মাই এক্স পর্ব-০২

0
328

মাই এক্স (২য় পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি


গাড়ীতে পুরো রাস্তা আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, নিজেকে স্বাভাবিক রাখবার। পারছিলাম না। আয়নায় একবার নিজেকে দেখলাম। মুখের ফ্যাকাশে ভাব যাচ্ছেই না। ব্যাপারটা এতোটাই অবভিয়াস ছিল যে একসময় শাহেদও জানতে চাইল, ‘এনিথিং রং?’ আমি স্মিত একটা হাসি দেয়ার চেষ্টা করলাম। যার বাহ্যিক মিনিং দাঁড়ায়, ‘তেমন কিছু না’ আর সত্যিকারের মিনিং দাঁড়ায়, ‘আই অ্যাম রিয়েলি ইন ট্রাবল।’ শাহেদকে ফাঁকি দেয়া এতো সোজা না। ও ঠিকই বুঝল, প্রব্লেমে আছি, তবে এই মুহুর্তে বলতে চাইছি না। স্পেশালি ওকে। বাট দ্যা গুড থিং ইজ, ওকে এই মুহূর্তে না বলতে চাওয়ার ব্যাপারটাকে মনে হল অ্যাক্সেপ্ট করে নিল। আর প্রশ্ন করল না।
আমাকে রিল্যাক্স করার জন্যই বোধহয়, দু একবার অন্য প্রসঙ্গ আনবার চেষ্টা করল শাহেদ। ‘শেলিদের একদিন দাওয়াত দেয়া উচিত’ টাইপ টপিক। আমার তরফ থেকে ‘ও হ্যাঁ’ টাইপ সাড়া পেয়ে বুঝে গেল, টপিক সঠিক থাকলেও সময়টা সঠিক না। আর কথা বাড়াল না। আমিও চুপচাপ থাকলাম। তবে এটাও জানি, আজকের বিহেভিয়ারের ব্যাখ্যা ওকে দিতে হবে। আমাকে সন্দেহ করছে, এমন না। ও সিওর আমি দারুণ কোন প্রব্লেমে পড়েছি, আর সেটা থেকে আমাকে উদ্ধারের জন্যই ও ডিটেলস জানতে চাইবে।
বাসায় ফিরে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলাম। রুমে থাকলেই শাহেদ আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। মুখে প্রশ্ন না করলেও, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বুঝিয়ে দেব, ‘টেল মি হোয়াট হ্যাপেন্ড’। এটাই এখন অ্যাভয়েড করতে চাইছি। আর সেটা করবার একটাই উপায়, একটা লম্বা শাওয়ার নাওয়া। শাওয়ারে আমি অনেক সময় নিই, এটা শাহেদ জানে। তাই, ‘খুব টায়ার্ড লাগছে, একটা শাওয়র নেব ভাবছি’ বলে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
আসলে চাইলেও আমি স্বাভাবিক হতে পারব না। ঘন্টা খানেক এখানে কাটানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এখনও আমার ভয়ে হাত পা কাঁপছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কি করব এখন? সুমন যে আমার জীবনে এভাবে ফিরে আসবে, কখনও ভাবিনি।
আজকের পুরো ঘটনা ভাবতে দিয়ে দেখলাম, নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে। কেন আসলাম এই বিয়েতে? শেলির ওপরই বরং রাগ উঠছে। ও যখন জানেই, সুমন আসছে, আমাকে সেটা জানাল না কেন? ও তো জানেই আমাদের ভেতর কি হয়েছিল।
মুহুর্তটা ভেবে এখনও গা কাঁপছে। সুমন যখন বলল
— মনে আছে? আমি সুমন, ইয়োর এক্স…
তখন এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল দম আঁটকে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। উত্তর দিতে গিয়ে দেখলাম কথা খুঁজে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে অবশেষে কেমন করে যেন বললাম
— কেমন আছ?
কথাটা শুনে একটা বাঁকা হাসি দিল সুমন। এরপরে বলল
— সত্যিই জানতে চাও?
বুঝতে বাকী থাকল না, সুমন স্কোর সেটল করার মুডে আছে। চোখে ঘৃণা? না ক্রোধ? বুঝতে পারছি না। ওর দিকে আর তাকালাম না। মন বলছে, অবস্থা সুবিধার না। এরকম অনুষ্ঠানে, সবার সামনে হয়তো সিন ক্রিয়েট করবে না, বাট আমাকে ছেড়েও দেবে না। এমন ভাবে কথা বলবে, যেন সবাই বুঝতে পারে, হি ইজ মাই এক্স। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল। কোন রকমে বললাম
— আমাকে আজকে যেতে হবে। ওর…
— ওর সকাল সকাল অফিস, আমি জানি।
সুমন ওর অবস্থান থেকে সরছে না। বেশ অকওয়ার্ড অবস্থায় আছি আমরা দুজন। একটু দূরত্ব তৈরী করা জরুরী। আমি পিছাতে পারছি না। জায়গা নেই। শেলির কাছে অন্য কেউ এসেছে, ওর পিঠ আমার পিঠের সাথে লেগে আছে। সামনে সুমন এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যে আমিও বেরোতে পারছি না। মুখে কাতর একটা ভাব নিয়ে বললাম
— প্লিজ সুমন। সবাই দেখছে।
ঠোঁট বাঁকা করে একটু হাসল সুমন। এরপরে বলল
— সরে যেতে বলছ?
দ্রুত চিন্তা করলাম। হ্যাঁ বললে, ওর জেদ কি বেড়ে যাবে? আর না বললে? সম্পর্ক তৈরি করতে চাইবে? ফোন নম্বর চাইবে? আর নয়তো…। সিক্সথ সেন্স বলছে, সফটলি ডিল করতে হবে। ওকে রাগানো যাবে না। মুখে হাসি টানবার চেষ্টা করে বললাম
— এসো না একদিন বাসায়।
— সিওর?
সুমনের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম, কথাটাকে ও ফর্মালিটি হিসেবে নিচ্ছে না। ও হয়তো সত্যিই আসবে। মাথা এখন আর কাজ করছে না। এখান থেকে দ্রুত সরে যাওয়া দরকার। কথা বললেই কথা বাড়বে। উত্তরে তাই ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছু বলতেই সাহস পেলাম না। অন্য আলাপের তো প্রশ্নই ওঠে না।এতোদিন পরে ইউনিভার্সিটির অন্য কারো সাথে দেখা হলে এখন কোথায় আছে, কি করে, এতোদিন কোথায় ছিল, এসব প্রশ্ন করতাম। কিন্তু এখন, এসব প্রশ্ন করার কথা ভাবতেও পারছি না। স্বাভাবিক ভদ্রতা টাইপ কিছু না বেরিয়ে মুখ দিয়ে একটা কথাই বেরোল
— আসি?
সুমন কি বুঝল জানি না, তবে কিছুটা সরে রাস্তা করে দিল। আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালাম না। খুব দ্রুত না হলেও স্বাভাবিকের আপার লিমিটে গিয়ে হাঁটতে লাগলাম। সামনের দিকে, আই মিন শাহেদকে যেখানে লাস্ট দেখেছিলাম, সোজা সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম, সুমন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমার ফিরে চলে যাওয়াটা দেখছে। হাঁটার তালে তালে আমার খোলা চুল উড়ছে, কোমর দুলছে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে হয়তো কিছুটা আনন্দ। আমার ভয় পাওয়াটা হয়তো ও এঞ্জয় করেছে।
জানি, ব্যাপারটা এখানেই থামবে না। কি হবে এই মুহুর্তে ভাবতে সাহস পাচ্ছি না। এখন একটাই চিন্তা, দ্রুত এখান থেকে বেরোতে হবে। শাহেদকে শেষ যেখানে দেখেছিলাম ওখানেই আছে। সোজা ওর কাছে এলাম। ও তখন বেশ কিছু শ্রোতা যোগাড় করে ফেলেছে। বেশ খোশগল্পে মত্ত । যথারীতি বাকীরা বেশ সমীহ ভরে শুনছে। অন্য যেকোন সময় হলে, ব্যাপারটা দেখে বেশ পুলক অনুভব করতাম। পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করতাম। বাট এখন? ইম্পসিবল। শুধু তাই না, এই প্রথমবারের মত ব্যাপারটাকে বিরক্তিকরও লাগল। দ্রুত ওর কাছে গিয়ে বললাম
— চল অনেক রাত হয়েছে।
শাহেদ বেশ অবাক হয়ে বলল
— এখনই যাবে?
ওর হাত ধরলাম। চোখের ইশারায় বোঝালাম, ‘আই মিন ইট’। শাহেদ আমার দিকে তাকিয়ে বুঝে গেল, সামথিং ইজ রং। আর তর্ক করল না। ফোন বের করে ড্রাইভারকে ডাকল। এরপরে আমার দিকে তাকাল। বোঝাতে চাইল, ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে সামনে আসুক, তারপরে বেরোই। কি করব, দ্রুত একবার ভাবলাম। এখানে থাকা মানেই সুমনকে আরেকবার সুযোগ দেয়া। দেখা যাবে, এখানে এসে, নতুন কোন সিন ক্রিয়েট করছে। ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। শাহেদের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলাম।
এই বছর দেড়েকের বিবাহিত জীবনে এমনটা কখনও করিনি। শাহেদ যে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, সেটা স্পস্ট বুঝতে পারছি, তারপরও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। কিছু একটা হয়েছে, ব্যাপারটা শাহেদও বুঝল, তবে জানতে চাইল না।
বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার সেরে যখন বেরোলাম, দেখলাম শাহেদ ঘুমিয়ে গেছে। মনে মনে বোধহয় এটাই চাইছিলাম। শাহেদ একটু ঘুমকাতুরে আছে। বিছানায় শুলে, ঘুমাতে সময় লাগে না। মনে হল, বুকের ওপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেল।
একটু সময় পেলে নিজেকে সামলে নিতে পারব। সুমনের আসাটা এতোটাই আচমকা ছিল যে চরম রকম ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ঘটনার আকষ্মিকতা ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার কাজ করেছিল। অনিশ্চয়তা। ‘ও কি করবে’? যেমন ডেসপারেট টাইপের ক্যারেক্টার, সবার সামনে সিন ক্রিয়েট করা ওর পক্ষে অসম্ভব না। আর ওর সাথে আমি যা করেছি, সেটা ভুলে যাওয়ার ছেলে ও না। আমার ধারণা ও ফিরেও এসেছে, সে কারণে।
সন্তর্পণে বিছানায় উঠলাম। শাহেদের ঘুম তেমন পাতলা না যে একটু আওয়াজে উঠে যাবে, তারপরও, আজকে কোন ঝুঁকি নিলাম না। ধীরে ধীরে ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার সময় মোবাইলটা আমি বেড সাইড টেবিলে রাখি। আজ কেন যেন বালিশের নীচে রাখলাম। ভাইব্রেটারে দিলাম। মন বলছে, সুমন আমার মোবাইল নম্বর যোগাড় করে ফেলবে। হয়তো ফোনও করবে।
ফেসবুকিংও মোবাইলেই করি। নোটিফিকেশান দেখার জন্য, শেষবারের মত মোবাইলটা চোখের সামনে ধরলাম। বাটন টিপে স্লিপ মোড থেকে বের করে আনলাম। লকড স্ক্রিনে বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ এসে বসে আছে। কিছু আছে মোবাইল কোম্পানীর প্রমোশানাল ম্যাসেজ, কিছু ফেসবুক ম্যাসেজ। নজর সরিয়ে ফেলতে যাব, এমন সময় নজরে পড়ল আননোন একটা মোবাইল নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজটা। ছোট্ট একটা একলাইনের ম্যাসেজ।
‘আগামীকাল সন্ধ্যে ছ’টায়, কফি হাউজে’

চলবে।