মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-১৫

0
416

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#পঞ্চদশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“কিরে জয় একটু গলা ভেজাবি নাকি?” নতুন কেনা নিজের সবচেয়ে প্রিয় গাড়ি এমজি গ্লস্টারের পিছনের সিটে পাশে বসা জয়ন্ত কে উদ্দেশ করে বলে ঋষি।
“চল নামলেই হয়।প্রায় ঘন্টাখানেক একটানা বসেও আছি।কিন্তু এ রাস্তায় তো তুইও অনেকদিন যাসনি।তাহলে?” জয়ন্ত কাঁচের মধ্যে দিয়ে বাইরে তাকিয়েই প্রশ্ন করে।
“কি হে ভাস্কর শুনতে পেলে?কোনো চায়ের দোকান দেখলেই গাড়িটা একটু গ্যারেজ করো।এখনো তো বেশ অনেকটা পথ বাকি?” ড্রাইভারের সিটে বসা বিশ্বস্ত ভাস্করকে উদ্দেশ করে বলে এবার ঋষি।
ভাস্কর রাস্তার দিকে নজর রাখলেও ঘাড় নাড়ে বেশ জোরেই।রণ হাত তুলে ভাস্করের “হ্যাঁ” ইঙ্গিতে পিছনে জানিয়ে দেয়।
জয়ি গাড়ি ছাড়ার পর থেকেই চোখ বুজে বসে আছে।সকালে উঠতে হয়েছে আজ,সংসার তিন চারদিনের মত গুছিয়ে আসা অনভ্যাসের কারণে একটু চাপ পরে যায়।
গ্রামের বাড়িতে শেষ দুবছর একজন কেয়ারটেকার আছে ঠিকই,কিন্তু জয়িতা পুরোপুরি ভরসা করতে পারেনি তাকে।তাই পঞ্চমীর দিন ঋষি হাওড়া স্টেশনে এসে রমাকে কাটোয়া লোকালে তুলে দিয়ে গেছিল,যাতে ও আগে পৌঁছে সব ভালো করে গুছিয়ে রাখে।
আজ সপ্তমী,সকালের চা টা খেয়েই বেরিয়ে পড়েছে সকলে মিলে।সুলেখাকে ছুটি দিয়ে শেষ অবধি জয়ন্ত-রাইও ওদের সাথেই এসেছে।
জয়ি মুখ খুললো,”বাড়ি থেকে বেরিয়ে তো সবে ঘন্টাখানেক হলো,এর মধ্যেই চায়ের নেশায় গলা শুকিয়ে গেল তোমার? আর ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে তো পৌঁছেই যাবো।গিয়ে ব্রেকফাস্টের সাথে নাহয় চা খেও।”
রাই আর রণ মুখ টিপে হাসলেও মুখ খুললো জয়,”একি রে ঋষি জয়ি তো একদম বুড়িয়ে গেছে রে।এই সেই মেয়ে যে বাইরে আউটিং এ গেলে বারবার রাস্তায় গাড়ি থামাতে বলতো? বলতো,’আরে পৌঁছে গেলে তো সেই একই পরিবেশে বেশ কিছুক্ষণ বা কিছুদিন থাকা।রাস্তার জার্নিটাই তো আসল।মুহূর্তে মুহূর্তে বদলায় আশপাশ।’ সেই জয়ি উঠে থেকে চোখ বুজে বসে”, জয়ন্ত অনেক বছর পর এত খোলা মনে মিশে যায় তার দুই বন্ধুর সাথে।
আওয়াজ করে হেসে ওঠে জয়ি,আর আক্ষেপের সুরে ঋষি বলে,”ভাব তাহলে আমার অবস্থা।কাকে বিয়ে করেছিলাম,আর এখন কাকে নিয়ে ঘর করছি।একদম টিপিক্যাল গিন্নি হয়ে গেছে, রসবোধ আর কিছুই নেই”,ওর মুখ দেখে হেসে ফেলে জয়। আর কপট রাগের স্বরে জয়ি বলে,”দুজনে মিলে শুরু করেছ সেই কলেজের মত আমায় লেগ পুল করতে,বাচ্ছা গুলো আছে ভুলে গেলে নাকি!ঠিক আছে ঠিক আছে বাবা যত খুশি থেমে থেমে চলো।আমার কি রমা ই বসে থাকবে।”

হাসতে থাকে ঋষি আর জয় জয়িতার কথা শুনে।রণ-রাই শুধু না তার ম্যাডামের কথায় ভাস্করও হাসতে থাকে।
“বাচ্ছা নাকি?আজকের দিনে স্কুলে পড়া ছেলে মেয়েই বাচ্ছা থাকেনা।আর এই কলেজে পড়া দুটো আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দেবে”,ঋষি এবার জয়ি কে ছেড়ে রাই-রণ কে নিয়ে পড়ে।
“স্যার সামনে একটা ধাবা দেখতে পাচ্ছি।গাড়ি দাঁড় করাই?” ভাস্করের কথায় ঋষি জানলার বাইরে চোখ রাখে,কিন্তু রণ আগেই ঘাড় নেড়ে ইশারায় হ্যাঁ বলে দেয়। গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে ধাবার সামনের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়।নেমে পড়ে সবাই একে একে।
বিগত কয়েক বছর ধরে মহামারীর কারণে গাড়িতে এতদূর আসা প্রায় বন্ধই ছিল।তাই সবারই একঘন্টার জার্নিতেই পা ধরে গেছে।সবাই হাত পা ছাড়িয়ে ধাবার বেঞ্চে বসে।
“উফ কতদিন পর যেন খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছি।এই ভয় আর আতঙ্কে প্রায় পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলাম আমরা।সারাক্ষন ব্যাগে স্যানিটাইজার নিয়ে ঘুরে ঘুরে…”,ঋষি যেন ভুলতে পারেনা ফেলে আসা দিনগুলো,যদিও মুখের মাস্ক এখনো সঙ্গী সবার।
জয়ন্ত মৃদু হাসে।এই পাঁচ বছর এক সময় অনন্তকাল মনে হত।আর মনে করতে ইচ্ছে করেনা ফেলে আসা বছর গুলো।ওই রোগের ভয়েতেই না ফিরে এসেছিল মেয়ের কাছে,কিন্তু মেয়েটা ততদিনে বড্ড বড় হয়ে গেছিল।
এখন চাইলেও মেয়ের সাথে দূরত্বটা মুছতে পারেনা জয়ন্ত।
ও নিজেকে বদলেছে,বদলেছে শুধু রেশমার স্বপ্ন পেয়ে না।বদলেছে কারণ ও বুঝতে পেরেছিল যে চলে যায় তার দায়িত্ব শেষ,কিন্তু যে থাকে তার কাজ তার মৃত্যু অবধি করে যেতে হয়।
রাই আজকাল নিজের একটা জগৎ তৈরি করে ফেলেছে। জয়ি একদিন হঠাৎ বলে ফেলেছিল, ‘রাই আর সেই ছোট্টটা নেই।কলেজে উঠেই বড্ড বদলে গেছে।হঠাৎ বড় হয়ে গেছে যেন তোকে পেয়ে’।
আজ বরং অনেকটা পুরোনো রাইয়ের দেখা পাচ্ছে জয়।সকাল থেকে বিশেষ ফোন নিয়ে খুটখাট করেনি।শেষ কমাস কেমন অপরিচিত একটা মেয়েকে দেখছিল যেন ও।

হঠাৎ জয়ন্তর মনে পড়ে কাল রাতে বাড়ি ফিরে কেমন থম মেরে বসেছিল মেয়েটা ডাইনিং টেবিলে।কাল থেকেই সুলেখা কে ছুটি দিয়ে দিয়েছিল জয়।রাই বলেছিল বন্ধুদের সাথে ঠাকুর দেখে ডিনার সেরে ফিরবে,তাই নিজের খাবার হসপিটালের ক্যান্টিনেই সেরে এসেছিল জয় সন্ধ্যেবেলা।ভেবেছিল রাতে একটু দুধ খেয়ে শুয়ে পড়বে,পরেরদিন সকাল সকাল ওঠা।আজ থেকে কদিন ছুটি নিয়েছে কাল তাই ডিউটির পরও কিছুক্ষন হাসপাতাল চত্বরে ছিল।

রাইকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে জয়ও এসে বসেছিল ওর পাশে।বাবাকে দেখে একটু অপ্রস্তুতে পড়লেও মুহূর্তে তা সামলে হালকা হেসেছিল ও।
বেশি কথা হয়নি কিন্তু জয়ন্ত বুঝেছিলো রাই একটু আপসেট।এমনিতেই চাপা স্বভাবের মেয়ে ও ,তাই কারণটা জানতে পারেনি জয়।
আজ সকালে ওর আগে উঠে নিজে রেডি হয়ে চা বানিয়ে জয়ন্তর ঘরে নক করেছিল তার মেয়ে।

“এই নে আলুর পরোটা,চা আসছে।” ঋষির কথায় ঘোর কাটে ওর।
-“আবার পরোটা?”
-“দূর খিদে পেয়ে গেছে।সকালে শুধু চা খেয়ে বেড়িয়েছি।তুই জানিস তো জয়ি একদম খিদে সহ্য করতে পারেনা।মুখ ফুটে তো বলবে না।”
-“তাহলে এই ব্যাপার।বউয়ের রাগকে পাত্তা না দিয়ে বউয়ের জন্যেই ধাবায় আসা?”
-“রাই বলছিল তুই হয়তো পরোটা খাবিনা।আমি জোর করে আনলাম।বললাম,’আমার বন্ধুকে আমার চেয়ে তুই বেশি চিনিস?’ তুই আলুর পরোটা খেতে কত ভালোবাসিস ও আর কিকরে জানবে?”
-“ঋষি ঠিকই বলেছে রাই।আমি পরোটা খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি।আমি স্টাফড পরোটা ভালোবাসতাম বলে রেশমা বিভিন্ন রকমের পরোটা বানাতো।তাই…।কিন্তু আজ খাবো, তুই হাতে করে এনে দিয়েছিস…।” নিজেকে নতুন করে ভালোবাসার চেষ্টা করছে জয় এখন,তার সাথে চেষ্টা করছে আশেপাশের মানুষগুলোকে আর কষ্ট না দিতে।

কিছু বলতে পারেনা ঋষি আলতো করে কাঁধটা জড়িয়ে ধরে জয়ের।
দূর থেকে জয়ির নজরে পড়ে দৃশ্যটা।কথোপকথন কানে না গেলেও মনটা ভরে যায়,মুখে একটা আলগা হাসি ফুটে ওঠে।

ছাদে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল রাই।ছাদ ব্যাপারটাই বরাবর ওর খুব প্রিয় একটা জিনিস।যে কবছর রণদের বাড়ি ছিল,দিনে কিছুক্ষন ছাদে ও কাটাতই।এখন ফ্ল্যাটে এসে আবার ব্যালকনি ভরসা।
ঋষি আঙ্কেলের দেশের বাড়ির ছাদটা একটা ছোটখাটো ফুটবল মাঠ হয়ে যাবে।
এখন রাত প্রায় আটটা বাজে।বড়োরা চন্ডীমণ্ডপে সপ্তমীর আরতি দেখতে গেছে।রাই আর যায়নি।দূর থেকে আরতির ঘন্টা,ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে।গ্রামের মানুষ গুলো অনেক বছর পর মায়ের পুজোয় মেতেছে একসাথে।আগের বছরও অনেকটা ঠিক হয়ে এসেছিল পরিস্থিতি, তাও মানুষের মনে একটা ভয় ছিল।এবছর অনেকটা স্বাভাবিক মানুষ।
এখানে এসে আঙ্কেলের মন একটু খারাপ হয়েছিল একটা খবরে।আঙ্কেলের এক ছোটবেলার বন্ধু,তার বাবার ক্যান্সারের চিকিৎসা করেছিল আঙ্কেল কয়েক বছর আগে,করোনা কালে দ্বিতীয় ঢেউয়ে মারা যায়।আঙ্কেল খবর পায়নি।
সব মিলিয়ে মন খারাপ নিয়ে শুরু হলেও বিকেলের পর অনেকটা ভালো হয়েছে সবার মন।খুব খারাপ ব্যাপার হলেও করোনা হয়তো মৃত্যুকে অনেকটা স্বাভাবিক করে দিয়েছে মানুষের কাছে।
হঠাৎ পায়ের আওয়াজে ফিরে তাকায় রাই…রণদা।মনেহয় সিগারেট খেতে এসেছে।
ও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বলে দেখতে পায়নি।বড্ড বদলে গেছে ওর প্রিয় বন্ধুটা।আগে ওর সাথে কত কথা বলতো,কিন্তু শেষ কমাস যেন ওকে সবসময় এড়িয়ে থাকে।কত কথা জমে গেছে রাইয়ের,কিন্তু রণর চারিদিকে এক অদৃশ্য প্রাচীর ওর কাছে যেন যেতে দেয়না।এটা কি ওর পেশার জন্যে বদলে যাওয়া নাকি অন্য কোনো কিছু,বুঝতে পারেনা রাইমা।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখে রণর কাঁধে।
প্রথমে চমকালেও পরিচিত পাউডারের গন্ধে রণ বুঝতে পারে রাইও ছাদে এসেছে।কতগুলো মাস কেটে গেল এখনো নিজেকে গুছতে পারলো না ও।উল্টে রাই চোখের সামনে থাকলে কষ্টগুলো বড্ড বেশি তাড়া করে আজকাল।সামলাতে পারেনা ও নিজেকে।তাও অমোঘ আকর্ষণও কাটাতে পারেনা।তাই শেষ অবধি ঠিক চলেই এলো এবারেও সবার সাথে।
রণর চোখে যে জলটা জমে আছে সেটা আটকাতে চোখের পাতা ফেলেনা রণ,ঘুরেও তাকায়না রাইয়ের দিকে।ওর দিকে পিছন করে দাঁড়িয়েই শুকনো কণ্ঠে বলে,”কিরে তুই ছাদে? কথা বলছিলি বুঝি?”
হাতটা সরিয়ে নেয় রাই।বুঝতে পারে রণ কি বলতে চাইছে, কিন্তু রণকে কিছু বলতে চেয়েও আর বলতে পারেনা স্বভাব চাপা মেয়েটা।রণ যে ওর বন্ধুত্ব ওর থেকে না বলেই ফেরত নিয়ে নিয়েছে,সেই অভিমানে মুখ বন্ধ রাখে ও।
ওর মা চলে যাওয়ার পর রণই না ওর মায়ের জায়গা নিয়েছিল! তাহলে কেন হঠাৎ সরিয়ে নিল ও নিজেকে।
কথা ঘোরায় রাই,”তুমি যাওনি ঠাকুরতলায়?”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়না রণ।সিগারেটে দুটো টান দিয়ে নিজের চোখেতেই জলটা শুকিয়ে নেয় যেন।তারপর গলা পরিষ্কার করে বলে,”যাবো।রাতের দিকে।এখন একটু পড়ছিলাম।”
“তুমি স্মোক করো রণদা কবে থেকে?আগে তো দেখিনি কখনো?আগের বার তোমাদের বাড়ি গিয়ে প্রথম দেখলাম”,রাই চেপে রাখা কৌতুহলটা প্রকাশ করেই ফেলে।

আবারও উত্তর দেয়না রণ।যেন রাইয়ের কথার কোনো গুরুত্ব নেই এরকম ভাব দেখায়,’উপেক্ষা’ জবাব দিতে চায় ওকে।
খুব কান্না পায় রাইয়ের।সেই পাঁচ বছর আগের মত।এই ছেলেটাই না ওকে কাঁদতে বারণ করেছিল, কত সহজে বলেছিল আমরা খুব ভালো বন্ধু।বন্ধুর চেয়ে পবিত্র সম্পর্ক হয়না।তাহলে এত সহজে বন্ধুত্ব কেড়ে নিল!
কত কথা জমে আছে রাইয়ের বুকে। রণ সব শুনতো আগে,আর এখন? বন্ধুত্বের সম্পর্ক বুঝি এত স্বার্থপর হয়! কেউ তাহলে সত্যি মায়ের জায়গা নিতে পারেনা? নিজেদের কোনো কিছু মনের মত নাহলেও বুঝি ছুঁড়ে ফেলে দিতে সময় লাগেনা?

“আসি রণদা।আমারও একটু কাজ আছে নীচে”,একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে রাই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়।

রণ বলতে চেয়েও বলতে পারেনা,’একটু থাকনা রাই।চল আগের মত গল্প করি।’ এক অব্যক্ত অভিমান গলা চেপে ধরে।
ও নিজেও ভুলে যায় ওর বলা প্রথমদিনের কথা গুলো।
বন্ধুত্ব আসলে শর্ত মানেনা।বন্ধুত্ব দেখেনা স্বার্থ।জীবনের
যেকোনো পরিস্থিতিতে যে পাশে থাকে সেই প্রকৃত বন্ধু।রাই রণকে সেভাবেই ভেবেছিল।তাই ভাইফোঁটার অতিরিক্ত বাঁধনে যেমন ওকে বাঁধতে চায়নি,তেমনই সম্পর্কটা নিয়ে কখনো বন্ধুত্বের বেশিকিছু ভেবেও দেখেনি আজ অবধি,যদিও রণর ব্যবহার ওকে অনেক কিছু ভাবাচ্ছে আজকাল।রণর বদলে যাওয়া ওকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে,তবে অদ্ভুতভাবে রণর অভাবে একটা আলাদা অনুভূতিও তৈরি হচ্ছে অবচেতনে।
সব সম্পর্কের ওপরেও জীবনে সবচেয়ে দরকার হয়তো একটা বন্ধুর,যার কাছে মন খোলা যায়।যখন সব সম্পর্ক পর করে দেয়,একটা বন্ধু সবসময় পাশে থাকে,কারণ তার মানসিকতা যে সমগোত্রীয় হয়,নাহলে বন্ধুত্ব গড়েই উঠতো না।

রণ এতদিন এটাই ভাবতো,কিন্তু রাইয়ের অজান্তেই রাইয়ের ক্ষেত্রে ওর মনে সম্পর্কের উত্তরণ ঘটেছিল।তাই জন্ম নিয়েছে এই অভিমান,যার খোঁজ না আছে রাইয়ের কাছে,না বলতে পারছে রণ।ছোট থেকে বুঝদার ছেলে আজ তাই অবুঝপনাটা স্বাভাবিক মনে করছে।

রাই এসে ওর আর জয়ির বরাদ্দ ঘরে ঢোকে।এটা জয়ির সিদ্ধান্ত।ঘরের অপ্রতুলতা না থাকা স্বত্ত্বেও জয়ি অচেনা পরিবেশে এসে রাইকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিল,”তুই আমার সাথে থাকবি না একা একটা ঘরে থাকা প্রেফার করবি?”
“তোমার সাথে থাকবো আন্টি।” একমুহূর্ত না ভেবেই বলেছিল ও।বুঝতে পেরেছিল শুধু রণ না অবাক হয়েছে সবাই।

ও কিকরে বলবে মা চলে যাওয়ার পরের বারের পুজোও এর থেকে ভালো কেটেছিল ওর।এমনকি কোভিদের চোখ রাঙানির মধ্যেও জয়ি আন্টির বাড়িতে বিগত কতগুলো বছরে পুজোর দিন গুলো ভালো ভাবেই কাটিয়েছিলো ওরা।
রণ শুধু মাতিয়ে রাখতো না,পুজোর দিনগুলো বাড়ির মধ্যেই পুজোর আবহ তৈরি করতো।আঙ্কেল আন্টির ডিউটি থাকলেও কখনো এত শূন্য লাগেনি কোনো বছর।রণ খুব ভালো রান্না করে সেই স্কুলে পড়া থেকে।রাইয়ের সাহায্য নিয়ে রমা পিসিকে একদিন বিশ্রাম দিয়ে ওরা নবমী বা দশমীতে বানাতো স্পেশাল মেনু।
আজ বড্ড মনে পড়ছে ওই দিনগুলো।বড্ড ফিরে পেতেও ইচ্ছে করছে।
অনিকেত মানুষটা খারাপ না,কিন্তু বয়সের কারণে বড্ড ডোমিনেটিং।নিজের সব ভালো লাগা মন্দ লাগা চাপিয়ে দেয় ওর ঘাড়ে।এই কমাসে ওদের মধ্যে শুধুই গড়ে উঠেছে নির্দেশ আদেশের সম্পর্ক।
রাই এমনি মেনে নেওয়া মানিয়ে নেওয়া চরিত্রের হলেও গতকাল আর পারেনি।অনিকেত রাইদের এই পুজোয় বেড়ানোর কথা কালই প্রথম জানে,আর তার প্রতিক্রিয়া হয় সাংঘাতিক।চোখ বুজলে এখনো কানে ভাসছে রাইয়ের ওই কথা গুলো।

-“কি তুমি কাল একটা গ্রামে যাচ্ছ, তাও আজ আমায় জানাচ্ছো! আগে জানানোর প্রয়োজন বোধ করনি?” অনিকেত যেন ফেটে পড়েছিল রাইয়ের কথা শুনে।

-“দেখা হয়নি তো কদিন।আর ফোনে বা মেসেজে বলার মত ইম্পরট্যান্ট কথা তো না।তুমিও ব্যস্ত ছিল কাজের নতুন পরিবেশে।” অবাক রাই আটকাতে পারেনি নিজেকে।

-“আবার এক্সকিউজ দিচ্ছ?আমার পারমিশন নেওয়াটা ইম্পরট্যান্ট না তোমার কাছে?”

-“পারমিশন?আমি তো বাবার সাথে যাচ্ছি।”

-“তো!!আমি তোমার ভবিষ্যৎ অভিভাবক ভুলো না সেটা।”

এবার আর কিছু বলেনি রাই।শুধু অবাক হয়েছিলো।ওর মনে আছে তখন ও খুব ছোট।ওর মা নিজের বান্ধবীদের সাথে শপিংয়ে যাবে সেটা বলতে বাবা কে ফোন করেছিল।ব্যস্ত সময়ে ফোন ধরে বাবা বিরক্ত হয়ে বলেছিল,”আমায় বলছো কেন?বলছো তো আমি ফেরার আগে ফিরে আসবে। তাহলে?” মা বলেছিল,”তোমায় না জানিয়ে যাবো তাও হয় নাকি?”
“কেন হয়না?তুমি স্বাধীন মানুষ,আমায় জানানোর দরকার থাকলে তবেই জানাবে।আগেও তো কতবার বলেছি তোমাকে।যাও আনন্দ করে এসো।এমনিও আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে”।

সংসার হলে একে অপরকে জানিয়ে যাওয়া এটা একটা ভালোবাসা হতে পারে,সম্মান হতে পারে।কিন্তু বিয়ের আগের পারমিশন!!সম্মত নাহলেও কথা বাড়ায়নি।
কিন্তু অনিকেতের কথা মেনে প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করতেও রাজি হয়নি ও এই প্রথমবার।
অনিকেত মানুষ হিসেবে সত্যি ভালো।ওর একটা সুন্দর মনের পরিচয় রাই এ কমাসে বেশ কয়েকবার পেয়েছে। একটা অনাথ আশ্রমে নিয়মিত টাকা পাঠায় ও,রাস্তার শিশুদের দেখলে খাবার কিনে খাওয়ায়।বাচ্ছাদের প্রতি টানটা ওর বেশি।কিন্তু ওর এই অত্যাধিক ‘পজেসিভনেস’ আর ‘ডোমিনেটিং নেচার’ আজকাল বড্ড ভাবায় রাইকে।
ওর অজান্তেই মনে বারবার তুলনা চলে আসে রণর।রণর বন্ধুত্ব ওকে খোলা আকাশ দিয়েছিল।নিজের মধ্যে গুটিয়ে বড় হওয়া রাই বাইরের প্রকৃতি চিনেছিলো রণর হাত ধরে।আর সেখানে অনিকেত খালি ওকে গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখতে চায়।পুরোনো রাই সেটা হয়তো স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিত,কিন্তু এই রাই নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে শিখেছে,ওকে শিখিয়েছে রণ।রণ ওকে স্বাবলম্বী করেছে শেষ কবছরে।তাই রণর মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বেশি করে নষ্ট করছে ওর পুজো।ও রণকে বলতে চাইছে,জানতে চাইছে,কিন্তু ও জানে এই ছেলেটা নিজের কথা সহজে কাউকে বলবে না।
হঠাৎ ওর ঘরের দরজায় আওয়াজ শুনে চমকে তাকায়।নিমেষে মলিন মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর।রণ খোলা দরজা নক করছে।মুখে হাসি এনে ও উঠে আসে পুরোনো দিনের দরজাটার কাছে।
“খোলা দরজা নক করছো রণদা?এতোটাও ফরমাল না আমাদের সম্পর্ক”,রাইয়ের কথায় রণর বিস্ময় জাগে।মেয়েটা কত গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে,ভুলে যায় সবটাই ওর শেখানো।
“ব্যস্ত আছিস?আসলে এবারে পুজোয় কিছু মেনু ঠিক হয়নি।সময় হবে তো তোর রান্না করার?একা করলে…”,রণর কথা শেষ হয়না রাইয়ের উত্তরে।
“একা করবে কেন?ওটা তো আমাদের দুজনের ‘টিম ওয়ার্ক’,নাহলে ভালো হবে নাকি?”
অনেকদিন পর তৃপ্তির হাসি ফোটে রণর ঠোঁটে।রাইয়ের সাথে অনেকদিন পর অনেকটা সময় কাটানোর সুযোগ ওকে একটা পরিতৃপ্তি দেয়।কথা না বাড়িয়ে বুড়ো আঙুল তুলে ওর অভ্যেসে ‘থাম্ব আপস’ দেখায়।হাসি ফোটে রাইয়ের ঠোটেও,শান্তির হাসি,রণদা কে পুরোনো মেজাজে ফিরে পাওয়ার হাসি।

“উফফ চিংড়ির মালাইকারীটা জাস্ট ফাটাফাটি হয়েছে।আজ তো ফাটিয়ে দিয়েছিস তোরা।আগেরবারের থেকেও খুব ভালো।আরে বাঙালি মানুষ আমরা,মাছে ভাতে বাঙালি।প্রতিবার দশমীতে বিরিয়ানি খেতে ভালোই লাগে,কিন্তু বাঙালি রান্নার ব্যাপারটাই আলাদা।” ঋষি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বলে।
রণ হাসে।ম্লান হাসি না,সেই পুরোনো ঝকঝকে হাসি।
“সবটাই রাইয়ের প্ল্যান ছিল।আর মালাইকারি টা ওই করেছে।”
রণর কথায় একটু লজ্জা পায় রাই।
সত্যি করেই রাই বলেছিল রণকে,”আচ্ছা রণদা,ওই স্পেশাল ডিস না করে আমরা যদি বাঙালি রান্না করি,আন্টির হেল্প নেব”।

রাইয়ের লজ্জা পাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে রণ হাসে,আঙ্গুল তুলে ‘থাম্বস আপ’ দেখায়।
রাইয়ের হঠাৎ একটা খুব চেনা দৃষ্টি নজরে পড়ে রণর চোখে।চমকে ওঠে রাই,’না না ভুল হচ্ছে’।সরে যায় ও ওখান থেকে।
কাল বিকেলের কথা মনে উঁকি দেয়।একই দৃষ্টি দেখেছিল না কাল যখন ও বেড়াতে বেরিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল মাঠের ধারে!!রণও হাসতে হাসতে ওকে লেগ পুল করে বসে পড়েছিল ওর পাশে।
“হাসো হাসো।তুমি যেন ক্লান্ত হও না।হমম ডাক্তারদের যেন ক্লান্তি আসেনা?”
ওর কথার ধরণে রণর সেই পুরোনো রাইকে মনে পড়ে যায়,যে রোজ এসে রণকে এরকম মজার কথা বলতো।
রণ বহুদিন পরে রাইয়ের কথায় উচ্চকণ্ঠে হাসতে শুরু করে দেয়।একসময় সেই হাসি ছড়িয়ে যায় রাইয়ের মধ্যেও।বাচ্চাদের মত অর্থহীন হাসি হাসতে হাসতে ক্লান্ত রাই নিজের ঘাড় ফেলে দেয় রণর কাঁধে।রণর বন্ধুত্বের কাছে ও কোনোদিনও জড়সড় ছিলোনা।তাই স্বাভাবিকভাবেই বন্ধুর কাঁধে মাথা রাখে,যা আগে হয়তো করেনি।
রাই বুঝতে পারে রণ যেন দমবন্ধ করে কেঁপে উঠলো একবার।রাই কাঁধে মাথা রেখেই তাকায় ওর মুখের দিকে।রক্তশূন্য এক অচেনা আবেগের মুখ দেখতে পায় ও।মনেহয় সিঁটিয়ে গেছে রণদা।মাথা তুলে নেয় ও,কিন্তু এক অজানা অস্বস্তি ছড়িয়ে যায় ওরও মনে।রণ এরপর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেও রাইয়ের কেন যেন মনেহয় রণদা হঠাৎ ধরা পড়ে গেছে,আর আপ্রাণ লুকোতে চাইছে নিজেকে কোনো এক সত্যি থেকে।কিন্তু রাই নিজেও নিজের কাছে পরিষ্কার হতে পারেনা,শেষ অবধি এড়িয়েই যায় বিষয়টা।

রণ রাইকে সরে যেতে দেখে নিজেও উঠে আসে খাবার জায়গা ছেড়ে।আজ ওরা ঠিক করেছে যেহেতু ওরা ‘সেফ’,ওরা খাবে সবাইকে খাইয়ে।কথা শোনেনি জয়ি,তাই প্রথম পাত পড়েছে ঋষি আর জয়ন্তর।

রাইয়ের খোঁজে এসে রণ দেখে ঘরের বড় জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাইমা।দৃষ্টি দূরে হলে মুখের হাসি ইঙ্গিত দিচ্ছে মনে মনে কিছু ভেবে হাসছে মেয়েটা।কোনো ভালো স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে বুঝতে পেরে আর ওকে ডাকেনা রণ।ওর হাসিমুখের ভালোলাগা মনে নিয়ে চলে যায় স্নান করতে।
কালকের স্মৃতি অনেকদিন পর ওকে অনেকটা প্রাণশক্তি দিয়েছে,অনেকদিন পর রাইয়ের সাথে কাটানো দিনটা ওকে এইটুকু অন্তত উপলব্ধি দিয়েছে এখনও রাই আছে ওর বন্ধু যায়।তৃতীয় মানুষটা এখনো ওদের বন্ধুত্বে বাধা হয়নি।পুরোনো রাই পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি ওর থেকে।এটাই ওর মধ্যে সেই প্রাণ চঞ্চল ছেলেটা কে আবার জাগাচ্ছে।স্বাভাবিক হচ্ছে রণ রাইয়ের উপস্থিতির স্পর্শে।

দশমীর সকালে ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙল রাইয়ের।সূর্যের আলোয় পুরো ঘর ভেসে গেলেও স্নিগ্ধ হাওয়ায় হালকা চাদর বেশ আরামদায়ক আগে।বরাবর ভোরে উঠে পরা রাই এখানে এসে একটু অলসতা করছে কদিন,তাই জয়ি আন্টি পাশে নেই দেখেও গায়ের চাদর জড়িয়ে পাশ ফিরল।হঠাৎ খেয়াল হলো ওতো চাদর নিয়ে শোয়েনি,তাহলে আন্টি উঠে যাওয়ার আগে দিয়ে গেছে বোধহয়!
আরো মিনিট পনেরো চুপ করে শুয়ে থাকলো,আর টুকরো টুকরো এলোমেলো ছবি ঘুরে বেড়াতে লাগলো মনের কোণে।
হঠাৎ মনে হল কি যেন নেই ওর জীবনে,বড্ড ফাঁকা লাগছে,বড্ড একা লাগছে,অনেকটা এখানে আসার আগের একমাসের মত।কাকে মন খুঁজছে ওর!কার না থাকা ওকে বেশি বিষন্ন করছে!আধো ঘুমের এলোমেলো চিন্তায় হঠাৎ ভেসে উঠলো সেই মুখটা,সেই একান্ত নিজের মানুষ,যে অভিমান করলে ওর মন অস্থির হয়ে,যে মুখ ঘুরিয়ে থাকলে আজকাল চোখে অন্ধকার দেখে ও,যে ওর হাত ছেড়ে দিলে জীবনে আর একপাও চলতে পারবে না…রণ,রণদা।
চোখ খুলে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে রাইমা।এত সহজ সত্যিটা আজ দশমীর দিনে কি মা দুর্গা ওকে জানিয়ে দিয়ে গেল?কাল রাতে নবমীর আরতি দেখতে দেখতে মা’কে তো এটাই জানতে চেয়েছিল ও।জানতে চেয়েছিল অনিকেতের মত হিরের টুকরো ছেলের সাথেও কেন ও মানাতে পারছে না?ডমিনেট করুক,অধিকার দেখাক বা অভিমান করুক সব কিছুর কারণই তো ভালোবাসা।
অনিকেত ভালোবাসে বলেই না জোর করে।কিন্তু রাই ওই জোড়টায় আনন্দ পায়না,উপভোগ করে না যেটা করে রণর ক্ষেত্রে।কেন?
আজ মা বোধহয় তার উত্তর দিলো।ওর এই দ্বিতীয় সত্ত্বার অস্তিত্বই তো রণর ওপর নির্ভর করে তৈরি।ওর এই দৃঢ়তা, এই স্বতঃস্ফূর্ততা,এই মিশুকে স্বভাব সবটাই তো রণর শেখানো, সবটা পরিপূর্ণ হয় একমাত্র ওর সাথেই।তাই ওর জায়গা কেউ নিতে পারছে না হয়তো।
কিন্তু অনিকেত?তাকে কি বলবে? আর রণ নিজেও তো বারবার বলেছে ওরা শুধুই বন্ধু।রণর সাথে এই সম্পর্কের অস্তিত্ব কি আদৌ আছে? কিছু ভেবে পায়না রাই?ফোনটা টেনে সময় দেখতে গিয়ে দেখে অনিকেতের দুটো মিসড কল।

অবাক হয় রাই।ষষ্ঠীর সন্ধ্যেটা মনে পড়ে।জোর দেখিয়ে যখন রাইয়ের যাওয়া ক্যানসেল করতে পারেনি অনিকেত,রাগ করে বলেছিল যেন বাইরে সবার সাথে থেকে ওকে ফোন বা মেসেজ না করে রাই।
“সম্পর্ক পাবলিক এই মুহূর্তে করার কোনো শখ নেই।তাই দয়া করে ফোন মেসেজ কোরোনা যখন তখন।আর আমিও সারাদিন বাড়ি থাকবো ফোন ধরতে বা রিপ্লাই করতেও পারবোনা।”
রাইয়ের আত্মসম্মানবোধ অনিকেতের ঠিক জানা ছিলোনা,তাই ভাবেনি মেয়েটা তিনদিন ওকে একটা মেসেজ অবধি করবে না।আজ আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে নিজেই ফোন করেছে সকালে উঠেই।ওর হিসেবে রাইমা ভোরে ওঠে।
দেখো একটা হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ ও এসেছে রণর নম্বর থেকে।অবাক হয় রাই।আজকাল তো রণর নম্বর থেকে মেসেজ আসেই না।
“হেমন্তের ঠান্ডা না লাগিয়ে চাদরটা নিয়ে শুবি।।এবছর থেকে দায়িত্বটা নিজেকেই নিতে হবে”। চোখটা চিকচিক করে ওঠে রাইয়ের।কি বোকা ও! কিকরে ভুলে গেল রণর এই ছোট ছোট যত্ন গুলো! রোজ রাতে মেসেজ করতো রণ ঘুমানোর আগে,চাদর নিয়ে শোয়ার কথা মনে করিয়ে।এমনকি হোস্টেলে গিয়েও ভুল হতোনা বছরের এই সময়টা।রাইয়ের ঠান্ডা লাগার ধাত ও ঠিক মনে রাখতো ওর মায়ের পরে।

রাই ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন চিন্তা করে অনিকেতের কল করা নিয়ে। সকালে ঘুম ভেঙেই কেন কে জানে অনিকেতকে ফোন করতে ঠিক ইচ্ছে করছে না।কল টাইমটা দেখে প্রায় ঘন্টা খানেক আগের।
নাহ আর দেরি করা ঠিক হবে না,মিসড কল লিস্ট খুলে কল বাটন টিপে দেয়।
দুবার রিং হতেই ওপারে ফোন ধরে অনিকেত।

-“হ্যালো রাই কেমন আছো? রাগ করেছ?” ফোন ধরেই নরম গলায় বলে অনিকেত।
-“না আমি তো রাগ করিনি।রাগ তুমি করেছিলে আর বলেছিলি এই কদিন ফোন মেসেজ না করতে।তাই করিনি।” চুপচাপ শান্ত মেয়েটা কে যত দেখছে অবাক হয়ে যাচ্ছে অনিকেত। কি দৃঢ় আর স্পষ্টবাদী মেয়েটা,বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় থাকেনা।
-“বাব্বা এত মানো আমার কথা?” মজা করলেও অবাক হয় মনে মনে অনিকেত গাঙ্গুলী,শান্ত ছাত্রীর আনুগত্য গার্লফ্রেন্ডের মধ্যে মোটেও খুঁজে পায়না ও।উল্টে প্রকাশ পায় চাপা আত্মসম্মানবোধ।
-“না শুধু তুমি বলে না। কেউ না চাইলে জোর করে আমার দ্বারা কিছু হয়না।আমি পারিনা।” রাই স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দেয় নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে অনিকেত বলে,”আচ্ছা ছাড়ো ওসব কথা।বলো কবে কলকাতা ফিরছো?মিস করছি তোমায়।দেখা করবো।”

“এই তো কাল ফিরবো।আজ পুজো শেষ,সবার ছুটিও শেষ”,রাইয়ের সংক্ষিপ্ত উত্তরে দেখা করার ব্যগ্রতা কিছুই ধরা পড়েনা।

শেষ দানটা চেলেই দেয় অনি,”হ্যাঁ মা’ও দেখা করতে চাইছে তোমার সাথে”।

-“মা!!”
-“হ্যাঁ বলেই দিলাম মা কে।সেদিন মুড অফ ছিল,খোঁচাচ্ছিলো। একদিন তো বলতেই হত।তাই আর লুকোলাম না।” সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড কে বেশিদিন অপেক্ষা করানো বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা বুঝেই দ্রুত পা ফেলে অনিকেত।
উত্তর দেয়না রাই, চুপ করে থাকে।মাথায় ঘুরতে থাকে ঘুমের ঘোর ভাঙার আগের মুহূর্তের ছেঁড়া স্বপ্নটা।মনের মধ্যে বারবার ভেসে ওঠে ওই চোখ,ওই হাসি।
“ঠিক আছে।ফিরে ফোন করবো।এখন রাখি?শুভ বিজয়া”,এত তাড়াতাড়ি রাইমা ফোন রাখবে চিন্তার বাইরে ছিল অনিকেতের। কিছুটা অপমান,কিছুটা অভিমান আর কিছুটা রাগের বসেই কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দেয় ও।

হঠাৎ ফোন কাটার শব্দে চমকে গেলেও অনিকেতের ব্যবহারের সাথে ছমাসের পরিচয়ে ও বুঝতে পারে কারণটা।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও ফোনটা নামিয়ে বালিশের পাশে রাখে।আর মিনিট খানেক ওভাবে বসে তারপর খাট থেকে নেমে বাথরুমে চলে যায়।

“কিরে রাই আয় মা কে প্রণাম করে যা”, জয়ি হাঁক দেয় দূরে দাঁড়ানো রাইমা কে উদ্দেশ করে।
পায়ে পায়ে ঠাকুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।জীবনে প্রথম বার ঠাকুর বরণ দেখছে ও,হ্যাঁ সত্যি প্রথমবার।মা বেঁচে থাকতে দূর থেকে ঠাকুর দেখে আসতো প্যান্ডেলে গিয়ে,কিন্তু কোয়ার্টারের পুজোয় ওরা সবসময় অতিথি থেকেছে।
“বিদায়কালে মা’র কাছে মনের ইচ্ছে মত যা প্রার্থনা করার কর রাই।মা ঠিক দেয়”,জয়িকে হঠাৎ কেমন শুধুই মা লাগে।জয়ি আন্টির মধ্যে এত বিশ্বাস আছে জানতো না রাইমা এতদিন।এমনকি শিবরাত্রির উপোস করতেও দেখেনি রাই, তাই জানতো না এই জয়িতাকে ও।

চোখ বুজে হাত জোড় করে অনেক কিছু বলতে চায় রাই, কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনা।ওর বলতে চাওয়া কথাগুলোর কোনো অর্থ ও নিজেই খুঁজে পায়না।
কি চায় ও?কেন ওর সরল স্বাভাবিক মন আজকাল এত কিছু জটিল চিন্তা করছে?ওর মাথা আজকাল মনের সাথে কিছুতেই এক হয়না।একটা দমচাপা কষ্ট ওর মনে সারাক্ষন ঘুরে বেড়ায়।
অনিকেত তো আসলে খুব ভালো একটা ছেলে,যাকে নিয়ে ওর বাবা বা কারোর কোনো সমস্যা হবে না ও জানে।আর ও বয়সে ছোট বলেই অনিকেত একটু শাসন করতে চায় ও বুঝতে পারে।ওকে ভালোবাসে বলেই খেয়াল রাখার চেষ্টা করে।
তবুও কিছুতেই সম্পর্ক শুরুর দিকের উচ্ছ্বাস আর অনুভব করেন রাই নিজে।কেমন একটা উদাসীনতা ওকে ঘিরে ধরে অনিকেতকে নিয়ে।মনেহয় অনিকেত কাছে আসছে,আর একটা দামি জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে ওর জীবন থেকে।আবার যেন নতুন করে মায়ের অভাব ভোগ করছে ও শেষ কমাস।মাকে হারানোর সেই কষ্টটা আবার ফিরে আসছে।
প্রণাম করে আবার দূরে সরে এসে দাঁড়ায় ও।একমনে দেখতে থাকে বিদায় বেলায় মায়ের মুখটা।কেমন যেন নিষ্প্রভ লাগে,চোখের সেই উজ্জ্বলতার জায়গায় বিষণ্ণতা নজরে আসে ওর।সত্যি তাহলে উমাও বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে আজও কষ্ট পায়?
রাইয়ের চোখ হঠাৎ কাউকে খুঁজতে থাকে।এতদিন এই শূন্যতা যে পূরণ করে এসেছে আজ তার জন্যে মন হুহু করে ওঠে।মায়ের অভাব বন্ধু হয়ে পূরণ করা রণ ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই অনুভূতি ওকে দিশেহারা করে দেয়।সেই অসহায়তা,সেই ভয়,সেই একাকীত্ব ওকে চেপে ধরতে থাকে।
হঠাৎ পিছন থেকে দুটো হাত এসে ওর দুটো গাল ছোঁয়।চমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে সেই ছেলেটা যার চিন্তায় ও পাগল হচ্ছিল হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে,ওর অন্যমনস্কতায় ওর গালে সিঁদুর মাখিয়ে হাসছে।
“দেখ সিঁদুর খেলবিনা দশমীতে তাই হয় বল?আবার কবে সুযোগ পাবি মায়ের এত কাছাকাছি আসার এই দিনে,তাই রাঙিয়ে দিলাম তোর পারমিশন ছাড়াই।” রণর কথা না,ওর চোখ গুলো একদৃষ্টে দেখতে থাকে রাই।
কি অদ্ভুত প্রশান্তি ওখানে,শেষ দুদিন আবার ফিরে এসেছে এই শান্তিটা ওর চোখে।তার আগে যে কবার দেখা হয়েছে রাই এক অদ্ভুত অস্থিরতা দেখেছে ওর চোখ দুটোতে।সেই শান্তি যা ওকে আশ্রয় দিয়েছে এত বছর,কোনোভাবেই নজরে আসেনি ওর।
অবাক লাগে।কিছু বলতে পারেনা ও,শুধু স্মিত হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে।
“থ্যাংক য়্যূ রণদা।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় রণ রাইয়ের দিকে।তারপর ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করতে চায় কারণটা।
রাই হাসি দিয়ে এড়িয়ে যায় উত্তরটা,কিন্তু ওর মন বলে,’থ্যাংক য়্যূ রণদা এখানে আসার জন্য।থ্যাংক য়্যূ আমার মনটা আমায় চিনতে সাহায্য করার জন্যে।অনিকেত আসার পরও তুমি আগের মত থাকলে আমি বুঝতেও পারতাম না কোনটা আসল ভালোবাসা,বুঝতে পারতাম না তুমি কি আমার জীবনে।তোমার দূরে চলে যাওয়া আমায় বুঝিয়েছে শূন্যতা কি?সবাই থাকার পরও কেন নিজেকে সর্বস্বহীন লাগে,মনেহয় ভিখারী হয়ে গেছি।তোমায় সব না বললে যেন অসম্পূর্ণ থাকে ঘটনা গুলো।তোমার গলা না শুনলে কান্না পায়।সবচেয়ে বড় আজও জীবনে ক্রাইসিস হলে শুধুই তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে করে,মনেহয় মায়ের মত তুমিও সব সমস্যা ঠিক মিটিয়ে দেবে।আমার জীবনে মা কে তুমি প্রায় রিপ্লেস করেছ,কিন্তু আমি জানি তোমায় রিপ্লেস কেউ করতে পারবে না।আমি করতে দিতে পারব না’।

সিঁদুর মাখা রাইয়ের মুখটা নতুন করে ছেপে যায় রণর মনে।হয়তো ওর সিঁদুর পড়া মুখটা রণর হবে না।কিন্তু এই মুখটা শুধুই ওর,এটা করতে অনিকেত ও পারবে না।ইচ্ছে করেই আজ রাইকে জীবনে প্রথম সিঁদুর রণ ছোঁয়ায়।ভুল করে না,অনেক চিন্তা করে এই কদিনের আনন্দ,ভালো লাগা সম্পূর্ণ করে রণ রাইকে সিঁদুর মাখিয়ে।
দুজন সদ্য যৌবনে প্রবেশ করা ছেলে মেয়ে নিজেদের অনুভূতি সাজিয়ে চোখে ভালোবাসার রঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকে একে অপরের মুখোমুখি।দূরে মা দুর্গার কপালে সিঁদুর ঠেকায় কোনো এয়ো।জলে যাওয়ার আগে ঠাকুর কি শুনতে পায় মানুষের তুচ্ছ চাওয়া পাওয়া গুলো?!!

ক্রমশ…