মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-২৫

0
397

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#পঞ্চবিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“রণ তোকে আরেকটু চিকেন দি?” ডিনার টেবিলে জয়িতা ছেলেকে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে ওর প্রিয় চিকেনের বাটিটা ধরে ওর দিকে বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো।
মুখে কিছু না বলে হাত তুলে ইশারায় বারণ করলো রণ।
জয়ন্ত কেও ঋষি জোর করে নিজেদের বাড়ি টেনে এনেছিল হসপিটাল থেকে।কিন্তু জয় বলেছে ডিনার করে ও ফ্ল্যাটে ফিরে যাবে।আজ রাইকে হসপিটালে ভর্তি করে সারাদিন রণ আর জয় ওখানেই ছিল।জয়ি আগামীকাল যাবে,আজ ওর একটা ইম্পরট্যান্ট ডেলিভারি কেস ছিল বলে যেতে পারেনি।
জয়ন্তর মনের কষ্ট ওর মুখে প্রকাশ পেলেও রণর মুখ ফিরে থেকে থমথমে ছিল।জয়ন্ত ফিরবে বলে ডিনারের দেরি না করে সবাই খেতে বসে গেছিলো হসপিটাল থেকে ফিরেই।
“রণ… তোর সাথে আমার কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা ছিল রে।কাল রাতেই ভেবেছিলাম বলবো, কিন্তু… তুই অনেক রাতে ফিরেছিলি বলে…জয় তুই থাকলেও ভালো হয়…”,ঋষির সংকোচ ওর কথায় ধরা পরে।

“আমারও কিছু কথা আছে তোমাদের তিনজনের সাথেই।আমি আসলে…কিছু চিন্তা করে উঠতে পারছিনা।আসলে…”,এত ঘেঁটে থাকতে রণকে আগে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে পারেনা জয়ি।তাও ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হয়,”ঠিক আছে,আগে সবাই খেয়ে নাও।তারপর…”,কথা শেষ করতে পারেনা জয়িতা।
“আমার খাওয়া হয়ে গেছে মম,তোমরা খেয়ে নাও।আমি ড্রইং স্পেসে ওয়েট করছি।খাবারের থালা পুরোটাই প্রায় ভর্তি রেখে উঠতে যায় রণ নিজের চেয়ার ছেড়ে।কিন্তু মায়ের ডাকে থামতে হয়,”রণ নিজে সুস্থ থাকলে তবেই না রাইয়ের কথা ভাবতে পারবি?এই বিপদের দিনে প্লিজ তুই আর নিজের শরীরের বারোটা বাজাসনা।সারাদিন কিছুই খাসনি তোর বাবা বললো,রাতেও খাবার নেড়েচেড়ে উঠে পড়ছিস…”,আবার বাধা পায় জয়ি।

“মম প্লিজ আমায় জোর কোরোনা।আমার মাথায় চিন্তাগুলো পিঁপড়ের মতো কামড়াচ্ছে।খাবার দেখলেই গা গুলোচ্ছে আমার।আমি আজ সত্যি পারবো না।মনে হচ্ছে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুধু ঘুমোই।কিন্তু আমার এমন অবস্থা ওষুধ খেলেও ঘুম আসবে না জানি।” রণর কথা গুলো ওদের তিনজনের বুকেই অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়।
হয়তো এই ক্লান্তি ওদের সবার কিন্তু সেটা স্বীকার করার সময় এটা না।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পরে ঋষিও খাবার অসমাপ্ত রেখে,সাথে জয়ন্তও।
জয়ি কিছু বলতে চেয়েও মুখ খুলতে পারেনা।ওর যে কোথায় কষ্ট হচ্ছে ওই জানে।সেই প্রথম দিনের রাইয়ের কান্না ভেজা মুখটা খালি ভেসে উঠছে মনের মধ্যে।আজ অপারেশন থিয়েটারে কত কষ্টে ও মনকে আয়ত্তে রেখে ডেলিভারি করিয়েছে ওর সঙ্গের সার্জেন বুঝেছিলেন।অবাক ডক্টর ঘোষকে বলতে চেয়েও জয়িতা বলতে পারেনি কিছুই।জন্ম না দিলেও মা হওয়া যায়,রাই ওর জীবনে না এলে জয়িতার জানা হত না এই সত্যিটা।আজ অপারেশন থিয়েটারে রাইয়ের জন্মের ক্ষণটাও মনের মধ্যে হানা দিচ্ছিলো বারবার।
যাহোক করে অল্প সামান্য ভাত পেটে চালান করে জয়িও উঠে পড়ে চেয়ার ছেড়ে,আর সেই মুহূর্তে নজর পরে রমার ওপর।শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে থাকা রমাকে দেখে অবাক হলেও বুঝতে পারে ওদের কথা শুনেই প্রায় সবটা বুঝে গেছে ওর সংসারকে আগলে রাখা রমা।কথা বলতে তাও ইচ্ছা করেনা,মাথা নিচু করে এঁটোহাত ধুতে বেসিনের দিকে এগিয়ে যায় জয়ি।

“রণ তুই আবার এগুলো কেন বলছিস?” জয়ন্তর অধৈর্য্য গলাটা কানে আসে জয়িতার ড্রইং রুমে ঢোকার মুখে,কৌতূহল বাড়ে।
“অধিকার পেতে আঙ্কেল।কাল রাতে যখন রাইকে ফ্ল্যাটে ছেড়ে চলে আসতে হলো মনে হচ্ছিল আমি ওর হাজব্যান্ড হলে আজ চলে আসার কথা কোনোভাবেই ভাবতে হতো না।যতক্ষণ না বিয়ে হচ্ছে আজও মধ্যবিত্ত সমাজ একটা ছেলেকে তার ফিয়ন্সের ঘরে রাত কাটাবার অধিকার দেয় না।আমি কাল থাকতে চেয়েছিলাম রাইয়ের কাছে,ওর জন্যেই তো ছুটে এসেছি আমি।কিন্তু মম আমায় বোঝালো এই মুহূর্তে তা সম্ভব না,এমনকি রাইয়ের চোখের ইচ্ছা পড়ার পরও ওর বদনামের ভয়…”,রণর কথা থেমে যায়।

“কখন এসব আলোচনা হলো কাল?তোর মা ভুল বলেছে আমি বলছি না।কিন্তু রাইয়ের এই অবস্থায় আমার মনেহয় না এখন সমাজকে নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার আছে।আমি বলছি তুই যখন ইচ্ছে হবে রাইয়ের সাথে থাকতে পারিস”,ঋষি দৃঢ় ভাবে বলে আড়চোখে দরজায় দাঁড়ানো জয়ির দিকে তাকায়।

“হ্যাঁ আমি কাল বলেছিলাম রণ কে।বলেছিলাম কারণ আজও মডার্ন সোসাইটি চিন্তাভাবনায় সেই মান্ধাতার আমলেই পরে।রাইয়ের মনের ওপর এমনি এত চাপ যাচ্ছে,আমি সেই চাপ বাড়াতে চাইনি।আমি জানি ফ্ল্যাটের মধ্যে কে কার ঘরে থাকলো বাইরের লোকে জানবে না।কিন্তু ওই সামনের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা সোসাইটির ইনচার্জ কে অলরেডি একটা কমপ্লেইন করে রেখেছেন,তাই…”,এবার জয়ন্ত উত্তেজিত হয় জয়ির কথা শুনতে শুনতে।

“কে কমপ্লেইন করেছে?কি বলেছে কি?” জয়ন্ত অবাকও হয়।
“আমার নামে এখন ফ্ল্যাট বলে আমায় জানিয়েছিল সেক্রেটারি।রণ রাইয়ের সাথে দেখা করতে যেত তাই উনি সোসাইটির কালচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।আমি নিজে গিয়ে জবাব দিয়ে এসেছিলাম।কিন্তু কাল ওই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিলো মেয়েটার মনে এসব ফালতু বিষয় নিয়ে আর চাপ তৈরি করা ঠিক না।আর রণ তো এমনিও দূরে থাকে,ও চলে যাবে।কিন্তু রাই তো আপাতত ওখানেই থাকবে।এদের সুস্থ,অসুস্থতা নিয়ে কিছু আসে বলে আমার মনে হয় না।…”,জয়িকে থামায় এবার ঋষি।

“জয়ি এখন রাইয়ের খুশি থাকা সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট।আর ওটা যেহেতু আমাদের কেনা ফ্ল্যাট আর রণর পুরো অধিকার আছে রাইয়ের কাছে যখন খুশি যাওয়ার তুই আর ইন ফিউচার কোনো আপত্তি করবি না প্লিজ।আর রণ,আমাদের মনেও তোর আর রাইয়ের বিয়ে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা আছে তাই তুই এভাবে আর কখনো বিয়ের কথা বলিস না প্লিজ।রাই সুস্থ হলে ধুমধাম করে আমি তোদের বিয়ে দিতে চাই।আমার ছেলের বউ আনবো পুরো সোসাইটি জানিয়ে,আর এটাই আমার ইচ্ছা।” ঋষিকে এতটা সিরিয়াস আগে বোধহয় কখনো দেখেনি জয়ি,এত মনখারাপের মধ্যেও একটা ভালো লাগা ছুঁয়ে যায়।

-“কিন্তু বাবা রাই আমাদের সেই সুযোগ দেবে তো?”
-“রণ…।”
-“রণ…।”
রণর কথায় প্রায় চিৎকার করে ওঠে ঋষি-জয় দুজনেই।জয়ি কিছু না বলে রণকে জড়িয়ে ধরে।
মায়ের বুকের মাথা রেখে কান্না জড়ানো গলায় স্বরে রণ বলে,”মাস দুই ধরে রাইয়ের একটা হালকা কাশি হচ্ছিল…আমি বলেওছিলাম,’ঠান্ডা লেগেছে হয়েতো ডাক্তারের কাছে চল’,গুরুত্ব দেয়নি আমার কথার।তখন জোর করে নিয়ে গেলে…আমাকেও ওকে ছেড়ে,এই শহর ছেড়ে গিয়ে এভাবে তড়পাতে হতনা প্রতি মুহূর্তে।” ওর কথাগুলো রাইয়ের আড়ালে আজকাল হাহাকার হয়ে ওঠে প্রায়ই।

জয়ন্ত এবার মুখ তুলে তাকায় রণর দিকে।অনেক্ষন থেকে মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা কথাগুলো আজ সবাইকে বলতেই হবে ওকে,তাই এবার ও মুখ খোলে।
“রণ যে সময় আমার মেয়ের আমায় দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি,নিজের দুঃখের দোহাই দিয়ে আমি পালিয়েছিলাম জয়ির ভরসায় ওকে ফেলে।কিন্তু পরে জেনেছিলাম ওকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছিলি তুই।আজ আমি জানি রাইয়ের তোকে বেশি দরকার কিন্তু প্লিজ আমার ওপর ভরসা রাখ।আমি চাই রেশমার সাথে যে ভুল করেছি,রাইয়ের সময় তার রিপিটেশন না করতে।তাই…ঠিক করেছি,আমি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নেব আগেই,শুধু রাইয়ের জন্যে।এখন ওর কাছে কোনো নিজের লোকের সবসময় থাকা দরকার,তাই…”,জয়ন্ত নিজের আবেগ সামলাতে পারেনা আর।

“কিন্তু জয়,তোর তো এখনো প্রায় বছর দশেক চাকরি ছিল।এতদিন সরকারি চাকরি করে…”,ঋষিকে থামিয়ে দেয় জয়ন্ত।
“কিসের চাকরি রে?কার জন্য এই অমূল্য সময় গুলো নষ্ট করছি?আগে আমার মেয়েটা কে বাঁচাই…টাকা পয়সার অভাব হবে না।আমার মা রেশমা মারা যাওয়ার খবর শুনে সেই শোক সামলাতে না পেরে নাকি মারা যান,আর তার আগে আমার প্রাপ্য সম্পত্তি আমায় লিখে দিয়ে যান।ভেবেছিলাম সেটা কোনোদিনও ছোঁবনা।কিন্তু এখন ওই সব ফালতু সেন্টিমেন্ট কে মূল্য দেওয়ার সময় আমার নেই।যে বউয়ের মুখ কখনো দেখলো না,তার মৃত্যুর শোক…হাহ! সেদিন মনে হয়েছিল ওই সম্পত্তি না দিয়ে নিজে এসে দাঁড়ালে…তোরা না থাকলে আমার রাই আজ ভেসে যেত…”,রণর কান্না ছড়িয়ে যায় জয়ন্তর মধ্যেও।ঋষি এবার উঠে এসে জয়ন্তর পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রাখে।
“বিশ্বাস কর জয় আমি টাকা পয়সার কথা ভেবে তোকে বলিনি।যদি বলতাম তোকে জিজ্ঞেস করে,আলোচনা করে রাইকে আমার হসপিটালে এডমিট করতাম।কিন্তু…তোরা সবাই কান্নাকাটি করছিস।একবার ভেবে দেখতো কি ট্রিমেন্ডাস চাপে আমি আছি!রাইকে আমি যে কতটা ভালোবাসি আমি জানি।যেদিন রাই তোর কাছে চলে গেল বাড়ি এসে বড্ড ফাঁকা লাগছিলো আমার।সেদিন মনে হয়েছিল যতই মেয়ে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি চলে যাক না কেন সব বাবার একটা মেয়ে দরকার।ছেলে তো খোলা পাখি আজকের দিনে,আর বয়স বাড়লে বাবার থেকে ছেলে দূরেই যায়।কিন্তু মেয়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে বন্ধু হয়।বড্ড মিস করি আমি রাইকে।তাই সেদিনই ভেবেছিলাম রাইকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরিয়ে আনবো রণর বউ করে।অনেক আগে থেকে জানতাম রণর মনের কথা।সেই আমি…সেই আমি অপারেশন থিয়েটারে নিজের হাতে নিজের মেয়ের সার্জারি…”,এই প্রথম ঋষিকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখে সবাই।সব ডাক্তারের মাঝে জীবনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু দেখা অঙ্কলজিস্ট ডাক্তার ঋষি মুখার্জীর মনটা যে কতটা নরম বুঝে যায় রণ-জয়।জয়ি তো জানতোই প্রতিটা মৃত্যু ঋষিকে প্রতিবার কতটা কষ্ট দিত,কিন্তু রাই যে ওর মনে এভাবে স্নেহের এতখানি জায়গা দখল করে আছে সেটা ও নিজেও বোঝেনি।
জয়ির আশ্রয় ছেড়ে উঠে এসে রণ হাত রাখে বাবার কাঁধে।রণর দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করে নেয় ওর বাবা,ওকে যে ভাঙলে হবে না।ডাক্তার ভেঙে পড়লে রোগী আর তার পরিবার কিকরে লড়াই করবে।চশমা খুলে তাড়াতাড়ি টি শার্টের হাতায় চোখের জল মুছে নেয় ঋষি।রাই সুষ্ঠুভাবে আবার জীবন কাটাবে, আর সেই দায়িত্বটাই মনে মনে আউরে নেয় ও।

অপারেশন থিয়েটারের সবুজ আলোটা জ্বলার সাথে সাথে রণর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো,বারবার ভেসে উঠতে লাগলো ওই ঘরটায় ঢোকার আগে রাইয়ের অসহায় সব হারানো মুখটা।কাল অবধি রাইকে বুঝিয়ে গেছে রণ কিন্তু তবুও কোথাও যেন রণর প্রতি একটা অভিমানই তীব্র হয়েছে বারবার।
এবারের ছুটিটা পেতে রণর সমস্যাই হচ্ছিল।এবারে দিন সাতেকের জন্যে ছুটি নিতে চেয়েছিল ও।এই তিনমাসে ওর ভালো স্টুডেন্ট আর ভালো ডাক্তার হিসেবে যে পরিচিতি হয়েছে তার জন্যে এক সপ্তাহের ছুটিটা মঞ্জুর হলেও ওর নিজের অনেকটাই ক্ষতি হচ্ছে বুঝতে পারছে ও।
মাঝের সময়টা প্রতি সপ্তাহে নাহলেও এই তিনমাসে সবমিলিয়ে বার চারেক কলকাতায় ছুটে এসেছে সপ্তাহান্তের ছুটিতে।কিন্তু এবার এসেই ফিরে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।রাইকে এই অবস্থায় হসপিটালে ছেড়ে যাওয়ার মনের জোর অন্তত ওর নেই।
মম আর জয়ন্ত আঙ্কেল বাবার চেম্বারে গিয়ে বসেছে,রণকে অনেকবার বলেছিল কিন্তু কিছুতেই ও এই জায়গাটা ছেড়ে নড়তে পারেনি।
অপারেশন থিয়েটারের সামনে রাখা চেয়ারে বসে মাথাটা হেলিয়ে দেয় রণ।গত তিনমাসের শারীরিক মানসিক ধকল নিতে নিতে আজকাল নিজেরই বড় ক্লান্ত লাগে ওর।
মনের মধ্যে চলতে থাকা ছবিগুলো ওকে আরো দুর্বল করে দেয় যেন।
প্রথমবার দিন তিনেক হসপিটালে থেকে রাই ফ্ল্যাটে ফেরার পর ওই ফোন কলটা রণকে পাগল করে দিয়েছিল।রাই ফেরার আগেই ওকে দিল্লি ফিরে যেতে হয়েছিল।হসপিটাল থেকে ফিরে সন্ধ্যেবেলা সেদিন ভয়েস কল করেছিল রণজয় রাইকে,কোনো আন্দাজ ছিলোনা রাইয়ের মনের খবরের সেই মুহূর্তে।কিন্তু কথা এগোনোর সাথে সাথে পনেরোশো কিলোমিটার দূরে বসে নিজের অসহায়তা বুঝতে পারছিল ও।সামনে থেকে বোঝানো যতটা সহজ,ফোনের মাধ্যমে সেটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।রাই কথাটা শুরুও করেছিল সরাসরি,কোনো ভনিতা না করে,তাই দৃঢ়তা ছিল বেশি।

“রণদা ডান ব্রেস্টে আর আরমপিটে আমার ছোট দুটো লাম্পস, তাহলে কেন ডাবল ম্যাসটেক্টমি করা হবে?কেন?” ভীষণ উত্তেজিত ছিল সেদিন রণর রাই।
“তুই জানিস না?তোকে বলিনি আমি কারণটা?” রণ অসহায়ের মত বলেছিল।
“কিন্তু শুধুমাত্র হাই রিস্কের জন্যে আমায় অসম্পূর্ণ…”,শেষ করতে পারেনা রাই কথাটা।
“কি ভুলভাল বলছিস রাই?কিসের অসম্পূর্ণতা?আজকাল এই রোগটা এতটাই কমন হয়ে গেছে যে ‘উইথ আউট ব্রেস্ট’ অনেক লেডি স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছে।আগে প্রাণ না আগে ফিসিকাল বিউটি?এত বোঝানোর পরও আবার কেন এসব কথা উঠছে?” রণ বুঝতে পারেনা কারণটা।

“রণদা তুমি আমার কথাটা ভাবছো না।কি লাভ এভাবে বেঁচে?” রাইয়ের গলা ধরে আসে।

“রা-ই”,দাঁতে দাঁত চিপে নিজের রাগটা সামলে রণ বলে,”…তুই আগে বলতো ‘উইথ আউট ব্রেস্ট’ কি এসে যাবে?আর তাছাড়া ভবিষ্যতে চাইলে ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট তো করানো যায়,এই মুহূর্তে ওই রিস্ক আমি নিতে চাইনা।আগে তোর সুস্থতা,তারপর…”,রণ থামতে বাধ্য হয় রাইয়ের কথায়।

“শুধু শারীরিক সুস্থতাই সব তাই না বলো?একটা মেয়ের কাছে এটা কত বড় হারানো…তুমি সব কিছু বাদ দাও…শারীরিক সৌন্দর্য, আমাদের সম্পর্ক,কিন্তু তারপরও ভাবো আমাদের বেবিকে আমি কোনোদিনও ফিড করাতে পারবো না।ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করেও না।একজন মা…”,রাইয়ের মধ্যে একজন ভালো মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ওকে ওর রোগের ভয়াবহতাও ভুলিয়ে দেয়।

“নিজে বাঁচলে তবে না বেবিকে আনবি?নিজেই যদি না থাকিস…”,রণ আর নিজেকে সামলাতে পারেনা।রাই অসুস্থ ভুলে যায় কয়েক মুহুর্ত।রাইয়ের এরকম কথায় অভিমানে ওর মাথায় চেপে রাখা রাগ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে,”আমি শুধু ভাবছি তুই কতটা স্বার্থপর।যে তোকে ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচার কথা ভাবতে পারেনা তার জন্যে বেঁচে থাকাটা তোর কাছে ইম্পরট্যান্ট না।তুই অনাগত বেবির কথা ভাবছিস?আমি আদৌ তোর জীবনে কোন ইম্পরটেন্স রাখি?যা তোকে সার্জারি করাতেই হবে না।যা মন চায়…”,রণর কথা রাইকে আরো উত্তেজিত করে।
“তুমি শিওর যে ব্রেস্ট বাদ দিয়ে দিলেই আমার ভবিষ্যৎ সেফ হয়ে যাবে!আর কোনো রিস্ক থাকবে না?” রাই কিছু শোনা কথায় নিজের আবেগ মিশিয়ে বলে।

“না শিওর না।কিন্তু জেনে বুঝে রিস্ক নেওয়ার কোনো কারণ দেখিনা।আর হ্যাঁ রিস্ক আরো কমাতে ওভারিও বাদ দিলে বেস্ট হয়,যা আমাদের দেশে আনম্যারেড মেয়েরা নিজেরা বা ডক্টরও ভাবতে পারেননা।আমিও সেই রিস্কটা শুধু নিচ্ছি তোর এই বাচ্ছা নিয়ে যে ড্রিম আছে সেটার জন্যে।সেটা যেদিন পূরণ হয়ে যাবে এই রিস্কের চান্স টাও সরিয়ে দেব আমি,তোকে জিজ্ঞেসও করবো না।কারণ ততদিনে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমি পেয়ে যাবো।কিন্তু তার আগে রেগুলার চেক আপে কখনো যদি মনেহয় অতদিন সময় নেই আমাদের হাতে তাহলে…।তুই কেন বুঝছিস না,ফিউচারে অন্য অর্গানে এই মারণ রোগ গ্রোও করতে পারে ভেবে যেটা রিস্ক সেটা বয়ে বেড়াবো?বিয়ে,সংসার,বাচ্ছা সবটাই তো বেঁচে থাকলে তবে হবে।হ্যাঁ ব্রেস্ট বাদ দিলে রিস্ক কমবে,জিরো হবে না।সেটা তো রাস্তায় বের হলেই একসিডেন্ট হতে পারে,তাই বলে কি প্রটেকশন নেব না?অদ্ভুত যুক্তি।তুই একজন শিক্ষিত মেয়ে,তুইও কেন বুঝছিস না এই সহজ সত্যিটা?তোর সঙ্গে যেখানে আমরা সবাই আছি।কত মেয়ে বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারছেনা শুধু ফ্যামিলি সাপোর্টের অভাবে।কি রে শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?” রণ একা একা কথা বলতে বলতে খেয়াল করে রাইয়ের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই।
“বল শুনছি।আমি কিছু বললে তুমি কি বুঝবে?” রাইয়ের গলার স্বর কষ্ট দেয় রণকে।এতটা অবুঝ ওর রাই ওর কোনো ধারণা ছিল না।
“রাই তোর মনে আছে দশ বছর আগের কথা? আন্টি চলে যাওয়ার পর তোর কি অবস্থা হয়েছিল?আমি জানিনা এই মুহূর্তে তোকে এগুলো বলা ঠিক কিনা?কিন্তু আর কিছু মাথায় আসছে না আমার।তোর ব্রেস্ট সার্জারি হবে এটা ফাইনাল।তার পরও তোর ওভারি যদি এফেক্টেড হয়,তোর বেবি হওয়ার পরও আর অপেক্ষা করার জন্যে যদি তোর নিজের প্রানটা না বাঁচে ওই ছোট বাচ্ছাটার কি হবে বলতে পারবি?তুই তখন ফরটিন ছিলি,তাও কত কাঁদতিস,হেলপ্লেস ফিল করতিস।তাহলে সেই দুধের শিশুটা!!তোর শখ পূরণ করতে পৃথিবীতে এসে তোর চেয়েও খারাপ জীবন পাবে সে।আর আমার কথা তো ছেড়েই দে।আমার কথা তুই কবেই বা ভেবেছিস বল।আমিই শুধু পাগলের মত একা একা ভালোবেসে গেছি।কি বলতো রাই, আজ আমি তোর জায়গায় থাকলে শুধু তোর কথাই ভাবতাম।যেকোনো শর্তে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতাম,অন্তত তোর জন্যে।আসলে ভালোবাসি বলা সহজ,কিন্তু ভালোবাসাটা বাঁচিয়ে রাখা…আচ্ছা যদি আমরা দুজনেই থাকি কি ক্ষতি তাতে?খুব খারাপ থাকবো?” রণর গলা আর নিজের বশে থাকেনা।

“রণদা তোমার জন্যে,শুধু তোমার জন্যে ভাবি বলেই একটা বাচ্চার কথা ভাবি।যদি এত কিছু করেও খুব বেশিদিন ধরে রাখতে না পারো আমাকে,তখন কি নিয়ে বাঁচবে তুমি?আমার একটা চিহ্ন থাকলেও…”,রাইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে রণ।
“তুই পাগল রাই।নাহলে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকেও শিক্ষা নিতে পারলি না?আঙ্কেলের কি অবস্থা হয়েছিল সেটা ভুলে গেলি?” একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রণ বলে,”আমি জানিনা আমার কি হবে?জানতেও চাইনা,আর তাই এত কিছু চেষ্টা করছি।পাগলের মত সারাদিন দেশে বিদেশে পরিচিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছি ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করে।তুই একটা কথা ক্লিয়ারলি শুনে রাখ,আমি আমার জীবনের শেষ টাকা দিয়েও,শেষ ক্ষমতা দিয়েও তোর চিকিৎসা করাবো।আমি বসে নেই,শীর্ষা আছে বাইরে,আমি এত সহজে হেরে যাবোনা।তোর এমন কিছু হয়নি যাতে তুই আমায় ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করতে পারিস,শুধু তুই ফিসিক্যালি আর মেন্টালি কো অপারেট করলে ব্যাপারটা সহজ হবে…”।

“রণ কিরে ঘুমিয়ে পড়লি?”হঠাৎ একটা হালকা ধাক্কা আর চেনা গলার আওয়াজে চোখ খুলে তাকায় রণ।মম দাঁড়িয়ে ওর সামনে।
“না ঘুমোইনি।আসলে চিন্তা করতে করতে তন্দ্রা মত এসে গেছিল।কতক্ষন হলো বলতো?”রণ খুব আস্তে করে উত্তর দেয়।
“ঘন্টাখানেক হলো সবে।চল একটু কফি খেয়ে আসি ক্যাফেটেরিয়া থেকে।জয়ন্তও কিছু খায়নি সকাল থেকে,আর তুই তো রাত থেকেই…চল কিছু খেয়ে নে।মেইন অপারেশন শেষ হওয়ার পর আরো কয়েক ঘন্টা অবসার্ভেশনে রাখবে।তোর বাবা আছে চিন্তার কিছু নেই।”জয়ি ছেলের মন অন্য দিকে করার চেষ্টা করে।

কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ে রণ।একটু কফি সত্যি দরকার।রাই কে সেদিন ও কনভিন্স করলেও হ্যাপি করতে পারেনি।আসলে কোন মেয়ের পক্ষেই মানসিক ভাবে এটা মানা হয়তো সম্ভব না।এটা তাদের আত্মবিশ্বাসের প্রতিরূপ।কিন্তু প্রেমের মূল্যের ওপরে কি কিছু হয়।আর এই মুহূর্তে রাইয়ের ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট নাহলেও পরবর্তীকালে ওর কনফিডেন্সের জন্যে রণ সেটাও নাহয় করিয়ে নেবে,কিন্তু কি লাভ তাতে!অহেতুক জটিলতা বাড়ানো।কেন যে রাই খুশি মনে সবটা মানতে পারলো না সবার এত সাপোর্ট সত্যিই!যাইহোক রণ পরে ঠিক মানিয়ে নেবে,ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে রাইয়ের সমস্ত অভাব।
রাইয়ের স্বপ্ন হঠাৎ কেমন যেন বদলে গেছে।যেদিন থেকে রোগ ধরা পড়েছে খালি ভবিষ্যতের কথা।কিছুতেই সেই মেয়েটা কে রণ খুঁজে পায়না যে ওর জন্যে হাসতো,ওর জন্যে বাঁচতো।রণ নিজেও বাচ্ছা ভালোবাসে,কিন্তু তাই বলে রাইয়ের থেকে বেশি না।একটা বাচ্ছা একটা সংসার সম্পূর্ণ করে,কিন্তু সংসারের কর্ত্রী না থাকলে শেষ হয়ে যায় পুরো পরিবারটা।একটা মেয়ে একটা পরিবারের প্রাণ এটা কবে যে এই পোড়া সমাজ বুঝবে?
চিন্তা গুলো সঙ্গে নিয়েই নিজের মা কে অনুসরণ করে রণ।

নিজের চেম্বারে এসে প্রথমেই জলের গ্লাসটা ফাঁকা করে ফেলে ঋষি।অপারেশন সাকসেসফুল।এখন কয়েক ঘন্টা অবসার্ভেশনে রাখতে হবে রাইকে।রণ আর জয়ন্তর সাথে এবার দরকারি কথাগুলো বলে নিতে হবে।
সারাদিন পেটে সেভাবে কিছু পড়েনি।সবে ইন্টারকমে নিজের অ্যাসিস্টেন্ট তনয়া কে খাবার অর্ডার করতে যাবে দরজায় ধাক্কার আওয়াজ শুনে ফোন নামিয়ে রাখে ঋষি,কৌতূহলী হওয়ার সাথেসাথে ঘরে এসে ঢোকে জয়ি।

“এসো।কোথায় ছিলে তোমরা?বাইরে বেরিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না।” ঋষি কৌতূহলী হয়।

“জয়ন্ত আর রণকে একটু ব্রাঞ্চ করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম।কি হলো রে?” ওদের ভাষাতে বোঝায় জয়ি।

-“অপারেশন ঠিকঠাক হয়েছে।কিন্তু আসল লড়াই এবার।রণরা কই?”
-“ওরা তো ওটির ওখানে গেল?দাঁড়াও ফোন করে ডাকি।এখন তো রাইকে দেখতে পাবেনা?”
-“না এখন কয়েক ঘন্টা অবসার্ভেশনে থাকবে।কিছু কথা বলার আছে ওদের সাথে।রাইকে হয়তো কাল ছেড়ে দেব।তুই যেটা ভেবেছিস সেই নিয়েও কথা বলে নিস জয়ন্তর সাথে।”
কানে ফোন রাখা অবস্থায় ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে জয়িতা।সেই মুহূর্তে দরজা নক করে মুখ বাড়ায় তনয়া,সাথে ক্যান্টিনের একটা ছেলে খাবারের ট্রে হাতে।বিয়ের এত বছর পর আর অবাক হয়না ঋষি,বুঝে যায় এটা জয়ির কাজ।
নিজের চেয়ার ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসে।

ঋষির খাওয়া তখন সবে শুরু হয়েছে রণ-জয় এসে ঢোকে ঘরে।
আড়চোখে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয় ঋষির,দুজনের মুখ শুকিয়ে গেছে উৎকণ্ঠায়।ঋষি মুখের খাবারটা গিলে শুধু বলে,”একটু বোস।অপারেশন ভালো হয়েছে…কিছু কথা আছে তোদের সাথে।”

কোনো কথা না বলে দুজনে উল্টোদিকের সোফায় গিয়ে বসে।
আজ এমনিও রবিবার বলে ঋষির আউটডোর থাকেনা,আর ও এখন এখানকার সিনিয়র ডাক্তারদের একজন,তাই এমার্জেন্সি ছাড়া চাপ বিশেষ থাকেনা।

“রণ তোর ফেরা কবে?” হাত ধুয়ে রুমালে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে ঋষি।
“টিকিট কাটিনি এখনো, তবে এই উইকটা ছুটি পেয়েছি।কেন বলতো?” ভ্রু তে ভাঁজ পরে রণর।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে ঋষি।তারপর রণর দিক থেকে চোখ সরিয়ে জয়ন্তর মুখে দৃষ্টি রেখে বলে,”জয় তুই তো জানিস এখন রাইয়ের কিরকম কি সমস্যা হবে?রেশমার সময় তো দেখেছিলি।তাও দেখাশোনার অভাব হবে বলে ও কে হসপিটালে রেখেছিলাম আমরা আফটার সার্জারি।সেই কারণেই আলাদা ভাবে এই কথাগুলো বলছি।”
রণর দিকে মুখ ঘুরিয়ে এবার বলে,”তুই তো এই সপ্তাহটা আছিস।আর তুইও জানিস কিভাবে ট্রিট করতে হবে রাইকে।ওর হাতের মুভমেন্ট বিশেষ কিছু তো ও করতে পারবে না।ওকে এই এক সপ্তাহ প্রায় সবই করিয়ে দিতে হবে।তারপর আফটার থ্রি উইকস ও হালকা এক্সসারসাইজ করবে,ফিজিও থেরাপিস্ট ওকে ভিসিট করবে।ওর মোটামুটি ফোর উইকস লাগবে রিকভার করতে।আর হ্যাঁ ড্রেইন লাগানো থাকে স্কিনের নিচ থেকে দিন দশেকের জন্যে,জানিস তো সে সম্বন্ধে,ওর সামনের দিকে একটা বাল্ব মত আছে ,ওটা দিনে থ্রি টু ফোর টাইমস এম্পটি করতে হবে।ফ্লুইড জমে ওখানে।খাওয়া নরমাল হলেও বাথ নিতে পারবে ড্রেইন রিমুভ হওয়ার দিন দুই পর।সেটা আজ থেকে প্রায় দিন দশেক পরে।আর সবচেয়ে যেটা বেশি ইম্পরট্যান্ট ওকে হাসি খুশি রাখা, বোঝানো।মানে মেন্টাল হেলথের খেয়াল রাখা,যাতে দরকারে সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করা যায়।আর জয়ির তোকে কিছু বলার আছে জয়ন্ত।” ঋষি এক নিঃশ্বাসে প্রায় পুরোটা বলে তাকায় জয়িতার দিকে।

জয়ন্তর স্বপ্রশ্ন দৃষ্টি এবার ঘুরে আসে জয়িতার মুখের ওপর।
“জয় আমি এই কয়েকমাস যদি আবার রাইকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখি তুই আপত্তি করবি?তুইও থাক আমাদের সাথে,আমাদের গেস্টরুমে তোর কোনো অসুবিধা হবে না কিন্তু।নাহলে তুই একা পারবিনা…”,জয়ি কথা শেষ করতে পারেনা।
“প্লিজ জয়ি,প্লিজ।গিমমি এটলিস্ট ওয়ান চান্স।এটলিস্ট প্রথম মাস দুই দে।কেমো যতদিন না শুরু হয়।আমি চাই আমার আগের ভুলটা সংশোধন করতে।রণ যখন খুশি ওই ফ্ল্যাটে যেতে পারবে,রাতে থাকতেও পারবে।…”,এবার জয়ি থামিয়ে দেয় জয়ন্ত কে।
“আমি রণর জন্যে বলিনি জয়।একটা মেয়ের অনেকরকম সমস্যা থাকে।তুই একা হাতে কিকরে সব সামলাবি বল।রণ থাকলে বরং আমি রাইকে আনার কথা বলতাম না,কারণ ও রণর কাছে আমার থেকেও বেশি ফ্রি।তোকে তাহলে একজন ট্রেইনড আয়া রাখতে হবে।অন্তত রাতের জন্যে,অতসীও পারবে না।”

“মম রাই থাকুক আঙ্কেলের কাছে।আমি এই সপ্তাহ তো আছি।আর উইকেন্ডে নাহোক মাসে দুবার আমি আসবো।তুমি বরঞ্চ পারলে মাঝে মধ্যে ওখানে গিয়ে থেকো।আর আঙ্কেল একজন আয়া বা নার্সের কথা আমিও ভাবছিলাম।এটা কিন্তু ভালো অপশন।”

জয়ি রণর দিকে তাকিয়ে ওর মনটা বোঝার চেষ্টা করে।রণই তো বলেছিলো শহর ছাড়ার আগে,ও জয়ন্ত কে ভরসা করতে পারেনা।কিন্তু আজ…

“বাবা রাইকে কবে ডিসচার্জ করবে?আর কেমো রে এগুলোই বা কবে থেকে স্টার্ট হবে?” রণ প্রসঙ্গ বদলায়।

ঋষিও অবাক হয় রণর কথা শুনে।জয়ি যে কারণেই বলুক ঋষি মনে মনে ভেবেছিল রাইকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে না পারলেও ওদের কাছে রাই থাকলে রণ অনেক নিশ্চিন্ত হবে।আর তাছাড়া বাড়ি এলে নিজের বাড়ির কমফোর্টে থেকে রাইয়ের কাছাকাছি থাকতে পারবে।কিন্তু রণ ওর ধারণা বদলেই দেয়।বাবা হিসেবে খুব জানতে ইচ্ছা করে কারণটা।
রণ মুখে কিছু না বললেও জয়ন্ত কে সাপোর্ট করে মনে মনে শান্তি পায়।কেউ না বুঝুক ও নিজে জানে কোনো একটা পয়েন্টে গিয়ে আজ ও জয়ন্ত আঙ্কেলের সাথে মিশে গেছে।আজ থেকে দশ বছর আগে জয় আঙ্কেলের কাজে অবাক হয়েছিল,বোঝেনি আঙ্কেল যে কাজ করেছিল সেটা কে স্বার্থপরতা বলা যায় কিনা?এমনকি দিল্লি যাওয়ার আগেও ও রাইয়ের ব্যাপারে ভরসা করতে পারেনি জয় কে।কিন্তু আজ রাইয়ের অসুস্থতা ওকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে জয়ন্তর কষ্টটা,ওর অসহায়তাটা।আসলে সংসারে যদি জীবনসঙ্গী না থাকে সেটা হয়তো সংসার থাকেনা।জয় আঙ্কেল আন্টিকে কতটা ভালোবাসতো বলে চেনা পরিবেশ থেকে পালিয়ে গেছিলো আজ রণ অনুভব করতে পারে।
রণ আজ রাইকে ছাড়া সত্যি বাঁচবে না,আসলে যতই ডাক্তারি সেবার প্রফেশন হোক দিনের শেষে সবাইকে নিজের ঘরেই ফিরতে হয়,আর রাইকে ছাড়া ওর বাড়ি কখনো ঘর হবে না।বেঁচে থাকলেও সেই বাঁচায় প্রাণ থাকবে না,বাঁচাটা ওর হবেনা।
আর তাছাড়া ওই ফ্ল্যাটে দিদুনের আশীর্বাদ আছে,ওখানে থাকলে রাইয়ের কিছু হবেনা এটা রণর বিশ্বাস।আড়চোখে জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সেখানে একটা প্রশান্তি লক্ষ্য করে ও,রণর সাপোর্ট ওকে সাহস যোগায়।

যেন একটা অন্ধকার গুহায় তলিয়ে গেছিলো রাই হঠাৎ করে,যখন চেতনা ফিরতে লাগলো মনে হলো জলের তলায় তলিয়ে গেছিলো ও,ধীরে ধীরে ওপরের দিকে ভেসে উঠছে।হাঁকপাঁক করতে করতে যখন ভেসে উঠলো অনুভব করলো খুব পরিচিত এক হাতের স্পর্শ ওর মাথায়।আস্তে আস্তে চোখ মেলে আধ খোলা চোখে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো রণর মুখটা।
চোখটা বুজে ফেললো রাই।বড্ড ঘুম পাচ্ছে এখনো,আর সারা শরীরে ব্যাথা।বিশেষ করে বুকের কাছটা যেন চেপে আছে।আবার ঝিমিয়ে পরে ও অ্যানেস্থেসিয়ার ঘোরে।
বুঝতে পারে মাথায় বাবার হাতের ছোঁয়া এখনো আছে,শেষ কদিন রোজ রাতে বাবা এভাবেই ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।রণ যখন ফিরতো এক দুদিনের জন্যে,ও চাইলেও রাই রাতে থাকতে দেয়নি ওকে।তার অনেক কারণ থাকলেও একটা অন্যতম কারণ বাবার এই ঘুম পাড়ানো টা মিস করতে চাইতো না ও।
“রাই রাই চোখ খোল মা।খুব কষ্ট হচ্ছে?” জয়ন্ত খুব আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে।
রণ ওই মুহূর্তে নিজেও ভুলে যায় ও একজন ডাক্তার।বারবার ঝাপসা হতে চাওয়া চোখটা বড় করে তাকিয়ে যেন চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসা জলটা আটকাতে চায় ও।
রাইকে এই ভাবে দেখা ওর কাছে যেন মৃত্যু সমান শাস্তি মনে হয়।মেয়েটা কে ভগবান সারাজীবন শাস্তি দিয়ে গেল।
রাইয়ের বাঁ দিকে বসে থাকা রণ আলতো করে নিজের ডান হাতটা রাইয়ের বাঁ হাতের ওপর রাখে।
রাইয়ের আঙ্গুল গুলো নড়ে আর বন্ধ চোখের মনিটা নড়াচড়া করে।রণর খুব ইচ্ছা করে রাইয়ের ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁট দিয়ে আলতো করে ছুঁতে।কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব না।এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাইয়ের মুখের দিকে।
হঠাৎ জয়ন্ত কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়ায় রাইয়ের পাশ ছেড়ে,আলতো করে রণর কাঁধটা ছুঁয়ে “আসছি” বলো বেরিয়ে যায় কেবিন ছেড়ে।রণর বুঝতে অসুবিধা হয়না রাইকে রণর কাছে একা ছেড়ে গেল রাইয়ের বাবা।অধিকার দিলো যেন ওকে।
রণ নিজের মুখটা রাইয়ের মুখের একদম কাছে এনে আলতো করে ডাকে,”রাই… রাই… আমার হার্টবিট।প্লিজ চোখ খোল সোনা।একদম ভালো লাগছে না তোকে এভাবে দেখতে।বিশ্বাস কর বড্ড কষ্ট হচ্ছে।আমি তোর জন্যে সব পারি,শুধু তোকে এভাবে দেখতে পারিনা।রাই…”,আর আটকায় না চোখের জল।রণর গাল বেয়ে গড়িয়ে রাইয়ের মুখে এসে পড়ে।রণ সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে রাইয়ের গাল মুছিয়ে দেয়।কিন্তু রণর স্পর্শে এতক্ষনে হালকা চোখ মেলে মেয়েটা।
আধ বোজা চোখে মুখে একটা প্রায় অদৃশ্য হালকা হাসি নিয়ে তাকায় ও।রণ বাঁ হাতটা রাখে রাইয়ের ডান গালে।
এতক্ষনের ইচ্ছাকে স্বীকার করে হালকা করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় রাইয়ের ফ্যাকাসে ঠোঁটে।
রণর শুকিয়ে যাওয়া করুন মুখ রাইয়ের দৃষ্টি এড়ায়না।মুখের হাসিটা টেনে একটু বড় করে নিজের ডানহাত তুলে রণর গালে ঠেকাতে চেষ্টা করে,কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে রণ তা বুঝে হাতটা চেপে ধরে ওর।রাইয়েরও হঠাৎ যেন সবটা মনে পরে যায়।রণর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে মুখটা পাশ করে।রণ বুঝতে পারে রাইয়ের চোখে জল।
কিছু বলেনা রণ মুখে।ধীরে ধীরে নিজের মুখটা নামিয়ে এনে হালকা করে ঠেকায় রাইয়ের কাঁধে।ডান হাত দিয়ে রাইয়ের বাঁ হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।
রাইয়ের কানের কাছে মুখ রাখা অবস্থায় রণ বলে,”যে ছেলেটার তোকে এভাবে দেখে বুকের মধ্যেটা ভেঙে যাচ্ছে,তার ক্ষমতা নেই তোকে এর চেয়ে খারাপ অবস্থায় দেখার।তোর মুখে একটা পুরোনো হাসি দেখার জন্যে মরে আছে সে।তোকে আর মানসিক কষ্টতে দেখার ক্ষমতা আমার নেই রাই।এই লড়াইটা আমাদের দুজনের,দুজনের একসাথে অনেকগুলো বছর থাকার।প্লিজ আর কষ্ট পাসনা।আমি শুধু তোকে হাসতে দেখতে চাই।কেন বুঝিসনা তোর হাসিতে আমার সবকিছু পাওয়া।হাস রাই, প্লিজ হাস।আমার কষ্টের মেডিসিন তোর ওই হাসিটা।তাকা আমার দিকে,একটু হাস সোনা।…”,মুখটা তুলে আনে রণ,চোখ বোলাতে থাকে রাইয়ের সারা মুখে।
ধীরে ধীরে রাইয়ের গালে রাখা রণর হাতের হালকা চাপ মুখ ফেরায় রাই।চোখের দুর্বল দৃষ্টি রাখে রণর চোখে।ঠোঁটে ফুটিয়ে তোলে হালকা হাসি।
“আমি…খুব লাকি রণদা।অনেক..ভালো কাজের…ফলে তোমায় পেয়েছি।আর হারাতে পারবোনা।সেরে উঠবো আমি ঠিক।অনেক সময় কাটানো বাকি তোমার সাথে।লাভ ইউ রণ,লাভ য়্যূ, সোও মাচ”,রাইয়ের কথায় রণ মুখটা তুলে আনে হালকা করে ঠেকানো রাইয়ের কাঁধ থেকে।ওর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে কান্না ভেজা গলায় বলে,”দ্যাটস মাই গার্ল,মাই হার্টবিট।আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন।”
রণর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার ঘোরের মধ্যে চোখ বুজে আসে ওর।মৃদু হেসে রণ ঠোঁটটা নামিয়ে আনে রাইয়ের কপালে।

ক্রমশ…