মাই এক্স পর্ব-০৮

0
190

মাই এক্স (৮ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি


ঘটনা এতো দ্রুত ঘটতে শুরু করবে, ভাবিনি। চাকরী নাই দেখে আজ সকালে একটু দেরী করেই ওঠা হয়েছে। ব্রেকফার্স্ট সেরে শাহেদ ব্যালকনিতে নিউজপেপার নিয়ে বসেছে। আমি বুয়াকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছি। প্ল্যান হচ্ছে, সব সেরে আমিও ব্যালকনিতে গিয়ে বসব। শাহেদের সাথে সবকিছু শেয়ার করা দরকার। গতকাল করিনি। আসলে এতোটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, যে ভালোমত কথাই বলতে পারছিলাম না। শাহেদ যখন আমাকে পানি এনে দিল, সেটা ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। এরপরে শাহেদের দিকে শূণ্য চোখে তাকিয়ে থাকলাম। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে শাহেদই বলল
— ঘরে চল।
আমিও ব্যাপারটায় সায় দিলাম। এরপরে আমাকে সাথে নিয়ে শাহেদ উঠে দাঁড়াল। ঘাড়ে হাত রেখে আমাকে সহ বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে আমাকে বিছানায় বসাল। নিজে স্টাডি টেবিলের চেয়ারটায় বসল। আমার হাতে হাত রেখে শুধু বলল
— পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, উই উইল ফাইট। ওকে?
ভয় ভয় চোখে শাহেদের দিকে তাকালাম। ও এক্সপেক্ট করে আছে, আমি সম্মতিসুচক মাথা নাড়ব। নাড়তে চেষ্টা করলামও। পারলাম না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। শাহেদ বুঝতে পারল, আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছি। সাথে এটাও হয়তো বুঝল, এমন কিছু ঘটেছে, যার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। শাহেদ আর কথা বাড়াল না। শুধু বলল
— আজ থাক। কাল সব শুনব।
আমি নিজেও শান্ত হতে চাইছিলাম। আমাকে অনেক কিছু হিসেব করতে হবে। পুরো কথা বললে, শাহেদ কি সিদ্ধান্ত নেবে আমি জানি। ও যখন দেখবে, বিপদ আমার না, ওর, তখন শাহেদ এক মুহুর্ত না ভেবে ঝুঁকিটা নেবে। সোজা বলবে
— এরপরে সুমনের সাথে কোন কথা বলার দরকার নেই। যা হওয়ার হবে।
তাই চাইছিলাম একটু ভেবে চিন্তে কথাগুলো বলব। বেশি জরুরী সুমনের সাইকোপ্যাথ চেহারাটা শাহেদকে বোঝানো। সুমন যে ভয়ানক ছক কেটেছে, সেটা ওকে বোঝাতে না পারলে, শাহেদ বুঝবে না সুমনের জালে আমরা কতটা আঁটকে গেছি।
এই প্রতিশোধের নেশায় সুমন কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পার, সে ব্যাপারটা শাহেদকে আগে বোঝানো দরকার। খুব ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সমস্যা আরও একটা আছে। সুমনের কথাগুলো যতটা সম্ভব ভদ্র ভাষায় আমাকে বলতে হবে, নইলে শাহেদ মাথা গরম করে ফেলবে।
রাতে ঘুম আসছিল না দেখে ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলাম। বেশ ঝরঝরে একটা ঘুম হয়েছে। সম্ভবত টেনশান রিলিভের প্রোপার্টিও ছিল ঔষধটায়। ফিল করলাম, সকালে ততোটা টেনশান লাগছে না। সেই একই ঘটনার কথা ভাবছি, কিন্তু গতকালকের মত ভয় পাচ্ছি না। ঔষধের ইফেক্ট, না সময়ের, জানিনা।
গতকাল যখন কফি হাউজে গিয়েছিলাম, সুমনের হাসি হাসি মুখ দেখেছিলাম, এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল, কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। হয়তো সুমন এসবের সাথে জড়িত না। এরপরে যখন সেই পুরনো দিনের মত স্বাভাবিক সুরে কথা বলতে শুরু করেছিল, তখন ভেবেছিলাম, যদি অভিমান করেও থাকে, ওকে বোঝাতে পারব।
বাট যখন কথাটা বলল, আমার তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না সুমন কথাগুলো বলছে। যখন জানতে চাইল, ‘স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে কি কি করতে রাজী আছ?’ এক মুহুর্তের জন্য মনে হল, আমি বোধহয় ভুল শুনছি। অবাক হয়ে খানিক্ষণ সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এরপরে রিফ্লেক্স অ্যাকশানেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল
— মানে?
স্মিত হেসে সুমন উত্তর দিলেও ওর চোখে প্রতিহিংসা জ্বলজ্বল করছিল। ঠান্ডা গলায় বলল
— মানে এই মুহুর্তে আমি যতটা পাওয়ার হোল্ড করি, তোমার স্বামীকে কোন আর্মস বা ড্রাগস কেসে ফাঁসিয়ে ক্রসফায়ারে দেয়া আমার জন্য কোন ব্যাপার না।
মেরুদন্ড বরাবর ঠান্ডা একটা স্রোতের অনুভুতি টের পেলাম। বুঝতে বাকী থাকল না, সুমনকে আমি কিছুই চিনতে পারিনি। এই সুমন আর আগের সুমন নেই। তখন সুমনের ভেতরে ছিল শুধু ষড়যন্ত্র করার মেধা, আর এখন তার সাথে যোগ হয়েছে ক্ষমতা। প্রতিশোধ নেয়ার স্টাইল একই আছে, শুধু বীভৎসতা বেড়েছে।
আমি ভেবেছিলাম, আমার সংসারে ভাঙ্গন কিংবা আমাকে শাহেদের চোখে ছোট করা ওর উদ্দেশ্য। আর তাই আমি অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, সুমন আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমার অতীত সম্পর্কে শাহেদের মন বুঝতে তাই অনেকটাই সাহসী হয়ে উঠেছিলাম।
ওর শেষ কথাগুলো শুনে বুঝতে বাকী থাকল না, ওর প্ল্যান তেমনটা না। ওর প্ল্যান, শাহেদকে জিম্মি করে আমার কাছ থেকে অন্য কিছু আদায় করা। সুমনের যে ছবি মনে ছিল, তাতে এমন প্ল্যান ও করবে, কল্পনাতেও আসেনি। তাই কথাটা যখন বলল তখন কিছুক্ষণের জন্য স্থির দৃষ্টিতে সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ধীরে ধীরে বললাম
— আর সেটা যেন তুমি না কর, তার জন্য আমাকে কি করতে হবে?
কথাগুলো ঠান্ডা স্বরে বললেও ফিল করলাম, আমার আত্মবিশ্বাস নড়ে যাচ্ছে। কতক্ষণ নিজেকে শক্ত রাখতে পারব জানি না। আপ্রাণ চেষ্টা করছি, চোখের পলক না ফেলে সোজাসুজি সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকতে। সুমনও কিছুক্ষণ আমাকে দেখল। এরপরে বেশ শান্তভাবেই বলল
— সেটাই তো জানতে চাইলাম, হোয়াট ইজ ইয়োর অফার?
ঠোঁটের কোণে বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত একটা হাসি। মনে হল সুমনের গালে কষে একটা চড় মেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাই। পারলাম না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, হি ইজ সিরিয়াস। শাহেদকে ফাঁসিয়ে দিতে ও এক মুহুর্ত হেজিটেট করবে না। যদিও মনে মনে সন্দেহ করে ফেলেছি, ও কি চাইছে, তারপরও ব্যাপারটা ক্লিয়ারলি জানতে চাইলাম। বললাম
— তোমার চাওয়াটা বুঝতে পারলে, আমার জন্য সুবিধা হত।
সুমন এতোক্ষণ আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আমার উত্তরটা শুনে কিছুক্ষণ ভাবল। কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে কফির মগটা পাশে রেখে দিল। সরাসরি আমার দিকে তাকাল। এবার অবশ্য সেই ক্রুর হাসি নেই। বেশ সাবলীলভাবেই বলল
— টাকা পয়সা যে চাই না, তা তো বুঝতেই পারছ।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কথাবার্তা আর আগাবো? স্পস্ট বুঝতে পারছি, কথা কোন দিকে নিতে চাইছে। নোংরা কথাটা আমার মুখ দিয়ে বলাতে চাইছে সুমন। মনে হচ্ছে আমি আর শক্ত থাকতে পারব না। নিজেকে যতটা সাহসী ভেবেছিলাম, আমি যে ততটা না, এটা বুঝে গেছি। স্থির করে ফেললাম, এনাফ ফর টুডে। এনিয়ে আর কথা বলব না। সুমনের দিকে সরাসরি তাকিয়ে, ওর চোখে চোখ রেখেই বললাম
— থ্যাঙ্কস ফর দ্যা ট্রিট। আই হ্যাভ টু লিভ।
সুমন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। হয়তো আমাকে বোঝার চেষ্টা করল। ওর অনুচ্চারিত প্রস্তাবে আমি ‘না’ বলছি, না ‘ভেবে দেখব’ বলছি। কি বুঝল, জানি না, তবে স্মিত একটা হাসি দিল। এরপরে বলল
— সিওর?
এক মুহুর্ত দেরী না করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। উত্তরে ‘সিওর’ বলার রুচিও আর তখন অবশিষ্ট নেই। আমি দরজার দিকে মুখ করে বসেছিলাম। সুমনের সামনে দিয়েই ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। সুমনও বোধহয় প্রস্তুত ছিল। দেখলাম এক ঝটকায় সে ও উঠে দাঁড়িয়েছে। এগোতে গিয়ে বুঝলাম দরজা পর্যন্ত সুমনও পাশে পাশে আসবে। গা ঘিনঘিন করছে, একবার ভাবলাম, মুখের ওপরই বলি, ‘লাগবে না, আমি একাই যেতে পারব।’ বললাম না। ওকে রাগিয়ে দেয়ার ঝুঁকি নিতে পারছি না। এই সাইকোপ্যাথ যে কোন কিছু করতে পারে।
দরজার কাছে পৌঁছে সুমন দরজাটা খুলে ধরল। ‘থ্যাঙ্কস’ দেয়া উচিৎ, অন্য পরিস্থিতি হলে হয়তো দিতামও, কিন্তু এখন কথা বলতেই ঘেন্না লাগছে। চুপ থাকলাম। বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। এখানে গাড়ী পার্ক করার জায়গা নেই। ড্রাইভার হয়তো আশে পাশে কোন গলিতে গাড়ীটা রেখেছে। ড্রাইভারকে ফোনটা করে আসতে বলে বের হওয়া উচিৎ ছিল। বাট পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে…
— হ্যাঁ, কফি হাউজের সামনে এস।
সুমনের আওয়াজ। ফোন করে কথাগুলো বলছে। বুঝতে বাকী থাকল না, ও ওর নিজের ড্রাইভারকে ডেকেছে। আমাকে ড্রপ করার জন্য? অসম্ভব। ওর সাথে আর এক মুহূর্ত না। এবার নিজের ওপর কন্ট্রোল হারালাম। বললাম
— আমি কিভাবে যাব, সে ব্যাপারে নাক না গলালেই খুশি হব।
আমার দিকে তাকাল সুমন। আমার চোখ দিয়ে তখন আগুন বেরোচ্ছে। আমার ক্রোধটা না বোঝার কথা না। দেখলাম মাথা ওপর নীচে করে ব্যাপারটায় সায় দিল। এরপরে ছোট্ট করে বলল
— আই নো। তোমার ড্রাইভারকেই ফোন করছিলাম।
এবার রীতিমত চমকে উঠলাম। তারমানে সুমন আমাদেরকে রীতিমত ঘিরে ফেলেছে।কোথায় যাই, কি করি, সব ওর নখদর্পনে? ড্রাইভার থেকে শুরু করে ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার, সবার সাথেই… মাই গড! অনুভব করলাম, পরিস্থিতি যতটা ভয়ানক ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি আসলে তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।

দ্রুত নিজেকে সংযত করলাম। ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা ডিল করতে হবে। রাগের মাথায় বলা একটা কথা ওর প্রতিশোধ স্পৃহা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে না করতে চাইলে, চুপ থাকাটাই বেটার হবে।
বাসায় ফিরেই শাহেদের সাথে দেশ ছাড়ার প্ল্যান শুরু করতে হবে। পরিচিত যারা এব্যাপারে হেল্প করতে পারে, দ্রুত তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সবকিছু তৈরী করতে যে কয়দিন লাগে, সেই ক’দিন যেভাবে হোক ওকে ভুলিয়ে রাখতে হবে।
নিমিষেই গাড়ীটা চলে এল। সম্ভবতঃ একেবারে পাশেরই কোন এক গলিতে ছিল। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পাশ ঘেঁষেই থামাল। আমি গাড়ীর দরজা খুলতে যাওয়ার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই সুমন দরজা খুলে দিল। এবার ‘থাঙ্কস’ দিলাম। সুমনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসিও দিলাম। এরপরে গাড়ীতে চড়ে বসলাম।
দরজা লাগাবার আগে শুধু একটা কথা বলল সুমন
— ফ্ল্যাটের ঠিকানা আর সময় আমি ম্যাসেজ করে দেব।

চলবে