ভয়ংকর সে পর্ব-০৮

0
216

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_৮
#M_Sonali

“কে বলেছে আমি তোমায় ভালবাসি না?”

শ্রাবণের এমন কথায় ওর বুক থেকে নিজের মাথাটা তুলে ওর মুখের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাল চাঁদনী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে করুন গলায় বললো,

“ভালোই যদি বাসেন, তাহলে মারতে চান কেন আমায়?”

ওর এমন কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেল শ্রাবণ। হকচকিয়ে উঠে ভাঙা গলায় বলে উঠল,

“মারতে চাই মানে! কি বলছো তুমি এসব?”

“ঠিকই তো বলছি। যদি নাই মারতে চান তাহলে এমন ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছেন কেন? আপনি জানেন বিয়ের আগে আমি কত স্বপ্ন দেখতাম। যে বিয়ের পর স্বামীর সাথে ইচ্ছামত ঘুরবো। কিন্তু আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় তিন দিন হতে চলল। অথচ আপনি আমাকে নিয়ে একটুও কোথাও ঘুরতে গেলেন না। আপনি একদম পঁচা। আমাকে একটুও ভালোবাসে না।”

কথাগুলো বলে অভিমানের ভান করে অন্যদিকে ঘুরে বসল চাঁদনী। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগল শ্রাবণ যেন তাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতে রাজি হয়। যেভাবেই হোক এই বাড়ি থেকে বেরোতে হবে তাকে।

কিন্তু বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও শ্রাবণের কাছ থেকে কোনরকম উত্তর এলো না। এতে বেশ নিরাশ হলো চাঁদনী। সে এবার পিছন দিকে ঘুরে তাকালো। কিন্তু আজব তার পাশে কেউ নেই। তার পাশে কেন পুরো রুমে কেউ নেই। এবার কিছুটা ভয় কাজ করতে লাগল তার মনে। সে কি কিছু ভুল বললো? যদি শ্রাবণ তার কোন ক্ষতি করে বসে? কথাটা ভেবেই একটি শুকনো ঢোক গিললো সে। উঠে দাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকতে লাগল,

“এই যে শুনছেন, কোথায় গেলেন আপনি? আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”

কিন্তু না কোথাও থেকে শ্রাবণের কোন সারা পেলো না। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে এ রুম ও রুম খুঁজে নিরাশ হয়ে বেডরুমে গিয়ে বিছানার ওপর বসে পরলো সে। মনে মনে বাবার কথা ভেবে ভীষণ রকম কান্না পেতে লাগল তার। সে মনে মনে বলতে লাগলো,

“বাবা তোমার সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। এ বন্দি জীবন থেকে আমি কখনোই বের হতে পারবো না। এখান থেকে হয়তো আমার রক্তহীন লাসটাই শুধু বের হবে। কোন ভুল করে থাকলে তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা। দাদি তোমাকেও বড্ড মিস করছি। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওনা তোমরা প্লিজ।”

কথা গুলো মনে মনে বলে চোখের জল ফেলতে লাগল সে। তখনই পাশে কারো উপস্থিতি টের পেলো। সে দ্রুত সে দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলো শ্রাবণ মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত দুটো পেছনে রাখা। সে উঠে দাঁড়ালো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই শ্রাবণ পিছন থেকে নিজের হাতটা সামনে এনে একটি বক্স ওর হাতে দিয়ে বলল,

“এই নাও এর মধ্যে যেটা আছে সেটা পড়ে রেডি হয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। আর মন খারাপ করে থাকতে হবে না তোমার।”

মুহূর্তেই যেন কান্নাটা হাসিতে পরিণত হতো চাঁদনীর। এখান থেকে বের হতে পারবে যেনে চোখের জল হারিয়ে গিয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। সে দ্রুত বক্স টা হাতে নিয়ে সেটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। বক্সটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসলো অনেক সুন্দর একদম কালো কুচকুচে রঙের একটি গাউন জামা। তবে জামাটার গলাটা অনেক লম্বা এবং বড়।

চাঁদনী জামাটা নিজের গায়ের সাথে ধরে করুন গলায় বলল,

“জামার গলাটা তো অনেক বড়। এটা আমি পড়বো কিভাবে? গলার জন্য তো অনেক নিচে নেমে আসবে এটা!”

ওর কথা শুনে শ্রাবণ মৃদু হেসে দিয়ে বলল,

“এত চিন্তা করছো কেন? এটা পড়ার পর তোমাকে আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখবে না। তাই এত চিন্তা করার কোনো কারণ নেই বুঝেছ। এখন তাড়াতাড়ি এটা পড়ে রেডি হয়ে নাও। আর হ্যাঁ তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু এই বক্স টার মধ্যেই আছে। সেগুলো নিয়ে রেডি হয়ে নাও। আমি অন্য রুমে গিয়ে বসছি।”

কথাটি বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সে। চাঁদনী এখান থেকে বের হওয়ার আনন্দে আর কোন কিছু চিন্তা না করে দ্রুত জামাটা পড়ে রেডি হতে লাগলো। ১৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল সে। শ্রাবণের সামনে এসে দাঁড়াতেই ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। একনজরে ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ওকে দেখতে এতটা সুন্দর লাগছে যেন কোন প্রিন্সেস দাঁড়িয়ে আছে। কালো কুচকুচে রঙের জামাটা ওর ফর্সা শরীরে যেন একদম ফুটে উঠেছে। জামার গলা বড় হওয়ার কারণে গলার অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ওর ফর্সা গলাটা দেখে বারবার রক্তের নেশা হতে লাগল শ্রাবনের। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে চাঁদনীর রুপের নেশায় পাগল হলো সে। তারপর একপা দুপা করে ওর কাছে এগিয়ে এলো। আচমকাই নিজের অজান্তে ওর কপালে চুমু দিয়ে বসলো শ্রাবণ। তারপর আবেগি গলায় বললো,

“তোমার মত সুন্দরী নারী আমি এর আগে কখনো দেখিনি চাঁদ পাখি।”

ওর এমন কথা এবং কাজে চাঁদনী যেন কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গেল ওর স্বামী একজন ভ্যাম্পায়ার। সেও আবেগি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলল,

“আপনার মত এমন সুদর্শন পুরুষও আমি এর আগে কখনো দেখিনি। আপনাকে প্রথম দেখাতেই আমি আপনার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু,,,!”

এতোটুকু বলেই থেমে গেল চাঁদনী। তারপর মাথা নিচু করে ফেলল সে। বুকের মাঝে ব্যথা করতে শুরু করল তার। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মনে মনে বার বার ভাবছে, আজ শ্রাবণ যদি একজন সাধারন মানুষ হতো। ওর ভালবাসার স্বামী হতো। তাহলে কতই না সুন্দর হতো ওর জীবনটা। কিন্তু এ যে ওর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য ওর সাথে এতো নাটক করছে। এসব ভেবেই যেন চোখে জল চলে আসলো চাঁদনীর। কিন্তু এই মুহুর্তে সে কাঁদতে চায় না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

” কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে দেখতেই থাকবেন। নাকি ঘুরতে নিয়ে যাবেন?”

ওর কথায় ধ্যান ভাঙলো শ্রাবণের। মুচকি হেসে আচমকাই ওকে কোলে তুলে নিল। চাঁদনী অবাক হয়ে বলল,

“এটা কি করছেন? আমাকে কোলে নিলেন কেন আপনি?”

“তুমি না বললে ঘুরতে যাবে! তাই তো কোলে নিলাম তোমায়। এখন এত কথা না বলে চোখটা বন্ধ করো।”

ওর কথার উত্তরে চাঁদনী আরো বড় বড় করে ওর দিকে তাকাল। শুকনো ঢোক গিলে বললো,

“চোখ বন্ধ করবো কেন? কি করবেন আপনি?”

শ্রাবণ কিছু বলল না। মুচকি হেসে ওর চোখের দিকে বড় বড় করে তাকালো। সাথে সাথে ওর চোখ থেকে একটি নীল আলোকরশ্মি বেরিয়ে চাঁদনীর চোখে গিয়ে পরলো। ঘুমে ঢুলে পরলো চাঁদনী। তখনই মুহূর্তের মধ্যে শ্রাবণের পিঠের চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে এলো বিশাল লম্বা লম্বা দুটি কালো রঙের ডানা। সেই ডানাগুলোর পালকগুলো যেন একদম চিকচিক করছে। ঠিক যেমন পালক চাঁদনীর হাতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

শ্রাবণ নিজের ডানা ঝাপটিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই চাঁদনী কে নিয়ে উড়াল দিয়ে কোথাও একটা চলে গেল।
,
,
,
গায়ে ঠান্ডা বাতাস এবং নাকে অসম্ভব সুন্দর ঘ্রাণ পাওয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল চাঁদনীর। চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো সে এখনও শ্রাবনের কোলের মধ্যেই রয়েছে। সাথে সাথে সে আশেপাশে ঘুরে তাকাল। দেখল বিশাল বড় এক পাহাড়ের চূড়ায় দাড়িয়ে আছে তারা। সে ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত শ্রাবণের গলা জড়িয়ে ধরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে বলল,

“ওমাগো, আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন। এখান থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলবেন নাকি?”

ওর কথা শুনে মুচকি হাসলো শ্রাবণ। কোল থেকে আস্তে করে নিচে নামিয়ে দিল। চাঁদনী চারপাশে তাকিয়ে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল পাহাড়ের চূড়া হলেও জায়গাটা অনেক চওড়া। অসম্ভব সুন্দর জায়গাটা। আকাশের মেঘ গুলো যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।

চারিপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা রকম ফুলের গাছ। সেই ফুলগুলো সে আগে কখনোই দেখেনি। অসম্ভব সুন্দর ফুলের ঘ্রাণটাও যেন বাতাসের তালে তালে তার নাকে বারি খেয়ে যাচ্ছে। যার সুবাসে ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছে তার মন। মুহূর্তেই সে সব কিছু ভুলে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল। আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই এক খন্ড মেঘ এসে তার হাত ভিজিয়ে দিল। এতটা সুন্দর জায়গা সে এর আগে কখনো দেখেনি। তার মনে হচ্ছে সে যেন জীবিত অবস্থাতেই স্বর্গে চলে এসেছে।

চাঁদনী এবার ব্যাকুল হয়ে এদিক থেকে ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। একটি ফুল গাছের কাছে গিয়ে ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগল। তার ঘ্রাণ নিতে লাগল। বারবার আকাশের মেঘগুলো ছুয়ে দিয়ে হাত ভেজাতে লাগল। তার এমন আনন্দ দেখে চোখ জুড়িয়ে উপভোগ করছিল শ্রাবণ। সেও যেন মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলে গিয়েছে। চাঁদনীকে সে কেন নিয়ে এসেছে সে ব্যপারে।

ছোটাছুটি করতে করতে আচমকা পাহাড়ের একদম কিনারায় চলে গেল চাঁদনী। আর বেখেয়ালে পা ফসকে পড়ে গেল পাহাড়ের নীচে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই শ্রাবণের যেন প্রাণ পাখিটা উড়ে যেতে চাইলো। সে এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজের ভ্যাম্পায়ার রূপে এসে লাফ দিলো পাহাড় থেকে। আর মুহূর্তের মাঝে চাঁদনীকে গিয়ে ধরে ফেলল। ওকে কোলে নিয়ে উঠে এলো পাহাড়ের চূড়ায়। এই প্রথম ওকে ভ্যাম্পায়ার রুপে দেখছে চাঁদনী। কোল থেকে নামিয়ে দিতেই সে ভয়ে ওর থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে দেখতে লাগল। শ্রাবণের চোখদুটো টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হাতের নখগুলো হয়ে গেছে লম্বা লম্বা। মুখের মধ্যে সরু দুটি দাঁত বেড়িয়ে এসেছে। পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে বিশাল লম্বা দুটি কালো কুচকুচে রঙের ডানা। সেই ডানার সাথে চিকচিক করতে থাকা পালকগুলো বাতাসে উড়ছে।

চাঁদনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।

সাথে সাথে শ্রাবণ দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে ফেলল। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে মানুষ রুপে ফিরে এলো। ওকে জড়িয়ে ধরেই চিৎকার করে বলল,

“ভয় পেওনা চাঁদপাখি। আমি তোমার কিচ্ছু হতে দিব না। তুমি এই পাথর মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছ। তোমার শরীরে কোনো আচর পরতে দিব না আমি। তোমাকে বিপদে ফেলার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। রক্ত খেয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন থেকে তোমার সকল বিপদে ঢাল হয়ে দাড়াবো আমি। তুমি আমার প্রাণ পাখি। তোমার কিছু হলে আমি নিজেও মরে যাব। আমি যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি চাঁদনী। কিন্তু আমার এই ভালবাসা’ই যে তোমার সব চাইতে বড় বিপদের কারণ হবে।”
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,