মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-২৭

0
408

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#সপ্তবিংশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“আস্তে রাই,আস্তে।আস্তে আস্তে ওঠ।দাঁড়া আমি ডিকিতে প্যাকেট গুলো রেখে এসে সাহায্য করছি”,দুহাত ভর্তি প্যাকেট নিয়ে রণ রাইকে ধমকে ওঠে।
“রণদা আমি ঠিক আছি।দুবছর তো হয়ে গেল।আর কতদিন এভাবে ধমকে রাখবে?” কাঁধ অবধি লম্বা,পাতলা হয়ে যাওয়া চুল নাড়িয়ে বলে রাই।
কৃত্রিম রাগের ভঙ্গিতে তাকায় রণ ওর কথা শুনে।

আর দুমাস,তারপর ওদের জীবনের সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটা আসতে চলেছে।রণর সার্জারিতে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ।এখন আপাতত কলকাতার এক নামি হসপিটালের সাথে যুক্ত আছে,আর যুক্ত আছে এক চ্যারিটি হোমের সাথে।সঙ্গে চলছে অঙ্কলজিস্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুতি।এবছরই সুপার স্পেশালাইজেশনের অল ইন্ডিয়া এন্ট্রান্স এক্সামে বসবে ও।তার আগেই সেরে ফেলতে চায় বিয়েটা।

রাই এখন ক্যান্সার মুক্ত,কিন্তু নিয়মমুক্ত না।উল্টে রণজয় কলকাতায় থাকায় নিয়মের রদবদল একদিনের জন্যেও সম্ভব হয়না।নিজের ব্যস্ত জীবনে রাইয়ের জন্যে সময়ের অভাব ওর কখনো হয়না।
রাইয়ের খাওয়া দাওয়া,জীবনযাত্রা সবটাই মেপে মেপেই চলে ঋষির নির্দেশ মেনে।

রণর গাড়ির সামনের সিটে বসে রাই বলে,”দূর আজকেও বাইরে কিছু খেতে দিলে না।কত বছর হল বলতো কিছু খায়নি রেস্টুরেন্টে? বাড়িতেও ও তেল মসলা খাইনা।বাইরে একদিন খেলে কিছু হতনা।কতদিন বাটার চিকেন খাইনি।” রাইয়ের ছেলেমানুষি আজকাল যেন বেড়েছে।নিয়মে আবদ্ধ জীবনে একদিন বাইরে বেরোনো ওর কাছে আজকাল মুক্তি।

রাই নিজের মাস্টার ডিগ্রি করতে এক বছর বেশি সময় নিয়ে এবছর উনিভার্সিটির ডিগ্রি পেয়েছে।কিন্তু পুরোটাই হয়েছে স্পেশাল পারমিশনে বাড়ি বসে।শুধু পরীক্ষা গুলো দিয়েছে ক্যাম্পাসে গিয়ে।পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট বেরোনোর পর থেকে জয়িতার উদ্যোগে শুরু হয়ে গেছে বিয়ের তোড়জোড়।
বাংলার অগ্রহায়ণ মাস সীতার বিয়ের মাস বলে চিরদুঃখী সীতার কথা ভেবে অনেকে এড়িয়ে যেতে চান ওই মাসটা,কিন্তু জয়ি তার রাম-সীতার চারহাত এই অগ্রহায়ণ মাসে এক করে দেবে ভেবেই রেখেছিলো,সেই মতোই প্রস্তুতি মাস ছয়েক আগে শুরু হলে,শেষ পর্যায়ের সমস্ত কাজটুকু হচ্ছে পুজোর মাসে।

“তুমি যে আজ এই সপ্তাহের মাঝে বেরিয়ে পড়লে তোমার হসপিটাল বা চেম্বারে কি বললে?” রাই আবার সেই পুরোনো সময়ের মতোই অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।
জয় পারেনি অবসর কে এগিয়ে আনতে,সেটা অনেকটাই রাইয়ের জেদের কাছে নত হয়েই।কিন্তু তাতেও রাইকে সঙ্গ দিয়েছে এই দুবছরে সবচেয়ে বেশি।হসপিটালের ডিউটি বাদে বাকি সময় রাইকে আগলেছে রেশমার মত করে।সারাজীবনের দূরত্ব এই দুবছরে প্রায় শেষ করে রাইয়ের একজন নির্ভরযোগ্য পরম বন্ধু হয়ে উঠেছে ওর বাবা।

“বললাম উইকেন্ডে শপিংয়ে গেলে আমার হবু বউয়ের খুব কষ্ট হবে।আমিও ওকে নজর দিতে গিয়ে শ্বশুরের ঘাড় ভালো করে ভাঙতে পারবো না।তাই প্লিজ উইক ডে তে একদিন ছুটি চাই”, রণ হাসতে হাসতে মজার ছলে বলে।চশমার আড়ালে চোখে দুস্টুমি ভরে তাকায় রাইয়ের দিকে,ওর উচ্ছ্বল মুখটা দেখবে বলে।

“যাহ! খালি বাজে কথা। আজকাল খালি ইয়ার্কি”,রাইও হাসতে থাকে।রণর পাশের সিটে বসে ওর কাঁধে মাথা ঠেকায় হাসতে হাসতে।ওর দুর্বল হাত দিয়ে রণর বাঁ হাতটা আলতো করে জড়িয়েও নেয়।
রণ নিজের গালটা রাইয়ের মাথায় হালকা করে ঘষে বলে,”আর তো কটাদিন।তারপর তুই সারাক্ষন আমার ঘরে আমার সাথে থাকবি।জানিস রাই প্রথম যেদিন তুই আমার এলোমেলো ঘরটা গুছতে এসেছিলি তুই তো জানতিস না কি চলছে আমার বুকে।তখন বয়স কম,আর প্রথম ভালোলাগা…সব মিলিয়ে ওই উত্তেজনার সাথে মনেহয় কোনোদিন কোনো কিছুর তুলনা হবে!”

“হমম তখন নিজেকে লুকোতে জানতে।তাই ধরতে পারিনি।তোমার কেয়ার কে সিমপ্যাথি ভাবতাম।মনে হত মা মরা মেয়ের প্রতি বিশেষ নজর।আসলে কখন তুমি আমার সব কিছুতে জড়িয়ে গেছিলে বুঝতেই পারিনি।যখন তুমি দূরে সরে গেলে,বিরাট এক শূন্যতা সৃষ্টি হল জীবনে।বুঝলাম কোনো কিছু দিয়ে,কাউকে দিয়ে সেই ফাঁক পূরণ সম্ভব না।হাত বাড়ালে তোমায় পাওয়ার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল,যেদিন সেটা পেলামনা বুঝলাম তোমার অভাব কি! তুমি না থাকলে কিছু নেই জীবনে।তাই..”,রাই নিজের মাথাটা আরো জোরে চেপে ধরে রণর বুকে।

কলকাতার রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা মুশকিল,তাও একটু ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়িটা থামিয়ে রণ রাইকে জড়িয়ে নেয় বুকে।
“দূর বোকা মেয়ে।আমি সবসময় তোর সাথে ছিলাম,আছি আর থাকবো।তুইও তাই।তবে আর কোনোদিনও তোর থেকে আমায় দূরে পাঠানোর চেষ্টা করিস না।আমি দূরে গেলেই তোর সাথে কিছু না কিছু গন্ডগোল হয়।আমি দেখেছি।সেই জন্যেই তো তোকে একদম আপন করে নিচ্ছি”, রাইয়ের কপালে আলতো করে ঠোঁট ঠেকিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট করে ও।
রাই চুপচাপ রণর স্টিয়ারিং ধরা হাতের উপর নিজের হাতটা আলতো করে রেখে বসে থাকে।

রাইয়ের মনে আজও শেষ তিনবছর যেন ভয়ার্ত স্মৃতি হয়ে আছে।আজও ঘুমের মধ্যে কেমো নেওয়ার দিনগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে আসলে ঘাম দিয়ে ঘুম ভেঙে যায়।
রাই কাউকে বলেনি অতসীর বলা কথা গুলো।তখন সবে রোগ ধরা পড়েছে,আর রাই মনে মনে বেঁচেও মরে গেছে।
সারাক্ষন নিজের ঘরে বসে সবার অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলতে ও।মাথায় খালি একটাই চিন্তা,”আমি মরে গেলে রণদা সামলাতে পারবে তো?”
খালি ভাবতো শীর্ষাকে ফোন করবে,একমাত্র শীর্ষাই পারবে রণ কে সামলাতে।
কিন্তু যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি আর।একদিন রাতে দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছিল ওর চিন্তা ঘুমের মধ্যে।স্বপ্নে দেখেছিল রণর সাথে শীর্ষার বিয়ে হচ্ছে,কিন্তু রাই সেখানে আছে।না রাই মরেনি,কিন্তু শীর্ষা আর ফেরত দেয়নি ওর রণকে।
অন্য কারোর সাথে রণকে ও বেঁচে থাকতে দেখতে পারবে না,সেদিন বুঝেছিলো রাই।ওর কান্নায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অতসীর।
অতসীর বোনের কথা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল রাই কে।
“দেখো বোন,জীবন বড় কষ্টের গো,বড় কষ্টের।শরীরের কষ্ট যত না আমাদের ক্ষতি করে,মনের কষ্ট তার চেয়েও বেশি।আমার বোনটা কে দেখলে আমার কি কম কষ্ট হয়!রোগ হলো,সে এক লড়াই।তোমার মতই রোগ,সুস্থ তো হয়ে গেল।কিন্তু অপারেশন করে ডাক্তার যেই বুক বাদ দিলে স্বামী ছেড়ে চলে গেল।আমার স্বামী মরে বিধবা করেছিল,আর আমার বোন স্বামী বেঁচে থাকতে বিধবা হলো।ওর শাশুড়ি আমার শাশুড়ির মত না।তাড়িয়ে দিল মেয়ে শুদ্ধু বাড়ি থেকে।আমার বিধবা মা নিজের শেষ সম্বল দুজোড়া বালা, এক টুকরো জমি বেচে চিকিৎসা করালে বোনটার।বেঁচেও গেল,কিন্তু সংসার আর হলো না।তোমার দাদাবাবু তো ভগবান গো, এমন কজনের ভাগ্যে মেলে?তুমি কোথায় সেই জোরে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করবে তা না রাতদিন কান্নাকাটি করছো?বলো কি লাভ হচ্ছে তাতে?ওই দাদাবাবু তোমায় সত্যিকারের ভালোবাসে গো।তুমি ওর কথা মত চলো,দেখবে সুস্থ হয়ে যাবে।সব পাবে জীবনে।”

অতসীর ওই কথাগুলো সেদিন বড্ড বেশি নাড়া দিয়েছিল রাইকে।আর কোনোদিনও রণকে ছাড়ার কথা ভাবেনি।ও বুঝতে পেরেছিল প্রাণ থাকতে কোনোদিনও এটা ওর পক্ষে সম্ভব না,এসব ওই সিনেমা সিরিয়ালেই হয়।।বাস্তবে কেউ পারেনা নিজের ভালোবাসা অন্যের হাতে তুলে দিতে,হয়তো মৃত্যুর পরও মানতে পারেনা।

জানলা দিয়ে চলন্ত গাড়ির বাইরে তাকিয়ে এসব চিন্তাই করছিল রাই।রণদের বাড়ি প্রপার কলকাতা থেকে গাড়িতে একটু সময় লাগেই, আর রাই এই সময় নিজের অতীতের ঝুলি খুলে বসে মনের দোকানে।
“কিরে কি এত ভাবছিস তখন থেকে কাঁচের বাইরে তাকিয়ে?” রণ চোখ রাস্তায় রেখেও রাইয়ের ওপর থেকে নজর যে সরায়নি বুঝতে পারে রাই।কিছু না বলে হেসে ঘাড় নাড়ে।
রণও ফিরিয়ে দেয় পাল্টা হাসি।এখনকার রণজয় যে কোনো ইয়ং মেয়ের হার্টরেট বাড়িয়ে দিতে পারে ওর হাসি দিয়ে।রাইকে কোনোভাবে মানসিক চিন্তা দিতে চায়না ও।তাই আগের বন্ধুত্ব এখন কর্তব্যের আড়ালে কিছুটা চাপা থাকে।রাইয়ের সেই ইনসিকিউরিটি থেকে বের করতে রণকে কম কসরত করতে হয়নি।রণ জানে কি করেছিল ও রাইকে স্বাভাবিক করতে।যদিও রণর জীবনে পরবর্তীকালে ওই সুখস্মৃতি শরীরে মনে উত্তেজনায় ছড়িয়েছে, কিন্তু সেই বিশেষ দিনটা উত্তেজনা না চাপা টেনশনেই রেখেছিলো ওকে,যদি না পারে রাইকে ওর ভালোবাসা বোঝাতে?

আজ থেকে মাস ছয় আগে রণ পৌঁছে গেছিল জয়ন্তর ফ্ল্যাটে,এক নির্জন দুপুরে।অতসী কে জয়ন্ত সেদিন ছুটি দিয়েছিল কারণ ছাড়াই,আর নিজে বেরিয়ে গিয়েছিল হসপিটালে।আসলে আগে থেকে জয়ন্তর কাছে পারমিশন চাওয়া ছিল,রাইয়ের দরকারে রাইয়ের সাথে কিছু সময় কাটাতো চেয়েছিল রণ একান্ত নিভৃতে।নিজের থেকেও বিশ্বাস করতে পারা ছেলেটা কে জয়ন্ত পারমিশন দিতে দুবার ভাবেনি।তাই রাই অবাক হলেও জয়ন্ত প্ল্যান মত সব কিছু করে হসপিটাল বেরিয়ে গিয়েছিল।

রণর বেলের আওয়াজে ধীর পায়ে দরজা খুলে দিয়েছিল রাই,কিন্তু রণকে দেখে চমকে গিয়েছিল।সঙ্গে সঙ্গে সরে এসেছিল দরজা ছেড়ে কিন্তু এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি,ছুটে চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে।

রণ নিজের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে এসে মেইন গেট খুলে আবার নিজের সিটে এসে বসে।রাইকে আজ বাড়ি ড্রপ করেনি জয়ির নির্দেশে,নিজের সঙ্গেই এনেছে।গাড়ি সোজা নিয়ে গিয়ে গ্যারেজে ঢোকায়।
রাই গাড়ির দরজা খুলে নামতে যাবে ফাঁকা গ্যারেজের সুযোগ নিয়ে রণ আলতো করে রাইকে টেনে নিজের বুকে এনে ফেলে।
অবাক রাই বড় বড় চোখে তাকায় রণর দিকে।সেই দৃষ্টি, যা পড়াকু রণজয়কে একটা সময় পাগল করে দিয়েছিল,এড়াতে পারেনি রণ রাইয়ের টান।
আজ সেই চোখে আলতো করে ঠোঁট দুটো ঠেকিয়ে পাতাজোড়া বন্ধ করে দেয়।তারপর সরাসরি রণজয়ের ঠোঁট রাইয়ের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়,রাই চোখ মেলে দেখে ওর সবচেয়ে কাছে রণর মুখটা।আবার চোখ বুজে রণর শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে নিজের গোলাপি ঠোঁট শুধু ডুবিয়েই দেয়না,আজ প্রথমবার রাই শুষে নিতে চায় রণর ঠোঁট দুটো।উত্তেজিত রণ শুধু নিজেকে সপে দেয় রাইয়ের ঠোঁটে।দুহাতে জড়িয়ে নেয় রাইকে।
প্রথমবার দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ গোপন প্রেমের ছেলেমানুষী উত্তেজনা অনুভব করে নিজেদের গ্যারেজে,কিশোর রণ যা পারেনি এই রণ সেটা উসুল করে নিতে চায় নিজের রাইয়ের থেকে।

জয়ি পুজোর আগে শেষদিন চেম্বারে বসে সবে ভাবছে এবার বেরিয়ে যাবে এক দম্পতি এসে ঢুকলো,আজকের শেষ পেশেন্ট।
মেয়েটা একটু বেশিই আনমনা।চেয়ারে বসে ওর দিকে তাকাতে মেয়েটার মধ্যে কোনো প্রাণ খুঁজে পেলেন জয়িতা।

“নমস্কার ডাক্তার মুখার্জী, আমি অলোক সেনাপতি।এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার”,ভদ্রলোকের কথায় ওঁর মুখের দিকে নজর গেল জয়ির।বয়স নিশ্চিত ভাবে চল্লিশের ওপর।ওঁর কথায় ঘাড় নেড়ে সৌজন্য প্রকাশ করে জয়ি মেয়েটার দিকে তাকায়,”বলুন কি জন্যে এসেছেন আমার কাছে?প্রবলেম কি?”
মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেও কথা বলেন আবার ভদ্রলোক,”আসলে আমাদের বিয়ের পর প্রায় দশ বছর কাটতে চললো।বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় আমার স্ত্রী রাইমা কনসিভ করে।কিন্তু প্রেগনেন্সির তিন মাসের মাথায় ওর ব্রেস্ট ক্যান্সার ফার্স্ট স্টেজ ধরা পরে।বাধ্য হই অবর্শন করাতে।ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট হয়,সেরেও ওঠে ও।কিন্তু সেরে ওঠার এক বছর পর থেকে চেষ্টা করেও এখনো অবধি কোনো সাকসেস পাইনি আমরা।আমার স্ত্রীর বয়সও প্রায় 37 হয়ে গেল।তাই আপনার কাছে আসা।”

“ট্রিটমেন্টের যা কিছু ডিটেইলস এনেছেন?” মেয়েটার নামই যেন জয়িতাকে অবশ করে দেয় কিছুক্ষনের জন্য।
ঘাড় নেড়ে ভদ্রলোক সাথের কাগজপত্র এগিয়ে দেন জয়ির দিকে।
জয়ির চোখে বারবার ভাসতে থাকে ওর রাইমার মুখ।এই মেয়েটার লাম্পেক্টোমি হয়েছিল,রিস্ক ফ্যাক্টর যথেষ্ট কম।কিন্তু রে দিয়েছিল ডক্টর।
এই রাইমার মানসিক স্বাস্থ্য ও যে বিশেষ ভালো না বুঝতে পারে জয়ি।নিজের সহকারী মেয়েটাকে ইশারা করে ভদ্রমহিলাকে পর্দা টানা অংশে নিয়ে যেতে।
রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে দেখে ব্লাড প্রেসার হাই,সাথে হার্টবিট ও।
“এত টেনশন করছেন কেন?” জয়ি ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করে।
কোনো উত্তর দেন না মহিলা।জয়ি বুঝতে পারে সহজে মুখ খুলবে না।
রাইমা কে ওখানে শুতে বলে নিজের চেয়ারে এসে বসে জয়ি।
“মিস্টার সেনাপতি আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন,কয়েকটা টেস্ট আর কিছু প্রশ্ন করার আছে আপনার স্ত্রী কে।আমার অ্যাসিস্টেন্ট ডাকলে আসবেন”,ডাক্তারবাবুর কথা ঠিক মনঃপুত হয়না ভদ্রলোকের।খুব অনিচ্ছুক ভাবে বলে,”ও তো নিজের কথা কিছু গুছিয়ে বলতে পারেনা,আমি থাকলে আপনার সুবিধাই হত।”
“না আপনি একটু বাইরে যান।কিছু কথা পেশেন্টের সাথে একাই বলতে হয়”,জয়ির গলার দৃঢ়তা বাধ্য করে অলোক সেনাপতি কে বাইরে যেতে।
“বলুন রাইমা আপনার মধ্যের চাপা উত্তেজনার কারণটা কি? আপনি কি জানেন এই টেনশন,এই উত্তেজনা নিয়ে ট্রাই করলে কখনো আপনার ইচ্ছা পূরণ হবে না।আপনি ভুলে যান আপনার ক্যান্সার হয়েছিল,ট্রিটমেন্ট হয়েছে।এগুলো আজকাল কোনো ব্যাপার না।কিন্তু হাসিখুশি থাকা,রিল্যাক্স থাকাটা খুব বেশি দরকার।আপনার মনে কোনো চাপ থাকলে আমায় বলতে পারেন।নাহলে আপনাকে সাইকিয়াট্রিস্ট কে রেফার করতে হবে।এবার আপনি ঠিক করুন”,জয়ি ইচ্ছা করে কথাগুলো বলে।
“না ডাক্তারবাবু প্লিজ সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে পাঠাবেন না।একে শরীরে খুঁত,তারপর মাথার রোগ বলে তাড়িয়ে দেবে বাড়ি থেকে।আমার স্বামী ভালো,কিন্তু শাশুড়ি অপারেশনের পর থেকে আমায় একদম সহ্য করতে পারেননা।ওই সময় ই স্বামী কে বলেছিল আমায় ছেড়ে দিতে,কিন্তু ও আমার সঙ্গ ছাড়েনি।কিন্তু বাচ্ছা নাহলে ওর আর কিছু করার থাকবে না ও বলে দিয়েছে”,কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে রাইমা।
জয়ি কিছুটা হলেও বুঝতে পারে সমস্যাটা।
“দেখুন রাইমা কটা কথা বলি।আপনি এটা মাথায় ঢুকিয়ে নিন আপনার কোনো প্রবলেম আছে কিনা সেটা টেস্ট করে জানা গেলেও আপনাকে সবার আগে মন থেকে এটা বের করতে হবে।আমি কয়েকটা টেস্ট দিচ্ছি।এক সপ্তাহ পর তার রিপোর্ট নিয়ে আসবেন আমার কাছে।কিন্তু সবার আগে আপনি এটা মনে রাখবেন মনে কোনো টেনশন থাকলে কিন্তু কোনো ট্রিটমেন্টেই কিছু হবে না।পুষ্টিকর খাবার খাবেন,আনন্দে থাকবেন,মন আনন্দে থাকলে শরীরেও তার প্রভাব পড়বে।তনিমা ওঁর হাজব্যান্ড কে ডাকো”,স্বামী কে নিয়ে সমস্যা না বুঝতে পেরে জয়ি ওর সহকারীকে নির্দেশ দেয় অলোক সেনাপতিকে ভেতরে ডেকে নিতে।
অলোককেও জয়ি একই কথা বলে।এমনকি এটাও বলে সমস্যা যে কোনো কারোর হতে পারে,এমন কোনো নিয়ম নেই যে সমস্যা শুধু মেয়েটার।দুজনকেই তাই টেস্ট দেয় কিছু।রাইমাকে কিছু ওষুধ দিয়ে এক সপ্তাহ পর রিপোর্ট নিয়ে দেখা করতে বলে।

সেনাপতি দম্পতি বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দেয় জয়িতা।রাইমা নামটাও এক।রাইয়ের বেবি হওয়া নিয়ে জয়ির কোনো মাথা ব্যাথা নেই।অনেক পরের কথা সেটা।কিন্তু রাইয়ের হাই রিস্ক মাঝে মাঝে ওকে ভাবায়।রেগুলার চেক আপে রাখা হয় মেয়েটা কে,তাও দুশ্চিন্তা কিছুতেই পিছু ছাড়েনা।
আজ রণ রাইকে নিয়ে বিয়ের মার্কেটিংয়ে গেছে,কি খুশি ছিল দুজনে।ছমাস আগেও রাই মনমরা থাকতো,কিন্তু রণ আস্তে আস্তে ভালোবাসা দিয়ে ওকে অনেক স্বাভাবিক করে দিয়েছে।
জয়ন্ত একদিন বলে ফেলেছিল রাইকে কিছুক্ষন ফ্ল্যাটে একা চেয়েছিল রণ মাস ছয় আগে।মেয়েকে রোগমুক্ত হওয়ার পরও দিনদিন মানসিক ভাবে চুপচাপ হয়ে যেতে দেখছিল জয় চোখের সামনে।রেশমার মৃত্যুর শক থেকে ফিরিয়ে আনা রণকে ওইটুকু পারমিশন দিতে জয় চিন্তা করেনি পাঁচ মিনিটও।
উঠে পড়ে জয়ি চেয়ার ছেড়ে।আজ রাই কে বাড়ি নিয়ে আসতে বলেছে জয়ি।জয়ন্তও আসবে রাতে,একসাথে ডিনার করে ফিরে যাবে ওরা।বাড়ি ফিরে একটু রান্নায় তদারকি করতে হবে জয়িকে।
জয়ি গাড়িতে উঠে একবার ঋষি আর একবার জয়ন্ত কে ফোন করে নেয়।আজ যা কিছু বিয়ের আলোচনার বাকি ফাইনাল করে নিতে হবে।
রাইয়ের শরীরের চিন্তা ওদের সবার থাকলেও বিয়েটা সবাই ধুমধাম করেই দিতে চেয়েছিল,কিন্তু রণর জেদের কাছে শেষ অবধি হার মেনে নেয় সবাই।রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে রিসেপশন এটাতেই আপাতত সব মত এক হয়েছে।
কোর্ট ম্যারেজ সেরে মন্দিরে গিয়ে সিঁদুর দান আর মালা বদল করে ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে ছেলে মেয়ে দুটো নতুন জীবন শুরু করুক এটাই জয়ি চেয়েছে অতিরিক্ত চাহিদা হিসেবে।
সেটাতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে রাই।ও বুঝতে পারছে ওর শরীরের চিন্তা করেই সাত পাকে ঘুরে নারায়ণ শিলা সাক্ষী রেখে বিয়ে সম্ভব না।ওর মায়ের মতোই খুব আটপৌরে ভাবে না হলেও ওর বিয়ে হবে শুধু সমাজ কে জানাতে,তাও মন্দিরে যাওয়ার ব্যাপারটায় ও সবচেয়ে বেশি খুশি।
রণ চেয়েছে খুব হালকা মেকআপে সেদিন রাই গিয়ে দাঁড়াবে অতিথিদের সামনে।ওর ওই মারণ রোগের ভয় রণকে আজও পিছু ছাড়েনি,তাই হয়তো এই সিদ্ধান্ত।কিন্তু সেই ভয় কি আদৌ কারোর পিছু ছেড়েছে?

রাইমা রণকে কতটা ভালোবাসে জয়ি বুঝেছে রাইয়ের সব কিছু মেনে নেওয়া দেখে।রণর মুখের ওপর কোনো প্রতিবাদ তো করেনি উল্টে চুপচাপ মেনে নিয়েছে সবটা।শুধু এই বিয়ের ক্ষেত্রে না জীবনের বাকি সব সিদ্ধান্তেও।
আর রণ! এই তিনবছরে প্রতিটা দায়িত্ব পালনে রণ প্রমান করে দিয়েছে বিয়েটা শুধু সামাজিক আইনি স্বীকৃতি, এটা বুঝতে জয়ি-ঋষি-জয়ের কোনো দ্বিমত নেই।তাই রাইকে ফ্ল্যাটে রণর কাছে একা ছেড়ে আসলে জয়ন্ত দুবার ভাবেনা।

চিন্তা গুলো আজকাল মাথায় সারাক্ষন ঘুরপাক খায়।শুধু যে বয়সের কারণে তা না,রাইয়ের ওই অসুস্থতা বড্ড নড়বড়েও করে দিয়েছে জয়িকে।ওই আতঙ্ক থেকে আজও ও মুক্ত হতে পারেনি।কারণ হয়তো রাইয়ের হাই রিস্ক।রাইয়ের চিন্তা তো আছেই,তারসাথে রণর চিন্তাও কিছু কম নেই।ও যে এত ভালো রেজাল্ট করে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করবে জয়িতা আশা ও করেনি।
সত্যি বলতে রণকে নিয়ে আজকাল জয়ির খুব গর্ব হয়।ডাক্তার রণজয় কে নিয়ে না,মানুষ রণ কে নিয়ে।রণর ভালোবাসা একটা প্রাণকে বাঁচতে বাধ্য করেছে,শুধু ওর জন্যেই বেঁচে আছে রাই, এটাই জয়ির বিশ্বাস।

“জয় তুই বল তোর কিছু আলাদা ইচ্ছা আছে রাই-রণর বিয়েকে ঘিরে?” ঋষি নিজের আইপ্যাডে সব ডিটেইলস নোট করতে করতে জয়কে প্রশ্ন করে।
“না।কারণ রাইয়ের জন্যে রণর থেকে বেস্ট আর কেউ ভাবতে পারবে না,আমি রাইয়ের বাবা হয়ে বলছি”,জয়ন্ত পাশে বসা রণর পিঠে চাপর মেরে বলে।
লজ্জার হাসি হেসে রণ মুখ নিচু করে নেয়।জয় আঙ্কেল ওকে যে কতটা ভরসা করে ও সেদিন বুঝেছিলো।

অনেক ভেবে রণ বুঝতে পেরেছিল রাইয়ের দিন দিন ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কারণ।সুস্থ হওয়ার পরও ওর মনের এলোমেলো চিন্তা গুলো কিছুতেই ওকে স্বাভাবিক হতে দিচ্ছিল না।রণ দু একবার রাইয়ের অন্তরঙ্গ হতে চেয়ে বুঝতে পেরেছিল।
সেদিন দুপুরবেলায় রণকে দরজায় দেখে রাই খুশি হওয়ার বদলে চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে।

রণ ওকে অনুসরণ করে ওর ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখেছিল রাই চুপ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
রণ সব কিছুর জন্য তৈরি হয়ে এগিয়ে গিয়েছিল রাইয়ের দিকে।
পুরোনো সময়ের মত রণ পেছন থেকে রাইয়ে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে সরাসরি তাকিয়েছিল আয়না দিয়ে ওর দিকে।
“রণদা আমি নিজের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছি।বারবার মনকে বোঝানো স্বত্ত্বেও মাথা খালি বলছে বড্ড স্বার্থপর আমি।কোনো অধিকার নেই তোমার জীবনটা এতটা জটিল বানানোর।নিজের স্বার্থে তোমার জীবন নষ্ট করার দোষ সারাজীবন বইতে পারবো না আমি”,খুব ক্লান্ত ভাঙা গলায় রাই কথা গুলো বলে।
রণ যেন রাইয়ের কথাগুলো আগেই জানতো এভাবে উপেক্ষা করে নিজের মুখটা রাইয়ের ঘাড়ে পিঠে আলতো করে বুলোতে থাকে।কেঁপে উঠে রাই রণর এতদিন পরের স্পর্শে।রণর হাবভাব কেমন যেন অচেনা লাগে ওর।
“কি হলো কিছু বলছো না?” রাই অধৈর্য্য হয়।
“রাই, আমি তোকে আজ পুরোপুরি চাই।যখন যে মুহূর্তে তোর কষ্ট বা অসুবিধা হলে আমায় বলবি”,রণ সরাসরি কথাগুলো বলে রাইকে আদর করতে করতে।

“রণদা…”,রাই একদিকের ভালোলাগার আবিষ্ঠে, অন্যদিকে রণর কথা শুনে চোখ বন্ধ করে কাতরে ওঠে।
“উমমম রাই বললাম না শুধুমাত্র খারাপ লাগলে,বা কষ্ট নাহলে আজ তুই আমার আটকাবি না।আর তোর কিসের সমস্যা! আমায় বিয়ে না করলে আর কোনোদিন তো অন্য কাউকে করবি না”,কথা বলতে বলতে রণ রাইকে হঠাৎ ঘুরিয়ে নিজের দিকে করে ওর ঠোঁটে নিজে ঠোঁট চেপে দেয়।
সেই সময়ের দীর্ঘ চুম্বন রাইকে এক অদ্ভুত শান্তি দেয়।রণকে বাধা দেওয়ার বদলে ওকে আরো নিজের দিকে টেনে নেয় ও।
রাই বাড়িতে সেদিন শার্ট পড়েছিল যেন রণকে সুবিধা দিতেই।রাইয়ের সাহায্য ছাড়াই রণ রাইয়ের সাথে নিজেকেও উন্মুক্ত করে ফেলে।তারপর রাইকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে।রাইয়ের খোলা শরীরে রণর অনভ্যস্ত হাত ঘুরতে ঘুরতে বুকের ওপর এসে থামে।
শিউরে ওঠে রাই বৃন্তবিহীন বুকে রণর হাতের স্পর্শে।কিন্তু রণ থামেনা।নিজের পরীক্ষার কথা ভুলে ও সত্যি ডুবে যায় রাইতে।কোনো ব্যাথা না দিয়েও অনুভূতি দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে থাকে রাইকে।একটা সময় রাই রণর আদরে ভুলেই যায় ও একজন অসম্পূর্ণ নারী ওর নিজের চোখে।উল্টে রণর স্পর্শ দিয়ে ও নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবতে শুরু করে।
একসময় রাইও ভুলে যায় সব কিছু,শুধু রণর মধ্যে হারিয়ে যেতে চায় প্রানপনে।শরীরের ক্ষতকে অগ্রাহ্য করে রণ রাইয়ের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে সফল হয় ওর পুরোনো নারীকে।যে নারী ওকে আনন্দ দিত, যে নারী ওকে করতো তৃপ্ত,যে নারী শুধু মাত্র ওর সামনে নিজের সবটা উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ছিল।
সমস্ত প্রটেকশন নিয়ে রণ নারী পুরুষের আদিম খেলা যখন শেষ করলো ক্লান্ত রাই রণর বুকে শান্তিতে চোখ বুজে ফেলেছে।এত শান্তি যে শরীরের ভালোবাসায় হয় রাইয়ের কোনো ধারণাই ছিলোনা।সব শেষে আরামে,আনন্দে,মনের মধ্যেকার লুকিয়ে থাকা ভয়ের মৃত্যুতে কেঁদে ফেলে রাই রণর বুকে।
রাইয়ের এক চিলতে বিছানায় রাইকে বুকে জড়িয়ে বেডশিটের তলায় শুয়ে থাকা রণ আলতো করে রাইয়ের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,”আমি রোজ রাতে তোকে দেখি।আগের মতোই এখনও তোকে ভেবেই উত্তেজিত হই।আজ আমি তোকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম শরীরটাও মনের নির্দেশেই চলে।তাই মনে মনে তুই নিজেকে সব দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভাববি।তুই কেন ভুলে যাস রাই আমার জীবনে আর দ্বিতীয় কোনো নারী নেই? তোর কাছেই ভালোবাসা শুরু,তোর কাছেই শেষ।আর সেই ভালবাসা এত ঠুনকো না যে এত সহজে কমে যাবে।রোজ তোকে নতুন করে ভালোবাসি আমি।আজ যেমন তোর এই ফ্যাকাসে গোলাপি ঠোঁটটা বড্ড বেশি টানছিল,কোনোদিন তোর খোলা বুকটা টানে,সেটা শুধু শারীরিক শান্তির জন্যেই না মনের শান্তির জন্যেও।তোকে ভালোবাসি রাই, ভালোবাসি তোকে সেদিন থেকে যেদিন ভালোবাসার মানে বুঝেছি।আমার কাছে ‘ভালোবাসা’ আর ‘রাই’ সমার্থক শব্দ।তোর মুখের হাসিটা যে বড্ড দামি আমার কাছে।তাই সব ভুলে শুধু এটা মনে রাখ তুই না হাসলে আমি সবচেয়ে খারাপ থাকি।তুই শুধু আগের মত হাসতে থাক।বাকি সব আমি সামলে নেব।তুই সব ভুলে যা শুধু আমাকে ছাড়া।মনে রাখ, আজীবন মনে রাখ রণ রাইকে ছাড়া মরে যাবে।তাই শুধু আমার জন্যে তোকে বাঁচতে হবে।সেই বাঁচায় যদি শুধু আমি আর তুই থাকি সারাজীবন তাতেও আমার কোনো দুঃখ নেই।কিন্তু রাই ছাড়া রণ থাকবে না।কারোর জন্যে না।আরে আমার অলরেডি একটা পুতুল আছে,আমি শুধু তাকে ভালো দেখতে চাই।কেন সে বোঝেনা? বল না রাই কেন বুঝিস না তোর প্রানের চেয়ে বড় কিছু নেই আমার কাছে।তোর মুখের হাসির চেয়ে বেশি কিছু লাগবে না আমার তোকে ভালোবাসতে।প্লিজ রাই আগের মত হাস,তোর রণ শুধু তোকে সারাজীবন সাথে চায়।তোর শাসন,তোর ভালোবাসা,তোর আদর টুকু নিয়ে বাঁচতে চায়।সেখানে কোনো শরীর নেই।আর আজ তুই তো বুঝলি শরীর আসলে শুধুই মনের কথা শোনে।কিরে বল?…”, এক টানা নিজের মনে বকতে বকতে রণ খেয়াল করে রাই ঘুমিয়ে পরেছে ওর বুকের গভীরে,বড় শান্তির সে ঘুম।রণ ওই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেও চোখ বুজে ফেলে।

“কিরে রণ কি এত ভাবছিস?” ঋষির ডাকে রণর চমক ভাঙে।মুখ তুলে চোখটা সরাসরি রাইয়ের মুখেই পরে, খুব লজ্জা মেশানো গলায় বলে,”বাবা আমি রিসেপশনে দুদিন পর রাইকে নিয়ে কোনো পাহাড়ে কদিন যেতে চাই।তোমাদের আপত্তি নেই তো?”
চোখ গোল গোল করে তাকায় রাই।কিন্তু ঋষির কথায় রণর চোখও গোল হয়ে যায়,”হ্যাঁ বাবা সে নিয়ে ভাবনা আমার।ভেবেছিলাম তোদের সাথে নিজের সেকেন্ড হানিমুনটা সেরে আসবো, কিন্তু তোর মা বেঁকে বসেছে।অগত্যা তোদের জন্যেই সিমলার টিকিটটা কেটেই ফেলেছি।মানে সিমলা ট্যুর,টিকিট অনেকগুলো।” ঋষির হাসিতে জয়ন্ত আর রণ যোগ দিলেও দুজন মেয়ের মুখে প্রকাশ পায় দুরকম অভিব্যক্তি।
রাই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়,কিন্তু ‘সেকেন্ড হানিমুন’ প্রসঙ্গ ওঠায় কৃত্রিম রাগের মুখ করে জয়িতা।
হাসি ঠাট্টা আনন্দে অনেকদিন পর গমগম করতে থাকে ‘মুখার্জী ভিলা’।

অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায় রাইয়ের।আজকের সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে এমনি ক্লান্ত ছিল বলে রণদের বাড়ি থেকে ফিরে জামাকাপড় বদলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কিন্তু আজকাল রাতে বড্ড গলা শুকিয়ে যায়।গলা শুকিয়ে আজও ঘুম ভেঙে জলের বোতল হাতে নিয়েই বুঝতে পারে জল নেই।
ধুর আজ তো শোয়ার আগে বোতলে জল ভরাই হয়নি।
কিন্তু গলা শুকিয়ে জিভ টেনে ধরছে।উঠে পড়ে রাই বিছানা ছেড়ে।ঘুম চোখে টলতে টলতে যাহোক করে শরীরটা টেনে নিয়ে যায় রান্নাঘরের ফিল্টারের সামনে।
জল ভরে ফিরে আসছে নজর যায় বাবার ঘরে,একি এত রাতে বাবার ঘরে আলো জ্বলছে কেন! জেগে আছে নাকি আলো জ্বেলেই ঘুমিয়ে গেছে?
ততক্ষনে ঘুমের ক্লান্তি থাকলেও মাথা কাজ করায় ঘুমের ঘোরটা কেটেছে।
কিছুটা কৌতূহলেই বাবার ঘরে গিয়ে দরজাটা আওয়াজ না করে খোলে ও।
অবাক হয়ে দেখে, ওর মায়ের ছবির ঠিক নীচে বাবার স্টাডি টেবিলে মাথা নিচু করে বসে আছে ওর বাবা।টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে না জেগে বুঝতে পারেনা ও,হঠাৎ মাথা ঘোরায় জয়ন্ত দরজার দিকে।
অপ্রস্তুত রাই মুখে একটা হাসি টেনে বলে,”জল ভরতে এসে দেখলাম তোমার ঘরে আলো জ্বলছে,তাই…”।
-“ঘুমোসনি এখনো?” অবাক জয়ন্ত রাইকে কথা শেষ করতে দেয় না।
-“না না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।জল তেষ্টা পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল।আজ বোতলে জল ভরিনি”।
-“তুই অতক্ষন ভারী বোতল ধরে থাকিসনা।ভেতরে আয় না”,বাবার কথায় রাই আবার কিন্তু কিন্তু করে বলে,”তুমি ঘুমোবে না?”
কিছুক্ষন চুপ থেকে জয়ন্ত বলে,”ঘুম আসছে না রে।তাই তোর মায়ের ফটোর কাছে এসে বসেছিলাম”।
বাবার গলার বিষাদ রাইয়ের কানে ধরা পড়ে,পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় বাবার চেয়ারের কাছে।হাতের বোতলটা টেবিলে রেখে দূরের সিঙ্গেল খাটে বসে।
“আজ তোর মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে রাই।আমাদের বিয়ে তো শুধু আইনের খাতায় হয়েছিল।তোর মা বা আমি কেউ বিশেষ ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতাম না বলে সিঁদুর পরানো বা মালা বদল কিছুই বিশেষ হয়নি।তোর মায়ের সারাজীবন ইচ্ছা ছিল তোকে নিজের পায়ে দাঁড় করাবে, কিন্তু বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন যে ছিল না তা না।শুধু একটা কথাই বারবার বলতো,’একটাই শর্ত ছেলেটা কে আমার রাইকে খুব ভালোবাসতে হবে’।রণ কে দেখলে তোর মা কি যে খুশি হত।”
একটু থেমে আবার জয় বলতে শুরু করে,”জানিস রাই মেয়ের জন্মের পর বাবা মার মনে কোনো না কোনো ভাবে একটা অনিশ্চয়তার জন্ম হয়।তার হৃদয়ের টুকরো ভবিষ্যতে কার হাতে গিয়ে পড়বে! যদি তাদের মত যত্ন সেই বাড়িতে,সেই ছেলেটার কাছে না পায়।একটা চিন্তা,একটা জীবনের ভাবনা।সত্যি বলতে আজও আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়ের গুরুত্ব এক হয়নি,কবে হবে জানিওনা।কিন্তু মেয়ের মা বাবার ভালোবাসা কি কম হয় বল!!
রণকে যেদিন প্রথম এ বাড়িতে দেখি প্রায় ছ’বছর আগে ওর চোখে একটা মায়া,এক ভালোবাসা দেখেছিল আমার অভিজ্ঞ চোখ।কিন্তু আজকের রণর চোখে আমি ভালোবাসা ছাড়াও যে দায়িত্ব,যে আগলে রাখা দেখি আমায় অদ্ভুত শান্তি দেয়।সত্যি বলছি রাই বাবা মা যখন দেখে তার চেয়েও বেশি তার মেয়েকে কেউ ভালোবাসছে,বিশেষ করে মেয়ের লাইফ পার্টনার,মনটা ভরে ওঠে।তোর মায়ের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে এটাই আমার শান্তি।ছেলেটার সবসময় চিন্তা শুধু তোকে নিয়ে।আমি নিশ্চিন্ত।তোকে নিয়ে আর আমার চিন্তা নেই”,আবেগে গলা ধরে আসে জয়ের।
মেয়ের বিদায়ক্ষণ যে এগিয়ে আসছে জয়ের কথায় তা ধরা পরে।
এতক্ষন চুপচাপ বাবার কথা শুনতে থাকা রাই বুঝতে পারে রণর প্রতি বাবা ভরসা,ভালোবাসা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে।একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ওর নিজের মনও ভরে যায়।রণদা যে কতটা ভরসা ওর কাছে ও অনেক আগেই তো সেটা বুঝেছিলো,তাই তো প্রকৃত ভালোবাসা বুঝতে দেরি হলেও ও ফিরে এসেছিল রণর কাছেই।আজ অন্য কেউ রণর জায়গায় থাকলে ওকে ছেড়ে দিয়েই চলে যেত।

মুখে কিছু না বলে রাই বলে,”শুয়ে পরো বাবা।আমি খুব ভালো থাকবো।তুমি চিন্তা কোরোনা।”
“দূর পাগলী এটা কি চিন্তা নাকি?এটা তো শান্তি।রণকে আমি মনে প্রানে আশীর্বাদ করি ওর মনস্কামনা সব সময় পূরণ হোক।তাহলে তুই সবসময় ভালো থাকবি।ওর সব মনস্কামনা তোর কাছে গিয়েই শেষ হয়।”

বাবার মুখের শান্তি রাইয়ের মন আর্দ্র করে দেয়।ঘুমের ঢুলুনিতে চোখ বুজে আসতে চাইলেও রাই ঘুমচোখে তাকিয়ে থাকে জয়ন্তর দিকে।
“নিজের পার্টনার যখন ছেড়ে চলে যায় জীবন কতটা দুর্বিসহ হয়ে যায় আমার থেকে ভালো কে জানে বল।কোথাও সে নেই।কিছু বললে কেউ উত্তর দেবে না,ঝগড়া করলে জবাব দেবে না,কাঁদলে ভোলাবে না,শরীর খারাপে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেনা।সর্বোপরি কোথাও গিয়েই তাকে দেখতে পাবো না।উফফ! কি যে অসহ্য সে কষ্ট।তাই রণর কষ্টটা আমি বেশি বুঝেছিলাম।হয়তো ওর কষ্টটাও উপলব্ধি করেছিলাম বেশি।”
হঠাৎ জয়ের চোখ পড়ে রাইয়ের দিকে,আহা মেয়েটা একটু দুর্বল হয়ে গেছে আগের থেকে,ঘুমে ঢুলে যাচ্ছে।
“যা রাই যা ঘুমিয়ে পর।আমিও ঘুমোই এবার।”
“হমম বাবা গুড নাইট।কাল কথা হবে।ঢুলতে ঢুলতে জয়ের ঘরের দরজা খুলতে যায় ও।
জয় ওর টেবিলে রাখা জলের বোতলটা নিজেই তুলে নেয়।থাক মেয়েটার হাতে দিয়ে কাজ নেই।রাইকে এক হাতে ধরে বলে,”চল তোকে শুইয়ে দিয়ে আসি।ঢুলছিস তো তুই”,মিষ্টি হাসি ফোটে রাইয়ের ঠোঁটে।
বাবার বুকে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে নিজের বিছানায় গিয়ে শোয়ার সাথে সাথেই তলিয়ে যায় ঘুমে।
জয়ন্ত মেয়ের কপালে ঠোঁট ঠেকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘরের বড় আলোটা সুইচ অফ করে দেয়।
বেরিয়ে আসে জয় রাইয়ের ঘর থেকে।
নিজের ঘরে ঢুকে আবার রেশমার ফটোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।আজও চোখ বুজলে দেখতে পায় রাই-রেশমার আনন্দের মুহূর্ত গুলো।কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল মেয়েটা।
রেশমা ফটোটা সালোয়ার সুট পরা এক রাজকন্যার ফটোর মতো,যার ঠোঁট দিয়ে চুইয়ে পড়ছে হাসি,জয়ন্তর বড় প্রিয় ছবি।তাই রেশমা মারা যেতে এটাই বাঁধিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলো ও,যা আজ একই রকম চকচকে আছে।
মনে মনে রেশমা কে গুড নাইট করে বিছানায় এসে শরীর ছেড়ে দেয় জয়।
চোখ বুজে আসে শান্তির ঘুমে, আর সেই মুহূর্তে অনুভব করে একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ নিজের কপালে।এতদিন প্রতিটা শান্তির ক্ষণে এই হাতের স্পর্শ ও অনুভব করেছি।কে বলে রেশমা নেই,রেশমা আজও বেঁচে আছে জয়ন্তর মনে,অনুভূতিতে।
ঘুমিয়ে পরে জয় কয়েক মুহূর্তে।

ক্রমশ…