ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-২৯+৩০

0
371

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২৯
©জারিন তামান্না

আলমারি থেকে একের পর এক শাড়ি বের করছে আর আয়নার সামনে গিয়ে তাতে দেখছে নিজেকে। বিথির বর কবিরকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের নিয়ে একটা গেট টু গেদারের আয়োজন করেছে বিথি। যদিও পলকের বিয়ের পরেই এটা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু, কবির বিথিকে সারপ্রাইজ দিতে ভ্যালেন্টাইন ডে -তেই দেশে এসেছে। তাই ছুটি শেষ হওয়ার মেয়াদও এগিয়ে গেছে। পলকের বিয়ের দু দিন পরেই চলে যাবে বিথি। তাই আগে ভাগেই আয়োজন করেছে এসবের। কিন্তু,পার্টিতে কি পড়বে সেটা নিয়ে কিছুই ডিসাইড করতে পারছে না পলক।

পলক যখন ড্রেস পছন্দ করা নিয়ে কনফিউজড ঠিক সে সময় কল এলো সিফাতের। কল রিসিভ করে আজ প্রথমেই সিফাত সালাম দিলো।বললো,
_আসসালামু আলাইকুম মৃন্ময়ী। কেমন আছেন আপনি?
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
_হুম,,ভালো আছি। কি করছেন?
_ড্রেস দেখছিলাম। কাল বিথির ওখানে গেট টুগেদার আছে।ইনভাইট করেছে সেখানে।
_হুম,,জানি। আমাকেও কল করেছিল আজ। ইনভাইট করেছে পার্টিতে যাওয়ার জন্য।
_আপনাকে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পলক।
_হ্যাঁ,,কেন বলেনি আপনাকে ও ?
_না।
_অহ! আমাকে সন্ধ্যায় কল করেছিল। এতবার করে বললো যেতে,,আমি আর না করতে পারিনি।তাছাড়া আপনার হয়েই তো যাচ্ছি,,অপরিচিত হলেও খুব একটা সমস্যা হবে না আমার। বলেই আলতো হাসলো সিফাত। তারপর বললো,
_আচ্ছা,যাই হোক….কি পড়ছেন কাল পার্টিতে?
_জানিনা আমি কিছু। একটা শাড়িও তো পছন্দ করে উঠতে পারছি না।
_আচ্ছা,,ওয়েট। আমি দেখে দিচ্ছি।
_আপ…বলতে বলতেই কল কেটে দিয়ে ভিডিও কল দিল সিফাত। তারপর বললো,
_এবার একটা একটা করে দেখান আমায়। আমি চুজ করে দিচ্ছি।
পলক বাধ্যমেয়ের মত একের পর এক শাড়ি ঘাঁটছে আর সিফাতকে দেখাচ্ছে। এভাবেই ৭/৮ টা শাড়ি দেখানোর পরে রয়েল ব্লু কালারের একটা শিফন শাড়ি নজর কাড়লো তার। শাড়িটা গোল্ডেন কালারের মোটা পাড় দিয়ে বর্ডার করা। সেখানে বিভিন্ন স্টোন আর সুতার কাজ করা কিছুটা ভারী কাজ করা। পার্টিতে পড়ার জন্য একদম পার্ফেক্ট। সিফাতের কথায় শেষ পর্যন্ত ওটাই ফাইনাল করা হলো পার্টিতে পড়ার জন্য।শাড়ি ফাইনাল করার পর সিফাত বললো,
_কাল ৬ টায় রেডি থাকবেন,আমি নিতে আসবো আপনাকে। একসাথেই যাবো দুজনে।
_না…না..সেটার দরকার হবে না। আমার সাথে ভাইয়া আর নিশাতকেও ইনভাইট করেছে বিথু। আমি তাদের সাথেই চলে আসবো। আপনাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না।
_ওকে,,ফাইন।
_জ্বী।
_কাল ৬’০০ টায় রেডি থাকবেন সবাই। একসাথেই যাবো আমরা।
_হ্যাঁ?! থতমত খাওয়া স্বরে জিজ্ঞেস করলো পলক।
_ঘুমিয়ে পড়ুন এবার। গুড নাইট মৃন্ময়ী। বলেই,,পলকের কিছু বলার অপেক্ষা না করেই কল ডিসকানেক্ট করে দিলো সিফাত। পলক হতভম্ব নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে। মনে মনে বললো,মানুষটা এমন অদ্ভুত কেন?!কিন্তু উত্তর দবার আপাদত কেউ নেই।তাই নিরাশ হয়েই ওঠে গেলো সেখান থেকে। সব গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়লো। ঘুমানোর আগে সিফাতকে ছোট করে ম্যাসেজ করলো,
গুড নাইট।

____________________________________

ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই থমকে গেল পলক। রয়েল ব্লু কালারের স্যুট পড়া,পায়ে পলিশড ব্ল্যাক সু,চুলগুলো একসাইডে ব্রাশ করে জেল দিয়ে পরিপাটি করে রাখা, মুখে চাপ দাঁড়ি আর হাতে মোটা চেইনের ব্রেন্ডড ঘড়ি পড়নে লম্বা ফর্সা সুদর্শন একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে।এক হাত পকেটে রেখে অন্য হাতে মোবাইলে কিছু একটা করছে। দুই একটা হার্টবিট মিস করলো পলক।এই সুদর্শন ব্যক্তিটিই তার হবু স্বামী। কাল পলককে যে রঙের শাড়ি দেখিয়েছিল আজ নিজেও সেই রঙেই সেজেছে।মুগ্ধ হয়ে দেখলো সে সিফাতকে। আপনা আপনি তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, মাশাল্লাহ।
পলকের আওয়াজ পেয়ে মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে চাইলো সিফাত। অনায়াসে দুই একটা হার্টবিট বুঝি সেও মিস করে গেল।ফর্সা না হলেও উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের পলকের গায়ে রয়েল ব্লু কালারের এই শাড়িটাও মানিয়েছে খুব। হাই নেকের ফুল স্লিভের ডিজাইন করা ব্লাউজ দিয়ে পড়ায় যেন আরও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। চুলগুলো মাঝে লম্বা সিঁথি করে পেছনে খোঁপা করা। কানে বড় ঝুমকো।নাকে সিফাতের দেওয়া গোল্ডের নাকফুলটা। চোখে মোটা করে টানা কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। আর হাতে এঙ্গেজমেন্ট রিং। ব্যস এটুকুই! এতেই যেন রাজ্যের মায়া এসে ভর করেছে পলককে। সিফাত অপলক চেয়ে আছে তার মৃন্ময়ীর দিকে। তাকিয়ে আছে পলকও। তার চোখেও আজ রাজ্যের ঘোর এসে ভীড় জমিয়েছে।আর তখনই হালকা গলা ঝাড়ার আওয়াজে ধ্যান ভাংলো দুজনের।চকমে পেছনে তাকাতেই পলক দেখতে পেলো, পলাশ আর নিশাত দাঁড়িয়ে আছে।ওদের দেখা সিফাত আর পলক দুজনেই বেশ লজ্জা পেয়ে গেল। তা দেখে নিশাত রসিকতার সুরে বললো,
_আর তো ক’টা মাত্র দিন ডিয়ার দুলাভাই,,তারপরেই তো বুবু পার্মানেন্টলি আপনার ঘরেই থাকবে। তখন ঘুমাতে, ঘুম ভাংতেই এই একটা মানুষকেই দেখবেন রোজ।সো,,এখন একটু কম কম দেখলেও চলবে।এখন আমাদেরকেও দেখেন একটু।
সিফাত লজ্জা পেয়ে গেল নিশাতের কথা।মাথা নিচু করে আলতো হেসে নিশাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
_এমন কিছু না ছোট আপু। মাশাল্লাহ, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।
_হ্যাঁ,,হ্যাঁ,,বুঝি তো আমরা সবই। ফিচলে হেসে বললো নিশাত।
_হ্যাঁ,,খুব বুঝো। ছোট আপু কি না তুমি! আচ্ছা চলো এবার,,লেট হয়ে যাচ্ছে। তারপর, পলাশকে উদ্দেশ্য করে বললো, আসুন ভাইয়া। তারপর তারা একসাথে বেরিয়ে গেল হোটেলে যাওয়ার জন্য যেখানে বিথি পার্টির আয়োজন করেছে।

__________________________________

অনেকদিন পর কলেজের পুরোনো বন্ধুরা একসাথে হয়েছে। বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করছিল তিয়ান। তখনই দেখলো, সিফাতের সাথে পলক ঢুকছে হলে। পলককে দেখেই মুগ্ধ হলো তিয়ান। আজও শাড়ি পড়েছে তার শ্যামকন্যা। কিন্তু তার পাশে সিফাতকে খেয়াল করতেই দেখলো তারা দুজনেই ম্যাচিং করে ড্রেস পড়েছে। পাশাপাশি দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে,তারা একে অন্যের জন্যই তৈরী। ম্লান হাসলো তিয়ান ওদের দেখে। মনে মনে ভাবলো,আজ এই জায়গাটা কেবল তার থাকা উচিৎ ছিল। অথচ…! আচ্ছা,,আজ যদি সে নিজের জায়গা ফেরত চায়,,খুব কি অন্যায় কিছু হবে? -তিয়ান যখন এসব ভাবনায় মশগুল তখনই হঠাৎ বিথির কথার আওয়াজে ধ্যান ভাংলো তার। তাদের বাকি বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সিফাত, পলক, পলাশ আর নিশাতকে। তিয়ানকে দেখতে পেয়েই সিফাত হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে দিয়ে বললো,
_Hey,Tiyan. কেমন আছো?
_I’m quiet good. what about u?
_আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।বলেই তৃপ্ত চোখে পলকের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো সিফাত। তার এই চাহনীতে সহসা লজ্জা পেয়ে গেল পলক। মাথা নিচু করে আলতো হাসলো সেও। তিয়ান সেটা ঠিকই খেয়াল করলো।কেন যেন ভালো লাগলো না ব্যাপারটা তার।

কবিরের সাথে পরিচিতি পর্ব শেষ হতেই ডান্স ফ্লোরে আমান্ত্রণ জানানো হলো বিথি আর কবিরকে। কিন্তু,বিথি জেদ ধরেছে সিফাত আর পলকেও ডান্স ফ্লোরে তাদেরকে জয়েন করতে হবে। কাপল ডান্স হওয়ায় পলক প্রথমে বেশ উশখুশ করছিল না যাওয়ার জন্য। কিন্তু,সিফাত যখন হাত বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_Mrinmoyee,,may I’ve a dance with u, plz?
পলক তবুও হাত বাড়িয়ে দিতে পারছিল না। সিফাত এর আগে বহুবার পলকের হাত ধরেছে। পলককে ছুঁয়েছে।সেদিন রাতে দিশেহারা হয়ে সিফাতের আশ্রয়ে তার বুকে মাথা রেখে কেঁদেছেও পলক কিন্তু,নিজে থেকে কখনো সিফাতকে স্পর্শ করেনি সে। তাই আজও হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরতে বেশ জড়তা কাজ করছে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই যখন পলক কি করবে না করবে ভাবছে তখনই পাশ থেকে নিশাত বললো,বুবু যাআ! আর কিছু দূরে সামনে দাঁড়ানো পলাশও চোখের ইশারায় পলককে যাওয়ার জন্য বললো তখন পলক আর বেশি কিছু না ভেবেই হাত বাড়িয়ে প্রথমবারের মত সজ্ঞানে সিফাতকে ছুঁয়ে দেখলো। প্রথমবারের মত ছুঁয়ে অনুভব করলো সিফাতকে। সিফাতও পলকের বাড়িয়ে দাওয়া হাতটা আলতো করে মুঠোয় পুরে তাকে কাছে টেনে নিল। আর দূর থেকেই এর সবাই দেখলো তিয়ান।

ডান্স ফ্লোরে রোমান্টিক গান প্লে করা হয়েছে।

জানাম জানাম জানাম
সাথ চালনা ইউহি
কাসাম তুমহে কাসাম
আকে মিলনা এহি – গানের তালে তালে নাচছে তারা। সিফাতের হাতের মুঠোয় পলকের হাত। তবে, কবির যেভাবে বিথির একেবারে কাছাকাছি হয়ে ওর কোমড় জড়িয়ে রেখে নাচছে,,সিফাত সেটা করছে না। সিফাত পলকের পিঠে আলতো করে হাত রেখে স্বাভাবিক দূরত্ব রেখেই ডান্স করছে তার সাথে। যার জন্য খুব একটা অস্বস্তিও হচ্ছে না পলকের। আর নাচের স্টেপগুলোতে যতবারই সে সিফাতের কাছাকাছি যাচ্ছিল একটা দমবন্ধ হওয়া ভালোলাগা এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাকে।সেই ভালোলাগা ফুঁটে উঠছিল তার চোখে মুখে,,মৃদু হাসিতে।দূরে বসে এসব খেয়াল করছিল তিয়ান। আচমকা সেখান থেকে উঠে নিশাতের দিকে এগিয়ে গেল। নিশাতকে কিছু না বলেই ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ডান্স ফ্লোরে।নিশাত পুরো হকচকিয়ে গেছে। পলাশও অবাক। সাথে সেখানে উপস্থিত বাকি সবাইও। কিন্তু,ডান্স ফ্লোরে গিয়েও সে নিশাতের খুব একটা ক্লোজ হয়ে ডান্স করছিল না তিয়ান। আর না ডান্সে তার খুব একটা মনোযোগ ছিল। আচমকা গানের মিউজিকে ঘুরতে ঘুরতে নিশাত গিয়ে কবিরের ,,বিথি সিফাতের আর পলক তিয়ানের হাতে পড়লো। পলককে হাতে পেতেই তিয়ান শক্ত করে তার কোমড় ধরে এক ঝটকায় খুব কাছে টেনে আনলো তার ।আচমকা এমন রুক্ষ স্পর্শে শিউরে উঠলো পলক।ঠিক তখনই গানের লিরিক্সে এলো ,

তালাব তালাব তালাব
বাস্ তেরি হে মুঝে
নাসো মে তু নাশা
বানকে ঘুলনা ইউহি
মেরি মুহাব্বাতকা কার না তু
হাক এ আদা
মেরি হোকে হামেশাহি রেহনা
কাভি না কেহ না আলভিদা….

পলককে খুব কাছে এনে ডান্স করতে করতেই তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো তিয়ান, যেটার জায়গা যেভাবে সেটাকে সেভাবেই মানায়। হোক সেটা ডান্স স্টেপের রুলস কিংবা কোন মানুষ!

চমকে উঠলো পলক। সে বিস্মিত..হতভম্ব! ভেতর ভেতর অজানা এক আশংকায় শিউরে উঠলো সে। তিয়ানের চোখের দিকে তাকাতেই দেখলো তার চোখে ফুঁটে ওঠা রুক্ষতা,কিঞ্চিৎ হিংস্রতা আর চিরকাঙ্ক্ষিত কোন কিছুকে পাওয়ার তীব্র নেশা। তার এহেন হাবভাব মোটেও ভালো লাগছে না পলকের। ভয় করছে তার। আড়চেখে সিফাতকে দেখার চেষ্টা করতেই সিফাতের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল তার।বিথির সাথে থাকলেও তার নজর সরেনি তার মৃন্ময়ী থেকে।তাই তার মৃন্ময়ীর চোখের অস্বস্তি,ভয়টাও নজর এড়ালোনা সিফাতের।এদিকে তিয়ানও বড্ড রুক্ষভাবে ডান্স করছে পলকের সাথে। খুব শক্ত করে স্পর্শ করছে তাকে,যেন একটু আলগা হলেই ফসকে যাবে পলক। নাগালের বাইরে চলে যাবে তার। তাই যতটা সম্ভব শক্ত বাঁধনে ধরে রাখতে চাইছে তাকে। পলক ব্যাথা পাচ্ছে তিয়ানের এহেন শক্ত স্পর্শে।কিন্তু,,এত মানুষের সামনে কিছু বলতেও পারছে না।একবার মৃদু স্বরে বললোও তিয়ানকে,, ‘It’s hurting Tiyan. ‘কিন্তু,,লাউড মিউজিকের শব্দে সেটা তিয়ান শুনলো কিনা কে জানে!

ওদিকে গানের মিউজিক চেঞ্জ হতেই তারা নিশাত আর বিথিকে ছেড়ে দিলেও তিয়ান পলককে ছাড়লো না। ফলে নিশাত সিফাতের আর বিথি আবার কবিরের হাতে পড়লো।কিছু একটা ভুলভাল চলছে ডান্সফ্লোরে সেটা উপস্থিত সকলেই খেয়াল করলো। সিফাতও দেখছে তিয়ান আর পলককে। তিয়ানের রুক্ষতা আর পলকের অস্বস্তি ঠিকই তার চোখে পড়লো। কিন্তু সেই মূহুর্তে সে কিছু বললো না,,বরং কৌশলে ডান্স করতে করতেই নিশাতকে তিয়ানের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে পলককে তিয়ানের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো।

পলক যখন তিয়ানের আঙুল ধরে ঘুরছিল,তখন তার কাছাকাছি গিয়ে অন্য হাতের আঙুলে নিজের আঙুল গুঁজে নিজের মুঠোয় পুরে একটানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো সিফাত। সিফাতকে কাছে পেয়ে যেন মূহুর্তেই যেন সব অস্বস্তি কেটে গেল পলকের। তবুও সে যতটা সম্ভব শক্ত করে সিফাতের হাতটা ধরলো সে। তা দেখে কিছুটা নীচু গলায় বললো সিফাত,
_Just relax Mrinmoyi. It’s absolutely all right.so, just relax.
সিফাতের এহেন কথায় অবাক হয়ে তার চোখের দিকে তাকালো পলক।সিফাত সেই অবাক হওয়া চোখের দৃষ্টিতে চোখ রেখেই মৃদু হাসলো কেবল। সেই হাসিতে যেন আরও বেশি বিস্ময় বিভ্রান্তি খেলে গেল পলকের চোখে। কিন্তু,মুখ ফুঁটে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পলকের হলো না।চুপচাপ কেবল ডান্স ফ্লোরে সিফাতের সাথে তালে তাল মেলালো সে।

____________________________________

হলের ড্রিংসবারে কবির সিফাত তিয়ান আর কলেজের কিছু ছেলে বন্ধু একসাথে বসে কথা বলছিল। কবিরের সাথে বিথির প্রেম কাহিনী শোনার জন্য চেপে ধরেছিল কবিরকে। তাই কবিরকেও বলতে হয়েছে সবাই। তার কথা শেষ হতেই রাজু নামের একজন বললো,
_আর যাই বলেন ভাইয়া আমরা স্কুল কলেজে যে বিথিকে চিনতাম তার ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট রাখেননি আপনি। এই টমবয় গার্ল যে কোনদিন টিপিক্যাল উইমেন হয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করবে ভুলেও ভাবিনি আমরা। তার কথা শেষ হতেই হাসির রোল পড়ে গেল ওখানে। তার কথায় সায় দিয়ে মিজান বললো,
_একদম! আর তাছাড়া বিথি যেভাবে তিয়ানের সাথে চলতো ফিরতো আমরা তো ভেবেছিলাম শেষমেশ তিয়ানের সাথেই ওর কিছু একটা হবে। যদিও তিয়ান সে সময় প্লে বয়ের থেকে কম কিছু ছিল না। কিন্তু তারপর যখন পলক জয়েন করলো ওদের গ্রুপে,তিয়ানের অন্য কোন গার্লফ্রেন্ডের নমুনাও আমরা আর দেখলাম না বাকি ১ টা বছর।
_আরেএএ ইয়াআআর……আমরা তো ভাবছিলাম পলক তিয়ানের গার্লফ্রেন্ড, ওতেই থিতু হবে আমাদের প্লে বয় তিয়ান। কিন্তু,আমাদের সব চিন্তা ভাবনা চিতায় চড়িয়ে পলক বিয়ে করছে সিফাত ভাইয়াকে।আর তিয়ান এখনো সিঙ্গেল! ধ্রুব বললো মিজানের কথা কেড়ে নিয়ে।
_হ্যাঁ,,সেই তো দেখছি। তবে এটা কিন্তু সত্যি পলকের সাথে তিয়ানকে দেখে সবাই আমরা ধরেই নিয়েছিলাম They are in a relationship. আর এত ভালো বন্ডিং দেখলে যে কারও এমন ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না কিন্তু!মিজান বললো।
_But seriously…Tiyan… তোর আর পলকের মাঝে কি কখনোই কিছুই ছিল না? সব আমাদের ভুল ছিল? রাফি জিজ্ঞেস করলো তিয়ানকে।
_ওইই,,ব্যাটা। সাথে পলকের উড’বি হাজবেন্ড বসা,,আর তার সামনেই তুই এসব কি জিজ্ঞেস করতেছিস বোকার মত! রাফিকে সতর্ক করে মিজান বললো।
_আরেএ…ধুর! সিফাত ভাইয়া যথেষ্ট ফ্রি মাইন্ডেড পার্সোন। আর তাছাড়া, পলকের ব্যাপারে জানার অধিকার তো তার আছেই।তাই না ভাইয়া? সিফাতকে জিজ্ঞেস করলো রাফি।
_Yeah…& its ok Mizan.
_এইত্তো দেখ বলছিলাম না ভাইয়া কিছু মনে করবেন না। এইই তিয়ান তুই বল যা জিজ্ঞেস করলাম।(রাফি)
কোল্ডড্রিংসের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল তিয়ান। রাফির কথা শুনে সেটায় একটা চুমুক দিয়ে বললো,
_হ্যাঁ,,ছিলই তো। এতটা সময় কাছাকাছি থাকার পরেও ভালোবাসাটা না হওয়ার মত কিছু না। আমি তো এখনো ভালোবাসি পলককে। প্রচন্ড ভালোবাসি।আর আমি জানি পলকও আমাকে খুব ভালোবাসে। এটুকু বলেই সিফাতের মুখের দিকে চাইলো তিয়ান। তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। কিন্তু সিফাতের মুখে মৃদু হাসি। সেও তিয়ানের দিকেই তাকিয়ে আছে। বাকি সবার ভ্রু কুচকে গেছে। কি অকপট স্বীকারোক্তি তিয়ানের! সে মজা করছে নাকি সিরিয়াসলি বলছে সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। আর তিয়ান সিফাতের চোখে চোখ রেখেই হাসি হাসি মুখেই আবারও বললো,
_ভালোবাসি আমি পলককে।তবে,,সেটা নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে। তোদের ধারণা এতটাও ভুল ছিল না। আবার খুব একটা ঠিকও ছিল না। আর পলককে ভালো না বেসে থাকা যায় না রে। ও মেয়েটাই এমন।তাই আজও ভালোবাসি আমি ওকে।কিন্তু,,সেটা বিথির থেকে একটু কম। বিথিকে আমি সবথেকে বেশি ভালোবাসি। She was the frist gril in the word whom I loved the most after my mom.& Still she is.

শেষের কথাগুলো সে কবিরের দিকে তাকিয়ে বলতে বলতেই হেসে দিলো। হাসছে বাকি সবাইও। তারা কি ভেবেছিল আর কি হলো!
_যাহ..ব্যাটা! তুই মিথ্যা বলতেছিস। তুই পলককে বন্ধুর থেকেও বেশি কিছুই ভাবিস। ওটা তোকে দেখলেই বোঝা যায়। তিয়ানকে উষ্কে দিতে বললো রাফি।
_হ্যাঁ,আমি সত্যি বলতেছিনা।কিন্তু আমি মিথ্যাও বলতেছিনা। আমি তো কবির ভাইয়া আর সিফাত ভাইয়ার সামনেই স্বীকার করলাম যে আমি তাদের ওয়াইফকে ভালোবাসি।আর এতে তাদের কোন আপত্তি থাকলেও আমার কিছু করার নেই। ভালোবাসাটা সময়ের সাথে একটু একটু করে হয়েছে,,এটার গভীরতা অন্য কেউ বুঝবে না। বলেই শুকনো হাসলো তিয়ান।
_আচ্ছা,,সিফাত ভাইয়া আপনাদের তো এরেঞ্জম্যারেজ। আপনি কি ভালোবাসেন পলককে? কবির জিজ্ঞেস করলো সিফাতকে।
কবিরের কথায় আলতো হাসলো সিফাত। তারপর তিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আমি আর কি বলবো! তিয়ান তো বললোই, মৃন্ময়ী মেয়েটাই এমন যে উনাকে ভালো না বেসে থাকা যায়!

_হ্যাঁ।বিথির কাছেও ওর অনেক অনেক গল্প শুনেছি আমি। পলক সত্যিই খুব ভালো মেয়ে। ওর সাথে যার বিয়ে হবে সেই সুখী হবেন ইন শা আল্লাহ। অবশ্য এখন আর অন্য কারও জন্য অপশন নেই কোন।সেই জায়গাটা আপনি নিয়ে নিয়েছেন। আর কত জনের যে কপাল পুড়েছে সে তারাই ভালো জানে। বলেই হাসলো কবির।সাথে বাকি সবাইও। তারপর বললো, আর তাছাড়া পলকও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে। খুব ভরসা করে আপনাকে।আর সেটা আজ ডান্স ফ্লোরে সবাই দেখেছি আমরা। আড়চোখে তিয়ানকে দেখে বললো কবির। তিয়ান আর পলকের ব্যাপারে সবটাই তার জানা। যদিও বিথি বলেছে সব স্বাভাবিকই আছে তাদের মাঝে,কিন্তু আজ ডান্সফ্লোরে তিয়ানকে দেখার পর সেই কথাটা কতটুকু সঠিক সেই নিয়েই কনফিউশনে আছে কবির। তিয়ানের কথা, কাজ সব স্বাভাবিক থাকলেও তা অনেকটাই অস্পষ্ট লেগেছে তার।আর সিফাতের সাথে পলককে দেখার পর তারও মনে হয়েছে পলক তিয়ানকে নয় সিফাতকে ভালোবাসে।She completely moved on in her life…but Tiyan….may be not!

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_৩০
©জারিন তামান্না

ঘরে বাইরে প্রচুর হই হট্টগোল চলছে। সবাই যার যার মতো কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ বা হাসি তামাশা আর আড্ডায় মেতে উঠেছে। আজ রাত পোহালেই কাল সকালে পলক আর সিফাতের গায়ের হলুদ। বিয়েটা মূলত গাজীপুরে সিফাতদের ফার্ম হাউজে হচ্ছে। ফার্ম হাউজটা বিশাল বড়। তাই একটা পোর্শনে পলকদের আত্মীয়স্বজন আর অন্য পোর্শনে সিফাতরা থাকছে। বিয়েটা মূলত দুই পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের আর খুব কাছের কয়েকজন বন্ধুবান্ধবদের নিয়েই বেশ ছিমছাম ভাবে হচ্ছে। আর বিয়ের রাতে একটা ছোটখাটো গেটটুগেদারের আয়োজন হয়েছে ওখানে। কিন্তু রিসিপশনের অনুষ্ঠানটা ঢাকার একটা হোটেলে বেশ বড় করে করা হবে।বিয়ের পরে পলককে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাবে ওরা। পলাশ প্রথমে এভাবে বিয়ের জন্য আপত্তি করলেও সিফাতের অনুরোধে আর না করতে পারেনি। তাই একই বাড়িতে থেকে দুই পরিবারে বিয়েটা হচ্ছে। বিথি,কবির,নোরা,তিয়ানও আজ বিকেলেই চলে এসেছে। বিয়ে হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবে ওরা। আর বাকিরা সরাসরি বিয়েতে আসবে।

ফার্ম হাউজের বিশাল ছাদ জুড়ে চলছে ডেকোরেশনের কাজ। সেসবের তত্ত্বাবধায়নে আছে সিফাত, রিহান,,দিহান। আবিদ নীচে ক্যাটারিং এর কাজ দেখছে। কবিরও বসে নেই। পলাশের সাথে নানান কাজে ব্যস্ত। বোনের বিয়ে বলে কথা। আজ প্রায় অর্ধেকরাত পর্যন্ত কাজ চলবে । সবাই যখন কাজে ব্যস্ত,,ক্লান্ত তখন সবার জন্য কফি নিয়ে ছাদে এসে হাজির হলো নিশাত,নাজিয়া,মিলি,বিথি,রুকু, সারা। তাদের কথা সবাই মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা দিবে,গল্প করবে। বিরতি নিয়ে সবাই গোল হয়ে একসাথে বসলো ছাদের একটা পাশে। একটু পরে তিয়ান,কবির, আবিদ পলাশও উঠে এলো ছাদে। পলককেও ডেকে আনা হলো।সাথে এসেছে তাদের কাজিন ভাই সাব্বির আর নিহালও। এতগুলো মানুষ একসাথে হওয়ায় বেশ জমজমাট একটা পরিবেশ তৈরী হয়ে গেল মূহুর্তেই।সবাই জোড়ায় জোড়ায় বসেছে একরকম। তিয়ানের পাশে নিশাত আর তাদের মুখোমুখি হয়ে বসেছে পলক আর সিফাত। সবাই কফি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিল। এরমাঝেই সিফাতের একটা কল আসায় সে তার কফির মগটা রেখে উঠে গেল ওখান থেকে। কথা বলা শেষ হতেই যখন সে কফির মগটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে যাচ্ছিল,নিশাত চেঁচিয়ে উঠলো। সবাই হকচকিয়ে গেল তার এহেন চেঁচানোতে। সবার দিকে তাকিয়ে একটা ফাঁকা ঢোক গিললো সে,বুঝতে পারলো ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কিন্তু,সেই বা কি করতো সিফাত যে ভুল করছিল। সবার দিকে একনজর দেখে সিফাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_আপনি ভুল মগ হাতে নিয়েছেন ভাইয়া।ওটা বুবুর মগ। বুবু খেয়েছে ওটা থেকে।
পলক সহ সবাই তাকিয়ে দেখলো সিফাতের মগটা তার সামনেই কিন্তু সে বেখেয়ালেই পলকের মগটা হাতে তুলে নিয়েছে। কিন্তু,সবাইকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে সিফাত বললো, অহ! তারপরে আরামসে চুমুক দিল কফির মগে। কয়েকসেকেন্ড লাগলো সবার ব্যাপারটা ধরতে। ব্যাপারটা বোঝা মাত্রই সবাই মিটমিটে হাসা শুরু করলো নিজেদের মধ্যে।কেবল সারা মুখ ভেংচি দিয়ে নিজের কফিতে মনোযোগ দিল।

পলক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সিফাতের দিকে।তার মনে পড়ে গেল,,সেদিনও ছাদে পলকের খাওয়া কফিই সিফাত অনায়াসে খেয়েছিল। সে ভেবে অবাক হয় সিফাতের কি বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হয়না এভাবে তার খাওয়া কফিটা খেতে? পলককে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিফাত চোখ দিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার? পলক থতমত খেয়ে গেল। লজ্জাও পেল খানিক।তারপর ওই লজ্জামাখা স্বরেই মিনমিনিয়ে বললো,
_আপনার কি একটুও খারাপ লাগে না এসবে?
_কিসবে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সিফাত।
_না মানে…এই যে আপনি আমার খাওয়া কফিটাই নির্দ্বিধায় খান এভাবে।খারাপ লাগে না আপনার?
_এতে খারাপ লাগার কি আছে মৃন্ময়ী? হতবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো সিফাত।যেন এমন প্রশ্ন ত্রিভুবনে কেউ কখনো করেনি কাউকে। আর সিফাতের এহেন হেয়ালিতে বিরক্ত হয়ে পলক বললো,
_উউউফফফফ…আপনি কি কিছুই বুঝেন না? এভাবে একজনেরটা অন্যজন খায় নাকি কখনো?
সিফাত এবারে বুঝলো পলক আদতে কি বলতে চাইছে।আলতো হাসলো সে।তারপর, পলকের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
_খায় তো। বিশেষ বিশেষ মানুষ খায়। আপনি বুঝবেন না।
সিফাতের এহেন কথা আর এটিটিউড দেখে হতাশ হলো পলক। এই মানুষটার সাথে কথায়, কাজে, বুদ্ধিতে সে কিছুতে পেরে উঠে না কখনো। পারবেই বা কি করে, গুণে গুণে ৮/৯ বছরের জ্ঞানবুদ্ধি বেশি এই মানুষটার তার থেকে।এই ভেবে মনে মনে একটা ভেংচি কেটে কফির মগে চুমুক দিলো সে। ঢুক গিলতে যাবে তার আগেই সিফাতের ফিসফিসিয়ে বলা কথায় সেটা গলাতেই আটকে গেল তার। তাকে কফিতে চুমুক দিতে দেখে সিফাত বললো,
_এবারে বলুন,,আপনার খারাপ লাগলো না? আমার খাওয়া কফিটা খেতে!
সিফাতের কথায় চোখ বড় বড় করে চাইলো সে তার দিকে। থতমত খাওয়া অবস্থাতেই গিলে নিলো কফিটা। তারপরেই আড়চোখে চাইলো সে কফির মগে।তার হাতে সিফাতের খাওয়া কফির মগ। ওদিকে তাকিয়েই কি যেন ভাবলো সে।তারপরেই মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।আর পরেরবার অনায়াসেই আর বেশ আরাম করেই চুমুক দিল কফির মগে। সিফাতের কাছাকাছি গিয়ে খাদে নামানো গলায় বললো,

_নাহ! লাগলো নাহ।কারণ,বিশেষ মানুষেরটার স্বাদটাও বিশেষ ভালো ছিল। বলেই মুচকি হাসলো সে সিফাতের দিকে তাকিয়ে। সিফাত মুগ্ধ নয়নে দেখলো সে হাসি। এভাবে ধীরে ধীরে একে অন্যের হওয়ার ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে সে। আর মাত্র ১ দিন পরেই এই নারীটি একান্তই তার হয়ে যাবে। তার অস্তিত্বের অংশীদারী হয়ে আমৃত্যু তারই থাকবে! এই ভেবেই এক পরম পরিপূর্ণতার সুখে আবিষ্ট হলো সিফাত। আর পলক! সে তো অপেক্ষায় আছে…মৃন্ময়ীর অপেক্ষার অবসানের!

____________________________________

সবাই যখন সবার মত গল্প কথায় আড্ডায় মশগুল,,তখন মুখোমুখি বসে বিদ্ধস্ত মনে সিফাত আর পলককে দেখতে ব্যস্ত তিয়ান।সিফাত আর পলকের এমন মূহুর্ত দেখে বিথি বললো, তোর মনে আছে তিনু? তোদের সময় তুই যখন তোর সাথে একপ্লেটে সাজিরে খাইতে বলতি তখন তো ও কিছুতেই খাইতো না। আর এখন দেখ..ভাইয়ার কফির মগ থেইকাই কি সুন্দর কফি খাইতেছে ও..দেখ। এই জন্যই বলে প্রেমে পড়লে মানুষের ভোল পাল্টায় যায়! এ কথা শুনে অবাক পলক চুপসে গেল,,তিয়ান বাঁকা হাসলো।সিফাতও আলতো হাসলো। কিন্তু, বিথির কথা শেষ হতেই পাশে বসা কবির বিথির হাত চেপে ধরে তাকে সতর্কসংকেত দিতেই বিথি বুঝতে পারলো কতবড় ভুল কথা সে বলে ফেলেছে সে।যদিও সে বেখায়ালি হয়েই মজার ছলে এটা বলেছে,,তবুও এই জায়গায় এই কথা তার বলা উচিৎ হয়নি। এদিকে আবার বিথির কথা কাটাতে কবির বললো,

_আরেএএ…তুমি যে কি সব বলো না বিবিজান। বন্ধু আর বরেরটা এক হলো নাকি! তুমিও তো আমার প্লেটেই খাও কতসময়,তাই বলে কি অন্য কারোর সাথে খাবা নাকি!

_একপ্লেটে খাওয়া বা এক জনেরটা অন্য জন খাওয়াটা খাবার নয় বরং ভালোবাসার ভাগাভাগি হয় কবির ভাইয়া।পলকের সাথে বহুবার একইখাবার টিফিনে শেয়ার করেছি আমি।ওর খাওয়া খাবারটাই খেয়েছি।আমাদের ভালোবাসাটাও এমনি এমনি হয়নি। আমরা এক হয়েছিলাম বলেই হয়েছিল। -তিয়ান বললো কবিরের কথার পিঠে।
তিয়ানের এহেন কথায় ওখানে উপস্থিত সবাই হতভম্ব। সবাই তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। নিশাত সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে।পলাশ এবারে সরাসরি পলকের দিকে তাকালো।তাকে বোঝার চেষ্টা করছে সে। তিয়ানের সাথে পলকের সম্পর্ক বন্ধুত্বে। এটা সে জানে। কিন্তু, সত্যিই কি তাই? নাকি বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু…!
আর কিছু ভাবতে পারলো না পলাশ তার আগেই নাজিয়া সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো,
_এই,,চলো সবাই এখন।অনেক রাত হইছে, ঘুমাইতে হবে।কাল দুই দুইটা হলুদের আয়োজন করা লাগবে।অনেক কাজ বাকি এখনো। উঠো..

_হ্যাঁ,,,বেশ রাত হয়েছে। যার যার ঘরে চলো সবাই। রুকু বললো। পরিস্থিতি গম্ভীর বুঝে সবাই চুপচাপ উঠে গেল ওখান থেকে।

ডেকোরেশনের কাজ চলছে এখনো। রিহান সিফাতকে ডেকে নিয়ে গেল শেষবার সব চেক করার জন্য। সবাই উঠে যাওয়ার পর পলক আর নিশাত কফির মগগুলো একসাথে জড় করছিল। নিশাত কাপগুলো নিয়ে নীচে নেমে যেতেই পলকও উঠে দাঁড়ালো নীচে যাওয়ার জন্য।কিন্তু,পেছনে ফিরতেই দেখলো তিয়ান দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ঘেঁষে। তার চারপাশে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। সম্ভবত সিগারেট খাচ্ছে সে। তাকে ওভাবে দেখে পলক বললো,
_এতরাতে স্মোক করছো কেন তিয়ান! ঘরে যাও।ঘুমাও।
_তুমি এখনো আমাকে নিয়ে ভাবো পলক?
_এটা কেমন কথা! তোমাকে নিয়ে ভাবার কি হলো এতে..আমি তো জাস্ট…
_এখনো ভালোবাসো আমাকে?
_ঘরে যাও তিয়ান। আসছি আমি।কঠিন গলায় বললো পলক। পা বাড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এক কদম যাওয়ার আগেই তিয়ান ওর হাত টেনে ধরলো পাশ থেকে।
থমকে গেল পলক।তারপর, পাশ ফিরে তিয়ান.. বলে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আচমকা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তিয়ান তাকে। কান্নায় ভারী হয়ে আসা গলায় বললো,
_কষ্ট হচ্ছে পলক। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।কেন এমন হলো সব…কেন তুমি আমার হলে না! আমি এখনো তোমাকেই ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।তাহলে তুমি কেন আমাকে ভালোবাসো না আর? কি করে সবটা ভুলে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিচ্ছো তুমি! আমার যে ভালো লাগছে না এটা, কষ্ট হচ্ছে খুব। বলতে বলতেই কেঁদে দিল তিয়ান। তার চোখের পানিতে পলকের কাঁধ ভিজে একাকার। আচমকা এমন একটা পরিস্থিতি পড়ে অপ্রস্তুত গেছে সে।অজানা আশংকায় ভীতু হলো মন।আর সেই ভয় ভয় কন্ঠেই সে বললো,
_তিয়ান কি করছো তুমি! ছাড়ো। সরে দাঁড়াও। কিন্তু,তিয়ানের কোন হেলদোল নেই পলকের কথায়। সে নিজের মতই বলে যাচ্ছে।

_নাহ…তুমি আগে বলো…তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো কিনা? নাকি ভুলে গেছো সবটাই?

_আমি কিছুই ভুলিনি তিয়ান। যা হয়েছে সেটা ভুলে যাওয়ার মত নয়। এখন ছাড়ো আমাকে। অস্থির কন্ঠে বললো পলক। তারপর একরকম জোর করেই ধাক্কিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজের থেকে তিয়ানকে। তিয়ানকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পলকের হাত ধরে এক ঝটকায় তাকে টেনে নিয়ে চেপে ধরলো ছাদের ট্যাংকির সাথে। পলকের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অবুঝ বাচ্চাদের মত জেদি স্বরে বললো,

_তাহলে এখনো ভালোবাসো আমাকে তাই না? তিয়ানের কন্ঠ ক্রমশ আরও ভারী হয়ে আসছে।পলকেরও চোখ টলমল করছে তিয়ানের অবস্থা দেখে। তিয়ানকে সে বরাবরই খুব শক্তপোক্ত মানসিকতার ছেলে হিসেবে জেনে এসেছে।যখন সে সোহেলের সাথে বিয়ের কথা বলেছিল, এক কথায় বলে দিয়েছিল,, ‘অপেক্ষা করতে না পারলে করে নাও বিয়ে। ‘ আর আজ সেই মানুষটাই কেমন বাচ্চাদের মত কেঁদে কেটে বলছে,তার কষ্ট হচ্ছে। ছেলে মানুষ নাকি খুব বেশি অসহনীয় কষ্ট না হলে কাঁদে না। কিন্তু,তিয়ান কাঁদছে আজ। বলছে, আজও ভালোবাসে তাকে। পলক জানে তিয়ান পরিস্থিতির চাপে পড়েই ছেড়েছিল তাকে ।আর পলকও নিরুপায় হয়েই তিয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না বলেছিল,কিন্তু সেও তো মন থেকে ছাড়তে পারেনি তিয়ানকে।৩ বছর পর যখন তিয়ানকে প্রথম দেখেছিল,,সেদিনও তার ভেতর যে ঝড় উঠেছিল সেটা কি তবে তিয়ানকে সে আজও ভালোবাসে বলে? কিন্তু,আজ বাদে কাল যে সে অন্য কারও হয়ে যাচ্ছে।সিফাত নামের মানুষটার সাথেও তো অনেকটাই জড়িয়ে গেছে সে।তাকেই বা ছাড়বে কি করে! পলক যখন নিজের মাঝেই এসব ভাবনা..প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত তখনই তিয়ান পলকের একদম কাছে গিয়ে খুব শক্ত করে তার বাহুগুলো চেপে ধরলো। তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।যেন আরেকটু হলেই পুরোপুরি মিশয়ে নিবে সে পলককে নিজের মাঝে। তিয়ানের তপ্ত নিশ্বাস অনবরত পলকের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ছে।ভয়ে,অস্বস্তিতে দমবন্ধ হয়ে আসছে পলকের। এরমাঝেই তিয়ান খুব শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
_সত্যি করে বলো পলক,,ভালোবাসো তুমি আমাকে?
_তিয়ান…
_কি হলো বলো? ধমকে উঠলো তিয়ান। কেঁপে উঠলো পলক। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
_হ্যাঁ,,বাসি। আর তারপরেই ঝরঝর করে কেঁদে দিল সে। তারপর বললো,কিন্তু…
_I love u Polok. খুব ভালোবাসি তোমাকে। প্লিজ আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও। আমি প্রমিস করছি,,আর কখনো তোমাকে নিজের থেকে দূরে করবো না। প্লিজ তুমি আবার শুধু আমার শ্যামকন্যা হয়ে যাও। প্লিজ পলক।
_তিয়ান, আমি… আর কিছু বলতে পারলো না পলক। তার আগেই ওখানে রিহানের গলার আওয়াজ পেয়ে চুপ হয়ে গেল সে।সতর্ক হলো তিয়ানও। কারও সাথে কথা বলতে বলতে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেল সে। রিহান বেরিয়ে যেতেই পলকও দেরি করলো না আর। তিয়ানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌঁড়ে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেল সে। তিয়ানও আর বাঁধা দিল না তাকে। তার প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে গেছে। পলক আজও তাকেই ভালোবাসে।তাই পলককে পাওয়ার একমাত্র অধিকারও তারই।

চলবে..