মধু পিঁপড়া পর্ব-১৪+১৫

0
87

#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ১৪
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
হরেক রকম মিষ্টি, ফল,মাছ,মাংস আরো কতো কি!আবির তার অফিসের একজন স্টাফের মাধ্যমে এসব পাঠিয়েছে।দেশে না থাকলে কি হবে?নতুন জামাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছে ঠিকি!তাইজুল ইসলামের মুখে হাসি।সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন,
—“আমার পছন্দ বলে কথা! কখনো খারাপ হতেই পারে না।মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হলে কি হবে,সামাজিকতা জানা আছে।”
আমেনা বেগম ভেংচি কাটলেন।তাইজুল ইসলামের সাথে তাল মিলিয়ে মনু মিয়া বললেন,
—“হুম,একদম ঠিক কইছেন স্যার।দুই নাম্বার ভালো জামাই বইলা কথা।”

দুই নাম্বার জামাই? আমেনা বেগম হেঁসে দিলেন।নাদিরা বেগম মাকে থামাতে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন।তিনি থামার বদলে ফ্যাসফ্যাসে গলায় হাসছেন।তাইজুল ইসলাম মনু মিয়ার দিকে ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়ে হুংকার ছাড়লেন,
—“গাধা!দুই নম্বর কেন বললি?এক নম্বর ভালো জামাই বল।”
–“কিন্তু স্যার হেয় তো নামিরা আম্মাজানের না, সামিরা আম্মাজানের জামাই?”
–“হোক!তারপরও তুই এক নম্বরই বলবি।”
–“ঠিক আছে।এক নাম্বার ভালো জামাই।
মনু মিয়া চুপসে মুখে উত্তর দিলেন।ভুল তারই! তিনি মেনে নিলেন।তার স্যার যা বলে সবই ঠিক!!
মনু মিয়ার ভালো নাম মজনু।যুবক বয়সে তিনি তার মায়ের পছন্দে লাইলি নামের এক কিশোরীকে বিয়ে করেছিলেন।কিন্তু বিয়ের দু’মাসের মাথায় মেয়েটি তাকে ধোঁকা দিয়ে তারই সমবয়সী এক বন্ধুর সাথে পালিয়ে যায়।মজনু মিয়ার ভেতরটাও ভেঙে যায়।লাইলি মজনুর প্রেম কাহিনি জগৎ খ্যাত হলেও,তার কাহিনি সমাজের কাছে হাসির খোরাক!তার ধারণা জন্মে যে মজনু নামটির যোগ্য নয় সে।তাই তীব্র কষ্ট নিয়ে,তিনি নিজের নাম বদলে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে পাড়ি জমান।এক বন্ধুর সহায়তায় তাইজুল ইসলামের সেক্রেটারির পদে যোগ দেন।সেই থেকে আজ সাত বছর হয়ে গেছে,তিনি এই বাড়ির আউট হাউজেই থাকছেন।একাগ্রতার সহিত সব দায়িত্ব সামলিয়ে যাচ্ছেন।মনুু মিয়ার এখন মনে হয়,লাইলি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল বলেই,আজকে তার জীবনে এতোগুলা বিচিত্র,দিলখোলা মানুষের আনাগোনা!!যারা সবাই মিলে তার জীবনের দুঃখ ভারাক্রান্ত প্রেক্ষাপটই বদলে দিয়েছে।

————-

–“নিজেকে আমার খুব অসহায় লাগছে।কেমন যেন এলোমেলো!কলেজে,ভার্সিটিতে কম মেয়ের কাছ থেকে তো প্রপোজাল পাই নি?কই, কখনো তো কারো প্রতি এমন উইকনেস কাজ করে নি?শেষমেশ কি না এক নাক উঁচু মেয়ে আমাকে কাবু করলো?বুজতে পারছিস তুই!কেবল দুইদিনেই আমার মনের অবস্থা নাজেহাল।”

—“সবই বুঝেছি কিন্তু এখন করবি কি?কিছু ভেবেছিস!আগেই বলে রাখছি,প্রেমে পড়েছিস ভালো কথা কিন্তু এই স্টুডিও সাথে কোনোরকম বোঝা পড়া হবে না।”

রাতুলের কথায় সাঈফ বিস্মিত।সে ভেবেছিলো সব কথা শেয়ার করার পর,তার বন্ধুরা হয়ত তাকে কোনো সমাধান দিবে!এখন দেখা যাচ্ছে এরা ভুলভাল বকছে।সাঈফ বিরক্ত হলো।

—“মানে কি?প্রেমে পড়ার সাথে স্টুডিওর কি সম্পর্ক?”

—“শোন,প্রেম ভালোবাসা হলো তীব্র নেশা!মদ,বিড়ি,সিগারেটে কিন্তু কিছুই নেই,তারপরও সেটা নেশা! প্রেমও ঠিক তেমন।কিন্তু পার্থক্য হলো মদ,বিড়ি,সিগারেট খেলে শরীর শেষ হয়।আর প্রেমে পড়লে ক্যারিয়ার!”

রাতুল কথার ফাঁকে সিগারেটে আগুন ধরালো।পোড়া দুই ঠোঁটের মাঝে গুঁজে দিলো।সিগারেট মুখে নিয়ে বলতে লাগলো,

–“তাই,আগেই বলে রাখছি তুই যদি ভাবিস যে প্রেমে পড়েছিস,ভবিষ্যতে বিয়ে করবি!গান গেয়ে আর কতোদিন?স্টুডিও,গান বাদ দিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে জব নিবি,সেটা আলাদা হিসেব!কিন্তু আমরা এই স্টুডিও ছাড়বো না,তুই এটা আমাদের দিয়ে দিবি।এর বদলে আমরা তোকে তোর…”

রাতুলের কথা শেষ হওয়ার আগে সাঈফ উঠে দাঁড়াল।ক্ষিপ্রগতিতে সেন্টার টেবিলে লাথি মারলো।মূহুর্তে কাচের টুকরোগুলো জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো।রাগে তার মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।হাসিব ওয়াশরুমে গোসল করছিলো।সাবান মাখা অবস্থা কোমড়ে তোয়ালে জড়িয়ে বাহিরে বেরিয়ে এলো।তার চোখে রাজ্যের আতঙ্ক!অপরদিকে রাতুল নির্লিপ্ত।চোখ বুঝে আরামে সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ছাড়ছে।যেন কিছুই হয় নি!সাঈফ আর এক মিনিটও দাঁড়ালো না হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।রাতুল কি করে তার স্বপ্ন আর গানের ছোঁয়াকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করতে পারলো?এতো বছরে তারা এই চিনলো তাকে?রাগে,কষ্টে সাঈফের ভেতরটা দগ্ধ হয়ে গেল।
———-
নিসর্গের মাঝে কতোই না বিচিত্রতা!অপরাহ্নের শেষ বেলায় সাগরের অগাধ জলরাশির নীলচে আভা খানিকটা প্রগাঢ় হয়ে এসেছে।আকাশ জুড়ে নীলাভ্রতা!দৃষ্টি সীমানার শেষ প্রান্তে সবকিছুই যেন নীলময়ী।মৃৃদু বাতাস শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।ল্যাগুন রেসট্রন্ট থেকে লাঞ্চ সেরে আবির সামিরা কিছু সময়ের জন্য রেস্ট নিতে আবার রুমে ফিরে এসেছে।আবির ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।সামিরার ঘুম না আসায় সে বারান্দায় এসে বসে আছে।ওপেন বারান্দায় দুটো কাউচের মধ্যে একটিতে সে বসে আছে।সেখানে একটা বাথটাবও আছে। বারান্দার শেষ মাথার এক কোণায় মাঝারি সিঁড়ি!সিঁড়ির শেষ ধাপ পানিতে যেয়ে শেষ হয়েছে।সামনে পুরো উন্মুক্ত মহাসাগর।ওয়াটার ভিলা যেহেতু সম্পূর্ণ পানির ওপরে তাই আশেপাশে তেমন স্যান্ড নেই।পানির নিচের সাদা বালিগুলো চিকচিক করে আহ্বান জানাচ্ছে।সামিরা প্রকৃতির প্রতিটি শোভা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উপভোগ করছে।আচমকা একটি পাখি উড়ে এসে বাথটাবের ওপরে বসলো।সাদা পালকে আবৃত লম্বা পা,কালো রঙের সরু ঠোঁট।ডানা কালো সাদা রঙের উড্ডয়ন পালকে আবৃত।অনেকটা দেশীয় বকের মতো দেখতে কিন্তু বক নয়।হয়ত আলাদা জাতের।
–“ক্র্যাব পোলভার”
আবির ঘুম ঘুম চোখে পাখির দিকে ইশারা করে বলল।সামিরার দৃষ্টি এখনো সেই পাখিতে নিবন্ধ।
–“প্লেনে বসে বসে মালদ্বীপের পাখিগোষ্ঠী নিয়েও গুগল করেছেন?”
–“অপরূপ এক রূপসীকে নিয়ে যাত্রাতে নেমেছি,টুকটাক জ্ঞান না থাকলে ইমপ্রেস করবো কি করে।”
নিজের তারিফ শুনে সামিরা ভড়কে গেল।বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না।লোকটা যে কেন এমন হৃদয় কাঁপানো কথাবার্তা বলে।তার সাদা গাল দুটোয় গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়েছে।আবির তার পাশেই বসে পড়ল।
–“আচ্ছা মিরা!আমাকে তুমি প্রথম কবে দেখেছিলে?”
সামিরা মনে করার চেষ্টা করলো।সে আবিরকে তাদের বিয়ের পূর্বে দেখেছে।কিন্তু সেটা বহু বছর আগে।কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
–“আমার তখন বোধহয় এগারো বারো বছর হবে।আপনি আপনার বাবার সাথে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন,তাই না?আসলে আমার ঠিক পরিষ্কার মনে নেই,আবছা আবছা মনে আছে।কোনো কারণ বশত আমি সেদিন আপানাকে কামড়ে দিয়েছিলাম।”
সামিরা কাচুমাচু মুখ করে বলল।আবির মৃদু হাঁসলো।
—“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
–“সেদিন তোমাদের বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই আমার জীবনটা বদলে গিয়েছে।”
–“ওমা তাই নাকি?তা এমন কি হয়েছিল ওইদিন?”
সামিরা কৌতূহলের সহিত জিজ্ঞেস করলো। আবির সরাসরি সামিরার চোখের দিকে তাকাল।বিষন্ন নয়নজোড়ার মলিন দৃষ্টিতে সামিরার ভেতরটা কেমন ধক করে উঠলো।সে আবিরের এমন দৃষ্টির অর্থ বোঝার চেষ্টা করলো।মানুষটার অভ্যন্তরণী অনুভূতিগুলো কেমন যেন জট পাকানো!আবির উঠে দাঁড়াল।
–“অনেক তো রেস্ট নেওয়া হলো।এবার চলো বাহিরটা একটু ঘুরে আসি।”
–“আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ইতিমধ্যে তিনদিন পেরিয়ে গেছে। আপনার কাছে এখন অবদি কোনো প্রশ্নের যথাযথ উত্তর আমি পাই নি।কিসের এতো হেজিটেশন?এতো রাখঢাকের কারণ কি?”
সামিরা আচমকা খেপে গেল।সে বহু চেষ্টা করছে তারপরও এই আকস্মিক বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না।আবির তার কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি জানতে চাও তুুমি?”
—“আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?”
–“তোমার আমার বিয়ে প্রি-প্ল্যানড ছিলো না।যা হয়েছে সব ওপরওয়ালা হুকুমে হয়েছে।”
আবিরের সোজাসাপটা উত্তর।সামিরা আবার জিজ্ঞেস করলো,
–“তাহলে,আপনি কাঁদছিলেন কেন?”
–“খুশিতে।”
–“খুশিতে?হঠাৎ করে একটা অচেনা মেয়ের সাথে আপনার বিয়ে হয়েছে,যে কি না অন্য একটি ছেলের সাথে বছরখানেকের মতো কমিটেড ছিলো।তাকে বিয়ে করে আপনি খুশিতে কেঁদেছেন?মজা হচ্ছে এখানে?”
সামিরা চেঁচিয়ে উঠলো।তার শ্বাস নেওয়ার গতি বেড়ে গেছে।আবিরের এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তা একদমই সহ্য হচ্ছে না।
–“তুমি শুধু তোমার দিকটাই ভাবছো!আমার দিকটাও একটু ভাবো।রাইট নাও,আ’ম থার্টি ওয়ান!আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে অনেক ইতিমধ্যে বাবা নামক ট্যাগ পেয়ে গেছে।সে জায়গায় আমি মাত্র তিনদিন আগে বিয়ে করেছি।ভাবতে পারছো,আমার জীবনের কতোবড় প্রাপ্তি,কতো আনন্দের?”
সামিরা এবার দমে গেল।আবিরের চোখে মুখে আলাদা উৎফুল্লতা।সে এবার ঠোঁট কামড়ে ফিচলে হাসি দিলো।
–“তা আমার কান্না নিয়ে তোমার এনালাইসিস কি ছিলো?”
সামিরা উত্তর না দিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিলো।আবির তার হাত খপ করে ধরে নিলো।তাকে টেনে এনে তার সামনে দাঁড় করালো।
–“টেল মি সুইটি!তা না হলে আমি নিজের মতো ভেবে নিবো।”
–“আপনার যা ইচ্ছে ভাবুন।”
–“তুমি ভেবেছিলে আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে,যাকে না পেয়ে আমি কেঁদেছি,,তাই তো?”
সামিরা বড় বড় চোখ করে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল।তার মনে আবিরকে নিয়ে ঠিক এমনই একটা ধারণা ছিলো।আবির এবার শব্দ করে হেঁসে দিলো।সামিরাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল,

—“তুমিময় প্রাপ্ত্যতাকে ঘিরে আমার সমস্ত অশ্রু বিলয়প্রাপ্ত।”

সামিরা হয়ত শুনতে পেল না।সে তখন আবিরের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণে মগ্ন।চোখ বুঝে শুষে নিতে লাগলো।
———
সন্ধ্যা খানিকটা গাঢ়ো হয়ে এসেছে।বালুকাময় তীরের কাছাকাছি কয়েক প্রজাতির মাছ ভেসে আসছে।বীচের পাশের লাইটের মৃদু আলোতে সবকিছু ভীষণ মনোরম দেখাচ্ছে।অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে, সবার আগ্রহের বিষয়বস্তু হলো স্টিংরে।বাংলায় যাকে বলে শঙ্কর মাছ।উপরনিচ চ্যাপ্টা,বাঁদুড়ের মতো ডানা,চাবুকের মতো লেজ। গঠন আকৃতির এরূপ ভিন্নতার জন্য বেশ নজরকাড়া।মালদ্বীপের বিভিন্ন রিসোর্টে সাঝের এই সময়টা স্টিং রে,শার্ক ফিডিংয়ের জন্য উপযুক্ত।আবির এক কোণায় সামিরাকে চিপকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সামিরা যতোবার বীচের কাছাকাছি যাওয়া চেষ্টা করেছে আবির ততোবারই বাধা দিয়েছে।সামিরা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে।এক পর্যায়ে মানুষের ভীড় কিছুটা কমে গেলে,তারা বিচের মধ্যে নেমে পড়লো।হাঁটুর কিছুটা নিচ অবদি পানি,সামিরার মুখে হাসি।বাতাসে চুলের আলুথালু অবস্থা।আবিরের দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম।এতো স্নিগ্ধ কেন এই মেয়েটা?সে আড়ালে সামিরার কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।দুু”একটা রে ফিস তাদের আশেপাশে ঘুরছে।সামিরা ধরতে চাইলো কিন্তু তার সাহসে কুলোয় নি।রিসোর্টের স্থানীয় লোকগুলো নিয়মমাফিক মাছদের খাবার দিচ্ছে।আবির সামিরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে উঁবু হয়ে পানির ভেতর হাত দিলো।আবিরের তপ্ত শ্বাস সামিরার কাঁধে পড়তেই তার সারা শরীর শিরশির করে উঠলো।হাঁটু দু’টো কাঁপতে লাগলো।সে নিজেকে ছাড়াতে চাইলো।আবির নাছোড়বান্দা,সে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। একটা রে ফিস তাদের কাছে আসতে আবির তা ধরে ফেললো।সামিরা অতি যত্নে মাছের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।তার চোখ মুখে আনন্দের ছটাক।

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ১৫
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
ফজরের নামাজের সময় শেষ।পূর্ব আকাশে জাজ্বল্যমান প্রভাতী তারার ঔজ্জ্বল্য ক্ষীণ হয়ে এসেছে।কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ মুখরিত!আমেনা বেগম ছাদে বসে আছেন। তসবিহ হাতে নিয়ে ঝিমাচ্ছেন।হঠাৎই কেউ একজন তার সামনে এসে ধপ করে বসে পড়লো।হকচকিয়ে উঠলেন তিনি।চোখ মেলে তাকালেন।গোলগাল উজ্জ্বল শ্যামবরণ আদর আদর মুখখানা দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন।
—“তেল দিয়ে চুলের গোড়া গোড়া একটু ম্যাসেজ করে দেও তো।”
নামিরা তেলের বাটি সাথে একটা কাঠের চিরুনি এগিয়ে দিলো।কোঁকড়া চুলের অবস্থা বেহাল।জট পাকিয়ে আছে।আমেনা বেগম তসবি রেখে সোজা হয়ে বসলেন।কাঠের চিরুনি তেলের বাটিতে ভালো করে চুবিয়ে আস্তে আস্তে চুলের জট ছাড়াতে লাগলেন।নামিরা ফোন হাতে নিয়ে গতকাল রাতের আবিরের পাঠানো ছবিগুলো দেখছিলো।ছবিতে প্রানবন্ত হাস্যজ্জ্বল সামিরা।বোনের খুশিতে নামিরার চোখ জুড়ে গেল।সে খামোখাই এতো চিন্তা করছিলো।আমেনা বেগমের নজর ফোনের স্ক্রিনে!তিনি মুখ ভেঙিয়ে বললেন,
–“নতুন নতুন বিয়া হইলে এমনই।এই রঙ, তামশা,কুলুবুলু কয়েকদিনই!মাস গেলেই শুরু হয়,সংসারের আসল খেলা!যতো রকম সমস্যা আর অশান্তি বাহির হয়।”
নামিরার হাত থমকে গেল। ফোন রেখে সে পেছনে ঘুরে বসলো।মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
–“নানী,ফজরের নামাজ পর,আমার জন্য দু’আ করেছিলে?”
–“আমার সব দোআ তো তোরে নিয়া।পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আমি আল্লাহ কাছে তোর জন্য কত কিছু চাই!”
আমেনা বেগম হাসি হাসি মুখে বললেন।
–“তা,কি কি চাও আমার জন্য?”
–“তুই যাতে সবসময় ভালো থাকোস,খুশি থাকোস এইডাই চাই।”
নামিরা তার নানীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো।তারপর নমনীয় গলায় বলল,
—“আমার সব খুশি আমার আপনজন, এই পরিবারের মানুষকে ঘিরে।তোমাকে ঘিরে।মা,বাবা,সাঈফ,সামুকে ঘিরে!সামু কষ্টে থাকলে,তার সংসারে অশান্তি হলে আমি কি করে ভালো আর খুশি থাকবো?জানি না,সামুকে নিয়ে তোমার মনে কিসের এতো ক্ষোভ,কিন্তু আমার অনুরোধ তুমি ওকে কোনো বদদোয়া দিও না।ওর কষ্ট আমার সহ্য হয় না।”

নামিরার গলা হালকা কেঁপে উঠলো।আমেনা বেগম হতভম্ব নয়নে তার আদরের বড় নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।ভোরের প্রথম রশ্মিতে নামিরার অবয়বের তেজস্বী রূপ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।বড় বড় চোখজোড়াতে আপনজনের জন্য ভালোবাসার জোয়ার!সাদামাটা হলদেটে সেলোয়ার-কামিজেে কতোই না মনোরম লাগছে!আমেনা বেগমের কিছু বলতে পারলেন না।তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।নামিরার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ তার বুকের মাঝে বেদনাদায়ক এক ঢেউ তুলে দিয়েছে।তিনি অতি সন্তপর্ণে উঠে চলে গেলেন।
——–

অফুরন্ত নীল জলরাশির ওপরে রবি কিরণের পসরা বসেছে।শ্বেত শুভ্র পাথুরে বালিগুলো চিকচিক করছে।সামুদ্রিক পাখির কলকাকলীতে বিমোহিত চারপাশ।মনোমুগ্ধকর এই প্রকৃতিকে অবহেলা করা যে বড্ড অপরাধের!সামিরা তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে পাশ ফিরলো।নজরে এলো ঘুমন্ত মায়াময় কায়া!আনমনে মুখে হাসি ফুটে উঠলো।মিষ্টি রোদের আবছায়ায় ভীষণ নিষ্পাপ দেখাচ্ছে তন্দ্রারত আবিরকে।সামিরা বিনা দ্বিধায় আলতোভাবে আবিরের গালের দাঁড়ির ওপর হাত বুলিয়ে দিলো।খেয়াল করলো সে আবিরের ডান হাতের বাহুর ওপর শুইয়ে আছে।বা’হাত তার আবৃত জঠরে।শরীর খানিকটা শিরশিরে উঠলো।গাল থেকে হাত সরিয়ে বুকের বা’পাশে রাখলো।ভাবতে লাগলো,এই বলিষ্ঠ দেহের ওমে বিগত রাত কেটে গেছে তার।নিজের সবটা দিয়ে এই সম্পর্কে সে এগিয়ে নিতে চায়।
জার্নি করার কারণে তারা ক্লান্ত থাকায়,রাতে বীচ থেকে সরাসরি ডিনার সেরে রুমে ফিরে এসেছিলো।বারান্দায় থাকা কাউচে বসে টুকটাক কথা বলতে বলতে সেই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো।ঢেউয়ের কল্লোলিত ধ্বনির সাথে তাল মেলাতে সামিরা কাউচ ছাড়লো।খোলাচুল বাঁধার চেষ্টা করলো না।তিরতির করে সিঁড়ি বেয়ে পানিতে নামল। স্বচ্ছ জলের ছোয়ায় মূহুর্তেই সমস্ত অবয়ব আলাদা জোয়ারে সিক্ত হলো।লং রাউন্ড শেপ ড্রেস ভিজে যাচ্ছে। তার কোনোরকম খেয়াল নেই।আরেকটু গভীরে যেয়ে,চোখ বুঝে ডুব দিলো।পাঁচ সেকেন্ড পর ভেসে উঠলো।একইভাবে আরো পাঁচ ছয়বার ডুব দিলো।শেষ বার চোখ মেলতেই দেখলো আবির তার দিকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে আছে।ফুলোফুলো চোখের গাঢ় দৃষ্টি তার পা থেকে মা অবদি ছুঁইয়ে দিচ্ছে।ভেজা কাপড়ে সামিরার এই মূহুর্তে খুব অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।আবিরের কোমর অবদি পানি।সে আরেকটু কাছে যেয়ে সামিরার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তারপর ডান হাত বাড়িয়ে গালের তিলের ওপর লেগেছে থাকা পানি মুছে দিলো।
—“অনেক হয়েছে এবার উঠে এসো।”
আবিরের কন্ঠে হালকা শাসন।সামিরা ভ্রু কুঁচকালো।ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
–“দশ মিনিট পর।”
আবির কোনোরূপ বাক্য ব্যয় করলো না।সে জানে এখানে তার আর কোনো কথাই কাজে দিবে না।তাই সে সরাসরি অ্যাকশন নিলো।তাৎক্ষণাৎ সামিরাকে কোলে তুলে কক্ষের দিকে পা বাড়ালো।অস্ফুটে স্বরে চিৎকার করে সামিরা আবিরের বাহু খামচে ধরলো।আবির ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে সামিরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।হাতে তোয়ালে আর কাপড় ধরিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।মুখে বলল,
—“জলদি বের হয়ে এসো।ব্রেকফাস্ট করে বেরুতে হবে। এখনও অনেক কিছু ঘুরে দেখার বাকি আছে।”
সামিরা এতো সময় গাল ফুলিয়ে রেখেছিলো।আবিরের কথায় সে অনিচ্ছায় রেডি হতে লাগলো।দশ মিনিট পর সামিরা বের হয়েই দেখলে আবির পুরোপুরি রেডি।বীচ আউটলুকে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে তাকে।হোয়াইট হাওয়াইয়ান শার্টে ভীষণ মানিয়েছে।সামিরা মুখ ফুটে কিছু না বললেও,মনে মনে হাজার বার মাশাল্লাহ উচ্চারণ করলো।
অপরদিকে সামিরাকে দেখে আবিরের চক্ষু চড়ক।সে পিচ কালারের হাফ স্লিভ লং সামার ড্রেস পড়েছে।রঙটাতে ভীষণ মানিয়েছে।পরন্তু ভেজা চুলের বেশ মোহনীয় লাগছে।আবির এগিয়ে এসে তার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে যত্নসহকারে মুছতে লাগলো।সামিরার বুক মুচড়িয়ে উঠলো।সে অনুভব করলো তার মধ্যে একটা পরিবর্তন হচ্ছে।কিন্তু সে চায় না এতো শীঘ্রই এই পরিবর্তন আসুক।সে কখনোই ঠিকঠাক ভেজা চুল মুছতে পারে না।নামিরাই বেশিরভাগ সময় তার চুল মুছে দিতো।অথচ মানুষটার চোখ সামান্যতম বিষয়টিও এড়ায় নি।সবটাই লক্ষ্য করেছে।নিজেকে এই মূহুর্তে তার খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।
——–
খালি পেটে পর পর তিন কাপ চা খেয়ে সাঈফের অবস্থা করুণ।গলা প্রচন্ড জ্বলছে।দৃষ্টি সামনে রেখে দোকানদারকে কাপ ফেরত দিলো।সাথে এক বোতল পানিও কিনলো।সে এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে মিরপুর গার্লস কলেজের সামনে।কাঙ্ক্ষিত মুখটি দেখবার জন্য তার পরাণ পুড়ে যাচ্ছে।হৃদয়ের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।অথচ ওপরে ওপরে সে একদম স্বাভাবিক!ঢকঢক করে অর্ধেক বোতল পানি খাওয়ার পর পেট মুচড়ে উঠলো।সামনের মানুষটিকে সরতে বলারও সময় পেলো না,হড়হড় করে বমি করে দিলো।

–“আপনার পিউর কাশ্মীরী শাল দিয়ে নাক পরিষ্কার করেছিলাম বলে এভাবে প্রতিশোধ নিলেন?”

সাঈফ মুখ তুলে চাইলো।বমি করতে করতে সে চায়ের দোকানের টুলের ওপর বসে পড়েছিলো।আদিবা কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তার কলেজ ইউনিফর্ম,বিশেষ করে জুতো সাঈফের বমিতে মাখামাখি।আদিবার গা গুলাতে লাগলো।অসহায় চোখে আশেপাশে তাকালো।দু’একজন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
এদিকে আদিবাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে সাঈফ হুঁশ খুইয়ে মাঝ রাস্তায় তার হাত চেপে ধরলো।তারপর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলতে লাগলো,
–“কোনো প্রতিশোধ নেই নি, সোনা।তোমাকে দেখতে এসেছি।তুমি চাইলে আমি একশটা শাল কিনে দিবো,তা দিয়ে নাক মুছো।দরকার হলে আমাকে রুমাল বানিয়ে তোমার নাকের পানি,চোখের পানি সাফ করো।যা ইচ্ছে তাই করো।কেবল আমার মনের অসুখটা সারিয়ে দেও।”
আদিবার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। সে সম্পূর্ণ কথা শুনলো,কিন্তু প্রতি উত্তর করলো না। লক্ষ্য করলো সাঈফের শরীর প্রচন্ড গরম।চোখ দুটি রক্তিম।মুখটা শুকিয়ে আছে ঠিক মতো কথাও বলতে পারছে না।দাঁড়িয়ে আছে কোনোরকম।সাঈফ এবার আদিবার গালে হাত রাখলো। অসহায় গলায় বলল,

—“ইফ আই হার্ট ইউ দ্যান ফরগিভ মি।জাস্ট গিভ মি সাম রিলি…..”

কথা শেষ করার আগেই সে ঢলে পড়লো।আদিবা দু’হাতে তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করলেও,শেষমেশ ব্যর্থ হলো।

চলবে