ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-৭+৮

0
458

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_৭
©জারিন তামান্না

পলক রীতিমত নাজেলহাল।কিন্তু এর থেকেও বেশি কিছুই বোধয় ছিল তার কপালে।তাই বেল্ট টানাটানির একপর্যায়ে হাত ফসকে বেল্ট গেল ছুটে।সজোরে ছিটকে ফিরে গেল নিজের জায়গায়।ব্যাপরটা এতই দ্রুত ঘটছে যে পলক ভয় পেয়ে পেছনের দিকে ঝুঁকে গেল।চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে সে।শক্ত হয়ে সেঁটে রইলো সীটের সাথে। সিফাত তখনও চুপচাপ।খুবজোর হাসি পেল তার পলকের এহেন ভয় পাওয়া দেখে। কিন্তু এই অবস্থায় বেচারিকে হেনস্থা করতে আর মন চাইলো না তার। তাই কোন রকমে হাসি চেপে শান্তস্বরে বললো,

_দেখি,,,বেল্টটা এদিকে দিন।আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।

পলক তখনো চোখ মুখ খিঁচে পেছনের দিকে সেঁটে আছে।সিফাতের কথা তার কানে গেল না। তার এহেন অবস্থা দেখে সিফাত বুঝলো সে শুনতে পায়নি তার কথা। তাই গলা বাড়িয়ে ডাকলো তাকে।
_মৃন্ময়ী!
সিফাতের ডাকে হকচকিয়ে গেল পলক। কিন্তু নড়লো না এক বিন্দুও।মিটিমিটিয়ে চোখ খুলে প্রথমে সামনে দেখলো। কি হয়েছিল খেয়াল হতেই তার বা’পাশে ঘুরে বেল্টটাকে দেখলো।সেটাকে নিজের জায়গায় দেখে ধাতস্ত করলো নিজেকে। এরপর তাকালো সিফাতের দিকে।কপাল কুঁচকে চিন্তাভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। পুরো ব্যাপরটা বুঝতে পেরে ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল সে। দ্রুত সোজ হয়ে বসে গায়ের ওড়না টেনেটুনে ঠিক করলো। যদিও বা সেটা ঠিকই ছিল। কিন্তু নার্ভাস হয়ে পড়ায় কি রেখে কি করছিল সেটা পলকের নিজেরও বোধগম্য হচ্ছিল না।

_Are you ok,Mrinmoyi? সিফাতের শান্তকন্ঠে করা প্রশ্ন।প্রশ্ন শুনে সিফাতের দিকে তাকালো পলক। অস্থিরকন্ঠে দ্রুত জবাব দিল।
_হ্যাঁ এ..হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।
_আচ্ছা।দেখি বেল্টটা এদিকে দিন তো আমি লক করে দিচ্ছি।
সিফাতের কথায় আবারও হকচকিয়ে গেল পলক। সিফাত ঠিক কি বললো, বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো তার। সিফাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে নির্বিকার ভঙ্গীতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল পলক। তারপর আস্তে করে বেল্টটা টেনে আনলো সামনের দিকে। লক করতে যাবে তখনই সিফাত বললো,
একটু উপরের দিকে ধরুন তো। কথাটা পলকের বোধগম্য হলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সিফাতের দিকে চাইতেই সে বেল্টের দিকে কিছু ইশারা করলো। সিফাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে বেল্টের দিকে চাইতেই সিফাত বললো,
_যেখানে ধরে আছেন সেখান থেকে খানিকটা পিছিয়ে ধরুন যাতে বেল্ট ছুটে না যায়। পলক এবারেরও ঠিক কিছু বুঝলো না। শুধু সিফাতের কথা মত অন্য হাতদিয়ে খানিকটা উপরে হাত রেখে টেনে ধরে রাখলো বেল্টটাকে। পলক বেল্ট টেনে ধরতেই সিফাত নিচের খালি জায়গাটায় ধরে টেনে বেল্টটা লক করে দিল।পলক অবাক হলো বেশ। কি সুন্দর দূরত্ব রেখেও মানুষটা ঠিক তাকে হেল্প করলো। একটা অন্য রকম ভালো লাগা ছুঁয়ে গেল তাকে। মনে মনেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মৃদু হাসলো সে। কিন্তু মুখে কিছুই বললো।এই মূহুর্তে ভীষণ লাজ্জা লাগছে তার।

________________________________

_সাজির বিয়ে ঠিক হয়েছে। ডেট ফাইনাল হয়নি কিন্তু ছেলেরবাড়ি থেকে দেখতে এসে পাকা কথা দিয়ে গেছে।
রাতে খাবার টেবিলে এসে বসতে বসতে নিজের স্ত্রী শিফাকে কথাগুলো বললো পলকের বড়ভাই পলাশ। কিন্তু শিফার তাতে কোন হ্যাতচ্যাঁত নেই। সে নির্বিকার ভঙ্গীতে স্বামীর প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে।

শিফার এমন নির্বিকার ভাবভঙ্গী দেখে খানিকটা বিরক্ত হলো পলাশ।বিরক্তি নিয়েই আবারও বলা শুরু করলো,
_ছেলে পাইলট। যদিও ছেলের বয়স আমার সাজির তুলনায় খানিকটা বেশিই কিন্তু মা বললো ছেলে আর তার পরিবার নিজে থেকে সম্বন্ধ নিয়ে এসছিল।পলককে দেখে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে।

স্বামীর প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে নির্বিকার ভাব বজায় রেখেই শিফা বললো,
_তা এসব আমাকে বলছো কেন? আমি কি কিছু শুনতে চেয়েছি নাকি আমাকে শোনাবার জন্যই এভাবে বলছো?

_আহ,শিফা! এভাবে বলতেছো কেন?এতদিন পরে আল্লাহ তা’আলা আমার বোনটার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। বিয়ের জন্য এত ভালো ছেলে, পরিবার পাচ্ছে ও। আমার ভীষণ খুশি লাগতেছে ওর ভাগ্য দেখে। শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো পলাশের।আর সেটা দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো শিফা। বেশ তেঁতানো গলায় বললো,

_এএএহ….কি আমার ভাগ্য!না জানি আবার কোন বাড়ির মানুষ গুলার কপাল পুড়লো।আরেএএ..তোমার ঐ অপয়া বোনটার জন্যই আমার একমাত্র ভাইটা আজকে জেলে।মাকে ভিটে মাটি ছেড়ে আমার কাছে এসে পড়ে থাকতে হচ্ছে।আমার মেয়েটা নিজের দাদাবাড়ির বাড়ির আদর, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।আর তুমি কিনা ঐ অপয়ার বিয়ের খবর আমাকে শুনাইতে আসছো! কিছুটা আর্তনাদ করেই বললো কথাগুলো শিফা।

_চুপ করো শিফা। অনেক বেশি বলে ফেলছো কিন্তু। রাগী অথচ ঠান্ডা গলায় নিজের স্ত্রীকে সাবধান করলো পলাশ। কিন্তু শিফা দমবার পাত্রী নয়। স্বামীর এমন সতর্কবাণী যেন আরও বেশি অগ্রাসী করে তুললো তাকে।তারপর প্রবল ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে বললো,
_হবে না,কোনদিনও সুখী হবে না ঐ অপয়া, পোড়ামুখী।কোন অকালের অভিশাপে যে আমার সোনা ভাইটার সাথে তোমার ওই রাক্ষসী বোনটার বিয়ের খেয়াল আসছিল আমার মাথায়…আল্লাহ গো..সব শেষ করে ছাড়ালো ঐ অপয়া রাক্ষসীটা। মরে না ক্যান ঐ রাক্ষসী।মরলে পরে এত কষ্টের মধ্যেও আমার ভাইটা একটু শান্তি পাইতো।আর..
এরপর আর কিছু বলতে পারলো না শিফা। তার আগেই ধমকে উঠলো পলাশ।

_শিফা!!আর একটাও কথা বলবা না বলতেছি। কি শুরু করছো তখন থেকে হ্যাঁ? কি শুরু করছো!যা মুখে আসতেছে বলে যাচ্ছো আমার বোনের নামে। কি দোষ করছে ও? যা হইছে সব তোমার ঐ ক্রিমিনাল ভাইয়ের জন্য। কোন যোগ্যতাই ছিল ওর আমার বোনের পাশে দাঁড়ানোর। আমার বোনের পায়ের নখের যোগ্যতাও ছিল না ওর।তারপরেও শুধুমাত্র তোমার কথায়, তোমার চাওয়া রাখতে আমার অনার্স পড়ুয়া বোনটার বিয়ে আমি তোমার ওই ক্লাস এইট পাশ অশিক্ষিত ক্রিমিনাল ভাইটার সাথে দিতে গেছিলাম। আর তুমি? তুমি কি করছো হ্যাঁ? বাবা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বললো, কি সিনক্রিয়েটটাই না করলা!আরেএএ বাবা না হয় রাগের মাথায় বলছিল, তুমিও ক্ষমা চাও নাই একবারও।আমার বোনের এত বড় সর্বনাশ করতে চাওয়ার পরেও এতটুকু অনুতাপ নাই তোমার।আর সেই তুমি কিনা আমার বোনকে বলে যাচ্ছে তাই বলে?এত সাহস কি করে হয় তোমার?
আর কি যেন বললা!আমার বোনের জন্য তোমার মেয়ে ও বাড়ির আদর পায় নাই। আরেএএ, সেদিন বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করতে কে গেছিল সুইসাডের নাটক করতে?জন্মের পরে ওর মুখটাও তুমি দেখতে দাও নাই ওই পরিবারের কাউকে।তখন শুধু মাত্র আমার মেয়েটা তোমার গর্ভে ছিল বলে আর এখন ওর মা হিসেবে আছো বলেই এতদিনেও আমি তোমায় ছাড়ি নাই। নয় তো তোমার মত মানুষের সাথে একঘরে থাকতেও আমার অসহ্য লাগে। কথাগুলো বলেই ভাতের প্লেটে হাত ধুয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেল পলাশ। আর স্বামীর থেকে এতগুলো কথা শোনার পর অপমানে রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো শিফা।
_______________________________

ছাদের রেলিং এর কাছে দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে পলাশ।অতিরিক্ত রাগ বা টেনশনে পড়লে তার সিগারেট খাওয়ার মাত্রাও বেড়ে যায়। তিন বোনের মধ্যে পলক হলো তার সবচেয়ে আদরের। ৬ বছরের বড় হলেও পলাশের সবচেয়ে কাছের ছিল এই পলক। মায়ের দেখাদেখি সেও সাজি নামেই ডাকতে শুরু করে বোনকে। অন্য দু বোনের থেকে পলকের রুপ রঙ খানিক চাপা হওয়ায় বিশেষ খেয়াল আর আদরে রাখতো সে পলকে। সে যেদিন বাসা ছেড়ে এলো সে কি কান্না পলকের।তার ভাইটাকে ছাড়া যে একদমই চলে না। ও বাড়িতে যদি ওর সবচেয়ে কাছের কেউ ছিল সেটা ওর এই ভাইটা। ছোট থেকে এই ভাইটাই তাকে আগলে রেখেছিল। এই ভাইয়ের কথা রাখতেই এত কান্নাকাটির পরেও শেষমেশ বিয়েতে রাজি হয়েছিল সে।আর সেই কি না তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে! এসব ভাবতে ভাবতেই আবারও মনে পড়ে গেল পলকের বিয়ের দিনের কথা।

সেদিন বিয়ে ভাঙার কথা শুনে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন তাদের বাবা আমজাদ আলী।এমনতেই বড় মেয়ের জন্য সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে গেছিল।তার ওপর মেজ মেয়ের বিয়েটাও ভেঙে গেল।তাও ছেলের দোষে।এখন তো লোকে আরও ছিঃ ছিঃ করবে তাকে। শেষমেশ একটা অশিক্ষিত, ক্রিমিনালের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। এতটাই নির্দয় পিতা সে। লোকে ভাববে মেয়ের বোঝা ঘাঁড় থেকে নামাতেই এহেন কাজ করেছেন তিনি। এসব ভাবনা চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু অন্যদিকে শিফা নিজের ভাইয়ের এহেন পরিস্থির জন্য পলককে দায়ী করে যাচ্ছেতাই বলে সে পলককে।অশান্তি করে খুব। এসব শুনে আমজাদ আলী আর সহ্য করতে না পেরে অনেক অনেক কথা শুনিয়ে দেয় শিফাকে।শিফাও চুপ থাকে না। শশুড়ের সাথে তর্কে জড়িয়ে যায়। কথায় কথায় একপর্যায়ে শিফাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন আমজাদ আলী।রাগে অপমানে শিফাও বলে দেয় সে থাকবে না এই সংসারে। কিন্তু সে একা যাবে না। গেলে পলাশকেও সাথে যেতে হবে। কিন্তু পলাশ যেতে রাজি হয় না। সে ভাবে বাবা রাগের মাথায় বলেছেন আর শিফাও উত্তেজিত হয়ে এসব করছে।শিফার গর্ভধারণের বিষয়টা তখনো তার ও পরিবারের সবার অজানা। শিফা জানতো ঠিকই কিন্তু বলেনি কাউকে। আর যখন পলাশ রাজী হচ্ছিল না তখন সে গর্ভধারণের বিষয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

সেদিন..
_তুমি সত্যিই যাবা না আমার সাথে?
_না।এই বাড়ি আমার পরিবার ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। আর তুমিও যাবে না কোথাও। বাবা রাগের মাথায় বলেছেন এমন। দোষ তো তোমারই ছিল।বাবার সাথে ওভাবে কথা বলা একদম উচিৎ হয়নি তোমার।
_না। আমি আর এক মূহুর্তও থাকবো না এই বাসায়। আমি তো যাবোই সাথে তুমিও যাবা। আর না গেলে..
_আহ,শিফা।চুপ করো তো। আমি কোথাও যাবো না বলছি তো। তোমার যাওয়ার হলে তুমি যাও।আমি তোমার জন্য আমার পরিবারকে ছাড়তে পারবো না। আর তুমি যা করেছো তারপরে তো এসবের প্রশ্নই আসে না।
কথাগুলো মূলত কথার কথা হিসেবে বলেছিল পলাশ। শুধু মাত্র শিফাকে ভয় দেখিয়ে সেই সময়টুকুর জন্য চুপ করাতে। কিন্তু তার এমন কথার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিফা যা বলেছিল তা সম্পূর্ণ তার ধারণার বাইরে ছিল।তাকে বাধ্য করেছিল নিজের পরিবার ছেড়ে শিফাকে নিয়ে আলাদা থাকতে।

_আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি যাবা না আমার সাথে। এটাই তোমার শেষ কথা তো! তাহলে তুমিও শুনে রাখো,তুমি কালই আমাকে ডিভোর্স দিবা। আমি কালই এই বাচ্চাটার এবর্শন করে ফেলবো। আর যদি তাও না দাও তাহলে আমি সুইসাইড করবো। আমরা দুজনেই শেষ হয়ে যাবো।তখন আমার জন্য আর কোন দায় তোমার থাকবে না।

বাচ্চার কথা শুনে চমকে যায় পলাশ। আচমকা এমন একটা খবরের বিস্ময়, প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ,আর তারপরেই বাচ্চাটাকে হারানোর ভয় এই সব অনুভূতি একে একে এসে জাপটে ধরে তাকে।বিস্মিত ভয় মিশ্রিত কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করে, তুমি প্রেগন্যান্ট, শিফা?

শিফা চুপ।সে বুঝে গেছে তার মোক্ষম হাতিয়ার কাজে দিয়েছে। সে খুব ভালো করেই জানতো যে পলাশের বাচ্চা কতটা পছন্দের। বিয়ের পর পরই বাচ্চা নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু শিফা এত তাড়াতাড়ি মা হতে চায়নি। তাই এই সেই অযুহাতে নয় তো পলাশের অগোচরেই পিল খেয়ে গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকতো। এরপূর্বেও একবার সে গর্ভধারণ করেছিল। কিন্তু সকলের অগোচরেই মেডিসিন নিয়ে এবর্শন করে ফেলে বাচ্চাটার। এবারও সেটাই করার চিন্তাভাবনা করেছিল বলেই কাউকে কিছু জানায়নি। বিয়ের ঝামেলা মিটলেই তার এবর্শন করার প্ল্যান ছিল। কিন্তু পলাশকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করতেই অনিচ্ছা স্বত্তেও বাচ্চাটার কথা বলতে হলো তার।

_কি হলো, চুপ করে আছো কেন? তুমি কি সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্ট? কত দিন হলো? আর আমাকে জানাওনি কেন তুমি? এইই শিফা.. কথা বলছো না কেন তুমি? উত্তেজনায় ভেতর ভেতর কাঁপছে পলাশ। কথা জড়িয়ে আসছে তার।পলাশের এই মূহুর্তের অবস্থাটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারলো শিফা। তাই নিজের কাজ হাসিল করার জন্য শেষ দাউটাও সে চেলে ফেললো। মুখ খুললো শিফা।

_হ্যাঁ। দু মাস চলছে। এটুকু বলতেই পলাশ দৌঁড়ে এসে জাপটে ধরলো শিফাকে। পূর্বের ন্যায় আনন্দে উত্তেজনা ভরা গলায় বললো,থ্যাংক ইউ শিফা। থ্যাংক ইউ সো মাচ। তুমি নিজেও বুঝতে পারছো না তুমি কত বড় উপহার দিয়েছো আমাকে। খুব খুশি হয়েছি আমি।

খুব ধীরে পলাশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল শিফা। তারপর অতিব শান্ত গলায় বললো,
_খুশি হওয়ার কোন কারণ নেই পলাশ। যখন এই বাচ্চাটা জন্মই নেবে না তখন..। এটুকু শুনেই ধমকে উঠলো পলাশ।

_শিফা!!কি যা তা বলছো তুমি? জন্ম নিবে না মানে?আমার সন্তান জন্ম নিবে। এই পৃথিবীর আলোও সে দেখবে। আলো দেখবে সে।

_আমিই যখন থাকবো না তখন এই বাচ্চা জন্ম নিবে কিভাবে? তুমি আমাকে ডিভোর্স না দিলে আমি সুইসাইড করবো। আমার সাথে সাথে এই বাচ্চাটাকেও শেষ করে দিবো। তাই,হয় তুমি আমাকে নিয়ে তোমার সন্তানকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে নয় তো..
_না…তুমি আমার সাথে এটা করতে পারো না শিফা। বাচ্চাটা আমারও। তুমি একা ওর জন্য কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারো না।(পলাশের প্রকাশ্য প্রতিবাদ।)

_না পারার কিছু নেই পলাশ। বাচ্চাটার মা আমি। আমার গর্ভে আছে ও। আমার যা ইচ্ছা করতে পারি আমি নিজের সাথে…আর ওর সাথেও।(শিফার সহজ কথায় হুমকি।) এখন তুমি বলো, তুমি আমাকে নিয়ে আলাদা হবে নাকি..

_শিফা প্লিজ!! বোঝার চেষ্টা করো।এমনটা করলে তুমি শুধু আমাকে না, আমাদের অনাগত সন্তানকেও তার পরিবার থেকে দূরে করে দিবে। প্লিজ শিফা..একটু বুঝো! আমি তোমাকে খুব যত্নে রাখবো।ইনফ্যান্ট বাড়ির সবাই এই খবরটা শুনলে কতটা খুশি হবে তোমার ধারণা নেই। তারা তোমায় মাথায় করে রাখবে। আর বাবা…বাবার রাগও দেখবে থাকবে না আর। ঝোঁকের মাথায় কি না কি বলেছেন তাই ধরে তুমি চলে যেতে চাইছো। এমন পাগলামো করে না সোনা.. প্লিজ।
_ওর পরিবার বলতে তুমি আর আমিই যথেষ্ট হবো। অন্যকাউকে লাগবে না। এখন তুমি সিদ্ধন্ত নাও। তোমার এই বাচ্চা চাই নাকি একেবারে মুক্তি চাই আমাদের থেকে?

শিফা তার কথায় অনড়। পলাশের কোন অনুনয় তাকে তার এগুয়ে দাবী থেকে টলাতে পারলো না।তাই বাধ্য হয়ে পলাশকেও আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো।আলাদা হওয়ার কথা শুনে আমজাদ আলী মুখে মুখে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিলেন। নিজের বাচ্চাটার জন্ম হোক পৃথিবীতে তার জন্য নিজের জন্মদাতা জন্মদাত্রী বাবা মা, আদরের বোনগুলোকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল সেদিন তাকে।আমজাদ আলীর ভয়ে কেউ তার সাথে প্রকাশ্যে যোগাযোগ না রাখলেও তার মা নিজের একমাত্র ছেলেকে ছাড়তে পারেননি। শহর ছেড়ে অন্যত্র থাকায় বিগত ২’৫ বছরে দেখাও হয়নি একবারও।

একটা চাপা অপরাধবোধ আর বিষাদ ভরা শ্বাস ছেড়ে অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো পলাশ। হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটা ওভাবেই মেঝেতে ফেলে দিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। মেয়েটা যে তার ভীষণ বাবা ভক্ত। রাতে বাবাকে ছাড়া সে কিছুতেই ঘুমায় না। এত এত কষ্ট মানসিক যন্ত্রণার মাঝে এই মেয়েটাই যে তার একমাত্র আনন্দ আর সুখের খোঁড়াক।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_৮
©জারিন তামান্না

রাতে ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল পলক।ঠিক তখনই বুবু…বুবু ডাকতে ডাকতে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো নিশাত। প্রচন্ড উত্তেজিত সে।আচমকা তার এমন হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করায় হকচকিয়ে গেল পলক।কিন্তু পরমূহুর্তেই নিশাতের হাতে থাকা র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো বক্স তিনটে দেখতেই মুচকি হাসলো সে।বুঝে গেছে যে নিশাত এই বক্সগুলোর রহস্য উদ্ধার করতেই এভাবে এ ঘরে এসেছে। তাই,নিশাতের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পুনরায় মুখ মুছতে ব্যস্ত হয়ে গেল। এদিকে নিশাত বোনের এমন নির্বিকার ভাব দেখে বিচলিত হলেও সেটাকে আপাদত পাত্তা না দিয়ে যেমন উত্তেজিতভাবে ঘরে এসেছিল ঠিক তেমনই উত্তেজিত ভাবে পলকের উদ্দেশ্য বললো,

_বুবু..মাসের মাঝ সময়ে এগুলা আবার কি কিনছিস তুই? আবার চোরের মত আলমারিতে রেখে আসছিস!আমি কতবার মানা করবো এভাবে আমার জন্য এটা সেটা না কিনতে?শুধু শুধু টাকা খরচ করিস ক্যান এভাবে?

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হাতে মশ্চারাইজার মাখছিল পলক। ওই অবস্থাতেই নিশাতের দিকে না তাকিয়েই বললো,
_আমি আবার কই কি কিনলাম। আমি তো কিছু কিনি নাই তোর জন্য। এগুলোও আমি দেই নাই।
পলকের এহেন কথা শুনে ভ্রু কুচকে গেল নিশাতের।ওভাবেই পলকের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো সে।কিন্তু বোনও তো তার মিথ্যা বলার পাত্রী নয়। তাহলে কে দিল এগুলা?মনের কথাটা এবার সে মুখেই বলে ফেললো,

_তুই দিস নাই,আম্মা তো বাইরেই যায় না তেমন । আব্বা তো ভুলেও দিবে না,যে হিসাবি মানুষ।প্রয়োজনেও তো এক আনা বেশি খরচ করতে দশবার ভাবে,,সে কি না মাসের মাঝ সময়ে এতগুলা গিফট দিবে?উহু…অসম্ভব এইটা!! তাইলে কে দিল বলতো?তাও আমার ঘরে আমার আলমারিতে রেখে আসছে!কে হইতে পারে?!বেশ ডিটেকটিভ টাইপ ভঙ্গিতে চোর ধরার তদন্তে একের পর এক যুক্তি সাজাচ্ছে নিশাত।বোনের এই কাজ দেখে এবার পলক না হেসে পারলো না। হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়ালো টুলটা ছেড়ে। চুলে বেণী করছিল সে। রাবার ব্যান্ডটা চুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে এগিয়ে এসে পেছন থেকে বোনকে জড়িয়ে ধরলো সে। তার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে কানের কাছে খানিকটা ফিসফিসিয়ে সেও বললো,
হুম…কে দিলো বলতো?!কে হইতে পারে? উউউউমমম… জ্বীন ভূত না তো! বলেই আবারও জোরে জোরে হাসতে লাগলো।

আসলে সে সবটাই জানে।তাও কিছু বললো না সে।আজ বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে যাওয়ার সময় সিফাতই বক্সগুলো পলকে দিয়েছিল। বলেছিল, যেন নিশাতকে এগুলো দিয়ে দেয়। এটা নাকি ভাইয়ার পক্ষ থেকে তার ছোট আপুর জন্য উপহার।পলক প্রথমে নিতে না চাইলেও শেষের কথাটার পরে আর ফেরাতে পারেনি। তাই,একপ্রকার সারপ্রাইজ দিতেই বাড়ি এসে চুপিচুপি গিয়ে ওগুলো বোনের আলমারিতে রেখে এসেছে। সে ভালো করেই জানতো,এগুলোর রহস্য উদ্ধার করতে বোন তার, তার কাছেই আসবে।

ওদিকে পলকের এমন কথা শুনে বিরক্ত হয়ে তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল নিশাত। সামনে ঘুরে কোমড়ে দু হাত রেখে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললো,
_এত রাতে ফাইজলামি করতেছিস তুই আমার সাথে?আমি জ্বীন ভূতে বিশ্বাস করিনা,এইটা জানিস না তুই?
_হ্যাঁ,জানি তো। (পলকের মুখে দুষ্টু হাসি)
_তাইলে এসব ক্যান বলতেছিস?আচ্ছা, সত্যি করে বলতো, তুই রাখিস নাই এগুলা আমার আলমারিতে?
_হ্যাঁ,আমিই রাখছি,কিন্তু আমি দেই নাই এগুলা।পলকের সহজ সরল স্বীকারোক্তি । আর বোনের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে কপাল কুঁচকে গেল নিশাতের। সহসা চিন্তিত স্বরেই প্রশ্ন করলো,
_তুই দিস নাই,তাইলে কে দিলো? আর আছেই বা কি এগুলায়?
_সেটা তুই বক্সগুলা খুলেই দেখ না!আমাকে কেন জিজ্ঞেস করতেছিস?
_আরেএএ..আশ্চর্য!বক্স তুই না দিলি,আনছিস তো তুই-ই নাকি?তাহলে তুই জানিস না কে দিলো এগুলা?
_হ্যাঁএএ..তা জানি।কিন্তু তাও আমি কিছু জানি না।(দুষ্টু ভঙ্গিতে বললো পলক।)
বোনের এমন কর্মকান্ডে নিশাতের বিরক্তি এবার চরম পর্যায়ে পৌছালো।বক্সগুলো নিয়ে পলকের বিছনার উপর রেখে বললো,
_যার জিনিস তারে ফিরায় দিস তাহলে। কোন অজ্ঞাত ব্যক্তির দেওয়া উপহার আমি নিই না।
বলেই হনহনিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো সে। কিন্তু দরজার কাছে যাওয়ার আগেই পলক হাত টেনে ধরে থামিয়ে নিল ওকে। এরপর আদুরে গলায় বললো,
_এইই..মেয়ে!এত রাগ কিসের হুম?বলেই নাক টেনে দিল বোনের। কিন্তু নিশাতের কোন ভাবান্তর হলো না এতে। সে আগের মতই মুখভার করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইলো। বোনের এমন ভাব দেখে বড্ড হাসি পেলো পলকের। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়া মেয়ে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চামো স্বভাবটা তার আজও গেল না। মনে মনে কথাগুলো ভেবে মুচকি হাসলো সে। তারপর বোনকে ছেড়ে বিছানা থেকে বক্সগুলো হাতে নিয়ে গিয়ে দিল তার দিকে। বললো,
_এগুলো তোর জন্যই। এতদিন যেগুলো ফিরিয়ে দিতি সেই ব্যক্তি তোকে বলতে বলেছেন যে, এগুলো তিনি তার ছোট আপুকে দিয়েছেন। এবং তুই নিজেই নাকি এবার এগুলো এক্সেপ্ট করবি।এটা তোদের ডিল ছিল। তাই আমিও তার দেওয়া উপহার তোর অবদি পৌঁছে দিয়েছি।

পলকের কথা শুনে এবার আর নিশাতের বুঝতে বাকি রইলো না এগুলো কে দিয়েছে। কারণ,প্রতিবার দেখা হওয়ার সময় সিফাত টুকটাক উপহার নিয়ে আসতো নিশাতের জন্য। কিন্তু নিশাত নিতো না। বলতো,যেদিন আমার বুবু আপনাকে এক্সেপ্ট করবে,আপনি আমার দুলাভাই হবেন সেদিন মিষ্টি মুখ করবো।চকলেট চাই অনেকগুলো।আর আজ সেই উপহারই সে পেয়েছে।

মূহুর্তেই আনন্দে, উত্তেজনায় চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। দ্রুত বক্সগুলো পুনরায় বিছানায় রেখে এসে পলকের দুহাত তুলে নিজের দুহাতের মুঠোয় নিল।শক্ত করে ধরে খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_তুই ভাইয়ার সাথে মিট করছিলি?
বোনের এমন খুশি আর উত্তেজনা দেখে পলক সহসা লজ্জা পেয়ে গেল।লাজুক হেসেই মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে জবাবে হ্যাঁ বোঝালো।নিশাত বোনের এমন লাজুকতা দেখে খুশিতে আরও বেশি গদগদ হয়ে উঠলো। তার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ পলকের হাত দুখানা হাল্কা ঝাঁকুনি দিয়ে আবার প্রশ্ন করলো,
_কবেএএ?? কখন? কোথায়? কি বললো ভাইয়া?এইইই বুবু বল না!
বোনের একনাগাড়ে করা একেরপর এক করা প্রশ্নে পলকের হিমশিম অবস্থা।একদিকে একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরেছে তাকে, অন্যদিকে ছোট বোনের একের পর এক প্রশ্ন। কি বলবে না বলবে সব গুলিয়ে গেল তার। এদিকে নিশাত উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। পলক কি বলবে সেটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু পলক কিছু বলছে না। তাই তাকে তাড়া দিয়ে আবার বললো,
_কি রে বুবু.. এখন মুখে কুলুপ এঁটে আছিস ক্যান!বলনা,কবে মিট করলি তোরা?
বোনের এমন তাড়া খেয়ে মুখ খুললো পলক। লাজুক ভঙ্গীতেই জবাব দিল,
_আজ দুপুরে। উনি লাঞ্চে ইনভাইট করেছিলেন।
_ওয়াওও…সো রোমান্টিককক!!! উচ্ছ্বসিত স্বরে বললো নিশাত। এতক্ষণ লজ্জায় মাথা নীচু করে কথা বলছিল পলক। কিন্তু রোমান্টিক শব্দটা শুনে চকিতেই তাকালো বোনের দিকে। বড় বড় চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সে। এদিকে বোনের এমনভাবে তাকানো দেখে সজোরে হেসে দিল নিশাত। তারপর বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
_I’m so happy for u, bubu!এভাবেই আল্লাহ তোকে দুনিয়ার সব সুখ দিক।খুব খুব সুখে থাক তুই। অবশ্য তুই সুখে থাকবিই। আল্লাহ এমন একজন মানুষকে তোর জীবনে দিয়েছেন যে তোকে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না। ভাইয়া খুব ভালো একজন মানুষ রে বুবু। তোকে খুব ভালোবাসে। সারাজীবন আগলে রাখবে। খুব… খুব… খুব ভালো থাকবি তুই। খুব ভালো থাকবি।
বোনের এমন কথা শুনে মূহুর্তেই চোখ ভিজে এলো পলকের। না পারতে দুই চারটে ফোঁটা জল বেরিয়ে এলো অবাধ্য চোখের কার্ণিশ বেয়ে। ওদিকে কাঁধে উষ্ণ কিছুর অনুভব হতেই বোনকে ছেড়ে তার মুখের দিকে তাকালো নিশাত। বোন তার কাঁদছে। মেয়েটা বড্ড ইমোশনাল । কিন্তু এখন সেটা শুধু ভেতর ভেতরেই। বিগত ২’৫ বছরের ঘটনাগুলো বেশ বদলে দিয়েছে তার বোনকে। বাইরে থেকে নিজেকে যতটা না শক্ত দেখায় ভিতর থেকে ঠিক ততটাই শক্ত আজও সে হয়ে উঠতে পারেনি। তাই সহসা সে কখনোই এভাবে কান্নাকাটি করে না। কিন্তু আজ সে কাঁদছে। আর এটা তার সুখের কান্না। এটা নিশাত জানে। তাই বোনকে আচমকা এভাবে কাঁদতে দেখে বিচলিত হলো না সে। বরং পলকের চাইতেও কয়েকগুণ বেশি সুখানুভূতি এসে ভর করলো তাকে। আর সেই সুখানুভূতিটুকুর রেশ ফুটে উঠলো তার চোখে মুখেও। মৃদু হেসে বোনের মুখখানা দু’হাতের আঁজলায় নিতে তার কপালে গভীরভাবে একটা চুমু খেলো।তারপর, নরম গলায় বললো,
_সুখ পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদে কাঁদতে হলেও সুখ পাওয়ার পর তার শুকিয়া করতে হয়।তাই,এখন এমন ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না বন্ধ কর। আর বেশি কাঁদতে ইচ্ছে করলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদ। প্র্যাক্টিস হয়ে যাবে। তারপর বিয়ের বিদায়ে কাজে দিবে।বলেই সকৌতুক হাসলো নিশাত।

বোনের এহেন কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিল পলক। হাল্কা হাতে চাপড় মাড়লো নিশাতের বাহুতে।
বোনের হাতে চাঁপড় খেয়ে নড়েচড়ে উঠলো নিশাত। দ্রুত হাতে বোনের চোখ মুছে দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসালো।বললো,
বুবু…চল,বক্সগুলা খুলে দেখি।বলেই বক্সের উপরের বাঁধা ফিতাটা খুলতে শুরু করলো। পলক মুখে কিছু বললো না। চুপচাপ পাশে বসে বোনের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলো।

এতক্ষণে প্রথম বক্সটা খোলা হয়ে গেছে নিশাতের।বক্স খুলতেই দেখলো,বিশাল সাইজের একটা কিটক্যাট চকলেটের বক্স। বক্সটা দেখেই ভীষণ খুশি হয়ে গেল নিশাত।কারণ, এটা তার প্রিয় চকলেট। এরপরের বক্সটা খুলতেই আরেকটা চকলেটের বক্স পাওয়া গেল। কয়েকপদের চকলেটের মিক্স কম্বো প্যাক। কিন্তু শেষ বক্সটা খুলতে গিয়েই বক্সের উপর একটা ছোট চিরকুট পাওয়া গেল। খুব সুন্দর হাতের লেখায় তিন লাইনের একটা চিরকুট। নিশাত সেটাকে জোরে জোরে পড়লো,যেন পলকও শুনতে পায়।
“ছোট আপু, উপরের দুটো বক্স তোমার জন্য। আর এই একটা বক্স মৃণ্ময়ীর জন্য।তার অবদি পৌঁছে দিও প্লিজ!”
– সিফাত

মৃন্ময়ী নামটা দেখেই ভ্রু কুঁচকে গেল নিশাতের। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে পলকের দিকে তাকাতেই দেখলো পলকের দৃষ্টি চঞ্চল। বেশ ইতস্তত করছে সে। সন্দিহান হয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো নিশাত।
_হ্যাঁ রে বুবু,এই মৃন্ময়ীটা কে রে?
পলক কিছু বললো না। পূর্বের ন্যায় কাচুমাচু করতে লাগলো।নিশাত বুদ্ধিমতী মেয়ে। বোনকেও সে খুব ভালো করেই চিনে। তাই চট করেই মনে উদয় হওয়া প্রশ্নটাকে মুখে করেই ফেললো,
_ভাইয়া তোকে মৃন্ময়ী বলে ডাকে,তাই না রে বুবু??
পলক নিশ্চুপ। লজ্জা পাচ্ছে সে। বোনের এই নিরবতাকেই তার সম্মতি ধরে নিয়েই মুচকি হাসলো নিশাত। বক্সটা আস্তে করে বোনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
_তোর বক্স তুই রাখ বুবু,আমি বরং যাই এখন। গুড নাইট। বলেই দুষ্টু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

________________________________

ডিনার শেষ করে রিহানের সাথে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল সিফাত। গন্তব্য নিজের বেডরুম। হঠাৎ পকেটে রাখা ফোনটার ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। ফোনটা বের দেখলো পরপর দুটো ম্যাসেজ। একটা নিশাতের নাম্বার থেকে আর অন্যটা পলকের। নিশাতের ম্যাসেজটা এসেছে মিনিট ২০ আগে। আর পলকের ম্যাসেজটা এই মাত্রই এলো।তবে, দুটো ম্যাসেজ দেখেই অবাক হলো সে। কারণ,দুটোতেই তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। তফাৎ শুধু এতটুকুই যে নিশাতের ম্যাসেজটায় লিখা,
_Thank u vaia. apnar mrinmoyir kachew tar box ta powche geche.
আর পলকেরটার ম্যাসেজটা বাংলায় ছোট্ট করে লেখা, ধন্যবাদ!
ম্যাসেজগুলো দেখে আপন মনেই হাসলো সে। আর সাথে সাথেই হাসি হাসি মুখেই নিশাতকে রিপ্লাই দিলো,
_you most welcome dear little sister.always stay blessed.
তার হাসি দেখে চকিতেই রিহান জিজ্ঞেস করলো,
_What happen bro.?why r u smiling so cute?ভাবীর ম্যাসেজ, না?? বলে সেও দুষ্টু হাসলো।
_হ্যাঁ। সিফাতের অকপট স্বীকারোক্তি।রিহানের কাছ থেকে এসব লুকানোর মত না।
_আআআ..হাআ!তাহলে তো এখন তোমাকে ডিস্টার্ব করা যাবে না।আমি বরং যাই এখন কেমন? তুই ভাবীকে সময় দে। বলেই চোখ মারলো রিহান।
রিহানের এমন কথায় খানিক লজ্জা পেয়ে গেল সিফাত। তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
_এমন কিছুই না,রিহান।আর আমি মোটেও ডিস্টার্ব হচ্ছি না। চল, আমার ঘরে যাই।গেম খেলি কিছুক্ষণ দুজনে।
_no..bro . আজ থাক। আজ এমনিতেই অনেক টায়ার্ড তুই। অন্য কোন দিন খেলবো।তাড়াছা,কাল সারাদিনও তোর ইয়ানার জন্য বুকড। You need to be energiesed yourself. তাই হয় তুই ভাবীকে একটু সময় দে, নয় তো যা..ঘুমিয়ে পড় গিয়ে।Good night bro. বলেই সিফাতকে hug করে দ্রুত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো রিহান। পিছন থেকে দুবার ডাকলো সিফাত রিহানকে।কিন্তু রিহান,
_See u tomorrow, dear. বলেই দ্রুত পায়ে করিডোর ছেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। অগ্যতা সিফাতও Good night বলে ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে ঘরের চলে গেল।

________________________________

বিছানা পরিপাটি করে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল পলক।ঠিক তখনই বেড সাইড টেবিলের উপরে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিতেই দেখলো ফোনের স্ক্রিনে একটা নাম ভেসে উঠেছে। Captain calling. এরমানে সিফাত কল করেছে।মূহুর্তেই একরাশ লজ্জা,জড়তা এসে ভর করলো পলককে। বুকের ধুকপুকুনিটাও যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেল। কি আশ্চর্য! পলক নিজেই নিজের সেই বেড়ে যাওয়া ধুকপুকুনির আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ভাবতেই আরও খানিক লজ্জা পেয়ে গেল সে।ইইইশশশ, আজ বোধয় তার লজ্জা দিবস! এটা ভাবতেই আপনমনেই হেসে উঠলো সে। দু তিন বার রিং হওয়ার পরে কলটা রিসিভ করলো সে।কল রিসিভ করতেই আজ প্রথমেই সিফাত সালাম জানালো,
_আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। ধীরস্বরে জবাব দিল পলক।
_কেমন আছেন?
_জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
_হ্যাঁ,ভালো আছি।রাতে খেয়েছে?
_জ্বী,আপনার খাওয়া হলো?
_হ্যাঁ,,খেয়েদেয়ে ঘরেই আসছিলাম।তখনই আপনার ম্যাসেজ পেলাম।কিন্তু কি জন্য ধন্যবাদ জানালেন সেটা ঠিক বুঝিনি।তাই কল করলাম আপনাকে। আপনার থেকেই জেনে নেব বলে।সিফাতের চোখে মুখে দুষ্টিমির আভাস। কারণ, সে জানে যে পলক তাকে দেওয়া তার দেওয়া প্রিয় চকলেটে ঠাসা ওই বক্সটার জন্যই তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। কিন্তু তাও সে পলকের মুখেই কারণটা শুনবে বলেই ওভাবে অবুঝ হওয়ার ভান করলো। এদিকে পলক চিন্তায় পড়ে গেল
। কি বলবে, কিভাবে বলবে এই ভেবে। লজ্জা লাগছে তার। চুপ করে রইলো সে। ওদিকে পলকের সাড়া না পেয়ে সিফাত ফোন চেক করলো। নাহ,লাইনে আছে তো। তাহলে কথা বলছে না কেন! সিফাত জিজ্ঞেস করলো,
_Hello, Mionmoyi. Are you there?শুনতে পাচ্ছেন?
সিফাতের কথায় ঘোর কাটলো পলকের। চকিতেই জবাব দিল,
_হ্যাঁ,শুনছি।বলুন আপনি।
_শুনতে পাচ্ছেন তাহলে চুপ করে ছিলেন কেন?
_এমনি।
_আচ্ছা, ছাড়ুন এটা। কি জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন সেটা বলুন।
_ও..ও .. ওটা..
_হ্যাঁ,ওটা?
_ওই আর কি! এমনি বলেছি আর কি।
_এমনি এমনি কেউ কাউকে ধন্যবাদ জানায় বুঝি? কই আমার তো আগে জানা ছিল না। তবে আজ জানলাম আপনার সুবাদে। ধন্যবাদ আপনাকে,মৃন্ময়ী। একনাগাড়ে কথাগুলো বললো সিফাত।
পলক আবারও প্যানিক হয়ে গেল। এ মানুষটা এমন কেন! কি ভাবে ধন্যবাদ বলছে তাকে। কিন্তু কি বলবে সে এখন। খানিক ইতস্তত করে চোখ খিঁচে বন্ধ করে দ্রুত বেগে পলক বললো,
_আমাকে যে চকলেটগুলো দিয়েছেন ওগুলোর জন্য ধন্যবাদ। বলেই সজোরে একটা শ্বাস ফেললো সে।যেন মাত্রই অনেক বড় কোন কার্যসিদ্ধি করে ফেলেছে সে। আর সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে জোরে জোরে হাসির শব্দ শোনা গেল। সিফাত হাসছে। প্রাণখোলা সে হাসি। পলক হতভম্ব! কি এমন বললো সে যার জন্য এভাবে হাসছে মানুষটা?!

_আপনি এভাবে হাসছেন কেন? পলকের বোকা মনের প্রশ্ন। পলকের এমন প্রশ্ন শুনেই হাসি থামিয়ে দিল সিফাত। নিজেকে সামলে নিয়ে তারপর বললো,
_I’m sorry. actually আপনার এমনভাবে বলা কথাটা শুনেই হাসি পেয়ে গেছিল। বলেই আরও একচোট হাসলো সে। সিফাতের এমন সকৌতুক আচরণে মন খারাপ হয়ে গেল পলকের। অভিমানও এসে জড়িয়ে ধরলো আলতো করে। তারপর সেই আলতো অভিমানী স্বরেই বললো,
_অহ।
প্রেয়সীর এমন ধাঁচের গলার স্বরেই সিফাত বুঝে গেল, অভিমান করেছে তার মৃন্ময়ী।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করলো সে,
_তাহলে কি ভাবলেন, সময় চাই আপনার নাকি..
_কিছুটা সময় দিলে ভালো হতো।
_বেশ।তবে এক মাস সময় দিচ্ছি আপনাকে।এরবেশি সময় দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। চলবে তো?
_জ্বী।
_ok. নেক্সট উইক আমার পরিবারকে পাঠাচ্ছি তবে।বিয়ের ডেট ফিক্স করতে। ঠিক আছে?
_আচ্ছা।
পলকের নিরস কণ্ঠস্বর। ফোনের ওপাশের মানুষটা সেটা ঠিক বুঝলো।তাই এই মূহুর্তে কথার মোড় বদলে বললো,
_আজ অনেক প্রেশার গেছে। বড্ড টায়ার্ড লাগছে।
_তাহলে এত রাত অবদি জেগে আছেন কেন?ঘুমিয়ে যান।
_হ্যাঁ,ঘুমাবো। কাল আবার আরেক দফা ব্যস্ত দিন কাটবে। কালকের দিনটা শুধু মাত্র ইয়ানার জন্য বুকড। আর তারপরের দিন চিটাগাং যাবো। একটা বিজনেস মিটিং আছে। টানা শিডিউল।
ইয়ানা নামটা শুনে মূহুর্তেই কিছু ভাবতে পারলো না পলক। তাই প্রশ্ন করলো,
_ইয়ানা?
_ও..হ্যাঁ! আপনাকে তো ওর কথা বলাই হয়নি। ইয়ানা আমার বড় সন্তান। আর ভবিষ্যতে আপনারও মেয়ে ।

চলবে….