মাই এক্স (১০ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি
১০
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মনে নাই। তিথির ফোনে ঘুম ভাঙ্গল। ফোনটা হাতে নিয়ে সময়টা দেখলাম। সকাল সাড়ে আট। অন্য যে কোন অফিস ডে হলে এই সময়ে আমি রীতিমত সংসারে ব্যস্ত হয়ে যেতাম। শাহেদের জন্য ব্রেকফার্স্ট তৈরি সেরে ফেলতাম আর শাহেদ ওর শাওয়ার সারত। একটা দিন, পুরো জীবন ওলট পালট করে দিল। মনে হচ্ছে, একটা দুঃস্বপ্ন চলছে, এক্ষুনি ঘুম ভাঙ্গবে।
রিং বেজে চলেছে। বোধহয় সেই কলেজের জন্য তদবীর করতে ফোন দিয়েছে। এই মেয়ে কি ইডিয়েট নাকি? মাথায় বুদ্ধি থাকলে তো সেদিনের পরই বোঝা উচিৎ যে…। ফোন ধরব না ঠিক করলাম। বাজুক। একসময় থামল। ঘুম ঘুম ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি। আবার কি ঘুমাবো? আবার ফোন করেছে। বাজুক। কতবার করবে?
ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। বিছানায় উঠে বসলাম। দুহাতে মাথা চেপে ধরে ভাবতে বসলাম।
গতকাল সুমনের ওখান থেকে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। রাতে সুমন রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। ওখানে ডিনার সেরে নিজেই বাসায় রেখে যায়। বাসায় ফিরে আর কিছু করা হয়নি। কাপড় পাল্টে একটু বিছানায় এলিয়েছিলাম। এরপরে আর কিছু মনে নেই। আসলে সারাটা দিন যে ঝড় গিয়েছিল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি?
আবার ফোন বেজে উঠল। তিথি। এ মেয়ে তো নাছোড়বান্দা। এবার ধরলাম।
— ঘুমাচ্ছিলি?
দাঁতে দাঁত চেপে কোনরকমে বললাম
— হ্যাঁ।
— সরি। তোকে ব্যাপারটা না জানানো পর্যন্ত আসলে শান্তি পাচ্ছিলাম না, জানিস।
কিছুটা অবাক হলাম। স্বগোতোক্তির মত বলে ফেললাম
— কি ব্যাপার?
— ঐ যে… যে জন্য তোকে ফোন করেছিলাম… ঐ যে আমাদের কলেজটা…
— সরি, সুমনকে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব না।
— সেটা আমি সেদিনই বুঝেছিলাম। তাই তোকে আর রিকোয়েস্ট করিনি।
— তাহলে আবার ফোন করেছিস কেন?
— মানে… তুই ‘না’ বলার পরে সাহস করে সুমন ভাইকে সরাসরিই ফোন করেছিলাম। কি বলব, একদম আগের মতই আছে, কর্ডিয়াল।
এরপরে বাকীটা বলল। সমস্যাটা শোনার পরে সুমন শুধু বলেছিল, ‘কিচ্ছু ভেব না, আমি দেখছি।’ সেদিনই কাজ হয়ে যায়। পরে পরিচিত একজনের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সুমনই নাকি সেক্রেটারীকে ফোন করে ফাইলটা ক্লিয়ার করিয়ে দেয়।
ফোনটা রেখে দিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে বসলাম। ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে যখন গিয়েছিলাম, তখন মাথায় দুটো চিন্তাই ছিল। ওর পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইব। আর তাতেও যদি দেখি মন গলছে না, তাহলে ও যা বলবে, মেনে নেব। শাহেদের জীবন বাঁচাতে আমি যে কোন কিছু করতে তখন প্রস্তুত। সুমন যখন বলল ‘এসো’ তখনও আমি অনিশ্চিত, ও কি চায়। ক্ষমা প্রার্থনা চায়? না, নোংরা কিছু?
ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকালাম। সুন্দর সাজানো ফ্ল্যাট। নিজের? না ভাড়া? আসবাবগুলোও বেশ দামী। সুমনের রুচি এমনিতেই বেশ ভাল, তার সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে অসীম ক্ষমতা। হয়তো কেউ ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে দিয়েছিল, যা খুশি কিনে নিয়েন।
— বসো।
সুমনের আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেলাম। সুমনের দিকে ফিরে তাকালাম। এরপরে লিভিং রুমের একটা সোফার দিকে এগিয়ে গেলাম।
— চা খাবে?
— কে করবে?
— বসো।
এরপরে সুমন ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল। সম্ভবতঃ পানি চড়িয়ে এল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— বাসা চিনতে অসুবিধা হয়নি তো?
কতটা কষ্টে যে নিজেকে সংযত রাখলাম, শুধু আমি নিজে জানি। বললাম
— না।
— আর কিছু নেবে?
সুমনের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে পুরনো বন্ধুর সাথে খুব স্বাভাবিক একটা আলাপচারিতা করছে। কিছুই যেন ঘটেনি। গলার আওয়াজ যতটা সম্ভব মোলায়েম রেখে ধীরে ধীরে একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করে বললাম
— কাজের কথায় আসি?
সুমন আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল। এরপরে বলল
— চা টা খেয়ে নাও, তারপরে শুনব।
অসহায় বোধ করলাম। একবার মনে হল, নিজে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আসি। কথাটা বলব ভাবছি এমন সময় সুমন নিজেই বলল
— আমি চা করি, তুমি বরং ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখ।
বলে আর থামল না। কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। মনে হল, আমাকে টেনশানটা ও এজনয় করছে। ভীষণ অসহায় লাগছিল। বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি করব। চুপচাপ মাথা নীচু করে সোফায় বসে থাকলাম। কতক্ষণ এমন ছিলাম, জানি না। সম্বিত ফিরে পেলাম সুমনের স্পর্শে। চোখ তুলে তাকালাম। কেমন ঝাপসা লাগছে সবকিছু। টের পেলাম, কাঁদছি।
পার্স থেকে রুমালটা বের করে চোখ মুছলাম। দেখলাম সুমন সামনে বসে।
— চিনি কি এখনও এক চামচ?
মুখে কথা আসল না। মাথা ওপর নীচে ঝুঁকিয়ে বোঝালাম, ‘হ্যা’। সুমন চিনি দিল। সময় নিয়ে চিনিটা গুলালো। কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিল
— দেখো, কেমন হয়েছে।
ততোক্ষণে বুঝে গেছি, তাড়াহুড়ো করে কোন লাভ নেই। আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যই ও ইচ্ছে করে সময় নিচ্ছে। আর কোন কথা তাই বললাম না। চায়ে চুমুক দিলাম। সুমনের দিকে তাকালাম। সুমন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যে একটু আগে কেঁদেছি, ও কি দেখেছে? ওর মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না, ওর মনে তেমন কোন করুণা জন্মেছে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন কিছুই হয়নি।
— বললে না?
— কি?
— কেমন হয়েছে?
উত্তরে কিছু বলতে পারলাম না। কিছুক্ষণ সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এরপরে কথাটা বলেই ফেললাম
— শাহেদ কি বেঁচে আছে?
উত্তরে সুমন কিছু বলল না। স্মিত হাসল শুধু। এরপরে বলল
— তুমি দেখতে আগের মতই আছ। বেশ ভালোই মেইন্টেইন করেছো।
এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে দুহাত জোর করে সুমনের মুখোমুখি হলাম। বললাম
— তুমি যা বলবে, আমি করব। শাহেদকে ছেড়ে দাও, প্লিজ।
সুমন কথাটা শুনল বলে মনে হল না। চায়ের কাপের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
— চা টা খেয়ে নাও। তারপরে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব।
বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে চায়ের কাপটা তুলে নিলাম। কাপে চুমুক দিলাম। ঠাণ্ডা আর গরমের মাঝামাঝি তবে যতটা গরম আছে, এক ঢোকেই খেতে পারব মনে হচ্ছে। পানির মত করে গিলে ফেললাম। কাপটা রেখে সুমনের দিকে তাকালাম। চোখে প্রশ্ন। আমার দিকে তাকিয়ে সুমন স্মিত হাসল। এরপরে জানতে চাইল
— ওকে। বল, কি জানতে চাও?
— শাহেদ? বেঁচে আছে?
সুমন স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। এরপরে বলল
— আছে।
কথাটা শুনে কোথা থেকে যেন একরাশ সাহস ফিরে পেলাম। সুমনের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জানতে চাইলাম
— আমাকে কি করতে হবে?
এবার আমি অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছি। শাহেদের জন্য, যা বলবে, করব। শুধু নিশ্চিত হতে হবে, ওর শর্ত মেনে নিলে শাহেদেকে ফিরিয়ে দেবে কি না।
— সিওর? যা বলব, করবে?
সুমনের চোখে চোখ রাখলাম। শীতল কন্ঠে বললাম
— আমার একটা শর্ত আছে।
সুমন কেমন শীতল একটা দৃষ্টি দিল। এরপরে বলল
— কোন শর্ত দেয়ার অবস্থায় কি তুমি আছ?
এক মুহুর্তের জন্য মনে হল, কে যেন পায়ের নিচ থেকে সবকিছু সরিয়ে নিল। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। কোন রকমে শুধু বললাম
— বেশ। বল কি করতে হবে?
সুমন কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপরে বলল
— ওকে দেন। লেটস স্টার্ট।
কথাটা শুনে যতটা কষ্ট পাব ভেবেছিলাম, ততোটা পেলাম না। শুধু চোখ তুলে সুমনের দিকে তাকালাম। চোখ দিয়ে ঘৃণা ছিটকে বেরোচ্ছিল। ব্যাপারটা সুমন লক্ষ্য করল কি না জানি না। সেটা নিয়ে ভাববার মত রুচিও আমার আর নেই। হিসহিস করে শুধু বললাম
— কোথায়? বেডরুমে?
সুমন আমার দিকে তাকাল। এরপরে হেসে বলল
— ওটা চাইলে তো তোমাকে উঠিয়েই আনতে পারতাম। খোকন যেমনটা করতে চেয়েছিল।
হতভম্ব হয়ে গেলাম। মেরুদন্ড বেয়ে বয়ে চলা শীতল স্রোতটা আবার ফিরে এল। ভয়ে মুখটা শুকিয়ে গেল। এতোক্ষণ তবুও একটা নিশ্চয়তা ছিল, প্রতিশোধে একটা প্যাটার্ন আশা করে ছিলাম। কি করতে হতে পারে, সে সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল, কিছুটা হলেও মনে মনে প্রস্তুতি ছিল। এক লহমায় সব সরে গেল। সুমন অন্য খেলা খেলছে। অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলাম
— তাহলে?
সুমন এবার গভীরভাবে আমার দিকে তাকাল। তিন বছর আগের সেই প্রেমিক দৃষ্টি। ক্যান্টিনের কেবিনে হাতে হাত নিয়ে প্রপোজ করার সময় যে দৃষ্টি ছিল, সেই দৃষ্টি। এবার শুধু ‘আই লাভ ইউ’ বলার বদলে বলল
— লেট’স রিওয়াইন্ড আওয়ার লাইফ। দেড় বছর আগে যেখানে ছেড়ে এসেছিলাম, সেখান থেকে চল আবার শুরু করি।
— আই লাভ শাহেদ। ওকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব না।
সুমনের চোখে আবার সেই শীতলতা ফিরে এল। শুধু বলল
— দেড় বছর আগে, জেলে, এই একই কথা তুমি আমাকে বলেছিলে। স্টিল ইউ কুড। আমাকে ভুলতেও পেরেছিলে, আরেকজনকে ভালোও বাসতে পেরেছিলে। আই গেস এবারও পারবে। সো…
কথাটা শেষ না করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। চোখে প্রেম? না প্রতিহিংসা? ভালো বুঝতে পারছি না। কিছুটা পজ দিয়ে, সোফায় হেলান দিয়ে, বাকী কথাটা বলল
— লেট’স স্টার্ট।
চলবে