ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-৪+৫+৬

0
551

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_৪
©জারিন তামান্না

একটা ফাইভ স্টার হোটেল বসে আছে পলক। সিফাতের অপেক্ষায়। সে রাতে যখন পলক তার সাথে ঘটা আজকের ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে ভ্যাবাচ্যাকা দিবস পালন করছিল আর সিফাত তার মৃন্ময়ীতে মশগুল,তখনই কথায় কথায় আজকের দেখা করার প্রস্তাব রাখে সিফাত। সে রাতে…

_কাল দুপুরে আমার ফ্লাইট। ইউএস যাচ্ছি। ৩ দিন পরে ফিরবো।

_অহ। বলেই চুপ করে গেল পলক।:

_বিয়ের ডেট ফাইনাল করবো। কিন্তু আপনার উত্তর না পেলে তো ফাইনাল কিছু বলতে পারছিনা তাদের। তখন তো ছাদে কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।তাই উত্তর জানতেই কল করেছিলাম। (সিফাতের নির্বিকার কথা।)

_কিসের উত্তর?

এবার সিফাতের মেজাজ পুরোপুরি বিগড়ে গেল।এই মেয়ের মেমোরি এত খারাপ কেন?এই মেমোরি নিয়ে সে কি না টিচারগিরি করে। এত এত বাচ্চা কাচ্চা পড়ায়। নাকি আমার বেলাতেই তার মেমোরি ড্যাম!

খিঁচানো মেজাজের স্বরেই সে বললো,এই নিয়ে তৃতীয় বার বলতে হচ্ছে কথাটা আমাকে। ৩য় বার কথাটা শুনেই দুপুরের কথাটা মনে পড়ে গেল পলকের। যে প্রশ্নের মাধ্যমে আজ তার ভ্যাবাচ্যাকা দিবসের উদ্বোধন হয়েছিল। কিন্তু সবটা জেনেও সে চুপ করে রইলো। বলবে না সে কিছু। এমন কথা কি এভাবে মুখে বলা যায় নাকি! এই লোকটা পারলেও সে পারবে না। তাই চুপ করেই থাকবে। যা বলার সেই বলুক।

_আমরা ভালোবেসে বিয়ে করবো নাকি বিয়ের পর ভালোবাসবো?? দাঁতে দাঁত চিপে বললো সিফাত।

_এসব কি কথা! এরেঞ্জম্যারেজে তো যা হওয়ার বিয়ের পরেই হয়। বিয়ের আগে কিভাবে…

সিফাত বুঝে গেছে। এভাবে বললে পলক বুঝবে না। তাকে ব্যাপরটা এবার পোস্টমর্টেম করেই বোঝাতে হবে। এই মেয়ে যে কি করে টিচার হলো আল্লাহ মালুম। মনে মনে কথাটা বললেও মুখে বললো অন্য কথা।

_ওকে ফাইন।ছাড়ুন এখন। আপনি বরং একটা কাজ করুন..

_কি কাজ? পলক অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করলো।

_৩ দিন পর আমি দেশে ফিরবো। মিট করতে পারবেন?

দেখা করার কথা শুনে কিছুটা দ্বিধায় পড়লো পলক। কিন্তু তারও তো দেখা করাটা দরকার।উনি বিয়ের ডেট ফিক্স করার কথা বলছেন।কিন্তু তিনি তো জানেন না এখনো কিছু। সত্যিটা তো উনাকে জানাতে হবে।এরপর তো বিয়েটাই আর হবে না!এসব সাত পাঁচ ভাবছে পলক। আর ওদিকে ফোনের ওপাশে সিফাত অপেক্ষা করছে তার মৃন্ময়ীর জবাবের।
খানিক সময় নিয়ে ভাবলো পলক। তারপর রাজি হয়ে গেল। সত্যিটা সে মুখোমুখি হয়েই বলতে চায়। তাই দেখা করার সুযোগটা তার মিস করা উচিৎ হবে না।

_হ্যাঁ,,পারবো।
_ওকে। আমি তাহলে সময় আর এড্রেসটা আপনাকে পরে জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি একবার চেক করে নেবেন। আপনার শিডিউলের সাথে ম্যাচ করে কিনা।

_জ্বী,আচ্ছা।

ঘড়িতে সময় দেখলো সিফাত। রাত ১২:২০ বাজে। কাল দুপুর ৩ টার ফ্লাইট তার। বাসা থেকে বেরোতে হবে ১২ টা নাগাদ। আজ সারাদিন বেশ ধকল গেছে। এখন একটা ফ্রেশ ঘুম দরকার। নয় তো কাল সমস্যা হতে পারে।তাই ভণিতা ছাড়াই সে বললো,

অনেকটা রাত হয়েছে।ঘুমোন এবার। আমারও ঘুমাতে হবে।কাল দুপুরের ফ্লাইট আমার।

_অহ,আচ্ছা। সাবধানে যাবেন। কথাটা বলে পলক আরও একবার ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। কেন বললো সে এমন?তাও আবার উনাকে! নিজের কাজে নিজেই ব্যাক্কল বনে গেল সে। লজ্জাও পেল খানিক। তাই চুপ করে গেল।

ওদিকে পলকের কথা শুনে মুচকি হাসছে সিফাত। ভালো লাগছে তার।তার মৃন্ময়ী তাকে নিয়ে ভাবছে। ভালোবাসার অফুরন্ত জার্নিতে তবে কি এটাই তাদের প্রথম পা ফেলা?কথাগুলো ভেবতেই মুখের হাসিটা আরও চওড়া হলো তার। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সেও সম্মতি জানালো।

_হুম। রাখছি তবে আজ। দেখা হবে ইন শা আল্লাহ।
_জ্বী।
_ভালো থাকবেন মৃন্ময়ী।
_জ্বী..আপনিও।
_গুড নাইট। বায়।
_গুড নাইট।আল্লাহ হাফেজ।
মৃদু হাসলো সিফাত। হাসি মুখে ধরে রেখে সেও বিদায় জানালো তার মৃন্ময়ী কে।
_আল্লাহ হাফেজ।

এরপর আরও কিছুটা সময় সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকলো। কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে তার। অন্য রকম একটা ভালো লাগায় ছেয়ে আছে মন। জীবনের বিশেষ মানুষের আগমন ঘটলে বুঝি এমনই লাগে?

ওদিকে, পলক চুপচাপ বসে আছে খাটে হেলান দিয়ে। কিছুক্ষণ আগে ঠিক কি ঘটলো তার ছক মেলানোর চেষ্টা করছে। আজ সারাদিন কত কি ঘটে গেল। একটা অন্য রকম মানুষের আগমন ঘটেছে তার জীবনে।কিন্তু সত্যি জানার পর এই মানুষটাও যে অচিরেই হারিয়ে যাবে এটা ভেবেই মন বিষাদে ভরে উঠলো তার। কিন্তু,,তারও কিছুই করার নেই। ভাগ্যে যা নেই তার জন্য কষ্ট পাবে না সে। এখন শুধু দেখা হওয়ার অপেক্ষা..তারপর আরও একবার শুরুর কথা বলার আগেই শেষ!
_________________________________

দুপুর ২:১৫ বাজে।প্রায় মিনিট ১৫ হলো সে একা একা বসে আছে। সিফাতের অপেক্ষা করছে। গতকাল হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট করে সময় আর এড্রেস জানিয়ে দিয়েছিল সিফাত। সাথে এও জানিয়েছিল যে সে আগে থেকেই টেবিল বুকিং দিয়ে রাখেছে। পলক যেন ঠিক সময় মত পৌঁছে যায়। সেদিনের পর আর একবারও যোগাযোগ হয়নি তাদের।আর আজ সরাসরি দেখা হবে।

আরও মিনিট ৪ পরে দেখা মিললো সিফাতের। হাতে ছোট একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে রেস্টুরেন্টের গেট দিয়ে ঢুকছে। পরনে বাংলাদেশ পাইলটের পোশাক। শুভ্রতায় ছেয়ে আছে মানুষটা। মাথায় ক্যাপ। চোখে কালো সানগ্লাস।হাতে সিলভার কালারের মোটা চেইনের ব্রেন্ডড ঘড়ি।পায়ে পলিশড সুজ।বেশ লাগছে তাকে। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি এখানেই এসেছে সে। পলক যে একধ্যানে তাকিয়ে আছে তো আছেই। সেদিন খুব একটা ভালো করে দেখা হয়নি। ছবিও নেই তার কাছে কোন। তাই আজ যখন দেখছে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। ফর্সা গায়ের রঙ।গড়নেও বেশ লম্বা চওড়া মানুষটা। তাকে এভাবে দেখে তার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো,মাশাল্লাহ! সিফাত দূর থেকে পলকে দেখতে পেয়েই একগাল হেসে দিল। যেন এবার হুশ হলো। ইশশশ..কি।বেহায়ার মত তাকিয়ে ছিল সে মানুষটার দিকে। না জানি সে কি ভাবলো। মনে মনে কথাগুলো বিড়বিড় করলো পলক। অবশ্য এমন কথা বলার মতই,যে মেয়েটা কখনো কোন ছেলেকে নিজের দৃষ্টিসীমানায় ঘেঁষতে দেয় না,সেই মেয়েটাই আজ কাউকে দেখে বেহায়ার মত তাকিয়ে দেখছিল। ব্যাপারটা প্রথমবার হলো। তাই পলকের জন্য এটা যেমন অবাক হওয়ার মত তেমনি লজ্জ্বারও। দ্রুত চোখ নামিয়ে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ‘Hi’বলতেই পলকের ঝটপট প্রতিউত্তর,
_আসসালামু আলাইকুম।
পলকের সালাম জানানো দেখে একমূহুর্ত থমকে গেল সিফাত। সে তো ভুলেই গেছিল,তার মৃন্ময়ী এসব হাই-হ্যালোর চাইতে বেশি সালামে অভ্যস্ত। এটা মনে হতেই মৃদু হাসলো সে। হাসি মুখেই সালামের জবাব দিল।

_ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন মৃন্ময়ী?
পলক এবার সত্যিই বিচলিত। তার চোখ মুখে সে ভাবটাও সুস্পষ্ট। ভ্রুকুটি কুচকে তাকালো সে সিফাতের মুখের দিকে। উদ্দেশ্য কিছু একটা বুঝতে চাওয়ার কিংবা কোন গভীর রহস্য উদ্ধার করার।
পলকে নিজের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিফাতও এবার ভ্রুকুটি কুচকালো। একবার দেখলো নিজেকে। নাহ সবই তো ঠিক আছে। এবার তার কপালেও চিন্তার ভাজ। পলক চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। তাই সিফাত নিজেই জানতে চাইলো।
_ এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন মৃন্ময়ী ?আমাকে কি খুব বেশিই সুন্দর লাগছে আজ?যদিও এত ঘন্টা ফ্লাই করে আমি কিছুটা.. উমমম..না,বেশ ভালোই ক্লান্ত! তাও কি খুব বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে আমায়???

সিফাতের এমন কথায় পলক যেন তার রহস্য উদঘাটনের জন্য মাঠে নামতেই বিশাল বড় গোল খেলো। একেবারে উস্টা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার মত অবস্থা হলো তার। সে এতটাই হতভম্ব আর লজ্জিতবোধ করলো যে তার মুখে সে স্পষ্ট দেখতে পেল সিফাত। পলক ব্যাক্কলের মত তাকিয়ে আছে। আর সেটা দেখে সিফাত মিটিমিটি হাসছে।
এটা দেখে এবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো পলক। তবে সেটা ভেতর ভেতরেই। বাইরে থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখেই বললো,
_এ এএ এই সব কি বলছেন! এমন কিছু না।
_কেমন কিছু না?
সিফাতের এমন প্রশ্নে এবার সত্যিই বিপাকে পড়লো পলক।কি বলবে সে? এটা বলবে যে আপনাকে সুন্দর লাগছে না।আর আমি মোটেও আপনাকে দেখছিলাম না। আমি তো অন্য কিছু ভাবছিলাম। ধুর,এভাবে কি বলা যায় নাকি!

পলকে এভাবে নাস্তানাবুদ হতে দেখে বেশ মজা পেল সিফাত। যদিও সে জানে মেয়েটাকে এভাবে পেরেশান করাটা তার মোটেই ঠিক হচ্ছে না।কিন্তু কেন জানি এই সব ধরণের অন্যায় তার শুধু এই মেয়েটার সাথেই করতে ইচ্ছে করে। মেয়েটা যখন হতভম্ব হয়ে কথা হারিয়ে ফেলে সেই বিচলিত মুখখানা দেখতে ভারী ভাল্লাগে তার। তবে কি এই সব অন্যায় শুধুমাত্র এই চেহারাটা দেখার লোভেই কি? আপনমনেই হাসলো সে। পলকের মুখপানে চেয়ে বড্ড মায়া হলো তার। মুখটা কেমন চুপসে গেছে। কিন্তু তাও সে শেষবারের মত মজাটুকু করতে ছাড়লো না। আবারো জিজ্ঞেস করলো,
_কি হলো বললেন না তো কেমন কিছু না? আমাকে কি তবে আজ সুন্দর লাগছে না?ফ্লাই করে কি পুরো চেহারারাটাই বিধ্বস্ত লাছে আমার?করুণ মুখ করে বললো সিফাত। এবারে তাড়াহুড়োয় পলক চেঁচিয়ে উঠলো।
_এইই না!!! এমন কিছুই না। মানে তেমন কিছুই না। না…মানে কোন কিছুই না..মানে আমি…
_হুম..আপনি?
_আ আ..আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম।
_অন্য কিছু!সেটা আবার কি? কিছুটা বিজ্ঞদের মত চিন্তিত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো সিফাত।
_এইইই যে সেদিন থেকে দেখছি যে আপনি আমাকে মৃন্ময়ী বলে ডাকছেন বারেবার।কিন্তু এটা তো আমার নাম নয়।তাহলে এই নামে কেন ডাকছেন?
ঘটনা বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো সিফাত। বেশ ভাব নিয়েই বললো,
উউমমম, আমি আপনাকে এই নামেই ডাকবো বলেই বারেবারে এই নামেই ডাকি।
_কেন? এই নামে কেন? আমার কি কোন নাম নেই,নাকি আমার নামটা আপনার পছন্দ নয়। কিছুটা মন খারাপের ভঙ্গী করেই বললো সে। ঠিক যেন একটা অবুঝ বাচ্চা কথা বলছে।বেশ আদুরে লাগছে পলকের মুখখানা।
সেদিকে চেয়েই এবার কিছুটা জোরে শব্দ করে হেসে উঠলো সিফাত।তার হাসি দেখে পলকের রাগ হলো আবার। এই মেয়ের এই এক সমস্যা। এমনিতে চুপচাপ স্বভাবের হলেও হুটহাট রেগে যায়। তার সেই রাগের প্রকাশও নিরবতায় ঘটে। খুব বেশি রাগ হলে নিজেকে আঘাত করবে সব রাগ নিজের উপরেই ঝাড়বে সে। তাই সিফাতের হাসি দেখেও এবার রাগে সে শক্তভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দৃষ্টি টেবিলের উপর রাখা ছুরির দিকে।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_৫
©জারিন তামান্না

পলককে ওমন স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হুঁশ হলো সিফাতের। হাসি থামিয়ে দিলো সে।বুঝতে পারলো যে এতটাও মজা করা ঠিক হয়নি। মৃন্ময়ী হার্ট হয়েছে।খারাপ লাগলো তার। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যেই না কিছু বলতে যাবে,ওমনি ফোন বেজে উঠলো তার। রিহান কল করেছে হোয়াটস অ্যাপে। পলকের দিকে এক নজর দেখে ফোন রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে রিহানই আগে বলে উঠলো,
_হ্যালো, ব্রো! হোয়াটস আপ?
_আ’ম ফাইন রিহান। হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?
_ওহ..আ’ম গুড। আছিস কই তুই?তোর তো ১২ টায় ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। এখনো বাসায় কেন আসিসনি?
_হ্যাঁ,ফ্লাইট ১২ টায়ই ল্যান্ড করেছে। সব ফর্মালিটিস শেষ করে চলে এসেছি আমি। আসলে..
_চলে এসেছিস মানে? বাসায় কেন আসিসনি তুই? তুই জানিস ইয়ানা সেই সকাল থেকে তোর জন্য ওয়েট করছে?বারবার জিজ্ঞেস করছে তোর কথা,কখন আসবি বলে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে মেয়েটা। কিছুটা অস্থির হয়েই কথাগুলো দ্রুত বললো রিহান।
_আরেএএএ ভাই,,আমার কথাটা তো শোন আগে।
_আচ্ছা বল।
_আমি আসলে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি অন্য একটা কাজে এসেছি। লাঞ্চ বাইরেই করবো। তোরা লাঞ্চ করে নে সবাই। আমি বিকালের দিকে ফিরে আসবো। ততোক্ষণ মেয়েটাকে একটু সামলে নে নারে ভাই আমার।
_তুই একচুয়ালি কোথায় গেছিস বলতো? কিছুটা সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলো রিহান।
_আ আব..আমি ফিরে এসে বলছি তোকে সব। ফোন রাখ এখন। bye.
_ওকে,ফাইন। come back soon…see u.bye.
_ ok. see u. মুচকি হেসে কল কেটে ফোনটা পকেটে ভরে রাখতে রাখতে চোখ তুলে চাইলো পলকের দিকে। সে আগের মতই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সিফাতও এসেছে পরে থেকে দাঁড়িয়েই আছে। পলককে দেখে মনে হলো বেশ রেগে আছে। তাই সব কিছু সামলে নিতেই কিছুটা গলা ঝেড়ে বললো,
_আ…তখন থেকে তো দাঁড়িয়েই আছি। এবার কি বসার অনুমতি পাবো?
এবার পলক দৃষ্টি ঘুরিয়ে সিফাতের দিকে চাইলো। বেচারা সেই কখন এসেছে আর এখনো বসতে অবদি পারেনি। সে যে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি এখানেই এসেছে সেটা সে শুনেছে।এত খানি জার্নি করে আসা ক্লান্ত মানুষটাকে সেই কখন থেকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সে। সেএএএ?! কিন্তু সে কিভাবে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখবে। এই মানুষটা এসেছে পরে থেকেই যা সব শুরু করেছে বসতে বলার সুযোগটাই তো হলো না। এতে তার দোষ কই? যা হয়েছে সব উনার নিজের দোষে। নিজেকে নিজেই বুঝ দিলো পলক।কিন্তু তাও মায়া লাগলো তার। চোখ নামিয়ে খুব শান্ত স্বরে বললো,বসুন।
পলকের এমন শান্ত স্বরে বলা কথায় স্বস্তি পাওয়ার কথা থাকলেও সেটা মোটেও স্বস্তিদায়ক হলো না সিফাতের কাছে। সে ঠিক বুঝতে পারলো রেগে আছে তার মৃন্ময়ী।
এদিকে পলকের রাগ যে সিফাতের ক্লান্ত মুখটা দেখেই মিইয়ে গেছে সেটা তো আর সে জানে না।কিন্তু পলক জানে এই রাগ মিয়িয়ে গেলেও সেখানে একটা অচেনা অভিমান খুব করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কেন এই মানুষটা সব সময় তাকে এমন হেনস্তা করে।যখন যখন এই মানুষটা তার সাথে থাকে তখনই তার ভ্যাবাচ্যাকা দিবস শুরু হয়ে যায়।এটা ভেবেই মনে মনেই একটা ভেংচি কাটলো সে সিফাতকে ।
_________________________________
পলকের অনুমতি পেয়ে ব্যাগটা সাইডে রেখে ধীরে সুস্থে পলকের সামনের সীটটায় বসলো। তবে জানলার ধার ঘেঁষে। তারা যে হোটেলের রেস্টুরেন্টাতে এসেছে সেটা এয়ারপোর্ট থেকে কিছুটা কাছেই। তাই ফ্লাই করার আগে বা ফিরে এসে প্রায়ই এখনে আসে সিফাত। এখানকার কফি তার ভীষণ পছন্দের। তার সব ক্লান্তি মেটানোর জন্য বাসায় মায়ের হাতের কফি আর বাইরে এখানকার কফিটাই তার চাই। প্রায় সময় আসার কারণে বেশ পরিচিত সে সবার কাছেই। আর এই যে, যে টেবিলটা সে বুকিং দিয়েছে সেটাও তার প্রিয় জায়গা এখানে। কারণ এখান থেকে স্কাই ভিউ টা খুব ভালোভাবেই দেখা যায়। তাই এটা একপ্রকার তার জন্যই বুক করা থাকে।

পলক বসেছে বাইরের দিকে। আর সিফাত কিছুটা কাঁচ ঘেঁষে ভেতরের দিকে।যেন ঘাড় ঘুরালেই আকাশ দেখতে বিন্দুমাত্র সমস্যা না হয়। বলতে গেলে মুখোমুখি চেয়ারে বসেও তারা আড়াআড়ি ভাবে বসেছে। দুজন দু প্রান্তে।

ক্যাপ আর সানগ্লাস খুলে টেবিলের একপাশে রাখতে রাখতে পলকে জিজ্ঞেস করলো,
_তো কি খাবেন?
_প্রশ্নটা শুনে কেমন যেন একটা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো পলক, যে কোন উদ্ভট টাইপের প্রশ্ন করা হয়েছে তাকে। সেটা দেখে সিফাত কিছুটা, মিনমিনে স্বরে বললো,
_না আ..মানে,লাঞ্চ টাইম তো এখন। সো, লাঞ্চের জন্য খাবার তো অর্ডার করতে হবে। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম কি খাবেন আপনি?
সিফাতের এভাবে বলা কথা শুনে বেশ হাসি পেল পলকের। কিন্তু সে হাসলো না। রাগ তো এখন একেবারেই নেই। তবুও কিছুটা ভাব নিয়ে কাঠকাঠ গলায় বললো,
_আপনার যেটা ভালো লাগে অর্ডার করে দিন।
_ওকে, ফাইন। চাইনিজ প্ল্যাটার অর্ডার করি তবে।
বলেই সে ওয়েটারকে ডেকে দুটো চাইনিজ প্ল্যাটার আর আফটার লাঞ্চ নিজের জন্য একটা স্ট্রং কফি আর পলকের জন্য ডার্ক চকলেট আইসক্রিম অর্ডার করে দিলো।
এদিকে পলক তো পুরাই তাজ্জব বনে গেছে। কারণ সিফাত যা যা অর্ডার করেছে সেগুলো সব ওর পছন্দের আইটেম। মনে মনে বললো,এই লোকটা কি।সব জেনে বুঝে করেছে নাকি আমিই বেশি ভাবছি?উনার তো আমার পছন্দ জানার কথা নয়।তাহলে?উত্তর খুঁজে পায় না পলক।

পলকের এহেন হতভম্বিতা দেখে মিটিমিটি হাসছে সিফাত। কিন্তু, এবার আর তাকে নিয়ে মজা করতে ইচ্ছে হলো না।আজকে এমনিতেই ঢের হয়েছে।খাবার আসতেও একটু সময় লাগবে। চুপচাপ বসে থেকে তো আর লাভ নেই।তাই সে নিজে থেকেই কথা বলা শুরু করলো। কিন্তু, কিছু বলার আগে প্রথমেই সে দু’চোখ মেলে ভালোভাবে দেখলো পলককে। আজ তার মৃন্ময়ী আকাশী আর সাদার কম্বিনেশনের একটা লং গাউন পড়েছে। মাথায় সাদা ওড়না টানা। যেন ভেজা মাটির গা’য়ে এক খন্ড আকাশ নেমে এসেছে।বাইরের রৌদ্রজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকালো একবার কি যেন বললো বিরবির করে। পলক সেটা শুনতে পেলো না। তাই জিজ্ঞেস করলো,
_কিছু কি বলছেন?

সে প্রশ্নের উত্তরে কিছু বললো না।শুধু হাসলো একটু।আকাশের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আবারও পূর্ণদৃষ্টি মেলে তার মৃন্ময়ীকে দেখলো। সেদিনের মতই লম্বা সিঁথি কাটা।কানে ছোট একজোড়া ক্রিস্টাল কালার স্টোনের টপ।বা হাতে সিলভার চেইনের মাঝারি একটা ঘড়ি। তার শুকনো কব্জিতে অনেকটা ব্রেসলেটের মতই লাগছে। আর ডান হাতে স্টোনের চিকন দুটো চুড়ি। ব্যস এটুকুই। মুখে না আছে তেমন কোন প্রসাধনীর ছোঁয়া আর না আছে চোখে সামান্য কাজল। এতটা সিম্পলভাবে একটা মেয়ে তার সামনে বসে রয়েছে।তারপরেও সিফাতের মনে হচ্ছে, পৃথিবীর এত এত দেশ ঘুরেও এর থেকে বিশুদ্ধ আর বিমোহিত সৌন্দর্য সে তার এতকালের জীবনে কখনো দেখেনি।
সিফাতের এভাবে তাকিয়ে থাকাটা পলককে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। কিন্তু পলক জানে এই দৃষ্টিতে খারাপ কিছুই নেই। যদি কিছু থেকেও থাকে তবে সেটা পবিত্র কিছুই।তবুও সিফাতের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে তার দৃষ্টি চঞ্চল হলো। সিফাত সেটা বুঝতে পারলো।তাই ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতেই প্রশ্ন করলো,
_স্কুল কখন ছুটি হয়েছে আপনার?
_জ্বী…১ টায়।
_অহ।কিন্তু আমি তো জানি আপনার স্কুল ১২টায় ছুটি হয়ে যায়।
_হ্যাঁ,,সেটা স্টুডেন্টদের জন্য।১২ টায় ক্লাস শেষ হয়। বাচ্চাদের কপি চেক করে, কাজ গুছিয়ে বেরোতে বেরোতে ১ টা বেজে যায় আর কি।
_অহ, আচ্ছা। তাহলে তো বোধয় আজ আর বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি আপনার। বাসায় জানে আপনি এখানে?
_না,জানে না। তবে স্কুলে যাওয়ার আগেই বলে বেরিয়েছিলাম যে আজ ফিরতে লেট হবে।
_আচ্ছা।
_হ্যাঁ।
এটুকু বলেই চুপ করে গেল পলক।
সিফাত নিজেই বললো,
তাহলে কি ডিসাইড করলেন মৃন্ময়ী? বিয়ের আগে না পরে….বলেই পলকের দিকে চোখ মেলে চাইলো সিফাত উত্তরের আশায়।
বিয়ের কথা শুনে কিছুটা চুপসে গেল পলক।কিছুটা ইতস্তত করেই বললো,
_ হ্যাঁ,,কিন্তু এর আগে আমার আসলে একটা কথা বলার ছিল আপনাকে।
_yeah, sure. say.
পলক কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়েটার খাবার নিয়ে চলে এলো। খাবার টেবিলে রেখে সে চলে যেতেই সিফাত বললো,খেতে খেতে কথা বলি আমরা?
পলক মুখে কিছু বললো না। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো।

তারপর সিফাত একটা প্লেট পলকের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যটা নিজের দিকে টেনে নিল। খাওয়া শুরু করতে করতে বললো,
_তো মৃন্ময়ী! কি যেন বলতে চাইছিলেন আপনি?
_সিফাত দিব্যি ছুরি কাটাচামচ চালিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। আর পলক শুধু সেসব দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে।

পলককে এভাবে শুধু খাবার নাড়াচাড়া করতে দেখে সিফাতও খাওয়া থামিয়ে দিল।পলকের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে বেশ চিন্তিত। তাই চকিতেই প্রশ্ন করলো,
_Any problem, Mrinmoyi? টায়ার্ড লাগছে কি?
সিফাতের কথায় চমকে তাকালো পলক।কিন্তু পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
_না..কোন সমস্যা নেই। ঠিক আছি আমি।বলেই মুখে জোরপূর্বক হাসি টানার চেষ্টা করলো।যেন সব স্বাভাবিক আছে।
পলকের অবস্থা বুঝতে না পেরে সিফাত বললো,
_তো খাচ্ছেন না কেন? এটা ভালো লাগছে না? অন্য কিছু খাবেন, অর্ডার করি?
পলকের তাৎক্ষণিক জবাব,
আরে না না….এটাই ঠিক আছে একদম। খাচ্ছি আমি। বলেই একচামচ ফ্রাইডরাইস তুলে মুখে দিল সে।
সিফাতও আর ঘাঁটলো না তাকে। খাওয়ায় মনোযোগ দিল।কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার আগেই পলক নিজের কথা বলতে শুরু করলো।
_আসলে আমার সম্পর্কে আপনার কিছু ভুল ধারণা রয়েছে।বলতে গেলে,আপনাদের থেকে একটা সত্য লুকানো হয়েছে।
এটুকু বলতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ মেলে পলকের মুখের দিকে চাইলো সিফাত। পলক কি বলতে চায় সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। সিফাতের দৃষ্টিতে আরও বেশি জড়তা এসে জাপটে ধরলো পলককে। কিন্তু তাকে যে সব সত্যিটা বলতেই হবে। এতবড় প্রতারণা যে সে কিছুতেই করতে পারবে না। তাই নিজেকে শক্ত করে, দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেই আবারও বলা শুরু করলো,
_আসলে এর আগে আমার একবার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।এটুকু বলেই সে সিফাতের দিকে তাকালো তার ভাব মূর্তি বোঝার জন্য। কিন্তু যা দেখলো তার পরে পলকের শরীর একরকম হিম হয়ে এলো। কেমন এক শান্ত গম্ভীর চোখ মুখ করে তাকিয়ে আছে পলকের দিকে। পলক দৃষ্টি রাখতে পারলো না সিফাতের ওমন চাহনীর পানে। দ্রুত চোখ নামিয়ে আবার মনের ওপর জোর দিয়েই বললো,
_বিয়ে ঠিক হয়েছিল,কিন্তু বিয়ের দিন..
_বিয়েটা ভেঙে গেছিল।কারণ,ছেলেটা আদম ব্যাবসার সাথে জড়িত ছিল। সাথে নারী ও শিশু পাঁচারকারী একটা বড় চক্রের সাথে সামিল ছিল। বিয়ের দিন সকালে পুলিশ এসে ওকে এরেস্ট করে নিয়ে গেছে। এখনো মামলা চলছে।জেলে আছে সে এখনও। এটুকু বলেই সেই পলকের মুখের দিকে তাকালো।

পলকের ভাবীর ভাই ছিল সে। ক্লাস এইট পাশ করেই দালাল ধরে ইতালি চলে গেছিল।অন্যদিকে পলকের বড় বোন পালিয়ে বিয়ে করায় তার বাবা বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়।যেটা খুব স্বাভাবিক।সমাজের লোকের নানান কথা সমালোচনা শুনতো হতো দিন রাত। একদল লোক বুদ্ধি দিল মেজ মেয়ের বেলায় যেন কোন রিক্স না নেয়। এই মেয়ে এমন কিছু ঘটানোর আগেই যেন কোন সু পাত্রের হাতে হস্থান্তর করে মেয়েকে। আর পলকের বাবাও কোন রিক্স নিতে চাননি বলে তার দ্রুত বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু পলকের এই শ্যামবরণ রূপের কারণে বিয়েটা ঠিক হচ্ছিল না। ঠিক তখনই পলকের ভাবী সম্পত্তির লোভে পড়ে আর এ সংসারে নিজের জোর বাড়াতে তার এইট পাস করা বিদেশ ফেরৎ অধম ভাইয়ের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব রাখে।তার বাবা প্রথমে রাজি না হলেও বউয়ের কথার বর্শবর্তী হওয়া একমাত্র ছেলে আর তার গুণধর বউয়ের কথার মারপ্যাঁচে পড়ে রাজি হয়ে যায় তার অনার্স ২য় বর্ষে পড়া মেয়েটার সাথে বিয়ে দিতে। কিন্তু বিয়ের দিন সকালে যখন হলুদ আর তত্ত্ব নিয়ে কেউ না আসে ও বাড়ি থেকে তখনই খবর আসে ছেলেকে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে গেছে। এরপর এই নিয়ে খুব অশান্তি হয় বাসায়। পলকের বাবা তার এহেন নির্বোধতার জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না। আর তার ছেলের বউ জেনে শুনে তার মেয়ের এত বড় ক্ষতি করতে চেয়েছিল সেই অপরাধে তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। কিন্তু শশুড় বাড়িতে ঠাই না পেলেও স্বামীর কাছে টিকে গেছে। ২ মাসের প্রেগন্যান্ট হওয়ায় তার একমাত্র ভাই নিজের বউ আর সন্তানকে ছাড়তে পারেনি। এখন তারা আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। যোগাযোগ নেই কোন। শুনেছিল তাদের নাকি একটা মেয়ে বাবু হয়েছে। কিন্তু তাকে দেখার ভাগ্য এখনো কারও হয়নি। পলকের ভাবী এই পরিবারের কাউকেই নিজের মেয়ের মুখ দেখতে দেয়নি। আর না দিয়েছে পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে।
____________________________________________

পলকের মুখ হা হয়ে গেছে সিফাতের কথা শুনে।যেন কেউ ওকে ৪৪০ ভোল্টের নয় ৪৪০০ ভোল্টের শক দিয়েছে।ফলাফল পলক পুরো স্থির হয়ে গেছে।বলতে গেলে পলক বেচারি আবারও পলক ফেলতেই ভুলে গেছে।
পলক চোখ নামিয়ে নেওয়ার পরেই সিফাতও স্বাভাবিক হয়ে খাবারের দিকে অগ্রসর হয়।কারণ, তার যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছিল। তাই সে মনোযোগ দিয়ে প্লেটে ছুরি চামচ দিয়ে খাবার নাড়াচাড়ার মাঝেই কান খাড়া রাখে পলকের বাকি কথা শোনার জন্য। পলক যেই না বিয়ের দিনের কথা তুললো,ওমনি সিফাতও ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গড়গড়িয়ে বাকিটুকু বলে দিল। তারপর, মুচকি হেসে পলকের দিকে চাইতেই দেখলো পলকের এহেন অবস্থা।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_৬
©জারিন তামান্না

‘খাবারটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নিন প্লিজ। বাকি কথা পরে শুনবো সব।’
পলক এখনো প্রচন্ড শকড।সিফাতের কথার কোন রেসপন্স নেই। এখনো তার স্থির চাহনী। সে যে প্রচন্ডরকম ঘোরের মধ্যে আছে সেটা সিফাত বেশ বুঝতে পারছে। তাই তাকে ঘোর থেকে বের করে আনার জন্য খানিক দুষ্টুমির সুরেই বললো,
_এভাবে হা হয়ে তাকিয়ে আছেন কেন, মৃন্ময়ী ? আপনি কি চাচ্ছেন যে এবার আমি আপনাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেই?তাও এই ভরা রেস্টুরেন্টে?আমার অবশ্য কোন সমস্যা নেই। এসবে ব্যাপকভাবে অভ্যস্ত আমি। সো,আপনি চাইলে আমি…বলেই দুষ্টু হাসি হাসলো সে।
সিফাতের ওমন চাহনী আর কথাবার্তায় আরেকদফা ঝটকা খেলো পলক।অবশ্য এবারের ঝটকায় সে আগের ঘোর থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ফিরে আসতে সক্ষম হলো। চকিতেই আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই রেস্টুরেন্ট ভরা। ফাঁকা ফাঁকা করে বেশ জায়গা নিয়ে টেবিল ফেলা হলেও এই এরিয়াটা বেশ বড় হওয়ায় অনেকগুলা টেবিল আছে এখানে। আর সবগুলোই ফুল। এবার বেশ লজ্জা পেল সে। লজ্জায় খানিক নড়েচড়ে বসলো।কিন্তু না সিফাতের দিকে তাকালো আর না কিছু বললো।
সিফাত বুঝে গেছে তার ডোজ কাজ করেছে। নিজের উপর নিজেরই গর্ববোধ হলো তার। নিজেই নিজেকে সাবাসী দিল। মনে মনে বললো,
_সাব্বাস ব্যাটা!তুই তো বিয়ের আগেই বউ সামলানোতে এক্সপার্ট হয়ে গেছিস। এক ডোজেই কেমন শকড মোড থেকে ব্যাক টু নরমাল মোড করে দিলি। very well done, Shifat..এরপর খানিক মুচকি হেসে পলকের উদ্দেশ্যে বললো,
_নিন খাবারটা কমপ্লিট করুন। নয় তো এবার সত্যি সত্যি একেবারেই ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেতে একদম ভাল্লাগবে না।
পলক খুব ধীর স্বরে বললো,জ্বী। বলেই পলক খাওয়া শুরু করলো।

খাওয়া শেষ না হওয়া অবদি মাঝে কেউ আর কোন কথা বললো না।
_________________________________

_তো আপনি কি যেন বলছিলেন,কথাটা শেষ করুন এখন। কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললো সিফাত।
_আমি আর কি বলবো। আপনি তো সবই জানেন দেখছি।কিন্তু এসব জানার পরেও কেন বিয়ে করতে চাইছেন আমায় সেটাই বুঝতে পারছি না আমি।

_মৃন্ময়ী আপনাকে কিছু কথা বলছি মন দিয়ে শুনুন। আর আমার কথা বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি একটা কথাও বলবেন না। কথা শেষ হোক,তারপর যা জানতে চাওয়ার, যত প্রশ্ন করার করবেন।আমি উত্তর দিব সে সবের।কিন্তু তার আগে টু শব্দ করবে না।শুধু আইসক্রিম খাবেন আর ঠান্ডা মাথায় আমার কথাগুলো শুনবেন। কেমন?
পলক মুখে কিছু বললো না।শুধু ঘাঁড় কাত করে সম্মতিজ্ঞাপন করলো।
মুচকি হেসে সিফাত বলা শুরু করলো।

_মৃন্ময়ী, আপনি আমাকে চেনেন মাত্র ৫ দিন। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি,জানি আজ ২ মাস ১৭ দিন।

এটুকু শুনেই পলকের চক্ষু চড়াকগাছ। কিভাবে কি সেটা জানার ইচ্ছা হলেও আপাদত সে কোন প্রশ্ন করতে পারলো না। তার যে এখন টু শব্দ করাও বারণ।তাই চুপচাপ সিফাতের কথা শুনতে লাগলো।কারণ সিফাত তার মত বলেই যাচ্ছে।

_২ মাস ১৭ দিন আগে প্রথমবারের মত আমি আপনাকে দেখি। আপনার বায়োডেটাটা ভুল করে আমার জন্য সিলেক্ট করা মেয়েদের বায়োডেটাগুলোর সাথে মিশে গেছিল। কিন্তু আমি এটাকে ভুল না বলে ভাগ্য বলবো।সত্যি বলতে এটাকে আমি আমার সৌভাগ্য মানি। নয় তো অন্যকারো অনিচ্ছাকৃত একটা ভুলের কারণে আমি আমার জন্য এই সঠিক মানুষটার সন্ধান পেতাম না। ‘একটু দম নিয়ে,কফিতে চুমুক দিল সিফাত। বাইরে আকাশের দিকে চাইলো। দুপুরের শেষভাগ চলছে। রোদের উত্তাপটাও কেমন মিইয়ে এসেছে। বাইরের আকাশে চোখ রেখেই আবারো বলা শুরু করলো,
_প্রথমবার দেখেই চোখদুটো থমকে গেছিল আমার। শ্রাবণের মেঘ জমা ওই মুখখানায় ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল দৃষ্টির গভীরতা। টানা দুদিন আমি শুধু ভেবেছি আপনাকে নিয়ে।আমার পরিবারের মতামত কি হবে সেই নিয়ে।তারপর সবশেষে নিজের মনের ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে নিয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম আমার আপনাকেই চাই। ‘কথাটা বলেই দৃষ্টি ফিরিয়ে চাইলো পলকের মুখের দিকে। মৃদু হাসলো। সে স্পষ্ট দেখতে পেলো পলকের চোখে মুখে অনেক অনেক প্রশ্নের সমাগম। সেটা উপেক্ষা করেই সে বলতে লাগলো,
_এরপর পুরো ১ মাস আমি আপনাকে মনিটর করেছি। আপনার জীবন সম্পর্কে যতটা ডিটেইলসে জানা যায় সবটা জেনেছি। আপনার বাহ্যিক চাল চলন, জীবন ধারা,ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, আপনার বিয়ে ভাঙার ব্যাপরটা এ সব..সব ইনফরমেশন আমি কালেক্ট করেছি। আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকতাম না কেন আপনার খবর আমার কাছে ঠিক টাইম টু টাইম পৌঁছে যেত। আমি যতই আপনার সম্পর্কে জানছিলাম ততই শিওর হচ্ছিলাম যে আপনাকেই আমার চাই। নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে।এরপর একদিন আমি নিশাতের সাথে দেখা করি। তাকে খুলে বলি আমার ব্যাপারটা। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই সেটা তাকে বুঝিয়ে বলার পরে সেও আমাকে হেল্প করতে রাজি হয়ে যায়।তারপর আপনার ব্যাপারে বাকি যতটুকু ইনফরমেশন নেওয়ার ছিল সেসব নিশাতই আমাকে দিয়েছে। নিশাতের সাথে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখা করতাম।কথা হতো আপনাকে নিয়ে। আর এভাবেই কেটে যায় আরও ১ মাস।সব কিছু জানার পর যখন আমি পুরোপুরি আপনাকে নিজের করার ডিসিশন নিলাম তখনই পরিবারকে জানিয়েছি। পরিবারকে রাজি করাতে বড্ড কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে গো মৃন্ময়ী। ‘বলেই কফিতে লাস্ট চুমুকটা দিয়ে পলকের চোখের দিকে চাইলো। সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি স্থির রেখেই বললো,’আর তারপর সপ্তাহ দেড় আগে আপনার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই এবং স্বপরিবারে গিয়ে প্রথমবারের মত আপনার মুখোমুখি হই। আর এখন আল্লাহ চাহেন তো আপনি খুব শিঘ্রই পুরোপুরিভাবে আমার হবেন। আমার অর্ধাঙ্গীনী হিসেবে।আমার জীবনের অংশ হবেন আপনি।
কিন্তু আপনাকে নিজের জন্য পেতে চাওয়াটা যেমন আমার একান্ত ব্যক্তিগত চাওয়া।সেখানে আপনার সম্মতিটাও আমার জন্য একান্ত গূরুত্বপূর্ণ। তাই আমি চাই আপনি আমাকে জানুন।যাচাই করুন।কোন কনফিউশন থাকলে সেটা ক্লিয়ার করে নিই। তারপর আমরা একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হই। মৃন্ময়ী আমি চাই, যেদিন থেকে আমরা বিয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হবো সেদিন থেকেই সেই সম্পর্কের প্রতিটা মূহুর্ত, একে অন্যের কাছে আসার প্রতিটা পদক্ষেপে আমাদের সমান সম্মতি থাকুক। ভালোবাসা থাকুক। জানি হুট করে কাউকে ইচ্ছে করে ভালোবাসা যায় না। কিন্তু আমি এটাও চাই না যে শুধু মাত্র স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের খাতিরে বা নিয়মের জোরে আপনি আমাকে ভালবাসুন। আমি জানি আপনি না চাইলেও এই বিয়ে হবেই। কিন্তু আমি আপনাকে কিছুটা সময় দিতে চাই। মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে।আমাকে নিজের লাইফে গ্রহণ করতে।

আমি আপনাকে আমাকে চুজ করা বা না করার জন্য কোন সুযোগ দিচ্ছি না।বিয়ে আপনার আমাকেই করতে হবে।কারণ আপনি তো আবার আপনার পরিবারের বাধ্যগত মেয়ে। বাবা যার কাছে তুলে দিবে নাচতে নাচতে তার কাছেই যাবেন।(শেষের তিনটে কথা একপ্রকার ঠ্যাস মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো সিফাত। কারণ ভুলভাল সিদ্ধান্ত হলেও যে পলক কখনো সেসবের প্রতিবাদ করে না সেটা সিফাত জেনেছে । তাই এ ক্ষেত্রে কিছুটা রাগ আছে সিফাতের পলকের প্রতি)তাহলে সেই সুযোগ আমার কেন হবে না?আর না হলেও এখন ছেড়ে দেওয়ার অপশন নেই কোন।আপনিই আমার ওয়াইফ হবেন এটাই ফাইনাল।এখন শুধু আপনার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তটা জানতে চাইছি। আর এটা যত দ্রুত সম্ভব আমাকে জানান। আপনি সময় চান নাকি সরাসরি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চান!

দেখুন, আমার কিন্তু এই মাঝবয়সে এসে প্রেম করার মানসিকতা নেই। যত রোমান্স, ভালবাসা-বাসি সব বউয়ের সাথেই হবে। যেটা আল্লাহ চাইলে আপনার প্রাপ্য। আমার স্ত্রী হিসবে সব অধিকারও হবে কেবলই আপনার। এখন আপনি আমার প্রেম না করা প্রেমিকা হোন বা একেবারে বিয়ে করা বউ, তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু খুব বেশি সময়ও আমার দেওয়ার নেই। So..take a decision fast. I want to make u ‘my lady’ as soon as possible.
কথাগুলো বলে একটা লম্বা দম নিল সিফাত।তারপর পলকের দিকে তাকিয়ে বললো,
_ব্যাস!এটুকুই বলার ছিল। এখন আপনি বলুন, আপনার কিছু বলার বা জানার আছে?

এতক্ষণ পলক লক্ষী মেয়ের মত সিফাতের বলা সব কথাগুলো শুনছিল।শুনছিল কি..একপ্রকার গিলছিল বলা চলে। কিন্তু এতসব শোনার পর, শেষমেশ যে প্রশ্নটা সে করলো সেটা শুনে এবার সিফাত নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল।

__________________________

সিফাতের কথা শেষ হবার পর পলক ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল সিফাতের দিকে।এরপর ব্যাক্কলের মত প্রশ্ন করলো,
_আপনার বয়স কত?

সিফাত হতভম্ব!বিস্মিত কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করলো,’কেন আপনি সত্যই জানেন না? বায়োডেটা দেখেনি?’
পলক বোকার মত ডানে বা’য়ে মাথা নাড়ালো।যার অর্থ সে কিছুই জানেন না।
সিফাত পুরাই ব্যাক্কল বনে গেল।এই মেয়ে কি তবে তার সাথে পরিচয়ের আগে তার বায়োডেটাটা অবধি দেখেনি! জানেই না কিছু? বড্ড হতাশ হলো সে। একটা চাপা শ্বাস ফেলে বিরস মুখে বললো,
_এবার জুলাইতে ৩২ শেষ হয়েছে। ৩৩ রানিং।
_কিইইইইই ৩২ বছর বয়স!!! তার মানে আমার থেকে তো ১,২,৩…(এভাবে হাতের কর গুণে)পাক্কা ৯ বছরের বড়অঅ!!
পলকের এরূপ প্রতিক্রিয়ায় পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সিফাত। এ মেয়ে তো এখনই বয়স শুনেই এমন চিল্লাপাল্লা করছে তাহলে বুড়ো হতে হতে না জানি কত চিল্লাপাল্লা করবে। হে আল্লাহ মাবুদ,রক্ষা করো। মনে মনে বিড়বিড় করলো সে। তারপর হুট করেই মনে হলো,আচ্ছা এই মেয়ে কি তার নামটা জানে? নাকি সেটাও এখনো জানা হয়ে ওঠেনি। তাই চকিতেই সে প্রশ্ন করলো, আচ্ছা,আপনি আমার নামটা জানেন তো? নাকি সেটাও…

_না, না..নাম জানি।আপনি পাইলট এটাও জানি। এটুকু বলেছিল মা।

পলকের কথাশুনে জোরে সোড়ে একটা শ্বাস ফেললো সিফাত। হতাশা খানিক কমলো।যাক, মেয়ে এটুকু অন্তত জানে। তারপর কিছুটা বিদ্রুপের সুরেই পলকের উদ্দেশ্যে বললো,

_অহ,আচ্ছা।থ্যাংক গড। বায়োডেটা দেখেননি তবুও আপনি এতকিছু জানেন আমার ব্যাপারে এও ভাগ্য আমার। ধন্য আমি!
_________________________________

হোটেলের পার্কিংলটে দাঁড়িয়ে আছে সিফাত আর পলক। রিহানকে কল করে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলেছিল অনেক আগেই। কিন্তু এখানে এসে গাড়িটা পেলেও ড্রাইভারকে পেলে না তারা। সিফাতের মেজাজ খারাপ হচ্ছে খুব। একে তো ড্রাইভার নিখোঁজ তার উপর আবার কল রিসিভ করছেনা। পলক বারবার করে বলেছিল যে সে একাই চলে যেতে পারবে কিন্তু সিফাত তাকে একা ছাড়বে না এখন। এমনিতেই এখান থেকে অনেকটা দূরে পলকের বাসা তার ওপর এখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। তাই সে নিজেই ওকে বাসায় পৌঁছে দিবে বলেছে। এভাবে অপেক্ষা করতে বড্ড বিরক্ত লাগছে সিফাতের। কিন্তু পলকের ঠিক কেমন লাগছে সেটা তার হাব ভাবে বোঝা গেল না কিছু। হঠাৎ সিফাত ডাকলো,
_মৃন্ময়ী?
হাতঘড়িতে সময় দেখছিল পলক।বিকেল ৪:২৫ বাজে।আচমকা সিফাতের ওমন ডাক শুনে চমকে উঠলো সে। অস্থির কন্ঠে বললো,
_জ্বী..কিছু বলছিলেন?
সিফাত চুপ করে আছে। একধ্যানে দেখছে তার মৃন্ময়ীকে।এই মেয়েটা বড্ড সরল। অল্পতেই প্যানিক হয়ে যায়। ঠিক যতটা মেধাবী ঠিক ততটাও বুদ্ধিমতী নয়।খুব সাধারণ একটা মেয়ে। কিন্তু,তারপরেও….তারপরেও কি যেন একটা আছে যেটা তাকে একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীতে পরিণত করেছে। তার সরলতা?আত্মসম্মানবোধ?চিন্তার পরিপক্কতা? নাকি অন্য কিছু যা সহজে বোঝা যায় না। অদৃশ্য কোন রূপ! সিফাত ভেবে পায় না কিছুই।
সিফাতকে এভাবে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে পলক নিজেও কিছুটা বিচলিত হলো। তাই সে একটু জোর আওয়াজেই আবারও জানতে চাইলো,
_কিছু কি বলছিলেন আমায় আপনি?
পলকের কথায় ঘোর কাটে সিফাতের।কিন্তু ঠিক কি বলার ছিল সেটা সেও জানেনা। নয় তো ভুলে গেছে হয় তো। তাই ঠিক কি বলবে বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক চাইলো একবার। ঠিক তখনই খেয়াল করলো ড্রাইভার আসছে। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে বললো,
_হ্যাঁ,বলছিলাম যে ড্রাইভার এসে গেছে।আর আপেক্ষা করতে হবে না আপনাকে। এখুনি বেরিয়ে পড়বো আমরা।
_ওহ,,আচ্ছা।
_yeah.

ড্রাইভার কাছে আসতেই চোট ঝাড়ি খেল সিফাতের।কারণ তার চা পান খাওয়ার চক্করে এতক্ষণ ওয়েট করতে হলো তাদের।

সিফাতের ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার রশিদ। বয়স সবে মাত্র ২৫ বছর। কিন্তু ব্যাপক চা পান খাওয়ার অভ্যাস। তাই সুযোগ পেলেই ছোটে চা পান খেতে।

_ইয়ে…মানে ভাইজান,আমি তো কাছেই গেছিলাম। এট্টু ভীড় আছিল। লাইনে খাড়াইতে হইছে। এইল্লাগাই দেরি হইয়া গেছে। কিন্তু দেখছে ভাইজান কি দিন আইলো আজকাল পান খাইবার লাইগ্গাও ঢাহা শহরে লাইন দইড়া খাঁড়ান লাগে! কি দিন কাল আইলো বাবা রে বাবা।

সিফাতের ঝাড়ি খেয়ে রশিদের অকপট স্বীকারোক্তি। এ আর নতুন কিছু নয়,প্রতিবারই এমন সব ঘটনার পর রশিদের একচোট স্বীকারোক্তি শুনতে হয়।যেটাকে সহজ ভাষায় কৈফিয়ত বলা চলে।সিফাত জানে ছেলেটার ঘন ঘন চা পান খাওয়ার অভ্যাস আছে। তাই আর কিছু বললো না। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তার উপর সে নিজেও বেশ ক্লান্ত। তাই কথা না বাড়িয়ে সে গাড়ির চাবি চাইলো। আজ সে নিজেই ড্রাইভ করবে। যদিও সে ভীষণ ক্লান্ত কিন্তু তাও আজ সে নিজেই ড্রাইভ করে পলকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।তারপর নিজের বাসায় যাবে।

এতক্ষণ কৈফিয়ত দিতে ব্যস্ত থাকায় পলককে খেয়াল করেনি রশিদ। তাই চাবি বাড়িয়ে দিতে দিতে পলককে চোখে পড়তেই উত্তেজনায় একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠলো সে।হাসি হাসি মুখ করে বললো,
_আরেএএএ…ভাবীজি না? সালামালাইকুম।কেমন আছেন ভাবীজি? আমি রশিদ। ভাইজানের পিয়ারের ডেরাইভার।(যদিও সে সিফাতের খুব পছন্দের কেউ নয়। কিন্তু তাও রশিদের এমন বাড়িয়ে বলা কথায় কিছু বললো না সে)

রশিদের আচমকা এমন চেঁচিয়ে উঠায় প্রথমে সিফাত আর পলক দুজনেই চমকে উঠেছিল। সিফাত নিজেকে দ্রুত সামলে নিলেও পলক থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুসময়। তারপর নিজেকে ধাতস্ত করে রশিদের কথার জবাব দিলো।

_ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?
_জ্বে, আমিও বহুত ভালা আছি আল্লাহর রহমতে। ভাইজানের লগে দেখা করতে আইছিলেন বুঝি?
এবার পলক বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। কি বলবে সে?বিয়ে ঠিক হতে না হতেই হবু বরের সাথে রেস্টুরেন্টে মিট করতে এসেছিল?কি ভাববে রশিদ! পলক আবারও প্যানিক হয়ে গেছে। সিফাত সেটা বুঝতে পেরে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল রশিদকে।
_আহ,রশিদ। বেশি কথা বলো না তো। দাও চাবি দাও,আর তুমি ক্যাব নিয়ে বাড়ি চলে যাও।আমি উনাকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরবো।
সিফাতের ধমকে চুপসে গেল রশিদ। একটু বেশি বকবক করার বাতিক আছে বেচারার। কিন্তু সিফাতকে সে বেশ সমীহ করে। সম্মান করে।ভালোওবাসে খুব।তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ চাবি বাড়িয়ে দিল সিফাতের হাতে।

চাবি হাতে নিয়ে পলককে বললো গাড়িতে গিয়ে বসতে। পলকও বাধ্য মেয়ের মত তাই করলো। একটু সময় পর সিফাতও গাড়িতে এসে বসলো। সীট বেল্ট লাগাতে লাগাতে পলককে ইশারা করলো সীট বেল্ট লাগিয়ে নিতে। সীট বেল্ট টেনে লাগানোর সময় পলক সেটা ঠিকঠাকভাবে লক করতে পারছিল না।বার বার সেটা ছুটে যাচ্ছিল। সিফাত চুপচাপ কিছুক্ষণ দেখলো পলকের কান্ড। মিটিমিটি হাসছে সে।এদিকে বেচারি পলক বেল্ট টানাটানি করে রীতিমত পেরেশান। সিফাতের বেশ মায়া লাগলো এবার। তাই সে নিজেই সেটা লাগিয়ে দিবে বলে ঠিক করলো।

চলবে……