কপালে কুঁচকে গেছে। এ সময়! সে একদমই আশা করেনি তিয়ানকে। পলককে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিয়ান শাড়িটা রেখে এগিয়ে এলো পলকের দিকে। মৃদু হেসে তার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে পাশের চেয়ারটার উপর রাখলো। আলতো হাতে পলকের হাত দুটো উল্টেপাল্টে দেখে বললো,
_বেশ গাঢ় রঙ হয়েছে মেহেদীর।
পলক চুপ। তাকে চুপ থাকতে দেখে তিয়ান বললো,
_আমায় বিয়ে করবে পলক? হবে আমার?
_তুমি কিন্তু এবার সত্যিই বাড়াবাড়ি করছো তিয়ান।
_মোটেও না। কেবল সুযোগ নিচ্ছি। ভাগ্যের দেওয়া শেষ সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছিনা জাস্ট।
_তুমি ভুল করছো তিয়ান।
_আমি আমার ভুলটাই ঠিক করতে চাইছি পলক।
_সেটা এখন আর সম্ভব না।
_তুমি চাইলেই সম্ভব, শ্যামকন্যা।
_আমি চাইলেও সম্ভব নয় তিয়ান। শুকনো হেসে বললো পলক।আর আলতো করে তিয়ানের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। ভেজা তোয়ালেটা হাতে নিয়ে বেলকোনির দিকে পা বাড়ালো।কিন্তু পলকের কথাকে পাত্তা না দিয়ে এবারে তিয়ান বললো,
_আর যদি ভাইয়া নিজেই চায় তুমি আমার হও, তখন?

থমকে গেল পলক। চমকে তাকালো সে তিয়ানের দিকে। তিয়ানের মুখে বিজয়ের হাসি।আর, পলকের চোখে বিস্ময় আর বিভ্রান্তি।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_৩২
©জারিন তামান্না

সন্ধ্যা ৭:০৩ মিনিট।

কাবিননামায় বরের সই নেওয়া হয়ে গেছে। কবুলও বলা হয়ে গেছে তার পক্ষ থেকে।এবার শুধু কনের সম্মতি নেওয়া বাকি। সে সই করে কবুল বললেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে।

এদিকে বাড়িতে বিয়ে তবুও পরিস্থিতি কিছুটা গোমট। আমজাদ আলী মুখভার করে রেখেছেন। নিশাত, পলাশও নারাজ। শাহনাজ বানু পড়েছেন বিপাকে।স্বামী আর সন্তানের মধ্যে।কোন একজনের পক্ষ তিনি নিতে পারছেন না। তার তো পুরো জগৎটাই এই স্বামী সন্তানদেরকে নিয়ে।তাদের মধ্যে কাকে ছেড়ে কাকে বেছে নেবেন এটা তার জন্যও অনেক কঠিন ব্যাপার। আর যদি সেখানে দুজনেই দুজনের জায়গায় সঠিক হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তাই দ্বিধাদ্বন্দে, মন খারাপ,কষ্ট, হতাশা সব মিলিয়ে তিনিও খুব একটা ভালো মানসিক অবস্থায় নেই। পলকের উপর প্রচন্ড রেগে আছেন আমজাদ আলী। তার এই মেয়েটা এমন কিছু করতে পারে, আজ দুপুর অবদি সেটা তার কল্পনাতীত ছিল। মেয়েটা যেমন তেমন সিফাতও পলককে এইভাবে সাপোর্ট করবে সেটাও তিনি ভাবতে পারেননি। কিন্তু,,সিফাতকে তিনি খুব স্নেহ করেন। নিজের ছেলের মত ভালোবেসে ফেলেছেন এই কয়েকদিনেই। ছেলেটাও তাকে কেমন বাবা বলে ডাকে।সব মিলিয়ে তার কথাটাই মূলত ফেলতে পারেননি তিনি। তাই পলকের এহেন কাজকেও মেনে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু,,মেনে নিলেও সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র খুশি নন তিনি। তবুও, সামাজিকতার খাতিরে আর বাবার দায়িত্ব হিসেবে সব নিয়মনীতি পালন করছেন তিনি।

পলকের থেকে বিয়ের সম্মতিসরূপ ৭ লক্ষ টাকা দেনমোহরে কবুল বলিয়ে নিয়েছেন কাজী সাহেবে। যার মধ্যে ৩ লক্ষ টাকা গয়না বাবদ আর বাকি ৪ লক্ষ টাকা নগদে পরিশোধ করা হয়েছে। পলক কবুল বলার পর পরই কাজী সাহেব নিজ হাতে সেই দেনমোহরের টাকা পলকের হাতে তুলে দিয়েছেন।বলেছেন, বরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যেন কবুল বলার সাথে সাথেই শরীয়ত মতে বরের ফরজ আদায় হিসেবে যেন এটা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু,কাজী সাহেব দেনমহরের পরিমাণ ঘোষণা করার পরপরই বেশ গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে।সবার মুখে একই কথা! এত ধনী পরিবারের বিয়ে হয়েছে, এত বড় ব্যবসায়, এত সম্পত্তি, বর নিজেই এত প্রতিষ্ঠিত , এত এত টাকা আয় করে, এত অর্থবিত্ত যাদের তারাই কিনা মাত্র ৭ লক্ষ টাকা দিলো দেনমোহরে? বিয়েটাও করছে কি সাদামাটাভাবে। একজন তো বলেই দিল,
_আরেএএএ এই মেয়ের জন্য এত টাকা কে দিবে বলো তো?

_হ্যাঁ,ঠিক বলছেন।তাছাড়া আর মেয়ের বাড়ির লোক তো কোন মতে মেয়েকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে তাই এত অল্প টাকায় দিয়ে দিল মেয়েকে। প্রথম ব্যক্তির কথায় সায় দিয়ে বললেন তার পাশের জন।
_শুনেছি মেয়ের আগে বিয়ে ভেঙেছিল।যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, সেই ছেলে এখনও জেলে। তারউপর মেয়ে দেখতে শ্যামলা। বরকে তো দেখলাম বেশ সুন্দর,,ফর্সা লম্বা।তার তুলনায় মেয়ে ভালোই খাটো। কি বুঝে এই মেয়েকে পছন্দ করলো কে জানে!

_আমার মনে হয় ছেলের কোন সমস্যা আছে। তাই এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করছে। নয় তো এত ধনী পরিবারের এত সুন্দর ছেলে মধ্যবিত্ত পরিবারের এমন একটা শ্যামলা মেয়ে বিয়ে করে কখনো?

কবুল বলার আগে খুব কেঁদেছে পলক।কিন্তু, কেউ তাকে থামানোর চেষ্টা করেনি। তার কান্না একদিকে যেমন খুশির তেমনি কষ্টেরও। পলক খুশি কারণ সে যা চেয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে। সে পেরেছে সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে মানুষটাকে নিজের করতে। আর এই মানুষটা পাশে ছিল বলেই, তাকে সাহস দিয়েছিল বলেই সে নতুন করে সবটা আগের মত সাজিয়ে দিতে পেরেছে। সে জানে পুরোনো জিনিস নিজের জায়গায় ফিরে এলে কিছুটা জড়তা,সংকীর্ণতা,দূরত্ব, মান অভিমান থাকেই।কিন্তু,,সময়ের সাথে ধীরে ধীরে সবটাই ঠিক হয়ে যায়। সবাই একসময় ঠিকই মেনে নিবে সবটা। স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু,,এই খুশির চাইতেও বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। এত বছরের পরিবার,,আপন মানুষ, সম্পর্ক সব কিছুকে ছেড়ে অন্য একজনের হয়ে,অন্য এক পরিবারে চলে যেতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু,যাওয়ার আগে সবাইকে এভাবে নারাজ করে যেতে হচ্ছে তার। তবে,,সে জানে যে যতই রাগ করুক…একদিন সবাই বুঝবে তাকেও। বুঝবে যে কেনো সে সব কিছু জেনে বুঝেও এমন একটা কাজ করেছে।

কিন্তু,,এত সব মানুষের এত সব বাজে কথা আর সহ্য হলো না পলকের। তাকে নিয়ে বলছে তো বলছেই,,এখন আবার বরকে নিয়েও এসব আজে বাজে কথা বলছে? অথচ এসবের প্রতিবাদে কেউ কিছুই বলছে না। এরা অন্যের বাড়ি এসে তাদের কথা শুনিয়ে যায় অথচ বাড়ির লোক কিছুই না বলে তাদের ভুলভাল কথাকেই পরোক্ষভাবে সায় দেয়। কি সমাজ আমাদের! নাহ,পলক আর চুপ করে থাকতে পারলো না। যে মানুষটার সাথে তার বাকি জীবনটা কাটাবে,,যে মানুষটা আজ থেকে তার হলো তাকে অন্য কেউ এভাবে ভুলভাল বলে অপমান করবে সে পলক কিছুতেই মানতে পারলো না। চোখ মুছে, কাবিননামায় সই না করেই নেমে গেল বিছানা থেকে। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

_আসসালামু আলাইকুম।আমার জীবনের এমন একটা মূহুর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাদের। তবে একটা কথা, আজকে আমার বিয়ে পড়ানো হয়েছে আমাকে,,,নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়নি। আর যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বিয়েটাও তিনিই করেছেন আমাকে। তার পরিবার নয়। তার জের ধরেই ওই পরিবারের অংশ হচ্ছি আমি।তাই দেনমোহরটাও একান্তই তার সামর্থ্য আর সুন্নতি নিয়ম অনুসারে ধার্য করা হয়েছে। সেটাও আমার কথায়। ইসলামে দেনমোহরকে স্ত্রীর অধিকার হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু,অধিকার কি জোরজুলুম বা কারও সামর্থ্যের বাইরে আদায় করা যায়? নাকি আদায় করা উচিৎ?

আপনারা তার অর্থ সম্পদ দেখছেন , সেই তুলনায় এই দেনমোহর খুবই সামান্য আমি জানি। এই অধিকার যার আদায় করার কথা তার সামার্থও এর থেকে বেশি। কিন্তু,এত বেশি দেনমোহর দিয়ে আমি কি করবো যেখানে একটা মানুষ তার গোটা জীবনের অংশীদার হিসেবে আমাকে অধিকার দিচ্ছে?স্ত্রী হওয়ার সম্মান দিচ্ছে,মর্যাদা দিচ্ছে। সামাজিকতার কথা ছাড়ুন,,ধর্মমতে লোক দেখানো কাজ হিসেবে অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য করাও নিষেধ করা হয়েছে। স্বামী যতটুকু দিতে সামর্থবান ততটুকুই দিতে বলা হয়েছে। আর সেটা আদায় করা আবশ্যকও বলা হয়েছে। আমার স্বামী নিজের ব্যক্তিগত সঞ্চয় সামর্থ থেকে আমার দেনমোহর পরিশোধ করেছে। তার পরিবারের অর্থ সম্পদ থেকে নয় । অর্থাৎ আমাদের বিয়ে, এই সম্পর্ক হালাল এখন থেকে।

আর তাছাড়া,বিয়েটা দুটো মানুষের মানসিক চাহিদা,সন্তুষ্টির একটা সম্পর্ক। আমরা দুজনই দুজনকে জেনেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। আমাকে আপনারা তার যোগ্য নাই বলতে পারেন,,কিন্তু উনি আমাকে আমার সবটা জেনেই গ্রহণ করেছেন, আর আমিও! তাই এই সম্পর্ক আর ওই মানুষটা যেমনই হোক, সবটাই আলহামদুলিল্লাহ।

আশা করি এখন এই নিয়ে আর কিছু বলার নেই আপনাদের। আমাদের সুখী সুন্দর জীবনের জন্য দো’য়া করবেন প্লিজ। আর এভাবে বলার জন্যও দুঃখিত।

_আআআআহ….এই মেয়ের তো দেখি খুব দেমাগ! ক্যামন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতেছে দেখো। আর আজকালকার মেয়েদের লাজ লজ্জা বলে কিছু আছে নাকি! আমরা হলে লজ্জায় মাথা তুলেই তাকাতে পারতাম না আর এ দেখো নতুন বউ হয়ে লাজ লজ্জা ভুলে কেমন কথা শোনাতে চলে এসেছে সবাইকে। পলকের কথা শেষ হতেই ঘরে উপস্থিত একজন প্রবীন মহিলা বললেন।

_নিজের জন্য বলার অধিকার তো সবারই আছে আন্টি। আর মেয়ে বলেই সব মিথ্যা অপবাদ, অপমান মুখ বুজে সহ্য করবে এমন ভাবার তো কিছু নেই। আপনারা তার বাড়ি এসে তাকেই অপমান করছেন,,তার হাজবেন্ডকে নিয়ে কথা বলছেন এভাবে.. সেটাই বা সে কেন শুনবে চুপচাপ?

আর কি যেন বলেছিলেন আপনি! সে আমার তুলনায় খাটো,শ্যামলা, বিয়ে ভেঙে গেছিল একবার..ব্লা ব্লা ব্লা..আজ ওর জায়গায় আপনার মেয়ে হলেও কি একই ভাবে ভাবতেন ব্যাপারটা? নাকি আপনিও চাইতেন আপনার মেয়েও সুন্দর,,ভালো কাউকে পাক জীবন সঙ্গী হিসেবে।শুনতে ভালো না লাগলেও এটাই সত্যি,, আপনি তেমনটাই চাইতেন। তাহলে সে কি দোষ করেছে? রূপ রঙ সবটাই আল্লাহর দান,,,কিন্তু স্বভাব চরিত্র আর মানসিকতা সবটাই মানুষের নিজের। আর আমিও তাকে এসব দেখেই আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে তাকে আমার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ।

তাই যে কোন কিছু বলার না ভাবার আগে,,সেই অবস্থানে নিজেকে বিচার করে দেখবেন একবার। তাহলে,,নেতিবাচকভাবটা কমে যাবে অনেকটাই।

বিয়ে বাড়িতে কিছু একটা নিয়ে বেশ গুঞ্জন চলছিল বুঝে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সদ্য নতুন বিবাহিত বরও।ঘরের কাছে এসে বাকি সব কথাও কানে গেছে তার।রাগ তারও হয়েছিল।তবে,পলককে ওভাবে বলতে দেখে নিজে থেকে আর কিছুই বলেনি তখন। কিন্তু, শেষ এপর্যন্ত পলককে নিয়ে এভাবে বলায় আর চুপ থাকতে পারেনি সে।তাই ঘরে ঢুকে উক্ত কথাগুলো বলেছে। পলকের কথা পরে সবাই মোটামুটি চুপ হয়ে গেলেও বরের বলা কথার শেষে এসব নিয়ে আর কারও কিছু বলার রইলো না।

_তুমি একদম ঠিক বলছো বাবা। বিয়ে তো রিজিকের ব্যাপার। আর আল্লাহ তোমাদের মন মানসিকতাও এক রকম কইরাই মিলায় দিছে। তোমরা নিজেরা খুশি থাকলেই হইলো। একজন বয়স্ক লোক বললো।
_জ্বী চাচা, দো’য়া করবেন। বলেই মিষ্টি করে হাসলো সে।

___________________________________

কাবিননামায় পলকের সই নেওয়া হলো। সই শেষে মোনাজাত করে ওদের নতুন জীবনের জন্য দো’য়াও করা হলো। মেয়ের উপর রাগ করে থাকলেও দোয়া করতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন আমজাদ আলী। কাঁদলো বাকি সবাইও। তবে তাদের এই কান্নার পুরোটাই ছিল আনন্দের।আবার কিঞ্চিৎ কষ্টেরও।

বিয়ে শেষে খুরমা খেজুর দেওয়া হলো সবাইকে। তারপর সবাই নতুন বর কনেকে নিয়ে গেল নীচতলার বিশাল হল রুমে। দুজনকে পাশাপাশি বসানো হলো বাদবাকি আচার অনুষ্টানের জন্য। প্রথমে বর বউয়ের মুখ দেখার পালা। তাই, নিশাত বড় একটা আয়না এনে বর কনের মাঝে সামনাসামনি রাখলো। বরকে উদ্দেশ্য করে পলকের মামী বললেন,
_শোনো বাবা! সামনে আয়না ধরার পরে তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে আয়নায় কি দেখো! তুমিও বলবা যা দেখতে পাবা,,কেমন?
_জ্বী,মামী।

তারপর সবাই একরকম ঘেরাও করে ধরলো নতুন বর কনেকে। নিশাত আয়না সামনে ধরতেই বরকে জিজ্ঞেস করা হলো,
_আয়নায় কি দেখা যায়? আসমানের চাঁন নাকি হুরপরী?
ঘোমটার ফাঁক গেলিয়ে উঁকি দেওয়া পলকের মুখটা ভেসে উঠেছে আয়নায়।লাজুক হাসি এসে জুড়ে বসেছে পলকের চোখ মুখের কোণায় কোণায়। লাল বেনারসীতে প্রথমবার দেখেই কয়েকটা হার্টবিট নির্দ্বিধায় মিস করে গেছিল সে।আর এখন লাল ওড়নার আচঁলের ফাঁকে উকি দেওয়া লাজুক মুখখানি একেবারে ঘায়েল করে দিয়েছে তাকে। নববধূ সাজে বড্ড মোহনীয় লাগছে পলককে। সেদিকে কিছুসময় মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলো সে।তারপর, ঘোর লাগা কন্ঠে সে বললো, _আমার মায়াবতী মৃন্ময়ী!

সিফাতের এই কথার সাথে আনন্দে হই হই রই রই রব পড়ে গেল চারিদিকে। পলককেও জিজ্ঞেস করা হলো,
_সাজি!! আয়নায় কি দেখা যায়?
আয়নায় সিফাতের ঘোর লাগা চোখের দিকে দৃষ্টি রেখে পলক বললো,
_মৃন্ময়ীর অপেক্ষার অবসান! বলেই মুচকি হাসলো সে।সেই মৃদু হাসিতেই তার মনের সন্তুষ্টি, আনন্দ আর একনিষ্ঠ ভরসাটুকুও ঠিক দেখতে পেল সিফাত। সন্তুষ্টচিত্তে সেও হাসলো তার ভুবনভুলানো হাসিখানা।

____________________________________

ফ্ল্যাশব্যাক,

_আর যদি ভাইয়া নিজেই চায় তুমি আমার হও, তখন?

থমকে গেল পলক। চমকে তাকালো সে তিয়ানের দিকে। তিয়ানের মুখে বিজয়ের হাসি।আর, পলকের চোখে বিস্ময় আর বিভ্রান্তি।

_বলো না পলক…যার জন্য তুমি আমার হতে পারছো না,,সেই যদি তোমাকে আমার হতে দেয়,তবুও ফিরিয়ে দেবে তুমি আমায়?

তিয়ানের কথা শুনে পলক কিছু বললো না। হাতের তোয়ালেটা নিয়ে বেলকোনিতে গিয়ে মেলে দিল তারে। তারপর, ঘরে এসে সোজা গিয়ে লক করে দিল ঘরের দরজাটা। তিয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে সব।পলকের কি করতে চাইছে বুঝতে পারছে না সে। তাই সে পলককে জিজ্ঞেস করলো,
_পলক….কি করছো তুমি এসব?

পলক এবারেও কিছু বললো না, কেবল তিয়ানের কাছে এসে তার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল বিছানার দিকে। তারপর,চোখের ইশারায় তাকে বসার জন্য বললো। তিয়ান পলককে বুঝতে না পারলেও তার কথা মেনে বাধ্য ছেলের মত বসলো বিছানার উপর। তিয়ান বসতেই তার সামনে হাটু গেঁড়ে বসলো পলকও। তিয়ান চমকালো তার এহেন কাজে। এই নিয়ে পলককে কিছু বলতে যাচ্ছিল,,তার আগেই পলক তিয়ানের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। তারপর ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
_উনি চাইলেও হবে না।কারণ, আমি নিজেই চাইনা এমন হোক।
_তুমি ভালোবাসোনা আমাকে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তিয়ান।
_বাসি! খুব ভালোবাসি।
_তাহলে? কেন চাইছো না তুমি আমার হতে? তুমি এখনো অভিমান করে আছো আমার উপর? তাই জন্য ফিরিয়ে দিচ্ছো আমাকে? অস্থির কন্ঠে বললো তিয়ান।
_উহু,,এমন কিছুই না, তিয়ান। তুমি শোনো আমার কথাটা।
_বলো..
_আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি তিয়ান। কিন্তু,সেই ভালোবাসাটুকু এখন কেবলই বন্ধুত্বের। বিথি আর তুমি দুজনেই এক আমার জন্য। সেদিন রাতে ছাদেও বলতে চেয়েছিলাম কথাটা কিন্তু তুমি শুনলেই না কিছু।আর গতকাল তুমি যখন আমাকে ওভাবে ধরে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছিলে,,জানো কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম আমি?
_পলক আমি..

_তোমাকে আমি শুরু থেকে যেভাবে দেখেছি,,এখানে এত বছর পরেও যেভাবে পেয়েছি,,সেই তিয়ানের সাথে কোন মিলই ছিল না বিগত কয়েকদিনের আমার দেখা তিয়ানের। এই তিয়ানকে তো আমি চিনিই না একমদই। বড্ড অপরিচিত সে আমার। কিন্তু আমি জানতাম এই তিয়ান শুধুমাত্র একটা সময়ের ব্যবধান।সময়টা পার হয়ে গেলেই আমার বন্ধু,,ভালোবাসার মানুষ..যে তিয়ান,সেও ফিরে আসবে তার আগের রূপে। আর আজ সেই সময়ের ব্যবধানটা পার করার সময় হয়েছে তিয়ান। তাই আজ তোমাকে শুনতে হবে, বুঝতে হবে আমার কথাটা।

_পলক তুমি ভুল বুঝতেছো আমাকে! আমি সত্যিই ভালোবাসি তোমাকে।আর আমি তোমার আগের তিয়ানই আছি। বিশ্বাস করো।তোমার সাথে ব্রেকআপের পরেও আমি কোন রিলেশনশিপে ইনভলভ হইনি। আমি অন্যকাউকে তোমার জায়গা দেইনি।- অস্থির কন্ঠে তিয়ান বললো।

_আমি সেটা জানি তিয়ান। কিন্তু,,এত দিন পরে এত কিছুর পরে অনেক কিছুই অদল বদল হয়ে গেছে। তোমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে যেমন ছিলে তুমি আমার কাছে আজও তেমনই আছো। হ্যাঁ,,এটা সত্যি যে একটা সময় এই ভালোবাসাটা অন্য এক পথে অগ্রসর হয়েছিল। আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম দুজনের হতে। যতদিন তোমার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল,,ওই সম্পর্কটা ছিল আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি,,তোমার ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল না তিয়ান। একজন প্রেমিকা হিসেবে নয় বরং ভালোবাসার মানুষ হিসেবে তুমি আমাকে সম্মান করেছো, আগলে রেখেছো,সাপোর্ট করেছো।আমিও খুব করে চেয়েছিলাম তখন যেন আমি তোমাকেই পাই নিজের করে। আমার সবটা জুড়ে তুমি থাকো।কিন্তু,ভাগ্য..পরিস্থিতি সেটা হতে দেয়নি। তুমিও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে। কোন সুযোগ দাওনি আমাদের এই সম্পর্কটাকে। ফলাফল আমাদের বিচ্ছেদ হলো! কিন্তু,,সেই তুমি আমাকে পরোক্ষভাবে সাপোর্ট করার জন্য আমাকে মিথ্যামিথ্যি অবজ্ঞা করলে। নিজেকে আমার কাছে খারাপ দেখিয়ে ব্রেকআপ করলে। তারপরে,,আমাদের আর কোন যোগাযোগ কিন্তু ছিল না। তুমি জানতে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। নিজেকে সেভাবেই মানিয়ে নিয়েছিলে তুমি।তোমার ভালোবাসাটাও কোথাও একটা চাপা পড়ে গেছিল। কিন্তু, পরে সব জানার পরে ভুলেও একটাবার খোঁজ করোনি আমার। সম্পূর্ণ ব্যাক আউট করে গেছিলে তুমি।আর তার ৩ বছর পর যখন তুমি আবার আমাকে দেখলে, আমার সাথে মেলামেশা শুরু হলো, পুরোনো স্মৃতি উল্টেপাল্টে দেখা হলো তুমি আমাদের অতীতকে মিস করতে শুরু করেছিলে।আবার ক্যাপ্টেনের সাথে যখন আমায় দেখলে তোমার খারাপ লাগলো।কারণ,তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলে আর আজও ভালোবাসো।আমি জানি সেটা। এটুকু বলেই খানিক থামলো পলক। তিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো।

_ভালোবাসি জানো তাহলে কেন ফিরিয়ে দিচ্ছো পলক? কাতর কন্ঠে বললো তিয়ান।

_ভালো তো উনিও বাসেন আমায়। মৃদু হেসে বললো পলক।

_তুমি ভালোবাসো তাকে?

তিয়ানের এহেন প্রশ্নে স্তব্ধ হয়ে কয়েকসেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো পলক। তারপর ঝরঝরে গলায় বললো,

_নাহ। তবে ভালো লাগে তাকে আমার। আর বিয়ের পর একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসাটাও হয়ে যাবে একসময়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাই তো এমন!

_তাহলে আমি নই কেন পলক? তুমিও ভালোবাসো আমায়।

_তোমার সাথে বিচ্ছেদের পরে আমার বিয়েটাও ভেঙে গেল।ভেঙে পড়েছিলাম আমিও। সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। প্রায় দেড় দু বছর সময় লেগেছে আমার নিজেকে স্বাভাবিক করতে। এরমাঝেই আমার আরও ৮ টা সম্বোধন ভেঙেছে আমার। আমি ভেবেছিলাম এটাও ভেঙে যাবে। কিন্তু,আমাকে অবাক করে দিয়ে এই মানুষটাই আমাকে ভালোবেসেছে।বিয়ে করতে চেয়েছে। পরিবারকে রাজি করিয়েছে। একবার তো আমি তাকে ভুল বুঝে বিয়েটাই ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি! কারও কাছে আমাকে ছোট না করেই কি সুন্দর সবটা সামলে নিয়েছিল সেদিন। এই ৩ টা মাসে উনি মুখে কিছু না বলেও পদে পদে বুঝিয়ে গেছেন,,কতটা ভালোবাসেন উনি আমাকে। আমার সবটা জেনেও আমাকেই চেয়েছেন নিজের জন্য।

কিন্তু তুমি বুঝতে পারছো না তিয়ান ,এত বছর পর আমাকে পেয়ে যে ভালোবাসার দাবি তুমি করছো সেটা এখন শুধুমাত্র আমাকে পাওয়ার জেদ হয়ে উঠেছে তোমার। আসলে, প্রিয় কোন কিছু একবার হারানোর পর সেটা ফিরে পেলে আমরা তাকে খুব করে আগলে রাখতে চাই। আবেগী হয়ে বর্তমান ভুলে আঁকড়ে ধরতে যাই সেটাকে। কিন্তু,,সেই জিনিসটা আদৌও ধরে রাখার মত আছে কিনা সেটা ভেবে দেখিনা। তাই জন্য তুমি চাইছো যে কোন মূল্যে আমি তোমার হই।আমি কি চাই সেটা কিন্তু একবারও জানতে চাওনি তুমি। যখন তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল,,তুমি ছিলে না। স্বেচ্ছায় দূরে করে দিয়েছিলে আমায়।মাঝে আরও ৩ টা বছর কেটে গেছে। তোমাকে প্রথম দেখার পর আমি ভেবেছিলাম আমি আজও ভালোবাসি তোমাকে। কিন্তু,উনি আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছেন, তোমাকে আমি এখন আর ভালোবাসি না সেভাবে। আমার খারাপ লাগার কারণ তুমি নও বরং তোমায় ভুল বুঝে পুষে রাখা কষ্টগুলো ছিল। আর সত্যি জানার পর আমিও ভেবে দেখেছি সবটাই।আমি সত্যিই মুভ অন করে গেছি তিয়ান। তোমার জন্য ওমন আর কোন অনুভূতি আমার নেই। আর সত্যি বলতে, সেসময় তুমি প্র্যাক্টিকাল হয়ে আমাকে ছেড়েছিলে আর আজ আমি প্র্যাক্টিকাল হয়ে তোমায় গ্রহণ করতে পারছিনা।

_অহ! তাহলে আমার জায়গাটা রিপ্লেস করে গেছে উনার আগমনে! তাই জন্য আমার সামনে এলেই আমাকে দেখানোর জন্যই এমন বিহেভ করেন উনি। আমাকে দেখায় কত ভালোবাসে উনি তোমায়।

_ভুল! ভুল ভাবছো তুমি। উনি তোমার জায়গাটা রিপ্লেস করেননি। বরং উনি স্বয়ং নিজের একটা জায়গা তৈরী করে নিয়েছেন। আর আমি চাই তার সেই জায়গাটাতেই তাকে সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতে। ইনফ্যাক্ট, সেদিন আমি তোমায় মিথ্যা বলেছিলাম। উনি কিছুই জানেন না তোমার আমার ব্যাপারে।উনি জানার পরে কি করবেন সেটাও জানি না আমি। তবে আমি চাইনা উনি কষ্ট পাক।তাই আজও বলার সাহস করে উঠতে পারিনি আমি। তাই উনার তোমার সাথে কম্পিটিশন বা তোমাকে রিপ্লেস করার কোন প্রশ্নই আসে না।

_উনি জানে না মানে? বিস্ফোরিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো তিয়ান।
_তাকে বলা হয়নি আমাদের সম্পর্কের কথা। অপরাধী কন্ঠে বললো পলক।
_উনি জানেন না তাহলে যে কাল রাতে…এটুকু বলতেই চুপ হয়ে গেল তিয়ান। তার মনে পড়ে গেল গতরাতে তার সাথে সিফাতের কথোপকথন। তিয়ান জানতো যে সিফাত সবটা জানে।তাই সে ওভাবে কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু,,সে তো কিছুই জানে না! তারমানে পলক কিছু না বললেও সে সবটা জানে কোনভাবে। আর এরপরেও সে না পলককে কিছু বলেছে আর না তিয়ানের সাথে কোন মিস বিহেভ করেছে। ঠিক কতটা ভরসা কেউ কাউকে করলে এভাবে সব জেনেও কোন প্রশ্ন করে না, সেটা তিয়ানও বুঝে গেল এবার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পলকের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আমি তোমাকে ভালোবাসি পলক।
_ভালো আমিও বাসি তোমাকে। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ তুমি। তোমার থেকেই এভাবে ভালোবাসতে শেখা।তোমার থেকে যে ভালোবাসা,,সম্মান আমি পেয়েছি সেটা কখনোই ভুলে যাওয়ার মতো নয়। আমৃত্যু সেটা আমার মনে থাকবে। কিন্তু, আমাদের বিচ্ছেদের পর আমি বেরিয়ে এসেছি সবটা থেকে। তুমিও শক্ত করো নিজেকে। বেরিয়ে এসো অসম্পূর্ণ অতীতটা থেকে।
_কিন্তু, তাও আমি তোমাকেই ভালোবাসবো আজীবন।
_তা বেসো.. আপত্তি নেই আমার।কিন্তু দেবদাস না হলেই হলো। এটুকু বলেই ফিক করে হেসে দিল পলক। হাসলো তিয়ানও। তারপর তিয়ান বললো,
_তুমি সুখী হবে ইন শাহ আল্লাহ। ভাইয়া ভালো রাখবেন তোমায়।
_ ইন শাহ আল্লাহ। পলক বললো সন্তুষ্টচিত্তে। তিয়ানকে সে বোঝাতে পেরেছে। এখন বেশ শান্তি লাগছে তার।

_রেডি হয়ে নাও তুমি।আসছি আমি।
_আচ্ছা।

এটুকু বলেই তিয়ান উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। সে দরজার কাছে যেতে যেতেই একটা কল এলো পলকের ফোনে। সেটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে কি বলা হলো বুঝলো না তিয়ান। কেবল পলককে বলতে শুনলো,
_ ওকে নিয়ে যাও হসপিটালে। আসতেছি আমি। বলেই দ্রুত পায়ে গিয়ে আলমারি থেকে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে ছুটে গেল দরজার কাছে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে দরজা খুলতে শুরু করলো সে। তা দেখে তিয়ান বললো,
_কোথায় যাচ্ছো এখন এভাবে?
_হসপিটালে।
_মানে?
_এখন কিছু বলার সময় নাই তিয়ান। বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল পলক। তিয়ান কিছু বুঝলো না,,কেবল পলকের পিছু পিছু যেতে যেতে বললো, ওয়েট..আমিও আসছি।

চলবে….