মাই এক্স পর্ব-০৯

0
229

মাই এক্স (৯ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি

ফ্ল্যাটটা ধানমন্ডিতে। রোড নম্বর, বাড়ীর নম্বর, ফ্ল্যাট নম্বর সবই দেয়া ছিল। নিচে সিকিউরিটিকেও সম্ভবতঃ বলা ছিল। ‘কার কাছে এসেছি’ টাইপ কোন প্রশ্ন করা হল না। সোজা ঢুকে গেলাম। কিছুটা গিয়ে হাতের বামে লিফট। টপ ফ্লোর। লিফট উঠছে। ঝোঁকের মাথায় চলে তো এসেছি, এখন কেমন ভয় ভয় করছে। লিফট যখন চলতে শুরু করল, ফিল করলাম, বুকের আওয়াজটা বাড়ছে। কি করব, কি বলব, কিছুই ভেবে আসিনি।
সুমনের সাথে কফি হাউজে দেখা করেছিলাম গতকাল। আর তার চব্বিশ ঘন্টা না পেরোতেই, আজ সকালে ঘটনাটা ঘটে। ভেবে রেখেছিলাম, ব্রেকফার্স্ট সেরে ধীরে সুস্থে কথাগুলো শাহেদকে বলব। শাহেদ যখন ব্যালকনিতে ছিল, আমি তখন এক অর্থে ফ্রি। বুয়া এখন ঘন্টা খানেক থাকবে। কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর মোছা, সব সারতে সারতে ওর এগারোটা বাজে। কেন যেন বুয়া বাসায় থাকতে কথাগুলো বলতে মন সায় দিল না। প্রাইভেসী সমস্যা না, সমস্যা শাহেদের রিয়াকশান। যদি চিৎকার করে ওঠে?
বুয়া এখনও বাকী কাজে হাত দেয়নি। কেবল ঘর মোছা শুরু করেছে। বেডরুম গুলো সেরে ফেলেছে, এখন লিভিং রুম করছে। এটা হলে, থালা বাসন ধোবে। কেমন যেন অস্থির লাগছে। মন বলছে, হাতে সময় কম। যা করার দ্রুত করতে হবে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। বুয়াকে বললাম
— আজ আর কাজ করতে হবে না, তুমি যাও।
বুয়া বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। জানতে চাইল
— বাইরে যাবেন আপা? পরে আসব?
— না। এমনিই।
বুয়া কেমন একটু দুষ্টামির হাসি দিল। এনিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এখন নেই। লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বুয়া বাকী ঘর না মুছে উঠে দাঁড়াল। বালতি নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। আমি ছটফট করছি। এতো দেরী করছে কেন। ভুল হয়েছে, বুয়াকে আজকে দরজা থেকেই বিদেয় করে দেয়া উচিৎ ছিল।
বুয়া ফিরে এল। আমি দরজা খুলেই রেখেছিলাম। বুয়া ‘আসি আপা’ বলে বেরোতেই দরজা লাগিয়ে দিলাম। ব্যালকনির দিকে এগোতে যাব, এমন সময় ঘটনাটা ঘটল। বেল বাজল। বুয়া ফিরে এল না কি? কিছু ফেলে গেছে? এমন আগে কখনও হয়নি।
আমি তখনও লিভিং রুমেই ছিলাম। গতকালের ঘটনার জন্যই বোধহয়, অন্য অপশান গুলোও মাথায় এল। ইন্টারকমে কোন ফোন আসেনি। এর মানে ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার কিংবা অতি পরিচিত কেউ। মন মানছে না। কেন যেন সুমনের কথাটা মন এল, ‘আমি যে পাওয়ার হোল্ড করি…’ ।
বাট সেটা তো একজিকিউট করার দরকার পড়বে আমি ডিনাই করলে। আমি তো এখনও ‘না’ বলিনি। আর ও তো বলেছিল, আমাকে ডিটেলস জানাবে, কোথায় যেতে হবে। হয়তো অযথা ভয় পাচ্ছি। হয়তো দেখা যাবে আম্মা কিংবা ভাইয়া এসেছে। নয়তো বুয়া কিছু ফেলে গেছে। কিংবা কেয়ারটেকার সেদিনের মত কোন আর্জেন্ট চিঠি নিয়ে এসেছে।
এমন সময় শাহেদও ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকল। দরজার দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে আমাকে দেখে থেমে গেল। আমার চেহারা দেখে অবাক হল। হেসে বলল
— সারাক্ষণ এতো ভয় পেলে চলে? দেখ কে।
তারপরও আমার সিক্সথ সেনস বলছে, অশনি সংকেত। আবার বেল বাজল। এবার কেমন যেন ভয় লাগল। আমাকে স্থবির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাহেদ এগিয়ে আসতে গেল। ততোক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। ওকে ইশারায় থামতে বলে, আমি নিজেই ডোর ভিউয়ার লেন্সে চোখ রাখলাম।
তিনজন লোক দাঁড়িয়ে। অপরিচিত। বেশ স্মার্ট সাজ পোশাক।
— জিজ্ঞেস করলাম
— কে?
— শাহেদ চৌধুরী সাহেব আছেন?
নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলাম। মন বলছে, এটা সুমনের কাজ। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম
— কিছু বলতে হবে?
শাহেদ লিভিং রুমে ছিল। আমকে সরিয়ে দিয়ে নিজে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। বলল
— কাকে চান?
তিনজনের ভেতর একজনকে লিডার মনে হল। বাকী দুজন সঙ্গী। লিডার সাহেব শাহেদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল
— আপনিই শাহেদ চৌধুরী?
শাহেদ আড়চোখে আমার দিকে একবার তাকাল। আমার ভীত চেহারা দেখে সম্ভবতঃ কিছু আঁচ করল। এরপরে ‘আপনারা বসুন, আমি আসছি’ বলে ঘুরতে গেল, সুযোগ পেল না। সঙ্গী দুজন দ্রুত এগিয়ে এসে শাহেদকে দুদিক থেকে ধরে ফেলল। শাহেদ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল
— কি করছেন। ছাড়ুন।
এবার লিডার সাহেব একটা রিভলবার বের করে এগিয়ে এল। শাহেদের দিকে সেটা তাক করে শুধু বলল
— আমাদের সাথে একটু হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে। আপনার সাথে কিছু আলাপ আছে।
আমার আর বুঝতে বাকী থাকল না, কি ঘটছে। শাহেদ অবাক হয়ে লোকগুলোর দিকে তাকাল। সবার চেহারাতেই নিষ্ঠুর এক অভিব্যক্তি। শাহেদ এবার আমার দিকে তাকাল। আমি মাথা ওপর নীচে করে ইশারায় বোঝালাম, এটাই তোমাকে বলতে চাচ্ছিলাম। আমার ভীত চেহারা আর ইশারার মানে ও সম্ভবতঃ বুঝল। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা থামিয়ে দিল। হয়তো বুঝল, তর্ক করে লাভ নেই। ওরা যা করতে এসেছে, করবেই। শান্তভাবে শুধু বলল
— বেশ। চলুন।
এবার লিডার সাহেব দেখলাম নরম হলেন। বললেন
— আপনি চাইলে পোশাক পাল্টে নিতে পারেন। তবে আমার লোক পাশে থাকবে।
শাহেদ আর কোন কথা বলল না। একজন লোকসহ আমাদের বেডরুমে গেল। আমি মুর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। দেখতে দেখতে ওরা শাহেদকে আমার চোখের সামনে দিয়ে ধরে নিয়ে গেল।
নেহাত মানসিক প্রস্তুতি ছিল বলে, নিজেকে সামলে নিতে সময় লাগল না। ওরা চলে যাওয়ার পরে দ্রুত দরজা লাগালাম। ঝড়ের বেগে ভাবছি, কার কাছে সাহায্য চাওয়া যায়। পুলিশ, আর্মি, র‍্যাব? না উকিল, টুকিল? না পরিচিত বন্ধু বান্ধব? এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। তিথি করেছে। হঠাৎ? একসময় খুব কাছের মানুষ হলেও, এখন তো না। নেহাত দরকার ছাড়া কথা হয় না। এই সময়ে এমন একটা ফোন কার ধরতে ইচ্ছে করে? ধরার কোন ইচ্ছে না থাকলেও ধরলাম। গলার স্বর নরম করার চেষ্টা করতে করতে জানতে চাইলাম
— কি রে তিথি?
— কেমন আছিস?
অনেক কষ্টে বিরক্তি সামলে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললাম
— এই তো। তোর খবর?
— চলে যাচ্ছে। তোর?
— ঐ। চলে যাচ্ছে টাইপ।
— কি যে বলিস? বর এতো ভাল চাকরী করে…
আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বলে ফেললাম
— আমি একটু বেরোব রে, কোন কাজে ফোন করেছিলি?
তিথি কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল মনে হল। এরপরে কিছুটা ইতস্ততঃ করে বলল
— তোকে কি ডিস্টার্ব করছি?
হঠাৎ নিজেরই খারাপ লাগল। অযথাই হার্স হচ্ছি ওর উপর। কথা ঘোরালাম
— একদিন আয় না বাসায়।
— সেজন্যই ফোন করলাম।
— বেশ তো, কবে আসবি?
এবার তিথির গলা খানিকটা নীচু হল। আমতা আমতা টাইপ গলায় বলল
— আসলে তোকে একটা রিকোয়েষ্ট করার জন্য ফোন করলাম
— বল না, কি রিকোয়েষ্ট?
— আমাদের কলেজটা, মানে, আমার হাজব্যান্ড যে কলেজে আছে, ওটা… মানে সুমন ভাই বলে দিলেই হয়ে যাবে।
এবার সত্যিই হতভম্ব হয়ে গেলাম। প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম
— মানে?
গলায় বোধহয় কিছুটা ঝাঁঝ ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এবার তিথি কিছুটা নরম গলায় বলল
— আসলে শেলির সাথে সেদিন দেখা হয়েছিল, ও বলল… মানে তোর সাথে তো… আমার খুব খারাপ লাগছে কথাটা বলতে… আসলে সুমন ভাইয়ের কিন্তু এখন অনেক ক্ষমতা। উনি একটা ফোন করলেই সেক্রেটারিরা সাথে সাথে ফাইলে সই করে দেবে।
কিভাবে যে ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রাখলাম, বলতে পারব না। শুধু জানি ফোনটা ডিসকানেক্ট করেই দ্রুত হাতে শেলিকে ফোন করলাম। ফোন একবার বাজতেই ও ধরল
— কিরে, হঠাৎ?
ভনিতা না করে সরাসরি মূল কথায় আসলাম। বললাম
— আজকে ছুটি নিতে পারবি?
— কেন?
— তোর সাথে একটু আলাপ ছিল।
— ফোনে বলা যায় না?
এক মুহুর্ত ভাবলাম। এরপরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, বলেই ফেলি।
— আসলে সুমনের বাসার ঠিকানাটা লাগবে। আছে?
— ও এই ব্যাপার? তুই তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। তা, শাহেদ ভাই জানে? না লুকিয়ে লুকিয়ে…
ফাজলামির সময় নেই। ওকে শেষ করতে না দিয়ে বললাম
— জানে। ঠিকানাটা আছে?
— অস্থির হচ্ছিস কেন। আমার কাছে নেই, আমার জামাইকে জিজ্ঞেস করে তোকে ম্যাসেজ করছি।
ফোন রেখে দিলাম। কি করব? শেলিকে গিয়ে কি সব খুলে বলব? ওর বরকে দিয়ে রিকোয়েষ্ট করালে কোন লাভ হবে? শেলিই বা তিথিকে আমার কথা কেন বলল? সুমন কি শেলিকে তেমন কোন ইঙ্গিত দিয়েছে?
মাথা একদম কাজ করছে না। কি করা যায় ভাবছি আর পায়চারী করছি। ম্যাসেজ আসলে একটা আওয়াজ হবে জানি, তারপরও কেন যেন পায়চারীর ফাঁকে মাঝে মাঝে মোবাইলটা হাতে নিয়ে চেক করছি। আবার কি ফোন করব শেলিকে? এমন সময় মোবাইলটায় ম্যাসেজ আসবার আওয়াজ হল।
দ্রুত মোবাইলটা হাতে তুলে নিলাম। লক স্ক্রিনেই, ছোট্ট চৌকনা বক্সে ম্যাসেজটা লেখা আছে। না, শেলি না, ম্যাসেজটা পাঠিয়েছে সুমন। ধানমন্ডির একটা ফ্ল্যাটের ঠিকানা। আর নীচে ইংরেজীতে একটাই শব্দ লেখা, ‘নাও’।
কোন কিছু ভাববার মত অবস্থা আমার তখন ছিল না। মনে তখন একটাই শব্দ বাজছে, ‘ক্রসফায়ার’। যে করেই হোক ওটা আঁটকাতে হবে। এক মুহুর্ত দেরী না করে সেই পোশাকেই রওয়ানা দিলাম।
পৌঁছতে আধ ঘন্টা খানেক লাগল। লিফট নিচেই পেলাম। উঠে ফাইভ বাটন চাপলাম। ওটাই টপ ফ্লোর। লিফট একসময় ৫য়ে থামল। করিডোরে বেরিয়ে এলাম। হাতের ডানদিকে ‘সি’। ঘেমে গেছি। শাড়ির আঁচল টেনে মুখটা মুছে নিলাম। আমাকে কেমন যে লাগছে?
এগিয়ে গেলাম। কলিং বেলে চাপ দিলাম। কেউ খুলল না। অপেক্ষা করে আছি। কতটা সময় যে পার হল? মনে তো হচ্ছে অনন্ত সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না। আরেকবার বেল চাপতে ইচ্ছে করছে। করলাম না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কেউ খুলছে না দেখে ফ্ল্যাটের নম্বরটা আবার চেক করলাম। ঠিক আছে।
ও কি আছে? দেরী করে ফেললাম কি? অস্থির লাগছে। কানে তিথির কথাটা বাজছে, ‘সুমন ভাই একটা ফোন করে দিলে…’। আর পারলাম না। আবার বেল বাজাতে যাব এমন সময় দরজা খুলে গেল। সুমন নিজেই খুলল। ঠোঁটে সেই মিষ্টি স্মিত হাসি। বেশ ওয়েলকাম করার ভঙ্গিতে বলল
— এসো।

চলবে।