মাই এক্স পর্ব-১২

0
162

মাই এক্স (১২তম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি

১২
রেস্টুরেন্টটায় আগেও এসেছি। স্টুডেন্ট লাইফে। নাম ঝন্টু রেস্তোরা। এটা শহর থেকে একটু দুরে। আগে দোতলা ছিল না। ছোট্ট মত একটা ছাপড়া ঘর ছিল। খুব বিজি ছিল না। সুমনই বোধহয় একমাত্র রেগুলার কাষ্টমার ছিল। পলিটিকস করত দেখে, শহর থেকে এতো দুরে আসত। কেউ যেন দেখে না ফেলে। তখন একটা কেবিন ছিল। নীচতলাতেই। আসবার আগে সুমন জানিয়ে দিত।
দেখতে দেখতে শহর বেড়ে গেল। রাস্তাও চওড়া হল। এখন তো গাড়ী নিয়েই এখানে আসা যায়। আসলে এখানেই আসার প্ল্যান ছিল কি না বলতে পারব না। যখন বেরোই তখন প্ল্যান ছিল লং ড্রাইভের। সুমনের গাড়ীতে আমরা বেরোলাম। ও ড্রাইভ করছিল। শহর থেকে একটু দুরে এসে গাড়ী যখন একটা ফাঁকা জায়গায় পার্ক করল, তখনও বুঝিনি ওর প্ল্যান কি। এরপরে দেখলাম একটা রিক্সা ভাড়া করল। আগের মত সেই ঘন্টা চুক্তি। একঘন্টা ঘুরব।
অনেস্টলি স্পীকিং, বেশ ভাল লাগছিল। কেমন যেন সেই পুরনো দিনের ফিল আসছিল। শাহেদের ব্যাপারটা না ঘটলে, আই রিয়েলি ডোন্ট নো, হয়তো ব্যাপারটা এঞ্জয়ও করতাম। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম। গল্প করলাম। প্রায় আধ ঘন্টা ঘোরার পরে চোখের সামনে রেস্টুরেন্টটা পড়ল। সুমন আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাইল, ‘চিনতে পারছো?’ প্রথমে আমি চিনতে পারিনি। অবাক হয়ে রেস্টুরেন্টটা দেখছিলাম। তখন সুমনই বলল, ‘আগে যেখানে আসতাম’। এবার নজরে পড়ল নামটা, ‘ঝন্টু রেস্তোরা।’
আবার তাকালাম। আগে থেকে বলে না দিলে কারোরই চেনার কথা না। চেহারা আমুল পাল্টে গেছে। ছাপড়া ঘর আর নেই। এখন দোতলা করেছে। বোধহয় ব্যাবসাও বেড়েছে।
ভেতরে ঢুকে মনে হল নীচতলাটা রেখেছে সাধারণ কাস্টমারদের জন্য। তাহলে দোতলাটা? ভিআইপি আর কাপল কাষ্টমারদের জন্য? মনে হয়। কারণ নীচে দেখলাম কোন কেবিন রাখেনি। দোতলায় উঠেই দেখলাম কাপলদের জন্য যেসব ছোট ছোট কেবিনগুলো হয়, সেসব দোতলায়। আর সেসবের ভেতরে একটা ছাড়া বাকীগুলোর পর্দা নামানো, মানে বুকড।
সুমন সম্ভবতঃ আগে থেকেই বলে রেখেছিল। একটা কেবিন আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। ওয়েটার আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল। আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে পর্দা নামিয়ে দিল। আগে যখন এভাবে আসতাম, তখন সারা মন জুড়ে থাকত একটা উত্তেজনা। হার্টবিট বেড়ে যেত। এই একাকীত্বের সুযোগ সুমন কখনও নিত, কখনও নিত না। ভালোই লাগত। কখনও আপত্তি করতাম না।
— আগের মতই, স্যুপ অর্ডার করেছি।
সুমনের গলার আওয়াজে, ওর দিকে তাকালাম। স্মিত হাসি দিয়ে বোঝালাম, ‘তোমার যা ইচ্ছা’। এরপরে সামনে রাখা লবনের পটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। যদিও সব গুছিয়ে রেখেছি। কি বলব, তা মনে মনে বার কয়েক রিহার্সালও করে রেখেছি। এখন শুধু ঠিক করতে হবে, কখন বলব।
কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। শেলির কথা কি বিশ্বাস করব? যদি ওকে এখনও না মেরে থাকে? সুমনের দিকে ইচ্ছে করেই তাকাচ্ছি না। আসলে পারছি না। মনে হচ্ছে তাকালেই বুঝে যাবে আমার মন এখানে নেই। আর তা হলেই… কে জানে কি করবে? ঘুরে ফিরে কেবলই শাহেদের কথা মনে পড়ছে।

সেদিন শেলির কাছ থেকে দুপুর বারোটা নাগাদ ফিরে আসি। ভয়ে হাত পা গুটিয়ে আসছিল। যদিও শেলি বলেছিল, এটা ওর ধারণা, কিন্তু বলার মধ্যে একটা দৃঢ়তা ছিল। খুব নিশ্চিত না হলে, এমনভাবে কেউ বলে না। যুক্তি দিয়ে ভাবলে আমারও মনে হচ্ছে, ওর ধারণা ঠিক। সুমন জানে, শাহেদ বেঁচে থাকলে, আমার পক্ষে অন্য কাউকে মেনে নেয়া সম্ভব না। আর তাই…
কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল, কোন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। এখুনি ঘুম ভাঙ্গবে, আর তখন দেখব সব আগের মতই চলছে। আসলে, সবকিছু বোঝার পরও, মেনে নিতে পারছিলাম না, শাহেদ নেই। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলাম। একবার মনে হয়েছিল, সুমনকে ফোন করে জানিয়ে দিই, আমি যাব না। সুমনের শর্তগুলো এই আশাতেই তো মানছিলাম, যেন ও শাহেদকে জীবিত রাখে। সে ই যখন নেই…
পরে সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। ছোট্ট হলেও একটা আশা আছে। কনফার্ম নিউজ এটা না। এটা অনুমান। একটা সম্ভাবনা। নিশ্চিত করে বলতে পারে কেবল সুমন। আর হয়তো শেলির বর, যদি ও আদৌ বলতে চায়। তাই যত কষ্টই হোক না কেন, সুমন যতক্ষণ না জানাচ্ছে, ততক্ষণ সুমনের সাথে কোন কনফ্রন্টেশানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আসবার সময় শেলিকে রিকোয়েস্টটা করলাম। শাহেদ বেঁচে আছে কি না, ওর বরকে দিয়ে যদি সম্ভব হয়, খোঁজটা যেন নেয়।
— কি ভাবছো?
সুমনের কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। ও আরও কিছু বলছিল কি না জানি না। সুমনের দিকে তাকালাম না। লবণের পটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম, সেটাই করতে থাকলাম। মন গুমড়াচ্ছে। কথা বলতে সাহস পাচ্ছি না। ঠিক ভয়ে না, মনে হচ্ছে কখন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাব। রাগের মাথায় কিছু একটা বলে ফেলব। নিজেকে সংযত করে, কথাগুলো মনে মনে একবার আউড়ে নিলাম। এরপরে বললাম
— এভাবে কতদিন?
সুমনের দিকে না তাকালেও বুঝতে পারছি, ও ভ্রু কুঁচকেছে। ঘুরতে আসার প্রস্তাবটা গতকালই ও দেয়। আমি বেশ সাবলীলভাবেই অফারটা মেনে নিই। আর আজই এই প্রশ্ন। ওর অবাক হওয়ারই কথা। অবাক হলেও আচরণে সেটা সুমন প্রকাশ করবে না, আমি জানি। বরং শান্তভাবে এমন একটা কিছু বলবে, যার পেছনে লুকিয়ে থাকবে, মৃদু হুমকি।
মাথা নীচু করেই থাকলাম। অপেক্ষা করে আছি, কথাটা শোনার জন্য। এমন সময় ওয়েটার স্যুপ নিয়ে এল। সুমন কিছু না বলে অপেক্ষা করে থাকল, ওয়েটার চলে যাওয়া পর্যন্ত।এরপরে বলল
— শেলি কি বলল?
এবার ঝট করে চোখ তুললাম। এতোটা আশা করিনি। আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগানোর ব্যাপারটা যদিও সন্দেহ করেছিলাম, বাট এটা যে ও এভাবে, সরাসরি স্বীকার করবে, সেটা ভাবিনি। সুমনের দিকে তাকিয়ে মনে হল না যে ও ব্যাপারটার জন্য আদৌ অ্যাশেমড। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। সোজাসুজিই বলে ফেললাম
— তোমার লজ্জা করে না, এভাবে একটা মেয়ের পেছনে গোয়েন্দা লাগাতে?
সুমনের আচরণে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না। শান্তভাবেই উত্তর দিল
— না।
কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। এই লোক কি অপমানও বোঝে না? রাগে ক্ষোভে তখন আমি রীতিমত কাঁপছি। কোন রকমে শুধু বললাম
— তোমার কি ধারণা, এভাবে একটা মেয়েকে ট্র্যাপে ফেলে প্রেম করবে?
সুমন আমার দিকে সরাসরি তাকাল। এরপরে স্যুপে চুমুক দিল। ইশারায় আমাকেও স্যুপ খেতে বলল। চোখের চাহনি আবার শীতল হয়ে গেছে। দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল। কেমন ভয় পেয়ে গেলাম। গলার স্বর মোলায়েম করে বললাম
— এভাবে হয় না সুমন।
সুমন ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকাল। এরপরে বলল
— স্যুপটা ভাল বানিয়েছে। খেয়ে দেখো।
বুঝলাম, সুমন ওর জেদ থেকে নড়বে না। অনেকবার রিহার্সেল করা কথাটা বলার পরিস্থিতি আর থাকল না। ভেবে রেখেছিলাম, ওকে বুঝিয়ে বলব, বিয়ের আগের আর পরের জীবন এক না। প্রেমিকা আর স্ত্রী সম্পুর্ণ আলাদা দুটি সত্ত্বা। এসবের কিছুই বলা হল না। নিজের অজান্তেই সম্পুর্ণ অন্য একটা কথা বলে ফেললাম
— আই হেইট ইউ।
কথাটা বলে নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম সুমন রিয়াক্ট করবে। করল না। শান্তভাবে স্যুপে চুমুক দিল। আমার দিকে তাকাল। তবে এবার সেই শীতল দৃষ্টি নেই। অনেকটাই স্বাভাবিক। বলল
— সুন্দর সন্ধ্যাটা নষ্ট করছ কেন?
এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম। বললাম
— তুমি বুঝতে পারছো, আমি কি অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি?
সুমন স্মিত হাসি দিল। বলল
— বেশ, বল, কি জানতে চাও?
প্রশ্নটা এবার সরাসরিই করলাম
— হাও ইজ শাহেদ?
সুমন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সেভাবে তাকিয়েই উত্তর দিল
— হি ইজ ডেড।
কথাটার জন্য প্রস্তুত থাকলেও, ধাক্কাটা কম লাগল না। কথাটা সোজা বুকে আঘাত করল। এবার আর কোন সন্দেহ থাকল না। শেষ ভরসার জায়গাটাও হারালাম। শুধু জিজ্ঞেস করতে পারলাম
— কেন?
সুমন স্যুপ খাচ্ছিল। হঠাৎ থেমে গিয়ে আমার দিকে শান্ত চোখে তাকাল। এরপরে বলল
— হি হ্যাড টু পে দ্যা প্রাইস।
এ কোন মানুষকে ভালবেসেছিলাম আমি? এমন ঠান্ডা মাথার খুনীকে আমি চিনতে পারিনি কেন? মনে হচ্ছিল আমি তলিয়ে যাচ্ছি। কথা বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। অবাক হয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দু’চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। সুমনের দেখলাম কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। স্যুপে চুমুক দিল। এরপরে ন্যাপকিন দিয়ে ঠোঁটা মুছল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— সিক্স মান্থ।
কথাটার মানে বুঝতে পারলাম না। শুধু বুঝতে পারলাম, ও যা করেছে তা নিয়ে ও আদৌ অনুতপ্ত না। মনে হল এক রক্তচোষা পিশাচের সাথে কথা বলছি। যার মনে কোন দয়া নেই, কোন মায়া নেই। আছে শুধু একরাশ প্রতিহিংসা। আমার কষ্টর কোন মুল্য নেই ওর কাছে। ওর চাই শুধু জয়। আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার ভেতরেই সুমন ওর বিজয় দেখতে পাচ্ছে। আর কোন কথা বলার বা শোনার অবস্থা আমার ছিল না। কোন রকমে শুধু বললাম
— আমি এখন যাব।
কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালাম। সুমন বসেই থাকল। শীতল একটা চাহনি দিয়ে শুধু বলল
— প্ল্যান চেঞ্জ করলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমি তোমার সাথে প্রেমের চেষ্টা করব। বাট নাও, আই চেঞ্জড মাই ডিসিশান।
কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, তারপরও জিজ্ঞেস করে ফেললাম
— অ্যান্ড হোয়াট ইজ দ্যাট ডিসিশান?
— ছয় মাস। তোমাকে ছয়মাস সময় দেয়া হল। এর মধ্যেই তোমাকে আমার প্রেমে পড়তে হবে।
নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই লোক কি সম্পুর্ণ পাগল হয়ে গেছে? ওর সাথে তর্ক করার কোন ইচ্ছে আর অবশিষ্ট ছিল না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, যা হওয়ার হবে। কি আর করবে? মেরেই তো ফেলবে? আর নয়তো… করুক যা খুশি। আমি আর ভয় পাব না। নিজের অজান্তেই তাই জানতে চাইলাম
— অ্যান্ড ইউ এক্সপেক্ট মি টু ডু দ্যাট?
সুমনের চেহারায় কোন বিকার দেখলাম না। আমার চোখ থেকে যে ঘৃণা ঠিকরে বেরোচ্ছে, তার কিছুই যেন ওকে স্পর্শ করছে না। বুঝতে পারছি, ক্ষমতার দম্ভে ওর ভেতর মনুষত্ব বলে আর কিছু বাকী নেই। নিজেকে শান্ত করলাম। এরপরে জানতে চাইলাম
— আর না পড়লে?
সুমন এবার উঠে দাঁড়াল। ধীরে সুস্থে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করল। এরপরে লবণের পটটার নিচে টাকাটা রাখল। আমার দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে বলল
— দেন, সেকেন্ড রাউন্ড অফ রিভেঞ্জ উইল স্টার্ট।
আমি নিস্পলক তাকিয়ে থাকলাম সুমনের দিকে। সুমন মানিব্যাগটা পেছনের পকেটে ঢোকাল। এরপরে
বলল
— আই হ্যাভ টু এক্সিকিউট মাই প্ল্যান বি।

চলবে।