মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-২৬

0
383

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#ষষ্ঠবিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

আইপ্যাড টা নিয়ে বসেছিল রণ,অনেকদিন পর ফোনের গ্যালারির ছবিগুলো খুলেছিল।এতে শেষ ছমাসের ছবি ছাড়াও রণর কম্পিউটারে রাখা রাইয়ের পুরোনো সব ছবির কপি আছে,বরং শেষ চারমাস রাই কোনো ফটো তুলতে দেয়নি।
পুরোনো ছবি গুলো রণ দেখে বেশি।এই অগোছালো,সরল মেয়েটাকে দেখেই তো ভালোবাসা কি বুঝেছিল ও।এই দুদিকে বিনুনি মেয়েটাই তো ওর মনে প্রথম ঝড় তুলেছিল।এই রাইকেই সেই রণজয় ভালোবেসেছিল মন থেকে।ভালোবেসেছিল প্রত্যাশা ছাড়া,ভালোবেসেছিল মনে মনে।
ওইসময়ের বেশিরভাগ ফটো ই লুকিয়ে তোলা,কোনোটা রাইয়ের খাবার ছবি,তার মধ্যে ফুচকা খাওয়া,আইসক্রিম খাওয়া সব আছে।কোনটা পিছন ঘুরে জানলায় বসার ছবি।আবার দুর্গা মণ্ডপে ঠাকুর নমস্কারের ছবিও কি কম!তবে রণর সবচেয়ে প্রিয় রাইয়ের ঘুমিয়ে থাকা মুখের ছবি।রণ বারবার ঠোঁট ঠেকায় ওই ছবিগুলোর ঠোঁটে,কপালে।
আজও রণর ভালোবাসা কমেনি,উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।ওর মনে একটা সন্দেহ ছিল,শারীরিক দূরত্ব হয়তো মানসিক দূরত্ব বাড়িয়ে দেবে,কমিয়ে দেবে ভালোবাসার পাগলামি।কিন্তু আদতে উল্টোটা ঘটেছে।শুধু রাইয়ের অসুস্থতার জন্যেই না,হঠাৎ হঠাৎ জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা, আদরের পাগলামি করতে না পারার তরপানি এই ভালোবাসার আবেশ যেন বাড়িয়ে দিয়েছে।
রণ ফোন করার আগেই শীর্ষা ফোন করেছিল আগের সপ্তাহে,কিন্তু ও রাইয়ের খবর দিতে পারেনি।ছোট থেকে কুসংস্কার মুক্ত রণজয়ের মনে অদ্ভুত এক ভয় ঢুকেছে আজকাল।শীর্ষা দিল্লির এক ব্যবসায়ীর সাথে এনগেজ শুনেও ও ভুলতে পারেনি ওর প্রতি ওই মেয়েটার দুর্বলতার কথা।শীর্ষার ওর প্রতি আকর্ষণ রাইকে হয়তো কেড়ে নেবে,ওর ভালোবাসার কাছে রণর ভালোবাসা হয়তো হেরে যাবে…এইসব অদ্ভুত চিন্তা আজকাল ওর মাথায় আসে।
ও জানে এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই,তাও অদ্ভুত এক ভয় ওকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়।
শীর্ষাকে ও অনেক বছর চিনলেও ওর মনের মধ্যে অদ্ভুত এক চিন্তা খেলা করে রাতদিন,ওর আর রাইয়ের সম্পর্ককে চাইতো না বা চায়না এমন যারাই আছে তাদের ও এড়িয়ে চলে এখন।কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় করে ওর।

রাইয়ের একটা ফটোতে এসে থমকে যায় রণ।সেই একঢাল লম্বা চুল পিঠের উপর ফেলে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ রণর ডাকে পিছন ঘুরে তাকানোর একটা রিসেন্ট ছবি।রাইয়ের ওই চুলগুলো বরাবর রণকে টানতো বেশি।ওকে চুল খুলে বসে থাকতে দেখলেই সেই প্রথম দিন থেকে মন করতো পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওই চুলের স্রোতে মুখ ডুবিয়ে দিতে।সম্পর্কে আসার পর রাইদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে যে কবার ওকে কাছে পেয়েছে রণ আগে ওর চুল খুলে দিত।
মম কাল বলছিল রাইয়ের চুল ওঠা শুরু হয়েছে।আবার হয়তো ট্রিটমেন্ট শেষ হওয়ার পর স্বাভাবিক চুল কিছু গজাবে কিন্তু আগের মত হবে না।রণ খোঁজ নিয়েছে দিল্লিতে কোথায় অর্ডারে বেস্ট উইগ বানায়,ও ঠিক রাইয়ের আগের চুলের মতোই উইগ বানাতে দেবে।নাহ এই শনিবার ঠিক যাবে ওই ঠিকানায়,রাইয়ের ফটো দেখিয়ে অর্ডার করে আসবে।
নিজের অজান্তেই আবার ডাক্তার রণজয় মুখার্জীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে গাল ভিজিয়ে দেয়।কিকরে আবার স্বাভাবিক হাসিখুশি প্রাণবন্ত করবে ও ওর আদরের রাইকে?
আজও যে কিছুতেই ভিডিও কলে এলোনা।
অপারেশনের পর মম, জয়ন্ত আঙ্কেলের কথা মেনে রাইকে ফ্ল্যাটে পাঠালেও কেমোর সময়টা কিছুতেই কাছ ছাড়া করছে না।রণ জানে পুরোটাই ওর জন্যে শুধু না,রাইকে মম নিজের মেয়ে ভাবে আজ থেকে আট বছর আগে থেকে।
প্রতিটা কেমো পাঁচদিনের পার্থক্যে দুটো ডোজ হয়।ওই সময় প্রায় দশদিন রাইকে আগলে রাখে মম।প্রতি মাসে হবে এরপর,সবে প্রথম দুটো হয়েছে।কটা হবে,বাবা বলেনি এখনো।
আইপ্যাডের ঘড়ি বলছে রাত প্রায় একটা বাজে।প্রচন্ড ইচ্ছা করছে রাইমাকে একবার দেখতে।প্রথম কেমোর কদিন পর থেকেই ভিডিও কল আর ধরেনা রাই।মম বলছিল আয়নার সামনেও যেতে চায়না।জানে রণ কারণটা।প্রথম কদিন খুব কাঁদতো রাই নিজের শরীরে কেমোর এফেক্টে।এখন আর কাঁদেনা,কিন্তু মম বলছিল অদ্ভুত রকম চুপচাপ হয়ে গেছে ওর স্বভাব শান্ত রাই।
দ্বিতীয়বার কেমোর পর একদিন মমের ফোনে ভিডিও কল করেছিল রণ যখন রাই ওদের বাড়ি ছিল।রাইকে না জানিয়েই জয়িতা ফোনটা নিয়ে গেছিল ওর কাছে।কিন্তু রণ নিজেই চমকে উঠেছিল রাইকে দেখে।
রাইয়ের সেই সোনা রং পুড়ে কালো হয়ে গেছে।সেই লম্বা চোখের পাতা…না পারেনি রণ কষ্ট পাওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে।প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল ওর রাইয়ের জন্যে।ওর দৃষ্টি হয়তো পড়তে পেরেছিল মেয়েটা,মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিল অন্য দিকে।
চিন্তা গুলো আজ মাথায় বড্ড হুল ফোটাচ্ছে।এবার কেমোর সময় রণ থাকবে ওর রাইয়ের কাছে।ওর প্রফেশনে কাছে দায়বদ্ধতা ওকে গত দুবার যেতে দেয়নি।কিন্তু এবার কেউ ওকে আটকাতে পারবে না।
সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢোকে রণ।আজকাল কিছুতেই মাথার কথা শুনতে পারেনা ও,সিগারেট একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে সারাদিনে।
ওয়াশরুম থেকে শুনতে পায় ফোন বাজছে,আজকাল ফোন নিয়ে যায়না।এখন রাইয়ের কারণে ফোন কখনোই সাইলেন্ট মোডে থাকেনা ওর।এখানে সবার সিঙ্গেল রুম,তাই প্রাইভেসি সমস্যা হয়না।ফ্লাশ করে বেরোতে বেরোতে ফোনটা কেটে যায়।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে রুদ্র ফোন করেছিল।এত রাতে রুদ্র!

-“বল রুদ্র।এত রাতে কি ব্যাপার?” কল ব্যাক করে রণই প্রথম কথাটা বলে।
-“রণ একটা চাকরি খুব দরকার ভাই।কয়েকমাস তো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ এর চাকরির চেষ্টা করে দেখলাম,আজকাল সবাই এমবিএ চাইছে।যাও বা একটা ছোট কোম্পানি তে পেলাম তারাও শালা মাসের শেষে মাইনে টুকুও ঠিক করে দিতনা।কিন্তু ওই চাকরির ভরসায় জীবন চলে না।আজ এই মুহূর্তে একটা সিরিয়াস জব খুব দরকার।খুব সমস্যায় পড়েছি ভাই”,রুদ্র একটানা বলে যায় নিজের কথা।
-” আগে বলিসনি কেন?তবে এমআর এর জব এরকমই হয়।এমবিএ কিসে চাইছে,মার্কেটিংয়ে?”
-“আসলে আগে দরকারটা বুঝিনি।কিন্তু এই মুহূর্তে একটা দায়িত্ব চেপে বসেছে,আর সেটা পার্মানেন্ট দায়িত্ব।তাই পার্মানেন্ট সলিউশন দরকার।আর আমার তুই ছাড়া বলার কে আছে বল?”
-“কিসের দায়িত্ব ভাই?বিয়ে থা করবি নাকি?” ঠাট্টা করলেও গলায় ঠাট্টার সুরও আসেনা রণর।তা কান এড়ায় না রুদ্রর।নিজের দরকারে ফোন করলেও মনে খটকা একটা লাগেই বন্ধুর আচরণে।
-“করবো না।করে ফেলেছি।এছাড়া উপায় ছিল না”,রুদ্রর কথায় চমকে ওঠে রণ।এই ছেলেটা এক রয়ে গেল।একে নিজের জীবনে এই অবস্থা,তারপর রুদ্রর এই হেঁয়ালি।কিছুটা বিরক্তির সুরেই রণ বলে,”প্লিজ খুলে বলবি কি হয়েছে?এত রাতে মজা করিসনা।আমি একটু ডিসটার্বড আছি,তাই যা বলার…পরিষ্কার করে বল।”
-“রণ ঐশি আর আমি আজ কোর্ট ম্যারেজ করলাম।একমাস আগে নোটিস দেওয়ার সময়ও কনফিডেন্স ছিল একমাসে বেটার কিছু জোগাড় করে ফেলবো,কিন্তু…”।
-“কিন্তু কি রুদ্র!আর য়্যূ ক্রেজি? তোর কি মনেহয় এত ইজি একটা জব পাওয়া,তাও আবার শুধু গ্রাজুয়েশন করে? আরে স্পেশালাইজেশন করে সব ঘুরে বেড়াচ্ছে,মাস্টার্স ডিগ্রিরও দাম নেই।আমি তোকে এমআর এর জবের কথা বলেছিলাম কারণ ওটাতেই স্পোকেন আর মার্কেটিং নলেজ থাকলে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি কিছু করা যায়।তাও ডেডিকেশন থাকতে হয়।এত সহজ কিছুই না।আর ঐশি তোকে এই অবস্থায় বিয়ে করতে রাজি হলোই বা কেন?” রণ চেষ্টা করেও স্বাভাবিক থাকতে পারেনা,কিকরে আজকের দিনের একটা ছেলে এরকম ইরেস্পন্সিবলের মত কাজ করতে পারে ওর মাথায় ঢোকেনা।
-“রণ তুই আগে পুরোটা শোন, তারপর প্লিজ যা বলার বলিস।” রুদ্রর গলায় আকুতি ভেসে আসে।
-“কি বলার আছে আর?কিসের ভরসায় তুই এটা করলি রুদ্র?বিয়ের রেস্পন্সিবিলিটি জানিস না তুই?ফিউচার না গুছোস, প্রেসেন্টটা নিয়েও তো অন্তত ভাববি?আঙ্কেল আন্টি,ঐশির মা বাবা মেনে নিলো?” রণর মাথা কাজ করেনা।ওর সামর্থ্য আছে,কারণ আছে। তাও ও বিয়ে করছে না ফ্যামিলির মুখ চেয়ে।আর রুদ্র…!
-“কেউ জানেনা রণ।ভেবেছিলাম বিয়ের আগেই তোদের বলবো।কিন্তু সাহস হলোনা।তাই রাইকেও উইটনেস হিসেবে সই করতে ডাকতে পারলাম না।ঐশি বড্ড ইনসিকিউরিটি তে ভুগছিল রে।খালি কান্নাকাটি করছিল ওর বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেবে বলে।আপাতত ওকে তো শান্ত করতে পেরেছি।আর আমরা যেমন যে যার বাড়ি আছি থাকবো,যতদিন না আমি সেটল হতে পারছি।কিন্তু আমি জানি সেই সময়টাও বেশিদিন নেওয়া যাবে না।তাই অনেক ভেবে তোকে ফোন করলাম।”
চুপ করে থাকে রণ রুদ্রর কথায়।প্রথমে একটু রাগই হয়েছিল ওর,ওকে বলে এসেছিল রণ রাইয়ের খবর রাখতে।কিন্তু এতদিন পর শুধু নিজের দরকারে ফোন করায় বড্ড স্বার্থপর মনে হয়েছিল নিজের ছোটবেলার বন্ধুটা কে।কিন্তু স্বার্থপর কে নয় এই পৃথিবীতে?ওই বা কত খোঁজ রেখেছিলো রুদ্রর। আর রুদ্র নিজেও ভালোই সমস্যায় ছিল।
“ওকে,আমি দেখছি।মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ বা বাবাদের হসপিটালে সুপারভাইজারের কোনো পোস্ট যদি ফাঁকা থাকে…কিন্তু আন্টি আমায় কোনোদিনও ক্ষমা করবেন না আমি জানি।কত স্বপ্ন ছিল ওঁর তোকে নিয়ে।ছাড়,পারলে জব পেয়ে এমবিএ টা করে নিস, পরে নিজেরই দরকার লাগবে।” রণ ফেলতে পারেনা রুদ্রর কথা।ছোট থেকে রুদ্রর কোনো প্রয়োজনকেই তো উপেক্ষা করেনি ও।
“থ্যাংক য়্যূ সো মাচ ইয়ার।আই ওয়াস ফিলিং সো লোনলি।জানি কারোর এক্সপেক্টেশন পূরণ করতে পারিনি।তাই ঐশিও ছেড়ে চলেই গেছিল।কিন্তু যেদিন তুই শহর ছাড়লি হঠাৎই আবার ফোন করলো,বললো আমার মত ও নিজেও আমায় ছাড়া ফিউচার ভাবতে পারছে না।তারপর…।বিশ্বাস কর কিছুই আমার হাতে ছিলোনা।” রুদ্রর জীবনে ঐশিকা যে ধ্রুবতারা রণ সেটা নিজেও জানতো।তাই ওদের ব্রেকআপ এ ও নিজেও কষ্ট পেয়েছিল সেদিন।
“তারপর বল ভাই তোর কি খবর?কবে ফিরছিস কলকাতায়?”

“যাবো নেক্সট মন্থ।তার মধ্যে তোর কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক করে দেব।চাপ নিসনা।” অন্যমনস্ক ভাবে বলে রণ।
“রাইয়ের কি খবর রে?সরি ভাই তুই খোঁজ রাখতে বলেছিলি ওর,কিন্তু এইসব ঝামেলায় একদম হয়ে ওঠেনি।মাঝে একদিন ফোন করেছিলাম ওকে,তোকে ফোনে না পেয়ে, ও ধরলো না।একদিন ভাবছি চলে যাবো ওদের ফ্ল্যাটে।” রুদ্র হাসতে হাসতে বলে।
“না যাসনা, এখন ওদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার দরকার নেই”,কথাটা বলেই চুপ করে যায় রণ।
রাই ওর মা মারা যেতে রণদের বাড়ি এসে থাকার কথাটার মত ওর রোগটাও রণ লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল শুধুমাত্র রাইয়ের মনের চাপের কারণে।ও চায়না ওর রাইকে কেউ অহেতুক সিমপ্যাথি দেখাক।কিন্তু রণর নিজের মনের বোঝা এত বেশি হয়ে গেছে,সেটা হালকা করতে খুব বেশি ইচ্ছা হল রুদ্র কে সব খুলে বলতে।
রুদ্র ওর কথায় হকচকিয়ে গিয়ে চুপ করে আছে দেখে রণ নিজেকে সামলে শুধু বলে,”রাই ভালো নেই রুদ্র,আর আমিও না।” শুধু এটুকু বলতে গিয়ে ওর গলা ধরে আসে।

“কি হয়েছে রণ! প্লিজ আমায় খুলে বল।আমি ভাবলাম ঝগড়া বা ব্রেকআপ হয়েছে তোদের।কিন্তু তোর কথা তো…কি হয়েছে রাইয়ের?” রুদ্রর উৎকণ্ঠা ওর গলায় ধরা পরে।
“ব্রেকআপ!!!…বেঁচে থাকতে বোধহয় আর হবে না।কিন্তু ওই বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত হয়ে গেছে আমাদের।রাইয়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে”, শেষ লাইনটা বলতে গিয়ে রণ নিজেও যেন কেঁপে যায় আর তার থেকেও বেশি কেঁপে ওঠে রুদ্র।
“কি বলছিস রণ,আই কান্ট বিলিভ।তুই আমায় আগে জানাসনি কেন?কতদিন হয়েছে ব্যাপারটা।উফ আমি ভাবতেও পারছিনা।কোন স্টেজে আছে রোগটা?” রুদ্র রণর কথা ভেবে বেশি করে চিন্তায় পরে যায়।
খুব কেটে কেটে ভাঙা গলায় রণ বলে,”আমি এখানে আসার পরেই ডিটেক্ট হয় স্কিনিং টেস্টে।আমি জানতে পারি সপ্তাহ খানেক পর।সেকেন্ড স্টেজে ধরা পড়লেও রিস্ক ফ্যাক্টর হাই ছিল বলে ডাবল ম্যাসটেক্টমি করতে হয়েছে।এখন কেমো চলছে।”
রুদ্র কি বলবে বুঝতে পারেনা।ও জানে রণর কাছে ভালোবাসার প্রতিশব্দ রাই। ও জানে রাইয়ের অতীত।ও জানে রণর ভবিষ্যৎ স্বপ্ন।সব মিলিয়ে কিছু বলার ভাষা ও খুঁজে পায়না।
নিজের সমস্যাটা বড্ড তুচ্ছ মনেহয় ওর।রণ ওকে দায়িত্ব দিয়েছিল রাইয়ের খোঁজ নেওয়ার,এই কমাস সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের টুকু নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিজেকে খুব ছোট লাগে।
রণর কথা গুলো রুদ্র চুপচাপ শুনতে থাকে।রণর হাহাকারের কাছে ওর কথা,ওর চিন্তা,ওর ভাবনা গুলো ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে।
অন্যদিকে রণ জানে ওর সমস্যা হয় মিটবে,নাহয় রাই হারিয়ে যাবে।কিন্তু পৃথিবী চলবে,আর চলবে রুদ্রর এই ছোটখাটো সমস্যা গুলো নিয়েই।এগুলোই থেকে যাবে,আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বেঁচে থাকা মানুষদের কাছে।

শীর্ষার আজ হসপিটাল থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।নিজের জন্যে আজ তাই বিশেষ কিছু রান্না করেনি ।এখানকার ভেজিটেবলস দিয়ে মিক্সড হাক্কা চাও ওর হট ফেভারিট,সেটা দিয়েই ডিনার সেরে যখন বিছানায় এলো ভারতীয় সময় তখন প্রায় সকাল সাতটা।একবার ভাবলো বাবা কে ফোন করি,পরমুহূর্তে মত বদলে যাকে ফোন করলো সেই এখন ওর অঘোষিত অভিভাবক।শত কাজেও শীর্ষার খোঁজ নিতে দিনে বার তিনেক ফোন আর কমপক্ষে খান কুড়ি মেসেজ তাকে করতেই হয়।
“আরে ডার্লিং কেয়া বাত!আজ তো মেরা নসিব হি খুল গ্যয়া লাগ রাহ হ্যয়?তুমি এতো সকালে নিজে থিকে ফোন করছো!!!তাবিয়াত ঠিক আছে না?”,শিবরাজ নিজের চেষ্টায় বাংলা শিখেছে শীর্ষার জন্যে।খুব ভালো না হলেও কাজ চলে যায় বোঝার জন্য।
“মন কেমন করছিল।কি করছো এখন?” শীর্ষার গলায় যা বিশেষ শোনা যায়না সেই আদুরে স্বরে গলে যায় শিবরাজ।
“ওহ মাই গড!!আর য়ু অলরাইট? আই ক্যান্ট বিলিভ অন মায় লিসেনিং পাওয়ার। বাই দ্য ওয়ে আর য়ু শীর্ষা!আই ডাউট।” লেগপুল করার লোভ সামলাতে পারেনা ও।
“ধুর আমি ফোন রাখছি।” কৃত্রিম বিরক্তি দেখায় শীর্ষা।
“কিঁঁউ ইয়াদ আয়া তুঝে মেরা?” শিবরাজের সবসময়ের ইয়ার্কি মজা করা স্বর হঠাৎ ই বড্ড বেশি গভীর শোনায় শীর্ষার কানে।কানে দুটো গরম হলেও শরীরে একটা শিরশিরানী ছড়িয়ে যায়।
মনে পড়ে প্রথমবার শিবরাজের জোর করে ওর রুমে আসার ঘটনা গুলো।ওর জন্মদিনের দিন হঠাৎ করে ওর গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে এভাবেই শীর্ষাকে রাঙিয়ে দিয়েছিল ছেলেটা।
শীর্ষার ওই লজ্জা ওকে হয়তো প্রশয় দিয়েছিল তাই একাঘরে একটু সাহসী হয়ে বার্থডে উইশ করেছিল এনগেজমেন্ট রিং দিয়ে।স্বল্পদিনের পরিচিত রাজ, শীর্ষাকে কিছুক্ষনের জন্য থমকে দিয়েছিল যখন রাজের চোখে একটা কষ্ট দেখেছিল শীষ,যে টা অনেক বছর ধরে দেখতে চেয়েছিল অন্য একজনের চোখে।
চোখ বুজে ফেলেছিল শীর্ষা চোখের জলটা বেরোতে দেবেনা বলে।কিন্তু অবাধ্য চোখের জল গাল গড়িয়ে নেমে এসেছিল বুকে।শীর্ষা বুঝতে পারেনি কিসের জন্য এই কান্না,কিন্তু সেই মুহূর্তে বন্ধ চোখের মধ্যে ভেসে উঠেছিল যে হাসিমুখটা সেটা রাইয়ের বয়ফ্রেন্ডের না,সেটা ছিল শীর্ষার আগামী সঙ্গীর।সে অপেক্ষা করছিল ডায়মন্ড রিংটা হাতে নিয়ে।মুখের হালকা হাসি নিয়ে বন্ধ চোখেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল ও মুখ কাঁচুমাচু করে একহাত দূরে হারিয়ে থাকা শিবরাজের দিকে।
যখন চোখ খুলেছিল প্রথমের নজরে এসেছিল সেই দামি হাসিটা,যেন বিশ্বজয়ের হাসি।আংটিটা আঙুলে পরিয়েই
“এক্সকিউজ মি”,বলে একদিনে বেশি সাহসী হয়ে ওঠা রাজ শীর্ষার জীবনের প্রথম চুম্বনটা ওকে অতর্কিতেই করেছিল।নিজের গোঁফের আড়ালের মোটা ঠোঁটটা দিয়ে কামড়ে ধরেছিল শীষের তলার ঠোঁট।

দূর আবার সেই সব চিন্তা মনে আসছে।চিন্তা সরিয়ে শীর্ষা উত্তর দিল,”কারণটা জানিনা।কিন্তু বড্ড মন কেমন করছে।ছুঁতে ইচ্ছা করছে তোমাকে।মিডল ক্লাস বেঙ্গলি লিভ ইন করেনা,তোমাদের ভাষায় শাদি করে।কিন্তু তুমি আমায় সে সুযোগ দাওনি।ভাসিয়ে নিয়ে গেছো,আমিও ভেসেছি।তখন জানতামনা কতটা ভালোবাসি তোমায়,আজ জানি।জানি আমার একজন আদর করতে জানা প্রেমিক আছে,একজন দুঃখ শেয়ার করার বন্ধু আছে,একজন ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে বাবার মত মানুষ আছে,একজন দুঃখে কাঁদলে ভাইয়ের মত কাঁধ বাড়িয়ে দেওয়ার মানুষও আছে।কিন্তু সিঁদুর পরিয়ে দেওয়ার হাজব্যান্ড…সেটাও যে দরকার জীবনে।রাতে ফিরে একা না,কাউকে জড়িয়ে ঘুমোতে ইচ্ছা করে আজকাল।আমার চাওয়াটা কি খুব বেশি?” শীর্ষা বলতে বলতে নিজেও লজ্জা পায় আবার নতুন করে।
“উ-উ-ম-ম-মুয়া।হামি এর থেকে বেশি আর কুছুই দিতে পারবোনা এই মোমেন্টে ।শুধু একঠা টাইট হাগ দিতে পারি।বহত জলদি আ রাহাহুঁ জান।তুঝে সিঁদুর মে দেখনে কি শখ মুঝে কিৎনা জ্যাদা হ্যয়…আউর উও সুহাগরাত কে ওয়ারেমে বাতই মাত কার তু।…”,রাজের গলার দুস্টুমি কান এড়ায়না শীর্ষার।তবে রাগের বদলে হাসি ছুঁয়ে যায় ওকে।

রাজ যখন ফোন ছাড়ে ঘুমে চোখ জুড়ে এসেছে শীর্ষার।লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে।
ঘুমের আগে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় হঠাৎ মনে পড়ে রণর সাথে সেদিন যখন কথা হলো রণ যেন একটু ডাউন ছিল।ফোন কেটে মনে হয়েছিল কিসের যেন অভাব ওর স্বরে ছিল।
আজ ঘুমের ঘোর লাগা অবস্থায় হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা রাইয়ের সাথে ওর ঝগড়া হয়নি তো।বা হয়তো ‘ব্ৰে-ক-আ-প’।
আচ্ছা রাইয়ের সাথে মনের মিল হয়তো হলোনা রণর,হয়তো ফিরে এলো শীর্ষার কাছে।কি করবে তাহলে শীর্ষা?রণকে ফিরিয়ে নেবে,রাজকে ফিরিয়ে দিয়ে,নাকি রাজ ওকে ছাড়বে না??
না না রণ ফিরে আসলে রাজকে…
হঠাৎ ঘোর কেটে যায় শীর্ষার।চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসে বিছানায়।কি পাগলের মত চিন্তা করছে ও?তাহলে আজও অবচেতনে ও কি রণর অপেক্ষায় আছে?ও কি মনে মনে রাইয়ের সাথে রণর ব্রেকআপ চায়?
ছি ছি কেন হঠাৎ এরকম চিন্তা এলো ওর! আজও কেন রণ ওকে চিন্তায়,ভাবনায় তাড়া করে? এখনো সব ক্ষেত্রে ও রাজের তুলনা করে রণর সাথে?
না রণর থেকে ওকে বেরোতেই হবে,নাহলে রাজকে ঠকানো হবে।ওর ভালোবাসার সাথে বেইমানি করতে পারবেনা ও।
আর ও অন্তত জানে রাইকে কিরকম পাগলের মত ভালোবাসে রণ।ও কোনোদিনও রাইকে ছেড়ে ওর কাছে আসবে সেটা সম্ভব না।কিন্তু এই ভাবনাটা আজও ওকে বড্ড কষ্ট দেয়।ও চায় রাই-রণ ভালো থাকুক কিন্তু মনটা মাঝে মাঝে বড্ড জ্বালায়।
হাত বাড়িয়ে জলের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে।ফোনটার লক বাটনটা একবার টেপে।স্ক্রিনটা জ্বলে ওঠে,ওর আর শিবরাজের ফটোটা চোখ ভরে দেখে মনে নিয়ে চোখ বোজে ও।ওই ফটোটা মনে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে যাতে অবচেতনেও রণ সরে গিয়ে রাজকে জায়গা করে দেয়।

“কিরে রাই কষ্ট হচ্ছে?” চোখ বুজে শুয়ে আছে মেয়েটা সেই ফিরে এসে থেকে।ডবল ম্যাসটেক্টমি তাই দুটো হাতে আর কোনোদিনও চ্যানেল করা সম্ভব না।এই সার্জারি তে কেমো দেওয়ার জন্যে অন্য উপায় থাকলেও ঋষি পায়ে চ্যানেল করে কেমো দেওয়ার ব্যবস্থাই করেছে।রাইয়ের পক্ষে তাই ওয়াশরুম যাওয়াও কষ্টসাধ্য হয় এই কেমোর দিন গুলো।
রণ রাইয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে মাথায় হাত বুলোতে থাকে।
“রণদা,যাওও-খেএয়ে-নাও।” কথা খুব ধীরে আর অস্পষ্ট ভাবে কানে আসে রণর।
“তুই খা একটু।এক চামচ,দু চামচ যা হোক।আমিও তাহলে খাবো”,আজকাল কেন যে রণ কান্না চাপতে শিখেও কষ্ট বেশি পায়!
এই রাইটা একদম অচেনা ওর,কেন হাসেনা মেয়েটা আগের মত।কবে দেখবে ওর হাসিভরা মুখটা?
হঠাৎ কি ভেবে বাকি সব সব সব বাস্তব ভুলে রণ নিজের ঠোঁটটা রাইয়ের ঠোঁটে হালকা করে ছোঁয়ায়।ওদের সেই আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে খেলাটা খেলতে ইচ্ছা করে ওর।ভুলে যেতে চায় রাইয়ের কেমোর পরের কষ্টগুলো।রাই সাড়া দেয়না।চুপ করে ঠোঁট চিপে শুয়ে থাকে।কিছু ভালো লাগে না ওর এই সময়।তাও রণ ঠোঁট সরায় না।
কিছুক্ষন পর কেমোর প্রভাবে গা গুলিয়ে ওঠে রাইয়ের,জোরে ঠোঁটটা সরাতে যায়।কিন্তু শরীরে কোনো জোর না থাকায় পারেনা রণকে ঠেলতে।
শেষে যখন অসহ্য হয়ে ওঠে রণর ওই আলতো ঠোঁট ছোঁয়ানোর কষ্টটা ও চেষ্টা করে হাত তুলে রণকে ঠেলতে।সঙ্গে সঙ্গে সেন্স ফিরে আসে রণর নিজের,নিজের মুখটা সরিয়ে রাইয়ের হাত দুটো সাপোর্ট দেয় নিজের হাত দিয়ে।

কিছুক্ষন হাঁফায় রাই, আর রণ বলতে না চেয়েও বলতে বাধ্য হয়,”সরি রাই”।
নিজেকে সামলে,নিশ্বাস স্বাভাবিক হলে রাই বলে,”কিছু আর আমার থেকে পাওয়ার নেই রণদা।চলে যাও।…এভাবে মানুষ বাঁচলেও সম্পর্ক বাঁচেনা।আমি আর এই সম্পর্কটার বোঝা বইতে পাচ্ছিনা।…মুক্তি দাও,মুক্তি দাও আমায় তোমার ভালোবাসা থেকে।ফিরে যাও তুমি শীর্ষা দির কাছে।আমি পারবো না,কিছুতেই পারবোনা তোমায় আর সুখি করতে।প্লিজ চলে যাও।এই বোঝা না থাকলে তাও আমি নিশ্বাস নিতে পারবো।সারাক্ষন মনে হবে না আমার ভালোবাসা আমায় দয়া করছে।প্লিজ বোঝ আমার দিকটা।আমি আর পারছিনা।আমার ঠোঁটের মত আমার শরীরটাও শুকিয়ে গেছে।কিছু ক্ষমতা নেই আর এই শরীরের।কিকরে সংসার করবে সে?” রাইয়ের দুর্বল শরীর নিতে পারেনা এই উত্তেজনা।গা আগেই গুলোচ্ছিলো, এবার কাসতে কাসতে মাথা ঘুরে যায়।চোখ বন্ধ হয়ে নির্জীব হয়ে পড়ে ও।শ্বাস নিতেও কষ্ট হতে শুরু করে।
রণ রাইয়ের কথা শুনতে ওর ঘরের জানলার কাছে চলে গিয়েছিল,রাইয়ের এই অবস্থায় ছুটে আসে ওর দিকে।
“রাই প্লিজ উত্তেজিত হোসনা।প্লিজ।”
-“তুমি…চলে…যাবে…বলো?”
-“ঠিক আছে যাবো।অনেক দূরে চলে যাবো।তুই শান্ত হ।”
-“না শীর্ষা দির কাছে…”।
-“রাই শীর্ষা এনজেগড।আর তুই আমায় তাড়িয়ে দিলেই অন্য কেউ অ্যাক্সেপ্ট করে নেবে কেন?ছাড়,আমি এমনি হারিয়ে যাব।তুই প্লিজ এখন শান্ত হ।একটু কিছু খা।স্যুপ খাবি?”
উত্তর দেয় না রাই।বুঝতে পারে রণর অভিমান হয়েছে।কিন্তু নিজের দিকে তাকালে আজকাল মনেহয় ওর জীবন এখানেই থেমে যাবে,বেঁচে থাকলেও সেটা বাঁচার মত হবেনা।বাইরের চেহারা তো পুরোপুরি আগের অবস্থায় কোনোদিনও ফিরবে না।তাছাড়া কত বাধা এসে জুটবে জীবনে।দুটো হাত তো এমনি আগের মত কাজ করতে পারবে না।ও রণর জীবনে বোঝা হয়ে যাবে।
-“কিরে মম বলছিল স্যুপ করেছে পিসি।স্যুপ খাবি?”
-“না তুমি যাও।কেন তুমি বারবার আসছো নিজের পড়ার ক্ষতি করে?আসবে না আমার কাছে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রণর ভিতর থেকে।ও নিজেও বুঝতে পারছে ওদের সম্পর্ক নিয়ে রাতদিন ভাবছে রাই।তাই এত চুপচাপ হয়ে গেছে।কিন্তু রাই তার মানে কিছুই বোঝেনি ওর পাগলামি।
আর কথা বাড়ায় না রণ।রাইয়ের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
রাই যখন বুঝতে পারে রণ ঘরে নেই।চোখটা টেনে খুলে তাকায়।শূন্যঘরের দিকে তাকিয়ে হুহু করে ওঠে বুকটা।রণ সত্যি চলে গেল ওর কথা শুনে।অভিমানে চোখে জল এসে যায়।
আসলে ওর শরীরের হরমোনের খেলা গুলো যেন সব উল্টে পাল্টে গেছে।পিরিয়ডের ও ঠিক নেই,ঠিক নেই মুডের।বুঝদার রাই আজকাল যেন অল্পেই অধৈর্য্য হয়ে পরে।বাবার ওপরও বিরক্তি দেখায় আজকাল।সেদিন আন্টির সাথেও কথা বলতে ইচ্ছা করেনি বলে চুপ করে ছিলো,কথার উত্তর দেয়নি।ও বুঝতে পারছে দিনদিন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে ও,কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না।
আজকাল খালি মনেহয় রণ সবসময় কাছে থাকুক,ওকে আদর করুক,খেয়াল রাখুক।কিন্তু ও কাছে এলেই খালি নিজের বাইরের অসম্পূর্ণ রূপটা মনে কাঁটা ফোটায়।
রণর মত ছেলের জীবন ওকে ভালোবেসে নষ্ট হয়ে যাবে এটা যখনই মনে হয়,রাগ হয় নিজের ওপর।আর সেটাই উগরে দিতে ইচ্ছা করে রণর ওপর।
রাই নিজের মনে ডুবে চোখের জল ফেলছে,ঘরে এসে ঢোকে জয়ি স্যুপের বাটি হাতে।
রণর ভাঙাচোরা মুখটা ওকে আগেই কষ্ট দিয়েছিল,এবার রাইকে কাঁদতে দেখে ও বুঝতে পারে রণর ওরকম মুখের কারণটা।কিছু না বলে রাইয়ের বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসে ও।
স্যুপটা বেড সাইড টেবিলে রেখে রাইয়ের গায়ে হাত দেয়,”রাই স্যুপ এনেছি।উঠে বোস।” নিজেই সাহায্য করে ওকে।রাই বুঝতে পারে ও ধরা পড়ে গেছে।
বালিশে হেলান দিয়ে যখন উঠে বসে ও চোখের জল তখনও গড়াচ্ছে গাল দিয়ে।ওর মাথার স্কার্ফ টা ঠিক করে চোখের জল নিজের ওড়না দিয়ে মুছিয়ে চেয়ারে বসে জয়ি।
স্যুপের চামচটা যখন ওর মুখের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে নিজেকে সামলাতে পারেনা রাই,হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে।ও বুঝতেও পারেনা ওর কান্নার কারণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওর ওই কান্না সহ্য করতে না পেরে কানে হাত চাপা দিচ্ছে।
“ভগবান প্লিজ যদি তুমি থাকো রাইকে প্লিজ ওর মনের জোরটা ফিরিয়ে দাও।আর ফিরিয়ে দাও…”,থেমে যায় রণর বিড়বিড়ানি,হাত দিয়ে চাপা কানে রাইয়ের হাহাকার এসে ঢোকে।
-“…রণ দা আমার জন্যে ছুটে ছুটে আসে…আর আমি…আমি যে জীবনটা ওকে ছাড়া ভাবতেও পারিনা,সেখান থেকে…”।

-“চুপ কর রাই, তুই আগে চুপ কর।আজকেই কেমো হয়েছে তোর।অসুস্থ হয়ে পড়বি।আগে থাম।প্লিজ…”,জয়ির নিজেকে অসহায় লাগে।কি করে সামলাবে ও এই ভেঙে পড়া মেয়ে টা কে!

-“জানো আন্টি…”,কান্নায় কথা বেরোতে চায়না।নিজেকে সামলে নিয়ে কান্না গিলে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে আবার,”…যতই ভাবি রণ দা কে সরিয়ে দেব নিজের জীবন থেকে।…কিন্তু,কিন্তু ও নেই ভাবলেই জীবন এমনি…কি করে মুক্তি দেব ওকে!!আমি না থাকলে…”,রাইয়ের কথা মুখেই রয়ে যায়, দরজার বাইরে থেকে রণ ছুটে আসে,ও যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে,বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয় রাই কে।
“আগে চুপ কর।চুপ কর”,রণ জড়িয়ে ধরে জোর দিয়ে বলে কথাগুলো।”চু-উ-উ-উ-প”।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে আস্তে আস্তে শান্ত হতে থাকে রাই।দুর্বল হাত গুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরে রণর কোমরটা।
জয়ির চোখের জল আর বাঁধ মানে না।বাঁ হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে,”দুজন পাগল পাগলী কে নিয়ে যত জ্বালা হয়েছে আমার।জানিস যখন একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারবি না…নে রণ এবার স্যুপটা মেয়েটা কে খাইয়ে দে।
“মম রাই সেন্সলেস হয়ে গেছে।মম,ম-অ-ম”,চিৎকার করে ওঠে রণ।
তাড়াতাড়ি স্যুপের বাটিটা টেবিলে রেখে রাইয়ের বিছানায় উঠে যায় জয়ি।কেমো চলার সময় ইমিউনিটি এমনি কম থাকে বলে জয়ি রাইয়ের বিছানায় চট করে ওঠেনা।

রণ রাইয়ের জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ছিটিয়ে দেয়।দুজন ডাক্তারই বুঝতে পারে সাময়িক উত্তেজনায় সেন্স হারিয়েছে দুর্বল রাই।কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর আস্তে আস্তে চোখ মেলে ও।চোখ মেলে দেখে রণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,আর ওর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে আন্টি।

“রণ-দা”,মুখে একটা স্মিত হাসি ফোটে রাইয়ের।
“রণ তুই বোস, আমি স্যুপ টা আর একবার গরম করে আনি”,রণ-রাইকে স্পেস দিয়ে জয়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
স্কার্ফের ওপর দিয়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে রণ রাইয়ের কপালে একবার ঠোঁট ঠেকায়।
একজন ডাক্তার হিসেবে ও জানে কেমোর সময় যে কোনো ইনফেকশন সহজে হয়ে যায়,কিন্তু তাও স্নেহ ভালোবাসার ছোঁয়ার জোর বড্ড বেশি যে ওর কাছে।ও জানে ওর ভালোবাসার ঘেরাটোপ থেকে রাইয়ের কিছু হবে না।
রাই আস্তে করে ওর বাঁ হাত তুলতে যায়,রণ ধরে ফেলে।রাই আসলে রণর হাতটাই ধরতে চাইছিল,দুহাতে রণর হাতটা নিজের বুকের ওপর চেপে ধরে।
রণর মনটা ভালোলাগায় ভরে যায়।রাই রণর হাতটা নিজের বুকে আলতো করে বুলিয়ে ওর মুখের ওপর দুর্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।প্রথমে না বুঝলেও পরে রণ অনুভব করে রাইয়ের উদ্দেশ্য।
রণর মুখে একটা হালকা হাসি ফোটে।নিজের মাথাটা আলতো করে রাইয়ের বুকে শুধু ঠেকায়,কোনো চাপ দেয়না।
“তুই আমরা মাথাটা দুহাতে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরলে আমার মনটা কিন্তু সেই আগের মতোই আশ্রয় পাওয়ার শান্তিতে ঠান্ডা হয়ে যাবে রাই।এখন শুধু মাথাটা ছোঁয়াতেই অনুভবটা ফিরে পাচ্ছি।তোর বুকে আমি আশ্রয়,ভালোবাসা খুঁজতাম,এখনো তাই খুঁজবো।ক্লান্ত হয়ে কাজের শেষে বাড়ি ফিরলে ওখানে ঢুকে শুয়ে আরাম পেতে চাইতাম,এখনো তাই চাইবো।এর সাথে তোর ব্রেস্ট থাকা,বা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই।”
তারপর মাথাটা তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”জানিস রাই, তোর এই আইল্যাশ,এই চুল ট্রিটমেন্ট শেষ হলে সব ফিরে আসবে।কিন্তু যেটা নিজে থেকে ফিরবে না সেটা তোর আত্মবিশ্বাস।তাই ওটাকে এত সহজে ভাঙবি না।আমার এটাই আক্ষেপ।আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমার রাইয়ের জন্যে আমি যথেষ্ট,ওর কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট লাগবে না।কিন্তু তোর ভেঙে যাওয়া কথা শুনলে আমার নিজের কনফিডেন্স ধাক্কা খায়।মানুষ মনের জোরে অনেক কিছু পারে।আমি বাবার কাছে এরকম কত পেশেন্টের কথা শুনেছি।প্লিজ রাই তোর মনের জোর হারাস না।তোর পুরো ফ্যামিলি তোর সাথে আছে,আর কি চাই তোর বল?”

রাইয়ের চোখ রণর কথা শুনতে শুনতে আবার ভিজে ওঠে।ধরা গলায় ও বলে,”তুমি আমায় ছেড়ে ঠিক যাবে না তো?আমি বললেও ছেড়ে যাবে না?আমার মা তুমি,আমার বাবা থাকলেও আমার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা তুমি।আমি জানি যেখানে যাই অসুবিধা হোক,তুমি আছো।যেরকম ছোট বেলায় আমরা মা কে ভরসা করি,অনেকটা সেরকম।যাবে না তো বলো?” রণর বুকে ঢুকে শুতে চেষ্টা করে রাই।

রণ বুঝতে পারে রাইয়ের গা গরম হচ্ছে।দুদিন ছুটি নিয়ে এসেছে ও।এই দুদিন রাইয়ের সব দায়িত্ব ওর।
রাইকে নিজের বুকের আড়ালে নিয়ে বলে,”কোথায় যাবো বল তোকে ছেড়ে! তুই কি জানিস না,এখনো বুঝতে পারিস না? আমি কি এতদিনে এই বিশ্বাসটুকুও তৈরি করতে পারিনি তোর মধ্যে যে কোনো কারণে কোনো অবস্থাতেই আমাদের সম্পর্কটা ভাঙার না? আমি তোর কনফিডেন্স হতে চেয়েছি রাই, তোর ইনসিকিউরিটি না।এই যে তোর বিশ্বাস আমি আছি,এই বিশ্বাসও রাখ আমি থাকবো।আর কোনো ভাবে তোকেও যেতে দেবনা।আমি জানি আমায় কি করতে হবে,আমি তার জন্যে প্রতি মুহূর্তে প্রিপেয়ার হচ্ছি।তুই শুধু এই বিশ্বাস রাখবি তোর কিছু হবে না,রণ বেঁচে থাকতে রাইয়ের কিছু হওয়া সম্ভব না।আমি এখনও বাবার ওপর বিশ্বাস রাখি,যদি কোনো কারণে সেই বিশ্বাসে চিড় ধরে আমি তোকে অন্য স্টেট,অন্য কানট্রি তে নিয়ে যেতে দুবার ভাববো না।তুই বাঁচবি, সুস্থ হবি।আর এটাই ফাইনাল।মনে থাকবে?”
রাই শুধু মাথা ওপর নিচ করে রণকে সমর্থন করে,আর রণর গায়ের গন্ধ থেকে সেই আত্মবিশ্বাস,সেই সাহস খুঁজতে চাই যেমন একটা সন্তান তার মায়ের গায়ে খোঁজে।
রণ ওর শুধু লাইফপার্টনার না,ওদের সম্পর্কের বিস্তৃতি সমস্ত রূপে এটাই ও নিজেও জানে।আর তাই রণ থাকলে ও অদ্ভুত মনের জোর পায়।

রাই-রণর এই কথাবার্তা,এই ভরসা জয়ি আড়াল থেকে শুনে সত্যি বলতে অবাক হয়।ও জানতো রণ রাইয়ের ঢাল,কিন্তু এরকম কেমিস্ট্রি ও নিজেও ভাবেনি।
আজ রণর মা নিজেও এক ভরসা খুঁজে পায় রণর কথাতে।একটা নতুন ধারণা ওর মনেও বদ্ধমূল হতে থাকে রাই ঠিক সেরে উঠবে।আবার ফিরবে স্বাভাবিক জীবনে।
রাই রণর বিশ্বাস,ভালোবাসা,ভরসা ঠিক হারিয়ে দেবে ওই প্রাণঘাতী রোগটা কে।

ঘরের মধ্যে রণও রাইকে কথা গুলো বলতে পেরে অদ্ভুত এক শান্তি পায়।মনে মনে বলে,”আমরা খুব তাড়াতাড়ি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবো রাই, দেখিস।আমরা বিয়ে করবো,তোর সিন্দুর পরা লজ্জানত মুখটা দেখার। অপেক্ষায় বাঁচি আমি।ঐ সৌন্দর্য কেউ কাড়তে পারবে না।আমরা গুছিয়ে সংসার করবো দুজনে।তোর পাহাড় দেখার স্বপ্ন,হানিমুনে যাবি তো পাহাড়ে?আমি আছি।তুই শুধু আমার বিশ্বাসটা নে, ঠিক ভালো হয়ে উঠবি তুই।।ভালো তোকে হতেই হবে”।

ক্রমশ…