মাই এক্স পর্ব-০৪

0
213

মাই এক্স (৪র্থ পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি


ম্যাসেজটায় যত না নির্দেশনা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল হুমকি। মনে হচ্ছে, আমাদের অন্তরঙ্গ ছবিগুলো আছে ওখানে। যতদুর মনে পড়ে, বেশ কিছু সেলফি তুলেছিলাম। আমার মোবাইলেরগুলো তো অনেক আগেই ডিলিট করে দিয়েছি। মনে হচ্ছে সুমন রেখে দিয়েছিল। এবার সেগুলো দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করবে।
ছবিগুলো দেখার কোন মানে হয় না। জানি কি কি ছবি আছে। সুমনের সাথে সেই অর্থে ফিজিক্যাল রিলেশান হয়নি। মাঝে মাঝে গায়ে হাত টাত দিত। কয়েকবার কিসও করেছে। তবে ঐ পর্যন্তই। একবার প্ল্যানিং হয়েছিল, হোটেলে যাওয়ার, যাইনি। আসলে সাহসে কুলায়নি। বান্ধবীদের ভেতর কেউ কেউ বারণও করেছিল, বেশি বাড়াবাড়ি করিস না। সব মিলিয়ে শরীর খারাপ বলে টলে সে যাত্রা অ্যাভয়েড করেছিলাম।
সুমনের সাথে প্রেমটা হয়েছিল সেকেন্ড ইয়ারে। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে সুমনের প্রস্তাবটা এসেছিল। আর সব প্রেমের প্রস্তাবের মত সেটার ব্যাপারেও ‘নো’ বলে দিয়েছিলাম। আসলে তখন অহংকারে মাটিতে পা পড়ত না। তাই টিচার হোক আর ভাল ছাত্র হোক, সব প্রেমের প্রস্তাবেই নাক শিঁটকিয়েছিলাম। এরপরও প্রায় প্রতিদিনই একটা দুটো আসছিল। কেউ কেউ তো পিছে লেগেই থাকত। গায়ে পড়ে গল্প করতে চাইত। কোন ছেলের সাথে একটু হেসে কথা বললেই, ও ধরে নিত, আমি প্রায় রাজি।
এভাবেই ফার্স্ট ইয়ার কাটল। সেকেন্ড ইয়ারে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হল। আমি ‘দেমাগী’ এমন একটা প্রচারণা হল। ফলে ‘গ্রেপস আর সাওয়ার’ ফর্মুলা শুরু হল। ‘বাজে মেয়ে’ ‘বেশি ঢং’ এসব রটনাও যেমন শুরু হল, তেমনি ‘অমুকের সাথে অ্যাফেয়ার আছে’ টাইপ রটনাও শুরু হল পাল্লা দিয়ে। ফলাফল হল, প্রেমের প্রস্তাব আসায় পড়ল ভাটা।
একদিক দিয়ে ভালোই হল। অনেকদিন পরে একটু সুস্থির জীবন যাপন করতে পারলাম। কিছুটা খারাপও লাগত। এসব প্রেমের প্রস্তাবগুলো আসলে এঞ্জয়ই করতাম। এসময় বেশ কিছু বান্ধবী প্রেম শুরু করে। কারো কারো বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু করে। দু’একটা তো বিয়েই করে ফেলে। কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা ভাব আসল জীবনে।
সুমন তখন মাস্টার্সে। ভাল ছাত্র। রাজনীতি করে। একটা দলের ভিপি ক্যান্ডিডেট। বেশ অনেক মেয়েই ওর জন্য পাগল। কিন্তু ও তখনও কোন ইমোশানাল অ্যাটাচমেন্টে যায়নি। কারো কারো মতে আমার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। তবে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে কখনও ডিস্টার্ব করত না, কেবল পরিচিত এক মেয়েকে দিয়ে একবার জানতে চেয়েছিল, আমি সিদ্ধান্ত রিথিংক করতে চাই কি না। ব্যাস ঐ পর্যন্তই।
এরপরে সেই ঘটনাটা ঘটে। সুমন যে দল করত সেই দলের এক ক্যাডার টাইপ নেতা আমাকে প্রপোজ করল। ছেলেটার নাম খোকন। একটু ভায়োলেন্ট টাইপ প্রপোজাল, সাথে হুমকিও, ‘প্রস্তাবে রাজি না হলে, উঠিয়ে নিয়ে যাবে’। কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। সবাই বলে, সুমনের সাথে দেখা করে ব্যাপারটা জানাতে।
তবে দরকার হয়নি। ব্যাপারটা ভয়ানক আকার নেয়ার আগেই থেমে যায়। ছেলেটা থ্রেট উইথড্র করে। শোনা যায় সুমন ব্যাপারটা ম্যানেজ করে। এর পরে একদিন সুমনের সাথে দেখা করে ওকে ধন্যবাদ দিই। পুরো ব্যাপারটা সুমনের প্ল্যান, না আসল, জানা যায়নি, তবে সেই থেকে শুরু।
এরপরে মাঝে মাঝেই দেখা হত। কখনও লেডিস হোস্টেলে, কখনও ক্যাফেটেরিয়ায়। কখনও বা ডিপার্টমেন্টের প্যাসেজে। আগে দেখা হলে সেভাবে গ্রিট করতাম না, তবে সেই ঘটনার পরে পরিস্থিতি চেঞ্জ হল। দেখা হলে, স্মিত একটা হাসি দিয়ে গ্রিট করতাম। কখনও একা থাকলে ‘কেমন আছেন’ টাইপ কথাও বলতাম।
হঠাৎ করে এই দেখা সাক্ষাৎটা বেড়ে যাওয়া কি কো-ইন্সিডেন্স? মনে হয় না। আমার ধারণা এটা ইচ্ছাকৃত। আমার রুটিন ওর অজানা ছিল না। ফলে আমি যেসব যায়গায় সাধারনতঃ যেসময়ে যেতাম, দেখা যেত সেসব জায়গায় ও আগে থেকেই আছে। শো করত, রাজনীতিরই কোন কাজেই এসেছে। এমনি এমনি থাকত না, ব্যস্তই থাকত। হয় কয়েকজনকে নিয়ে মিটিং করছে, আর নয়তো পার্টির প্রচার করছে।
এরপরে একদিন, জানাল, আমাকে নিয়ে ও ঘুরতে যেতে চায়। তেমন কোথাও না, মেইন রোড দিয়ে, ঘন্টা খানেক রিক্সায় চড়ে ঘুরবে। তখন ইউনিভার্সিটিতে এটাই ছিল প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার স্টাইল। রাজী মানে প্রেম করতেও রাজী। ততোদিনে ওর ক্যারিশমায় আমি অনেকটাই মুগ্ধ হয়ে গেছি। ঘাড় কাত করে জানালাম, রাজী।
সেই ভদ্র, সভ্য মানুষটাই এখন এই চেহারা নিয়েছে, বিশ্বাস হচ্ছে না। বান্ধবীদের সাথে যে আলাপ করব তারও উপায় নেই। বান্ধবীদের ভেতর তিথি ছিল সবচেয়ে ক্লোজ। রুমমেট ছিল। সুমন সম্পর্কে সবকিছু সবচেয়ে বেশি ওর সাথেই শেয়ার করতাম।
আমাদের অ্যাফেয়ারটা অবশ্য স্বীকার করিনি। ‘জাস্ট গুড ফ্রেন্ড’ বলেই চালাতাম। কেউ বিশ্বাস করত, কেউ করত না। তবে ক্যাম্পাসে সুমনের একটা প্রভাব থাকায়, প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলত না।
যাইহোক, যখন আমাদের ‘অস্বীকৃত’ অ্যাফেয়ার শুরু হয়, তখন তো সবাই বেশ ঈর্ষার চোখেই দেখত আমাকে। সুমন যখন লেডিস হোস্টেলে আসত, তখন তো বাকী মেয়েরা কারণে অকারণে বাইরে আসত। আসল উদ্দেশ্য ছিল একনজর সুমনকে দেখা। কখনও ছোটখাট আবদার।
অনেকে ইন্টেরেস্টেডও ছিল। তিথি নিজেও ছিল সেই গ্রুপে। স্বীকার করেনি, আমার ধারণা। আই মিন, আমার সাথে যখন সুমন একটু বেশি ঘোরাঘুরি শুরু করল, তখন ওর চেঞ্জটা দেখে আমি গেস করছি। হোস্টেলে ফিরে আসলেই, আমাকে চেপে ধরত। ‘বল আজকে কি হয়েছে’। কেন এসব প্রশ্ন, আমি জানতে চাইনি। আমার ধারণা, বোঝার চেষ্টা করত, আমরা কতোটা সিরিয়াস। ওর সম্ভাবনা আছে কি না।
তিথির সম্পর্ক এখন যদিও পাতলা হয়ে এসেছে, তারপরও রেখেছি। পাতলা হওয়ার কারণও আছে। ওর হাজব্যান্ড আসলে সিম্পল স্কুল টিচার। অফিসের পরে ব্যাচে প্রাইভেট পড়িয়ে চলে। উঁচু মহলে খুব বেশি আসা যাওয়া নেই। সেজন্য ওর সাথে খুব বেশি কথা হয় না। যেসব পার্টিতে আমি যাই, সেসবে ওর যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। ফোন নম্বর অবশ্য আছে। কথা খুব কমই হয়। আজকে কি করব?
একটু ভাবলাম। ফোন করে কি বলব? সুমন ভাই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে? কি লাভ? কি করবে তিথি? যা একটু হেল্প করার, করতে পারে শেলি। ওর বরের মাধ্যমে যদি একটু রিকোয়েস্ট করে, কিংবা বোঝায়। কিন্তু ও যে মুডে আছে, কথাই তো শুরু করা যাচ্ছে না। ধরেই নিচ্ছে, ওর মাধ্যমে সুমনের সাথে আবার রোমান্স করার মুডে আছি। নাহ, যা করার আমাকেই করতে হবে।
বুয়া জানাল, কাজ শেষ। যাওয়ার সময় কি মনে করে কুরিয়ারের প্যাকেটটা নিয়ে গেল। যাক একটা ব্যাপারের সমাধান হল। সময়ের সাথে সাথে আরেকটা ব্যাপার ঘটল। ভয়টা থিতিয়ে আসতে শুরু করল। মনে হল, অযথাই এতো ভয় পাচ্ছি। কি হত দেখতে পেলে? বলে দিতাম, কোন এক বন্ধু কুরিয়ারে একটা গিফট পাঠিয়েছে। কিংবা মোবাইলটাই যদি দেখতে পায়, বলে দেব মোবাইলটা গিফট করেছে। শাহেদ বড়জোর নেড়ে চেড়ে দেখত। এর বেশি আর কি হত?
দরজা লাগিয়ে ফিরতে ফিরতে ফিল করলাম, অনেকটা নির্ভার লাগছে। রান্নাঘরে ঢুকলাম। চিংড়ির তরকারীটা শাহেদের বেশ পছন্দ। ইদানিং অবশ্য কোলেস্টেরল নিয়ে চিন্তা শুরু করেছে। রিচ ফুড খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে খায়। স্পেশালি আমার রান্না চিংড়িটা ও বেশ পছন্দ করেই খায়।
রান্না দ্রুত সেরে ফেললাম। আজকের মত আর তেমন কোন কাজ নেই। বুয়াটা বেশ কাজের আর বেশ ফাস্ট। ঘর ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে বাসন ধোয়া, কাপড় কাচা ঘন্টা দুয়েকের ভেতর সেরে ফেলে। তাই ও চলে যাওয়ার পরে সত্যিই আর তেমন কোন কাজ থাকে না।
বেডরুমে এসে বসলাম। এই সময়টা সাধারনতঃ ফোনে আর নয়তো টিভি দেখে কাটে। স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা খুব কম হয়। দুপুরে শাহেদ সাধারণতঃ আসে না। তবে চাইলে আসতে পারে। ফোন করে ডাকবো? আমার নিজের মোবাইলটা হাতে নিলাম। এমন সময় নতুন মোবাইলটার দিকে নজর গেল। সেদিকে মনোযোগ দেব না ভাবতে ভাবতেই দেখলাম আমার মোবাইলটা বিছানায় রেখে ঐ মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেলেছি। মেমোরি কার্ডটা কি চেক করব? কি আর হবে। নিজের পুরনো ছবিগুলো দেখা হবে। এই তো? বড়জোর কিছুটা স্মৃতি রোমন্থন হবে। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়বে।
হঠাৎ অন্য একটা ব্যাপার মনে এল। ব্যাপারটা নিয়ে যদি সুমন নোংরামি করেই, তাহলে কি করব? ওর চাহিদা মোতাবেক কাজ? অসম্ভব। কখনই না। তারচেয়ে বরং শাহেদকে সবকিছু জানাব। সম্পর্ক ছিল, এটা অনেক হাজব্যান্ডই আজকাল মেনে নেয়। হয়তো ধরেই নেয়, একটু আধটু এদিক ওদিক হলেও হয়ে থাকতে পারে। সব ডিটেইলে না বললেও ছবি টবি যে তুলেছিলাম, এটা জানাব। কিস য়ের ব্যাপারটাও বলতে হবে। গালে কিস করা অবস্থায় কিছু ছবি ও তুলেছিল।
আগে কেন বলিনি, এর একটা উত্তর দিতে হবে। কি বলব? সরি? বলা যায়। তবে কিছু ব্যাখ্যাও দিতে হবে। ভয় পেয়েছিলাম বলব? না, ‘তোমাকে হারাতে চাইনি?’ খুব বেশি ভাবছি মনে হয়। হয়ত ও জানতেই চাইবে না। নিজের অজান্তেই কখন মোবাইলের ফাইল ম্যানেজারে চলে গেছি, লক্ষ্যই করিনি। দেখলাম একটাই ফাইল। পিডিএফ। এবার সত্যিই অবাক হলাম।
শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিলাম। প্রেমপত্র পাঠিয়েছে? এতো ঢং করে? মুখে হাসি ফিরে এল। শুধু শুধু সুমনকে নিয়ে আজে বাজে ভাবছিলাম। ফাইলটা ওপেন করলাম। মোবাইলটা সাড়ে পাচ ইঞ্চির স্ক্রিন। পড়তে খুব অসুবিধা হল না। এক পেজের একটা ডকুমেন্ট।
পড়া শেষ করে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বুঝতে অসুবিধা হল না, দ্যা রিভেঞ্জ হ্যাজ বিগ্যান।

চলবে