ভয়ংকর সে পর্ব-০৭

0
222

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৭
#M_Sonali

বিছানার ওপর শুয়ে থাকতে থাকতে ভীষণ একগুঁয়ে লাগছে চাঁদনীর। কিন্তু ভয়ে বিছানা থেকে উঠতে পারছেনা সে। এবার সে ঘুরে শুয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে শ্রাবণ কোথাও আছে কিনা। ওকে পুরো রুমে দেখতে না পেয়ে হাফ ছেড়ে বাচে সে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বাইরের দিকে একটু উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে এখন দিনের বেলা নাকি রাত। কিন্তু কোন কিছুই বুঝতে পারে না। আন্দাজে ধরে নেয় হয়তো বিকেল হবে। অনেক ক্ষুধা লেগেছে তার। কিন্তু শ্রাবণের কাছে আবার খাবার চাওয়ার মত সাহস নেই তার। তাই চুপচাপ বসে ভাবতে থাকে কিভাবে এখান থেকে পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করা যায়।

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ভেবে ও কোনরকম আশার আলো দেখতে পায় না সে। মৃত্যুর ভয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু জল। চাঁদনী দ্রুত সেটা মুছে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা মনে মনে ভাবে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আবারো জানালার কাছে চলে যায়। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে এখনো বটগাছ গুলোর সাথে অনেকগুলো বাদুড় রুপি ভ্যাম্পায়ার ঝুলে আছে। চাঁদনী মনে মনে বলে এই বাদুড় দের মাঝে একটা হয়তো শ্রাবণ ও হতে পারে। যে কিনা বাদুরের রূপ নিয়ে ওর ওপর নজর রাখছে! কথাটা ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। জানালার কাছ থেকে সরে এসে আবারও বিছানার উপর বসে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে শক্ত করে নেয়। মনে মনে চিন্তা করে তার বাবা সবসময় বলত, যে কোন বিপদ আসুক না কেন হাসি মুখে সেই বিপদের মোকাবেলা করতে।

মনোবল হারিয়ে নিজেকে অসহায় ভাবলে সবসময় বিপদে পিসে মরতে হয়। তাই নিজেকে শক্ত রেখে বুদ্ধি খাটিয়ে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করতে হয়। কথাগুলো ভেবেই যেন মনের মাঝে এক আশার আলো দেখতে পেল চাঁদনী। কিন্তু কি করা যায় এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে? সেটাও তো ভাবতে হবে তাকে! সে আবারও ভাবতে লাগল তার বাবা তাকে আর কি বলেছিলেন। তখনই তার মনে পড়ে, তার বাবা তাকে বলেছিলো পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস নেই যেটা চাইলে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু জয় করা যায়। কথাটা মনে পরতেই যেন মুখে হাসি ফুটে উঠল চাঁদনীর। সে মনে মনে ঠিক করে নিল যেভাবেই হোক শ্রাবণের বুকে নিজের ভালবাসার দীপ জ্বালাবে। সেটা হয়তো সত্যি কারের ভালোবাসা হবে না। কিন্তু মিথ্যে ভালবাসার অভিনয় করেই তার থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।

কথাগুলো ভেবে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো চাঁদনী। তারপর ওই রুম থেকে বেরিয়ে বাইরের রুমে আসতে আসতে শ্রাবনকে ডাকতে লাগল,

“শ্রাবণ আপনি কোথায়? আপনাকে কোথাও দেখছি না কেন? প্লিজ সামনে আসুন। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”

কথাটা বলার সাথে সাথে কোথা থেকে যেন হাওয়ার বেগে ছুটে এসে ওর সামনে হাজির হল শ্রাবণ। প্রথমে চাঁদনী কিছুটা ঘাবড়ে গেল। ভয়ে দুপা পিছিয়ে গেলো। তারপর দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও ওর কাছে এগিয়ে এল। ওকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে শ্রাবণ বলে উঠলো,

“কি হয়েছে, এভাবে ডাকছো কেন আমায়?”

“কি হয়েছে আপনি জানেন না? বারবার আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে যান আপনি? আমার যে বড্ড ক্ষুধা লেগেছে সেটাও কি আপনাকে বলতে হবে? বিয়ে করে যখন এনেছেন তা হলে সবকিছুর দায়িত্ব পূরণ করুন। আমার জন্য তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে আসুন আমার বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে।”

ওর এমন কথা শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো শ্রাবন। মনে মনে ফিসফিস করে বলল,

“আমরা ভ্যাম্পায়ার হয়েও তো এত খাই না। যতটা এই মানুষগুলো খায়। এরা এক একটা রাক্ষসের চাইতেও বেশি খাদক মনে হচ্ছে।”

“কি হলো দাঁড়িয়ে থেকে কি ভাবছেন একমনে? আমাকে কিছু খাবার এনে দিবেন নাকি আমি সারারাত অভুক্ত থাকবো?”

” তুমি রুমে গিয়ে বসো। আমি তোমার জন্য এখনই খাবার নিয়ে আসছি।”

ওর কথা শুনে চাঁদনী চুপচাপ গিয়ে রুমের মধ্যে বসে পড়ল। সে রুম টাকে ভালভাবে তীক্ষ্ণ নজরে দেখে মনে মনে ভাবল,

“কিছুতো একটা আছে। যেটার উপায়ে আমি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু সেটা কি? আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে যেভাবেই হোক। সেটাও আমাবস্যার আগে।”

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তার চোখ আটকে গেল হাতে বেঁধে রাখা সেই পালকটার দিকে। যেটা তার হাতে শ্রাবণ পড়িয়ে দিয়েছিলো। সে পালকটাকে অন্য হাত দিয়ে ধরে বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। পাকলটা ভীষণ অদ্ভুত দেখতে। এটা আসলে কিসের পালক তা কোন ভাবেই বোঝা যাচ্ছে না। একদম ছোট এবং কালো কুচকুচে রঙের পালক টা। কিন্তু ভীষণ চিকচিকে। লাইটের আলোতে যেন চকমক করছে হাতে। যেন সোনাদানা লাগানো আছে তার সাথে। দূর থেকে দেখলে এমনটাই মনে হবে। খুবই সুন্দর এবং সফট সেটা।

চাঁদনী কি মনে করে নিজের হাত থেকে পালক টা খুলে অন্যহাতে ধরল। এপিঠ-ওপিঠ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। আনমনেই পালকটা দুই হাতে ধরে দুদিক থেকে টান দিলো। সাথে সাথে সে খেয়াল করল বাইরে বট গাছে ঝুলে থাকা বাদুড়েরদল গুলো উড়ে এসে তার জানালার উপর পড়েছে। লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ব্যাপারটা দেখে সে ভীষণ রকম ভয় পেয়ে গেল। পালকটা হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। তখন’ই তার মনে পড়ল শ্রাবণ তাকে বলেছিল, এটা যতক্ষণ তার সাথে আছে তার কোনো বিপদ হবে না। তবে কি হাত থেকে খুলে সে ভুল করেছে? কথাটা ভেবে তাড়াতাড়ি আবার পালক টা হাতে বেঁধে নিল। সাথে সাথে আবারো বাঁদুড়গুলো ওরে গাছের আগায় গিয়ে বসলো।

তখনই রুমের মাঝে এসে হাজির হলো শ্রাবণ। হাতে তার বিরিয়ানির প্যাকেট। কিন্তু তার মুখটা একদম লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করে আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রকম রেগে আছে সে। সে দৌড়ে এসে চাঁদনীর সামনে দাঁড়ালো। হাতের দিকে তাঁকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,

“তুমি এটা হাতে থেকে খুলে ছিলে কেন? তোমার কোন ধারনা আছে এটা খোলার পর তোমার সাথে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত? পাগল হয়েছ নাকি? আমি কতবার করে বলেছি এটা কোনোভাবেই হাত থেকে না খুলতে। এটা খুললেই তোমার বিপদ হবে কেন বোঝনা? তোমরা মানুষেরা এতটা বোকা কেন হও?”

চাঁদনী কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। ওর এমন ভয়ঙ্কর রাগি মুখটা দেখে যেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার। সে চুপচাপ জড়োসড়ো হয়ে বসে নিচ দিকে মাথা দিয়ে রাখলো। শ্রাবণ বুঝতে পারলো ও ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে গম্ভীর গলায় বলল,

“দ্বিতীয়বার এই ভুলটা যেন আর কখনো না হয়! এই নাও বিরিয়ানি। খেয়ে নিজের আত্মাকে শান্তি দাও। সাথে আমাকেও।”

কথাটা বলেই রুম থেকে অন্য রুমে চলে গেল সে। চাঁদনীর চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। চোখ থেকে জল টা মুছে নিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট টা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করল। ছোটবেলা থেকেই ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না সে। আর টেনশন করলে তো আরো বেশি ক্ষুধা লাগে তার। খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আরেক রুমে গেল। দেখল শ্রাবণ চুপচাপ বসে আছে সোফার ওপর। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। চাঁদনী সোজা গিয়ে একদম গা ঘেষে বসলো তার। ওর এমন কান্ডে সন্দেহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল শ্রাবণ। ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চাঁদনী আচমকা ওর গালে একটি চুমু দিল। তারপর লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলল,

“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কেন? শুধু ধমকান আর বকা দেন। নিজের বউয়ের সাথে কেউ এরকম আচরণ করে? তাও আবার নতুন বউ।”

ওর এমন কথা এবং কাজে শ্রাবণ যেন আকাশ থেকে পড়লো। বলদ এর মত তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কি বলবে না বলবে কিছুই বুঝে আসছেনা তার। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চাঁদনী আবারো বললো,

“দেখুন আমি আপনাকে আগেও বলেছি, আবার বলছি। আমি কিন্তু স্বামীকে নিয়ে বিয়ের আগে অনেক স্বপ্ন দেখেছি। স্বামীর সাথে প্রেম করবো সারাক্ষণ তার আদর ভালোবাসায় রাঙিয়ে থাকবো। কত চিন্তা করেছি এসব নিয়ে। অথচ আপনার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সবকিছু ভেস্তে যাচ্ছে। আর চলবে না এসব। এখন থেকে আমাকে ভাল না বাসলে আপনার সাথে আর কথা বলব না। আজকেই বাবার বাড়ি চলে যাবো। এই বলে দিলাম। বলুন না আমায় ভালোবাসবেন তো?”

কথাগুলো বলেই শ্রাবণের বুকের ওপর আলতো করে নিজের মাথাটা রাখলে চাঁদনী। রেখে যেনো আরেক দফা চমকে উঠল সে। সব সময় শ্রাবণের শরীর বরফের মত ঠান্ডা থাকে। বুকের উপর মাথা রাখার পর তার কোন হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছেনা চাঁদনী। যেন কোন মৃত ব্যক্তির বুকে মাথা রেখেছে সে। তবুও চুপচাপ সেভাবেই হইল। ভয় না পেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। এদিকে শ্রাবণ যেন অবাক এর ওপর অবাক হচ্ছে। সেই সাথে ওর প্রতি প্রচন্ড পরিমাণ মায়া কাজ করছে তার। কেমন একটা ঘোর লেগে যাচ্ছে বারবার। কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়। ভ্যাম্পায়ারদের কোন মন থাকে না। না থাকে কোন ভালোবাসা। তারা কারো উপরে কখনো দুর্বল হয় না। তবে সে কেন এমন হচ্ছে? কেন বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলছে একজন সাধারন মানুষের কাছে?

ও চাঁদনী কে নিজের থেকে জোর করে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু চাঁদনী নাছোড়বান্দার মতো ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা দিয়ে রইল। এবার যেনো শ্রাবন আরো বেশি দুর্বল হতে লাগলো ওর প্রতি। কেন জানি বারবার নিজের ভ্যাম্পায়ার রুপ কে হারিয়ে ফেলে সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে ইচ্ছা করলো তার। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এই মুহূর্তে তার রক্তের নেশা হচ্ছে না। কেন এমন হচ্ছে? কেন এই মেয়েটার প্রতি এত মায়া কাজ করছে তার? এটা তো হওয়ার কথা নয়! কথাগুলো ভেবে তার মাথা ঘুরে উঠলো। সে আবারও ফিরে তাকাল। দেখলো চাঁদনী আগের মতোই তার বুকের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। সে না চাওয়া সত্ত্বেও ডান হাত দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর শান্ত গলায় বললো,

“কে বলেছে আমি তোমায় ভালবাসি না?”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,