মধু পিঁপড়া পর্ব-২+৩

0
120

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ০২
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

-‘ছেলেকে বিয়ে করিয়েছ একঘন্টা হয়েছে।এর মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পরেছ দেখি!কোথায় নতুন বউকে আপ্যায়ন করবে তা না!এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো।’স্বামীর কথায় সেলিনা খাতুনের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।তিনি সোফায় মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন।একাগ্রচিত্তে ভাবছেন।ছেলের খুশির কথা ভাবতে যেয়ে,মেয়েটিকে কষ্ট দিয়ে ফেলেন নি তো আবার!তিনি নিজেও তো তখন বুঝতে পারেন নি।প্রথম ভেবেছিলেন বিয়ে ভাঙার বিষয়টি কাকতালীয়।তাইজুল ইসলাম যে কেবল তার এক কথায় মেয়ের পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন,সে সময় যদি একটু বুঝতেন!!কি বা করতেন?তার ছেলেই বা কোনো অংশে কম!তারা তাদের মতো কোটিপতি নাই বা হতে পারেন,তাই বলে কি না খেয়ে থাকেন নাকি?ছেলে তার কাস্টমসের উপ-কমিশনার।এ গ্রেডের বেতন স্কিল!এই তো আর পাচঁ বছর গেলে ভালো প্রমোশনও পেয়ে যাবে।তিন বছর হলো মিরপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের সেকশন-৬ এর আন্ডারের একটা কোয়ার্টারে তারা শিফট হয়েছেন।ছেলের অফিস থেকে গাড়িও পেয়েছে। সেই গাড়িতে চড়েই তো সকলে মিলে বিয়ে খেতে গিয়েছিলেন!নতুন বউকে তো সেই গাড়িতে করেই নিয়ে এলেন।বউ আদোও খেয়াল করেছে কি না কে জানে!তাইজুলের বাড়িতে কয়টা গাড়ি যেন আছে?ছয়টা বোধহয়! কিন্তু সেটা তো পাঁচ বছর আগের কথা।এখন হয়ত আরো গাড়ি কিনেছেন!হুট করেই সেলিনা খাতুনের মন খারাপ হয়ে গেল।চোখ বন্ধ করা অবস্থায় কপাল কুঁচকালেন।সবকিছু ভীষণ বিতৃষ্ণা লাগছে।

——

-‘খালাম্মা হজাগ নি!খালু আব্বার নাকি পেট ঘুটঘুট করতাছে?আমনেরে বুলাইছে,বলসে ছাদে যাইতে।বিয়াত নাকি শাহি টুরহা বেশি খাইয়া লাইছে।দুধের খাওন খাইলে যতক্ষণ এতো সমস্যা,তয় না খাইলে কি আয় কন তো দেখি!’

সেলিনা খাতুন চোখ মেলে তাকালেন।সে সময় সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।চমকি উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।মৃদু কন্ঠে জবাব দিলেন।

-‘তোর এতো কিছু ভাবতে হবে না।তা,বউ কি করছে?

-‘ভাবী তো ঘুমায়।বেচারি বিয়া কইরা ক্লান্ত হইয়া পড়ছে!’

-‘সে কি খাবে,যেয়ে জিজ্ঞেস কর?বমি করে তো সব ভাসিয়েছে।ঘরে যে কোনো রান্না নেই ভুলে গেছিস নাকি?’

-‘কি যে কন আমনে?আমরা যেডি খাই,হেডি নতুন বউয়ের মুহে রুচবো!আমি টেলিভিশনো দেখছি কোডিপোতিরা পাছতা না খাসতা কি জানি কয়,হেডি কাডা চামচদা গুঁতাইয়া গুতাইয়া খায়।’

চমকির কথা শুনে সেলিনা খাতুনের মন খারাপের পরিমাণ যেন আরো বেড়ে গেল।সামিরা মেয়েটার জন্য তার বেশ দুঃখ হচ্ছে।সেই সাথে নিজের ছেলের জন্য হচ্ছে সীমাহীন কষ্ট!সেলিনা খাতুন ভুলেই গেলেন যে দুঃখ, কষ্ট একই সূত্রে গাঁথা।

——–

সামিরা শশুর বাড়িতে পৌঁছানোর এক ঘন্টা পর পরই নামিরা ও সাঈফ এসেছে হাজির।সাথে এনেছে একগাদা খাবার।তাইজুল ইসলামের সেক্রেটারির সাথে আরো দুুই তিনজন ছেলে মিলে কাচ্চির হাড়ি ফ্লাটে আনার ব্যবস্থা করছে।সোফায় বসে উশখুশ করছে নামিরা।তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার সারা শরীর চুলকাচ্ছে।এই চুলকানি নরমাল কোনো চুলকানি না!কথা বলার চুলকানি।সাঈফ খুব ভালো করেই জানে তার আপার এই চুলকানি থামানোর ব্যবস্থা না করলে,আরো বেড়ে যাবে।

-‘বড়পা!কিছু বলবি!এতো নড়ছি কেন?’

নামিরা এমন একটা প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলো।ভাব বজায় রাখার জন্য মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুললো।

-‘একটু চুপচাপ বসে আছি তোর ভাল্লাগছে না তাই না!তা…জিজ্ঞেস যখন করলি তখন তো বলতেই হয়!’আশেপাশে তাকিয়ে দেখ সব বুঝতে পারবি।’

বোনের কথামতো সাঈফ আশেপাশে তাকালো।মিডিয়াম সাইজের ড্রইং রুম।আশেপাশে চার/পাঁচটির মতো রুম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ড্রইং রুম থেকে কিচেন একপাশ স্পষ্ট।সাঈফের নজরে বিশেষ কিছু পরলো না।জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল।

-‘তুই আসলেও একটা গাধা।ওয়াল সেল্ফের দিকে তাকিয়ে দেখ এন্টিকের টেলিফোন!এটার দাম আনুমানিক পাঁচ হাজার টাকা তো হবেই।আমি খবর নিয়েছি ছেলের বেতন ষাট হাজার।এই যতসামান্য টাকায় এতো দামি এন্টিক পিস কেনার সাহস আসে কোথা থেকে তুই বল!ছেলে যে ঘুষখোর এটাই তার হলো যথার্থ প্রমাণ।সব জিনিস ঘুষের টাকায় কেনা।’

সাঈফ বোনের কথায় নিজেকে শান্ত রাখলো।সবকিছুতে খুঁত,ধরতেই হবে!এটা যেন আপার মুদ্রাদোষ।সে নামিরা বাম হাত চেপে ধরলো।ফিসফিস করে বলল,

-‘বড়পা যেদিন থেকে তুই দুলাভাইয়ের আরেকটা বিয়ের খবর পেয়েছিস,সেদিন থেকে তুই কেমন জানি বদলে গেছিস!এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু না!’

এসির নিচে বসেও নামিরা ঘামতে লাগলো।বুক ধড়ফড় করছে তার।ভেতরটা হাহাকার করছে।সাঈফের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত সরানোর চেষ্টা করছে।বাকি কথাগুলো সে একদম শুনতে চাইছে না।একদমই না!সাঈফ একদমে নির্লিপ্তভাবে নিজের মতোই বলে চলছে।

-‘ছোট থেকেই তুই বেশ সৌখিন।কোনোকিছু পছন্দ হলে যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন মনে করতি না!লাবিব ভাইয়ের ব্যাপারেও একই কাজ করলি।তোর জেদের কাছে হেরে,ছেলে বেকার জেনেও বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন।বিয়ের ছয় মাসের মাথায় তুই দুলাভাইয়ের নতুন ব্যবসার কথা জানতে পারলি।বাবার কাছে টাকা চাইতে তোর আত্মসম্মানে লাগে!তাই দুলাভাইয়ের কথামতো কাউকে না জানিয়ে,নিজের গহনার পাশাপাশি নানীর গহনা গুলো তার হাতে তুলে দিলি।ভেবেছিলি ব্যবসা দাঁড়ালেই গহনা গুলো ব্যাংক থেকে এনে আগের জায়গায় রেখে দিবি।তুই হয়ত জানিস না!সেসব গহনা নানী তোর জন্যই রেখেছিলো।”

এ পর্যায়ে এসে সাঈফ থেমে গেল।স্থান, সময়,বর্তমান ভুলে নামিরা ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো।এবার নিজেই সাঈফের হাত চেপে ধরলো।পৃথিবীর সবচেয়ে ভরসা যোগ্য হাত।সাঈফ আশেপাশে তাকালো।ড্রইং রুমে তারা দুজন ব্যতিত আর কেউ নেই।বোনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো একহাতে ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিলো।

-‘বড়পা,আমার দেখা সবচেয়ে সরল মেয়ে হলি তুই।দুলাভাই তোকে ধোঁকা দিলো।গহনা নিয়ে পালালো।নতুন সংসার শুরু করলো।সে সময় তুই সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করে নিলেও,ভেতরে ভেতরে কনফিডেন্স হারিয়ে ফেললি।সবাই সব জেনেও তোর দিকে তাকিয়ে চুপ রইলাম।আমরা চাইতাম তুই নিজে থেকে ওই মানুষটাকে ডিফেন্ড কর।অথচ আস্তে আস্তে সব মানুষের ওপর থেকে তুই ট্রাস্ট হারিয়ে ফেললি।আমি চাই এবার তুই মানুষকে নতুন করে বিশ্বাস করা শেখ।ভালো সাথে সাথে খারাপের জন্য,পজিটিভ মাইন্ডসেট কর।বাবা আমাদের জন্য সব সময় বেস্ট টাই সিলেক্ট করে এসেছে!আপার সাথে একমাত্র আবির ভাই এডজাস্টট্যাবেল।আমার দেখা স্টেইনলেস মানুষগুলোর মধ্যে একজন হলো আবির ভাই।মধ্যবিত্ত মানেই যে তারা সকলে অসৎ হবে,ছোট মন মানসিকতার হবে বিষয়টি এমন না।ইউনিভার্স তার হুউম্যানিটি এখনো হারিয়ে ফেলে নি।আজ আমার হাত ধরেছিস না?এই হাত একদম ছাড়বি না।আমরা দুজন মিলে এই নতুন পরিবারকে এক্সপ্লোর করবো……কেমন!

সাঈফ এক হাতে তার বড়’পার চোখের পানি মুছে দিলো।নামিরার নিজেকে খুব হাল্কা মনে হলো।দু’বছর যাবৎ এই বোঝা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।অগণিত বার নিজের করা কাজের অনুশোচনা করেছে।নিজের সত্তাকে ছোট করেছে।সাঈফ একটা কথা ভুল বলেছে।সে সরল নয়,মহা বোকা!নামিরা সবার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো।সেটাই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।আসলে নিজের মানুষদের কাছে কোনো কিছুই আড়াল করা যায় না,কেবল দৃষ্টি লুকিয়ে রাখা যায়।

——

-‘ইস,এতো গুলো মুক্ত খুইয়ে দিলে?আমাকে দিয়ে দিলেই পারতে!যে কি আফসোস হচ্ছে আমার!’

সেলিনা খাতুনের কথা বুঝতে না পেরে নামিরা ও সাঈফের এক অপরের দিকে তাকাল।তিনি এগিয়ে এসে সোফায় বসলেন।নামিরা ও সাঈফের কথা মাঝেই তিনি হাজির হয়েছেন।নামিরার চোখ থেকে পানির ফোঁটা নিজের আঙুলে তুলে নিলেন।তারপর আফসোস গলায় বললেন,

-‘মুক্তো গুলো কি চকচক করছে!আগে জানলে তো তোমার চোখের সামনে আমি হাঁড়ি পেতে বসে যেতাম।এরপর থেকে যখন মুক্ত ঝরাবে আমাকে কিন্তু বলে নিবে…..কেমন?’

কথার ভঙ্গিমায় নামিরা ও সাঈফ খিলখিল করে হেঁসে উঠলো।মূহুর্তেই নামিরার সেলিনা খাতুনকে ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল।সে তার হাতের দিকে তাকাল,সেটি এখনো সাঈফের হাতের মুঠোয়।রক্ত বরণ গালে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি ও ওষ্ঠে বিচরণে করা প্রাণবন্ত হাসির সংমিশ্রণে মেয়েটিকে যে ভীষণ নজরকাঁড়া লাগছে।সেলিনা খাতুন বিমোহিত হয়ে গেলেন।নামিরা ও সাঈফ খেয়াল করলো যে সেলিনা খাতুনের বা’হাত শাড়ির আঁচলে ঢেকে রাখা।এর কারণ তারা চট করেই ধরতে পারলো।তাদের বাবার বেপরোয়া ড্রাইভিং এর কারণে এই মহিলাটি তার বা’হাত খুইয়েছে এবং এর প্রতিদান দিতে হচ্ছে সামিরাকে।দুইজনের মুখে আধার নেমে এলো।মুখের হাসি মিইয়ে গেল।সেলিনা খাতুন কিছুটা বুঝতে পারলেন।

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ০৩
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

দু’ঘন্টা ঘুম,এরপর লম্বা একটা হট শাওয়ার।সব মিলিয়ে সামিরার শরীর ফুরফুরে হয়ে গেছে। ব্যাকুল হৃদয়ও কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে। শাওয়ার নিয়ে মাত্রই ওয়াশরুমের বাহিরে এসেছে দাঁড়িয়েছে সে।স্বভাব বশত শ্বাস ছাড়লো।দু’হাত কোমড়ে রেখে গভীর দৃষ্টিতে বেডরুমে নজর বোলালো।আসার সাথে সাথে ভারি শাড়ি আর হেভি মেকআপ নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো।বেশ পরিপাটি কামরা!আকৃতিতে মাঝারি!রুমের মাঝামাঝি হাতিলের কাপল স্টোরেজ বেড।বিছানার ডান পাশে লং লেন্থ মিরর।গোল্ডের রঙের মোজাইক ফ্রেম।মিররের সামনে বেতের গোল চেয়ার।ওপরে সাদা কুশন বিছানো।বিছানার বাম পাশে ট্রিপড ফ্লোর ল্যাম্পশেড।পূর্ব পাশের দেয়ালের এক তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে ফ্লোর টু সেলিং মিরর উইন্ডো।তার ওপরে ওফ হোয়াইট রঙের পিউর লিলেন কার্টেন।জানালার পাশে রুমের দরজা।উত্তর পাশে উডেন স্লাইডিং ওয়ারড্রব।এক কোনায় দু’জন মানুষের বসার জন্য মডিউলার সোফা।বিছানার কিছুটা ওপরে ইউরোপিয়ান রাউন্ড পিকক ওয়াল ক্লক।দেয়ালের সাথে বেশ ভালোভাবে সেট করা।সামিরা অভিভূত!মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।ছোট থেকে তার এমন ছিমছাম জিনিস বেশ পছন্দ।

-“হায়!হায় ভাবী কামডা করছেন কি!এমন তিন সন্ধ্যা বেলা ন্যাংডা হইয়া গোসলখানাত গেছেন?”

কানের কাছে চমকির কর্কশ স্বর বেজে উঠতে সামিরা ধড়ফড়িয়ে উঠলো।নিজের ভাবনায় এতোই মগ্ন ছিলো যে,চমকি কখন প্রবেশ করেছে টেরই পায় নি সে।সামিরা নিজের দিকে তাকালো।তার পরনে পিংক ওয়াফেলো বাথরোব।লম্বায় হাঁটুর কিছুটা উপরে।ধবধবে ফর্সা সরু পা গুলো দৃশ্যমান।সামিরার কান ঝা ঝা করে উঠলো।মাথার তালু গরম হতে লাগলো।এই মেয়েতো দেখা যায় ভীষণ ঠোঁটকাটা!কি একটা অবস্থা!এভাবে হুট করে নক না করে কেউ এসে পড়বে সে একদম বুঝতে পারে নি।

-“আধুনিক যুগের মাইয়া আপনে,এইডা তো আর জানেন না যে টয়লেডো খন্নাস জ্বিন থাকে।আমার দাদী কইতো মাগরিবের আজানের সময় হাগা/মোতা বন্ধ রাহন লাগে।নাইলে ক্ষতি হয়।”

-“আমি তো গোসল করেছি!তাও কি ক্ষতি হবে?”

সামিরা ভয় পাওয়ার ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করলো।সে সব সময় পোশাক পরেই গোসল করে।বাহিরে বের হওয়ার আগে ভেজা কাপড় বদলিয়ে বাথরোব জড়িয়ে নেয়।কিন্তু এই কথা সে চমকিকে বললো না।চমকির মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।তাকে বেশ চিন্তিত মনে হল।যুতসই কোনো জবাব দিতে পারলো না।অনেকক্ষণ ভেবে বলল,

-“ক্ষতি হওয়ায় হইলে তো এতক্ষণে হইয়াই যাইতো।আর কপাল পুড়তো আবির ভাইয়ের।”
-“কিভাবে?”
-“এই জ্বীন যুয়ান ছেড়ি গো লগে আকাম-কুকাম করে।এর মধ্যে আপনি হইলেন নতুন বিয়াইত্তা।শইলে হলুদের ছোঁয়া……”

-“কিরে সামি এভাবে আধ-উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?জামা কাপড় পরে বাহিরে আয়!ছাদে পার্টি করা হবে।ফিস বারবিকিউ!আর চমকি তুমি!সামিকে ডাকতে এসে এখানেই মজে গেছো দেখছি?সামি তো এখন থেকে সারাজীবন এখানেই থাকবে।পরে গল্প করো!!এখন জলদি চল বাহিরে কাজ আছে অনেক।”

নামিরার উপস্থিতিতে চমকির কথা থেমে গেল।সামিরা বেশ স্বাভাবিক। বোনকে দেখে তার মধ্যে কোনোরকম কোনো উৎফুল্লতা নেই।আদিবার কাছে তাদের আসার খবর সে আগেই পেয়েছে।নামিরাও সেদিকে খেয়াল দিলো না। চমকির সাথে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।সামিরা হেঁটে বিছানার পাশ থেকে তার লাগেজ টেনে বের করলো।লাল কালো মিশেলের লং পোলাক ডট কুর্তি ও কালো প্লাজু নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

———-
সেলিনা খাতুনের আর ছাদে যাওয়া হয় নি।স্বামীকে নিয়ে এই মূহুর্তে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই।এদিকে ডান হাত একটু পর পর কাঁপছে।মাছে ঠিকমতো মশলা মাখাতে পারছেন না।শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণা মুছছেন।খুশিতে বার বার চোখ ভিজে উঠছে।নামিরা আর সাঈফ তাদের সাথে এতো সহজে মিশে যাবে,এ যেন কল্পনাতীত!সাঈফ ছেলেটার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে কতোদিনের যেন পূর্ব পরিচিত তারা!ঘরের ছেলের মতো কাজ করছে।অতি যত্নে কাচ্চি বিরিয়ানি ওয়ান টাইম বক্সে ভরছে।সেই সাথে চমকিকে নিয়ে কোয়ার্টারের বাকি ফ্লাটগুলোতে বিলি করছে।এদিকে ঘরের ছেলের কোনো খবর নেই।কোথায় যে ঘাপটি মেরে বসে আছে!কে জানে?সেলিনা খাতুন ছেলেকে মনে মনে বকা দিলেন।বিয়ে হয়েছে ,কই বউয়ের আঁচলের তলায় লুকিয়ে থাকবে!তা না!তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।ধ্যাত!মেজাজ চটে যাচ্ছে।

-“আন্টি!আমাকে এক কাপ কফি দেওয়া যাবে?”

রিনরিনে মিষ্টি সুমধুর কন্ঠ!সেলিনা খাতুন পেছনে ফিরলেন।মূহুর্তে চোখ ধাঁধিয়ে গেল।সুনিপুণ চোখে ছেলের বউকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।চকচকে পরিষ্কার চামড়া। মাখনের মতো কোমলাঙ্গ দেহে কালো রং এঁটে বসে আছে। হাঁটুর নিচ অবদি লম্বা কুর্তির এক পাশ কুঁচকে আছে,প্লাজুর অল্প অংশ দেখা যাচ্ছে।বুকের ওপর কালো রঙের শিফনের ওড়না ছড়ানো।মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করা।ভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়ানো।কাজল বিহীন টলটলে চোখ।হাত,গলা,কান,নাক সম্পূর্ণ খালি।সব মিলিয়ে সাধারণ এক অনবদ্য সুন্দরী।অন্তত সেলিনা খাতুনের তাই মনে হলো!মশলা মাখা হাত নিয়ে সামিরার দিকে এগিয়ে গেলে।তার উপর থুতু ছিটালেন।মনে মনে বললেন,”মাশাল্লাহ”।মুখে বললেন,

-“আদিবাকে নিয়ে ছাদে যাও।তোমার বোন ও সেখানে।চমকি আসলে আমি কফি পাঠিয়ে দিবো।”

সেলিনা খাতুন আরো কিছু বলতে চাইলেন।সামিরার চোখের দিকে তাকিয়ে তার মুখ ভোঁতা হয়ে গেল।ভাবলেশহীন ভাবে নিজের কাজে মন দিলেন।হাতের কম্পন বহু আগেই থেমে গেছে। এদিকে সামিরা ভাবছে কি মাপা মাপা কথা!কাট কাট গলা।দূর থেকে সেলিনা খাতুনকে একা কাজ করতে দেখে সে এগিয়ে এসেছিলো সাহায্যের জন্যে।জড়তার কারণে কফি চেয়ে বসে।এদিকে শাশুড়ির এমন নির্লিপ্ততায় সামিরার মন খারাপ হয়ে গেল।কিছু সময় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে কিচেন থেকে বের হয়ে গেল।আদিবার রুমের দরজা ভিড়ানো।সামিরা দু”বার নক করলো।কোনো রকম কোনো রেসপন্স নেই। একা একাই ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

——

-“আমার বাপ আছিল বালা মানুষ।কোনোদিন আম্মা ছাড়া আমার লগে কথা কইতো না!ভাঙ্গা ঘরে সুখের কমতি আছিলো না।একদিন হের ডেঙ্গু হইলো।সাতদিন হাসপাতালো ভর্তি!হের লগে শুধু আমি।এই ফাঁকে মায় আরেকখান হাঙ্গা করলো।সেই খবর কানে যাইতে দেরী আমার বাপের মরতে দেরি হইলো না।মায়ের বিয়ার রাতেই বাপ পগারপার!সৎ বাপের লগে থাকন শুরু করলাম।পড়াশোনা চাঙ্গে উঠলো।ঘরের কামের বদলে মাইর ফ্রী!”

চমকির গলা কিছুটা কেঁপে উঠলো। তার থেমে যাওয়ায় সাঈফ সেদিকে তাকাল।জীর্ণ শীর্ণ দেহের মেয়েটি কেমন জুড়ে জুড়ে শ্বাস নিচ্ছে।চোখ দুটো পানিতে টলটল করছে।হয়ত,ভয়ংকর বিষাদমাখা স্মৃতিগুলো তাড়া করছে।বয়স কতো হবে মেয়েটার?ষোলো কি সতেরো!আদিবার চেয়ে বছর দুয়েক ছোট হবে।ধুর!আবার সেই আদিবা।বিয়ে থেকে শুরু করে বিগত পাঁচ ঘন্টা যাবৎ এই আদিবা ভীষণ ভাবে জ্বালাচ্ছে।সাঈফের মস্তিষ্কে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে।অথচ গাধার রানীর কোনো খবর নেই!আর একবার দেখা দিলে কি এমন হয়?সাঈফ মাথা ঝাঁকাল।আর ভাববে না সে!!চমকির দিকে মনযোগ দিলো।নিজেকে টিকিয়ে রাখতে এই বয়সে মেয়েটাকে কতো স্ট্রাগল করতে হয়েছে কে জানে!চমকি ঢোক গিলে পুনরায় বলা শুরু করলো।

-“আবির ভাই আমগো গ্রামে গেছিলো হের কামের উদ্দেশ্যে।সীমান্ত এলাকা।চোরাকারবারির কয়েকজন বেডা আমগো গ্রামে আইসা গাপটি মারসিলো।এর মধ্যে একজন আসিলো আমার সৎ বাপের বন্ধু!হেরা দামি দামি গাঞ্জা লুকাই ভারতের তন এদেশ আনতো।আমার মা আর সৎ বাপেও হেগো লগে হাল্কা পাতলা জড়িতো আছিলো।পরে আমিই সাক্ষী দিলাম!

চমকির অশ্রুমাখা চোখ দুটো কেমন জ্বলে উঠলো।ঠোঁটের কোণে তৃপ্তি মাখা হাসি!সাঈফ বিষন্ন সেই চোখে এক অদ্ভুত উত্তাপ লক্ষ্য করল।প্রতিশোধের আগুনের উত্তাপ!ডেডি’স গার্ল!এই কথাটি যেন চমকির মতো মেয়েদের জন্যই তৈরি।

-“সব কয়ডারে বাইন্ধা জেলে ভরা হইলো।বেবাক কামের দায়িত্ব আছিলো আবির ভাইয়ের ওপরে।আমার মায়ও তহন জেলে।বাপ নাই।এতিম মাইয়া!এর উপরে যুয়ান!চারধারে মানুষ্যবেশী হায়ান।সব ভাইবা আবির ভাই আমারে সাথে কইরা এই শহরে আনলেন।বছর গড়াইছে আমি তহনতে হেগো লগেই থাকি।”

চমকির চোখ মুখে উৎফুল্লতা।এমন একটা পরিবারের সদস্য হতে পেরে সে যেনো বেশ সুখী!সাঈফ বোনের কথা ভেবে নিজের খুশি।

-“তয় সাঈফ ভাই আমেনেরে একখান কতা কই?
-“হে!বলো।”
-“মাইন্ড খাইয়েন না আবার।”
-“ওকে,তুমি বলো।”
-“আমনের নেলপালিশ দেওয়া নখ গিলি না,বরকির লেদার মতো দেখতে।”

চমকি উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। সাঈফ কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। নখের দিকে তাকাল।বাম হাতের নখে কালো কুচকুচে রঙের নেইলপলিশ দেওয়া।ব্যান্ডের অন্যান্য ছেলেদের দেখাদেখি সে একই কাজ করেছে।হাতের আঙ্গুলের তুলনায় নখগুলো খাটো খাটো।রাউন্ড শেপে কাটা।সত্যি সত্যি ছাগলের বড়ি বড়ি হাগুর মতো দেখতে।এবার চমকির সাথে সাথে সাঈফ নিজেও উচ্চস্বরে হেঁসে দিলো।হাসির দমকে তার একপেশে লম্বা চুলগুলো মুখে এসে পড়লো।কপাল আর চোখ ঢেকে গেল।

চলবে
ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়