মাই এক্স পর্ব-০১

0
1006

মাই এক্স (প্রথম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি

আজকে শেলির বিয়ে। শেলি হচ্ছে আমার বান্ধবী। অন্ততঃ কলেজের দিনে ছিল। কলেজে আমাদের যে গ্রুপ ছিল, সেই গ্রুপের একজন। এটা অবশ্য ওর প্রথম না। সেকেন্ড বিয়ে। প্রথমটা খুব বেশিদিন টেকেনি। কার দোষ তা নিয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারব না। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ডিভোর্স হয়ে যায়।
আমাদের গ্রুপের সব মেয়েই দেখতে সুন্দরী ছিল। খুব না বলেও, মোটামুটি টাইপের তো অবশ্যই। বাট নট লাইক মি। আই ওয়াজ দ্যা বেস্ট। নাহ, বাড়িয়ে বলছি না। ইটস ফ্যাক্ট। সবাই এমনটাই বলত। শেলিও দেখতে খারাপ ছিল না। কিন্তু ঐ যে বললাম, ‘মোটামুটি’র আশেপাশে ছিল। বিচ্ছিরী না, আবার আহামরি কিছু সুন্দরীও না। মোর দ্যান অ্যাভারেজ বলা যায়। বাট পড়াশোনায় ভাল। মাস্টার্স শেষে চাকরীও শুরু করেছিল। দেন বিয়ে।
আর আজ, দ্বিতীয় বিয়ে। বাজেট ঘাটতি ছিল কি না জানি না, তবে অনুষ্ঠানটা ছোট্ট পরিসরে করেছে। খুব বেশি কেউ আসেনি। কিছু ক্লোজ রিলেটিভ আর আমরা ক’জন বন্ধু। ক’জনের ভেতরে আমরা মেয়েরা সবাই ম্যারিড। সবাই স্পাউস সহই এসেছি।
ইদানীং শেলির সাথেই সম্পর্ক কিছুটা পাতলা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বান্ধবীদের ভেতর যেকজন চাকরি করছে, তার মধ্যে ও একজন। তাই বোধহয়, আড্ডা মারা কিংবা গল্প করার মত সময় ওর হাতে তেমন থাকত না। থাকবেই বা কি করে। ব্যাংকের চাকরী । বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ছটা।
ডিভোর্সের পর থেকে থাকত ভাইয়ের বাসায়। প্রথমে অবশ্য ভাবী বাহিনী বেঁকে বসে। ভয় পেয়েছিল, এই মেয়ে একবার ঘরে ঢুকলে, সারাজীবন পুষতে হবে। কিন্তু লাভ হয়নি। শেলির মা’র জন্যবের করে দিতে পারেনি। উনি এখনও জীবিত, আর বাড়ীটাও সম্ভবতঃ উনার নামে। সো, অ্যারেঞ্জমেন্ট ছিল, থাকতে পাবে তবে খাওয়া নিজের। মা অন্য ঘরগুলো ছেলেদের দিলেও নিজের জন্য একটা রুম রেখেছিলেন। সেই রুমে, মা মেয়ে দুজন থাকত। অফিস থেকে ফিরেই রান্নাবান্না অ্যান্ড অল দ্যাট। গল্প গুজব আর করবে কখন?
সম্পর্ক পাতলা হবার আরও একটা কারণ হয়তোবা ডিভোর্স। কিছুটা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগত। দেখা হলে সবাই ‘আহারে’ টাইপ একটা জেস্টার দিত। সহানুভুতি দেখাবার নাম করে আসলে চিমটি কাটত। ডিভোর্সের পর থেকে তাই সবাইকে একরকম অ্যাভয়েড করেই চলত শেলি।
বিয়েটা অবশ্য সেকারণে অ্যাভয়েড করতে চাইছিলাম না। আসলে আমার এখন যা স্ট্যাটাস, তাতে এমন ছোটখাট বিয়ে অ্যাটেন্ড করা আমাকে মানায় না। আমার হাজব্যান্ড একটা কোম্পানীর বেশ সিনিওর ম্যানেজার। লাখের উপরে বেতন। ঢাকায় নিজের বাসা আছে। দুজনের জন্য দুটো আলাদা গাড়ী। এধরনের ছোটখাট কমিউনিটি সেন্টারে লাস্ট কবে এসেছি, মনে করতে পারি না। যাইহোক… তারপরও এসেছি।
কিছুটা এসেছি, শেলি অনেক করে বলেছে বলে। না আসলে মন খারাপ করত। অ্যানাদার কারণ হচ্ছে, আজকে সব বন্ধুরা আসবে। দাওয়াত দেয়ার সময় শেলি বলেছিল, সব বন্ধুদের ডেকেছে। শেলি আমার কলেজেরও বন্ধু। আশা করা যায়, অনেকদিন পরে কলেজ আর ইউনিভার্সিটির বেশ কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা হবে। অনেকটা সে কারণেও আসা।

আমাদের বান্ধবীদের, মানে ইউনিভার্সিটিতে আমরা যারা একসাথে পড়তাম, তাদের সবারই বিয়ে গেছে। অ্যাটলিস্ট আমার জানামতে। ছেলে বন্ধুদের ভেতর দু’একজনের হয়েছে। বিশেষ করে যারা ক্লাসমেটের সাথে প্রেম করত, তাদের। উপায়ও ছিল না, প্রেমিকার বয়স হয়ে যাচ্ছে। সো তেমন ভাল কোন চাকরী না থাকলেও বিয়ে করে ফেলেছ।
বাকী ছেলেদের ভেতরও কেউ কেউ করেছে। স্পেশালি যারা ভাল চাকরী জুটিয়েছে কিংবা শ্বশুর জুটিয়ে দিতে চেয়েছে, তাদের। চাকরী বাকরী যারা পায়নি, তাদেরও কেউ কেউ করেছে, তবে বেশিরভাগই এখনও ব্যাচেলার।
পুওর গাই। ওদের দেখে মায়াই লাগে। একটা ভাল চাকরীর জন্য কেমন হন্যে হয়ে ঘুরছে। কেউ কেউ রিকোয়েষ্ট করে, ‘তোর বরকে বল না, আমার জন্য যদি একটু রিকোয়েস্ট করে দেয়’। কিছু হেল্প করি না যদিও, তাও ‘হ্যাঁ বলব’ টাইপ কিছু বলে আশায় রাখি। ভালোই লাগে। নিজেকে কেমন কেউকেটা মনে হয়।
অনুষ্ঠানে আসলে বেশ খানিক্ষণ আগেই এসেছি। বিয়ে তো আগেই হয়ে গেছে। নিজেরা কোর্টে গিয়ে সেরে ফেলেছে। এটা অনেকটা রিসেপশান টাইপ অনুষ্ঠান। আমরা যারা ঢাকাতে আছি, তাদের ভেতর প্রায় সবাই এসেছি। বেশিরভাগই আমার মত, সবার সাথে দেখা হবে, এই জন্যই এসেছে। অনেকদিন পরে এমন কোন গেট টুগেদার টাইপ অনুষ্ঠান হল। সবাই তাই ট্রাই করেছে আসবার জন্য। কেবল খাওয়া সারলাম। এদিক ওদিক ঘুরছি। আমাদের গ্রুপের বেশ কয়েকজন বান্ধবীকে দেখলাম জটলা করে গল্প করছে। ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম।

এই ফাঁকে আমার পরিচয়টা একটু দিয়ে নিই। আমি তৃণা। এমবিএ। ফাইনান্স ছিল মেজর। তবে ঐ পর্যন্তই। সুন্দরী মেয়েদের যা হয়। মাস্টার্সে থাকতেই ভাল ভাল প্রস্তাব আসা শুরু করে। আমারও ব্যতিক্রম হয়নি। এরপরে শুরু হয় বাছ বিচার। সেখান থেকে অবশেষে সিলেক্টেড হয় শাহেদ। পরের ঘটনা গতানুগতিক। ঘটা করে বিয়ে অ্যান্ড সংসার যাত্রা। অ্যান্ড, আপাততঃ হাউজওয়াইফ। চাইলেই চাকরী করতে পারতাম, বাট কে করে। পায়ের ওপর পা তুলে খাচ্ছি, শপিং করছি, কিটি পার্টি করছি, আর কি চাই?
বিয়ের বছর দেড়েক হয়েছে। এখনও কোন ইস্যু হয়নি। নিচ্ছি, নিব করছি। যেকোনদিন হয়তো জানব…। নিজের সম্পর্কে বলার মত কথা ঘুরে ফিরে একটাই, ‘অপূর্ব সুন্দরী’। অপূর্ব মানে আসলেই চোখ ধাঁধানো যাকে বলে। যেমনটা হলে কবি সাহিত্যিকরা, রুপের বর্ণনা দিয়ে কবিতা টবিতা লেখে, তেমন টাইপের।
প্রতিটা ফ্রেন্ডগ্রুপে এমন একজন থাকে না, যাকে বাকী বান্ধবীরা বেশ হিংসের চোখে দেখ। আমি সেই টাইপ ছিলাম। দল বেঁধে হেঁটে গেলে সবার চোখ আমার ওপরই পড়ত। পাড়ার ছেলেগুলোর মনে আগেই ঝড় তুলেছিলাম। কলেজে ঢোকার পরে সেখানেও তুললাম। প্রতিদিনই প্রায় আটটা দশটা প্রস্তাব পেতাম। এরপরে এলাম ইউনিভার্সিটিতে। এখানে ছাত্রদের সাথে সাথে টিচারদেরও মাথা ঘোরালাম।
অ্যান্ড দেন? বললামই তো। ফ্যামিলি থেকে যাচাই বাছাই করে সিলেক্ট করা হল শাহেদকে। ব্রিলিয়ান্ট চ্যাপ। উন্নতি আর দারুণ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে। যেকোন মেয়ের বাবা এমন পাত্র পেলে বর্তে যাবেন। আমারও অমত ছিল না। সো…হয়ে গেল।
জটলার দিকে এগিয়ে যেতেই তারিন প্রথমে আমাকে দেখল।‘তৃণা’ বলে চিৎকার করে উঠল। ভালোই লাগল। বাকী বন্ধুদের ভেতর তিথি, অদিতি, শিউলি আর পরশ এসেছে। শিউলি ডাক্তার। ওর হাজব্যান্ডও ডাক্তার। পরশ ব্যাবসা করে। শুধু তিথি আর অদিতি আমার মতই। হাউজ ওয়াইফ।
শাহেদকেও ডাকলাম। যদিও প্রায় সবাই চেনে, তারপরও আবার পরিচয় করিয়ে দিলাম। আসলে ও পাশে থাকলে, সবাই দেখি আমাকেও বেশ সমীহ করে কথা বলে। মিসেস শাহেদ বলে কথা। ওর স্ট্যাটাসের এই ইফেক্টটা বেশ ভালোই লাগে। মাঝে মাঝে কেন যেন মনে হয়, আমার এই অবস্থার জন্য ওরা আমাকে কিছুটা হিংসেও করে। নাহ, খারাপ লাগে না, এই ব্যাপারটাও আমি এঞ্জয় করি।
শেলি ডাকছে। ইশারায় বোঝাল বর ছাড়া, একা আসতে। আমরা বান্ধবীরা, এগিয়ে গেলাম। শুরু হল আমাদের বান্ধবীদের ফটোসেশান। সামনে যাকে পেলাম, তার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে কিছু তুললাম। বাকী আমরা সবাই নিজেদের মোবাইলে সেলফি তুললাম। এই সুযোগে আমার নতুন আইফোনটাও সবাইকে দেখালাম। ‘ওয়াও, লেটেষ্ট আই ফোন?’ হা হা হা, আই জাস্ট লাভড ইট।
শেলির নতুন হাজব্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার। ভদ্রলোকের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। একটা মেয়ে আছে। শেলির অবশ্য কোন ইস্যু হয়নি। একদিক দিয়ে রক্ষা। বাচ্চা সহ কোন মেয়ের বিয়ে হওয়া রিয়েলি টাফ। বিশেষ করে তেমন সুন্দরী না হলে।
ফয়সাল ভাইয়ের সাথে ডিভোর্সের পরে বেশ সমস্যায় পড়ে যায় বেচারী। নেহাত চাকরী করত বলে রক্ষা।মায়ের জেদে কিভাবে রক্ষা পায়, সেটা তো বললামই। মা মরে গেলে যে কি হত?
যাই হোক, এভাবে বছর খানেক চলার পরে, অফিসের এক কলিগ একদিন এই বিয়ের প্রস্তাবটা আনে। দেখলাম ভদ্রলোককে। নাইস লুকিং। মেয়ে আছে বলেই হয়তো শেলির ব্যাপারে মত দিয়েছেন। আগের পক্ষে বাচ্চা না থাকলে, হয়তো কুমারী মেয়েই খুঁজত। এনিওয়ে, আশা তো করছি এবার বিয়েটা টিকবে। একবার যেহেতু ধাক্কা খেয়েছে, এবার হয়ত শেলিও একটু মানিয়ে টানিয়ে চলবে।
সেলফি সেরে স্টেজেরই একপাশে বান্ধবীরা গল্প করছি। এমন সময় দেখি শেলি হাত নেড়ে আমাকে ডাকছে। এগিয়ে গেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, ওর হাজব্যান্ডের সাথে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ডায়াসে উঠে বুঝলাম, ব্যাপারটা তা না। ওর সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেলে আমাকে মাথা নীচু করতে বলল। কানে কানে কিছু বলবে মনে হচ্ছে। কান এগিয়ে দিলাম।
— সুমনের ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে?
অবাক হলাম। সুমন ভাই বলতে একজনকেই বোঝানোর কথা। ও এখানে এসেছে? বাট হাও? না অন্য কোন সুমন? ভ্রু কুঁচকে শেলির দিকে তাকালাম। আমার অবস্থাটা বুঝল শেলি। চোখের ইশারায় বোঝাল, আমি ঠিকই ধরেছি। হঠাৎ করে বুকটা ধক করে উঠল।
এতোদিন পরে? মুখোমুখি দেখা হলে কেমন লাগবে? একটা ভয়ও কাজ করল। শাহেদ জানতে পারলে কি ভাববে? প্রথম যে রিয়াকশান হল, তা হচ্ছে, দ্রুত এখান থেকে চলে যাই।
ভয়টা বোধহয় আমার চেহারায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সেটা লক্ষ্য করে শেলি বলল
— ভয় পাচ্ছিস কেন?
কিছুটা থতমত খেয়ে বললাম
— নাহ। ভয় পাব কেন?
আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল শেলি। এরপরে স্মিত হেসে বলল
— ওর ফ্রেন্ড।
উত্তরে কি বলব বুঝে পেলাম না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম, এক্ষুণি এখান থেকে বেরোতে হবে। ‘গুড বাই স্মাইল’ দেয়ার চেষ্টা করলাম। হল কি না জানি না। শুধু বললাম
— অনেক রাত হয়ে গেছে রে। ওকে আবার খুব সকাল সকাল বেরোতে হয়।
যা বোঝার শেলি বুঝে গেল। আমাকে আর আঁটকাল না। হেসে বলল
— ফোন করিস।
উত্তর একটা স্মাইল দিলাম। এরপরে যেই ঘুরতে যাব এমন সময় সেই কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম
— তোমার বান্ধবীকে বল আমকেও যেন মাঝে মাঝে ফোন করে।
ঝট করে পেছন ফিরলাম। সামনে সুমন। বুঝতে পারলাম আমার মুখ থেকে সব রক্ত সরে যাচ্ছে।
কখন ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। ঘুরে দাঁড়াতেই আবিষ্কার করলাম আমি আর ও একেবারে মুখোমুখি। একসময় যেভাবে মাঝে মাঝে লেডিস হোস্টেলের দেবদারু গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করেছি, সেভাবে।
ও দেখতে এখনও আগের মতই আছে। সেই হ্যান্ডসাম চেহারা। লাল টাই আর নীল রংয়ের স্যুটে দুর্দান্ত লাগছে। ঠোঁটের কোণে সেই হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— মনে আছে? আমি সুমন, ইয়োর এক্স…
চলবে।