মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-১৬

0
408

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#ষোড়শ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“ব্রাভো মাই বয় ব্রাভো।আই’ম প্রাউড অফ য়্যূ।য়্যূ’ভ সাক্সেসফুলি ফিনিশড য়্যূর গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি ইন মেডিকেল সায়েন্স।তোমাকে জুনিয়র হিসেবে পেয়ে আমি সত্যি আনন্দিত।বাই দ্য ওয়ে,আই থিংক তুমি এই মুহূর্তে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু না করে হায়ার স্টাডিস করবে?” মেডিকেল কলেজের সিনিয়র ডাক্তার ডক্টর খান্নার মুখে এরকম কথা শুনলে যেকোনো জুনিয়র ডাক্তারের অহংকারে বুক ফুলে যাওয়ার কথা।রণ শুধু মৃদু হেসে স্যারের পা ছুঁলো।
আজ ওর ইন্টার্নশিপের শেষদিন ছিল।এই একবছর জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিসের সাথে সাথে মাস্টার ডিগ্রির প্রিপারেশন ও নিয়েছে।আর কয়েকমাস পর পরীক্ষা,এখন ওর সমস্ত মনোযোগ সেই দিকে।
“হ্যাঁ স্যার আমার লক্ষ্যও তাই।জানি হসপিটালে ডক্টরের অভাব খুব কিন্তু আমার লক্ষ্য আরেকটু উঁচু।বলতে পারেন বাবা কে অনুসরণ করার ইচ্ছা আছে”,রণ উজ্জ্বল চোখে কথাগুলো বলে।
“ওয়েল সেইড রণজয়।আমি জানি তুমি পারবে।আমাদের দেশে যে স্পেশালিস্ট ডক্টরও দরকার,বিশেষ করে তোমার মত।তাই তুমি এগিয়ে যাও।আমরা অপেক্ষা করবো।আর যখনই যা দরকার হবে আমায় বলবে।আই’ম অলওয়েজ উইথ য়্যূ।গড ব্লেস য়্যূ মাই সান।” হাত টা মাথায় ছুঁয়ে দেন ডাক্তার অশোক খান্না।
আরো কিছুক্ষন স্যারের কেবিনে কাটিয়ে বেরিয়ে আসে সদ্য ডাক্তার হওয়া মেডিকেল কলেজের অন্যতম হ্যান্ডসম ছেলেটা,বিগত দুবছরে আরো পরিণত হয়েছে সে আর তার সাথে সাথে অনেকটাই স্বাভাবিক।পুরোনো হাসি অনেকটাই ফিরে এসেছে ওর ঠোঁটে,যার কৃতিত্ব কিছুটা হলেও ডাক্তার শীর্ষা ভট্টাচারিয়া’রও প্রাপ্য।হ্যাঁ শীর্ষা ই বন্ধু হয়ে বন্ধুকে খুঁজে এনেছে এই দুবছর ধরে।তার বদলে কোনো দাবি করেনি।এমনকি রণর মধ্যেকার অব্যক্ত কষ্টটা খুঁচিয়ে বের করে এনেছে সযত্নে।
প্রায় দুবছর আগের দেশের বাড়ির দুর্গাপুজোর ওই কটা দিন ওর জীবনে অক্সিজেন ভরেছিলো অনেকটা।যে কদিন রাইয়ের সংস্পর্শে ছিলো অনেক স্বাভাবিক ছিল রণ।ভেবেছিল কাটিয়ে উঠেছে ও ওর অবসাদ।কিন্তু ভুল ছিল ও।কলকাতায় ফেরার পর আবার এক অদ্ভুত শূন্যতা ফিরে এসেছিল ওর জীবনে।উল্টে পুজোর দিনগুলোর স্মৃতি ওকে আরো অস্থির করে তুলেছিল।
পাগল হয়ে যাচ্ছিল রণ রাইয়ের কথা ভেবে।
এক একবার মনে হত রাইকে বলে দেয় ওর মনের কথা।কিন্তু তারপর রাইয়ের কি অবস্থা হবে ও নিজেও বুঝেছিলো।তাছাড়া রাইকে সব বলার পর যদি বন্ধুত্বটা হারাতে হয় সেই ভয়ে…না বলা হয়নি আজও,আর হয়তো বলা হবেনা কোনোদিনও।

হঠাৎ প্যান্টের পকেটের সেল ফোনটা নড়াচড়া শুরু করে দেয়।
হসপিটালের করিডোর দিয়ে যেতে যেতে হালকা ট্রিম করা দাড়িতে ডান হাত বুলোতে বুলোতে বাঁ হাতে ফোনটা রিসিভ করে ডাক্তার রণজয় মুখার্জী।

-“বল শীর্ষা কোথায় তুই?”
-“আমি কফিশপে প্রায় পৌঁছেই গেছি ডিয়ার।তুই কতক্ষণে আসতে পারবি সেটা বল।”
-“আমি হসপিটালে আছি এখনো।আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি।”
শীর্ষা কপট রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ফেলে।ওর অভ্যেস হয়ে গেছে রণর এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুলো।ও জানে এই ছেলেটা ওকে অন্তত আধ ঘন্টা অপেক্ষা করাবেই।
কফিশপে পৌঁছে নিজেদের পছন্দের টেবিলে গিয়ে বসে শীর্ষা।
ওর পছন্দের একটা এক্সপ্রেসো অর্ডার করে।

একা,আজ অনেকদিন পর নিজের সাথে একা এই কফি শপে বসলো ও।আজ ওর কাছে একটা বিশেষ দিন।ও স্টেটসে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে মাস্টার ডিগ্রি করার,সেই কারণেই আজ এই রণর সাথে দেখা করতে আসা।

বন্ধুত্ব হয়তো সত্যি সব সম্পর্কের ওপরে হয়।সেইদিন মন্দারমনি তে রণজয়ের ওর কাছে আত্মসমর্পণ হয়তো বন্ধুকে বিশ্বাস করেই।
মাস খানেক আগের ট্যুরের ওই রাতটা শীর্ষা আজীবন মনে রাখবে।কেউ কাউকে এরকম পাগলের মত নিঃশব্দে ভালোবেসে কষ্ট পেতে পারে রণ কে নিজের চোখে না দেখলে ও বিশ্বাস করত না কোনোদিন।অন্য কারোর মুখে শুনলে ভাবতো ঠিক বাড়িয়ে বলছে।
কিন্তু রণজয়ের ওই কান্না…না ভোলা সম্ভব না শীর্ষার পক্ষে। ওই রাতের পর ওর মধ্যে অস্থিরতা,কষ্ট সব কমে গেছে।ও বুঝতে পেরেছে মুখে না বলেও ভালোবাসা যায়।সবাই যদিও তা পারেনা,কিন্তু রণ…না ও সবার থেকে আলাদা।তাই হয়তো শীর্ষা ও পতঙ্গের মতোই ছুটে গেছিল ওই আগুনের দিকে। স্মার্ট,হ্যান্ডসম সেটা তো ওর বাইরের রূপ,কিন্তু ওর অন্তর তার সত্যি কোনো তুলনা হয়না।
ভালো থাক রণ।

ওর চিন্তার মাঝে কফিশপের সুইং ডোর ঠেলে ঢোকে বহু রোগী,বহু ইয়ং লেডি ডাক্তারের হার্টথ্রব ডক্টর রণজয় মুখার্জী।এই দুবছর রেগুলার জিম করে নিজের শরীরকে যে জায়গায় নিয়ে গেছে ডাক্তারি প্র্যাকটিস না করে মডেলিং করলেও জীবন দৌড়াবে।
নিজের চিন্তায় নিজের মনেই হাসে শীর্ষা।
ওকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে ভ্রু কুঁচকোয় রণ ওকে আপন মনে হাসতে দেখে।

-“হোয়াট হ্যাপেন্ড ইয়ার? নিজের মনে হাসছিস কেন?”
-“আরে কিছু না।বোকা বোকা চিন্তা করে হাসছি।”
-“তুই আর বোকা বোকা চিন্তা!কতক্ষন বসে আছিস বল?”
-“বেশিক্ষন না রে।এই ফেলে আসা দিনের কথা ভাবছিলাম।”
-“হমম বুঝলাম।তবে তুই যা তীর মেরেছিস,কয়েকবছর পর মনে হয়না আমায় আর তোর মনে থাকবে।”

আওয়াজ করে হেসে ফেলে শীর্ষা।মনে মনে বলে,’তোর পাত্তা পেতে সবাই মরিয়া রণ।আর সেই তোকে পাত্তা দেবনা আমি,তাও কি সম্ভব?’
“তোকে আমি পাত্তা দেবনা এই দিন কখনো আসবে বলে মনে হয়না।বরং আমি দূরে গেলে প্লিজ আমায় ভুলে যাসনা।তোর মত বন্ধু আমাদের অহংকার।আমার একমাত্র ভালো বন্ধু,যাকে কোনো মূল্যে হারাতে চাইনা আমি।”

রণজয় আর কিছু বলতে পারেনা।নিজের হাত দুটো রাখে টেবিলে রাখা শীর্ষার জোড়া হাতে,হালকা চাপ দেয়।তারপর নিজের মাথাটা ধীরে ধীরে দু জোড়া হাতের ওপর নামিয়ে এনে যেন আলিঙ্গন করে হাত জোড়াদের।
“শীর্ষা আমার জীবনে তোর অনেক ঋণ রয়ে গেল।তোর বন্ধুত্বের ঋণ,যা আমায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছে আজ।আর তোর ভালোবাসার ঋণ,যা হয়তো কোনোদিনও শোধ করতে পারবো না রে।”
-“দূর বোকা।তোর ভালোবাসার কাছে তা তুচ্ছ।কাশ তোর মত ভালোবাসার ক্ষমতা ঠাকুর দিত।” একটু হলেও ম্লান হয় শীর্ষার মুখ।সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে বলে,”ভালো থাকিস রণ।আর ভালো রাখিস সুযোগ পেলে”।
কথাটার গূঢ় অর্থ শুধু বোঝে রণ,মুখে বিষন্ন হাসির ছোঁয়া এনে শুধু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতে পারে ও।ওর প্রাণপাখি যার হাতে তাকে ভালো তো রাখতেই হবে।কিন্তু সুযোগ কি আদৌ আসবে কোনদিন?!আদৌ কি ওদের মধ্যে সেই সম্পর্ক সম্ভব!বুঝতে পারেনা রণ,সবটা ছেড়ে দেয় সময়ের হাতে।

“কিরে রাই তখন থেকে কি এত দেখছিস বলতো ওই কাপেলটা কে?যদি ওরা দেখে ফেলে কি ভাববে বলতো?” উনিভার্সিটির নতুন বন্ধু চিত্রিতার সাথে কফিশপে এসেছে রাইমা।
চিত্রিতার বাবা মা দুজনেই প্রফেসর,কিন্তু ওর শখ লেখিকা হওয়ার।রাইমার সাথে ইউনিভার্সিটির শুরুর দিন থেকে সম্পর্কের সূচনা হলেও এই ছমাসে খুব কাছের বন্ধুই হয়ে উঠেছে ওরা দুজন।
সাধারণ ঘরের সরল মনের রাইমা কে চিত্রিতার প্রথম দিনই খুব নিজের মনে হয়েছিল।কলেজ ইউনিভার্সিটিতে এসে নতুন করে ভালো বন্ধু হয়না,রাইয়েরও এই ভুল ধারণা ভেঙেছে চিটির সান্নিধ্যে।
আজ ক্লাস না থাকায় ইউনিভার্সিটি থেকে একটু দূরে চিটির প্রিয় কফিশপে ওরই আবদারে এসেছিল রাই।কিন্তু নিজেদের টেবিলে বসে দূরের টেবিলে চোখ যেতে চোখটা আটকেই গেল।
রণদা না?!!
সঙ্গে মেয়েটা???
দুজনের একে অপরের হাতে হাত দিয়ে কথা বলার দৃশ্য…প্রথমে হাঁ করে কিছুক্ষন দেখলেও হঠাৎ অবিশ্বাস্য লাগে রাইয়ের।
মেয়েটা কে?রণদা কোনোদিন বলেওনি ওর কথা।এটাই কি কারণ তাহলে রণদার ওকে এড়িয়ে যাওয়ার!!
কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারেনা রাই।
চিটির কথায় ঘোর ভেঙে ওর মুখের দিকে তাকায় এবার।অবাক হয় চিত্রিতা বন্ধুর চোখে শুন্য দৃষ্টি দেখে।

-“কিরে কি হলো?চিনিস নাকি ওদের?”
-“নাহ।একজনের সাথে মিল পেয়েছিলাম।তাই ভালো করে দেখছিলাম।” এড়িয়ে যায় রাই।এই মেয়েটাকে ভরসা নেই।রণদার কথা একমাত্র ওই জানে।তাও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনেছে।অনিকেত স্যারের ঘটনাটা বুঝতে পেরেছিল স্যারের ক্লাসেই।ওঁর হাবেভাবে চিত্রিতা বুঝে নিয়েছিল হয়তো।আর তার সূত্র ধরেই এসেছিল রণজয়ের কথা।
এই ছেলেটাই রণদা শুনলে ওকে আটকানো যাবেনা।
রাই একটু ঘুরে রণদের টেবিলের দিকে পিছন করে বসে।

চিত্রিতা একটু চোখ সরু করে তাকালেও পাত্তা দেয়না রাই।যতই বাইরে বদলাক ও,ভেতরে আজও সেই চাপা মেয়েটাই আছে।শেষ দুবছর রণ সরে যাওয়ায় আবার একাকিত্বে ডুবিয়ে দিয়েছে নিজেকে।চিটি অনেকটা সময় দেয় ওকে,তাই শেষ ছমাসে মনটা অল্প খুললেও রণর বন্ধুত্ব বা বিশ্বাস কোনোটাই ওকে দিতে পারেনি রাইমা।এখনো বুকের মধ্যে ঝড়টা বাইরে প্রকাশ না করে স্বাভাবিক হাসি দিয়ে বন্ধুকে আর নিজের মনকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে ও।বারবার ইচ্ছে করে দূরের টেবিলটা আড়চোখে দেখতে, ওরা কি বলছে শুনতে,কিন্তু নিজেকে কষ্ট করে হলেও আটকে রাখে রাই।
আজ ওর অন্য একটা অপেক্ষার শেষ হলো সেটাও অনুভব করছে রাই।সেই দুবছর আগের দুর্গাপুজো ওকে প্রথম অনুভব করিয়েছিল ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক না।ছোট্ট রাই হঠাৎ নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেছিল একটা মেয়েকে,যে প্রচন্ড ভাবে বাঁচে শুধু রণর জন্যে।যার জীবনটাই রণ নির্ভর।কিন্তু সেই পুজোর পর রণ আবার হারিয়ে গেছিল আগের মতোই।
কিন্তু রাইমা অপেক্ষা করা শুরু করেছিল রণজয়ের ফেরার।অনিকেত বুঝতেও পারেনি তার ছাত্রী তাকে গ্রহণ করার ছমাস পর কেন ফিরিয়ে দিল!যে চোখে সে নিজের প্রতি ভালোলাগা,আনুগত্য দেখেছিল সেই চোখ নির্জীব ভাবে বলে গেল,”সরি স্যার।আমায় ক্ষমা করুন।আমি আজ থেকে আবার শুধুই আপনার ছাত্রী।আমি ভুল করেছিলাম।”
তার অসহায় আকুতি শুধু মুক্তি চেয়েছিল,কারণ বলেনি।অনিকেত স্বপ্নভঙ্গের কষ্টে আর জানতেও চায়নি কারণটা।সেদিনের পর থেকে রাইমা আর চোখ মেলাতে পারেনি অনিকেতের সাথে,এমনকি ইউনিভার্সিটি গিয়েও স্বাভাবিক হতে পারেনা অনিকেতের ক্লাসে।
কিন্তু সবার অলক্ষ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের শেষটার কাহিনীও ওদের মধ্যেই থেকে গেছিল,জানতে পারেনি কেউ।

“রাই তুই যাকে দেখছিলি ছেলেটা কি হ্যান্ডু রে,উঠে পড়লো চেয়ার ছেড়ে,বেরিয়ে যাচ্ছে।” চিত্রিতার কথায় একটু নড়েচড়ে বসে রাই।তাও নিজেকে আটকে রাখে।
“ওহ!ওই জন্যেই বুঝি তাকিয়ে ছিলি?এই এই…কেলো করেছে।..”,চিত্রিতার কথায় মনের ঝড় উপেক্ষা করে এতক্ষন ঠোঁট চিপে হালকা হাসতে থাকা রাই এবার ভ্রু তুলে বিরক্তির ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকায় জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে।
“আরে ছেলেটা আমাদের টেবিলের দিকে আসছে কেন?” চিটি খুব ঝাড়ি মারছিল,কিন্তু রণকে হেঁটে ওদের দিকে আসতে দেখে একটু নার্ভাস হয়ে যায়।ছেলেটা তো খুব স্মার্ট,সঙ্গে গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও অপরিচিত মেয়েদের দিকে এগিয়ে আসছে।
চিত্রিতার কথায় রাইমার মুখ শুকিয়ে যায়,”তাহলে কি তখন রণদা ওকে দেখে ফেলেছিল?’

“এক্সকিউজ মি”,সরাসরি রাইদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় রণ।পিছন ফিরে বসে থাকা মেয়েটার চুল,টপ বড্ড চেনা যে।এই মেয়েটা কে লক্ষ মানুষের ভিড়ে আলাদা করার ক্ষমতা আছে যার,সে এই ফাঁকা কফিহাউসে এক ঝলক দেখে বুঝবে না তা কি হয়?!

বাধ্য হয়েই মুখ ঘোরায় রাই এবার ওর দিকে,মিষ্টি হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়াবার সময় আড়চোখে দেখে চিটির চোখ গোল হয়ে গেছে।

“তুই এখানে?” রণ চোখের সানগ্লাসটা খুলে হাতে নেয়,চোখে প্রশ্ন নিয়ে।
“হমম।আমার বন্ধু চিত্রিতা,ও নিয়ে এসেছে।” মিষ্টি হেসে চিটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় রাই,তারপর চিত্রিতার চোখে বিস্ময় দেখে রণকে দেখিয়ে বলে,”চিটি এ আমার পূর্বপরিচিত,আমি…রণদা বলি”।পরিচয় করিয়েই মুখটা ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে।
ও জানে রণদা চলে যাওয়ার পর কি কি শুনতে হবে ওকে ওর এই বন্ধুর কাছে।তাই এই মুহূর্তে ওকে এড়িয়ে থাকাই শ্রেয়।
ওদের কথার মাঝে শীর্ষা এসে দাঁড়ায় রণর পিছনে, ও দূর থেকেই চিনেছিলো রাইমা কে।অনেক বছর আগে একবার বর্ষার সন্ধ্যায় দেখা মেয়েটা বদলেছে অনেক। কিন্তু ওর কি মনে আছে শীর্ষাকে?

শীর্ষা এসে দাঁড়াতে রণকে পেরিয়ে রাই তাকায় ওর দিকে।কাছ থেকে কিছুটা চেনা লাগে।কিন্তু ও কিছু বলার আগেই মেয়েটা বলে,”কিরে রাই চিনতে পারছিস আমায়?আমি শীর্ষা রে।”
কিছুক্ষন ভেবেই রাইয়ের মনে পড়ে সেই সন্ধের কথা।রুদ্রদার সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে রণদার কাছে এসেছিল।তারপই আর কোনোদিন দেখেছে বলে মনে পড়েনা।কিন্তু এই লেডি যে ওই স্কুল পড়ুয়া,না বললে চেনা দায়।এই স্মার্টনেস রাইয়ের খুব পছন্দের।শীর্ষাকে পারফেক্ট মনে হয় ওর।
আর একটা প্রশ্ন উঁকি মারে রাইয়ের মনে।স্কুল জীবনের বন্ধুত্ব আজও যারা এত সুন্দর ভাবে রেখেছে তাদের মধ্যের সম্পর্ক কি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠেনি, শুধুই কি বন্ধুত্ব এত ক্লোজ রেখেছে দুজনকে?
ওদের বডি ল্যাংগুয়েজ বলে দেয় সম্পর্ক হয়তো এগিয়েছে সময়ের হাত ধরে।

টুকটাক কথার পর রণ চিটির সামনেই রাইকে বলে,”তোর দেরি আছে? নাহলে আমি ড্রপ করে দিতাম।আজ বাড়ি ফিরছি আমি।”

অবাক হয় রাই, নিজের গার্লফ্রেন্ডের সামনে রণকে এধরণের কথা বলতে শুনে।কি ভাববে শীর্ষা ওদের সম্পর্কে?!আর কতটাই বা কি জানে ওদের কথা! তাই রাইমা এড়িয়ে যায় রণকে।

“না রণদা তুমি বেরিয়ে যাও।আমার একটু চিটির বাড়ি যাওয়ার আছে”।

রাইমার কথায় অবাক চিটি শুধু চোখ বড় করে তাকায় রাইয়ের দিকে,কিন্তু রাই পাত্তাও দেয়না।
বেরিয়ে যায় রণরা।

“রাই তুই কি রে? তুই নিজের ভালোবাসা কে যেতে দিলি অন্যের সাথে।কে ওই শীর্ষা?আর তুই এতদিন বলিসনি তোর রণদা একদম বলিউড হিরো!আমি তো আজ ফিদা হয়ে গেছি”,চিত্রিতার কথা বলার ধরণে হেসে ফেলে রাই।
“শীর্ষা রণদার স্কুলমেট,কিন্তু এখনো সেই বন্ধুত্ব টিকে আছে জানতাম না।শীর্ষাদি হয়তো একদম পারফেক্ট ম্যাচ রণদার জন্যে।” নিজের অন্যমনস্কতায় বলে ফেলে রাই মনের উদ্বেগ।

-“মানে শীর্ষা বলে মেয়েটা রণদার গার্লফ্রেন্ড?তুই শিওর?”

-“জানিনা।আমরা এখানে এসে বসার পর যখন আমি ওদের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম ওদের কথা বলার ধরণে সেরকমই মনে হচ্ছিল।শীর্ষা দি যে রণদার ভালো বন্ধু সেটা তো শিওর।আর ও নিজেও ডক্টর,মানে এতদিন প্রায় একসাথে পথ চলেছে।রণদার সাথে এতদিন কাটানোর পর, এত ভালো বন্ধুত্বের পর ওকে ভালো না বেসে থাকা হয়তো সম্ভব না।যাইহোক ছাড়।সময় হলে সব ঠিক জানতে পারবো।”

-“জানার পর তোর কি হবে?তোর অপেক্ষার? তুই অনিকেত স্যারকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি যেদিন থেকে বুঝেছিস তোর আসল ভালোবাসা কে,ঠকাতে চাসনি স্যার কে।কিন্তু এখন নিজেকে ঠকাতে চাইছিস কেন?”

-“কি ভুলভাল বকছিস বলতো? আমি রণদা কে ভালবাসি মানে রণদা কেও আমায় ভালোবাসতে হবে?এভাবে সম্পর্ক হয় নাকি?আর হতেই তো পারে যে কারণে আমি অনিকেত কে ঠকাতে চাইনি,সেই একই কারণে রণদা আমায় ঠকাতে চাইলো না।ওরা দুজন একে অপরকে ভালোবাসলে আমি কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার কে বল?আর তোকে তো বলেইছি বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।সেদিন বিয়ের কথা বলছিল,আমি যাহোক করে এড়িয়ে গেছি।হয়তো…বাবার পছন্দেই শেষ পর্যন্ত কারোর গলায় মালা দিয়ে দেব।” ম্লান হেসে বলে রাই।

-“তুই পাগলের প্রলাপ বকছিস।বাবার পছন্দেই যদি করবি তাহলে অনিকেত স্যার কি দোষ করেছিল?”

-“চিটি প্লিজ ছাড় না এসব টপিক।আমি নিজে সম্পর্কে জড়িয়ে কাউকে ঠকাতে চায়নি।আর তাছাড়া তখন আমি জানতাম না শীর্ষা দির কথা,জানলে হয়তো…।”

-“জানলে কি কম্প্রোমাইজ করে নিতিস?মেনে নিতিস অনিকেত স্যারকে স্বামী হিসেবে।তখন মনে হতনা রণজয় ছাড়া আমার পক্ষে বাঁচা সম্ভব না।একবার অন্তত জানিয়ে তো দেখ।”

-“চিটি এই নিয়ে আর আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হবে না।আর শুধু তাই না,আমার বন্ধুত্বের খাতিরে আমায় ভালোবাসলে তুই কাউকে কোনোদিনও এই নিয়ে কোনো কথা বলবি না।যদি বলিস,সেদিনই আমাদের বন্ধুত্ব শেষ।”

চমকে ওঠে চিত্রিতা রাইমার শেষ কথায়।নরম স্বভাবের মেয়েটার মুখে এরকম কথা ও কোনোদিনও শোনেনি,আর এরকম টোন শুনবে কোনোদিন আশাও করেনি। এত রিজিডিটির কারণ কিছুটা হলেও বুঝতে পারে চিত্রিতা।প্রচন্ড ভালোবাসা থাকলেও নিজের আত্মসম্মানবোধ এই মেয়েটার বড্ড প্রিয়,প্রথম থেকে এটা খেয়াল করেছে চিত্রিতা। কিন্তু শেষ অবধি জীবনে ভালো থাকাটা আসল।কত মানুষ শুধু চুপ থেকে জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ সময়,মানুষ হারিয়ে ফেলে।আফসোস হয় চিটির।কিন্তু রাইয়ের বন্ধুত্ব এতটাই দামি ওর কাছে, ওর নিজেকে অসহায় লাগে।তাছাড়া রণজয় আদৌ রাইকে বিশেষ নজরে দেখে কিনা, নাহলে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে ওদের সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে যাবে।সব ভেবে চিন্তে চুপ করে যায় চিত্রিতা।কিন্তু অনুভব করে ওকে চুপ করিয়ে দিলেও রাইয়ের মনের ঝড় থামেনা। হাজার চেষ্টা করেও ওর মুখে কষ্টের ছাপ আড়াল করতে পারেনা ও।
বন্ধু হয়ে চিটিরও প্রার্থনা করা ছাড়া কিছু করার থাকেনা।

রাই বাথরুমে ছিল,শুনতে পেল কেউ বেল দিচ্ছে।বাবা তো এই বেরোলো,আজ ইভিনিং শিফট,ফিরতে সেই রাত দশটা।তাহলে এই দুপুরে আবার কে এলো?সুলেখা মাসি তো বাড়ি গেছে কাল,আজ যদিও ফিরে আসবে। তাহলে কি মাসি এলো?অগত্যা ও ভিজে গায়ে হালকা গোলাপি রঙের লং বাথরোব টা জড়িয়ে দরজার কাছে এসে আইহোলে চোখ রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে হার্টবিট বেড়ে গেল কয়েক গুণ।দরজার বাইরে রণ,সাদা ডেনিম শার্ট আর ব্লু জিন্সের সাথে চোখে রোদচশমা যেন এক অচেনা পুরুষকে নির্দেশ করছে।
রাই ভেবেছিল মাসি,নাহলে বড়জোর কোনো কুরিয়ার এসেছে হয়তো বাবার নামে,দরজা ফাঁক করে নিয়ে নেবে। রোবটা আরেকটু ভালো করে বেঁধে দরজা খুলে দিল রাই।

রণ একটু অন্যমনস্ক ভাবেই ভিতরে ঢুকে এলো,সানগ্লাস খুলে হঠাৎ রাইয়ের দিকে চোখ পড়ায় একটু থতমত খেলো।ওকে বেশিরভাগ সালোয়ার নাহলে লং কুর্তি আর ট্রাউজারে দেখেছে।ও বুঝতে পারলো রাই বাথরুমে ছিল আর বাড়িতে দ্বিতীয় কেউ নেই বলে ওকেই বাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে।
দুজনেই অপ্রস্তুতে পড়লেও পরিস্থিতির স্বীকার বুঝতে পেরে কিছুক্ষন চুপ করে কথা হাতড়াতে লাগলো। চোখে চোখ না রেখে,তারাও এড়িয়ে যেতে চাইলে একে অপরকে।

প্রথম কথা বললো রাই,”বসো রণদা আমি চেঞ্জ করে আসছি।আসলে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে এসেছিলাম”,ওর গলায় অস্বস্তি স্পষ্ট।
রণ ঠোঁটটা ঈষৎ প্রসারিত করে হালকা হেসে সিঙ্গেল সোফায় বসলো চুপ করে।ওর একটু সময় দরকার নিজেকে সামলানোর,তাই কথা প্রত্যুত্তর করতে পারলো না সঙ্গে সঙ্গে।
সদ্য স্নান করে ভিজে গায়ে বাথরোব জড়িয়ে বেরোনো রাইয়ের চুল দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল ওর বুকে কি ঝড় তুলেছে শুধু ওই জানে।নিজের মধ্যের অস্বস্তি ওকে স্থির ভাবে বসতে দিচ্ছিল না।একবার মনে হল দরজা খুলে বেরিয়ে যায়,তারপর ভাবলো সেটা খুব বাড়াবাড়ি হবে।
রাইয়ের সাথে সেই রেস্টুরেন্টে দেখা হওয়ার পর মাসখানেক কেটে গেছে।
দুদিন আগে মম বলেছিল জয়ন্ত আঙ্কেলের শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছেনা।হার্টের একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে।রণ সেই শুনে ফোন করেছিল জয়ন্ত কে।কথায় কথায় জয়ন্ত বলেছিলো ওর শরীরের জন্য ইদানীং বেশিরভাগ মর্নিং ডিউটি করে,দুপুরের মধ্যে ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। রণ সেই কারণেই আজ রবিবার দেখে আর ফোন না করে হঠাৎ চলে এসেছিল।তাছাড়া জয়ন্ত বলেছিল রণর সাথে কিছু দরকারি কথা আছে ওর।
ওর ভাবনার মাঝে হঠাৎ রাইয়ের রুমের দরজা খোলার শব্দ পায়।
কালো রঙের পাতিয়ালা প্যান্টের উপর সাদা কুর্তি পরে বেরিয়ে আসে রণর হার্টবিট, মুখে হাসি ছড়িয়ে।রণর সেই মুহূর্তে মনেহয় পুরো পৃথিবী মিথ্যে হয়ে যাক,মুছে যাক অনিকেতের অস্তিত্ব।শুধু সত্যি হয়ে উঠুক ওর ভালোবাসা। মনেহয় ছুটে গিয়ে জড়িয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে রাইকে বলুক,’বাঁচতে পারছিনা রাই তোকে ছাড়া।প্লিজ অনিকেত গাঙ্গুলী কে ছেড়ে তুই ফিরে আয় আমার কাছে। আমি তো ওরও আগে থেকে তোকে ভালোবাসি।প্লিজ আর কষ্ট দিসনা।’
কিন্তু ঠোঁট চুপ থাকে দুজনের।নিজের মনের কথাও বলতে পারেনা রণ,আর শুনতে পায়না রাইয়ের মনের কথাও।যেটা প্রতি মুহূর্তে চাইছে ছুটে এসে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।কিন্তু রণ যেমন অনিকেত কে দেখছে ওর আর রাইয়ের মাঝে,রাই দেখছে সেভাবেই শীর্ষা কে।
রাইকে দেখে উঠে দাঁড়ানো রণর চোখ দেখে তাই মনে মনে অবাক হয় রাই নিজেও।ও এতোটাও ছোট নেই যে এই মুগ্ধ, সব হারানো চোখের নেশা বুঝবে না।ওর চোখ ওকেও অস্থির করে,জোর করে উপেক্ষা করে রাই বলে,” বলো ডাক্তারবাবু,হঠাৎ করে কি মনে করে এলে?রাস্তা ভুলে নাকি?”
ওর কথায় নিছক ঠাট্টা থাকলেও রাইয়ের মুখে এরকম কথা নতুন লাগে রণর।ওর ছোট পরিটা বেশ বড়দের মত কথা বলতে শিখেছে।
“বাহ বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখছিস তো?তা তুইও তো যাসনা আজকাল আমাদের বাড়ি।আমি প্রায় মাসখানেক বাড়িতে আছি,তার মধ্যে তো একদিনও তোকে যেতে দেখলাম না”,রণ ঘুরিয়ে বলে।
রাই হাসিটা চওড়া করে,”তাই বুঝি ঝগড়া করতে এসেছ?” খুব ইচ্ছে করে শুনতে যে রণ ওর জন্যে এসেছে। সেই আগে যেমন ওর সাথে গল্প করতে যখন তখন ওর ঘরে গিয়ে টোকা দিত।
রণ ওর ছেলেমানুষি কথায় হেসে ফেলে।কিন্তু সত্যিটাই বলে,”না।আর ঝগড়া করিনা কারোর সাথে।আঙ্কেলের শরীর খারাপ,তাই দেখতে এসেছিলাম।পরশু ফোন করেছিলাম,বললো এখন মর্নিং শিফট চলছে,দুপুরের মধ্যে ফিরে পরে।তাই আজ এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম বলে ঢুঁ মারতে এসেছিলাম।”

একটা সূক্ষ্ম অভিমান কানে বাজে রাইয়ের,রণর কথা শুনে।রণদা কোনো কারণে আজকাল ডিপ্রেসড থাকে।আগের মত উচ্ছ্বলতার যেন বড্ড অভাব ওর মধ্যে।
“বাবার আজ থেকে ইভিনিং শুরু হলো এক সপ্তাহ।একটু আগেই বেড়োলো।”
ওদের কথার মাঝে হঠাৎ রাইয়ের মোবাইল বাজতে থাকে। রণর দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকে ওর সামনে দাঁড়িয়েই ফোন ধরে রাই,”বলো মাসি”।
ওহ সুলেখা মাসির ফোন।
দু একটা কথা বলে মুখটা কৃত্রিম হতাশ করে ফোনটা কেটে দেয় ও।ওর ওই মুখের ভাব দেখে রণ আবার জোরে হেসে ফেলে,”আজ বুঝি মহারানীর মুড খুব বিন্দাস।তা মাসি বুঝি বাড়ি গেছে?”
“হমম,কাল গেছে।আজ নাতি আসতে দিচ্ছে না।আর কি বলবো,বয়সও হয়েছে।কাল রান্না করেই গেছিল।আজ সকালে বাবা আর আমি মিলে মাংসের ঝোল ভাত করেছিলাম।রাতেও আছে,তাই আর চাপ নিলাম না।” রাই নিজেদের কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলে,”কি খাবে বল রণদা?”
-“কিছু না রে।আসলে আঙ্কেল বলেছিল কিছু দরকার আছে।তাই এসেছিলাম বলতে পারিস।আসলে আজকাল সারাদিন পড়াশোনা করেই কেটে যায়।সামনে এমএস এর এন্ট্রান্স আছে।উঠি এবার।আঙ্কেল নেই যখন…।”
উঠে দাঁড়ায় রণ।
“আর একটু বোস না রণদা”,রাইয়ের গলার আকুতি স্বভাবতই একটু নাড়া দিলো রণকে।কিন্তু এই আকুতি না ও উপেক্ষা করতে পারতো,না কোনোদিনও পারবে। আবার বসে পড়লো রণ।
কিন্তু কথারা আবার সাময়িক ছুটি নিলো যেন দুজনের থেকে,নিস্তব্ধতা কিছুক্ষন খেলা করার পর রণ বললো,”তোর খবর বল রাই।কি ভাবছিস ভবিষ্যৎ নিয়ে?”
হঠাৎ এরকম প্রশ্নে থতমত খেয়ে রাইমা বলে,”ভবিষ্যৎ নিয়ে মানে?কি করবো বা করতে চাই সে তো তুমি জানো! পড়ানোর লাইনে যাওয়ার ইচ্ছে আমার,সে স্কুলে হোক বা কলেজে।”

কয়েক সেকেন্ড থামে রণ।তারপর একটু ভেঙে ভেঙে বলে,”সে নিয়ে গাইড করার লোক তো পেয়েই গেছিস।উনিভার্সিটির প্রফেসর হবু হাজব্যান্ড জানে না বন্ধুরা?”

কথাটা অন্য টোনে হতে পারতো,ঠাট্টার টোনে।কিন্তু রণর কথাটা হতাশার সুরে গিয়ে লাগলো রাইয়ের কানে। সেই মুহূর্তে মনে হল সত্যিটা বলে দেয়,তারপরও চোখে ভেসে উঠলো রণ আর শীর্ষার যুগলবন্দি।কোনো অজানা কারণে রাইয়ের মুখ আটকে দিলো।বলতে দিলোনা সত্যিটা।বলতে দিলোনা ও নিজের বাবাকে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের জন্যে মত দিয়েছে।গতকাল সন্ধ্যেবেলা বাবার সাথে বসে ম্যাট্রিমনি ওয়েবসাইটে প্রোফাইল ও বানিয়েছে।তার আগে জয়ন্ত অনেকবার আকারে ইঙ্গিতে জানতে চেয়েছিল রাইয়ের জন্যে কেউ অপেক্ষায় আছে কিনা,অথবা রাই কারোর জন্যে অপেক্ষা করবে কিনা?প্রতিক্ষেত্রেই রাই হতাশ করেছে ওর বাবাকে।
রাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রণ বুঝতে পারে ও এই বিষয়ে কিছু বলতে আগ্রহী না।এত বছর ধরে এড়িয়ে থাকা বিষয় নিয়ে আজ যেচে প্রশ্ন করে নিজের ওপর নিজেরই রাগ হয় রণর।
আর রাইয়ের সাথে আগের মত আড্ডা সম্ভব না বুঝতে পারে ও।উঠে পড়ে সোফা ছেড়ে।এবার আর রাই ওকে আটকায় না।রণর কথার উত্তর দিতে না পেরে বড্ড কষ্ট হচ্ছে ওর।কিন্তু কোনো অজানা কারণে যেন ওর গলা টিপে ধরেছে কেউ।
‘অনিকেত আর আমার জীবনে নেই।আজ থেকে না,সেই দুর্গাপুজোর পর থেকে’,বলতে পারেনা রাই।আর ভীষণ কান্না পায়।যে কান্নাটা হয়তো গলায় দলা পাকিয়েছিলো আজ থেকে মাস খানেক আগে,কফিহাউসে রণর সাথে শীর্ষা কে দেখে,আজ বেরিয়ে আসতে চায় গলা ঠেলে।
‘আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই রণদা,নেই আমার মনেও’,বলা হয়ে ওঠেনা রাইয়ের।তার আগেই “আসছি” বলে ফ্ল্যাটের দরজা টেনে বেরিয়ে যায় রণ।

নিজের ঘরে জানলার ধারে চুপচাপ বসে ছিল রণ।দুপুরে রাইয়ের ওখান থেকে ফিরে থেকে বড্ড চঞ্চল হয়ে আছে মনটা।নিজের কোটা ছাড়িয়ে ধূমপান করেও শান্ত হয়নি মাথা।প্রায় সন্ধ্যে হতে চললো এখনো পড়ায় মন বসাতে পারেনি ও।আর মাস খানেক পর এন্ট্রান্স।স্টেটের বাইরে পেলেও চলে যাবে এটাই ভেবে রেখেছে ও,কিন্তু তার জন্যে দরকার একটা ভালো রেজাল্ট।
জোর করে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে রণ।কিন্তু কিছুতেই মাথা সঙ্গ দেয়না,আবার একটা ফ্যাগ নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসার কথা ভাবছে দরজায় কেউ নক করে। নির্ঘাত রমা পিসি সন্ধ্যের খাবারের জন্য ডাকছে।দরজা না খুলে রণ চেঁচিয়ে বলে,”কিছু খাবোনা পিসি”,কিন্তু ওকে অবাক করে দরজায় আবার নক হয়।
দরজা খুলে রণ দেখে মম দাঁড়িয়ে,নিজের ভুল বুঝে ছোট করে জিভ বের করে বলে,”সরি মম।আমি জানতাম না তুমি ফিরে পড়েছ।ভেতরে এস।”
জয়িতা ছেলের গালে স্নেহের হাত বুলিয়ে ছেলের ঘরে ঢোকে।

-“রণ আজ তুই রাইদের ওখানে গেছিলি?”
-“হমম।আঙ্কেলকে দেখতে,কিন্তু আঙ্কেল ছিলোনা।”
-“হমম রাইকে ফোন করেছিলাম একটা দরকারে,ও বললো।তুই যাবি জানলে জিনিসটা আনতে বলতাম।ঠিক আছে আমি কাল গিয়ে নিয়ে আসবো।”
-“কি জিনিস মম?” রণর চোখে বিস্ময় আর ঠোঁটে এই প্রশ্নটাই শুনতে চেয়েছিল জয়ি।
রাইয়ের ধরা গলা আর অন্যমনস্কতা জয়িতা কে আজ অনেকটা নিশ্চিন্ত করেছে।তাই জয়ন্তর কথা গুলো বিশ্বাস করে ছুটে এসেছে ছেলের ঘরে।

-“রাইয়ের কটা ফটো। জয়ন্ত বলছিল ভালো ফটোগ্রাফার দিয়ে তুলিয়েছে। আমার দরকার ছিল এক কপি করে”,জয়ি কথাগুলো অন্যদিকে তাকিয়ে বললেও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ রাখে ছেলের এক্সপ্রেসন বুঝতে।
-“রাইয়ের ছবি?ও কি মডেলিং করছে নাকি?আর তুমিই বা কি করবে ছবি নিয়ে?”
-“আমার এক কলিগ কে দেব।ওর বোনের ছেলের জন্য।ছেলেটা দিল্লিতে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার পোস্টে আছে।ভালো ছেলে।দেখতে শুনতেও ভালো।আর ওরা ইন্টারেস্টেডও রাইয়ের…”, বাধা পায় জয়ি।
-“মম প্লিজ ক্লিয়ার করে বলবে। একে আজ আমি ঘেঁটে আছে, তাই প্লিজ হেঁয়ালি কোরোনা।রাইয়ের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড মানে কি?” গলার আওয়াজ অজান্তেই উঠে যায় রণর।আর জয়ি এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল,সঙ্গে সঙ্গে অবাক হওয়ার ভান করে বলে,”সে কি রে!!রাইয়ের খবর তো আগে তুই আমার থেকে বেশি রাখতিস।তোকে রাই বলেনি,জয়ন্তর শরীরের কারণে ওর চাপে পড়ে রাই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এ রাজি হয়েছে।আমরা সবাই ওর জন্যে উপযুক্ত সম্বন্ধ খুঁজছি।আমি ভাবলাম আজ রাই তোকে বলেছে নিশ্চই”, যে মা নিজের বন্ধুত্বের খাতিরে একদিন অন্য সম্পর্কে বাঁধতে চেয়েছিল ছেলে মেয়ে দুটোকে।আজ সেই মা’ই বন্ধুর দেওয়া প্রোপোশালে আনন্দে ডগমগ হয়ে ছেলেকে যাচাই করতে এসেছে।যদিও প্রপোশালটা ওদের দুজনের মধ্যেই আছে,কিন্তু জয়ন্তর অনুমান যে ভুল না সে বিষয়ে জয়ির মনেও একটা সন্দেহ আছে আজ বহুবছর ধরে।
জয়ির কথা শেষ হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরে রণ,”য়্যূ মিন রাই নিজের পছন্দে না তোমাদের পছন্দে বিয়ে করবে?” চোয়াল শক্ত হয় ওর।মনে মনে বলে,’কি ভেবেছে কি ও!আমার জীবন তছনছ করে,অনিকেত কেও বিয়ে না করে অন্য কাউকে লাইফপার্টনার করবে,আর আমি সেটা মেনে নেব?!!একটা অচেনা অজানা ছেলের সাথে… উফ আমি ভাবতেও পারছিনা।কারণটা আমায় জানতেই হবে’।

অস্থির হয়ে উঠে রণ ভেতরে ভেতরে।জয়ির উত্তরের অপেক্ষা না করে ছুটে যায় ও নিজের কাবার্ডের কাছে, একটানে বের করে আনে দুপুরের শার্ট প্যান্টের সেটটা।সেটা নিয়ে ঢুকে যায় নিজের ওয়াশরুমে।
পাঁচ মিনিটে বেরিয়ে এসে জয়ি কে বলে,”মম আমি একটু বেরোচ্ছি।একটা প্রশ্নের উত্তর জানা খুব দরকার।আমার পুরো জীবনের প্রশ্ন।প্লিজ এই মুহূর্তে কিছু জিজ্ঞেস কোরোনা।ফিরে সব বলবো”।
রণ আশাও করেনি এমন উত্তর আসে জয়ির দিক থেকে,”হ্যাঁ যা জেনে আয়।আমি তোর ফেরার অপেক্ষা করবো”।”
অবাক রণ আর কিছু বলতে পারেনা।কিছুক্ষণ মায়ের মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে কিছু খোঁজে,তারপর মায়ের কপালে একবার ঠোঁট ঠেকিয়ে আস্তে করে শুধু বলে,”থ্যাংক য়্যূ মম”,ছুটে বেরিয়ে যায় নিজের ঘর থেকে।

দিদুনের ঘরটা এখন বাবা থাকে। সেই ঘরের ব্যালকনিতে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল রাই।কিছু ভাবতে,মনের সাথে লড়াই করতে ইচ্ছে করছিল না আর।বড্ড ক্লান্ত লাগছিলো নিজের।সন্ধ্যের এই আদা চা বাড়ি থাকলে ও চট করে মিস করেনা।সেই চায়ে চুমুক দিয়ে দূরের দিকে চোখ মেলে দাঁড়িয়েছিল রেশমার মেয়ে।
হঠাৎ একটানা কলিং বেলের আওয়াজ চমকে দিলো ওকে।কেউ পাগলের মত টানা বেল বাজাচ্ছে।একটু ভয় পেয়ে গেল মনে মনে,একা আছে ও।কিন্তু গেট,টাওয়ার সিকিউরিটি পেরিয়ে অচেনা কেউ তো ঢুকতে পারবে না!
তাহলে কে এরকম অধৈর্য্যের মত বেল দিচ্ছে?বাবা ঠিক আছে তো?হাতের কাপ টা ডাইনিং টেবিলে রেখে ছুটে গিয়ে দুপুরের মত একই ভাবে আইহোলে চোখ রাখলো রাই,আর একই ভাবে চমকালো।
রণদা,সেই একই ড্রেসে,কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড অস্থির।দরজার লক খুলে দিল ও।দরজা এদিক থেকে টেনে খোলার আগেই ওদিক থেকে লক ঘুরিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে এলো রণজয়।ওর চোখের এই অস্থিরতা ভাবিয়ে দিলো রাইকে।কিন্তু ওকে অবাক করে অদ্ভুত ভাবে পা দিয়ে ঠেলে মেইন দরজা বন্ধ করে দিলো ওর দিকে এগিয়ে এলো রণ।ওখানকার সরু প্যাসেজের দেওয়ালে ওকে চেপে ধরে মুখের একদম কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে হিংস্র ভঙ্গিতে বললো,”কি ভেবেছিস কি তুই?আমায় পাগল না করে থামবি না?অনিকেত ছাড়াও আরো অন্য অপরিচিত কেউ তোর গায়ে হাত দেবে আর আমি চুপচাপ বসে বসে তাই দেখবো?”
চোখ গুলো বড় বড় রাই বিস্ময়ের শেষ সীমায় গিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো ওর ভালোবাসার দিকে,এত কাছ থেকে আগে কোনোদিনও দেখেনি যে।রণর পারমিউমের গন্ধ ওকে পাগল করতে লাগলো,রণর পুরুষালী হাতের চাপে যে ওর বাঁ হাতের বাহু কনকন করছে অনুভব করতে পারলো না ও।শুধু দুহাত দিয়ে খামচে ধরলো রণর কোমরের শার্ট টা।

ক্রমশ…